- হরিদাসের গুপ্তকথা
- প্রথম পরিচ্ছেদ : কিসের মন্ত্রণা?
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : এরা কে?
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল!
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ : আজব চিঠি!
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাবু দেবীপ্রসাদ।
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : ভয়ানক ব্যাপার!
- সপ্তম পরিচ্ছেদ : বিষম সন্দেহ।
- অষ্টম পরিচ্ছেদ : আলেকসাই ফকির।
- নবম পরিচ্ছেদ : পীরের দরগা।
- দশম পরিচ্ছেদ : মোহিত বাবু।
- একাদশ পরিচ্ছেদ : ভূঁড়ো-কর্ত্তা।
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : গুণের খানসামা।
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মাষ্টার মহাশয়।
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : গোমিস্ সাহেব।
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : আখড়া।
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ : গ্রেপ্তার।
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : দারোগা সাহেব।
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : হাজত বা হাবুজখানা।
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল।
- বিংশ পরিচ্ছেদ : হাজতে দ্বিতীয় রাত্রিবাস।
- একবিংশ পরিচ্ছেদ : আমার বিচার।
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ : বিচারালয়।
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ : এ কথা কি সত্য?
- চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ : ব্রহ্মচারী মহাশয়।
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ : গুপ্তকথা।
- ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ : পাপের পরিণাম।
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ : নবাব বাহাদুর।
- অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ : নীলমণি বসাক।
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ : উদ্যোগপৰ্ব্ব।
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ : আশা মিটিল।
- একত্রিংশ পরিচ্ছেদ : দীক্ষা।
- দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ : লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু।
- উপসংহার
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
কূপে-কমল।
আমি ভিতরে গিয়া দেখিলাম যে, হাবুজখানার চারিদিক উচ্চ প্রাচীরে বেষ্টিত, সম্মুখে খুব প্রশস্ত প্রাঙ্গণ, কেবল উত্তর দিকে ধনুকাকারে পায়রা কুটুরির মত সারবন্দি ঘর আছে। প্রত্যেক ঘর লোহার গরাদেযুক্ত দরজায় আবদ্ধ, এই সকল ঘরে কয়েদিরা বাস করিয়া থাকে, দরজার উপরে ১, ২ করিয়া নম্বয় লেখা আছে।
উঠানের ঠিক মধ্যস্থলে গোসলখানায় আমাকে নিয়ে গেল; এবং বাবুর আদেশমত দেবীসিং তাহার বাসা হইতে গামছা কাপড় ও মাখিবার জন্য ফুলাল তৈল আনিয়া দিল। আমি ব্যাপার দেখিয়া নিতান্ত বিস্মিত হইলাম, দুপুর বেলায় কোতয়ালিতে দুটী চিড়েমুড়কি জল খাইতে দিল, আর বৈকালে কি না ফুলাল তৈল মাখিতে পাইলাম। সেখানে বরকন্দাজেরা গালাগালি না দিয়া প্রায় কথা কহে নাই, আমিও ভয়ে কুণ্ঠিত ছিলাম; কিন্তু এখানে আসিয়া সেই বরকন্দাজ স্থানীয় ব্যক্তি আমাকে যেন সম্ভ্রমের চক্ষে দেখছেন, সম্মানের সহিত কথা কইছেন, কাজেই আমার সাহস বেড়ে গেল, বরকন্দাজদের ন্যায় দেবীসিংহকে তেমন সভয়ে দেখতে হইল না। আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, এই হাবুজখানার অধ্যক্ষ ভদ্রলোকটীর কৃপায় আমার এ প্রকার আদর অপ্যায়ণ হইতেছে।
আমি দেবীসিংকে জিজ্ঞাসা ক’রে জ্ঞাত হ’লাম যে, বাবুর নাম লছমীপ্রসাদ ওঝা, সারস্বত শ্রেণীর ব্রাহ্মণ, প্রায় এক বৎসর হইল বাবু এই হাবুজখানার দারোগা হ’য়েছেন, পূর্ব্বে একজন মুসলমান এই পদে বাহাল ছিলেন। দেবীসিং সরকারি হাবুজখানার একজন সেপাহী; কিন্তু বাবুর বিশ্বাসী ও প্রিয়পাত্র, তার উপর বাবুর বাসার মহারাজ, সুতরাং আর আর সেপাহীদের উপর সর্দ্দারি চালাইয়া অধিকাংশ সময় সরকারি কাজের আঞ্জাম দিয়ে থাকে। বাবুর বাসায় তাহার পরিবারাদি কেহই নাই, কাজেই এই দেবীসিং সৰ্ব্বতোভাবে তাহার অন্দরমহলে কর্ত্তৃত্ব ক’রে থাকে।
আমি স্নানাদি করিয়া কাপড় ছাড়িলাম, দেবীসিং আমাকে সঙ্গে করিয়া নয় নম্বর ঘর দেখাইয়া দিল। দেখিলাম অন্যান্য ঘরের ন্যায় সে ঘরটা বাহিরদিক দিয়ে চাবী বন্ধ নাই, লৌহকপাট কেবলমাত্র ভেজানো আছে। আমি আস্তে আস্তে সেই দরজা ঠেলিয়া কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করিলাম। দেবীসিং অন্যত্রে গমন করিল, অতিরিক্ত সাবধানের জন্য আর বাহির হ’তে দরজা বন্ধ করিল না, পূর্ব্বের ন্যায় খোলা রহিল।
আমি ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম যে, ঘরটি ক্ষুদ্র; কিন্তু লম্বা চৌড়ায় প্রায় সমান। জানালার নামমাত্র নাই, কেবল উত্তরদিকে খুব উঁচুতে তার দিয়ে ঘেরা একটা খুলি আছে, মেজের উপর দু-হাত ক’রে চওড়া পাশাপাশি চারটা মাটীর ঢিপি শোভা পাচ্ছে ও একদিকে একখানা ক’রে ইট গাঁথা আছে, আমি দেখিবামাত্র বুঝিতে পারিলাম যে, ইহাই অভাগা বন্দীদের সুখশয্যা ও মস্তক রাখিবার সুকোমল উপাদান।
এই চারিটী ঢিপির তিনটা শূন্য পড়িয়া আছে, কেবল একটীতে কম্বল পাতিয়া গেরুয়াবশনধারী উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের একটা ব্রাহ্মণ নয়নদ্বয় মুদ্রিত ক’রে যোগাসনে বসিয়া আছেন।
এই ব্রাহ্মণকে দেখিবামাত্র আমার অন্তর যেন ভক্তিরসে উচ্ছ্বলিল তাঁরা উঠিল; মনে কেমন এক প্রকার অভূতপূর্ব্ব আনন্দের উদয় হ’লো, কাজেই আমি মনের আবেগ বশতঃ তাহার পদতলে প্ৰণত হ’লাম এবং পদধূলি গ্রহণ করিলাম।
ব্রাহ্মণ চক্ষুরুন্মীল করিলেন এবং আমার দিকে চাহিয়া ঈষৎহাস্যে আমাকে বসিতে বলিলেন।
আমি তাহার আজ্ঞামত পাশের শূন্য ঢিপির উপর উপবেশন করিলাম ও একদৃষ্টে তেজপুঞ্জ কলেবর এই সদানন্দ ব্রাহ্মণকে দেখিতে লাগিলাম।
সংসারে বীতস্পৃহ পরমার্থ পথের পথিক মহাত্মাদের বয়স ঠিক করবার ক্ষমতা কাহার নাই। কিন্তু অনুমানে বোধ হয় যে, প্রায় ষাট বৎসর তাঁহার মাথার উপর দিয়া বহিয়া গিয়াছে; কিন্তু দেহের মাসে বিন্দুমাত্র লোল হয় নাই, মস্তকের একগাছি কেশও শ্বেতবর্ণ ধারণ করে নাই। মুক্তা নিন্দিত শুভ্রদন্তগুলি পূর্ণ অবস্থায় বর্ত্তমান আছে, তারা এখন পর্য্যন্ত একটাও সঙ্গী হারায় নাই। ফলকথা, সংসারে সুখের নিদান স্বরূপ স্বাস্থ্যের লক্ষণ সকল পূর্ণ অবস্থায় তাঁহার শ্রীঅঙ্গে বৰ্ত্তমান আছে।
ব্রাহ্মণের শ্রীঅঙ্গের বর্ণ ঈষৎ মলিন সত্য, কিন্তু সেই শ্যামবর্ণের উপর কেমন একটু চাকচিক্য বর্ত্তমান আছে এবং এক প্রকার স্বর্গীয় প্রভা যেন তাহার শ্রীঅঙ্গ হ’তে বহির্গত হ’চ্ছে।
এই ভয়াবহ স্থানে আসিলে নিতান্ত নির্ভীক লোকের অন্তরে ত্রাসের সঞ্চার হ’য়ে থাকে। রবিতাপে ম্রিয়মান কিশলয়সম দারুণ ভয়ে মুখখানি শুকাইয়া যায়, নিতান্ত উৎকণ্ঠিতভাবে অবস্থান করিতে হয়; কিন্তু এই ব্রাহ্মণের তাহার বিপরীতভাব পরিদৃশ্যমান হইল।
আমি দেখিলাম এই মহাত্মার বদনমণ্ডল প্রসন্ন ও শারদীয় পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় বিমল, ললাটদেশ চিন্তারেখা-পরিশূন্য এবং তেজগৰ্ব্বিত, নয়নদ্বয় যুবাদের ন্যায় উৎসাহব্যঞ্জক ও সমুজ্জ্বল। ফলকথা, এই সদানন্দ ব্রাহ্মণের ঈদৃশ প্রশান্ত ভাব ও সহাস্য বদন দেখলে বোধ হয় না যে, তাঁহার কোনরূপ বিপদ উপস্থিত হ’য়েছে; ঠিক যেন নিজের বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সদালাপ ক’চ্ছেন; কোন প্রকার যে দুর্ঘটনা উপস্থিত হ’য়েছে, তাহা তাঁহার বাহ্যিক ভাব দেখে আদৌ বুঝিবার উপায় নাই।
যেমন ভাবে সোণা ও পিতলের প্রভেদ বুঝিতে পারা যায়, তেমনি বিপদে ঈদৃশ অসীম ধৈর্য্য ও অসামান্য সহিষ্ণুতা দেখিয়া এই ব্রাহ্মণকে কোন মহাপুরুষ ব’লে আমার স্থির বিশ্বাস হ’লো। মনে করিলাম যখন ঈদৃশ মহাত্মা নিরপরাধ হইয়াও বিচারের জন্য এই হাবুজখানায় আবদ্ধ আছেন, তখন আমার ভাগ্যে যে এরূপ বিপদ ঘটিবে তার আর বিচিত্র কি।
সেই সদানন্দ ব্রাহ্মণ আমার আপাদমস্তক একবার নিরীক্ষণ ক’রে হাসি মুখে কহিলেন, “বাপু! এই কিশোর বয়সে তুমি এমন কি অপরাধ ক’রেছ যে, তাহার জন্য এই পাপ পুরীতে তোমাকে আসিতে হইয়াছে?”
আমি করযোড়ে কহিলাম, “প্রভো! আমি নিজে কোন অপরাধ করি নাই, তথাপি আমি গ্রেপ্তার হইলাম; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে অপরাধ ক’রেছ, তাহার কেহ নামোল্লেখ পর্য্যন্ত করিল না।”
ব্রাহ্মণ হো হো ক’রে হেসে উঠে ব’ল্লেন, “সংসারে এরূপ কাণ্ড অনেক ঘটে, তুমি ছেলেমানুষ ব’লে এর নিগূঢ় ভাব এখনো বুঝতে পার নাই। দেখছি তুমি বড় ভাগ্যবান ছেলে, কারণ তোমার স্পর্দ্ধা বেশী না বাড়িয়ে ঈশ্বর এই বয়সেই তোমাকে তুফানে ফেলেছেন; তোমার উপর তাঁর লক্ষ্য প’ড়েছে, এই সময় বাপু, কুতর্ক জালকে তাড়িয়ে মনকে নিৰ্ম্মল রাখিতে চেষ্টা কর; হৃদয়ের ধৈর্য্য, প্রাণের সহিষ্ণুতা, মনের একাগ্রতা দেখাও, এক মনে বিশ্বাসের হাল ধ’রে থাক, তাহ’লে সব তুফান কাটিয়ে তিনিই পার ক’রে দিবেন। মাটীর উপর প’ড়ে গেলে যেমন সেই মাটী ধ’রেই উঠতে হয়, বাপ মা প্রহার ক’ল্লে বালক যেমন “বাবাগো মাগো” ব’লে কাঁদে, তেমনি অকপট হৃদয়ে সেই অভয় পাদপদ্মে শরণ নিলে তাঁর দত্ত বিপদ-জাল অচিরকাল মধ্যে লয় হ’য়ে যাবে। তুমি যে কোন অপরাধ না করিয়াও গ্রেপ্তার হ’য়েছ, আর প্রকৃত দোষী ব্যক্তিরা সানন্দে দিনপাত ক’চ্ছে, তারও নিগূঢ় কারণ আছে। এ সংসারে কোন উদ্দেশ্য ব্যতীত একটি পত্রও বৃক্ষচ্যুত হয় না, তবে ক্ষীণপ্রাণ মানবের ততটা দূরদৰ্শন নাই ব’লে আপাততঃ তাহা বুঝতে পারে না। দারুণ শীতের পর যেমন মধুর বসন্ত আইসে, পূর্ণিমার অবসানে যেমন অমাবস্যা দেখা দেয়, তেমনি মানবমাত্রেই বিপদ সম্পদ সুখ দুঃখ আনন্দ নিরানন্দ পর্য্যায়ক্রমে উপভোগ ক’রে থাকে। তবে যেমন স্বর্ণকার অন্যান্য ধাতু অপেক্ষা স্বর্ণকে উজ্জ্বল করবার অভিপ্রায়ে পুনঃ পুনঃ দগ্ধ ক’রে থাকে, তেমনি সেই অগতির গতি শ্রীপতি ধৰ্ম্ম বলে বলীয়ান করবার জন্য অন্যের অপেক্ষা নিজ জনদের অধিক পরিমাণে পেষিত ক’রে থাকেন। হৃদয়বল প্রভাবে সেই মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হ’তে সক্ষম হ’লে, তবে মানব অনন্ত-সুখ-ভোগের অধিকারী হয়। যাই হোক্ তুমি কে, আর কি সূত্রে এখানে এলে, আমার নিকট সত্য ক’রে বল?”
আমি অতীব বিনীতভাবে, আগাগোড়া সমস্ত সত্যকথা, এই দেবপ্রতিম ব্রাহ্মণের কাছে অকপটে প্রকাশ করিয়া বলিলাম। ব্রাহ্মণ মনযোগের সহিত আমার কথাগুলি শুনিয়া গম্ভীরভাবে কহিলেন, “আচ্ছা, ছেলেবেলা হ’তে তুমি যাদের কাছে ছিলে, সেই কিষণজি বাবু ও তাহার সহধর্ম্মিণী যে তোমার বাপ মা নয়, তা তুমি কি ক’রে বুঝলে?”
আমি কহিলাম, “প্রভো, পূৰ্ব্ব হ’তেই তারা আমাকে তাদের কোন উচ্ছিষ্ট খাদ্য কখন আমাকে দিত না। ব্রাহ্মণে রান্না করিত, আমি তাই আহার করিতাম, তবে তাতে আমার মনে তেমন কোন সন্দেহ হয় নাই, তারপর একদিন রাত্রে ঘটনাক্রমে কর্ত্তা গিন্নির কথা শুনে আমি যে তাহাদের কেহ নই এই ধারণাই আমার হৃদয়ে বদ্ধমূল হ’য়েছে।”
ব্রাহ্মণ। তুমি কি কোন কথা শুনেছিলে?
আমার প্রতিপালকদের সেই ভয়ানক কেলেঙ্কারীর কথা জগতে প্রকাশ করা আমার আদৌ অভিপ্রেত ছিল না, আমি এতাবৎকাল সেই কুৎসা কাহারও কর্ণগোচর করি নাই, বরং সকলের নিকট গোপন করিয়াছিলাম, কিন্তু এক্ষণে এই তেজস্বী ব্রাহ্মণের সহিত সেরূপ ব্যবহার করিতে আমার ইচ্ছা হইল না, ইহার নিকট অকপটে সকল কথা প্ৰকাশ করিব বলিয়াই স্থির করিলাম।
আমি মনে মনে এই স্থির ক’রে, সেই রাত্রে জাগ্রত থেকে স্বকর্ণে যাহা শুনিয়াছিলাম এবং নিৰ্ম্মলার কাছে যাহা শুনিয়াছিলাম তাহা প্রকাশ করিয়া বলিলাম।
আমার এই কথা শুনিয়া ব্রাহ্মণের সহসা একটু ভাবান্তর হইল। তিনি যেন বিস্ময়-বিস্ফারিত নয়নে আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ চাহিয়া রহিলেন। আমি কোন কথা বলিবার পূর্ব্বে তিনি পুনরায় আমাকে কহিলেন, “আচ্ছা, সেই অভয়ানন্দ স্বামী তোমাকে কোথায় পাইয়াছিল ও তাঁর শিষ্য কিষণজি বাবুর নিবাস কোথায়, কিছু কি শুনিয়াছ?”
আমি। আজ্ঞে না, আমার ন্যায় নিৰ্ম্মলাও ঘটনাক্রমে যাহা কর্ত্তার নিকট শুনিয়াছিল তাহাই আমার কাছে প্রকাশ করিল। ইহার অধিক আর সে কোন কথা শুনে নাই, কাজেই আমাকে সে কিরূপে বলিবে?
আমার কথা শেষ হইলে সেই দেব প্রতিম ব্রাহ্মণ গম্ভীরভাবে কি ভাবিতে লাগিলেন ও মাঝে মাঝে আড়চোখে আমার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। আমি প্রকৃত ব্যাপার বুঝতে না পেরে নিতান্ত বিস্মিতভাবে ব্রাহ্মণের দিকে চাহিয়া রহিলাম।
খানিকক্ষণ পরে সেই সদানন্দ ব্রাহ্মণ পূর্ব্বের ন্যায় হাসি হাসি মুখে আমাকে কহিল, “ভাই, কিষণজির ন্যায় পাপাত্মার বাড়ি তার পাপান্ন গ্রহণ ক’রেছিলে, সেই পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য তোমাকে এই বিড়ম্বনা ভোগ করতে হচ্ছে কিন্তু এত শীঘ্র হাতে হাতে অন্য কাহার কর্ম্মান্তিকের ফল ভোগ হয় না। তাতেই বোধ হ’চ্ছে সাধারণ মানবের সঙ্গে তুলনায়, বিধাতা ভিন্ন উপকরণে তোমার ভাগ্য নিৰ্ম্মাণ ক’রেছেন, অল্প দিনের মধ্যে এদিককার সব খেলা শেষ করতে হবে, শীঘ্র শীঘ্র জাল গুড়ুতে হবে, সেই জন্য সদ্য সদ্য গাছে ফল ধরলো। তবে ভাই এখন কথা হ’চ্ছে, তুফান দেখে ভয় পেয় না, এই রকমভাবে দাঁড় টেনে যাও, ঝাঁ ক’রে তোমার পাড়ি জমে যাবে, আর সকল লা পেছনে প’ড়ে থাকবে।
ব্রাহ্মণের এই সকল কথার প্রকৃত মর্ম্ম বুঝতে না পেরে, উদাসভাবে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম, এমন সময় হাবুজখানার অধ্যক্ষ সেই সদাশয় ভদ্রলোকটা একটা আলো হস্তে সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও খুব বিনীতভাবে সেই দেবপ্রতিম ব্রাহ্মণকে কহিলেন, “প্রভো! দু-দিন আপনি নিরম্বু উপবাস ক’রে আছেন, এ পাপ পুরীতে আপনি ত আর কিছু আহার করিবেন না, কিছু কাঁচা দুগ্ধ ও গঙ্গাজল আনাইয়াছি, অনুমতি হয় তো নিয়ে আসি।”
সেই সদানন্দ ব্রাহ্মণ তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ সহাস্য বদনে কহিলেন, “বাপু, তোমার অনুগ্রহে নিতান্ত বাধ্য হ’লাম, তবে আজকার রাতটা যাক্, কাল যা হয় হবে, এখন এ ছেলেটাকে কিছু খাইতে দাও।”
লছমী প্রসাদ বাবু উত্তর করিলেন, “ইহার জন্য লুচি ভাজাইয়াছি, দেবীসিং এখনি লইয়া আসিবে। আমি কেবল আপনার জন্য আসিয়াছি, দেহ রক্ষা করতে হ’লে তো কিঞ্চিৎ আহারের প্রয়োজন?”
ব্রাহ্মণ। সে কথা সত্য, কিন্তু বাবা এখন তো আমি আহার অভাবে মর মর হই নাই, অভ্যাসের গুণে যতটুকুন পারি, তাহা ছাড়িব কেন? তারপর এই পাপ প্রাণ রক্ষা করা যদি নিতান্ত আবশ্যক হ’য়ে উঠে, তাহলে তখন দেখা যাবে, তিন দিন তো যাক্, দেখি মা জগদম্বা দাসের প্রতি কি বিধান করেন, সে বেটী কি একেবারে ভুলে থাকবে। প্রতিদিন বেটীর চরণামৃত পান না ক’রে জলগ্রহণ করি না, ইহাই আমার জীবনের ব্রত, পোড়া পেটের জন্য সেই ব্রতটা ভঙ্গ ক’রে ফেলবো? জীব জন্মাবার আগে মার স্তনে যিনি দুধ জুগিয়ে দেন, তিনি কি আমাকে অনাহারে মারবেন?
লছমীপ্রসাদ বাবু কোন কথা না ব’লে, ভক্তিভাবে একটী প্রণাম ক’রে, সে স্থান হ’তে প্রস্থান করলেন।
আমি এই কথা শুনিয়া অপার বিস্ময়-হ্রদে নিমগ্ন হ’লাম। কি আশ্চৰ্য্য, এই তেজস্বী ব্রাহ্মণ, দুই দিন উপবাসে আছেন, কিন্তু কই মুখ তো কিছুমাত্র শুষ্ক হয় নাই, মনের প্রফুল্লতা ত কমে নাই, অভ্যাসের গুণে মানুষের এতদূর ক্ষমতা জন্মাতে পারে? ফল কথা, ইনি কখনই সামান্য ব্যক্তি নন। এঁকে এই পাপ পুরীতে কেন আটক ক’রে রেখেছে, কথায় কথায় সেই কথাটা জিজ্ঞাসা ক’রে দেখি।
আমি মনে মনে এই স্থির ক’রে, সেই ভক্তিভাজন দ্বিজবরকে কহিলাম, “আপনি দু-দিন উপবাসে আছেন, কিন্তু এরূপ অনাহারে আর কদিন থাকবেন? পাপিষ্ঠেরা শীঘ্র যে আপনাকে ছাড়িয়া দেবে, তাহারি বা সম্ভাবনা কি?”
ব্রাহ্মণ। ভাই, সে কথা সত্য, কিন্তু আমার তা ভাববার তো কোন দরকার নাই। আমার যা কায কেবল তাই ক’রে যাব, তারপর সে বেটীর মনে যা আছে তাই হবে।
আমি। আজ্ঞে, মানব মাত্রই তো আহার করে, উপবাস থেকে আত্মাকে কষ্ট দেওয়া তো উচিত কাজ নয়?
ব্রাহ্মণ। ভাই, আমি পূর্ব্বেই তো ব’লেছি, মার পূজান্তে তাঁর চরণামৃত পান ক’রে তবে জল গ্রহণ ক’রে থাকি, আজ দু-দিন তা হয় নাই, সুতরাং দগ্ধ উদর পোষণের জন্য জীবনের প্রিয়ব্রত কি ভঙ্গ করবো? আর তাহ’লেই কি আমার জীবন রক্ষা হবে, জগতে অমরত্ব লাভ করবো। ভাই, মানুষের শান্তির একটা নির্দ্দিষ্ট সময় আছে, সে দিন না এলে কিছুতেই কেউ ইহকালের সম্বন্ধজাল ছিন্ন করতে পারে না। সেইজন্য সমুদ্রগর্ভে জাহাজ ডুবি হ’লেও মানুষ বাঁচে, আবার ঘরে শুয়ে থেকেও মানুষ মরে, আমার সে দিন এলে কেউ কিছুতেই রক্ষা করতে পারবে না। তা ব’লে আগে থেকে হাল ছেড়ে দিই কেন? দেখি না, মা আমাকে উপবাসে মারেন, কি প্রসাদ দিয়ে বাঁচান। এখান হ’তে আমার শীঘ্র মুক্তির কোন উপায় নাই সত্য, কিন্তু সে বেটীর এমন খেলা নয়, তাঁর ইচ্ছা হ’লে, নিতান্ত অসম্ভবও সম্ভবে পরিণত হয়, পাষাণের উপর পদ্ম প্রস্ফুটিত হয় ও মরুভূমির মধ্য দিয়ে স্নিগ্ধ-সলিলা নদী প্রবাহিত হ’য়ে থাকে; মানুষ ততটা তলিয়ে বোঝে না, অপেক্ষা করতে না পেরে ক্ষুধার ঝোকে পাটকিলে কামড় দিয়ে বসে, সেইজন্য পদে পদে বিড়ম্বনা ভোগ করতে বাধ্য হয়, মার অপার মহিমা বুঝতে পারে না।
এমন সময় দেবীসিং একখানি থালায় ক’রে লুচি তরকারি ও তিন চার রকম ক্ষিরের মিষ্টান্ন আমাকে আনিয়া দিল। তখন আমার ক্ষুধানল খুব প্রবল হ’য়ে উঠেছে, প্রাণের ভয়ও অনেকটা ভেঙ্গে গেছে, কাজেই আর ক্ষণ বিলম্ব না ক’রে ঢিপি হ’তে নামিয়া আহারে বসিলাম, দেবীসিং পুনরায় এক ঘটী কর্পূরবাসিত জল, এক বাটি ঘন দুগ্ধ ও দু-খিলি ছাচি পান আনিয়া দিল।
হাবুজখানায় এ প্রকার জামাই আদর দেখিয়া নিতান্ত বিস্মিত হইলাম, মনে করিলাম যে, ইহা নিশ্চয় এই ব্রাহ্মণের কথিত জগদম্বার খেলা, আমার বোঝবার ক্ষমতা নাই ব’লে, কখন কখন বিষাদে কাতর ও আনন্দে উৎফুল্ল হ’য়ে উঠি, এই তত্ত্বজ্ঞানী ব্রাহ্মণ সার বুঝেছেন বলে, অচলের ন্যায় অটলভাবে অবস্থান করছেন, কিছুতেই টলাতে পারছে না।
আমি পরিতোষে আহার ক’রে তাম্বুল চর্ব্বন করিতে করিতে পুনরায় সেই ঢিপিতে বসিলাম ও ভক্তিভাবে ব্রাহ্মণকে কহিলাম, “একবেলা আহার না করিয়াই আমার যথেষ্ট কষ্টবোধ হইয়াছিল, এখন যেন ধড়ে প্রাণ আসিল, কিন্তু আপনি কিরূপে দু-দিন উপবাসে আছেন? মুখমণ্ডল বিন্দুমাত্র ম্লান হয় নাই, সদ্য বিকসিত পদ্মের ন্যায় প্রফুল্লিত র’য়েছে, এই উপবাসে আপনার কি কিছুমাত্র কষ্ট হ’চ্ছে না। তবে বাহ্যিকে আপনাকে দেখলেই কিছুতেই বোধ হয় না যে, আপনি দু-দিন উপবাসে আছেন।
সেই তত্ত্বজ্ঞানী ব্রাহ্মণ সেইরূপ হাসি হাসি মুখে উত্তর করিলেন, “ভাই, কৰ্ম্মভূমি লোকে যাকে সংসার বলে, সেই সংসারে এই ক্ষীণপ্রাণ মানুষ একমাত্র অভ্যাসের দ্বারায় ও মনের একগ্রতার গুণে যাবতীয় দুষ্করকার্য্য অনায়াসে সম্পন্ন করিতে পারে; আর অভ্যাস না করলে, হৃদয়ে বল না থাকলে, এই তীক্ষ্ণবুদ্ধি বিবেকসম্পন্ন মনুষ্যে ও জড়-প্রকৃতি প্রস্তরখণ্ডে কোন বিভিন্নতা থাকে না। আবার এই অভ্যাসের ফলে অধম জীবের ব্রহ্মসাক্ষাৎকার অবধি লাভ হ’য়ে থাকে। কষ্টকে কষ্ট ব’লে গ্ৰাহ্য না করলে, কোনপ্রকার অভাবে জড়িত না হ’লে, পার্থিব কোনরূপ দুঃখের অস্তিত্ত্ব আদৌ বুঝতে পারে না। তবে কোন সিগ্ধ-সলিলা সরোবরে অবগাহন করলে যেমন গাত্রদাহ প্রশমিত হ’য়ে যায়, তেমনি এক মনে, এক প্রাণে মার নাম জপ করতে পারলে, ক্ষুধা তৃষ্ণার নাম অবধি থাকে না, কেমন একপ্রকার অভূতপূৰ্ব্ব আনন্দে চিত্তভূমি প্লাবিত হ’য়ে উঠে। আর ভাই, এখানেই বা আমার বিশেষ কষ্ট কি? ঘরে ব’সে যা করতাম, এখানে থেকেও তাই করছি, তারপর সে বেটী যে দিন খাওয়াবেন, সেই দিন খাব, অনাহারে মারেন মরবো, তবু প্রাণ থাকতে সহজে হাল ছাড়বো না।
এই বলতে বলতে দরদরিত ধারে অশ্রুজল ব্রাহ্মণের গণ্ডদেশ দিয়া গড়াইয়া পড়িল, সঙ্গে সঙ্গে আমারও চক্ষে জল আসিল, কষ্ট হ’লে লোকে কেঁদে থাকে সত্য, কিন্তু প্রাণের অন্তস্থলে বিমল আনন্দের উৎস উৎসায়িত হ’লেও যে চ’খে জল আসে ও সংসারে সেরূপ কান্নার তুল্য সুখ যে আর নাই, তা আজ প্রথমে বুঝতে পারলাম। ফুলের সঙ্গে থাকলে জলও যেমন সুরভিত হয়, তেমনি আজ আমি এই মহাত্মার সহবাসগুণে এই অনাস্বাদিতপূর্ব্ব বিমল আনন্দের অংশভাগী হইলাম। ক্ষণেকের জন্য পার্থিব সকল চিন্তা ও ভয় আমার অন্তর হ’তে যেন অন্তরিত হ’য়ে গেল, মনে করিলাম, ভাগ্যে আমি রহিম মোল্লার খুনদায়ে অভিযুক্ত হ’য়েছিলাম, ভাগ্যে দারোগা সাহেব আমাকে এখানে চালান দিয়েছিলেন, তা না হ’লে তো এই মহাত্মার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হ’তো না, কাজেই তখন মিথ্যা খুনদায়ে অভিযুক্ত এই বিপদকেও সৌভাগ্যের নিদান ব’লে বোধ করিলাম। মনে করিলাম এ সকলি মায়ের খেলা, যিনি বিষাক্ত সর্পের মাথায় অমূল্য মাণিক স্থাপিত ক’রেছেন, তিনিই নরককুণ্ড বিশেষ মুসলমানদের হাজতখানায় এরূপ তত্ত্বদর্শী মহাত্মার সঙ্গে আমার মিলন করে দিলেন। বিষম প্লাবনে দেশ প্লাবিত হ’য়ে গেলে যেমন ভূমির উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি হয়, তেমনি বিপদ হ’তে যে সম্পদের সূত্রপাত হ’য়ে থাকে, নিতান্ত দুর্ঘটনার পরিণাম ফল যে নিতান্ত শুভ হ’তে পারে, তাহা আজ স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম। তবে জীবপ্রতি কৃপাবান্ দয়ার সাগর মহাত্মার শত্রু কে হইল? এবং কি অপরাধে ইহাকে এখানে আটক করিয়া রাখিল, তাহা এইবার জিজ্ঞাসা করিব, কারণ তাহা শুনিবার বাসনা আমার মনমধ্যে নিতান্ত প্রবল হইয়া উঠিল।
আমি মনে মনে এই স্থির ক’রে সেই দেবপ্রতিম ব্রাহ্মণকে কহিলাম, “প্রভো, কুলোকের ষড়যন্ত্রে আমি এই বিপদে প’ড়েছি, বকের সঙ্গে সারসপক্ষী থাকলে সেও যেমন শীকারির ফাঁদে পতিত হ’য়ে প্রাণ হারায়, তেমনি আমি কুলোকের সঙ্গে ছিলাম ব’লে আমার আজ এ দশা ঘটলো, কিন্তু আপনি তো কখন কুসংসর্গে মেশেন নাই, কাহার সঙ্গে মহাশয়ের যে বিবাদ আছে, তাহা কিছুতেই বোধ হয় না। তাহ’লে কিজন্য আপনাকে গ্রেপ্তার করিয়া আনিল, কাজী সাহেব কি অপরাধের জন্য আপনার বিচার করিবে?
আমার কথা শুনিয়া সেই সদানন্দ ব্রাহ্মণ হো হো করিয়া হাসিতে হাসিতে কহিল, “ভাই বড় গুরুতর অপরাধে আমি অপরাধী, কাজী সাহেব আমার অপরাধের গুরুত্ব বুঝে বোধ হয় ফাঁসির ব্যবস্থা করবেন, আর না হয় ত শূলে চড়াবেন।”
ব্রাহ্মণের কথায় আমি একটু ভয় পেয়ে বলিলাম, “কেন, আপনি এমন কি গুরুতর অপরাধ করিয়াছেন যে, যার জন্য আপনাকে এরূপ কঠোর দণ্ডভোগ করতে হইবে?”
ব্রাহ্মণ হাসিয়া কহিলেন, “ভাই, তবে আমার অপরাধের কথা শুন; এই সহরের অন্তর্ভাগে একটি কালী বাড়ি আছে, সকলে তাহাকে ব্রহ্মচারীর কালীবাড়ি বলে, আমি এক্ষণে গুরুদেবের আজ্ঞায় মার সেবাকর্ম্মে নিযুক্ত আছি, অল্পদিন হইল একঘর মুসলমান আসিয়া মন্দিরের অনতিদূরে বাস করিয়াছে। মার আরতির সময় শঙ্খ ঘণ্টার ধ্বনি হয় তাহাতেই ঐ মুসলমানের নেমাজ খারাপ হইয়া যায়, কাজেই কাফেরের দোষে তাহার ধৰ্ম্মহানি ঘটিয়াছে, এই মর্ম্মে কাজীর কাছে আমার অভিযোগ আনে ও পরদিন আমাকে গ্রেপ্তার করিয়া প্রথমে দারোগার কাছে নিয়ে যায় ও পরে এখানে আনিয়া আটক করিয়া রাখিয়াছে, বিচারে যে কি হইবে তাহা জগদম্বাই জানেন।
আমি রোষভরে কহিলাম, “পাপিষ্ঠদের অসাধ্য কিছুই নাই। সংসারে ধৰ্ম্ম ব’লে পদার্থ থাকলে কখন আপনার ন্যায় মহাত্মাকে এ প্রকার দুর্গতি ভোগ করতে হ’তো না। আর অর্থলোলুপ, নীচাশয় পাষণ্ডেরা ধনে মানে উজ্জ্বল হ’য়ে উঠতো না।
ব্রাহ্মণ আমার কথা শুনে হাসতে হাসতে বললেন, “না ভাই, এটা ভুল বললে, হাজার হোক্ এখনও তুমি ছেলেমানুষ, সেই জন্য মানব ভাগ্যচক্রের আবর্ত্তন কি সাধারণভোগ্য বিপদ সম্পদ সুখ দুঃখের সঙ্গে সাক্ষাতের নিগূঢ় রহস্য এখনও ঠিক বুঝিতে পার নাই। তবে অল্পদিনের মধ্যে যখন ঘোর কেটে যাবে, নূতন জীবন লাভ করবে, তখন এসব ব্যাপারের প্রকৃত তত্ত্ব বুঝতে পারবে। এখন এইমাত্র জেনে রাখ যে, এই সংসারে ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা ভিন্ন কোন ঘটনা ঘটে না, বা কোনকালেও পদানত ভক্তের প্রতি তাঁর করুণার হ্রাস হয় না। তার সাক্ষ্য দেখ না, আমাদের ন্যায় কুপুত্ত্রের পাছে কোন কষ্ট হয় ব’লে, মা যমপুরী সদৃশ মুসলমানদের এই হাবুজখানায় লছমীপ্রসাদের ন্যায় সদাশয় ভদ্রলোককে পূৰ্ব্বেই পাঠিয়েছেন, আমিত তোমাকে আগেই ব’লেছি যে, এ সব সেই বেটীর খেলা, চোরকে চুরি করতে ব’লে গৃহস্থকে সজাগ রাখা বেটীর চিরকালের অভ্যাস, সে বেটী যেদিন যেখানে যে অবস্থায় রাখবে, তাতেই সন্তুষ্ট থাকবে, সুতরাং আমার পক্ষে মন্দির ও এই হাজত দুই সমান, বলপূর্ব্বক আমাকে অনায়াসে আটক ক’রে রাখতে পারে, কিন্তু আমার মনের উপর তো কাহার প্রভুত্ব নাই, যেখানেই থাকি না কেন, মনে মনে সেই মহেশ-মনমোহিনীর মোহিনী-মূর্ত্তি ধ্যান করবো, সুতরাং আমার নিজের জন্য বিশেষ কোন ক্ষতি বৃদ্ধি নাই। তবে একটা বিষয়ের জন্য আমার অন্তরে একটু ভাবনা হচ্ছে?
আমি। আপনাদের ন্যায় মহাপুরুষের আবার ভাবনা কি? একমাত্র সেই ভাবময়ের ভাবনা ভিন্ন অন্য কোন অনিত্য ভাবনা তো ভবদীয় বিমল অন্তরে স্থান পেতে পারে না।
ব্রাহ্মণ। সে কথা ঠিক ভাই, কখন কোন পার্থিব ভাবনার ধার ধারি নাই; চিরকাল মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় মুক্তপ্রাণে স্বাধীনভাবে মার গুণগান ক’রে দিন কাটাতাম। আজ প্রায় দুই বৎসর হ’লো আমি বাধ্য হ’য়ে এই ভাবনাকে নিমন্ত্রণ ক’রে এনেছি; কারণ তা না হ’লে সেই অভাগিনীর আর কোন উপায় ছিল না, কাজেই আমি তাকে আশ্রয় দিতে বাধ্য হ’লাম। এখন জগদম্বা নিজে তার ভার গ্রহণ করবেন, তার কোন চিন্তা নাই; কিন্তু আমা বিহনে সেই মেয়েটার কি হ’চ্ছে কেবল তাই, ভাবছি। তবে আমার মতন সে কখন উপবাসে নাই, নিশ্চয় জগদম্বা সেই অনাথিনীর কোন উপায় ক’রে দিবেন। কারণ এ সংসারে যায় কেউ নাই, সেই জগজ্জননী নিশ্চয় তার সহায় হ’য়ে থাকেন। এ কথা বেদ বাক্যের ন্যায় অভ্রান্ত; কেবল আমরা চঞ্চল চিত্ত ব’লে ততটা নির্ভর করতে পারি না, সেই জন্য বৃথা ভাবনার কোলে পতিত হ’য়ে মনকে ক্লিষ্ট করি।
আমি। তাহ’লে আপনি যে মেয়েটীকে আশ্রয় দিয়েছেন, সে কি আপনার কোন আত্মীয়া?
ব্রাহ্মণ। না, সে আমার আপনার কেহ নয়, কিন্তু তবু আমাকে ফাঁদে ফেলেছে, কখন কাহারও জন্য ভাবি নাই, কিন্তু সেই বেটীই কেবল ভাবাচ্ছে। সে বেটী তাঁতির মেয়ে, কিন্তু অর্থ পিশাচ নরাধমের কুচক্রে পড়ে তার সর্ব্বনাশ হ’য়েছে, রাজরাণী হ’তে একেবারে ভিখারিণী হয়ে পড়েছে, তবে সে মেয়েটী যথার্থ পতিপ্রাণা সতী বলে, সেই সতী-শিরোমণি তার জাতকুল রক্ষা করলেন, কাজেই দেবীর উচ্চাসন হ’তে পরিভ্রষ্টা হ’য়ে কুক্কুরীর অধমা হ’তে হ’লো না, বিপদবারিণী তার সব বিপদ কাটিয়ে দিলেন। এখন আমার এই গলগ্রহ ঘুচে গেলেই আমি পুনরায় নিশ্চিন্ত হ’তে পারি।
“সেই অভাগিনী তাঁতির মেয়ে” এই কথা শুনিবামাত্র আমার মনটা যেন ঝাঁৎ ক’রে উঠলো, প্রাণে বিষম খটকা লাগিল; কাজেই এই ব্রাহ্মণের কথার শেষ ভাগটা মনোযোগের সহিত শুনিতে পারিলাম না, মনে মনে সেই অভাগিনী রমণীর কথাই ভাবিতে লাগিলাম।
ব্রাহ্মণ বিরত হইলে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “প্রভো! সে কন্যাটী কে? তার নিবাস কোথায়, আর কি রকম সূত্রে সেই অভাগিনী আপনার আশ্রয়ে আসিল?
ব্ৰাহ্মণ। সে অনেক কথা ভাই, লিখিলে একখান আঠার পৰ্ব্ব মহাভারত হয়। তবে তোমাকে সংক্ষেপে বলছি যে, তার শ্বশুরালয় এই আজীমগঞ্জে, তার দাদা-শ্বশুর সাহেবদের কাছে হাজার টাকা দাদন লয়; কিন্তু প্রায় দু-হাজার টাকার রেশমী কাপড় ও প্রায় লক্ষ টাকার জমিদারী দিয়েও সেই দাদনের টাকা শোধ যায় না, শেষে অভাগিনীর শ্বশুর ও দেবরকে বাকীর দায়ী ক’রে রাখে। সে সাহেবকে এক বাঙ্গালী বাবু পরামর্শ দেয় যে, বাঙ্গালিদের পুরুষ অপেক্ষা অন্দরের মেয়েদের ধ’রে কয়েদ করলে বড় কায়দায় পড়ে, তখন তাদের কাছে যা চাওয়া যায়, তাই বার ক’রে দেয়, কিছুমাত্র টাকার মায়া করে না। বুড়া বেটার হাতে এখনো কিছু টাকা চাপা আছে, তার বউকে ধ’রে কয়েদ করলে আর চেপে থাকতে পারবে না। এই পরামর্শ ঠিক ক’রে একদিন সেই শোক-সন্তপ্ত বুড়াকে বলে যে, আরও পাঁচ শত টাকা না দিলে তোর নাত বউকে ধ’রে নিয়ে যাব। বৃদ্ধের তখন এক পয়সারও সম্বল নাই, কাজেই পাপীদের অভিষ্ট সিদ্ধ করিতে পারিল না, এই অপরাধে কুটীর বরকন্দাজ পাঠাইয়া বুদ্ধের সম্মুখ হ’তে অভাগিনীকে ধরিয়া লইয়া যায় এবং একটা খালি বাড়ীতে আবদ্ধ ক’রে রাখে।
যে বাড়ীটায় তাকে বন্দিনী করিল, সেটা ঠিক গঙ্গার উপরে অবস্থিত। তখন ভাদ্রমাস, কাজেই জোয়ারের জল বাড়ীর ভিতরে গিয়া ঠেকিয়াছে। কন্যাটী আর কোন উপায় না দেখে, ধৰ্ম্মনাশ ভয়ে ভীত হ’য়ে ঘরের জানালার একটা গরাদে ভেঙ্গে গঙ্গায় ঝাপিয়ে পড়ে ও টানের মুখে ভাসিতে ভাসিতে যায়। ঘটনাক্রমে আমিও নৌকা ক’রে অন্যত্র যাইতেছিলাম, দূর হ’তে প্রথমে আমি তাহার চুল দেখিতে পাই ও তাড়াতাড়ি সেইদিকে নৌকা নিয়ে গিয়ে অজ্ঞান অবস্থায় অভাগিনীকে তুলিয়া ফেলি ও অনেক কষ্টে বাঁচাই। সেই অবধি বেটী আমার কাছে আছে ও আমার পায়ের বেড়ি হ’লে প’ড়েছে। শেষে জগদম্বা যে সে বেটীর কি হিল্লে ক’রে দেবেন তা তিনিই জানেন, আমি তো ভেবে কিছু স্থির করতে পারি নাই।
যদিও সেই মহাত্মা স্পষ্ট কাহার নাম বলেন নাই, কিন্তু তথাপি অনুমানে আমি অনেকটা বুঝিতে পারিলাম। তবে একেবারে নিঃসংশয় হওয়ার জন্য কহিলাম, “আচ্ছা, সেই তাঁতির মেয়েটা সধবা না বিধবা?”
ব্রাহ্মণ। তাহা সে ঠিক জানে না, কারণ যে সময় সাহেবের লোকেরা বৃদ্ধের দুই পুত্ত্রকে গ্রেপ্তার করে, সেই সময় তাহার স্বামী ভয়ে মাতুলালয়ে পলাইয়া যায়, তারপর সাহেবেরা বাড়ীখানি দখল করে ও তাহাদের তাড়াইয়া দিলে বৃদ্ধ নাতবউটীকে লইয়া একখানি খড়ো ঘরে বাস করিতেছিল ও রুগ্ন অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিল। সেই সময় তাহার মুখে একমাত্র জল দেবার পাত্রী সুশীলা কন্যাটীকে ধরিয়া আনিয়াছিল। ফলকথা প্রায় পাঁচ বৎসর হইল তাহারা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হ’য়ে প’ড়েছে, কাজেই তাহার স্বামীর সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই; সুতরাং সে জীবিত কি মৃত তাহার কোন ঠিক নাই।
আমি। ধর্ম্মরক্ষার জন্য যে নারী হাস্যমুখে নিজের জীবন বলি দিতে উদ্যত হয়, সে রকম পুণ্যবতীরা সংসারে কখনই বৈধব্য যন্ত্রণা ভোগ করে না। নিশ্চয়ই সেই সতী সাধ্বীর, স্বামী এখনো জীবিত আছে। তবে দারুণ দুর্দ্দশাগ্রস্ত হ’য়ে এখন উন্মাদ রোগে আক্রান্ত হ’য়েছে।
ব্রাহ্মণ অনেকটা বিস্মিতভাবে কহিলেন, “তুমি কি সেই কন্যাটীকে চেনো?”
আমি। আজ্ঞে না, তবে তাদের সব কথা শুনেছি। আচ্ছা, সেই কন্যাটীর দাদাশ্বশুরের নাম কি রামসদয় বসাক?
ব্রাহ্মণ। হাঁ, তাহার ঐ নাম বটে; আহা, এই সংসারে তার মতন মনঃকষ্ট আর কেউ ভোগ ক’রেছে কি না সন্দেহ। তার মনের ঠিক বিশ্বাস হ’য়েছে যে, মনুষ্য সমাজ অপেক্ষা হিংস্র-পশু-পূর্ণ নিবিড় বনে বাস করাও সহস্রাংশে শ্রেয়ঙ্কর; সে যাই হোক্, তুমি কি ক’রে এ কথা জালে তা বল?
আমি। আজিমগঞ্জে দিনকয়েক সেই বসাক মহাশয়ের বাটীতে বাস করিয়াছিলাম। যে পাপিষ্ঠ বাঙ্গালীর পরামর্শে এই সর্ব্বনেশে কাণ্ড হয়, তার নাম মাণিকলাল সরকার, সে বেটা কৈবর্ত্ত হ’য়ে এখন কায়েত হ’য়ে প’ড়েছে। সে মহাপাতক ক’রে অনেক টাকা উপার্জ্জন ক’রেছে বটে, কিন্তু বেটা এমনি কৃপণ যে, একটী পয়সাকে হৃদয়ের অস্থিতুল্য জ্ঞান করে। মার কৃপায় তার একটী ঘোরমূর্খ অপব্যয়ী পুত্ত্ররত্ন জন্মেছে, তার নাম মোহিতলাল সরকার। সাহেবেরা পাপিষ্ঠের পাপকার্য্যের পুরস্কার স্বরূপ বসাক মহাশয়ের বাড়ীখানি তাকে দান ক’রেছে, মোহিতবাবু আমাকে সেই বাড়ীতে এনেছিলেন। আমি পাপিষ্ঠ কর্ত্তার প্রধান আমলার মুখে শুনিয়াছি যে, মানুষ হ’য়ে মানুষের উপর যে এতদূর নির্ম্মম ব্যবহার কর্ত্তে পারে তা পূর্ব্বে তাঁর বিশ্বাস ছিল না।
ব্রাহ্মণ। আচ্ছা, তুমি সেই হতভাগ্য যুবককে কোথায় কি অবস্থায় দেখেছিলে, আর সেই যে রামসদয় বসাকের পৌত্ত্র তা তুমি কি ক’রে বুঝলে?
আমি। আমি দুইবার তাকে দেখেছি; প্রথমে আজিমগঞ্জের জোন সাহেবের বাজারের কাছে দেখিয়াছিলাম। যুবকের রুক্ষ্মকেশ, মলিনবেশ, কেবল মাত্র কতকগুলো কাগজের একটা দপ্তর বগলে র’য়েছে; দেখলাম লোকটা এক বিষয়ে অনেকক্ষণ মনোনিবেশ করতে পাচ্ছে না, মাঝে মাঝে যখন পূর্ব্বকথা স্মৃতিপটে উদয় হ’চ্ছে, তখনই ক্রোধে উন্মত্ত হ’য়ে “কাট শালাকে মার শালাকে, শালার ভূঁড়িটা তরমুজের মত ফাঁসিয়ে দে” এই বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠে। যুবকের সঙ্গে দুটো কথা কহিবার ইচ্ছা থাকিলেও আমি কহিতে পারি নাই; কারণ যুবক নিজের খেয়ালের বশে মুহূৰ্ত্ত মধ্যে অদৃশ্য হ’য়ে গেল। তারপর আজ গঙ্গাপার হইবার সময় নৌকায় তাহাকে দেখিলাম, কিন্তু এখানেও আমার প্রয়াস বিফল হইল কারণ আমি তাহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে, আবার সেইরূপ পাগলামি আরম্ভ করিল, নৌকা ডুবিবার উপক্রম হইল, কাজেই আমি নীরব হ’তে বাধ্য হ’লাম। মনে করিলাম, তীরে উঠিয়া হতভাগ্যের আত্মকাহিনী শ্রবণ করিব, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমার সে ইচ্ছা ফলবতী হইল না। পাপিষ্ঠ নরপ্রেত মাণিকলালের অমানুষিক ব্যবহারে সে সমস্ত বাঙ্গালীর উপর এমনি হাড়ে চটিয়া গিয়াছে যে, আমাকেও সাহেবের লোক বলিয়া তাহার ভ্রম হইল, কিছুতেই প্রাণের কথা খুলিয়া বলিল না; শেষে পূর্ব্ব স্মৃতির উদয়ে তাহার অন্তরে প্রতিহিংসানল প্রজ্জ্বলিত হওয়ায় সেই রকম চীৎকার করতে করতে ছুটে পলাইল, কাজেই আর তাকে ধরিতে পারিলাম না! এবং এই ঘটনার একটু পরেই বরকন্দাজেরা আমাকে গ্রেপ্তার করিয়াছিল; যাহা হউক এক্ষণে মহাশয়ের কথা শুনিয়া আমার স্থির বিশ্বাস হইল যে, সেই হতভাগ্য যুবাই বৃদ্ধ রামসদয় বসাকের পৌত্ত্র ও সেই রমণীর স্বামী। কারণ তাহার সকল ক্রোধ একমাত্র ঐ পাপিষ্ঠ মাণিকলাল সরকারের উপর, কেবলমাত্র তাহারই উদ্দেশে সে গালাগালি দেয় ও তাহার ভুঁড়ি ফাঁসাবার জন্য চীৎকার ক’রে থাকে। ফলকথা কোনরূপে তাহার প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি নিবৃত্তি হ’লে, তাহার মস্তিষ্ক শীতল হবার সম্ভাবনা।
ব্রাহ্মণ একটী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “যাই হোক্, তোমার নিকট এই সংবাদ শুনে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম। তবে ভাই, এটা ঠিক জেনো যে, এই সংসারে সাধনা করলেই তাহা সিদ্ধ হ’য়ে থাকে। একদিন নিশ্চয় যুবকের মনোরথ সিদ্ধ হবে ও পাপিষ্ঠ মাণিকলাল তাহার কৃতকর্ম্মের উপযুক্ত ফলভোগ করবে। চঞ্চল চঞ্চলার আলোক বিকাশ ক্ষণেকের তরে, পরে যেমন অন্ধকার দ্বিগুণ বৃদ্ধি হইয়া থাকে, তেমনি পাপীদের ভাগ্যদীপ একবার উজ্জ্বল হ’য়ে তারপর দুর্ভেদ্য অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন হয়। পরিণামে পাপীর নরকযন্ত্রণা কেউই ভোগ রোধ করতে পারে না। তুমি এই সংসার মধ্যে আমার এই সকল কথার প্রকৃত পরিচয় প্রাপ্ত হবে। নরপ্রেত সদৃশ মাণিকলালের ভাগ্য জোয়ার দেখিয়াছ, আবার ভাটার টানে কি হয় তাহাও প্রত্যক্ষ করিবে। ভাই! এই সংসার মানবের পক্ষে মহাপরীক্ষার স্থল, উপভোগের স্থান ইহা নহে; তবে যে মূর্খ অপেক্ষা করতে না পেরে, ইহকালকে সার ভেবে, নিজেকে অমরজ্ঞানে অনিত্য প্রমোদে প্রমত্ত হ’য়ে পড়ে, সেই ভ্রান্ত জীবের অসীম দুর্দ্দশা কেহই রোধ করতে পারে না। এই বৈষম্যময় জগতে পাপীর উন্নতি ও ধৰ্ম্মভীরু সাধুদের অবনতি দেখা যায় বটে, কিন্তু শেষে নিশ্চয় ধর্ম্মের জয় হ’য়ে থাকে। ফলকথা, হৃদয়বল প্রভাবে এই মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হ’তে না পারিলে মানুষ কখন মানুষ নামের উপযুক্ত হয় না। আমি দেখছি তোমারও পরীক্ষা আরম্ভ হ’য়েছে, এই সময় একটু সাবধানে থাকিলে, অবিচলিত চিত্তে অসীম সহিষ্ণুতাগুণে সব সহ্য করিতে পারিলে, সুখ দুঃখ বিপদ সম্পদ সব মার শ্রীচরণে অর্পণ ক’রে নিশ্চিন্ত হ’লে, অনায়াসে এই পরীক্ষা হইতে উত্তীর্ণ হ’তে সক্ষম হবে। তখন বুঝিবে যে, আপাতমধুর পরিণামবিরস, তুচ্ছ ঐহিক সুখের সহিত বিমল ভগবৎ প্রেমরসে আপ্লুত থাকার কত প্রভেদ; অমৃতের সহিত তুচ্ছ তক্র আস্বাদনের কত অন্তর তাহা বুঝিতে পারিবে।
ব্রাহ্মণের জ্ঞানগর্ভ সুধাসিঞ্চিত কথাগুলি শুনিয়া আমার অন্তরে বিপুল আনন্দের উদয় হইল, তখন হাবুজখানাকে স্বর্গের নন্দনকানন ব’লে বোধ করিলাম। ফলকথা, এরূপ সুখে সময়পাত আমার ভাগ্যে একদিনের জন্যও ঘটে নাই; আজ ভাগ্যবলে এই অনাস্বাদিতপূর্ব্ব বিমল আনন্দলাভ করিলাম। পূর্ব্ব জন্মের বহুপুণ্য ফলে যে সাধু দর্শন ঘটে থাকে, সাধু দর্শনের ফল যে কিছুতেই ব্যর্থ হয় না তাহা সত্য। অগ্নিতে পড়িলে অঙ্গারের মলিনমূৰ্ত্তি যেমন তিরোহিত হ’য়ে যায়; তেমনি সাধুসহবাস লাভ করতে পারলে নিতান্ত নীরস অন্তরেও বিমল আনন্দের উদয় হ’য়ে থাকে; ফলকথা আমার ক্ষুদ্র জীবনের এই বিচিত্র ঘটনাই তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
আমার বেশ বোধ হইল যে, কূপে যেমন কমল বিকশিত হয়, তেমনি নিশ্চয় এ অভাগার প্রাণে শান্তি দিবার জন্য, আমার অন্তরের তর্ক-জাল ছিন্ন করিবার অভিপ্রায়ে জগদম্বা তাঁর এই সুপুত্ত্রকে এখানে কৌশলক্রমে পাঠাইয়াছেন, কাজেই বিমল ভক্তিরসে আমার চিত্তভূমি প্লাবিত হইয়া উঠিল, আজ আমার জীবনের এই প্রথমে এ প্রকার অভূতপূর্ব্ব আনন্দ অনুভব করিলাম।
প্রায় রাত্রি দুইটা অবধি এই মহাপুরুষের সঙ্গে কথাবার্ত্তায় কাটাইলাম। ঊষার মধুরমূর্ত্তি দর্শনে অন্ধকারচর যেমন পলায়ন করে, তেমনি ভক্তিরসে প্লাবিত সদর্থযুক্ত কথা শুনিয়া আমার অন্তরের সেই সকল ভয় ভাবনা ও উদ্বেগ তখনি অন্তর্হিত হইল এবং একপ্রকার সাহসে হৃদয় সুদৃঢ় হইয়া উঠিল। শেষে রাত্রি অধিক হইয়াছে বলিয়া, তিনি আমাকে শয়ন করিতে বলিলেন, কাজেই আমি আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই ঢিপির উপর কম্বলখানি পাতিয়া শয়ন করিতে বাধ্য হইলাম।