- হরিদাসের গুপ্তকথা
- প্রথম পরিচ্ছেদ : কিসের মন্ত্রণা?
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : এরা কে?
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল!
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ : আজব চিঠি!
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাবু দেবীপ্রসাদ।
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : ভয়ানক ব্যাপার!
- সপ্তম পরিচ্ছেদ : বিষম সন্দেহ।
- অষ্টম পরিচ্ছেদ : আলেকসাই ফকির।
- নবম পরিচ্ছেদ : পীরের দরগা।
- দশম পরিচ্ছেদ : মোহিত বাবু।
- একাদশ পরিচ্ছেদ : ভূঁড়ো-কর্ত্তা।
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : গুণের খানসামা।
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মাষ্টার মহাশয়।
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : গোমিস্ সাহেব।
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : আখড়া।
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ : গ্রেপ্তার।
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : দারোগা সাহেব।
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : হাজত বা হাবুজখানা।
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল।
- বিংশ পরিচ্ছেদ : হাজতে দ্বিতীয় রাত্রিবাস।
- একবিংশ পরিচ্ছেদ : আমার বিচার।
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ : বিচারালয়।
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ : এ কথা কি সত্য?
- চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ : ব্রহ্মচারী মহাশয়।
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ : গুপ্তকথা।
- ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ : পাপের পরিণাম।
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ : নবাব বাহাদুর।
- অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ : নীলমণি বসাক।
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ : উদ্যোগপৰ্ব্ব।
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ : আশা মিটিল।
- একত্রিংশ পরিচ্ছেদ : দীক্ষা।
- দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ : লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু।
- উপসংহার
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
মাষ্টার মহাশয়।
পাপিষ্ঠ রামার ঊপর আমার বিজাতীয় ঘৃণার উদয় হ’য়েছিল; তাকে দেখলেই বিষম ক্রোধে আমার সর্ব্বশরীর কম্পিত হইয়া উঠিত। সেই দিন হ’তে আমি আর পাপিষ্ঠের সঙ্গে কোন বাক্যালাপ পর্য্যন্ত করিতাম না। তবে এই সকল কেলেঙ্কারীর কথা প্রকাশ হ’লে, পাছে মোহিতবাবু আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়, এই ভয়ে এ সম্বন্ধের কোন কথা আমার অতীব বিশ্বাসভাজন চক্রবর্ত্তী মহাশয়কে অবধি বলিলাম না; গুরুদত্ত ইষ্টমন্ত্রের ন্যায় আমার হৃদয়মধ্যে লুকাইয়া রাখিলাম।
দুপুর বেলায় অন্দরমহলের ভিতরে আমি আহার করিতে যাইতাম, কাজেই দোরের আড়াল হইতে আড়ঘোমটার মধ্যে দিয়া মোহিতবাবুর গুণবতী পত্নীর মুখখানি দেখিয়াছিলাম। উপন্যাস লেখকের আসনে সমাসীন হ’লে সকলকার দৃষ্টিশক্তি সাতিশয় প্রবল হ’য়ে থাকে; যাহা নিতান্ত অসম্ভব ঘোর অস্বাভাবিক, তাহাকে অভ্রান্ত সত্যরূপে প্রতিপাদন করবার হকদারী পৌঁছিয়া থাকে; যে স্থানে “ভয়ে বায়ু না সঞ্চারে” তেমন দুর্গম স্থানে অবাধে প্রবেশ করবার ক্ষমতা জন্মায়, সুতরাং আমার ন্যায় ক্ষুদ্র ব্যক্তি সেই পথের পথিক হ’য়ে, কুমুদিনীর ঘোমটার ভিতর হ’তে মুখখানির আবছায়া দেখেই তাহার সর্ব্বাঙ্গের রূপ বর্ণনা করতে যে সক্ষম হবে তার আর আশ্চর্য্য কি?
কুমুদিনীর বয়স ১৮/১৯ বৎসরের অধিক হবে না। বর্ণটুকু ফেকফেকে ফরসা, মাথার চুলগুলো কটা কটা ও পাতলা পাতলা; টাকের বিষম অত্যাচারে সামনেকার প্রায় ছয় আনা ভাগ ম্যালেরিয়া বিষের অনুগ্রহে অনুগৃহিত গ্রামের ন্যায় খাঁ খাঁ করছে; কাজেই শ্রীমতীর কবরী বড় জাহাজি সুপারিকে অতিক্রম করিতে পারিত না।
কুমুদিনীর চেহারাখানি খুব ছিপছিপে পাতলা ও বেঢপ চেঙ্গা, পা থেকে মাথা অবধি প্রায় তক্তাখানির ন্যায় খাসা চৌরস, কোনখানে বিশেষ উঁচু নীচু নাই। শ্রীমতীর কপালখানি পরেশনাথের পাহাড়ের ন্যায় উঁচু ও গড়েরমাঠের মত চওড়া, ভ্রুযুগলের মনের মিলন না হওয়ায় পরস্পর পৃথক ভাবে বসবাস করছে; চক্ষু দুটী ছোট, ঈষৎ কোটরগত ও তারাদ্বয় বিড়ালের অনুরূপ। কুমুদিনীর চক্ষু দুটী আকর্ণ-বিস্তৃত নয় বলে বিধাতা তার হাঁ-টীকে আকর্ণ-বিস্তৃত ক’রে সৃষ্টি ক’রেছেন। অধর যুগল আফ্রিকাখণ্ড হ’তে এনে বেমালুম বসিয়ে দিয়াছেন।
শ্রীমতীর হাত-পাগুলি তাহার দেহের অনুরূপ; একমাত্র বাঁখারি ও তল্তা বাঁশ ভিন্ন আর কিছুর সঙ্গে তার তুলনা হয় না। ঢেঙ্গা ঢেঙ্গা আঙ্গুলগুলি কলাছড়ার ন্যায় শোভা পাচ্ছে ও কুকুরের জীবের ন্যায় দুখণ্ড মাংস বুকের দুদিকে ঝুলছে। আমাদের প্রাণের দুঃখ নেহাৎ রহিল যে, যুবতীর রূপ বর্ণনা করতে আরম্ভ ক’রে, “ক্ষীণ-কটী, পীন-পয়োধর, বিপুল নিতম্ব” প্রভৃতি বাঁধাগৎ রসাল কথাগুলি ব্যবহার করতে পারলাম না, কারণ তাহ’লে সত্যের অপলাপ করা হয়; কাজেই শ্ৰীমতী প্রকৃতপক্ষে যেরূপ সুন্দরী, আমরা অবিকল সেইরূপ রূপ পাঠক মহাশয়দের চক্ষের সামনে ধরিলাম।
শ্রীমতী কুমুদিনী রূপে গুণে সমান; আমি অন্দরমহলে আহার করিতে যাইবার সমর কপাটের আড়াল হ’তে এই বেড়াল-চোখীর চাঁদ মুখখানি দেখিয়াছিলাম এবং লালসা-পরিপূর্ণ কুটীল দৃষ্টি দেখে তার উপর আমার একপ্রকার বিজাতীয় ঘৃণার উদয় হ’য়েছিল; কিন্তু এই পৈশাচিক ব্যাপার প্রত্যক্ষ ক’রে, পাপিয়সীকে নারীরূপা পিশাচী ব’লে জ্ঞান হ’লো। পাপিয়সী মনের আবেগকে দমন করতে না পেরে, হৃদয়ের দুর্ব্বলতাপ্রযুক্ত পিপাসার শান্তির জন্য ভীষণ মরুভূমে পতিত হ’য়েছে। ফুলের মালা ভেবে ভীষণ সর্পকে কণ্ঠে ধারণ ক’রেছে, তীব্র কালকুটকে স্নিগ্ধ-চন্দন জ্ঞানে সৰ্ব্বাঙ্গে লেপন ক’রেছে; সুতরাং পরিণামে পাপিনীকে এই বিষম ভ্রমের জন্য ভীষণ অনুতাপানলে নিয়ত দগ্ধ হ’তে হবে। হায়! যে মানুষ নিজের বস্তুকে অযত্ন ক’রে, অন্য বস্তু পাবার আশে উন্মত্ত হয়, সংসারী হ’য়ে সংসারের সার ধর্ম্ম, দাম্পত্যবিধানকে পদে পদে লঙ্ঘন ক’রে একান্ত আত্মসুখপ্রিয় হ’য়ে উঠে; স্বভাবের নিয়ম বলে তার সংসারে এ প্রকার বিষবৃক্ষের বীজ উপ্ত হয় এবং একমাত্র সেই পাপে তার শান্তিময় সোণার সংসার শ্মশানে পরিণত হ’য়ে থাকে। যদি মোহিতবাবু এ প্রকার নীচ-আমোদপ্রিয়, ধৰ্ম্মজ্ঞান শূন্য, উচ্ছৃঙ্খল না হ’তেন, পবিত্রভাবে সংসার-যাত্রা নির্ব্বাহ করতেন, তাহ’লে বোধ হয় পাপিনীর এতদূর অধঃপতন হইত না।
আমি গায়ের রাগ গায়ে মেরে, মনের ভাবকে প্রচ্ছন্ন রেখে, কেবলমাত্র মোহিতবাবুর অপেক্ষায় রহিলাম; কিন্তু কয়েকদিবস কাটিয়া গেল, তবু আর তিনি ফিরিলেন না। দেখিতে দেখিতে সপ্তাহ পূর্ণ হইল, তথাপি মোহিতবাবুর কোন সংবাদ পাইলাম না, কাজেই তাহার জন্য আমরা সকলে উদ্বিগ্ন হইলাম।
মোহিতবাবু আমার নিকট প্রতিশ্রুত হ’য়েছিলেন যে, তিনি চারদিনের মধ্যে বাড়ী ফিরিয়া আসিবেন; তবে কি জন্য যে তাহার আসিতে বিলম্ব হচ্ছে, তিনি কি পুনরায় দেবীপ্রসাদ প্রমুখ পাপাত্মাদের কবলে পতিত হ’য়েছেন? পাপাত্মা দেবীপ্রসাদ যে তাঁহার কতদূর শুভানুধ্যায়ী বন্ধু, তাহা তিনি বুঝিতে পারিয়াছেন, আমিও তাহাকে বিশেষরূপে বুঝাইয়া দিয়াছি; আর তিনিও তাহাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন না ব’লে প্ৰতিজ্ঞা ক’রেছেন, তবে তার আসতে কি জন্য এত বিলম্ব হচ্ছে? তিনি কি এত দূর নির্ব্বোধ হবেন যে, জেনে শুনে আবার সেই আগুনে হাত দিবেন, ইহা কি সম্ভব? নিশ্চয় একটা কোন ঘটনা হয়েছে, তা না হলে তাহার আসিতে কখনই এত বিলম্ব হইত না।
মোহিতবাবুর আসিতে বিলম্ব দেখে, কৰ্ত্তা অবধি চিন্তিত হ’লেন এবং আমাকে ডাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাই তো মোনা ছোড়া আজও বাড়ী আছে না কেন, সে কি তোমাকে কিছু ব’লে গেছে?”
আমি উত্তর করিলাম, “আজ্ঞে না, মোহিতবাবু আমাকে বিশেষ কিছু বলেন নাই। তিন চারিদিনের মধ্যে ফিরিয়া আসিবেন বলিয়াছিলেন, কিন্তু কি জন্য যে এত বিলম্ব হ’চ্ছে, তা বলতে পারি না। বোধ হয় আপনার মোকদ্দমার কোন কাজের জন্য তার আসতে এত বিলম্ব হ’চ্ছে।”
কৰ্ত্তা একটু চিশ্চিতভাবে কহিলেন, “না, তা কি ক’রে হবে; আমি জয়গোপালবাবুর পত্রে জেনেছি যে, মোকদ্দমার তারিখ পড়ে গেছে। তবে ও ছোড়ার আসতে এত বিলম্ব হচ্ছে কেন, সে গেল কোথায়? সে যে জয়গোপালবাবুর বাসায় আছে, তাতো আমার বোধ হয় না। যাই হোক্ ছোড়ার জন্য বড় ভাবনা হ’চ্ছে, তুমি একবার জয়গোপাল উকীলের বাসায় গিয়ে ছোড়ার খবরটা নিয়ে এসো, আমি তোমায় পারানির দুটো পয়সা দিচ্ছি। ছোড়ার বাঁদরামির জন্য কেবল অনর্গল পরসা খরচ করতে হচ্ছে।”
কৰ্ত্তা এই কথা ব’লে মুখখানি ভার ক’রে বাক্স খুলে দুটি পয়সা বাহির ক’রে যেমন আমাকে দিবেন, অমনি ঠিক সেই সময়ে, একজন পিয়াদা আসিয়া তাহার হাতে একখানি পত্র দিল। তাহাতে এই লেখা ছিল—
‘শ্রীশ্রীদুর্গা।
শরণং।
প্রণাম শতকোটী নিবেদন মিদং।
সেবক শ্রীমোহিতচন্দ্র সরকার, সবিনয় পূর্ব্বক নিবেদন যে, আপনার আশীর্বাদে আমার প্রাণগতিক সমস্ত মঙ্গল। পরে উকীল মহাশয়ের পত্রে মামলার হাল নিশ্চয় জানিতে পারিয়াছেন, আমিও পরদিন বাড়ী গিয়া শ্রীচরণ দর্শন করিতাম; কিন্তু একটা বিশেষ কার্য্যের জন্য যাইতে পারিলাম না।
এবার বাকী খাজনার জন্য অনেকগুলি ভাল ভাল মহল নিলামে বিক্রয় হইবে। আমি সেরেস্তাদার মহাশয়ের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া জানিতে পারিয়াছি যে, সামান্য টাকায় সেই সকল মহল কিনিতে পারিলে, ভবিষ্যতে বেশ দশ টাকা লাভ হইবে। আমি আমলাদিগকে বশ করিয়া আবশ্যকীয় সমস্ত তথ্য সংগ্রহ ক’রেছি, কাৰ্য্য শেষ হইলে সন্তুষ্ট করিব বলিয়া আশা দিয়াছি। তারা আমার কথায় বিশ্বাস ক’রে, যথাসাধ্য সাহায্য করছেন। আমি আপাতত এই যোগাড়ে ব্যস্ত আছি, সেই জন্য বাড়ী যাইতে পারিলাম না।
*** আষাঢ় নিলামের দিনস্থির হইয়াছে বটে, কিন্তু ইহার মধ্যে সব কাগজপত্র দেখিয়া ওয়কিহাল হ’য়ে থাকতে হবে, তাহ’লে দখল পাবার জন্য আর বিশেষ বেগ পেতে হবে না।
আপাততঃ টাকার কোন আবশ্যক নাই; মহল কেনা হইলে আমি পত্র লিখিব, আপনি নিজে টাকা আনিয়া সরকারে জমা দিবেন। আমলাদের সাহায্যে খুব সামান্য টাকায় বেশ লাভের মহল কিনিতে পারিব; কিন্তু আগে সব ভিতরের খবর জানা আবশ্যক, তাহ’লে কেহ কোনরূপে ঠকাইতে পারিবে না।
আমি এক্ষণে এই যোগাড়ে ব্যস্ত আছি, কাজেই বাড়ী যাইতে বিলম্ব হইবে, আপনি ভাবিত হইবেন না, আপনার আশীর্ব্বাদে কায়িক কুশলে আছি। ইতি ১১৭২ সাল,
২১ জ্যৈষ্ঠ।
সেবক—শ্রীমোহিতলাল সরকার।
কর্ত্তা পত্রখানি আমার হাতে দিলেন; আমি আগাগোড়া পাঠ করিলাম বটে, কিন্তু প্রাণে একটা বিষম খটকা উপস্থিত হইল, মোহিতবাবুর পত্রের কথা বিশ্বাস করতে আদৌ প্রবৃত্তি হ’লো না। কারণ মোহিতবাবু যে কিরূপ ধরণের লোক, তাহার মতি গতি যে কিরূপ তাহা আমি এই কয়দিনের মধ্যে উত্তমরূপে বুঝিতে পারিয়াছি। নরপিশাচ কর্ত্তার বহু পাপার্জ্জিত অর্থ পাপ কার্য্যে নিঃশেষ করবার অন্য যে তাহার জন্ম, এই ধারণাই আমার মনে প্রবল আছে; সুতরাং সেই ঘোর অপব্যয়ী হস্তীমূর্খ মোহিতকুমার কর্ত্তার বিষয় বাড়াবার জন্য যে এরূপ যত্নশীল হবে, তাহা কিছুতেই সম্ভবপর নহে। নিশ্চয় কথাগুলি আগাগোড়া মিথ্যা, কেবল কৃপণ-প্রধান অর্থলোভী কৰ্ত্তাকে স্তোক দিবার জন্য এই পত্রখানি লিখিত হ’য়েছে; নিশ্চয় মোহিতবাবু অন্য কোন একটা ব্যাপারে ব্যস্ত হ’য়েছেন। আমি পূর্ব্ব হইতেই তাহার বিদ্যা বুদ্ধি ও স্বভাব প্রকৃতির বিশেষ পরিচয় পেয়েছি, সুতরাং তাহার ন্যায় বাল্যসখা, নীতিজ্ঞানবর্জ্জিত উচ্ছৃঙ্খল যুবার কলুষিত চিত্ত যে কোন সৎপ্রসঙ্গে আকৃষ্ট হবে, পাষাণ মৃদুতাপে দ্রবীভূত হ’য়ে যাবে, পঙ্কিল-কূপে পদ্ম বিকশিত হবে তাহা কিছুতেই সম্ভবপর নহে। পুত্ত্রের মতি গতি ও আচার ব্যবহারে পিতার পুণ্য প্রকাশ পাইয়া থাকে, সেই জন্য গুণবান সৎপুত্ত্ৰ লাভ সাধনা সাপেক্ষ ব’লে বুধগণ কর্তৃক উক্ত হ’য়েছে। এ জগতে অর্থের নিকট যে আত্ম বিক্রয় ক’রেছে, সঞ্চয় ব্যতীত জীবনে যার আর কোন কৰ্ত্তব্য নাই; প্রত্যেক তাম্রখণ্ডকে যে হৃদয়ের অস্থি তুল্য জ্ঞান করে, দয়ামায়া প্রভৃতি মনুষ্যোচিত কোনল প্রবৃত্তি যার হৃদয়-মন্দিরে কখন এক মুহূর্ত্তের জন্য প্রবেশ লাভ করতে পারে নাই; সেরূপ কঠিন প্রাণ নরপ্রেতের ভাগ্যে বিলক্ষণ সুশীল পুত্ত্র লাভ নিতান্ত অসম্ভব, অকাট্য ঐশ্বরিক নিয়মবলে পিতৃকৃত পাপের প্রায়চিত্ত পুত্ত্রের দ্বারায় সমাধা হইয়া থাকে; সৃষ্টির প্রারম্ভ হ’তে এই নিয়ম বলবৎ আছে, কখন কাহার ভাগ্যে অন্যথা হওয়া কিছুতেই সম্ভবপর নহে। সুতরাং মোহিতবাবুর পত্রের একটি অর্থও যে সত্য নয়, তিনি যে অন্য কোন নীচ-আমোদে উন্মত্ত হ’য়েছেন তাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
আমার মনে এই সকল কথা তোলাপাড়া হইতে লাগিল, কিন্তু কর্ত্তার মনে কোন প্রকার সন্দেহ হ’লো ব’লে বোধ হ’লো না। বরং আমার পারানীর দরুণ দু দুটো পয়সা বেঁচে গেল ব’লে তিনি অনেকটা সন্তুষ্ট হ’লেন এবং হাসি হাসি মুখে পয়সা দুটী পুনরায় বাক্সের মধ্যে রাখিয়া দিলেন। আমি অর্থপিশাচ নরাধমের ঈদৃশ নীচতার পরিচয় পেয়ে মনে মনে নিতান্ত বিরক্ত হইলাম এবং সে স্থান হ’তে উঠিয়া আসিলাম। ভাবে বোধ হ’লো যে, তাহার গুণবান্ পুত্ত্রের কথাতে অবিশ্বাস হয় নাই, সমস্ত সত্য বলিয়া জ্ঞান হইয়াছে।
আমি কর্ত্তার নিকট হ’তে উঠিয়া আসিলাম বটে, কিন্তু প্রাণের খট্কা, মনের সন্দেহ কিছুতেই লয় হইল না, কাজেই মোহিতবাবুর জন্য বিশেষ চিন্তিত হইলাম। কুসংসর্গে মিশিতে আমি তাহাকে পুনঃ পুনঃ নিষেধ ক’রেছিলাম, দেবীপ্রসাদ প্রমুখ বদমাইসেরা যে কিরূপ দরের লোক, তাহাও বুঝাইয়া দিয়াছিলাম, তিনিও আমার অনুরোধ রক্ষা করতে স্বীকৃত হ’য়েছিলেন। বিশেষ তাঁহার প্রাণের বন্ধু-বান্ধবেরা যে কিরূপ দরের ভদ্রলোক তাহাও তিনি স্পষ্ট বুঝিতে পারিয়াছেন, তবে তিনি কি এতদূর কাণ্ডজ্ঞানশূন্য নির্ব্বোধ হবেন যে, আবার সেই সব নরপ্রেতদের সঙ্গে মিশিবেন? বিশেষরূপে তাদের উদ্দেশ্য জেনে, তাদের প্রাণের খবর ও মতিগতির পরিচয় পেয়ে পুনরায় কি সেই ফাঁদে পতিত হবেন, ইহা কি সম্ভব? মনুষ্য কি কখন এতদূর নির্ব্বোধ হয়? কিন্তু হায়, তখন আমি জানি নাই যে, অর্থপিশাচ সুদখোর, বড়মানুষের ঘরে আস্তো মা ভগবতী বিশেষ মাংসপিণ্ডময় নিরেট মূর্খ পুত্ত্ৰ, কেবলমাত্র পিতার সুদারুণ পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য জন্ম গ্রহণ ক’রে থাকে; কাজেই তারা বিদ্যায় কুকি, সভ্যতার সাঁওতাল ও বুদ্ধিতে হাবা তাঁতির পিতামহ হ’য়ে থাকে। মোহিতকুমার যখন মহাপাপী মাণিকলালের একমাত্র পুত্ত্র, তখন তিনি যে বোকার সর্দ্দার ও নিরেট মূর্খ হবেন, যে ডালে বসবেন, সেইটাই কাটবেন, জেনে শুনে অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিবেন, নিজের সর্ব্বনাশকে নিমন্ত্রণ ক’রে স্বগৃহে আনবেন, তার আর আশ্চর্য্য কি? ফলকথা মোহিতবাবুর পত্রের এক বর্ণ যে সত্য নয়, খাজানার দায়ে বিক্রিত মহল কেনা যে ওজর মাত্র, তাহা আমি স্পষ্ট বুঝিতে পারিয়াছিলাম। কারণ আত্মবঞ্চক মহাপাপী কৃপণের ধন শেষে কি হয়, জগতকে তাহাই দেখবার জন্য তিনি এই ভবধামে আগমন ক’রেছেন। সুতরাং তার মাথায় বিষয় ওড়ানো ছাড়া বাড়ানোর মতলব কিছুতেই প্রবেশ করতে পারে না। পত্রে যে ওজর করা হ’য়েছে, তাহা কখনই তার বুদ্ধিতে যোগায় নাই, নিশ্চয় অন্য কোন সুচালাক বদমাইস এই চিঠিখানি মুসবিদা করে দিয়েছে। তাহ’লে নিশ্চয়ই অন্য কোন বদলোকের সঙ্গে তাহার মিলন হ’য়েছে, তাদের প্ররোচনায় তাহার রুচীমত নানাপ্রকার পশুপ্রমোদে প্রমত্ত হ’য়ে প’ড়েছেন; যাই হোক, সময় পেলে তাহার সন্ধানটা দেখতে হবে।
মোহিতবাবুর জন্য আমার মনে বিষম ভাবনা হইল; বোধ হয় দেবীপ্রসাদের মিষ্ট কথায় তুষ্ট হ’য়ে আবার ফাঁদে পা দিয়াছেন। আমার উপদেশবাণী আর তার মনে নাই, সম্ভবতঃ বক্সী বেটার মতলবে কর্ত্তার ন্যায় কৃপণকে দিন কয়েকের জন্য নিরস্ত রাখার অভিপ্রায়ে বুদ্ধি খরচ ক’রে ঐ পত্রখানি লিখেছেন। যাই হোক কর্ত্তার অজ্ঞাতে সুবিধামত একবার মুরশিদাবাদে গিয়ে মোহিতবাবু কোন্ মহল কেনবার জন্য ব্যস্ত হ’য়েছেন তা জেনে আসতে হবে।
আমি এই মতলব মনে মনে স্থির ক’রে রাখলাম, কিন্তু প্রকাশ্যে কাহাকেও কোন কথা বলিলাম না। প্রথামত এন্টনি সাহেব ইংরাজী পড়াইবার জন্য আসিলেন, আমি আমার ইংরাজী পুস্তক লইয়া পড়িতে বসিলাম। তিনি আমাকে নূতন পড়া দিলেন ও মোহিতবাবুর সম্বন্ধে অনেকগুলি কথা জিজ্ঞাসা করিলেন।
আমার এই মাষ্টারটি আরমেনিয়ান সাহেবের সন্ততি সত্য, কোট পেণ্টুলেন পরিধান করেনও বটে, কিন্তু ধরণধারণ চালচলন অনেকটা এ দেশবাসীরমত হ’য়েছে, সকলের সঙ্গে বেশ পরিষ্কার বাঙ্গালায় কথাবার্ত্তা বলেন, বাঙ্গালীদের বাড়ীতে কলাপাতে পরমানন্দে ডাল ভাত বা লুচি তরকারী আহার করেন, কাজেই অনেক ভদ্র বাঙ্গালীর সহিত তাহার বেশ দহরম মহরম জন্মাইয়াছে। বিশেষ তিনিও বাঙ্গালীদের সঙ্গে মিশিতে ভালবাসিতেন, অনেকটা এ দেশী কায়দায় থাকতেন, মেম সাহেব মুদির দোকান হ’তে তেল নুন কিনিয়া আনিত, পাউরুটী বিস্কুটের বদলে মসুরের ডালের ঝোল ও অন্নে উদরদেবের তৃপ্তিসাধন করতেন, বাড়ীতে মুসলমানদের মত একটা লুঙ্গি পরিতেন, কেবল বাহির হইবার সময় সেই রকমারি তালি শোভিত প্রপিতামহের আমলের সেই কাশ্মীরের কোট পেন্টুলেনটি পরিতেন ও নেহাৎ বদরংয়া ঝাজরার ন্যায় অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত, মান্ধাতার আমলের সেই কালো টুপিটি মাথায় দিয়া সাহেব হইতেন। তখন ইংরাজ বাহাদুরদের প্রভাব দেশ মধ্যে বদ্ধমূল হ’য়েছিল; দেশের মালীক যে কে তাও ছোট বড় সকলে বুঝতে পেরেছিল, কাজেই শাল দোশালার চেয়ে হ্যাটকোটের মান খুব বেড়ে উঠেছিল। সেই জন্য এই ডাল ভাত খেকো দেশী সাহেবকেও অনেকে খাতির করিত, ছোট ছেলেরা দেখলেই ভয়ে পালাতো; মেয়েরা আঁৎকে উঠে “বাপরে সাহেব” ব’লে দোরে খিল দিত, কেন না, তখন সাহেবের বাজার ততো সস্তা হয় নাই, ক্বচিৎ হ্যাটকোটধারী গৌরাঙ্গমূর্ত্তি লোকের দৃষ্টিপথে পতিত হইত।
সাহেবের পুরা নাম রোজারেব এন্টুনি, ইংরাজী কায়দায় বাপের নাম জিজ্ঞাসা করা ভয়ানক অসভ্যতার কাজ, কাজেই একটা সাহেব মানুষকে বাপের নাম জিজ্ঞাসা করতে আমার সাহসে কুলায় নাই। কাজেই সাহেবের জন্মদাতা যে কে ছিলেন, তা আমি জানিতে পারি নাই; কিন্তু আমি জানি খোদ সাহেব এ কথাটা ঠিক জানেন কি না, সে সম্বন্ধেও আমার বিলক্ষণ সন্দেহ আছে। উপস্থিতে গোমিস্ এন্টুনি নামে তাঁহার এক ভাই ও এ দেশবাসিনী এক লালবেগীর কন্যা মেম ভিন্ন আর সাহেবের কোন আপনার জন নাই। সাহেব সেই কাল কুচ্কুচে মেম সহ একখানি খোলার ঘরে বাস করেন ও রেসমের কাজ দ্বারায় জীবিকা নির্ব্বাহ করেন, বাড়ার ভাগ কর্ত্তার অনুরোধে আমাদের ইংরাজী পড়াইতেছেন।
এই সাহেবটী একহারা সৃষ্টিছাড়া ঢেঙ্গা, দু-হাজার মানুষের মাঝখানে সংকীর্ত্তনের ধ্বজার ন্যায় তাহার মাথাটি উঁচু হইয়া থাকে; কাজেই মুড়ো তালগাছ কি তালপাতার সেপাহীর সহিত সাহেবকে তুলনা করলে বোধ হয় উপমার বিশেষ কোন দোষ হয় না।
সাহেবের রংটা মেটে মেটে, তবে ততদূর পালিস করা নয়, মুখখানি বাটীর মত গোল ও ডায়মণ্ডকাটা, অর্থাৎ মা শীতলার চিরস্থায়ী অনুগ্রহের চিহ্নে চিহ্নিত। সাহেবের মুখে লোমের ভাগ খুব অল্প, গোঁফের স্থানে খড়্কের খোঁচার ন্যায় ফাঁক ফাঁক দু-একগাছা রোম বিদ্যমান আছে; কিন্তু দাড়িটী একেবারে প্লেন, কাজেই সাহেব চির দিনের মত পরামাণিককে ফাঁকি দিয়েছেন, কখন খুরের সঙ্গে শ্রীমুখমণ্ডলের মিলন হয় নাই, তবে তার সেই মুখে কর্কশতা ও নিষ্ঠুরতা যেন মাখানো আছে।
সাহেব অন্য দিন অপেক্ষা মোহিতবাবুর সম্বন্ধে আজ অনেক কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। তাঁহার একটা কথায় আমার মনে বিষম সন্দেহের উদয় হ’য়েছিল, কিন্তু তিনি ভেঙ্গেচুরে কোন কথা বলেন না। কাজেই আমি কোনরূপ মীমাংসায় উপনীত হ’তে পারলাম না, কেবল অন্তর মধ্যে অভিনব খটকার উদয় হইল।
দু-চারটা অন্য কথার পর সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা, মোহিতবাবুর ভিতরের সব কথা ত তুমি জান, এখন সত্য ক’রে বল দেখি মুরর্শিদাবাদে কোন গৃহস্থের মেয়ের সঙ্গে মোহিতবাবুর আসনাই আছে কি না?”
আমি অনেকটা বিস্মিতভাবে উত্তর করিলাম, “কৈ না, আমি তো এ সম্বন্ধের কোন কথা জানি না; কিন্তু আজ আপনি আমাকে একথা জিজ্ঞাসা করলেন কেন? আপনি কি এ সম্বন্ধের কোন খপর জানেন?”
সাহেব আমার কথার উত্তর না দিয়া, অন্য কতকগুলো বাজে কথা বলে কথাটাকে উড়িয়ে দিবার চেষ্টা করলেন। আমি প্রকৃত ব্যাপারখানা জানার জন্য একটু চেষ্টা করিলাম বটে, কিন্তু ধড়িবাজ সাহেবের মুখ দিয়ে প্রকৃত কথা বার করতে পারলাম না, তিনি কেবল ছেলে ভুলানো গোচের কতকগুলো বাজে কথা ব’লে আমাকে নিরস্ত করলেন।
সাহেব প্রস্থান করিলে পর মোহিতবাবুর চিন্তা আমার মনোমধ্যে প্রবল হইল। আমি ভাবিতে লাগিলাম যে, আজ সাহেব আমাকে মোহিতবাবুর সম্বন্ধে একথা কেন জিজ্ঞাসা করলেন? সাহেব আমার কাছে কোন কথা ব্যক্ত করলেন না বটে, কিন্তু ইহার মধ্যে নিশ্চয় কোন গূঢ় রহস্য নিহিত আছে। সাহেব অনেকটা ভিতরের কথা জানেন, কেবল আমার কাছে ব্যক্ত না করে পাঁচটা বাজে কথা ব’লে চাপা দিলেন। ফলকথা মুর্শিদাবাদে একবার গিয়া মোহিতবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ না করিলে এ সব কথার কোন মীমাংসা হবে না।
আহারাদির পর নিজের সেই কক্ষে শয়ন ক’রে এই সকল কথা মনে মনে তোলাপাড়া করতে লাগলাম, কিন্তু কোন বিষয়েরও মীমাংসা করতে পারলাম না। কাজেই তরঙ্গে কাণ্ডারিহীন তরীর ন্যায় আমার মন চিন্তা-সাগরে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল, কিছুতেই আর কূলে উপস্থিত হ’তে পারলাম না।
ক্রমে বেলা তিনটে বেজে গেল, আমি একাকী সেই শয্যার উপর শয়ন ক’রে বিবিধপ্রকার মানসিক যাতনায় শরবিদ্ধ মৃগের ন্যায় ছট্ফট করিতে লাগিলাম, কিছুতেই আর শান্তিলাভে সমর্থ হইলাম না। সেই দিনকার রাত্রের পৈশাচিককাণ্ড স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ ক’রে, রামা খানসামার উপর আমার ভয়ানক ঘৃণার উদ্রেক হ’য়েছিল, কাজেই তার সঙ্গে বড় কথাবার্ত্তা কহিতাম না; এক চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের কাছে আমার ক্ষণেক জুড়াবার স্থান ছিল, কিন্তু তাহার অবসর খুব অল্প ছিল; প্রায় তাঁহাকে বাহিরে ঘুরিতে হইত, আমার কাছে প্রায় বসিতে পারিতেন না, কাজেই মোহিতবাবু প্রস্থান করিবার পর হইতে আমাকে প্রায় একাকী বাস করিতে হইত। কয়েদির ন্যায় এইরূপ নির্জ্জনে বাস ক্রমে আমার পক্ষে নিতান্ত অসহ্য হইয়া উঠিল; কাজেই বৈকাল সমাগত দেখিয়া খানিকটা বেড়াবার জন্য চাদরখানি কাঁধে ফেলিয়া বাটী হইতে বাহির হইলাম।