» » হরিদাসের গুপ্তকথা

বর্ণাকার

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

হাজত বা হাবুজখানা।

মুসলমান রাজত্বকালে বিচারের পূর্ব্বে অপরাধীদের যে স্থানে আটক ক’রে রাখা হ’ত তাহাকে হাবুজখানা বলিত। অবশ্য ইংরাজ বাহাদুদের সময় তাহার হাজতখানা নামকরণ হইয়াছে। যদিও তখন ভিতর ভূয়া হইয়া গিয়াছিল, রাজ্যের প্রকৃত শাসন ইংরাজ বাহাদুরদের হাতে আসিয়াছে; কিন্তু তথাপি মুসলমান আমলের ঈষৎ কায়দা তখনও পর্য্যন্ত মুরশিদাবাদে ছিল। যাবতীয় ফৌজদারী মোকদ্দমার বিচার কাজী সাহেব করিতেন, আর দাওয়ানি মোকদ্দমা নেজামতি আদালত হ’তে নিষ্পত্তি হইত। ট্যাকশালও সেইখানে ছিল, ইংরাজ বাহাদুরেরা তখন দেশের রাজস্ব আদায় নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, সুতরাং শাসন ও বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ ক্ষমতা তখনও হাতে লইবার তেমন অবসর হয় নাই। কাজেই তখন যে কিরূপ বিচার প্রণালী প্রচলিত ছিল, কিরূপ দরের লোকের উপর এই সকল গুরুভার ন্যস্ত ছিল, তাহার প্রকৃষ্ট পরিচয় আমার কৃপাময় পাঠক মহাশয়েরা আমার এই আখ্যায়িকা মধ্যে প্রাপ্ত হবেন।

আমরা যথাকালে হাবুজখানায় উপস্থিত হইলাম, বদরুদ্দিনের ডাকাডাকিতে লোহার গুলযুক্ত প্রকাণ্ড কাঠের দরজা মধ্য হ’তে একটি ছোট কাটা দরজা খুলে গেল; আমরা তিনজনে সেই পথ দিয়ে প্রবিষ্ট হইলাম এবং তাহারা সেই বৃহৎ ফটকের ডাইনদিকের একটি অতি ক্ষুদ্র কক্ষ মধ্যে আমাকে নিয়ে গেল।

আমি দেখিলাম যে, সেই কক্ষটীর প্রায় দশ আনা ভাগ খুব নীচু পায়ার একটি তক্তপোষে যোড়া ও তাহার উপর ঢালা বিছানায় একটি মস্ত বাক্স কোলে ক’রে একটা ভদ্রলোক বসিয়া আছেন। লোকটার ডানদিকে তালায় আবদ্ধ একটা আলমারি ও চারিদিকে নানারকমের কাগজের তাড়া এলোমেলো ভাবে ছড়ান আছে।

এই ভদ্রলোকটার বয়স ৪০ বৎসরের অধিক হইবে না, বর্ণটুকু ফিট্‌ গৌর, চক্ষুদ্বয় আকর্ণ-বিস্তৃত সমুজ্জল ও তেজপূর্ণ; কার্ম্মকের ন্যায় ভ্রুদ্বয় পরস্পর যুক্ত ও নাসিকাটী বেশ সমুন্নত ছিল। সুন্দরীর ভালে খদিরের টীপ যেমন শোভা পায়, প্রফুল্ল কমলে ভ্রমর যেমন বাহার খোলে, তেমনি ভ্রমরকৃষ্ণ গোঁফ জোড়াটীতে তাহার মুখের সৌন্দর্য্য শতগুণ বৃদ্ধি হ’য়েছে। আমি প্রথমে এই লোকটীকে দেখিয়াই চমকিয়া উঠিলাম, কারণ দেখিলাম সেই গিন্নীর মুখের সহিত ইহার মুখের অনেকটা সৌসাদৃশ্য আছে। ইহা দেখিয়া তখন আমার আর কোন চিন্তা মানসপটে আদৌ দেখা দিল না।

লোকটী মুসলমানি কায়দায় ঢিলে ইজের চাপকান পরিয়াছে বটে, কিন্তু তাহার চাপকানের বোতাম ও কপালে একটী ক্ষুদ্র রক্তচন্দনের টীপ দেখিয়া তাহাকে হিন্দু বলিয়া আমার বিশ্বাস হইল। আমি মনে মনে একটু আনন্দিতও হইলাম, কারণ ইনি স্বজাতী ও ভদ্রলোক, চেহারা দেখে অনেকটা সদাশয় বলিয়াও বোধ হয়; সুতরাং ইনি যে, আমার সঙ্গে কোনরূপ কপট ব্যবহার না করিয়া, আমার প্রকৃত অপরাধ কি, কে শত্রুতা ক’রে আমাকে গ্রেপ্তার করাইয়া দিল, তা সম্ভবতঃ গোপন করবেন না বলিয়াই বিশ্বাস হইল।

আমি সেইখানে দাঁড়াইয়া হাড়িকাঠের নিকটস্থ পাঁঠার ন্যায় কাঁপিতেছি, এমন সময় বদরুদ্দিন অগ্রসর হইয়া একখানি কাগজ তাঁহার হাতে দিল। তিনি সেই কাগজখানি পড়িয়া একবার আমার আপাদ- মস্তক নিরীক্ষণ করিলেন ও সেই সঙ্গে ঈষৎ হাস্যের রেখা তাহার অধর প্রান্তে প্রকটিত হ’য়ে চঞ্চলা চপলার ন্যায় তখনি লয় হইয়া গেল। আমি এক দৃষ্টে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া ছিলাম; কাজেই তাহার সেই হাসিটুকু লক্ষ্য করিলাম, কিন্তু তাহার প্রকৃত কারণ তখন বুঝিতে পারিলাম না।

লোকটী বরকন্দাজদ্বয়কে বিদায় দিয়া, সহাস্য আস্যে আমাকে সেই তক্তপোষের উপর বসিতে বলিলেন। আমি তাঁহার আদেশমত উপবেশন করিলাম, কাজেই আমার একটু সাহস বাড়িয়া গেল; আমি খুব বিনীতভাবে কহিলাম, “মহাশয়! কি অপরাধের জন্য আমাকে ইহারা ধরিয়া আনিয়াছে, তাহা অনুগ্রহ করিয়া আমাকে বলুন? দারোগা মহাশয় আমাকে এখানে চালান দিলেন বটে, কিন্তু আমি যে কি অপরাধের জন্য গ্রেপ্তার হ’লাম, তাহা আমাকে বলা সঙ্গত ব’লে বোধ করলেন না। সুতরাং কি অপরাধে আমি ধৃত হইলাম, তাহা এখন জানিতে পারি নাই।”

আমার কথা শুনিয়া ভদ্রলোকটা একটু গম্ভীরভাবে বদরুদ্দিন দত্ত সেই কাগজখানি মনযোগের সহিত আর একবার পাঠ করিলেন এবং পূর্ব্বেকার ন্যায় সহাস্য আস্যে কহিলেন, “যে রাজ্যে এ প্রকার অদ্ভুত বিচারের প্রহসনের ফলে, পাপীরা অর্থের জোরে নিষ্কৃতি পায়, আর নির্দ্দোষ নিরীহ লোকেরা তাহার পরিবর্ত্তে নির্য্যাতন সহ্য করে, ক্ষয়িতমূল বৃক্ষের ন্যায় অচিরকাল মধ্যে সে রাজ্যের পতন হ’য়ে থাকে। মুসলমানদের কপাল একেবারে ভেঙ্গেছে, রাজলক্ষ্মী জন্মের মত ত্যাগ ক’রেছে, সেই জন্য এই অন্তিম সময়ে অবিচার ও অনাচারের স্রোত এক প্রকার প্রকাশ্য ভাবে চলছে। যাই হোক্, যে অপরাধের জন্য তোমাকে গ্রেপ্তার করেছে, সে প্রকার গর্হিত কাজ যে তোমার দ্বারা হয় নাই, তাহা আমি তোমাকে দেখিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারিয়াছি; তবে প্রকৃত ব্যাপারখানা যে কি, তাহা আমি ঠিক বুঝিতে পারিলাম না। তোমার বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত হ’য়েছে, কোন লোক পেছনে থেকে তোমাকে বিপদে ফেলবার জন্য যে টাকা খরচ ক’চ্ছে, তাহাতে সন্দেহ নাই।

আমি এই কথা শুনিয়া অনেকটা ভীতভাবে কহিলাম, “যাই হোক, মহাশয়ের কাছে যখন আমাকে চালান দিয়াছে, তখন আমার অপরাধের কথা নিশ্চয় জানিয়াছেন; পরোয়ানাতেও তাহা লেখা আছে, অতএব কি দায়ে আমি গ্রেপ্তার হ’লাম তা আমাকে অনুগ্রহ ক’রে বলুন?”

সেই ভদ্রলোকটি হাসিতে হাসিতে কহিলেন, “এমন কিছু গুরুতর ব্যাপার নহে; তুমি খুনের দায়ে অভিযুক্ত হ’য়েছ।”

এই কথা শুনিয়া আমার মুখ শুকাইয়া গেল, বুক ঢিপ্‌ টিপ্‌ করিতে আরম্ভ করিল, দারুণ ত্রাসে সর্ব্বশরীর কণ্টকিত হইয়া উঠিল এবং সহসা স্বেদজলে সৰ্ব্বাঙ্গ ভিজিয়া উঠিল। আমি ভাবিতে লাগিলাম, কি আশ্চর্য্য, আমি ইহজীবনে কখন কাহার গাত্রে একটী তৃণঘাত পর্য্যন্ত করি নাই, তাহ’লে কিরূপে আজ খুনের দায়ে অভিযুক্ত হ’লাম? কাহার সঙ্গে আমার তো কিছুমাত্র শত্রুতা নাই, তাহ’লে কে আমার বিরুদ্ধে এ প্রকার ভয়ানক চক্রান্ত করিল ও আমাকে বিপদে ফেলার জন্য টাকা খরচ করতে প্রস্তুত হলো? আমি বিপদে পড়লে তার কি স্বার্থ সাধিত হবে, আমি তার কি অপকার ক’রেছি, কি জন্য আমার উপর তার এ প্রকার বিজাতীয় ক্রোধের উদয় হ’লো?”

সহসা এই কথা আমার মনে উদয় হইল, আমি প্রকৃত ব্যাপার জানিবার অভিপ্রায়ে পুনরপি সেই সদাশয় ভদ্রলোকটীকে কহিলাম, “মহাশয়! তাহ’লে আমি কোথায় কাকে খুন ক’রেছি এবং কে খুনে ব’লে কোতয়ালিতে চিনাইয়া দিল, তাহা আমাকে বলুন।”

সেই ভদ্রলোকটী ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “কাজী সাহেবের দস্তখতি পরোয়ানাতে যাহা লেখা আছে শুন, ‘গত ২৩শে চৈত্র বালুচর নিবাসী সার্থক জেলে গঙ্গায় জাল ফেলিতে ফেলিতে একটা বড় ভারি বস্তা পায়; বস্তা খুলিয়া দেখে যে, তাহার মধ্যে একটা মুসলমান যুবার লাশ র’য়েছে। জেলে বেচারি কোতয়ালিতে এই খবর দেয় ও লাশ দেখায়, তাতে মঞ্জুর হয় যে, কোন বদমাইস আকোচ ক’রে পিস্তলের গুলিতে খুন ক’রে বস্তায় পুরে গঙ্গায় ফেলে দিয়েছে। দারোগা সফি খাঁ এই খুনের কিনারা করে, তিনি হররোজ মেহনতের পর মোবারক আলি, হিম্মত খাঁ ও গোলাব মাড়োয়ারি এই তিনজনকে গাওয়া খাড়া ক’রে ফেলেন। মোবারক আলি নামে যে গাওয়া সে দর্জ্জির পেশা করে, সে বলে ২২শে চৈত্র রাত্রি আন্দাজ দশটার সময় হরিদাস নামে একজন ছোকরা এই বস্তাটা মাথায় ক’রে তার দোকানের ধার দিয়ে গিয়েছিল, চাঁদের আলোতে সে স্পষ্ট লোক চিনতে পেরেছিল। হিম্মত খাঁ ও গোলাব মাড়য়ারি বলে, হরিদাস নামে একটা ছোকরা কিষণজি বাজপাই নামে একজন ভদ্রলোকের বাড়ীতে ছোকরা খানসামা ছিল; একদিন ছোঁড়া বাক্সো ভেঙ্গে কিছু টাকা ও গহনা চুরি ক’রে বাবুর বাড়ী থেকে পালায় ও ঠাকুর সাহেবের আখড়ায় মদ ভাং খেতে আরম্ভ করে। একদিন তাস্ খেলতে খেলতে মৃত ব্যক্তি যাহার নাম সেখ রহিম মোল্লা, তাহার সহিত ঐ ছোকরার গালাগালি ও কেজিয়ে হয়। হরিদাস খুব রেগে বলে আমার কাছে পিস্তল আছে, আমি গুলি করবো। আর পাঁচ জন এই কেজিয়ে তখনকার মতন আপোষ ক’রে দিল, কিন্তু তারপর হ’তে আর কেউ রহিম মোল্লার খবর পায় নাই, চারিদিকে ঢুড়ে ঢুড়ে কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। তার পরদিন সার্থক জেলের জালে রহিম মোল্লার লাশ পাওয়া যায়, তদন্তে এই সব গাওয়ার দ্বারায় প্রমাণ হ’য়েছে যে, উক্ত হরিদাস রহিম মোল্লাকে পিস্তল দ্বারায় খুন করিয়াছে, অতএব সেই খুনে হরিদাসের গ্রেপ্তারের জন্য পরোয়ানা জারি হইল। তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়া এনসাফের জন্য আমার কাছে ভেজিবে। ইতি ৩রা জ্যৈষ্ঠ, হিজরি ১১৬৫।

মহম্মদ টোকী খাঁ, কাজী।”

আমি তখন খুনদায়ে অভিযুক্ত, কাজেই প্রাণেও যথেষ্ট ভয়ের সঞ্চার হ’য়েছে, কিন্তু তথাপি এই পরোয়ানা শুনিয়া আমি একটু না হাসিয়া থাকিতে পারিলাম না, কোথা হ’তে পোড়া হাসি আসিয়া সেই সময় আমার অধরদেশে উপস্থিত হইল। আমি মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, “এ কি ভয়ানক চক্রান্ত, কি বিষম যোগাযোগ, যাহা কখন স্বপ্নেও ভাবি নাই, কল্পনায় আনি নাই, তাহাই এক্ষণে প্রত্যক্ষ্যে ঘটীল। শেষে আমাকে কিনা রহিম মোল্লার খুন দায়ে অভিযুক্ত হ’তে হ’লো; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে খুন তো কিষণজি বাবুর বাড়ীতে হইয়াছিল, কিন্তু পরোয়ানায় তাহার নামোল্লেখ না ক’রে ঠাকুর সাহেবের আখড়ার কথা লিখিত হইল কেন? কে বুদ্ধি খরচ ক’রে এরূপভাবে মোকদ্দমাটী সাজাইল? আমি দণ্ডভোগ করিলে কাহার কি স্বার্থ সাধিত হইবে, কে গোপনে গোপনে আমার সঙ্গে এ প্রকার শত্রুতা করছে? আমি তো এ জীবনের মধ্যে কখন কাহার বিন্দুমাত্র অপকার করি নাই, কাহার প্রাণে বিষের বাতি জ্বালি নাই, তবে আমাকে এ প্রকার বিড়ম্বনা ভোগ করতে হ’চ্ছে কেন? পরোয়ানায় যে তিন জন সাক্ষীর নাম শুনিলাম, তাদের আমি আদৌ চিনি না, এ জীবনে কখন যে দেখেছি, তাহাও বোধ হয় না, বিশেষ তিনজন সাক্ষীর মধ্যে কেহই একটীও সত্য কথা বলে নাই, আগাগোড়া মিথ্যা কথা বলিয়াছে, সুতরাং এই মিথ্যাবাদী পাপাত্মাদের সাক্ষ্য দেবার জন্য কে যোগাড় করলে? গতিক দেখে বোধ হয় যে, কিষণজিবাবু এই ষড়যন্ত্রের মূলে আছেন, তবে তিনি নিজের ঘাড়ে কোন ঝোক্ রাখেন নাই, একেবারে পাশ কাটাইয়া ভাল মানুষ সাজিয়াছেন। বোধ হয় তাহার আজ্ঞায়, আমাকে বিপদে ফেলার জন্য নরাধম দেবীপ্রসাদ এই যোগাযোগ করিয়াছে, নিশ্চয় সেই বেটাই দূর হ’তে আমাকে সনাক্ত করিয়া তাড়াতাড়ি ছাতা আড়াল দিয়া চলিয়া গেল, তারপর বরকন্দাজেরা আসিয়া আমাকে গ্রেপ্তার করিয়া ফেলিল।”

আমি এই সব কথা মনোমধ্যে তোলাপাড়া কচ্ছি, এমন সময় সেই ভদ্রলোকটী পরোয়ানাখানি বাক্সের মধ্যে রাখিয়া তাহার স্বভাবসিদ্ধ হাসি হাসি মুখে কহিলেন, “কেমন হে! ব্যাপারখানা কি বুঝে তে পারলে?”

আমি বিনীত ভাবে উত্তর করিলাম, “মহাশয়, প্রকৃত ব্যাপারখানা আমি বুঝিতে পারি নাই। তবে রহিম মোল্লা নামে একজন মুসলমান যুবক পিস্তলের গুলিতে খুন হইয়াছিল সত্য; কিন্তু আমি নিজে খুন বা খুনের কিছুমাত্র সাহায্য করি নাই। কিষণজি বাবুর বাড়ীতে জোয়া খেলা হ’তে হ’তে কি জন্য ঠিক জানি না, অন্য আর এক ব্যক্তি পিস্তলের দ্বারায় খুন ক’রে পলাইয়া যায়। পরদিবস সাঁইজি নামে একটি ফকিরবেশী বদমাইস, বস্তাবন্দি লাশ লইয়া গঙ্গায় ফেলিয়া দিয়াছিল; কিষণজি বাবুর আজ্ঞাক্রমে আমি সেই সাঁইজির সঙ্গে সঙ্গে গিয়াছিলাম, কিন্তু ঘটনাক্রমে কিষণজি বাবুর বাড়ী আর আমার যাওয়া হইল না। ইহা ভিন্ন এ ব্যাপারের আর আমি কিছুই জানি না। আজ আমি কোন বিশেষ কাৰ্য্যোপলক্ষে আজীমগঞ্জ হ’তে আসিতেছিলাম, হঠাৎ পথ মধ্য হ’তে কাহার সনাক্ত মতে ঠিক জানি না, দু-জন বরকন্দাজ আমাকে গ্রেপ্তার ক’রে কোতয়ালিতে নিয়ে গেল। তারপর দারোগা কোন কথা না ব’লে আপনার নিকট আমাকে পাঠাইয়া দিল; জগদম্বা জানেন যে, মহাশয়ের নিকট এক বর্ণ ও মিথ্যা বলি নাই।”

আমার কথা শেষ হ’লে সেই ভদ্রলোকটী কহিলেন, “ব্যাপারটা যে কি তাহা আমি বুঝিতে পারিয়াছি, তুমি যে মিথ্যা কথা বলার লোক নয়, তাহা আমার বুঝিতে বাকী নাই; কিন্তু কিষণজি বাবু প্রকৃতপক্ষে লোকটা কে, তোমার সহিত তাহার কি সম্বন্ধ ছিল, আর কিজন্যই বা তুমি তাহার আশ্রয় ত্যাগ করলে, তাহা আমার নিকট প্রকাশ করিয়া বল। আমার নিকট কোন কথা গোপন ক’রো না, কেন না, আমার দ্বারায় তোমার কোন অপকার হবে না, বরং আমি সাধ্যমত তোমার উপকার করবো; কারণ মুসলমানের অধীনে চাকরী গ্রহণের ইহাই আমার একমাত্র মুখ্য উদ্দেশ্য।

ভদ্রলোকটার কথায় আমার মনে কিঞ্চিৎ আশার সঞ্চার হইল। আমি বুঝিয়া দেখিলাম যে, এক সমুদ্রগর্ভে যেমন বহুমূল্য মুক্তা ও অকিঞ্চিৎকর বালুকা একত্রে অবস্থান করে, ভীষণ সর্পের মাথায় যেমন অমূল্য মাণিক থাকে, তেমনি এই সংসারে আলো অন্ধকারের ন্যায় দেবতার প্রতিরূপ ও পিশাচের হেয়, উভয় প্রকার মনুষ্যই দৃষ্টিগোচর হইয়া থাকে। এই ভদ্রলোকটী মুসলমানদের সরকারে চাকরী করে সত্য, কিন্তু অন্যান্য কর্ম্মচারীদের ন্যায় অত্যাচার-প্রিয়, অর্থলোলুপ পিশাচ প্রকৃতি নহেন, তুচ্ছ অর্থের জন্য মনুষ্যত্বকে বলি দিতে অগ্রসর হন নাই; অন্যের কষ্টে ইহার কোমল অন্তঃকরণ আর্দ্র হয় এবং করুণার প্রবাহ খরবেগে প্রবাহিত হ’য়ে থাকে। যেমন চক্ষে না দেখে কেবলমাত্র স্বরে কাক ও কোকিল চেনা যায়, তেমনি মুখের দুটো কথা শুনিলেই ভদ্র কি ইতর, নিষ্ঠুর কি সদাশয় তাহা অনায়াসে জানিতে পারা যায়। বিশেষ মানবের মুখমণ্ডলে তাহার অন্তরের অনেকটা আভাষ প্রতিফলিত হ’য়ে থাকে। সেইজন্য এক একজনকে দেখলে অন্তর মধ্যে যেমন ভক্তির উদয় হ’য়ে উঠে, সর্বস্ব তার চরণে উৎসর্গ করবার ইচ্ছা প্রবল হয়, আবার এমন লোকও আছে যে, তাদের মূর্ত্তি দৃষ্টিপথে পতিত হ’লে, এক প্রকার অব্যক্ত ত্রাসে প্রাণ শিহরিয়া ওঠে এবং ক্রোধ ও ঘৃণার যুগপৎ আক্রমণে হৃদয়-রাজ্য সমাক্রান্ত হ’য়ে উঠে। সেইজন্য বোধ হয় পণ্ডিতেরা বলেন যে মানবের আকারের সহিত তাহার মানসিক ভাবের অনেকটা সামঞ্জস্য আছে। এই ভদ্রলোকটী যেরূপভাবে কথা কহিলেন, আমার ন্যায় অপরিচিত বিপন্ন ব্যক্তির উপর যে প্রকার সহানুভূতি প্রকাশ করলেন, তাতে বেশ বোধ হ’লো যে, এই মহাত্মার অন্তর নিশ্চয় স্বর্গীয় উপাদানে নির্ম্মিত ও যাবতীয় সদগুণের আধার এবং দয়া ধর্ম্মের নিকেতন। স্থির করিলাম, ইহার নিকট কোন কথা গোপন করিব না, যাহা জানি অকপটে প্রকাশ করিব। যদিও সব সত্য বলিলে ভবিষ্যতে মোহিতবাবুর বিপদ ঘটিতে পারে, কিন্তু তথাপি এখন আর উপায় নাই, নিজের নির্দ্দোষিতা প্রমাণের জন্য এখন তো সব সত্য কথা বলি, তারপর যাহা অদৃষ্টে আছে তাহাই হইবে।

মনে মনে এই স্থির ক’রে আমি যাহা জানিতাম, তাহা তাহার নিকট অকপটে প্রকাশ করিলাম। দেবীপ্রসাদের সহিত কর্ত্তার সেই পরামর্শ, চিঠি নিয়ে ঠাকুর সাহেবের আখড়ায় আমার গমন, খোদ ঠাকুর সাহেবের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সাজা প্রভৃতি সে রাত্রের সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করিলাম, একটা কথাও বাদ দিলাম না।

ভদ্রলোকটী অতীব মনযোগের সহিত আমার কথাগুলি আগাগোড়া শুনিয়া একটু ব্যগ্রভাবে কহিলেন, “আচ্ছা সেই কিষণজি বাজপাই যে যথার্থ কণোজি ব্রাহ্মণ, তাহার কোন প্রমান পেয়েছো বা তাহার দেশের কুটুম্ব কি আপনার জনকে কখন দেখেছ?”

আমি। না, আমার জ্ঞান হওয়া পর্য্যন্ত কৰ্ত্তাকে দেশে যেতে কি তাহার দেশ হ’তে কোন লোককে আসতে কখন দেখি নাই, তিনি চিরকাল সহরেই আছেন।

ভদ্রলোক। আচ্ছা তোমাদের কর্ত্তা এখানে কি বিষয় কৰ্ম্ম করেন?

আমি। তা ঠিক জানি না। তবে গিন্নির মুখে শুনেছি যে, কৰ্ত্তা টিকারির রাজা ও গয়া জেলার আর তিন জন জমিদারের আমমোক্তার, কিন্তু কখন কোন কাজকর্ম্ম করতে, কি কাগজ কলমে হাত দিতে দেখি নাই। তবে মাঝে মাঝে ঠিক দুপুরবেলায় ইজার চাপকান চোগা পরে পরামাণিকদের মতন হাতে বাঁধা পাগড়ি মাথায় দিয়ে, পাল্কী আনিয়ে কোথায় বেরুতেন ও গোছা গোছা টাকা নিয়ে ঘরে ফিরতেন; প্ৰকাশ্য পেশার মধ্যে বাড়ীতে জুয়াখেলার আড্ডা ছিল, মূর্খ বড়মানুষের ছেলেদের লোভ দেখিয়ে এনে খেলায়, ও শেষে বলপূর্ব্বক তাহাদের নিকট যাহা থাকে তাহা কাড়িয়া লয়। সেদিন রাত্রে এই জন্যই ওপ্রকার ভয়ানক বিভ্রাট উপস্থিত হ’য়েছিল। কিন্তু কি আশ্চর্য্য, প্রকৃতপক্ষে যেখানে খুন হইল, সেখানকার নামোল্লেখ পৰ্য্যন্ত হইল না, সত্য কথা গোপন ক’রে ঠাকুর সাহেবের আখড়ার নাম করা হইল।

আমার শেষের কথাগুলি তিনি শুনিলেন কি না সন্দেহ, কারণ ওসকল কথার কোন উত্তর দিলেন না; বরং যেন অধিকতর আগ্রহের সহিত কহিলেন, “আচ্ছা, সত্য ক’রে বল দেখি যে, সেই মেয়েটা কিষণজি বাবুর ঔরষজাত মেয়ে কি পালিতা মেয়ে?”

এইবার একটু বিপদে পড়লাম। যদিও নির্ম্মলার মুখে প্রকৃত কথা শুনিয়াছিলাম, কিন্তু এতদিন পুত্ত্রের ন্যায় যারা প্রতিপালন ক’রেছিলেন, তাদের সেই ভয়ানক কেলেঙ্কারীর কথা এই অপরিচিত ভদ্রলোকের কাছে প্রকাশ করা যুক্তিযুক্ত ব’লে বোধ করিলাম না। কাজেই এক্ষেত্রে আমি সত্য কথা গোপন করতে বাধ্য হ’লাম, কারণ কথায় কথায় যদি তাদের চরিত্র সম্বন্ধের সেই জঘন্য কথা প্রকাশ হয়ে পড়ে, এই আশঙ্কায় নির্ম্মলার মুখে যাহা শুনিয়াছিলাম, তাহা প্রকাশ না করিয়া কহিলাম, “সম্ভবতঃ কিষণজি বাবুর স্ত্রীর গর্ভজাত কন্যা হবে।”

ভদ্রলোক। আচ্ছা মেয়েটা তো বড় হ’য়েছে, তবু এখনও বিবাহ হয় নাই কেন?

আমি। তাহা আমি ঠিক জানি না, তবে গিন্নির মুখে শুনিয়াছি যে, এদেশে তাদের স্বঘরের ছেলে নাই, সেইজন্য মেয়ে আজও আইবড় আছে, দেশ হ’তে ছেলে আনাইয়া মেয়ের বিবাহ দিতে হবে।

ভদ্রলোক। আচ্ছা, তোমাদের কর্ত্তা ও গিন্নিকে কি রকম দেখতে বল দেখি?

আমি যথাযথ কর্ত্তা ও গিন্নির রূপ বর্ণনা করিলাম। আমার কথা শুনে ভদ্রলোকটী যেন বিমনা হ’লেন ও গম্ভীর ভাবে কি ভাবতে লাগলেন। আমি একদৃষ্টে ভদ্রলোকটীর ভাবভঙ্গি দেখিতে লাগিলাম, কিন্তু আমার এই কথা শুনিয়া তিনি যে কেন ঈদৃশ বিমনা হ’য়ে’ প’ড়লেন, তাহা বুঝিতে পারিলাম না, কেবল উদাসভাবে তাঁহার মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলাম।

খানিকক্ষণ পরে ভদ্রলোকটা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আমাকে কহিলেন, “তাই তো ভাই! বদলোকের ষড়যন্ত্রে তুমি তো বড় বিপদে প’ড়েছে। নিশ্চয় কোন ক্ষমতাশালী লোক পেছন থেকে টাকা খরচ করছে; সেইজন্য বিনা সূতায় হার গাথার ন্যায় এইরূপ মিথ্যা মোকদ্দমার সৃষ্টি হ’য়েছে। যাই হোক্, আমি গোপনে তোমার সম্বন্ধে তদন্ত করবো, তুমি মনে মনে সেই বিপদহারী মধুসূদন নাম জপ কর; তাহলে সেই নিরুপায়ের উপায় তোমার কোন সদুপায় ক’রে দেবেন। এক্ষণে তুমি ৯নং ঘরে বাস করগে, সেখানে তোমার ন্যায় নিরপরাধ এক ব্রাহ্মণ অবরুদ্ধ আছেন। তাঁহার সহিত কথাবার্ত্তার তুমি সুখে সময়ক্ষেপ করতে পারবে। এখানে যে ক’দিন থাকবে, কোন বিষয়ে তোমার কষ্ট হবে না। দেখছি এখনো তোমার আহার হয় নাই, আচ্ছা আমি এখনি সে বিষয়ের বন্দোবস্ত করছি, আজকার মতন লুচি খাও, তারপর কাল হ’তে বামুনরান্না ভাতের বন্দোবস্ত করবো।”

ভদ্রলোকটী এই কথাগুলি বলিয়া “দেবীসিং দেবীসিং” ব’লে চীৎকার ক’রে উঠলেন, অমনি “হুকুম-গরিব পরবর” এই জবাব দিয়ে তালগাছের ন্যায় ঢেঙ্গা, নেতার মতন কালো চিরকূট পৈতে গলায়, এক হিন্দুস্থানী ব্রাহ্মণ মহাশয় স্বশরীরে সেইখানে এসে উপস্থিত হ’লেন। বাবুটী তাহার দিকে ফিরিয়া কহিলেন, “দেখ দেবীসিং তুমি এই ছোকরাটিকে গোছলখানায় নিয়ে গিয়ে স্নান করিয়ে ৯নং কামরায় নিয়ে যাও; আমার মাখিবার তেলও একখানি কাপড় বাসা হ’তে এনে দিও। প্রকৃতপক্ষে এই ভদ্রসন্তানটা কোন কসুর করে নাই, কেবল বদলোকের যোগাড়ে ঐ ঘরের ঠাকুর মহাশয়ের মতন মিছে ফ্যাসাদে পড়িয়াছে; সেইজন্য এক ঘরে দুই-জনকে দিলাম। এ ছোকরা কখনই পালাবার পাত্র নয়; কাজেই তোমাকে কিছুমাত্র সাবধান হ’তে হবে না, ইহার সহিত সাধারণ কয়েদির মতন ব্যবহার ক’রো না, এ কেবল গ্রহফেরে ও কুলোকের চক্রান্তে কোন দোষ না করিয়াও এখানে আসিয়াছে। আমার হুকুমে এই ভদ্রসন্তানের সঙ্গে ভদ্রব্যবহার করবে, আমার দোস্তজ্ঞানে আদর যত্ন করবে।”

দেবীসিং এক “জো হুকুম” ব’লে তাঁহার সকল কথার উত্তর দিল। তারপর তিনি আমার দিকে চেয়ে কহিলেন, “তাহ’লে যাও ভাই, স্নান করগে, আর বেলাও অধিক নাই, একেবারে সন্ধ্যার পর আহারাদি ক’রো। বোধ হয় বিধাতা আজ তোমার অন্ন মাপান নাই, সেই জন্য একটা মিছে ফ্যাসাদে প’ড়ে আজ সমস্ত দিনটা উপবাসে কাটালে। এই সংসারে কবে যে কাহার ভাগ্যে কিরূপ ঘটনা ঘটে, তা অনুমানে স্থির করবার ক্ষমতা কাহার নাই।”

এই সদাশয় ভদ্রলোকটির সহানুভূতিসূচক এই সকল কথা শুনিয়া মনে মনে নিতান্ত প্রীত হ’লাম, এমন কি ত্রাসরূপ-নিরদখণ্ডে-সমাচ্ছন্ন অন্তরাকাশ যেন অনেকটা নিৰ্ম্মল হ’লো। আমি ভাবিয়া দেখিলাম জীবদেহের ব্যাধি নিরাময় ক্ষমতা যে বিভু বনৌষধিতে প্রদান করিয়াছেন, তিনিই দয়া করিয়া এই নিঃস্বহায় বিপন্ন অভাগার পরিত্রাণের জন্য এ প্রকার জঘন্য স্থানে ঈদৃশ দয়ামায়ার আধার মহাত্মাকে প্রেরণ ক’রেছেন। তা না হ’লে সরকারি আমলা হ’য়ে আসামীর উপর যে এতদূর সদয় হবে, তাহা কিছুতেই সম্ভবপর নহে। এই ঘোর বিপদে পতিত হ’য়ে আজ আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে, সেই ইচ্ছাময়ের ইচ্ছা হ’লে নীরস পাষাণের মধ্য হ’তেও সিগ্ধ সলিলরাশি নিঃসৃত হ’য়ে থাকে, ঘোর নরককুণ্ডও স্বর্গীয় সৌরভে সুরভিত হ’য়ে উঠে।

আমি এই ভদ্রলোকটীর সদয় ব্যবহারে এরূপ মুগ্ধ হ’য়েছিলাম যে, এই পাপতাপময় সংসারে তাঁহাকে দেবতার প্রতিরূপ ব’লে আমার বিশ্বাস হইল। আমি কি বলে যে, এই মহাত্মার নিকট হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, তাহা ঠিক করিতে পারিলাম না, কেবল অশ্রুপূর্ণ চক্ষে তাহার দিকে চাহিয়া রহিলাম।

বাবুজি দেবীসিংহকে এই হুকুম দিয়া সেই কক্ষ হ’তে অন্যত্রে গমন করিলেন, কাজেই আমিও দেবীসিংহের সঙ্গে হাবুজখানার মধ্যে প্রবিষ্ট হইলাম।