- হরিদাসের গুপ্তকথা
- প্রথম পরিচ্ছেদ : কিসের মন্ত্রণা?
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : এরা কে?
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল!
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ : আজব চিঠি!
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাবু দেবীপ্রসাদ।
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : ভয়ানক ব্যাপার!
- সপ্তম পরিচ্ছেদ : বিষম সন্দেহ।
- অষ্টম পরিচ্ছেদ : আলেকসাই ফকির।
- নবম পরিচ্ছেদ : পীরের দরগা।
- দশম পরিচ্ছেদ : মোহিত বাবু।
- একাদশ পরিচ্ছেদ : ভূঁড়ো-কর্ত্তা।
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : গুণের খানসামা।
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মাষ্টার মহাশয়।
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : গোমিস্ সাহেব।
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : আখড়া।
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ : গ্রেপ্তার।
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : দারোগা সাহেব।
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : হাজত বা হাবুজখানা।
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল।
- বিংশ পরিচ্ছেদ : হাজতে দ্বিতীয় রাত্রিবাস।
- একবিংশ পরিচ্ছেদ : আমার বিচার।
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ : বিচারালয়।
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ : এ কথা কি সত্য?
- চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ : ব্রহ্মচারী মহাশয়।
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ : গুপ্তকথা।
- ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ : পাপের পরিণাম।
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ : নবাব বাহাদুর।
- অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ : নীলমণি বসাক।
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ : উদ্যোগপৰ্ব্ব।
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ : আশা মিটিল।
- একত্রিংশ পরিচ্ছেদ : দীক্ষা।
- দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ : লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু।
- উপসংহার
চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ
গোমিস্ সাহেব।
বেলা প্রায় চারটার সময় আমি বাড়ী হইতে বাহির হইলাম, কিন্তু কোথায় যে যাই তাহার কোন স্থিরতা নাই, কাজেই লক্ষ্য-শূন্যভাবে প্রশস্ত রাজপথ ধ’রে বরাবর পশ্চিম মুখে যাইতে লাগিলাম।
প্রায় আধক্রোশটাক পথ পর্য্যটন ক’রে আমি একটা বাজারের সম্মুখে এসে উপস্থিত হইলাম; একটা লোককে জিজ্ঞাসা ক’রে জানতে পারলাম যে, এর নাম জোন সাহেবের বাজার। বাজারের চারিদিকে ইংরাজদের কুটী, বাংলা, বাগানবাড়ী ও কারখানা বেষ্টিত আছে, কাজেই সহরের অন্যদিক অপেক্ষা এইখানটা সমধিক পরিচ্ছন্ন, অন্য স্থানের অপেক্ষা রাজপথটা বেশ প্রশস্ত ও উভয়দিক বৃক্ষ শ্রেণীতে পরিশোভিত। অদূরে বৃটীশ সাম্রাজ্যের গৌরবের হেতু স্বরূপ একটি মাঝারী গির্জ্জা সদর্পে মাথা উঁচু ক’রে আছে ও গির্জ্জার একটু পার্শ্বেই আধুনিক সভ্যতার প্রধান অঙ্গ, পাশ্চত্য জাতির অতি-প্রিয় ও পেয় একখানি মদের দোকান শোভা পাচ্ছে।
আমি কৌতূহলাক্রান্ত চিত্তে বাজারের মধ্যে প্রবেশ করিলাম এবং দেখিলাম যে, ইংরাজীটোলায় উপযুক্ত ইংরাজী ধরণে বাজারটি সাজানো, অধিকাংশ দোকান একটু উঁচু কাঠের মাচার উপর স্থাপিত এবং বড় বড় গোল আলু, কাঁদি কাঁদি কলা, পাউরুটী, বিস্কুট, ডিম, মাখন, পিঁয়াজ ও নানাজাতি ফলে সাজানো; বাজারের একদিকে পাশ্চত্য-জাতির নিত্য আহার্য্য বহুবিধ প্রকারের পশু ও পক্ষী মাংস টাঙ্গানো রয়েছে। আমি এই বীভৎস কাণ্ড স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ ক’রে, নাকে কাপড় দিয়ে বাজার হইতে বহির্গত হইলাম।
আমি বাজার হ’তে বাহির হ’য়ে দেখি, রাস্তায় একবারে গোল হ’য়ে কতকগুলি লোক দাঁড়িয়ে আছে। আমি ব্যাপারখানা কি দেখবার জন্য সেখানে গিয়ে দেখি যে, একটি লোক মাঝখানে দাঁড়িয়ে কি বিজ্বিজ্ ক’রে বক্ছে ও মাঝে মাঝে শালার ভূঁড়িটা তরমুজের মত ফাঁসাবো ব’লে চীৎকার ক’রে উঠছে; কতকগুলো নেহাৎ বেকার লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই তামাসা দেখছে।
আমিও তখন এক প্রকার বেকার, হাতে বিশেষ কোন কাজ নেই, কি কোথায় যাবার কোন আবশ্যক নাই; কাজেই আমিও গিয়ে সেই বেকারদের দলে মিশিলাম। আমি দেখিবামাত্র বুঝিতে পারিলাম যে, এই হতভাগ্য যুবা উন্মাদ রোগে আক্রান্ত হইয়াছে। যুবকটীর বয়ঃক্রম ৩০ বৎসরের অধিক হইবে না, চুলগুলি তৈল অভাবে রুক্ষ্ম, মুখমণ্ডল বিষাদরেখায় অঙ্কিত ও রবিতাপে কিশলয় সম বিশুষ্ক। যদিও অযতনে অনাহারে তাহার দেহের লাবণ্য নিতান্ত হীনপ্রভ হ’য়েছে, কিন্তু তথাপি হতভাগ্য যে কোন ইতর বংশ সম্ভূত নয়, কোন ধনবানের সন্ততি, তাহা তাহার এই মলিন মূর্ত্তি দেখিলেও স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। যুবকের পরিধানে গ্রন্থিযুক্ত একখানি মলিন ধুতি, গায়ে তিন চারি স্থানে সেলাই করা একখানি মলিন চাদর ও পায়ে অসংখ্য তালি চিত্রিত এক জোড়া বহুকালের পুরাণো চটী জুতা। জুতা জোড়াটী যে বহু শতাব্দি পূর্ব্বে নির্ম্মিত, তাহা তাহার এই শোচনীয় অবস্থা দেখিয়া স্পষ্ট অনুমিত হ’য়ে থাকে; কারণ করাল কালের পীড়নে গোড়ালির দিক হ’তে খানিকটা একেবারে উধাও হ’য়ে চলে গেছে; কাজেই গাড়ী সঙ্গে থাকলেও বাবু ভেয়েরা যেমন সখ ক’রে হেঁটে বেড়ান, তেমনি জুতা পায়ে পরে যুবকের অর্দ্ধেকটা পা বাহিরে পড়িয়াছে। এ ছাড়া একখানি নিতান্ত ময়লা নেকড়ায় বাঁধা একটি ছোট দপ্তর ততদূর যত্নে সে বগলে লইয়া বেড়াইত।
যুবক সেইখানে দাঁড়িয়ে সেই রকম পাগলামি ক’চ্ছে ও মাঝে মাঝে “মার শালাকে, কাট শালাকে”, ব’লে রুকে উঠছে, এমন সময় দর্শকদের মধ্যে একজন লোক বলিল, “কি বাবু এখানে দাঁড়িয়ে কেন, কোথায় যাবে?”
যুবক একবার উদাসভাবে তাহার দিকে চেয়ে কহিল, “যাব, অনেকদূর— একবার বিলাতে যাব, তাই এদিকে এসেছিলাম; কোন সাহেবের সঙ্গে দেখা হ’লে কোনদিক দিয়ে বিলাত যেতে হয় সেই রাস্তাটা জিজ্ঞাসা ক’রে নেবো।”
যুবকের এই কথা শুনে সকলে হো হো করে হেসে উঠলো। অল্পক্ষণ পরে হাসির রোল থামলে সেই লোকটা পুনরায় বলে, “কেন বাবু, বিলাত যাবে কেন— মেম বে করবে নাকি?”
যুবক অনেকটা স্থিরভাবে কহিল, “শুনেছি বিলাতের লোকেরা বড় দয়ালু ও ন্যায়পরায়ণ, আমি একবার তাদের কাছে গিয়ে বিচার প্রার্থনা করবো, দেখি তারা কি বলে। ওঃ, এত অত্যাচার কি মানুষ হ’য়ে মানুষের উপর করে? হাজার টাকার জন্য সব গেল, সব গেল, কেউ র’ইলো না; সোণার পুরী একেবারে শশ্মান হ’য়ে গেল, শালা আবার সেই বাড়ীতে বাস ক’চ্ছে? কাট শালাকে, শালার ভুঁড়িটা তরমুজে’র মত ফাঁসিয়ে দাও।”
যুবক ক্ষেপে উঠে এই কথা বলতে বলতে পাশের একটা গলির মধ্য দিয়া ছুটে গেল, লোকগুলো হাততালি দিয়ে হো হো ক’রে হাসতে লাগলো।
উন্মত্ত যুবকের এই সকল প্রলাপ শুনে আমার মনে একটা সন্দেহের উদয় হইল। ভূঁড়ো কর্ত্তার আমলা চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের সেই কথাগুলি আমার স্মৃতিপথে উদয় হইল। তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন, কৰ্ত্তা দাদনের কলে ফেলে একঘর ধনাঢ্য তাঁতির সর্ব্বনাশ করেছিলেন এবং সেই কার্য্যের পুরস্কার স্বরূপ এই বাড়ীখানা সাহেবদের নিকট পাইয়াছেন। চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের মুখেই শুনিয়াছিলাম, সেই তাঁতির দুইটী ছেলেই কয়েদখানায় আত্মহত্যা ক’রে আপনার দায় হ’তে নিষ্কৃতিলাভ করেছে, কেবল তাহার একটি পৌত্ত্র জীবিত আছে। তাহ’লে সম্ভবতঃ এই হতভাগ্য যুবক সেই বৃদ্ধের পৌত্ত্র হ’লেও হ’তে পারে, সর্ব্বস্বান্ত হ’য়ে একেবারে ক্ষেপে উঠেছে। মাঝে মাঝে পূর্ব্ব-স্মৃতির উদয়ে ভীষণ প্রতি-হিংসানল প্রজ্জ্বলিত ভ’য়ে উঠে, সেই জন্য বিষম ক্রোধে কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হ’য়ে “শালাকে কাটবো, শালার ভুঁড়ি ফাঁসাবো” ব’লে চীৎকার ক’রে উঠে। তাহার রাগ যে কেবলমাত্র এক ভূঁড়ো কর্ত্তার উপর ও তাহার উদ্দেশ্যে যে গালাগালি দেয়, ভূড়ি ফাঁসাবার জন্য চীৎকার করে তাতে আর অণুমাত্র সন্দেহ নাই। বাস্তবিক ঐ অর্থপিশাচ কৃপণ বেটাই সমস্ত অপরাধের প্রধান নায়ক; কারণ হাজার হোক্ ইংরাজেরা বিদেশী, এ দেশবাসীর উপর কোনরূপ সহানুভূতি না হওয়াই সম্ভব; তারা আত্মীয় স্বজন ছেড়ে, একপ্রকার প্রাণের মায়া ত্যাগ ক’রে, কেবলমাত্র অর্থের জন্য এ দেশে এসেছে। যে কোন উপায়ে হোক অল্পদিনের মধ্যে সেই অর্থ সংগ্রহ ক’রে দেশে ফিরে যাওয়াই তাহাদের জীবনের সারব্রত; সুতরাং সেই অর্থ লাভের জন্য তারা দিক্বিদিক জ্ঞানশূন্য হ’তে পারে, কিন্তু এ দেশবাসী হ’য়ে যে পাপাত্মা আর এক ভ্রাতার সর্ব্বনাশ সাধনের জন্য এই সকল অর্থ-লোলুপ বিদেশীদের পরামর্শ দেয়, লুণ্ঠন ব্যাপারের সহায়তা করে, পাপকার্য্যে উৎসাহ দেয়, তাদের তুল্য স্বদেশদ্রোহী নরপিশাচ আর কেহই নাই, বোধ হয় অনন্তকাল নরকভোগ তাহাদের পক্ষে পৰ্য্যাপ্ত সাজা নহে।
যুবকের সঙ্গে আমার দু-একটা কথা বলার সাধ হ’য়েছিল, কিন্তু সহসা সে অদৃশ্য হওয়ায় আমার মনের ইচ্ছা জলে জলবিম্বসম মনমধ্যেই লয় হইয়া গেল।
আমি বাটীর দিকে ফিরিবার মনস্থ করিতেছি, এমন সময় দেখি যে, ঠিক আমার মাষ্টার সাহেবের মতন একটা লোক রুমালে মুখ মুছিতে মুছিতে সেই শুঁড়ির দোকান হইতে বহির্গত হইলেন। আমি মাষ্টার সাহেবকে এরূপ অবস্থায় দেখে নিতান্ত বিস্মিত হইলাম। কারণ তিনি এত দিন পড়াবার জন্য আমাদের বাড়ীতে আসিয়াছিলেন; কিন্তু কখন তাহার মুখে মদের গন্ধ পাই নাই, কিন্তু তিনি নেহাৎ বেলেল্লা মাতাল না হ’লে এই দিনের বেলায় শুঁড়ির দোকানে প্রবেশ করিয়া মদ খাইত না। ফল কথা এই সংসারে মানুষ চেনা ভার, কত কপট ছদ্মবেশী যে সাধুর ভোল ধরে অন্ধ বিশ্বাসী সরল চিত্ত মানবদের প্রতারণা জালে আবদ্ধ ক’রে আত্মোদর পূর্ণ করছে, তাহার আর ইয়ত্তা নাই। অনেক বিষাক্ত সর্প যেমন দেখতে মনোরম, তেমনি অনেক মিষ্টভাষী নরাধম ভদ্রের বেশ ধরে এই সংসারে বিচরণ ক’রে থাকে; বাহিরে তারা দেবতার প্রতিরূপ, কিন্তু তাদের গোপনের কার্য্যাবলী দেখলে পিশাচও শঙ্কিত হয় এবং পশু অপেক্ষা হেয় ব’লে বোধ হ’য়ে থাকে।
এক্ষণে মাষ্টার মহাশয়ের পরিচয় পাইলাম। একরকম সিঁদ মুখে চোর ধরিলাম বলিলেও অত্যুক্তি হয় না, আর তিনি মিছে ধাপ্পা ঝেড়ে, আমার কাছে উড়তে পারবেন না, সুতরাং এই সময় তাঁকে ডেকে একটু অপ্রস্তুত করি, দেখি তিনি কি ওজর করেন। আমি এই মনে ক’রে মাষ্টার-মশায় মাষ্টার-মশায় ব’লে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলাম। লোকটা আমার দিকে ফিরে, একটু মুচকি হাসিল ও ঝড়ের নারিকেল গাছের ন্যায় টলিতে টলিতে আমার সম্মুখে এসে ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমা শ্যাম নটবরের ন্যায় বেঁকেচুরে দাঁড়ালেন। তখন আমার ভ্রম অপনীত হইল আমি তাহাকে যথার্থ মাষ্টার মহাশয় জ্ঞান ক’রে বলিলাম, “মাষ্টার মশায়! আপনি এদিকে কোথায় এসেছিলেন?”
আমার কথা শুনে লোকটা হো হো ক’রে হেসে উঠে, আমার কাঁদের উপর বাম হাতখানি দিয়ে জড়িত স্বরে কহিল, “আরে ম্যান তুমি ভুল করেছ, হামার নাম গোমিস্ এন্টুনি, মোর নামে সব শালা গুণ্ডা ডরে— হাড়ে কাঁপে, মুই রাতকে দিন বানাতে পারি; সব শালা মোকে চেনে, হামার ছোট ভাই রোজিরো তোমার মাষ্টার আছে।”
আমার তখন চমক ভাঙ্গিল, আমি পূর্ব্বেও শুনেছিলাম যে, সাহেবের আর এক ভাই আছে। তাহ’লে গুণ্ডা মাতালটা তাহার বড় ভাই, কিন্তু দুই সহোদরের এ প্রকার চেহারার সৌসাদৃশ প্রায় পরিলক্ষিত হয় না, হঠাৎ দেখিলে আমার ন্যায় সকলের ভ্রম হবার সম্ভাবনা। তবে খুব নিবিষ্ট চক্ষে দেখলে আমার মাষ্টার মশায় অপেক্ষা একটু দোহারা বলে বোধ হয়, তা ছাড়া নাক মুখ চোখ দুই ভায়ের ঠিক একরূপ, নেহাৎ চেনা লোক ভিন্ন কে কোনটা তা ঠিক বলতে পারে না।
সাহেব বেশ বাগিয়ে আমার গলাটি জড়িয়ে মাতলামি ঢঙ্গে কহিতে লাগিল “তুমি হামাকে জানতে পেরেছ তো, আমি আদমিটা কে? তুমি রোজিরোর পোড়ো, তোমার কোন ভয় নাই, বেপরোয়া মজা মারগে। যদি কিছু আপদ গেরে গোমিস্ সাহেবের নাম নেবে, কোন শালা সামনে খাড়া হবে না। তুমি বাবা যখন এ মহল্লায় ঘুরছো, তখন দেলে কোন মতলব আছে, তুমি ম্যান মোর জানপছান আদ্মি আছে, তাই বল্ছি যে বাজে জায়গায় না গিয়ে খাঁ সাহেবের আখড়ায়; সেখানে মোর নাম নিলে দুশো খাতির পাবে, থোড়া পয়সা খরচ করলে সব আয়েস মিলবে। এখান থেকে আখড়া যান্তি দূর নয়, ঐ বাজারের বাঁ দিকের গলি ধরে বরাবর সোজা গিয়ে একটা মোড় পাবে, তুমি বাঁহাতি সড়ক ধরে গেলেই একেবারে আখড়ার সামনে পৌঁছিবে, তোমাকে কোই শালাকে পুছ করতে হবে না। আখড়া রাতদিন গুজার আছে, আন্ধা আদমির ভি মালুম্ হবে। তুমি ম্যান দেখবে, সহরের বড় বড় নামজাদা আদমি সব জমেয়াৎ হ’য়েছে; হামি বি যাবে, তুমি থাকবে, সখ হয় ছোট ছোট দানে খেলবে, তোমার কোন ডর নাই। সব শালা গোমিস্ সাহেবের গোড়ে সেলাম করে। মোর একটা জরুরী কামের বাত আছে সেখানে হামি আবি যাবে, তুমি না খুঁজে বাতলানো সড়ক ধরে চলে যাও, আখড়ার সামনে পৌঁছবে।”
আমার নিতান্ত প্রাণ সঙ্কট উপস্থিত হ’লো, আমি সাহেবের কবল হ’তে মুক্ত হবার জন্য নিতান্ত অস্থির হ’য়ে পড়লাম। বিশেষ সাহেবের শ্রীমুখ হ’তে পিয়াজ রসুনের সহিত বিমিশ্রিত মদের গন্ধে আমাকে নিতান্ত বিব্রত করিয়া তুলিল, এমন কি আমার অন্নপ্রাশনের অন্ন পৰ্য্যন্ত দেখা দিবার উপক্রম হইল। আমি সাধ্যমত মুখ ফিরাইয়া নাকে কাপড় দিয়া রহিলাম এবং কতক্ষণে সাহেব এই অনুগ্রহ হ’তে বঞ্চিত করেন, তাহাই মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম। এমন সময় সাহেবের বক্তৃতা-স্রোত থামিল, আমি উপযুক্ত অবসর বুঝে বলিলাম। “বেশ কথা, আমি খাঁ সাহেবের আখড়ায় যাব, কিন্তু আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো, আপনি নিশ্চয় যাবেন?”
সাহেব কহিল, “হাঁ হাঁ হাতে কাম না লাগে এক ঘণ্টার বিচে আমি লোটবে। তুমি হামার নাম লেবে, দেখবে খোদ খাঁ সাহেব তোমাকে সেলাম করবে। মোর ভাইয়ের কাছে ঝুটমুট চিড়িয়ার মাফিক কেতাব প’ড়ে কি ফয়দা হবে, তার চেয়ে মোর পিছু ফের, মোর কাছে কাম শেখ, তোমাকে একটা আদমি বানিয়ে দেব; গুড বাই! হামি এখন চলে।”
সাহেব এই কথা ব’লে আমার কাঁধ থেকে হাতখানি তুলে নিলেন এবং কান্নিখেকো ঘুড়ির ন্যায় গোঁত্তা খেতে খেতে ডানদিক্কার একটা গলির মধ্যে প্রবেশ করলেন।
আমার ধড়ে যেন প্রাণ আসিল, আমি হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলাম; ততক্ষণ আমার যে কি ভীষণ নরক যন্ত্রণা ভোগ হইতেছিল, তাহা আমি এই লেখনি মুখে প্রকাশ করিতে পারি নাই। মাষ্টার মহাশয়ের গুণধর ভাইটি যে কিরূপ দরের লোক ও কেমন ভদ্র ব্যক্তি, এই সামান্যক্ষণ আলাপেতেই আমি বুঝিতে পারিলাম। দেবীপ্রসাদের ন্যায় ইনিও এক কথায় আমার মুরুব্বির পদ গ্রহণ করলেন, আমাকে কাজ কৰ্ম্ম সেখায়ে একবারে একটা আদমি ক’রে দিবার ভার নিলেন, কিন্তু উভয়ের কাজের আঞ্জাম যে এক রকম, পরের সর্ব্বনাশ সাধন মূখ্য পেশা, চুরি জুয়াচুরি খুন ডাকাতি ইত্যাদি অঙ্গের ভূষণ, তাহা আমি অনুমানে ঠিক বুঝিতে পারিলাম; কাজেই যুগপৎ ঘৃণায় আমার অন্তরার্ণব উদ্বেলিত হইয়া উঠিল।
তবে সাহেবের মুখে খাঁ সাহেবের আখড়ার কথা শুনিলাম, এরূপ আখড়া যে বিবিধ শ্রেণীর বদমাইসদের সম্মিলন স্থল, তাদের পাপার্জ্জিত অর্থ যে এইখানে নিঃশেষ হয়, তাহা আমি অনুমানে বুঝিতে পারিয়াছিলাম। ইতিপূর্ব্বে আমি একবার কিষণজি বাবুর পত্র নিয়ে ঠাকুর সাহেবের আখড়ায় দেবীপ্রসাদের কাছে গিয়াছিলাম, কিন্তু আখড়ার ভিতরে ঐ সকল নরপ্রেত সদৃশ বদমাইসদের কার্য্য কলাপ আমার দেখা হয় নাই; কাজেই খাঁ সাহেবের গুলজার আখড়ার বদমাইসদের কাণ্ড কারখানা ও লীলা খেলা দেখবার সাধ আমার অন্তর মধ্যে নিতান্ত প্রবল হ’লো, আমি কিছুতেই আমার মনের কৌতুহলকে দমন করতে পারলাম না। কাজেই সাহেবের নির্দ্দেশমত সেই বাজারের পাশের গলি ধ’রে বরাবর যেতে আরম্ভ করলাম।
আমি যে গলিটার মধ্যে প্রবেশ করিলাম, সে গলিটার মধ্যে কোন ভদ্রলোকের বাস নাই। কেবল এদেশে ফিরিঙ্গি নামক এক প্রকার শঙ্কর জাতি উৎপন্ন হবার বীজ স্বরূপ কতকগুলি মাদ্রাজি ও মুসলমানি বেশ্যা তথায় বিরাজমান আছে। ইংরাজ ফরাসী প্রভৃতি বিদেশীদের পশু প্রবৃত্তি নিবৃত্তি করবার জন্য তারা সাহেব টোলার এত নিকটে বাস করিয়া আছে। সাহেব প্রভুরা ক্ষুধার প্রভাবে পাটকিলে কামড় দেন, কাজেই অবশ্য প্রতিপাল্য জ্ঞানে এই সকল পাপিনীদের প্রতিপালন ক’রে থাকেন; কিন্তু প্রভুদের খানসামা এই সব পতিতা অভাগিনীদের বিশেষ অনুগৃহিত অন্নভোক্তা সেবাদাস পদে বাহাল আছে। বাবুরচি এদের একমাত্র মুরুব্বি, তারা গুণ্ডার ন্যায় মাতালদের নিকট হ’তে পয়সা আদায় করে ও তারাই সর্ব্বপ্রকার বিপদে ইহাদের মধুসূদনরূপে বিরাজমান থাকে।
তখন বৈকাল হ’য়েছে, কাজেই পাপিনীরা বেশ ভূষায় ভূষিত হ’য়ে স্ব স্ব খোলার ঘরের সম্মুখে মোড়ার উপর ব’সে আছে। প্রায় অনেকের সম্মুখে মাটী বা বিদরির গুড়গুড়ি শোভা পাচ্ছে ও খোপায় ফুলের মালা দিয়ে একগাল পান খেয়ে, নিজেদের জঘন্য কারবারের খদ্দেরের প্রতীক্ষায় আছে।
আমি এই সব দেখতে দেখতে ক্রমে অগ্রসর হ’তে লাগ্লাম, অনেকে ঘৃণিত অঙ্গভঙ্গি ও ইঙ্গিত দ্বারায় আমাকে ডাকতে লাগলো; দু-একটা পাপিনী একেবারে লজ্জার মাথা থেয়ে, “এসো হে বাবু, পান তামাক খেয়ে যাও; তোমায় কালী গঙ্গার দিব্বি যদি না আস” প্রভৃতি বাক্যে আমাকে আপ্যায়িত করিতে লাগিল, আমি কোনদিকে আর লক্ষ্য না ক’রে, পরমপিতা পরমেশ্বরের মঙ্গলময় রাজ্যে এই সব পতিতা-জীবের শোচনীয় অবস্থা ভাবতে ভাবতে ক্রমে অগ্রসর হইতে লাগলাম। ক্রমে সাহেবের কহত মত সেই মোড় পাইলাম এবং বাঁহাতি গলি ধরিয়া খানিক দূর যাইবার পর আমি একেবারে আখড়ার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলাম।