- হরিদাসের গুপ্তকথা
- প্রথম পরিচ্ছেদ : কিসের মন্ত্রণা?
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : এরা কে?
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল!
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ : আজব চিঠি!
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাবু দেবীপ্রসাদ।
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : ভয়ানক ব্যাপার!
- সপ্তম পরিচ্ছেদ : বিষম সন্দেহ।
- অষ্টম পরিচ্ছেদ : আলেকসাই ফকির।
- নবম পরিচ্ছেদ : পীরের দরগা।
- দশম পরিচ্ছেদ : মোহিত বাবু।
- একাদশ পরিচ্ছেদ : ভূঁড়ো-কর্ত্তা।
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : গুণের খানসামা।
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মাষ্টার মহাশয়।
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : গোমিস্ সাহেব।
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : আখড়া।
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ : গ্রেপ্তার।
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : দারোগা সাহেব।
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : হাজত বা হাবুজখানা।
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল।
- বিংশ পরিচ্ছেদ : হাজতে দ্বিতীয় রাত্রিবাস।
- একবিংশ পরিচ্ছেদ : আমার বিচার।
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ : বিচারালয়।
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ : এ কথা কি সত্য?
- চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ : ব্রহ্মচারী মহাশয়।
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ : গুপ্তকথা।
- ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ : পাপের পরিণাম।
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ : নবাব বাহাদুর।
- অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ : নীলমণি বসাক।
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ : উদ্যোগপৰ্ব্ব।
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ : আশা মিটিল।
- একত্রিংশ পরিচ্ছেদ : দীক্ষা।
- দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ : লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু।
- উপসংহার
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
গ্রেপ্তার।
যদিও সে দিন আমি পথশ্রমে নিতান্ত কাতর হ’য়ে প’ড়েছিলাম, কিন্তু তথাপি সৰ্ব্বসন্তাপহারিণী নিদ্রাদেবী আমার নিকটস্থ হ’লেন না। আখড়ার রজব আলি ও সর্দ্দারের কথাগুলি স্মৃতিপথে উদয় হ’য়ে আমাকে নিতান্ত অশান্তির কবলে নিক্ষেপ করিল। আমি এক মনে কেবল সেই সকল কথা তোলাপাড়া করিতে লাগিলাম, পাপিষ্ঠদের কথার ভাবে বোধ হ’ল যে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপূর্ব্বক কোন কুল-ললনাকে ধ’রে আনাকে মাল টপকানো বলে। কিন্তু দেশে দণ্ডমুণ্ডের কর্ত্তা প্রজারঞ্জন রাজা থাকতেও কি এ প্রকার ঘোর অপকার্য্য হ’তে পারে? আর মোহিতবাবুই কি এতদূর নীচাশয় পশু হবেন, যে পঞ্চাশ টাকা খরচ করে কোন কুলস্ত্রীকে ধ’রে আনাবেন, যদি ইহা সত্য হয়, তাহ’লে পাপিষ্ঠ মোহিতবাবুর পতনের আর অধিক বিলম্ব নাই, সর্প দংশনের ন্যায় সতীর অভিশাপে তাকে নিশ্চয় ধ্বংশ হ’তে হবে। কারণ দেবতা পর্য্যন্ত সহায় হ’লে সতীর কোপ হ’তে কাহাকেও রক্ষা করতে পারে নাই। সহসা আমার সেই আরমেনিয়ান মাষ্টার গোমিস্ভ্রাতা রোজিয়োর কথা স্মরণপথে উদয় হইল। তিনি পড়াইতে পড়াইতে আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন যে, মুর্শিদাবাদের কোন গৃহস্থ কন্যার সহিত মোহিতবাবুর আস্নাই আছে কি না? তিনি তো একদিনের জন্য কখন ওরকম ভাবের কোন কথা বলেন নাই, তাহ’লে তিনি আমাকে এ কথা কেন জিজ্ঞাসা করলেন? নিশ্চয় এ সম্বন্ধে কোন কথা তিনি শুনেছিলেন, কিন্তু আমার কাছে কোন কথা ভাঙ্গলেন না। আমি পেড়াপেড়ি করলে, তিনি পাঁচটা বাজে কথায় আসল কথাটা চাপা দিয়ে ফেল্লেন। যা’হোক্ কাল প্রাতঃকালে সহস্র কাজ ত্যাগ ক’রে একবার মুরশিদাবাদে গিয়ে মোহিতবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে, তা না হ’লে আমার এই ভয়ানক সন্দেহ কিছুতেই মিটবে না। পাছে পারানির জন্য দু-পয়সা বাজে খরচ করতে কর্ত্তা অসন্তোষ হন, এই জন্য তাঁকে কোন কথা না জানাইয়া গোপনে জয়গোপাল উকীল মশায়ের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হব স্থির করিলাম। বিশ্বাস মোহিতবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারলে, ব্যাপারখানা বুঝতে পারবো। যদি তরলমতি অস্থিরচিত্ত মূর্খ মোহিতবাবু পাপাত্মাদের প্ররোচনায় এ প্রকার ভয়ানক অপকৰ্ম্মে লিপ্ত হ’য়ে থাকেন, তাহ’লে যে কোন উপায়ে হোক্ এই সৰ্ব্বনেশে সঙ্কল্প হ’তে তাকে নিরস্ত করা আমার একান্ত কর্ত্তব্য। আমি উপস্থিত থাকলে তিনি কখনই এমন ভয়ানক অপকৰ্ম্ম করতে পারবেন না। ইতিপূর্ব্বে মোহিতবাবুর যে প্রকার মেজাজের পরিচয় পেয়েছি, তাতে আমার বিশ্বাস হয় যে, আমার কথা তিনি একেবারে অগ্রাহ্য করতে পারবেন না। যাই হোক, আমার একবার মুরশিদাবাদে যাওয়া খুব আবশ্যক, সেখানে না গেলে কোন বিষয়ের মীমাংসা হ’চ্ছে না, বা আনার মনের সন্দেহ ও প্রাণের উৎকণ্ঠা কিছুতেই মিটছে না। কাজেই কাল সকালে, কাকেও কিছু না বলে মুরশিদাবাদ উদ্দেশে যাত্রা করিব।
আমি মনে মনে এই মতলব ঠিক ক’রে প্রায় এক প্রকার জাগ্রত অবস্থায় রাত্রি যাপন করিলাম এবং খুব প্রত্যুষে উঠিয়া মুরশিদাবাদ উদ্দেশে রওনা হইলাম।
মানুষের মনের ইচ্ছা, অন্তরের কামনা, অনেক সময় সিদ্ধ হয় না। প্রবাহিনীর খর প্রবাহে বালির বাঁধ কোন নিমিষ মধ্যে অদৃশ্য হ’য়ে যায়, তেমনি মানুষ কল্পনা বলে একটা স্থির ক’রে রাখে, কিন্তু ভাগ্য বিপর্য্যয়ে কি ঘটনাচক্রে, অন্য একটা অভাবনীয় অচিন্তনীয় প্রলয়কাণ্ড সংঘটিত হ’য়ে থাকে। আবার যে বিষয় কখন স্বপ্নেও মনে উদয় হয় নাই, তেমনি বিচিত্র ব্যাপার প্রত্যক্ষ ঘটিয়া থাকে। স্বভাবের অকাট্য নিয়মানুসারে প্রত্যেক রাত্রির পর প্রভাত হয়; কিন্তু এই প্রভাত কাহার ভাগ্যে সুপ্রভাত কি কুপ্রভাতে পরিণত হ’য়ে থাকে। তবে কবে যে কাহার ভাগ্যে কি ঘটনা ঘটে, তা স্থির করবার ক্ষমতা কাহার নাই; কারণ ভবিষ্যত মাত্ৰই অন্ধকারের পথে; মানুষ এক ভাবে, কিন্তু কার্য্যক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হয়, সুধায় বিষ উঠে, যা কল্পনায় ভাবে নাই, স্বপ্নেও দেখে নাই, তেমন ভয়ানক ব্যাপারে অভিভূত হ’য়ে পড়ে। সেই জন্য প্রত্যেক প্রভাত কাহারও ভাগ্যে সুপ্রভাত ও কাহারও কুপ্রভাত হ’য়ে থাকে। কেউ বা আশার অতিরিক্ত রত্নরাজি লাভ ক’রে আনন্দে উৎফুল্ল হয়, আবার কেউ বা বিপদ সাগরে নিমগ্ন হ’য়ে হাবুডুবু খায়।
আমি মনে মনে দুর্গামাম স্মরণ ক’রে বাটী হ’তে বাহির হলাম। মনের নিতান্ত ইচ্ছা যে, মোহিতবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ ক’রে প্রকৃত ব্যাপারখানা কি জানিয়া আসিব, কিন্তু ঘটনাক্রমে আমার ভাগ্য-তরুতে আজ যে কি ফল ফলিল, তাহা আমার কৃপাময় পাঠক মহাশয়েরা দেখিতে পাইবেন ও অপার বিস্ময় সাগরে নিমগ্ন হইবেন।
ক্রমে আমি গঙ্গাতীরে আসিয়া উপস্থিত হইলাম এবং পার হইবার জন্য একখানি নৌকার উপরে উঠিলাম। আমাদের নৌকায় আরোহীর সংখ্যা পূর্ণ হইয়া গেল, কাজেই মাঝি নৌকাখানি ছাড়িয়া দিল, দাঁড়িরা দাঁড় টানিতে আরম্ভ করিল, নৌকাখানি তরঙ্গরাশি ভেদ করিয়া নাচিতে নাচিতে অগ্রসর হইতে লাগিল।
মাঝির আদেশমত আমি বাহির হইতে নৌকার ভিতর গিয়া বসিলাম এবং দেখিলাম যে, জোন সাহেবের বাজারের সম্মুখে যে যুবক পাগলামি করিতেছিল, সেই এই নৌকায় একেবারে চুপ করিয়া বসিয়া আছে। আমি পূর্ব্বে ইহাকে যে প্রকার বেশ-ভূষায় দেখিয়াছিলাম, এখন তাহার কিছুমাত্র পরিবর্ত্তন হয় নাই এবং মলিন নেকড়ায় বাঁধা দপ্তরটি বগলে রহিয়াছে। ইতিপূর্ব্বে এই যুবক সম্বন্ধে আমার মনে একটা সন্দেহ হ’য়েছিল, তাহার সঙ্গে দু-চারটা কথা বলিবার সাধ আমার মনোমধ্যে নিতান্ত প্রবল হ’য়েছিল, কিন্তু উন্মত্ত যুবক তীরের ন্যায় সহসা অদৃশ্য হওয়ায় আমার বাসনা পূর্ণ হয় নাই। এক্ষণে এই নৌকার যুবককে দেখিয়া তাহার বর্ত্তমান অবস্থা সম্বন্ধে দু-চারটা কথা তাহাকে জিজ্ঞাসা করবার সাধ আমার মন মধ্যে নিতান্ত প্রবল হইয়া উঠিল, আমি কিছুতেই আমার মনের এই কৌতূহলকে দমন করিতে পারিলাম না।
আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করবার অভিপ্রায়ে আমি আস্তে আস্তে সেই যুবকের পাশে গিয়া বসিলাম এবং নিতান্ত বিনীতভাবে কহিলাম, “ভাই তোমার দপ্তরের ভিতর কি আছে?”
যুবক আমার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়া কেবল উদাস ভাবে আমার দিকে চাহিয়া রহিল এবং পাছে আমি তাহার দপ্তর কাড়িয়া লই বোধ হয় এই আশঙ্কায় তাহার সেই বহুমূল্য দপ্তরটি অতি সন্তর্পণে বগলের মধ্যে চাপিয়া ধরিল। আমি পুনর্ব্বার সেই কথা জিজ্ঞাসা করিলে, যুবক চীৎকার ক’রে কহিল, “এতে সব দলিল আছে, বাগানের দলিল, বাড়ীর দলিল, তালুকের দলিল, সব দলিল এতে মজুত আছে। আমি এগুলি নিয়ে একবার দিল্লীর বাদশা ও ইংরাজদের রাজার কাছে যাব, দেখি তারা কি বিচার করে, ও শালার ভূঁড়ি ফাঁসাতে আমাকে হুকুম দেয় কি না। ও তুমিও বুঝি সাহেবের লোক, তাহ’লে তোমাকে বলে তো ভাল করিনি। তুমি যখন সাহেবের লোক, তখন তুমি সব পার; কিন্তু তুমি আর কি নেবে, আর তো কিছুই নাই, সব গেছে, জন্মের মতন গেছে, কেবল জ্বলবার জন্য আমি আছি।” এই কথা বলতে বলতে অভাগা যুবকের চক্ষু দিয়ে অশ্রুজল গড়াইয়া পড়িল।
আমার মনে বড় কষ্ট বোধ হইল, আমি আমার নিজের চিন্তা বিস্মৃত হ’য়ে এই ভাগ্যহীন যুবকের শোচনীয় অবস্থার বিষয় ভাবিতে লাগিলাম। যুবক নিজের সেই মলিন চাদরে চক্ষু দুটী মুছিলে আমি খুব মোলায়েম ভাবে কহিলাম, “আমি শপথ ক’রে বলছি, আমি কোন সাহেবের লোক নই। আমার দ্বারায় তোমার উপকার ভিন্ন অপকার হবে না।”
আমার কথায় বাধা দিয়ে সেই যুবক উচ্চৈস্বরে কহিল, “মানুষ কখন কি মানুষের উপকার করে; না, না, কেউ করে না। টাকা না থাকলে, দুৰ্ব্বল হ’লে মানুষ আর একজন মানুষের মাথা কড়াই ভাজার মতন কড়মড় ক’রে চিবিয়ে খায়। মার শালাকে মার, শালাকে কেটে ফেল, তরমুজের মতন শালার ভুঁড়িটা ফাঁসিয়ে দে!” এই কথা ব’লে সেই নৌকার উপর বিরাশি সিক্কা ওজনের এক কিল মারিল, কাজেই নৌকা কাঁপিয়া উঠিল ও আরোহী সকলে ভীত হইল। পাছে পাগল গঙ্গার মাঝখানে ক্ষেপিয়া ওঠে ও তজ্জন্য নৌকা ডুবিয়া যায়, এই আশঙ্কায় পাগলের সহিত কথা কহিতে সকলে আমায় নিষেধ করিল। কাজেই আর আমি তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। মনে করিলাম যে ওপারে গিয়া যুবকের সঙ্গে কথাবার্ত্তায় প্রবৃত্ত হব, রাস্তার উপর মাঝে মাঝে ক্ষেপিয়া উঠিলেও বিশেষ কোন ক্ষতি হইবে না। আমি এই মনে মনে স্থির করিয়া তখনকার মতন চুপ করিলাম, যুবককে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। যুবক আপনাআপনি খানিকক্ষণ বকিয়া নিজেই চুপ করিল এবং দলিলপূর্ণ দরপ্তটী অতীব যত্নের সহিত বগলের মধ্যে লুকাইয়া রাখিল। কারণ আমি যে কোন সাহেবের লোক, পাছে কাড়িয়া লই, এই আশঙ্কা বোধ হয় পাগলের মনে প্রবল হ’য়েছিল। তাহার সাত রাজার ধন মাণিক বিশেষ সেই দপ্তরটি নীচে নামাইয়া রাখিতে সাহসে কুলাইল না।
ক্রমে নৌকাখানি পরপারে গিয়া উপস্থিত হইল। আরোহীগণ একে একে নামিয়া গেল, আমি যুবকের পিছু পিছু চলিলাম এবং গঙ্গার তীর ছাড়াইয়া রাস্তার উঠিলাম।
যুবক আপনার মনে গোঁভরে চলিতেছে, কোনদিকে আদৌ লক্ষ্য করিতেছে না, সুতরাং প্রথমেই আমাকে মুখ খুলিতে হইল। আমি নিকটে গিয়া খুব নম্রভাবে কহিলান, “আপনি এখন কোথায় যাবেন?”
যুবক আমার মুখের দিকে কট্কট্ ক’রে চেয়ে, উদাসভাবে কহিল, “এ কথা জিজ্ঞাসা কচ্ছো কেন? তুমি কি সাহেবের কুটীতে আটক ক’রে রাখবে, এখনও কি দাদনের টাকা পরিশোধ হয় নাই? দেখছি তুমি বাঙ্গালীবাবু কাজেই সাহেবের জন্য নিরীহ তাঁতির বুকের রক্ত চুষে নিতে কখনই তোমার কিছুমাত্র মমতা হবে না।”
যুবকের কথায় আমার চক্ষে জল এলো, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে, ভীষণ নিৰ্য্যাতনে কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হ’য়ে, অন্তসার শূন্য সাহেবের পদ লেহন প্রার্থী, নীচাশয় সমাজদ্রোহী বাবু জাতীয় বাঙ্গালীর উপর সে হাড়ে চটিয়া গিয়াছে, সকল প্রকার অপকর্ম্মের নায়ক ব’লে তাহাদিগকে তাহার বিশ্বাস হ’য়েছিল। সেই জন্য আমাকে বাবু বেশধারী বাঙ্গালী দেখে যুবকের মনে ঈদৃশ সন্দেহের উদয় হইল। প্রকৃতপক্ষে সেই সময়কার দেশীয় কুলাঙ্গারেরা যদি অতিলোভী সাহেব বণিকদের শোষণ কার্য্যে সহায়তা না করিত, লোকের সর্ব্বনাশের উপায় না বলিয়া দিত, তাহ’লে দেশ এত শীঘ্র এরূপ উৎসন্নের পথে উপনীত হইত না, শত শত শ্রমজীবি সম্পন্ন শিল্পীর বৃক্ষতল সার হইত না, এই নীচাশয়েরা নীচ স্বার্থের জন্য নালা কাটিয়া স্বগৃহে কুমীর আনিল; জগতে এককালীন দেশদ্রোহী ও সমাজদ্রোহী নাম কিনিল এবং অজ্ঞতার প্রত্যক্ষ ফল স্বরূপ শেষে নিজেরাই স্বখাদ সলিলে নিমগ্ন হইল। ফলকথা, একজন স্বদেশী ভ্রাতার বুকের রক্ত শোষণরূপ মহাপাতকের ফল আমাদিগকে অনেকদিন ভোগ করতে হবে। কারণ সেই সকল মহাপাতকের জন্য বিধাতার শাপে, দগ্ধ-উদর-পোষণের জন্য পরের গোলামী করা ভিন্ন আর কোন গত্যন্তর থাকিবে না। গৃহপালিত পশুর ন্যায় পরের প্রদত্ত অন্নে বহুকাল জীবন ধারণ করিয়া থাকিতে হইবে।
আমি যুবককে প্রবোধ বচনে কহিলাম, “আমি কোন সাহেবের লোক নহি, আমার দ্বারায় তোমার কোন অনিষ্ট হইবে না। এক্ষণে তুমি কে, তোমার এমন অবস্থা কেন হ’লো, তা আমার কাছে বল? তোমাকে আর একদিন জোন সাহেবের বাজারের সম্মুখে দেখিয়াছিলাম, কিন্তু সহসা তুমি দৌড়ে চলে গেলে ব’লে কোন কথা জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। আজ আবার ঘটনাক্রমে তোমার সঙ্গে দেখা হ’লো, তোমার কোন ভয় নাই, আমি কাহার কাছে কোন কথা প্রকাশ করবো না, তুমি স্বচ্ছন্দে তোমার নিজের কাহিনী আমাকে সত্য ক’রে বল। তোমার সম্বন্ধে আমার মনে একটা ভয়ানক সন্দেহ হ’য়েছে, সেইজন্য তোমাকে বলছি।”
যুবক উদাসভাবে একবার আমার দিকে চেয়ে কহিল, “ওঃ তাহ’লে তুমি এখনো আমার পেছনে লেগে আছ, তা থাক, আর ভয় করিনে, আর তুমি আমার কি করবে? তোমার সাহেবকে আর কেন ভয় করবো? আর তো কিছু নাই; একে একে সব গেছে, কেবল আমি বেঁচে আছি; আছি, বেঁচে আছি, শালার ভূড়িটা তরমুজের মত ফাঁসাবার জন্য; কাট শালাকে, মার শালাকে।”
যুবক ক্ষেপে উঠে এই কথা ব’লে লাফাতে লাফাতে দৌড়ে গেল, পথের লোক তামাসা দেখতে লাগলো, আমি কেবল অবাক্ হ’য়ে সেইখানে দাঁড়িয়ে রইলাম।
দেখিতে দেখিতে যুবক অদৃশ্য হইয়া গেল, আমারও যেন চমক ভাঙ্গিল, কাজেই আর সেখানে বৃথা অপেক্ষা না করিয়া জয়গোপাল বাবুর বাসা উদ্দেশে যাত্রা করিলাম।
আমি যুবকের অবস্থা ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি, এমন সময় দেখি আমার সামনে দিয়া একটা লোক ঝাঁ ক’রে বাঁ-হাতি একটা গলির মধ্যে প্রবেশ করিল। আমি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম, সেইজন্য যদিও লোকটার মুখ ভাল করিয়া দেখিতে পাইলাম না, কিন্তু পশ্চাদ্ভাগ দেখিয়া আমার ঠিক বিশ্বাস হইল যে, এ লোকটা দেবীপ্রসাদ ভিন্ন আর কেহ নহে। বোধ হয় খুব তাড়াতাড়ি কোন কাজে যাচ্ছে, সেইজন্য আমাকে দেখতে পায় নাই, দেখা হ’লে নিশ্চয় আমার সহিত কথা কহিত। সেই দরগা বাড়ীতে রাত্রে দেখা হবার পর আর তাহার সঙ্গে দেখা হয় নাই; সুতরাং আমি এখন কিরূপ অবস্থায় আছি, তাহা জানিবার জন্য নিশ্চয় আমার কাছে আসিত; বোধ হয় দেবীপ্রসাদ নয়, আর না হয়তো আমাকে দেখতে পায় নাই।
আমি মনে মনে এইরূপ মীমাংসা করিলাম; কিন্তু হায়! তখন আমি জগতকে ভালরূপে চিনিতে পারি নাই। এখানকার কাণ্ডকারখানা ভালরূপ বুঝি নাই, এখানে পাপ না করিয়াও যে আইন ও বিচার মহাত্মে লোকে দণ্ডভোগ করে; আবার টাকা ও যোগাড়ের গুণে শত শত অপরাধ করিয়াও নিষ্কৃতি পায়, কিঞ্চিৎ ব্যয় স্বীকার করিলেই যে কোন গুরুতর অপরাধে একজন নির্দ্দোষ ব্যক্তিকে ফেলা যেতে পারে উদোর বোঝা বুদোর মাথায় যায়; তাহা আমি ভাবি নাই। পাপ না করিলে দণ্ড হয় না, নির্দ্দোষ নিরীহ ব্যক্তির কোন আশঙ্কা নাই, এই বিশ্বাসই তখন আমার প্রবল ছিল, কাজেই এ ক্ষেত্রে আমি আমার মতে মীমাংসায় উপনীত হইলাম।
আমি সবে মাত্র আর দু-চার পা অগ্রসর হ’য়েছি, অম্নি নীলপাগড়ি মাথায় দু-জন বরকন্দাজ আমার দু-দিকে দাঁড়াইয়া নিতান্ত রুক্ষস্বরে কহিল, “কেমন হে, তোমার নাম কি হরিদাস?” আমার মুখ হ’তে যেমন হাঁ শব্দ বাহির হ’য়েছে, অমনি তারা দু-জন আমার দু-দিক্ হ’তে দু-খানি হাত ধ’রে ব’ল্লে, “চল্ শালা, কোতয়ালিতে চল্, তোর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে, আমরা তোর জন্য আজিমগঞ্জ যাইতেছিলাম, নসিবের জোরে এখানেই মিলে গেল।”
সহসা এই ব্যাপারে আমি অবাক হইয়া পড়িলাম বটে, কিন্তু ভীত হইলাম না। কারণ আমার বোধ হইল যে, ইহারা নিশ্চয় ভ্রমপ্রযুক্ত আমাকে ধরিয়াছে, অন্য কোন হরিদাসকে গ্রেপ্তার করা ইহাদের উদ্দেশ্য ছিল। যাহা হউক কোতয়ালিতে দারোগার নিকট গেলে নিশ্চয় এ ভুল ধরা পড়িবে, সুতরাং তখনি আমাকে ছাড়িয়াও দেবে।
আমি মনে মনে এই স্থির করিয়া খুব বিনীতভাবে কহিলাম, “বাবু, কি অপরাধের জন্য আমাকে গ্রেপ্তার করলে? আর আমি যে প্রকৃত অপরাধী ব্যক্তি তাহা কে দেখাইয়া দিল?”
আমার কথা শুনিয়া এক বেটা বরকন্দাজ একটু গম্ভীরভাবে কহিল, “আসামির সঙ্গে ঝুটমুট বকবার আইন নেই। এখন কিছু থাকে তো আমাদের মিঠাই খেতে দে, বাবুর মত যাবি, নৈলে গর্দানে ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে যাব। মোর নাম বদরুদ্দিন খাঁ, মোর এই হাতে বহুত বদমাইস দোরস্ত হ’য়েছে।
দেশের শান্তিরক্ষক মহাশয়দের সঙ্গে এই আমার প্রথম আলাপ, ইহারা যে কিরূপ দরের জানোয়ার, তাহা এক আঁচড়েই জানিতে পারিলাম, আরও বুঝিলাম যে, কোন দৈব দুর্ব্বিপাকে ইহাদের কবলে পতিত হ’লে, কিঞ্চিৎ অর্থব্যয় ভিন্ন আর কোন উপায় নাই। ইসের মূলের গন্ধে কেউটে সাপ যেমন মাথা নীচু করে, তেমনি টাকার খোসবয়ে এরাও গোলাম হয়ে যায়, কিন্তু তা না হ’লে খেকি কুকুরের ন্যায় নিয়ত দংশন করতে আরম্ভ করে। ফলকথা ইহারা যে, কি দরের ভদ্রলোক, তাহা দু-চারটি কথায় স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম, সুতরাং বিষ্ঠায় লোষ্ট্র নিক্ষেপের ন্যায় ইহাদের সঙ্গে কোন বাদানুবাদ করিতে আমার আর ইচ্ছা হইল না। আমি নিজের মান বাঁচাইবার জন্য আমার সম্বল একটা দুয়ানি বাঁ ট্যাক্ হইতে খুলিয়া বদরুদ্দিন খাঁর হাতে দিলাম। অমনি যেন আগুনে জল পড়িল, মূর্ত্তি ফিরিয়া গেল, স্বরেরও পরিবর্ত্তন ঘটিল ও সঙ্গে সঙ্গে দু-জনেই হাত ছাড়িয়া দিয়া কহিল, “চল বাবু, মোরা পাছে পাছে যাচ্ছি।”
যদিও আমার অতি অসময়, কিন্তু তথাপি ইহাদের কাণ্ডকারখানা দেখিয়া একটু না হাসিয়া থাকিতে পারিলাম না। হায়, এই সংসারে অর্থের কি মোহিনী মায়া, কি অনির্বচনীয় শক্তি; এই অর্থের লালসায় বিবেক সম্পন্ন মনুষ্য সহাস্য মুখে মনুষ্যত্বকে বলি দিতেছে, কোমল অন্তরকে ইচ্ছা ক’রে পাষাণের অপেক্ষা নীরস ও কঠিন ক’রে তুলছে, মানব হ’য়ে পিশাচের অভিনয়ে প্রবৃত্ত হ’চ্ছে; কিন্তু ভাবে না যে, দু-দিনের তরে এখানে এসে নিত্য বস্তু ভুলে অনিত্য অর্থের লোভে একেবারে কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হ’য়ে পড়ছি, মানুষ হ’য়ে পশুর ন্যায় কার্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হচ্ছি; দয়া মায়ার সহিত পৃথক্ হ’য়ে ধৰ্ম্মের বন্ধন বিচ্ছিন্ন ক’রে, আর একজন ভ্রাতার গলদেশে ছুরি বাসাচ্ছি, কেন যে ব্যাঘ্রের ন্যায় হিংস্র ও সর্প সম ক্রুর ব্যবহার ক’চ্ছি তাহা কি তাহারা বুঝিতে পারে না।
অর্থ এই সংসারে অতীব প্রয়োজনীয় পদার্থ বটে, জীবিকা নির্ব্বাহের প্রধান সহায় সত্য, কিন্তু সৎ উপায়ে তাহা উপার্জ্জন করা কি উচিত নহে? তা না ক’রে যে মূর্খ সেই অর্থের নিকট আত্ম বিক্রয় করে, একমাত্র উপাস্যদেবতা জ্ঞানে একেবারে দিক্-বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হ’য়ে পড়ে, তার তুল্য ভ্রান্ত অভাগা আর কে আছে? তাহারই যথার্থ দুর্ল্লভ মনুষ্য জন্ম লাভ করা বৃথা হইল এবং মনের অজ্ঞতা নিবন্ধন একখণ্ড লোষ্ট্র পাইয়া অমূল্য মাণিক ফেলিয়া দিল।
ক্ষুদ্র দোয়ানিটার কল্যাণে তখনকার মতন আমার লক্ষ টাকার মান বাঁচিয়া গেল, যে বরকন্দাজ-কুলতিলক বদরুদ্দিন খাঁ নিজের অসীম ক্ষমতায় শত শত বদমাইসদের দোরস্ত করেছে, সেই কড়া মেজাজী কর্ত্তব্যপরায়ণ বীরপুরুষ কিছু ঘুষ পাইয়া একেবারে জুতার সুকতলার ন্যায় মোলায়েম হইয়া পড়িল, বোধ হইল যেন জোঁকের মুখে লবণ পড়িয়াছে।
বরকন্দাজদ্বয় আমার পিছনে পিছনে চলিতে আরম্ভ করিল, আমি বড়-মানুষি কায়দায় যেন দু-জন আরদালি সঙ্গে লইয়া গম্ভীর চালে চলিতে লাগিলাম এবং বোধ হয় ক্রোশটাক পথ অতিক্রম ক’রে কোতয়ালিতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম এবং আমার সঙ্গীদের নির্দ্দেশ মত তাহার মধ্যে প্রবেশ করিলাম।