- হরিদাসের গুপ্তকথা
- প্রথম পরিচ্ছেদ : কিসের মন্ত্রণা?
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : এরা কে?
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল!
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ : আজব চিঠি!
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাবু দেবীপ্রসাদ।
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : ভয়ানক ব্যাপার!
- সপ্তম পরিচ্ছেদ : বিষম সন্দেহ।
- অষ্টম পরিচ্ছেদ : আলেকসাই ফকির।
- নবম পরিচ্ছেদ : পীরের দরগা।
- দশম পরিচ্ছেদ : মোহিত বাবু।
- একাদশ পরিচ্ছেদ : ভূঁড়ো-কর্ত্তা।
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : গুণের খানসামা।
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মাষ্টার মহাশয়।
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : গোমিস্ সাহেব।
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : আখড়া।
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ : গ্রেপ্তার।
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : দারোগা সাহেব।
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : হাজত বা হাবুজখানা।
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল।
- বিংশ পরিচ্ছেদ : হাজতে দ্বিতীয় রাত্রিবাস।
- একবিংশ পরিচ্ছেদ : আমার বিচার।
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ : বিচারালয়।
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ : এ কথা কি সত্য?
- চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ : ব্রহ্মচারী মহাশয়।
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ : গুপ্তকথা।
- ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ : পাপের পরিণাম।
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ : নবাব বাহাদুর।
- অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ : নীলমণি বসাক।
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ : উদ্যোগপৰ্ব্ব।
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ : আশা মিটিল।
- একত্রিংশ পরিচ্ছেদ : দীক্ষা।
- দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ : লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু।
- উপসংহার
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
দারোগা সাহেব।
বেলা আন্দাজ নয়টার সময় আমরা কোতয়ালিতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন পৰ্য্যন্ত দারোগা সাহেবের সুখনিদ্রা ভাঙ্গে নাই, কাজেই তাঁহার জন্য অপেক্ষা করিতে হইল।
আমি লোকের মুখে কোতয়ালির নাম শুনিয়াছিলাম বটে, কিন্তু কখন চক্ষে দেখি নাই বা কিরূপ প্রকৃতির লোক দেশের শান্তিরক্ষা কাজে নিযুক্ত আছে তাহাও জানিতাম না; আজীবনের মধ্যে এই প্রথম কোতয়ালিতে পদার্পণ করিলাম এবং ইহাদের সহিত আলাপের সুযোগ হইল।
আমি দেখিলাম যে, একটা মস্ত উলুর আটচালার উপর কোতয়ালি স্থাপিত, ভিতরে বরকন্দাজেরা বাস করে ও বাহিরের রকে একখানি তক্তপোষের উপর দারোগা সাহেবের সেরেস্তা হইয়া থাকে। ঘরের ভিতরে সারি সারি খাটিয়া পাতা আছে ও তাহাতে অনেকগুলি লোক কেবলমাত্র একটি লেংটীতে লজ্জা নিবারণ ক’রে সেই খাটিয়ার উপর বিরাজমান আছে ও নানাপ্রকার অভদ্রোচিত ইতর ভাষায় পরস্পরে কথাবার্ত্তা কহিতেছে। ঘরের আসবাবের মধ্যে সত্যকালের গোটা দুই জলের কুঁজো, খান কয়েক শানকি, চারিটী বদনা, একটা কানা ভাঙ্গা ও দুটো আস্ত কাঁচের গেলাস, কাহন খানেক মেটে বিদরির গুড়গুড়ি ও একটি ঢোল টাঙ্গান রয়েছে।
আমি একটা খাটিয়ার উপর বসিলাম, কেহ আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিল না, আমার সঙ্গী বরকন্দাজদ্বয় ঝাঁকের কইএর মত ঝাঁকে গিয়া মিশিল ও খোদ বদরুদ্দিন খাঁ একটা খাটিয়ায় বসিয়া মেটে গুড়গুড়িতে তামাক খাইতে আরম্ভ করিল।
আমি সেই খাটিয়ার উপর বসিয়া নিজ মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম যে, কোথায় মনের ভয়ানক সন্দেহ মেটাবার জন্য নিতান্ত চিন্তাকুলিতচিত্তে মোহিতবাবুর সন্ধানের জন্য জয়গোপাল উকীলের বাসায় যাইতেছি, না পথ হ’তে বরকন্দাজেরা আমাকে গ্রেপ্তার ক’রে এখানে আটক ক’রে রাখলে; কৈ আমার জীবনে এমন তো কোন অসৎ কার্য্য করি নাই যে, তার জন্য এরা আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারে, তাহলে কি অপরাধের জন্য আমাকে ধরিয়া আনিল? কে আমাকে অপরাধী বলিয়া নিসিন্দি করিল বা আমার বিরুদ্ধে কোতয়ালিতে অভিযোগ আনিল, আমি ত কখন কাহার কোন অপকার করি নাই। তবে একটা কথা না বলিয়া কিষণজি বাবুর বাড়ী হ’তে পলাইয়া আসিয়াছি, কিন্তু তার জন্য কোতয়ালির সরকারি বরকন্দাজে চোর খুনে ডাকাতদের ন্যায় আমাকে গ্রেপ্তার করিল কেন? কিষণজি বাবু কি রাগের বশে আমাকে চোর ব’লে গ্রেপ্তার করালে, তাই কি সম্ভব? হয় তো পাপাত্মা দেবীপ্রসাদের নিকট সন্ধান পেয়ে তলে তলে তিনিই আমার বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র ক’রেছেন, তারপর ঘটনাক্রমে আমি নিজেই এসে তাদের জালে পতিত হ’লাম। সামান্যরূপ আলাপে কোতয়ালির শান্তিরক্ষকদের যে প্রকার পরিচয় পাইলাম, তাতে বেশ বোধ হ’লো যে, টাকা খরচ করলে, একজন দোষীকে ছাড়ানো ও অন্য আর একজন নির্দ্দোষীকে বাঁধানো যেতে পারে, সুতরাং কিষণজি বাবু যে, টাকা খরচ করে আমাকে বিপদে ফেলবেন তার আর বিচিত্র কি? কিন্তু বাড়ী হ’তে পালানো অপরাধের জন্য তাঁর মনে কি এতদুর আকোচ হবে যে, ঘর হ’তে টাকা খরচ ক’রে আমাকে গ্রেপ্তার করাবেন? আমি তো তাঁর নিকট কোন গুরুতর অপরাধ করি নাই, বরং চিরকাল তাঁহার আজ্ঞাবহ ছিলাম, তিনি ও গিন্নি উভয়ে আমাকে পুত্ত্রের ন্যায় স্নেহ করতেন; সুতরাং এই সামান্য অপরাধের জন্য তিনি কি আমার উপর এতদূর বিরূপ হবেন, একেবারে চোর ডাকাতের ন্যায় গ্রেপ্তার করিয়ে দেবেন? তাই কি, দেবীপ্রসাদ আমাকে নিসিন্দি করবার জন্য বরকন্দাজদের সঙ্গে এসেছিল, তারপর পথের মাঝে আমাকে দেখিয়ে দিয়ে গলির ভিতর স’রে পড়লো? ফলকথা, দারোগা মহাশয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ না হ’লে আমার মনের এই সকল সন্দেহ মিটবে না; প্রকৃত ব্যাপারখানা কি, কোন্ মহাত্মা আমার প্রতি এতাদৃশ অনুগ্রহ প্রকাশ করলেন, তা ঠিক বুঝতে পারবো না।
আমি সেই খাটিয়ায় ব’সে মনে মনে এই সব কথা ভাবছি, বরকন্দাজগুলো পরস্পর বেছুট কথাবার্ত্তা কইছে, সকলের মুখ দিয়ে অশ্লীল কথার স্রোত বইছে, গাঁজার ধোঁয়ায় ঘরের মধ্যে মেঘ জমিবার উপক্রম হ’য়েছে, এমন সময় একটা লোক আসিয়া খবর দিল দারোগা সাহেব আসছেন।
এই কথা শুনে সকলেই একটু চুপ করিল, আমার বুকটা গুর্ গুরু করিয়া উঠিল। এমন সময় একখানা ধুতি দোফেরতা দিয়ে কোমরে জড়িয়ে, খড়ম পায়ে দিয়ে খোদ দারোগা সাহেব তাঁহার সেরেস্তার কাছে একখানি বড় কাঠের চৌকির উপর উপবেশন করিলেন।
তখন বেলা প্রায় দশটা অতীত হইয়াছে; কিন্তু দারোগা মহাশয় এইমাত্র বোধ হয় কাঁচা ঘুমে উঠিয়া আসিয়াছেন। শয্যা ত্যাগ করিয়া এখনো জল স্পর্শ করেন নাই, খাটিয়া হ’তে বরাবর কোতয়ালিতে আসিয়াছেন।
দারোগা মহাশয়ের বয়স চল্লিশ কি পঞ্চশের অধিক হবে না। বর্ণ টুকু বেশ কুচকুচে কালো ও লোকটা মুগুরে মটকির ন্যায় বেঁটে, সংসারে বেঁটে মুসলমান সম্বন্ধে যে খ্যাতি প্ৰচলন আছে, তাহা যে সম্পূৰ্ণ সত্য, তাহা দারোগা সাহেবের শ্রীমুখকমল সন্দর্শনে স্পষ্ট প্রতীত হইয়া থাকে। কেন না ঘোর নিষ্ঠুরতা ও স্বার্থপরতার স্পষ্ট চিহ্ন সকল তাহাতে বিদ্যমান আছে। দারোগা সাহেবের হাত-পাগুলি তাহার দেহের অনুরূপ, কিন্তু বেশ সুদৃঢ় ও মাংসল, বক্ষস্থল ঘন লোমে আচ্ছাদিত ও ভূঁড়িটা মাঝারি ধরণের ছিল। যেমন একটা প্রকাণ্ড ঢাকাই জালার মুখে খুব বড় একটা ছিপি থাকে, তেমনি তাহার মুখখানি বাটীর মত গোল ও মা শীতলার চিরস্থায়ী অনুগ্রহের চিহ্নে চিহ্নিত। কাণ দুটী ছোট, নাকটী টেয়াপাখীর ঠোঁটের মত থাবড়া ও ঠোঁট দুখানি বোধ হয় কাফ্রিদের নিকট হ’তে হাওলাত ক’রে নিয়েছিল। দারোগা মহাশয়ের শ্রীমুখে পুরুষের প্রধান শোভা গোঁফ দাড়ির নাম মাত্র ছিল না, সেইজন্য বোধ হয় দেহেতে লোমই ক্ষতিপূরণ করিয়াছে, কেবল লম্বা জুলপীটাতে তাহার মুখের ভীষণ ভাব আরো বৃদ্ধি ক’রেছে।
দারোগা সাহেবের ঘুমের ঘোর এখনো সম্পূর্ণরূপে কাটে নাই, সেইজন্য চোখ বুজাইয়া পাথরের গড়া মুরদের ন্যায় চৌকীর উপর বসিয়া রহিলেন, তাহার দুই চক্ষের ধারে এক ধাপড়া পিচুটী জমিয়া রহিল ও দুকস্ দিয়া পানের পিচ গড়াইয়া মুখের বাহার আরও বৃদ্ধি করিয়া তুলিল।
দারোগা সাহেব সেইরূপ ধ্যানস্থ অবস্থায় বসিয়া আছেন, এমন সময় একজন চাকর আসিয়া গুড়গুড়িতে তামাক আনিয়া দিল ও নলটা ধ্যানন্দস্থ প্রভুর হাতে ধরাইয়া দিল।
দারোগা সাহেব একটা লম্বা গোচের হাই তুলিয়া নলটী মুখে পুরিলেন এবং সেইরূপ মুদ্রিত চক্ষে খুব মোলামভাবে টানিতে লাগিলেন।
দারোগা সাহেব সজীব হ’য়েছেন দেখে, বদরুদ্দিন খাঁ তাঁর কাছে গিয়ে চুপি চুপি কি বলিল, দারোগা সাহেব কেবল ঘাড় নাড়িয়া তাহার কথায় সায় দিল।
এইবার বদরুদ্দিন খাঁ আমার কাছে আসিয়া কহিল, “দারোগা সাহেবের কাছে চল, তিনি তোমাকে ডাক্ছেন।”
সহসা এই কথা শুনিয়া আমার সর্ব্বশরীর কণ্টকিত হইয়া উঠিল, বুক গুরগুর্ করিতে লাগিল এবং একপ্রকার অব্যক্ত ত্রাসে আমার চিত্ত আক্রান্ত হইল। আমি অতি কষ্টে প্রাণের এই বিপ্লবকে প্রশমিত করিয়া ফেলিলাম। মনে করিলাম, ভাল হোক্ আর মন্দ হোক্, প্রকৃত ব্যাপারখানা কি তাহা জানিতে হইবে যে, আমি কাহার সুখের পথের কণ্টক হইয়াছি। আমাকে বিপদে ফেলা কাহার অভিপ্রেত, তাহাও বুঝিতে বাকী থাকিবে না; সুতরাং মনের এই প্রদীপ্ত সন্দেহানল নিৰ্ব্বাপিত হইবে। আমি এই আশ্বাসে সন্ধিপূজার পাঁঠার ন্যায় কাঁপিতে কাঁপিতে দারোগা সাহেবের নিকট উপস্থিত হইলাম, বদরুদ্দিনও আমার পাশে গিয়া দাঁড়াইল। দারোগা সাহেব অতি কষ্টে কুঁচের ন্যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চক্ষু দুটী তুলিয়া বক্র দৃষ্টিতে আমার আপাদমস্তক দেখিয়া বদরুদ্দিনকে কহিল, “এতো ছোরা হ্যায়।” বদরুদ্দিন একটু অগ্রসর হ’য়ে উত্তর করিল, “লেকিন হুজুর! এ বহুত বদমাইস্ লেড়কা হ্যায়, হাম্ জান্কা আশ ছোড়কে বহু তক্লিফ মে উস্কো গ্রেপ্তার কিয়া হ্যায়।”
বদরুদ্দিন মিয়ার এই কথা শুনে সেই বিপদের সময়ও ঈষৎ হাস্যের রেখা আমার অধর প্রান্তে প্রকটিত হইল। কারণ আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য যে, এই বরকন্দাজ কুলতিলক কি তকলিফ ভোগ করলেন বা কিরূপে জানের মায়া কাটালেন, তা আমি কিছুতেই বুঝিতে পারিলাম না। ফলকথা ঈশ্বরের রাজ্যে এই অভাগারা মিথ্যা কথায় এ প্রকার অভ্যস্ত যে, স্রোতের ন্যায় অনর্গল তাদের মুখ হ’তে মিথ্যা কথা বহির্গত হয়ে থাকে। মিথ্যা কথা বলায় যে কোন পাপ আছে, তাহা ইহারা আদৌ স্বীকার করে না, কেবল বন্ধন শূন্য বলিবর্দ্ধের ন্যায় উদ্দাম ভাবে সংসারক্ষেত্রে বিচরণ ক’রে থাকে।
দারোগা সাহেব তামাক খেতে খেতে খুব মিহি সুরে কহিল, “কেমন ঠিক, আদমি তো গ্রেপ্তার করেছো? দেখো যেন বখরা খাড়া না হয়।”
বদরুদ্দিন মা কালীর মত আধ হাত জীব বাহির ক’রে উত্তর করিল, “তোবা তোবা, খোদাতাল্লার হেকমতে মোরা ঠিক আদমি গ্রেপ্তার ক’রেছি। মোদের কামে যে দিন ভুল হবে, সে দিন কোরাণ সরিফ অবধি ঝুট হ’য়ে যাবে।”
দারোগা সাহেব পুনরপি সেই প্রকার ঝিম্ আওয়াজে কহিল, “তাহ’লে আসামীকে নিসান্দাই কে করলে?”
আমি যদিও এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য কাণ খাড়া করিয়া রহিলাম, কিন্তু বদরুদ্দিন দারোগা সাহেবের কাণে কাণে এমনি আস্তে আস্তে কথা কহিল যে, আমি তাহার এক বর্ণও বুঝিতে পারিলাম না।
দারোগা সাহেব আর একবার আমার দিকে বক্রদৃষ্টি ক’রে বদরুদ্দিনকে কহিল, “তাহ’লে আসামীকে কিছু নাস্তা খাইয়ে আজ হাবুজখানায় ভেজে দাও। ছোরা যখন বহুত বদমাইস আছে, তখন কোতয়ালির ফাটকে রাখবার দরকার নাই, কাজী সাহেবের কাছে এর এনসাফ হবে।”
ন্যায়পরায়ণ দারোগা মহাশয়ের এই ঢালা হুকুম শুনিয়া অবাক্ হইয়া পড়িলাম। আমার মস্তকে যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হইল। আমার অন্তর মধ্যে যে আশার ক্ষীণ আলোক ধিক্ ধিক্ করিয়া জ্বলিতেছিল, তাহা সম্পূর্ণরূপে নিৰ্ব্বাপিত হ’য়ে গেল, কাজেই আমি তখন চতুর্দ্দিকে অন্ধকার দেখিতে লাগিলাম। আমি আর কোন উপায় না দেখে যুক্তকরে কাঁদ কাঁদ স্বরে দারোগা সাহেবকে কহিলাম, “হুজুর! কিজন্য আমাকে গ্রেপ্তার করা হইল, আমার অপরাধ কি অনুগ্রহ ক’রে আমাকে বলুন? আমি প্রকৃত ব্যাপার বুঝিতে পারি নাই; বোধ হয় ভুলক্রমে আমাকে ধরা হ’য়েছে, প্রকৃত অপরাধী আমি নহি।”
আমার এই কথা শুনে দারোগা সাহেব একবার ষোল আনা চেঁচিয়ে চেয়ে দেখে তাহার স্বভাবসিদ্ধ রুক্ষ্ম স্বরে কহিল, “মোদের কামে কখন ভুল হয় না। তোম্ বহুত বদমাইস হ্যায়, তোমরা কসুরকা বাত পরোয়ানা মে লিখা হ্যায়; আবি হামকো দিক্ মৎ কিয়ো, হামরা তবিয়ৎ বহুত মন্দা হ্যায়।”
দারোগা সাহেব এই কথা ব’লে আবার চোখ বুজিয়ে তামাকে মনোনিবেশ করিলেন, আমিও বদরুদ্দিনের সঙ্গে গৃহ মধ্যে এসে পুনরায় সেই খাটিয়ার উপর বসিলাম ও গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হইলাম।
আমি মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, “আমার ভাগ্যে একি দুৰ্দ্দৈব হইল, এক কিষণজি বাবুর বাড়ী হ’তে না ব’লে পলায়ন করা ভিন্ন এ জীবনে আমি তো আর কোন অপরাধ করি নাই; তবে আজ আমি সহসা এরূপ ভয়ানক বিপদে পতিত হ’লাম কেন? দারোগা কি বরকন্দাজদের সঙ্গে আমার কোন বিবাদ নাই, এরা কখনই স্বইচ্ছায় আমাকে গ্রেপ্তার করে নাই, নিশ্চয় অন্য কোন লোকের ষড়যন্ত্রে মিথ্যাকে সত্যজ্ঞানে কর্ত্তব্য বোধে আমাকে ধৃত করিয়াছে। কিন্তু দারোগা সাহেবের এ কিপ্রকার অদ্ভুত কর্ত্তব্য বোধ, আমার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ না নিয়ে বদরুদ্দিনের গোটাকয়েক চুপি চুপি কথা শুনে আমাকে প্রকৃত দোষী ব’লে কি ক’রে স্থির করলেন? আমি কি অপরাধ ক’রেছি, তাহা এ পর্য্যন্ত বলেন না কেন? ভাবে বোধ হ’লো যেন পূৰ্ব্ব হ’তেই সব ঠিক্ঠাক্ বন্দোবস্ত করা ছিল, কিন্তু তাহ’লেও আমি খুন করেছি, কি ডাকাতি ক’রেছি, তা আমাকে স্পষ্ট ক’রে বললেন না কেন? এ কি রকম আশ্চর্য্য ব্যাপার, এরা কি এইরূপেই দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন ক’রে থাকে। দেশের শান্তিরক্ষকের এই কি উপযুক্ত কাজ? কোতয়ালিতে আসিয়া যেটুকু দেখিলাম, তাতে বেশ বুঝতে পারলাম, বড় বড় অপরাধীরা টাকার জোরে ও যোগাড়ের গুণে পদে পদে অপরাধ ক’রে নিষ্কৃতি পায়, আর নির্দ্দোষ দরিদ্রেরা দোষ না করিয়াও কেবল আইনের মর্য্যাদা রক্ষা হবার জন্যে তাদের স্থলাভিষিক্ত হ’য়ে এই মহাপুরুষদের কৃপায় দণ্ডভোগ ক’রে থাকে। ধর্ম্মের জয়, অধর্ম্মের ক্ষয়, এ রাজ্যে এখন কথার কথা হ’য়ে পড়েছে; দেশের শাসনকর্ত্তা যদি ঈদৃশ কাণ্ডজ্ঞানশূন্য অর্থলোলুপ নীচাশয়দের শান্তিরক্ষা কার্য্যে নিযুক্ত ক’রে নিশ্চিন্ত না হতেন, বিচারের নামে এ প্রকার ঘোর ব্যাভিচার যদি না ঘটিত, তাহ’লে মুসলমানদের রাজলক্ষ্মী এত শীঘ্র তাদের আশ্রয় ত্যাগ করতেন না, বা ক্ষুদ্র-দ্বীপবাসী একদল বণিক বাণিজ্য করতে এসে একেবারে রাজ্যেশ্বর হ’য়ে পড়তো না। কেবলমাত্র পাপে, অবিচারে ও বিলাসিতার আতিশর্য্যে মুসলমান রাজত্বের পতন হ’ল। যেরূপ গতিক দেখিতেছি, তাহাতে বোধ হ’চ্ছে যে, এখন মুসলমান রাজত্বের যে সামান্য নিদর্শনটুকু আছে, আর দু-এক বৎসর পরে তাহার নাম মাত্র থাকিবে না। যদি নবাব বাহাদুরের অস্থিত্ব থাকে, তবে তিনি ঠুটো জগন্নাথের ন্যায় নিশ্চলভাবে অবস্থান করিবেন, দেশের প্রকৃত মালীক ইংরাজ বাহাদুরেরাই হইবেন; কারণ খোদ দিল্লীর বাদশাহ এক্ষণে ভিক্ষুকবেশে তাহাদের প্রসাদ লাভের জন্য লালায়িত।
আমি সেই খাটিয়ার উপর ব’সে এক মনে নিজের অবস্থার বিষয় ভাবছি, নিজে নির্দ্দোষ ব’লে পূর্ব্বে যে একটু সাহস ছিল, দারোগা সাহেবের ব্যবহার দেখে সেটুকু এখন লয় হইয়া গেল, কাজেই প্রাণে বিশেষ ভয়ের সঞ্চার হ’য়েছে। জগতে আমার কিছুমাত্র সম্পত্তি নাই, সুতরাং তখন সেই অসহায়ের সহায়, দুর্ব্বলের বল ভগবানকে একমনে ডাকিতে লাগিলাম এবং সকল প্রকার অনিত্য-চিন্তাকে বলপূর্ব্বক চিত্তভূমি হ’তে দূর করিয়া দিলাম।
প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে একজন হিন্দুস্থানি বরকন্দাজ চাট্টি চিড়ে ও মুড়কি এবং পেতলের ঘটীতে ক’রে খানিকটা জল আমাকে আনিয়া দিল। আমি চিড়ে মুড়কিতে হাত পর্য্যন্ত দিলাম না, তবে ভয়ানক পিপাসায় আমার কণ্ঠদেশ অবধি শুষ্ক হইয়াছিল, কাজেই এক ঘটি জল এক নিশ্বাসে পান করিয়া ফেলিলাম।
বেলা আন্দাজ দুটার সময় আমার পূর্ব্ব পরিচিত বদরুদ্দিন ও আর একজন নূতন বরকন্দাজ আমাকে লইয়া কোতয়ালি হ’তে বাহির হইল। আমি তাদের জিজ্ঞাসা ক’রে জ্ঞাত হইলাম যে, তারা আমাকে দারোগার আদেশে হাবুজখানায় লইয়া যাইতেছে।
ভাগ্যে যা আছে তাই হবে, এই মনে ক’রে স্রোতে গা ঢালিয়া দিলাম এবং আকস্মিক এই মহাবিপদ হ’তে রক্ষা পাইবার জন্য ঐকান্তিকভাবে বিপদবারণ মধুসূদনের নাম মনে মনে জপ করিতে লাগিলাম।