» » হরিদাসের গুপ্তকথা

বর্ণাকার

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

আখড়া।

আমি কাহাকেও জিজ্ঞাসা না করিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম যে, ইহাই খাঁ সাহেবের আখড়া; কেন না সাহেবের কথামত এ স্থানটা খুব গুল্‌জার হ’য়ে আছে, কাজেই ইহা যে একটা পিঠস্থান তাহা নিতান্ত কাণাও বুঝিতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে আখড়া একটা বাড়ি নয়, একটা নিমগাছের তলায় একখানা খুব ধাউড়ে খোলার ঘরের ভিতর আখড়া অবস্থিত। আখড়ার ঠিক সদর দ্বারের দু-ধারে তিন চারিখানি পানের খিলি ও সরবতের দোকান ব’সেছে এবং একদল লোক গোল হ’য়ে ব’সে ঢোল বাজিয়ে গান গাইছে ও হরদম গাঁজা খাচ্ছে। আমি দেখলাম আখড়ার দ্বার অবারিত, রকম বেরকমের হিন্দু মুসলমান ফিরিঙ্গি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের লোক দলে দলে ঢুক্‌ছ বেরুচ্ছে, কেহ কাহাকেও কোন কথা জিজ্ঞাসা ক’চ্ছে না। কারণ সকলেই নিজের কাজেই ব্যস্ত, নিজের ধান্দায় রত, কাজেই কেহ কাহার তত্ত্ব লইতেছে না, যে যার নিজের তালে ফিরিতেছে।

তখন প্রায় সন্ধ্যা হইয়াছে গগন-গবাক্ষ হ’তে দু-একটী তারা উঁকি ঝুকি মারছে এবং দুষ্ট অন্ধকার এসে স্বভাব সুন্দরীর সৌন্দর্য্যরাশিকে একেবারে আচ্ছাদিত ক’রে ফেলেছে।

আমি উপযুক্ত অবসর বুঝে, মুখে চাদরখানি জড়িয়ে সেই আখড়ার মধ্যে প্রবেশ করিলাম, কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় কেহ আমিকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিল না, এমন কি আমি যে একটা নূতন মানুষ আখড়ায় আসিলাম, তাহা কেহ লক্ষ্য পর্য্যন্ত করিল না।

আমি ভিতরে গিয়া অপার বিস্ময়-হ্রদে নিমগ্ন হইলাম, কারণ দেখিলাম যে নরক গুল্‌জার; আমি এ জীবনের মধ্যে কখন এতো রকমারি বদমাইসের সম্মিলন চক্ষে দেখি নাই। হিন্দু, মুসলমান, খোট্টা, কাফরি, ফিরিঙ্গি প্রভৃতি সকল শ্রেণীর বিখ্যাত বদমাইস ও জোয়াড়েরা এখানে সমাগত হ’য়েছে এবং খাতায় খাতায় ব’সে কড়ি, তাস, দাবা প্রভৃতি নানা রকম উপকরণে রকমারি জোয়া খেলছে।

আমার বেশ বোধ হ’লো যে, এই সংসার মধ্যে বিধাতার এমন বিচিত্র চিড়িয়াখানা আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ; কারণ নররূপী এত জানোয়ার একস্থানে প্রায় জমেয়াৎবস্ত হয় না। আমি ঘরটার চারিদিকে চেয়ে দেখলাম যে, পট্‌পটির মাদুর পেতে খাতায় খাতায় লোক ব’সে আছে, প্রত্যেক মজলিসের মাঝখানে মেটে ক্বচিৎ টীনের দেরকোর উপর দুর্গ প্রদীপ মিট্‌ মিট্‌ ক’রে জ্বল্‌ছে ও মেটে গুড়গুড়ির নলগুলি সারস পাখীর ঠোটের মতন যেন উঁচু হ’য়ে আছে।

এই সকল প্রত্যেক মজলিস প্রায় আটভাজার অনুরূপ, অর্থাৎ সকল শ্রেণীর লোকের দ্বারায় গঠিত। তবে কোন মজলিসের কেহই বেকারে ব’সে নাই, সকলেই একটা না একটা কাজে ব্যস্ত আছে। প্রত্যেক মজলিসে মদ, গাঁজা, গুলি প্রভৃতি মাদক দ্রব্য হরদম্ চল্‌ছে, পানের দোনা, খাবারের ঠোঙ্গা ও কুচো কাপড় মজলিসের চারিদিকে এলোমেলো ভাবে ছড়ানো র’য়েছে। মাঝে মাঝে “হুররে হো” প্রভৃতি চীৎকারে মেদিনী যেন বিদীর্ণ হচ্ছে।

আমি দেখলাম যে মেজের উপর এইরূপ খাতায় খাতায় লোক ভিন্ন ভিন্ন রকমের জোয়াখেলায় মত্ত আছে, কোথায় বা কেবল মদ কি গুলি খাচ্ছে, কেবল ঘরের ঠিক মধ্যস্থলে একখানি ছোট তক্তপোষের উপর কথক ঠাকুরের ন্যায় একজন বর্ষিয়ান মুসলমান চোখ দুটীতে ঝাপ ফেলে ঝিম্ হ’য়ে ব’সে আছে এবং খোকারা চুষি মুখে পুরে যেমন খেলা করে, তেমনি সটকার নলটা মুখে পূরে যেন চিত্রিত চিত্রের ন্যায় শোভা পাচ্ছে।

লোকটার বয়স প্রায় পঞ্চাশ বৎসরের উপর হবে, মাথার চুল ও লম্বা দাড়ি পেকে যেন শোন নুটির ন্যায় ধবধবে হ’য়ে গেছে, কিন্তু গায়ের চর্ম্ম— বিন্দুমাত্র ঢিলা হয় নাই; এই বৃদ্ধ বয়সেও স্বাস্থ্যের পূর্ণ লক্ষণের চিহ্ন সকল তাহার শ্রীঅঙ্গে বৰ্ত্তমান আছে। আমি এই লোকটার ধরণধারণ সম্মানসূচক উচ্চাসন দেখে, ভাবেই এই আখড়ার অধিকারী ব’লে আমার বিশ্বাস জন্মাইল, সম্ভবতঃ ইহাকেই খাঁ সাহেব বলে লোকে ডাকে এবং এই নামে আখড়ার নামকরণ হইয়াছে।

লোকটা তক্তপোষের উপর একখানি ছোট গালিচে পাতিয়া বসিয়া আছে; তাহার পেছনে তাকিয়া, সামনে একটা কাঠের বড় হাতবাক্স, বাঁদিকে গুড়গুড়ি ও ডানদিকে পানের ডিবা, একটি ছোচ্‌দানি প্রভৃতি আসবাব সাজানো আছে। লোকটার মাথায় কার্ত্তিক ঠাকুরের ন্যায় সেই পাকা চুলের বাবরি, গালপাট্টা দাড়ি কাণের সঙ্গে বাঁধা, হাতের দু-আঙ্গুলে রকমারি ঝুটো পাথর বসানো গণ্ডা পাঁচেক রূপার আংটি, করতল মেদিপাতার রংয়ে রঞ্জিত, ও কাজল পরা খোকার নূতন দুই চক্ষু সুর্ম্মায় সুশোভিত ছিল। লোকটা ইহকালের সমস্ত সম্বন্ধ ত্যাগ ক’রে অহিফেন প্রসাদাৎ দিব্য চক্ষু পেয়ে, পার্থিব চোখ দুটোকে একেবারে কল্পনা রথে চড়িয়ে যেন কোন পরীর রাজ্যে ভ্রমণ করছে, লোকটার ঠিক ডানদিকে মোড়ার উপর দু-জন যণ্ডা মুসলমান বসিয়া আছে; তাদের মধ্যে একজন একটা কাচের পিয়ালায় তুলো দিয়ে আফিং গুলছে ও অন্যটা গাঁজা টিপছে।

হাঁসের খাঁচা নেড়ে দিলে যেমন হয়, সেইরূপ হেটো-গোল আখড়ার ভিতর নিয়ত হ’চ্ছে; অনেকেই বক্তার আসন গ্রহণ করছে, মাঝে মাঝে রকমারি গোচের বক্তৃতা চলছে, কিন্তু কে কার কথা শোনে, সকলে যে যার কাজেই ব্যস্ত আছে, কেবল মাঝে মাঝে খেলোয়াড়দের মধ্যে কেহ কেহ “হা সাবাস” ব’লে বিকট চীৎকার ক’রে উঠছে এবং আর সকলের কোল হ’তে দান কুড়িয়ে নিচ্ছে। ফলতঃ টাকা পয়সার ঝম্ ঝম্ শব্দ, উচ্চহাসির গটরা, জোয়াড়েদের জয়ধ্বনি ও মাতালের মাথামুণ্ডহীন বেতালা গান, একত্র মিশ্রিত হ’য়ে বাত্যাবিক্ষোভিত রত্নাকরের ন্যায় সেই আখড়াটিকে নিতান্ত আকুলিত ক’রে তুলেছে।

আমি সর্দ্দার মহাশয়ের তক্তপোষের কাছাকাছি একটা দলে গিয়া বসিলাম, সেখানেও পাঁচমিশালি লোক বসিয়া আছে এবং একটা লোক মজলিসের ঠিক মাঝখানে একটা মাটীর কলসী উপুড় ক’রে তার উপর কড়া কয়েক ঘেচি কড়ি ফেল্‌ছে ও কেবল “পোয়া ভাই পোয়া” এই কথা বলছে, আর সকলে দান ধ’রে কেউ বা জিতে স্ফূৰ্ত্তিতে চেঁচিয়ে উঠছে, আবার কেউ হেরে একেবারে মাটীর সঙ্গে যেন মিশে যাচ্ছে, মুখে আর কথা সরছে না, কেবল রোষকষায়িত চক্ষে যে জিতেছে তার দিকে চেয়ে দেখছে।

জোয়াড়িরা এ প্রকার তন্ময়চিত্তে জুয়া খেলছে যে, কেহই আমাকে লক্ষ্য পর্য্যন্ত করিল না; এমন কি আমি যাহার পাশে গিয়া বসিলাম, সে পৰ্য্যন্ত আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিল না, বা আমি কে কিজন্য আসিয়াছি, তাহার কোন খোঁজও লইল না। কেবল মুখে “ছক্কা ভাই ছক্কা” বলছে, আর ট্যাক হ’তে পয়সা বার ক’রে অনবরত দান ধরছে আর হারছে।

আমি এই সব তামাসা দেখছি, এমন সময় সর্দ্দার মহাশয়ের যেন ধ্যান ভঙ্গ হইল, তিনি অতিকষ্টে একটু চেঁচিয়ে চেয়ে, সটকার নলটা দুইবার টালেন; তারপর পাশের মোড়ার উপর যে লোকটা বসে পেয়ালায় আফিং গুল্‌ছিল, তাহাকে কহিল, “রজব আলি, মোহিতবাবুর কামে কাদের বাহাল ক’রেছ?”

মোহিতবাবুর নামটা আমার কর্ণগোচর হইবাবাত্র আমি চমকিয়া উঠিলাম এবং রজব আলি কি উত্তর দেয় শুনিবার জন্য কাণ খাড়া করিয়া রহিলাম।

সম্ভবতঃ সর্দ্দারের ডাইনের দোহার বা খাস দাওয়ান বিশেষ রজব আলি খুব ঝিম্ আওয়াজে কহিল, “মোবু সর্দ্দার ও গোমিস্ সাহেবকে বাহাল ক’রেছি, শুনেছি তার বাপ নেহাৎ গোলা লোক নয়, পাল্লায় দু-চারজন লোক আছে, কাজেই নেহাৎ কেজো লোক না হ’লে বেমালুম মাল্‌টা টপ্‌কে আনতে পারবে না। সাহেবের কাছে পিস্তল থাকবে, কাজেই জানে ভয়ে কেউ সামনে খাড়া হবে না।”

সর্দ্দার মশায় আবার চোখ দু’টা বুজিয়ে পূর্ব্বেকার ন্যায় অনেকটা ধ্যানস্থ অবস্থায় মিহিসুরে কহিল, “তাহ’লে এ দিক্কার কি করছো?”

রজব আলি কহিল, “পঞ্চাশ টাকা মোট ফুরাণ হ’য়েছে, কুড়ি টাকা বায়না পাঠিয়েছে, কাজ হাসিল হ’লে আরো তিরিশ টাকা দেবে, জুম্মা সাহবের দরগায় মাল থামাল করবার কথা আছে।”

সর্দ্দার মশায় আর একবার পুরো দস্তুর মত চেয়ে কহিল, “তুমি নেহাৎ বেকুবের মতন কাম করছো, এ সব কাম থোড়া টাকায় হয় না। তবে যখন ঝোঁক ধরেছে, তখন আর থোড়া চাপ দিলেও সইতো, তারপর গাং পার হ’য়ে যদি কুমীরকে কেলা দেখায়, তখন কি করবে? বাকী তিরিশ রূপেয়া আদায় করা যে ভার হ’য়ে দাঁড়াবে। খোদা তাল্লা তোমাকে যে এমন বেকুব বানাবে, তা আমি কখন ভাবি নাই।”

রজবআলি ঈষৎ অপ্রস্তুত হ’য়ে আমতা আমতা ভাবে কহিল, “কাজ হাসিল ক’রে সে মোদের ফাঁকি দিতে পারবে না, কেন না, সে ঠিক জানে যে তাহ’লে তার জান থাকবে না; তার উপর বাবুটা জান পছান আদমি, কাজেই হাতে রাখলে আখেরে অনেক কামে আসবে, তাই এত থোড়া টাকায় এত বড় কাটা হাতে নিলাম। আমাদের রহমান, বাবুটার পিছনে লেগে আছে, কাজেই মোদের হাত ছেড়ে অন্য কোন খপ্পরে পড়ে পারবে না।”

সর্দ্দার। রহমান বড় ফিকিরবাজ আদমি, সহরের বিচে র’য়েছে তবু কোন বেটা তার গায়ে হাত লাগাতে পারছে না। গ্রেপ্তারি পরোয়ানাগুলো কেতোয়ালির সেরেস্তায় আছে।

রজব। রহমান একজন ওস্তাদ আদমি, কাফের সেজে হাজার হাজার পাকা চালকদের চ’খে ধূলো দিচ্ছে। পাছে বাতচিতের দোষে ধরা পড়ে, তাই বাঙ্গালি না হ’য়ে হিন্দুস্থানি সেজে দুশো হিন্দুর জাত মেরে বেড়াচ্ছে। লোকটা তোখড় ধড়িবাজ, তাই কেউ ধরতে পারে না, বেমালুম গোঁফে তেল দিয়ে বেড়াচ্ছে। সেই খোদ রহমান এই কামের গোয়েন্দা হ’য়েছে, সেই সব বন্দোবস্ত ক’রে রাখছে।

আর আমার কোন কথা শুনিবার আবশ্যক হইল না। দৈবগতিকে যাহা শুনিলাম, তাহাতে বিষম খট্‌কা, ভয়ানক সন্দেহ ও অন্তরে এক প্রকার অব্যক্ত ত্রাসের সঞ্চার হইল। আমি ভাবিতে লাগিলাম যে, ব্যাপারখানা কি, এরা কেন মোহিতবাবুর কথা কহিল? সর্দ্দারের কড়কানিতে ভয় পেয়ে ঐ মুসলমানটা তো স্পষ্টই বললে যে তার বাপের অনেক টাকা আছে, নিজেও খুব সৌখিন আদমি, আখেরে অনেক কাজে আসবে, তাই এ থোড়া টাকায় এত বড় কাজটা হাতে নিয়েছি। এ সব কথায় তো আমাদের মোহিতবাবুর উপর খুব সন্দেহ হয়। কারণ তার বাপের অনেক টাকা আছে, নিজেও খুব সৌখীন অপব্যয়ী, বিশেষ তাহার বাড়ী এই আজীমগঞ্জে, সেই জন্য বোধ হয় ঐ কনিষ্ঠ মুসলমানটা বললে যে, “আমাদের জানপছান আদমি; কাজ হাসিল হ’লে আমাদের আর ফাঁকি দিতে পারবে না।”

সেই সর্দ্দারের সহিত তাহার সাকরেতের সেই রহস্যপূর্ণ কথাবাৰ্ত্তা যতই ভাবতে লাগলাম, ততই আমার মনের সন্দেহ ক্রমে ক্রমে ঘনীভূত হইতে লাগিল, কিন্তু স্পষ্ট কোন কথা বুঝিতে কি কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হ’তে পারলাম না। আমার অনুমান যদি সত্য হয়, রজব আলির কথিত ব্যক্তি যদি কর্ত্তার গুণধর পুত্ত্র আমাদের মোহিত বাবু হয়, তাহ’লে মুর্শিদাবাদে মোকদ্দমার তদ্বির করতে গিয়ে তার এমন কি দরকার উপস্থিত যে, তার জন্য পঞ্চাশ টাকা খরচ ক’রে দু-জন বিখ্যাত বদমাইসকে নিয়ে গেলেন? একটু আগে ঘটনাক্রমে গোমিস্ সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হ’য়েছিল, এখানে এসেও তার নাম শুনলাম; সাহেবও ব’লেছিলো যে, তার একটা জরুরী কাম আছে, তাহ’লে পূর্ব্বে হ’তেই একটা বন্দোবস্ত হ’য়ে আছে; কি কাজ করতে হবে তা সাহেব জানে, কেবল আমি বাহিরের লোক ব’লে আমার কাছে কোন কথা ভাঙ্গিল না; তবে যে কার্য্যের জন্য নরপ্রেত সদৃশ এই সব বদমাইস লোক নিযুক্ত হয়েছে, তাহা যে কখনই কোন সৎকাৰ্য্য নহে, ইহা আমি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম। বিশেষ রজব আলির মুখে শুনিলাম যে, “তার বাপ বড় সামান্য ব্যক্তি নয়, সাহেবের হাতে পিস্তল থাকলে কেউ বড় এগুতে পারবে না। সহজে মালটা টপকে এনে জুম্মা সাহেবের দরগায় থামাল হবে। এ সব কথার অর্থ কি? সাঁইজির সঙ্গে আমিও একবার জুম্মা সাহেবের দরগায় গিয়াছিলাম। এই আখড়ার ন্যায় সেটাও যে বদমাইসদের একটা প্রধান আড্ডা, তাহা আমি স্পষ্ট বুঝিতে পারিয়াছিলাম, সেইখানেই দেবীপ্রসাদের সঙ্গে মোহিতবাবুকে দেখি, সেই দরগায় কি মাল থামাল করবে? আর মাল টপকে আনবার প্রকৃত অর্থ কি? রজব আলির মুখে আর একটা কথা শুনে মনে বিষম খট্‌কা রইল, অথচ তাহার মর্ম্ম ঠিক বুঝিতে পরিলাম না। ও বেটা কহিল যে, রহমন তাহার সঙ্গে সঙ্গে আছে, কাজেই বাবুটা আমাদের হাতছাড়া হবে না, সেই রহমন এ কাজের সমস্ত বন্দোবস্ত ক’রেছে। সর্দ্দার রহমনকে দুশো তারিফ করিল ও সুখ্যাতির ছলে কহিল যে, “রহমন হিন্দু সেজে কোতোয়ালির চ’খে ধূলো দিতেছে, কেউ তাকে চিনতে পারছে না। পাছে কথাবর্ত্তায় ধরা পড়ে এই ভয়ে বাঙ্গালী না হ’য়ে হিন্দুস্থানির ভোল ফিরিয়েছে। কাজেই তার গ্রেপ্তারি পরোয়ানাগুলো কোতয়ালির সেরেস্তায় পচছে।” রজব আলির কথিত ব্যক্তি যদি আমাদের মোহিত বাবুই হয়, তাহ’লে এ লোকটা কে? মোহিত বাবুর বন্ধুবান্ধবের মধ্যে কোন বেটা মুসলমান হ’য়ে হিন্দুস্থানি সেজে সকলের জাত মজাচ্ছে? এত বড় বুকের পাটা কার? রজব আলি ও তার ওস্তাদ যেরকম ভাবের কথা বলে, তাতে পাপিষ্ঠ দেবীপ্রসাদের উপর আঁচ হয়, কারণ মোহিত বাবুর সঙ্গে ঐ বেটার একটু বেশী মাখামাখি ভাব, ঐ বেটাই বাবুর ইয়াররূপে মানোয়ার জাহাজের কম্পাস্ ও উৎসন্নধামে নিয়ে যাবার প্রধান পাণ্ডা। আমি বেশ জানি মোহিতবাবু ঐ পাপিষ্ঠের পরামর্শে যাবতীয় অপকার্য্যে অগ্রসর হ’য়েছে। কিষণজির বাড়ী, জুম্মাপীরের দরগা প্রভৃতি ভয়ানক ভয়ানক স্থানে ঐ বেটাই নির্ব্বোধ মোহিতবাবুকে মুরুব্বি হ’য়ে নিয়ে গিয়েছিলো। ফলকথা এই বেটার সঙ্গে যদি মোহিতবাবুর মিলন না হ’তো, তাহলে তাকে কখনই এতটা অধঃপাতের খরস্রোতে ভাসতে হ’তো না। বিপুল বিষয়ের অধিপতি হ’য়ে পরমসুখে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করতে পারতো, কিন্তু বোধ হয় বিধাতার তাহা অভিপ্রেত নহে; সেই জন্য তাহার এ প্রকার ঘোর কুমতির উদয় হলো, সুমিষ্ট পারস পরিত্যাগ ক’রে পুরীষের দিকে লোভ জন্মালো; কিন্তু মোহিতবাবুর সেই পরম সুহৃৎ প্রকৃতপক্ষে লোকটা কে? রজব আলির মুখে যে কথাগুলি শুনিলাম, তাহাতে এই বেটার উপর বিশেষ সন্দেহ হয়। আমি স্বচক্ষে ঠাকুর সাহেবের আড্ডায়, ও বেটার যে প্রকার অবস্থা ও সঙ্গিনী বেশ্যাটাকে দেখিয়া আসিয়াছি ও পদে পদে যে প্রকার কার্য্যের পরিচয় পেয়েছি, তাতে আমার বিশ্বাস যে, এ বেটা পাপীর এমন কোন অকাৰ্য্য এই জগতে নাই। বিশেষ ওবেটা কিষণজির ন্যায় চাঁচছোলা বাঙ্গালায় কথা কহিতে পারে না, সেইজন্য রজব আলির কথায় এই বেটার উপর আমার কেমন সন্দেহ হইল।

এই সব কথা আমার মনে তোলাপাড়া হইতে লাগিল; আমি মোটামুটী বুঝিলাম যে, মোহিতবাবু নামে এক ব্যক্তি পঞ্চাশ টাকা ব্যয় ক’রে একটা মাল টপকাবার জন্য দু-জন লোক নিয়ে গেছেন। এ কাজে যে বলের প্রয়োজন, এমন কি পিস্তল অবধি ব্যবহার হয়, তাহা উহাদের কথার ভাবে বুঝা গেল। কাজটা বিশেষ সঙ্গিন ব’লে সাহেবের ন্যায় পাকা লোককে এ ব্যাপারে বাহাল ক’রেছে, তাহ’লে এ কাজটা কি? কেন এ লোকটা এ কাজের জন্য পঞ্চাশ টাকা খরচ করলে, মাল টপকানোর অর্থ কি?

আমি ঠিক ব্যাপারখানা কি বুঝিতে পারিলাম না বটে, কিন্তু প্রাণে কেমন একটা বিষম খটকা উপস্থিত হ’লো, আর আমার সেই আখড়ায় থাকতে ইচ্ছা হ’লো না; সহসা আমার যেন গলদ্ঘর্ম্ম উপস্থিত হ’লো এবং এক প্রকার অব্যক্ত যাতনায় মন প্রাণ যেন কাতর হইয়া উঠিল।

আমি নিঃশব্দে সেই আখড়া হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলাম ও চিন্তাকুলচিত্তে বাটিতে ফিরিয়া আসিলাম। তখন রাত্রি প্রায় দশটা বাজিয়া গিয়াছে, বামনঠাকুর হাঁড়ি তুলিয়া বাসায় গিয়াছেন, কাজেই পিপাসার ঝোঁকে এক গেলাস জল পান করিয়া শয্যার উপর শয়ন করিলাম।