» » হরিদাসের গুপ্তকথা

বর্ণাকার

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

গুণের খানসামা।

যদিও চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের নিকট কর্ত্তার গুণের সব কথা শুনি নাই, কিন্তু তথাপি তাহাকে একটা ঘোর পাষণ্ড নীচাশয় ব’লে আমার মনে মনে স্থির বিশ্বাস হ’য়েছিল। কারণ এই জগৎ মধ্যে একমাত্র অর্থ যার উপাস্য দেবতা, যে কোন উপায়ে হোক্ সঞ্চয় করা যায় জীবনের সারব্রত, সেরূপ নিৰ্ম্মম-হৃদয় অর্থপিশাচ ব্যয়কুণ্ঠ্য কৃপণ কখনই সহৃদয় সরল প্রকৃতি সৎলোক হ’তে পারে না। কাজেই আমি অদৃষ্ট দোষে একটা নরককুণ্ড হ’তে অন্য একটায় এসে পড়লাম্, কেন না, কিষণজি বাবু আর এই ভূঁড়ো-কৰ্ত্তা দু-জনেই এক-দরের লোক। ধৰ্ম্মজ্ঞান, কি মনুষ্যোচিত সদ্‌গুণাবলী কাহার নাই, তুচ্ছ অর্থের জন্য উভয়েই পিশাচ অপেক্ষা নিষ্ঠুর, কি সর্প সম ক্রুর হ’তে পারে, তবে প্রভেদের মধ্যে এই যে কিষণজি সেই পাপার্জ্জিত অর্থ জলের ন্যায় অকাতরে খরচ করে, নিজের ভোগবিলাসকে চরিতার্থ করতে কুণ্ঠিত হয় না, কিন্তু ভূঁড়ো-কর্ত্তা কেবল পরের জন্য সঞ্চয় ক’রে রেখে গেল, ভোগ করা তাহার ভাগ্যে ঘটিয়া উঠিল না। কেবল পাপের পসরা মাথায় নিয়ে, জগতের ঘৃণা ও নিন্দা কুড়িয়ে প্রেতপুরে চললো; মানুষের কুলে জন্ম ল’য়ে মানুষ ব’লে পরিচয় দিতে পারল না।

ভূঁড়ো-কর্ত্তার কাহিনীর শেষ ভাগটা শোবার ইচ্ছা আমার মনে নিতান্ত প্রবল হ’য়েছিল, আমি কিছুতেই আমার সেই কৌতূহলকে দমন করতে পারলাম না। চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের একটা কথায় আমার বিশেষ খট্‌কা হ’রেছিল, আমি কিছুতেই এ কথাটার কোনরূপ মীমাংসা করতে পারি নাই। তিনি বলেছিলেন যে, কৈবর্ত্ত নিধিরাম মাইতির পুত্ত্র মাণিকলাল মাইতি কিন্তু তবে ভূড়ো-কর্ত্তা সরকার উপাধিধারী বাহাত্তুরে-কায়েত কিরূপে হ’লেন? পুরুষের অর্থ হ’লে অবস্থার পরিবর্ত্তন হয়, মেজাজ ফিরে যায়, গরিব আত্মীয় স্বজনকে আর চিনিতে পারে না; কিন্তু টাকা হ’লে যে জাতেরও পরিবর্ত্তন ঘটে, কৈবর্ত্ত-নন্দন কায়েস্ত হ’য়ে পড়ে তা জান্‌তাম না, কাজেই সন্দেহ-পবনে আমার হৃদয়ার্ণব খুব উদ্বেলিত হ’য়ে উঠেছিল। হায়, এ সংসারে অর্থের কি মোহিনী-মায়া, কি অপ্রতিহত প্রভাব, বোধ হয় এই জন্য তত্ত্বজ্ঞ মহাত্মারা এই অর্থকে অনর্থের মূল ব’লে নির্দ্দেশ ক’রেছেন; কিন্তু সংসারী মানবের পক্ষে ইহা যে অতীব আবশ্যকীয় পদার্থ তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। একমাত্র ইহার অভাবে নিতান্ত প্রতিভাশালী ব্যক্তিরও অনন্য সাধারণ প্রতিভার আদৌ বিকাশ হয় না, গুণ থাকিলেও গ্রহণের চাঁদের ন্যায় নিতান্ত নিষ্প্রভ হ’য়ে পড়ে; পদানত লতিকার ন্যায় ভারতীয় সুপুত্ত্রেরা অনাদৃতভাবে অবস্থান করে, কিন্তু আবার এই অর্থের প্রভাবে ঘোর হস্তীমুর্খ বুদ্ধি বলে জন-সমাজে সমাদৃত হয় এবং নিতান্ত কদাচারী পাষণ্ডকে আমোদপ্রিয় উদার ব’লে লোকে সুখ্যাতি ক’রে থাকে। ফলকথা যেমন সর্ষপ তৈলে সকল প্রকার দুর্গন্ধকে নষ্ট করে, তেমনি টাকার প্রভাবে সকল প্রকার দোষ চাপা প’ড়ে থাকে। রাজার নিয়ম, সমাজের শাসন, কেবল দরিদ্রের জন্য, ধনীদের নিকটস্থ হ’তে পারে না। তারা বন্ধন পরিশূন্য বলীবর্দ্ধের ন্যায় ইচ্ছামত স্বচ্ছন্দে নির্ভয়ে সংসার-মাঠে বিচরণ ক’রে থাকে।

আমি পরদিন আহারাদির পর চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের নিকট উপস্থিত হইলাম এবং আমার অনুরোধক্রমে তিনি পুনর্ব্বার ভূঁড়ো-কর্ত্তার পূর্ব্ব কাহিনী বলতে আরম্ভ করলেন।

“রামকৃষ্ণ মাষ্টারের কাছে শ্রীমান ইংরাজী শিখিতে আরম্ভ করিল; প্রত্যহ পড়িতে যাইবার অবসর হইত না, মাঝে মাঝে ফুরসুত মতন মাষ্টার মহাশয়ের বাড়ীতে গিয়া বিনামূল্যে তাহার মস্তক ক্রয় করিত। তবে গুরুমহাশয়ের ন্যায় মাষ্টার মহাশয়ও তাহাকে সোণার চক্ষে দেখতেন; কারণ লেখা পড়া যত হোক্ না হোক্‌, কাঠ কাটা, জল তোলা, গরুকে জাব দেওয়া প্রভৃতি কাজ করিত, কাজেই ছেলেটা যে নেহাৎ ভাল, তাহা মাষ্টার মশার ও তাঁহার পত্নী উভয়ে এক বাক্যে স্বীকার করিতেন।

এইরূপে প্রায় দুই তিন বৎসর কাটিয়া গেল। এই সামান্য সময়ের মধ্যে শ্রীমান্ স্বীয় অসামান্য প্রতিভাবলে, প্রায় দু-কুড়ি ইংরাজী কথা মুখস্ত করিয়া ফেলিল; গ্রানে গুজব উঠিল, শ্রীমান্ মাণিকলাল দৈত্যকুলের প্রহ্লাদের ন্যায় চাষাকুলে একখানা আস্তো বিদ্বান্ ছেলে হ’য়ে উঠেছে।

এইখানেই শ্রীমানের লেখাপড়া শিখিবার ইতি হইল, জন্মের মত না সরস্বতীর সঙ্গে দলাদলি বেধে গেল; কারণ নিধিরামের কর্ম্মভোগ কিঞ্চিৎ অল্প ছিল, সেই জন্য একদিন হঠাৎ বিসূচিকা রোগে পতিত হ’য়ে ইহধামের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ত্যাগ করিল। ছেলে লেখাপড়া শিখে কৃতি-পুরুষ হ’য়ে পিতা মাতার উপর কিরূপ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তা আর দেখতে হ’লো না। তার ভোগ অল্প ছিল, তাই অল্পে মিটিয়া গেল, যত ভোগা কেবল মাগীকে ভুগিতে হইল; কেন না মাগী আরো দিনকতক বাঁচিয়া কীর্ত্তিকুশল ছেলের লীলা-খেলা দেখিয়া চক্ষের জলে ভাসিতে ভাসিতে মরিয়াছিল। মাগী শ্রীমানকে রোজ “বেঁচে থাক” বলে আশীর্ব্বাদ করতো, কিন্তু তার একমাত্র লেখাপড়ার উপর বড় রাগ হ’য়েছিল, সেই জন্য বুড়ী প্রাণ খুলে শাপ দিয়েছিল যে, তার বংশে আর যেন কেহ কখন লেখা পড়া না শিখে।

কৈবর্ত্ত-নন্দন মাণিকলালের উদর মধ্যে দু-চারটা ইংরাজী অক্ষর প্রবেশ ক’রেছে, কাজেই সেই সঙ্গে ভদ্রলোক হবার হকদার তাহার পৌঁছিয়াছে। সেই জন্য ছোট লোকের ন্যায় কোন ছোট কাজে তিনি আদৌ হাত দিতেন না; এমন কি তেলের ভাঁড় হাতে নিয়ে কলু বাড়ী হ’তে তেলটুকু আনাও বিশেষ অপমানজনক ব’লে বোধ করতেন। শ্রীমানের ছোট ভাই চুণিলাল ইংরাজী শিখে নাই, সুতরাং ভদ্রলোক হ’তে পারে নাই, প্রকাণ্ড আত্মমৰ্য্যাদা জ্ঞান জন্মায় নাই; কাজেই বেচারীকে সংসারের সমস্ত কাজকর্ম্ম সেরে, তারপর মাঠে গিয়ে চাষ আবাদ দেখতে হ’তো। বাবু কেবল ময়ূরহীন কার্ত্তিকের মত সরষের তেল দিয়ে টেরি কেটে, খারে-কাচা ফরসা কাপড়খানি পরে টপ্পামেরে বেড়াতেন, বিদ্বান্ ছোক্‌রা ব’লে হঠাৎ কেউ কিছু বলতো না।

চাষার ঘরে একটা এতদূ’র জলজেন্ত বিদ্বান্ ছেলে আইবুড় থাকা কিছুতেই সম্ভবপর নহে, তার উপর অবস্থাও নিতান্ত হীন নহে; কাজেই বিদ্বান্ মুর্খ দুই ভায়েরই এক সঙ্গে বিবাহ হইল। শুভক্ষণে কি কুক্ষণে ঠিক জানি না, দুই বৌ বাড়ীতে প্রবেশ করিতেই লক্ষ্মীঠাকরুণ প্রাণের ভয়ে থিড়কির দোর দিয়ে আস্তে আস্তে সরে পড়লেন। কারণ বৌমাদের পদার্পণে বাড়ীতে নারদ ঋষির পূর্ণ আবির্ভাব হ’লো, সজোরে রণবাদ্য বেজে উঠলো। যোদ্দারা (ব্যাকরণের কিঞ্চিৎ লিঙ্গ ভুল হইল, পাঠক মহাশয়েরা ক্ষমা করিবেন।) রসনা-তূণ হ’তে বাছা বাছা শাণিত বাণ বার করে পরস্পরকে বিদ্ধ করতে আরম্ভ করল, ঘরের চালে কাক চিল পৰ্য্যন্ত বসতে আর সাহস করতো না, কাজেই অশান্তির ঝড় নিধিরামের শান্তিময় গৃহে খুব সজোরে বহিতে লাগিল।

সুশিক্ষিত মাণিকলাল এই ব্যাপারে নিতান্ত চটিয়া গেল ও যত দোষ ঐ চাষা ছোড়া ও বিনা মাহিনার চাকরাণী মা মাগীর ঘাড়ে চাপাইল। শ্রীমান্ বুঝিয়া দেখিল যে, এই সকল অসভ্য মূর্খ ছোটলোকদের সঙ্গে থাকিলে কোনকালেও তাহার ভাল কি উন্নতি হইবে না। অমূল্য মাণিক অযতনে ঘাসের মধ্যে প’ড়ে থাকবে, তিনি যে একটা মানুষের মতন মানুষ হ’য়েছেন, তা কেউ জানতে পারবে না। মাণিকলাল এই স্থির ক’রে ভাইয়ের সঙ্গে ভিন্ন হ’লো; টাকা কড়ি গহনা পত্র ও বাসনকোসন, চুল-চিরে বখরা ক’রে লইল। তবে সম্প্রতি তিনি ভদ্রলোক হ’য়েছেন, যদি এ সম্বন্ধে কেহ কিছু সন্দেহ করে বা চাষার ছেলে ব’লে মানহানি ঘটায়, এই আশঙ্কায় তিনি বলদ লাঙ্গল প্রভৃতি চাষের জিনিসের ভাগ না নিয়ে কেবল মূল্য গ্রহণ করিলেন। তিনি ইংরাজী শিখে ভদ্রলোক হ’য়ে এক পইঠে উপরে উঠেছেন, সুতরাং আবার হ’টে এসে ছোটলোকদের মত তো আর মাঠে গিয়ে চাষ করবেন না, কাজেই অনাবশ্যক বোধে ও কতকটা সম্ভ্রম বজায়ের জন্য, এ সব দ্রব্য গ্রহণ করিলেন না, কেবল নগদ টাকাকটি ট্যাকে গুঁজিলেন।

শ্রীমান্ মাণিকবাবু নিজের শয্যা-সঙ্গিনীটীকে নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে ভিন্ন হ’লেন। শ্ৰীমান্ সকল জিনিসের অর্দ্ধেক হিসাবে ভাগ নিয়েছিলো, কেবল নিজের অসাধারণ উদারতাগুণে মা নামে সেই চাকরাণী মাগীর ও এক সের আলো-চাউল খাইয়ে গদাধর-জীউ নামক বিগ্রহের ষোল আনা স্বত্ত্ব ভাই চুণিলালকে দিয়াছিল। অসভ্য চুণিলাল তেমন লেখা-পড়া, বিশেষ ইংরাজী আদৌ শিখে নাই, বুদ্ধির ডগা ততদূর সরু হয় নাই, লাভ লোকসান বোঝবার ক্ষমতা জন্মায় নাই; কাজেই উদার হৃদয় দাদা দয়া ক’রে যাহা দিল, তাহাই মাথায় করিয়া লইল, কোন বিষয়ে বিন্দুমাত্র আপত্তি করিল না।

অসভ্য চুণিলাল পিতার চাষবাস করিয়া এক প্রকার সুখে স্বচ্ছন্দে দিন কাটাইতে লাগিল। কিন্তু হালের ভদ্রলোক শ্রীমান্ মাণিকলাল মানের ভয়ে কোন ছোট কাজে হাত দিতে পারিল না, কাজেই ভাগে বাহা পাইয়াছিল, তাহাই ভাঙ্গাইয়া উদর দেবের পূজা করিতে লাগিল; সুতরাং অল্প দিনের মধ্যে তাহার পূঁজিতে ভাটার টান ধরিল, ভাঁড়ের কর্পূর শেষ হবার উপক্রম হইল। কেন না এই সংসারে আলস্যের দাস হ’য়ে নিরবচ্ছিন্ন বসিয়া ব্যয় করলে, ক্রমে ক্রমে কুবেরের ভাণ্ডারও শূন্য হয়ে যায়; আবার অন্যদিকে শ্রমসহিষ্ণু উদ্যোগী পুরুষেরা সংসারে অভাবের তীব্র-যাতনা একদিনের জন্যও অনুভব করতে পারে না। সন্তোষের শরণাপন্ন হ’য়ে চিরকাল মনের সুখে কালযাপন করিয়া থাকে।

ক্রমে ক্রমে মাণিকলালের বেশ টানাটানি আরম্ভ হইল, দিন চলা এক রকম ভার হ’য়ে উঠলো, শেষে আর কোন উপায় না দেখিয়া স্ত্রীকে পিত্রালয়ে পাঠাইয়া দিল এবং নিজে চাকরীর জন্য বাড়ী হইতে বহির্গত হইল। মাণিকলাল মাষ্টারের কাছে থেকে প্রায় দু-কুড়ি ইংরাজী কথা শিখেছিল, অন্তরে যথেষ্ট গৰ্ব্বও জন্মেছিল। তাহার মনে মনে ধারণা ছিল যে, তাহার নাম-ডাক শুনে সাহেবেরা নিজে এসে দেখা ক’রে শেষে চাকরী দিবে; কিন্তু এতদিন কেটে গেল, কোন সাহেব তাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলো না, তৃষ্ণাতুরের ভাগ্যে জল এগিয়ে এলো না, কাজেই শেষে তৃষ্ণাকেই অগ্রসর হ’তে হলো। অতি শুভক্ষণে চাকরীর প্রত্যাশা শ্ৰীমান্ মাণিকলাল বাটী হইতে বহির্গত হইল এবং এই আজিমগঞ্জে আসিয়া উপস্থিত হইল। সে সময় বৰ্ত্তমান সাহেবের পিতা ডেভিড বার্লো সাহেব নূতন রেশমের কুটী খোলেন, তখন তাহার একজন সরকারের প্রয়োজন হইয়াছিল; কপালক্রমে মাণিকলাল সাহেবের সুনজরে পড়িল এবং ৬ টাকা বেতনে সরকারি পদে নিযুক্ত হইল।

“যেমন তেমন চাকরী ঘি-ভাত” বাঙ্গালার এই প্রচলিত প্রবাদ-বাক্য মাণিকলালের ভাগ্যে ষোল আনা সার্থক হ’য়েছিল। কারণ চাকরীতে বাহাল হ’য়েই নিজের বুদ্ধির জোরে বেশ দু-টাকা উপরি রোজগার করতে লাগলেন। খরচের দিকে না গিয়ে কিসে টাকা জমিবে তাহার জন্য নিতান্ত বিব্রত হ’য়ে পড়লেন। এক একটা পয়সাকে টাকার কুচি, বুকের রক্ত, হৃদয়ের অস্থি বলিয়া জ্ঞান করিতে লাগিলেন; কাজেই প্রাণের সখ, দেহের যত্ন, এমন কি সেই বড় সাধের ভদ্রলোক হওয়ার সখটুকুও ভুলিতে বাধ্য হইলেন। কিসে টাকা জমিবে ইহা জীবনের মূলমন্ত্র হইল, আর কোনদিকে দৃষ্টি রহিল না; কাজেই ৶১০ পয়সা নাসিক ভাড়া হিসাবে বৃন্দাবন মুদির হোগলা দিয়ে ঘেরা গইলের দাওয়াটা প্রথমে ভাড়া লইলেন এবং স্বপাকে আধখানি বেগুন দগ্ধ মাত্র উপলক্ষ ক’রে, আধসের চালের অন্নের দ্বারায় উদর নামে বিধাতার বিরাট গর্ত্তটী ভরাট করতেন। এই সময় হইতে একমাত্র টাকাই তাহার উপাস্য দেবতা হইল এবং কিসে টাকা জমিবে তাহাই ধ্যান জ্ঞান হইয়া পড়িল।

কলিকালে কমলা যে জলের ন্যায় নীচগামিনী এ কথা অভ্রান্ত সত্য। কারণ দিন দিন মাণিকলালের কপাল লুচির-ফোস্কার মত ফুলে উঠলো; কিন্তু এদিকে যত টাকা জমতে লাগলো, ততই হৃদয় কঠিন ও আরো জনাবার সাধ প্রবল হ’য়ে উঠলো। ফলকথা অভাগা মাণিকলাল বিষম নিরেনব্বূয়ের ধাক্কায় পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগলো, টাকা রোজগার ক’রেও সুখের মুখ দেখতে, কি শান্তির ছায়ায় বসতে পারলো না, মানব অদৃষ্টে ইহা অপেক্ষা আর অধিক বিড়ম্বনা কি হ’তে পারে?

মাণিকলাল সাহেব বশের মূলমন্ত্র উত্তমরূপে শিখিয়াছিলেন। সেই জন্য এই চাকরীতে বাহাল হ’য়েই মানাপমান বোধ, ধৰ্ম্মাধর্ম্মজ্ঞান এমন কি চক্ষু-লজ্জা ও মনুষ্যত্বকে পৰ্য্যন্ত অতলতলে ভাসিয়ে দিয়ে, সম্পূর্ণ প্রকারে এক নূতন ধরণের জীব হ’য়ে সাহেব সেবায় নিযুক্ত হ’য়েছিলেন। সাহেবের নিকট মেষের ন্যায় নিরীহ থাকিতেন, কিন্তু অন্য সকলের নিকট সিংহমূৰ্ত্তি পরিগ্রহ করিতেন; তবে হাতে কিছু গুঁজিয়া দিলে, একেবারে জুতার সুকতলার চেয়ে নরম হ’য়ে যেতেন; কিন্তু তার পরামর্শে ও কলমের গুণে, বার্লো সাহেবের ভাগ্যলক্ষ্মী নূতন-চেলের ফেণের মত একেবারে উলে উঠেছিল। কারণ কি উপায়ে নিরীহ তাঁতিদের বুকের রক্ত স্বরূপ সৰ্ব্বস্ব শোষণ করা যায়, তা অনভিজ্ঞ সাহেবদের উত্তমরূপে বুঝিয়ে দিয়েছিল। এমন কি বাঙ্গালীদের অন্দরমহল হ’তে বৌ ঝি টেনে আনলে তারা যে জব্দ হয়, তখন তাদের দ্বারায় যা ইচ্ছা তা লেখান বা করান যেতে পারে, তাহাও বলতে ভুল ক’রে নাই, কাজেই সরকারের পরামর্শমত কাজ ক’রে সাহেবদের রেসনের কারবারের আশাতীত উন্নতি হ’য়েছিল; কিন্তু এদিকে কত শত সম্পন্নশালী গৃহস্থ তাঁতির সোণার সংসার যে শ্মশানে পরিণত হ’লো, কত তাপদগ্ধ অভাগা সৰ্ব্বস্বান্ত হ’য়ে সন্ন্যাসীরূপে দিগদিগন্তে পলায়ন করলো, কত লজ্জাশীলা কুলকামিনী আত্মহত্যা ক’রে সুদারুণ কলঙ্কের দায় হ’তে মুক্ত হ’লো তার আয় ইয়াত্তা নাই। এক কথায় বাঙ্গালীকুলে মাণিকলালের ন্যায় স্বদেশ-দ্রোহী কুলাঙ্গার আর ছিল না বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।

সাহেবের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাবুরও যথেষ্ট উন্নতি হ’লো। ৬৲ টাকা মাহিনার সরকার হ’তে ক্রমে ক্রমে ১৫০৲ টাকা মাহিনার দাওয়ান হ’য়ে পড়লেন, এদিকে উপরি রোজগারে প্রায় তিন চারি লক্ষ টাকা জমিয়ে ফেললেন, কিন্তু চালের কিছুমাত্র পরিবর্ত্তন হ’লো না, তবে টাকার গরমে সেই বেগুণ-পোড়া দিয়ে ভাত খেয়ে ভূড়িটা খুব বেড়ে উঠলো। চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের কথায় বাধা দিয়া আমি কহিলাম, “আচ্ছা, তাহ’লে এত বড় কৃপণ এত টাকা খরচ ক’রে এরূপ বড় বাড়ী কি ক’রে তৈয়ারী করলে, এ বাড়ী তৈয়ারী করতেও বড় অল্প টাকা খরচ হয় নাই?”

আমার কথা শুনে চক্রবর্ত্তী মহাশয় একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উত্তর করলেন, “টাকা খরচ ক’রে এ রকম বাড়ী করতে হ’লে বেটার ভূড়িটা ভস্‌কে যেতো। বেটা যে রকম ক’রে এ বাড়ীখানা পেয়েছে, তা শুনলে নিতান্ত পাষাণেরও চোখ ফেটে জল পড়বে। বোধ হয় সে রকম কাজ মানুষে করতে পারে না; মানুষের উপর সেরূপ অমানুষিক অত্যাচার পিশাচের দ্বারায় সম্পন্ন হয় কিনা সন্দেহ! বেটা এত বড় ঘরটাকে একেবারে মাটী ক’রে দিলে। হায়, পূর্ব্বে যাদের বাড়ী বারমাসে তের পাৰ্ব্বণ হ’তো, দুপুরবেলা যাদের বাড়ী থেকে কোন অতিথি ফিরতো না, এই বেটা একমাত্র দাদনের কলে ফেলে, একেবারে তাদের ভিটে মাটী চাটী ক’রে ফেললে; বংশে বাতি দিতে আর কেউ রইলো না।”

আমি নিতান্ত কৌতুহলাক্রান্তচিত্তে কহিলাম, “কি উপায়ে কর্ত্তা এদের ভিটে মাটী চাটী করলেন?”

চক্রবর্ত্তী মহাশয় কহিলেন, “তবে শোন, পূর্ব্বে রামসদয় বসাক নামে একজন খুব ধনী তাঁতীর এই বাড়ী ছিল। তাহার কোন বিষয়ে বিন্দুমাত্র অভাব ছিল না, পরমসুখে দিনপাত করিত। শেষে এই বেটার কুহকে প’ড়ে অতি কুক্ষণে বার্লো সাহেবের নিকট হ’তে হাজার টাকা দাদন গ্রহণ করে, সেই দিন হ’তে অভাগাদের সর্ব্বনাশের সূত্রপাত হয়। কারণ এই বেটা চণ্ডালের কলমের গুণে বিশ হাজার টাকার রেসম দিয়েও দাদনের টাকা শোধ হ’লো না। শেষে বুড়া ও তার দু’টী ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়ে কুটীর ফটকে আটক ক’রে রাখে; শুনতে পাই আর পীড়ন সহ্য করতে না পেরে, তারা দু’জনেই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা ক’রেছে, বৃদ্ধ রামসদয় মনস্তাপে কালগ্রাসে পতিত হ’য়েছে। তারপর এই নরাধম বেটার পরামর্শে রামসদয়ের জ্যেষ্ঠ পুত্ত্রের সুন্দরী পুত্ত্রবধূকে সেপাহী দিয়ে ধরে নিয়ে যায়, সম্ভবতঃ সেও আত্মহত্যা ক’রে ধর্ম্ম রক্ষা ক’রেছে। তবে লোকের মুখে শুনেছি যে রামসদয়ের একটা পৌত্র এখনও বোধ হয় জীবিত আছে; কিন্তু কোথায় কি অবস্থায় আছে, তাহার কিছুমাত্র খবর জানি না। শেষে দাদনের বাকীর দায় রামসদয়ের প্রায় লক্ষ টাকার বিষয় ও এই বাড়ী সাহেবেরা খাস করিয়া লয়েন এবং কর্ত্তার অসামান্যগুণের পুরস্কার স্বরূপ এই বাড়ীখানি তাকে দান করেন।

তখন হ’তে কৰ্ত্তা গইলের-দাওয়া পরিত্যাগ ক’রে এই বাড়ীতে আসিলেন এবং পিত্রালয় হ’তে তাঁহার পত্নীকে আনাইলেন; কিন্তু পাছে তাহার মান সম্ভ্রম নষ্ট হয়, এই ভয়ে চুনিলাল নামে সেই অসভ্য চাষা ছোড়া কি নিধিরামের পরিবার সেই ছোটলোক মাগীর কোন খবর লইলেন না। তবে লোকমুখে তাহার ঈদৃশ অবস্থা শুনিয়া সেই বোকামাগী আহ্লাদে নিতান্ত অধীরা হ’য়ে দেখা করবার জন্য ব্যস্ত হ’য়েছিল, কিন্তু অসভ্য চুণিলাল তাহার মোটা চাষা বুদ্ধিতে বুঝিতে পেরেছিল যে, সে স্থানে গেলে কখনই মান থাকবে না। কাজেই গুণের-সাগর বড়মানুষ দাদার কাছে আসতে কিছুতেই সে সম্মত হ’লো না; কিন্তু সেই ঘোর আহাম্মুক ছোটলোক মাগী কিছুতেই নিরন্ত হলো না। কারণ তার মনে মনে বিশ্বাস ছিল যে, আমার মাণিক আমাকে পেলে কখনই স্থির হ’য়ে থাকতে পারবে না, নিশ্চয় মা মা বলে আমার কাছে ছুটে আসবে; কিন্তু তার বড় সাধের মাণিক যে একেবারে সাত রাজার ধন এক মাণিক হ’য়ে গেছে তা বোঝবার ক্ষমতা বুড়ির ছিল না। সেইজন্য মিথ্যা-বিশ্বাসের বশবর্ত্তিনী হ’য়ে অভাগিনী শূন্যপথে অট্টালিকা নিৰ্ম্মাণ ক’রে তাতে বাস করতেছিল। ফলকথা বিধাতা যে কি স্বর্গীয় উপকরণে স্নেহময়ী জননীদের অন্তর নির্ম্মাণ ক’রেছেন, তাহা একমাত্র তিনি ভিন্ন আর কাহারও বোঝবার ক্ষমতা নাই। কেন না সংসারে শত শত কুপুত্ত্র বিদ্যমান আছে; কিন্তু কুত্রাপি একটীও কুমাতা পরিদৃশ্যমান হয় না। এই সংসার রঙ্গভূমে প্রবেশ ক’রে প্রত্যেক অভিনেতাকে নিজের যত্ন শ্রম ও অধ্যবসায়ের দ্বারায় পার্থিব সকল বস্তু উপার্জ্জন করতে হয়। আগে ভাল না বাসলে কেউ ভালবাসে না, যত্ন না করলে কেউ যত্ন করে না, কিন্তু একমাত্র মাতৃস্নেহ সকলের পক্ষে অনায়াসলভ্য, কাজেই অপার্থিব ধন ঘৃণার পরিবর্ত্তে মমতা, কটুক্তির বিনিময়ে আশীর্ব্বাদ, একমাত্র না ভিন্ন আর কাহারও নিকট পাওয়া যায় না। নিঃস্বার্থভালবাসা জননীর হৃদিভাণ্ডার ছাড়া পৃথিবীতে আর কোথাও নাই। পুত্ত্রের শত শত অপরাধ বা পশুবৎ ব্যবহার, তৃণগুচ্ছের ন্যায় জননীর নিয়ত প্রবহমান স্নেহ-স্রোতে কোথায় ভাসিয়া যায়। যে নরাধম দেবীরূপা সেই মাতৃসেবায় পরাঙ্মুখ হয়, তার দুর্লভ মনুষ্য জন্ম ধারণ করাই বৃথা।

ছেলে মস্ত বড়মানুষ হ’য়ে উঠেছে, এই সংবাদ পেয়েই নিধিরামের বিধবা-পত্নী আহ্লাদে আত্মহারা হ’য়েছিল। তখন আর কিছু কু-ভাববার তার অবসর ছিল না। সেইজন্য চুণিলালের উপদেশ অগ্রাহ্য ক’রে কুটুম্ব-বাড়ী যাবার নাম ক’রে বুড়ী একবার পুত্ত্র দর্শনে এসেছিল। কিন্তু ছোটলোক বেটীর এরূপ ভয়ানক দুরাশা পূর্ণ হয় নাই। মাগী দু-তিনটা পুটুলি কাঁখে ক’রে ও ঘরে তৈয়ারি এক ভাঁর ঘি হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে যেমন সদর-দোরের কাছে এসেছে, অমনি দূর হ’তে দেখতে পেয়ে, এই নরাধম বেটা সপ্তমে সুর তুলে “দরওয়ান! দরওয়ান! ঐ বুড়ীকো আনে মৎ দেও, একদম্‌সে হাঁকায় দেও।” এই ঢালা-হুকুম দিয়ে রাগে ফুলতে ফুলতে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। বৃদ্ধা গুণধর পুত্ত্রের ব্যবহার দেখে একেবারে অবাক্, আর তার এক পা অগ্রসর হ’তে সাহস হ’ল না, কাজেই ত্রিশঙ্কু রাজার ন্যায় তাহার অবস্থা হইল। তবে কর্ত্তার দেউড়িতে কোন দরওয়ান ছিল না, সেইজন্য তাহার হুকুম তামিল করতে কেহ অগ্রসর হ’লো না। গুণের-সাগর খানসামা দেখিল যে, বাবুর অতবড় হুকুমখানা লোকবিহনে মাঠে মারা যায়, কাজেই মনিবের মান রক্ষার জন্য দরওয়ান মূৰ্ত্তি পরিগ্রহ ক’রে “আরে বুড্ডি! হিঁয়াসে ভাগো।” এই মধুর সম্বোধন ক’রে হাতখানি ধ’রে হড়হড় ক’রে টেনে বাটীর বাহির করিয়া দিল; বুড়ী মাগী সেই পুটুলি ও ঘিয়ের ভাঁড় ফেলে দিয়ে মরা-কান্না আরম্ভ করিল এবং তাহার বংশে আর কেউ যেন লেখা-পড়া না শেখে, এই অভিসম্পাত ক’রে চ’খের জল ফেলতে ফেলতে চলে গেল। সেই অবধি আর কখন ছেলেকে দেখতে যেতে বুড়ীর সাহস হয় নাই, শুনেছি বুড়ী এক্ষণে শান্তিধামে গিয়ে শান্তিলাভ ক’রেছে। চুণিলাল ও তাহার পুত্ত্রেরা এখন বহরমপুরে আছে; কিন্তু তারা কৈবর্ত্ত আর কর্ত্তা একেবারে কায়স্থ হ’য়ে পড়েছেন, সুতরাং তাদের সঙ্গে কোনরূপ সম্বন্ধ রাখা কিছুতেই সম্ভবপর নহে।

আমি একটু হাসিয়া কহিলাম, “দু’জন সহোদর ভায়ের মধ্যে কিরূপে একজন কৈবর্ত্ত ও অন্যজন কায়স্থ হইল?”

চক্রবর্ত্তী মহাশয় একটু মুচ্‌কে হেসে উত্তর করিলেন, “এই ঘোর কলিকালে ম্লেচ্ছযুগে টাকাতে সব হয়। সরষের তেলে যেমন সকল প্রকার দুর্গন্ধ বিনষ্ট হয়, তেমনি টাকার জোরে সকল প্রকার দোষ ঢাকা প’ড়ে যায়। ঘোর মূর্খ বিদ্বানের ন্যায় সম্মান প্রাপ্ত হয় এবং নিষ্ঠুরকর্ম্মা পাপাত্মাকে সকলে ধাৰ্ম্মিক-চুড়ামণি ব’লে সুখ্যাতি ক’রে থাকে। সুতরাং এই সংসারে নিতান্ত অসম্ভব ব্যাপারও সম্ভবে পরিণত হ’য়ে থাকে। কাজেই কৈবর্ত্ত-নন্দন মাণিকলাল সেই টাকার মহিমায় যে কায়েত হ’য়ে প’ড়েছে তার আর বিচিত্র কি?”

প্রথমে কৰ্ত্তা যখন ৬৲ টাকা মাহিনার চাকরীতে বাহাল হন, সেই সময় হ’তে সাহেব তাকে সরকার সরকার ব’লে ডাক্‌ত, বাজে লোকেরা সরকার মশায় বলিত। ক্রমে বাজারে তাহার এই সরকার খেতাব প্রচার হ’য়ে পড়িল, সুচতুর মাণিকলাল এই সুযোগে নিজের মাইতি উপাধিটি বেমালুম গাপ ক’রে নিজের নামের পেছনে সরকার খেতাবটি জুড়ে দিলেন এবং সকলের কাছে অম্লান বদনে মৌলিক কায়েত ব’লে পরিচয় দিতে আরম্ভ করলেন।

মাণিকলাল নিজে ভুঁইফোড় কায়েত হয়ে পড়লো বটে, কিন্তু সহসা কোন সৎ কায়স্থ তাহার বাটীতে আহার করিত না। তিনিও জোর ক’রে কোন কথা বলতে পারতেন না, কাজেই তাহার ইচ্ছা ষোল আনা ফলবতী হইল না, পাকা কায়েত হওয়া ভাগ্যে ঘটিল না। মাণিকলাল ইহার প্রতিবিধানের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিলেন, কপালক্রমে একটা সুবিধা জুটিয়া গেল।

কৰ্ত্তা মনে মনে ঠিক করলেন যে, কুলিন কায়েতের মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিবাহ দিতে পারলে, তাহার কায়েত হওয়া এক প্রকার কায়েম মোকাম হবে, সকলের কাছে ঘাড় উঁচু ক’রে পরিচয় দিতে পারা যাবে, কাজেই আর কেউ বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতে পারবে না। তার উপর যখন কুলিনপুত্ত্র দৌহিত্র জন্মাবে, তখন তার মাতামহকে গোষ্টিপতি বলে সকলে মালা চন্দন পর্য্যন্ত দিতে পারবে, সুতরাং একটা কায়েতের মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিবাহ না দিলে আসল কাজে তেমন জুত হবে না।

কৰ্ত্তা এই মতলব ঠিক ক’রে কাজ হাসিল করবার জন্য ঘটক নিযুক্ত করিল এবং অনেক টাকা বকসিসের লোভ দেখাইল। ঘটক-চুড়ামণি অনেক পাঁজি-পুথি উট্‌কে বার করলো যে, মাণিকলালের প্রপিতামহ নদের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পিতামহের আমলে দাওয়ানি করতেন, তার নাম ছিল ৺পিতাম্বর সরকার, বাঙ্গালার মধ্যে এক ঘর বিশিষ্ট কায়স্থ; কারণ মাণিকলালের পিতামহ আদ্যিরস ক’রে কুলিনের ছেলে ঘরে এনেছে, কাজেই কর্ত্তা যে একজন নামজাদা সন্মানী কায়স্থ সন্তান তাতে আর অনুমাত্র সন্দেহ নাই।

কর্ত্তা ঘটকের মুখে এই অভাবনীয় অচিন্তনীয় নিজের বংশের পরিচর জ্ঞাত হ’য়ে, তার বুদ্ধির দুশো তারিফ ক’রেছিলেন এবং অত্যন্ত খুসি হ’য়ে চারি পাঁচ বৎসরের ব্যবহার করা অসংখ্য তালি ও দেড়ে সেলাইযুক্ত বদরংয়া একখানি বালাপোষ বক্‌সিস্ দিয়েছিলেন।

সংসারে কিছুই অপ্রাপ্য নহে; যেমন হাঁড়ি তার তেমনি উপযুক্ত সরা মিলে থাকে, সুতরাং কর্ত্তার বাসনাও অপূর্ণ রহিল না। শেষে ঘটকেরা অনেক সন্ধান ক’রে, যশোহর নিবাসী হরেকৃষ্ণ ঘোষ নামক একজন ভাসা কাপ্তেনের কন্যার সঙ্গে মাণিকলালের পুত্ত্রের বিবাহের সম্বন্ধ ঠিক করিল।

হরেকৃষ্ণ ঘোষ কাশিমবাজারে ভুষিমালের দালালি করিত। লোকটা কায়েত-ঘোষ কি গয়লা-ঘোষ তাহা এ পর্য্যন্ত কেহ জানতো না, কিন্তু গরজ বড় বালাই বলে ঘটকেরা তাকেই একের নম্বরের কুলীন কায়েত করিয়া তুলিল এবং তাহার কন্যার সহিত বিবাহ দিল, তাহার থামে যে হাতী বাঁধা যাবে, কয়লার মত মলিন মুখ মোমবাতির মত যে দাউ দাউ ক’রে জ্বলবে, কায়েতদের একটা ছোটখাটো চাঁই হ’য়ে প’ড়বে ইত্যাদি বাক্যে কর্ত্তাকে সম্মত করাইল। তবে এই ব্যাপারে অর্থাৎ পুত্ত্রের বিবাহ দিয়া খাঁটী কায়েত হবার জন্য তাহার বিশেষ কিছু ব্যয় হয়েছিল ও সেই অত্যধিক ব্যয়ের জন্য তাহার ভুঁড়ির একধারে খানিকটা টোলও পড়িয়াছিল এবং এই ভয়ানক শোকে প্রায় তিন মাসকাল শয্যাশায়ী হইয়াছিলেন।

প্রজাপতি নির্ব্বন্ধে হরেকৃষ্ণ বাবুর কন্যা শ্রীমতী কুমুদিনী দাসীর সহিত কর্ত্তার পিণ্ডাধিকারী মোহিতলাল সরকারের সহিত শুভবিবাহ কাৰ্য্য সম্পন্ন হইল, কিঞ্চিৎ নগদসহ ধুতি চাদর মান দিয়ে অনেক কায়েতকে আহার করালেন। সুতরাং দাড়কাক ময়ূরের দলে উঠিল, একজন কৈবৰ্ত্ত-নন্দন কিঞ্চিৎ ব্যয় ক’রে বেমালুম কায়েত বনিয়া গেল। তবে অনেকে বলে যে এ কাজে সেয়ানায় সেয়ানায় কোলাকুলি হ’য়েছে, কেহ কাহাকে ঠকাইতে পারে নাই। কারণ কন্যাটী হরে কৃষ্ণ বাবুর এক উপপত্নীর গর্ভজাত, তবে কর্ত্তা কুলোকের এই সকল কুকথা আদৌ বিশ্বাস করিতেন না। কর্ত্তা এইরূপ উপায়ে বুদ্ধি খরচ ক’রে, টাকার জোরে কায়েত হ’য়ে পড়লেন, কিন্তু এই শুভবিবাহের পরিণাম যে কি হবে তা নিশ্চয় তুমি একদিন দেখতে পাবে।

আমি চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের মুখে কর্ত্তার পুরাণো কাহিনী শুনিলাম এবং মনে মনে স্থির করলাম যে, কর্ত্তার ন্যায় নরাধম এই সংসারে আর কেহ আছে কি না সন্দেহ। নিশ্চয় এই পুত্ত্র পুত্ত্রবধূ হ’তে পাপিষ্ঠের সকল পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে। আমার অদৃষ্ট মন্দ ব’লে সংসারে সৎলোকের সঙ্গে আমার আলাপ হ’লো না, আমি একটা নরককুণ্ড হ’তে অন্য একটায় এসে পড়লাম। তবে কিষণলাল বাবু এক ধরণের বদমাইস, আর কর্ত্তা অন্য ধাতুর বদলোক; উভয়েই ধৰ্ম্মজ্ঞানশূন্য নিষ্ঠুর-হৃদয়, নীচাশয় ও স্বার্থপর, এই বিশ্বের-স্রষ্টা সর্ব্বশক্তিমান্ ঈশ্বরের উপর কাহারো বিশ্বাস নাই। দয়া মায়ার সহিত পৃথক হ’য়ে সেই ইষ্টবস্তুকে একেবারে ভুলে, পশুর ন্যায় যথেচ্ছাচারে জীবন যাপন করছে। জীবের কর্ম্মফল যখন অক্ষয়, তখন পরিণামে নিশ্চয় এই সব কুৎসিৎকর্ম্মা অভাগারা তাদের কৃতকর্ম্মের উপযুক্ত ফল ভোগ করবে। তবে এখন আমার উপায় কি? এই নরাধম কৃপণের আশ্রয় ত্যাগ ক’রে কোথায় যাই। বিশেষ এখানে আমার একটা উপকার হ’চ্ছে, ইহার আনুকুল্যে এন্টনি সাহেবের নিকট ইংরাজী শিখিতেছি, তাহার উপর মোহিতবাবু বিশেষ স্নেহ করেন, চাকর বেটা খাতির ক’রে চলে; সুতরাং সহসা ইহার আশ্রয় ত্যাগ ক’রে অন্যত্র যাওয়া যুক্তিযুক্ত ব’লে বোধ করলাম না, অদৃষ্টের উপর নির্ভর ক’রে সুসময়ের অপেক্ষায় সেইখানেই রহিলাম।

কর্ত্তার বাটীতে রহিলাম বটে, কিন্তু সাবেক কর্ত্তার সেই গোপনে কথাবার্ত্তা ও নির্ম্মলার সেই চাঁদ মুখখানি একদিনের তরেও ভুলিতে পারি নাই। তবে অনেক ভাবিয়া স্থির করিলাম যে, আপাততঃ আমার আশাপূর্ণ হওয়া কিছুতেই সম্ভবপর নহে। কারণ কাশীতে গিয়া অভয়ানন্দ- স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ না করলে, আমার মনের সন্দেহ কিছুতেই মিটিবে না; কিন্তু এ অবস্থায় সুদূর কাশীতে যাওয়া কখনই আমার ক্ষমতার অধীন নহে। আর এরূপ অবস্থায় কিষণজির ন্যায় পাষাণ-হৃদয় অর্থ-পিশাচ যে আমার প্রাণের পিপাসা মিটাইবে, তাহা একান্ত অসম্ভব। তবে যদি কখন ভাগ্য অনুকুল হয়, অবস্থার পরিবর্ত্তন ঘটে, তাহ’লে তখন আমার আশা পূর্ণ হওয়া নিতান্ত সুদূর পরাহত হইবে না।

এইরূপে প্রায় তিন সপ্তাহকাল অনন্ত-সাগরে গড়াইয়া পড়িল। আমার প্রাণে একটুকু ভয় হইয়াছিল যে, হয় ত পাপাত্মা দেবীপ্রসাদের নিকট সন্ধান পাইয়া সবেক কর্ত্তা এখানে একবার খুঁজতে আসতে পারে, কিন্তু এতদিনের মধ্যে কেহই আমার কোন সংবাদ জানিতে আসিল না। ইহাতে ভয় কাটিয়া গেল সত্য, কিন্তু প্রাণে কেমন একটা বিষম খট্‌কা হ’লো; কারণ ছোটবেলা হ’তে যারা ছেলের মত হাতে ক’রে মানুষ ক’রেছে, তারা এত শীঘ্র কি আমার মায়া একেবারে কাটাইয়া ফেলিলেন? আমি ম’রেছি কি বেঁচে আছি, তাহার কোন উদ্দেশ পৰ্য্যন্ত নিলে না। হায়! তখন আমি সংসারকে উত্তমরূপে চিনি নাই, বাহ্য সৌন্দর্য্যশালী, মিষ্টভাষী এই মানব বিশেষের প্রাণের বিশেষ খবর জানি নাই, সেইজন্য আমার মনে এ প্রকার বিতর্কের উদয় হ’য়েছিল; কিন্তু তলে তলে আমার সর্ব্বনাশের জন্য যে এক বিষম ষড়যন্ত্রের সৃষ্টি হচ্ছে, তাহা স্বপ্নেও আমার মনে উদয় হয় নাই। জীবনে আমি কখন কাহার সহিত শত্রুতা করি নাই, সুতরাং আমার আর শত্রু কে হবে? এই সরল বিশ্বাসবশে নিশ্চিন্ত ছিলাম, মুহূর্ত্তের জন্য কখন কোন অনিষ্ট আশঙ্কা করি নাই।

মধুর কলসী গৃহে আনলে যেমন সঙ্গে সঙ্গে মাছি আসে, তেমনি বিষয় হইলেই নানাপ্রকার মামলা মোকদ্দমা জুটিয়া থাকে, সেই নিয়ম অনন্তকাল হ’তে চলে আসছে, কাজেই বিজয়ী মাণিকলাল কিরূপে সেই মামলার কবল হ’তে মুক্ত হবেন; সম্প্রতি তাহার মহলে একটা দাঙ্গা হওয়ায় এক নম্বর ফৌজদারী মোকদ্দমা দায়ের হইল, তিনি তাহার তদ্বিরের জন্য জয়গোপাল উকীলের বাসায় নিজ পুত্ত্রকে পাঠাইতে বাধ্য হইলেন।

কাজেই মোহিতবাবুকে মুরশিদাবাদে যাইতে হইল। যাইবার সময় আমি তাহাকে বিশেষরূপে সাবধান করিয়া দিলাম, তিনি আমার কথামত কার্য্য করিতেও স্বীকৃত হইলেন এবং দেবীপ্রসাদে প্রমুখ বদমাইসদের সঙ্গে সাক্ষাৎ পর্য্যন্ত করিবেন না বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন। আমি তাহার কথা অবিশ্বাস করিলাম না, তিনি কিছু টাকা ও পীলেরোগা সেই উড়ে মালিকে সঙ্গে লইয়া সেইদিন বৈকালে মুর্শিদাবাদ উদ্দেশে যাত্রা করিলেন।

মোহিতবাবু প্রস্থান করিলে আমার একটা বিষম অসুবিধা হইল, অর্থাৎ রাত্রে অতি গোপনে সেই লুচি ভক্ষণ একেবারে বন্ধ হইয়া গেল। কাজেই কর্ত্তার মামুলি বন্দোবস্ত মত দুবেলা সেই খোসাপূর্ণ ও ঘ্নতশূন্য কলায়ের দাল আর ঝাঁটা-চচ্চড়ি দিয়ে ক্ষুধা নামক সুমিষ্ট তরকারির সাহায্যে ও কতকটা বুড়ো আঙ্গুলের ঠেলায় বোলতার টিপের ন্যায় লাল অন্নগুলি আহার করিতে হইত। তবে এ কষ্ট আমি আদৌ গ্রাহ্য করতাম না, কারণ চারদিনের মধ্যে মোহিতবাবুর ফিরিবার কথা আছে, তিনি আসিলেই আমার এ কষ্টের লাঘব হবে; কাজেই আমি সতৃষ্ণনয়নে মোহিতবাবুর প্রত্যাগমনের অপেক্ষায় রহিলাম।

রাত্রি আন্দাজ নয়টার পর আহারাদি করিয়া আমার সেই ছোট ঘরটীতে শুইয়া আছি, অন্তর-সাগরে নানাপ্রকার চিন্তার ঢেউ উঠিতেছে। কাজেই সম্পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় শয্যার উপর শুইয়া ছট্‌ফট্ করিতেছি, এমন সময় কে যেন ধীরপদ-বিক্ষেপে অন্দর মহলের দিকে অগ্রসর হইল, আমি সেই নিস্তব্ধ রাত্রিতে স্পষ্ট পায়ের শব্দ শুনিতে পাইলাম। মোহিতবাবু বাড়ীতে নাই, কৰ্ত্তা কস্মিনকালেও বাড়ীর ভিতরে আসেন না, চিরকাল সেই লোহার সিন্দুক আগলাইয়া বাহিরের নীচের ঘরে শয়ন করিতেন; সুতরাং এত রাত্রে পা টিপে টিপে কে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল? মনে বিষম সন্দেহ হইল, আর নিশ্চিন্তভাবে শয়ন করিয়া থাকিতে পারিলাম না, কাজেই শয্যা ত্যাগ ক’রে আস্তে আস্তে দোরটী খুলিলাম ও খুব নিঃশব্দে বাড়ীর দিকে অগ্রসর হ’তে লাগলাম।

তবে আমাকে অনেকদূর আর যেতে হ’লো না; কারণ অন্দরমহলে প্রবেশ করবার পথের ঘরে মানুষের কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হইল, কাজেই আমি দোরের আড়ালে দাঁড়াইয়া ইহাদের কথাবার্ত্তা শুনিতে লাগিলাম।

প্রথমেই বামা-স্বরে কহিল “যাবার সুবিধা অনেক হয়, কিন্তু শুধু হাতে বেরুলে কি হবে, তাই কেবল কাদায় গুণ ফেলে আছি। পাছে ক্ষয়ে যায়, এই ভয়ে পোড়ারমুখো শ্বশুর গহনাগুলোকে পরতে দেয় না, ইষ্টি-কবচের মত বুকে ক’রে রেখেছে! নিদেন পক্ষে গহনাগুলো যদি হাত করতে পারি তাহ’লে পোড়ারমুখো ভাতারের মুখে বাসী উনুনের ছাই দিয়ে, তোকে নিয়ে কাশীতে যাই; কিন্তু পোড়াকপালে তাও তো হচ্ছে না।”

পুরুষ মানুষের গলায় উত্তর করিল, “আমার তো আর এক দণ্ড এখানে থাকতে ইচ্ছা হয় না। আমি কোন্‌কালে গা ভাসান্ দিতুম, কেবল তোমার লোভে আধপেটা খেয়ে এই কঞ্জুস বেটার বাড়ীতে আছি। আমি নিজে যা ক’রেছি তাতে আমাদের এক রকম চলতে পারে, এ উপর আমি কিছু বাগিয়ে নিতে পারলে সোণার সোহাগা হয়।”

রমণী উত্তর করিল, “অমৃত খেতে কি কাহার অরুচী হয়, আমি তো রাতদিন সেই যোগাড়ে আছি; কেবল সুবিধা হ’চ্ছে না ব’লে আজও এই পাপ পুরীতে আছি। বাবা বড় মানুষ দেখে জামাই করলেন, কিন্তু একদিনের তরেও সুখের মুখ দেখতে পেলাম না। একখানা ভাল তরকারী রেঁধে পোড়ারমুখো শ্বশুরের পাতে দিলে আর রক্ষা থাকে না, বেটা একেবারে রেগে টং হ’য়ে উঠে; তুই যদি কোন গতিকে বুড়ো বেটার ভূঁড়ি ফাসিয়ে দিয়ে লোহার সিন্দুক হ’তে মাল মারতে পারিস, তাহ্’লে বড় ভাল হয়।”

এই কথা শুনে পুরুষ উত্তর করিল, “না ভাই, আমার তা সাহসে কুলায় না; হাজার হোক্ সে মনিব, দশদিন তার নেমক খেয়েছি, সেই জন্য এ কাজটা করতে মন সরে না। তবে খুন না ক’রে কোন গতিকে যদি চুরি করতে পারি সেই চেষ্টায় রইলাম। দেখি ভূঁড়ো-শালার চোখে ধূলো দিয়ে যদি কিছু মারতে পারি।”

আর আমার অধিক শুনিবার আবশ্যক হইল না; আমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে কর্ত্তার বড় পিয়ারের খানসামা রামা নির্জ্জনে তাহার কুল উজ্জ্বল করিতেছে। এই পাপাত্মার কথা শুনিয়া ও কাণ্ডকারখানা দেখিয়া, বিষম ক্রোধে আমার সর্ব্বশরীর কাঁপিতে লাগিল। একবার মনে হ’লো এখনি এই অকৃতজ্ঞ নরাধমকে তাহার পাপকার্য্যের উপযুক্ত প্রতিফল প্রদান করি, কিন্তু আবার ভাবিয়া দেখিলাম যে, মোহিত বাবু যখন গৃহে নাই, ক্রোধের বশে কোন কার্য্য করিলে পাছে হিতে বিপরীত হয়, পাছে যার জন্য চুরি করবো, সেই চোর বলে; এই আশঙ্কায় অতি কষ্টে আমার সেই প্রদীপ্ত ক্রোধানলকে দমন করিয়া ফেলিলাম। তবে, তাদের পৈশাচিক কাণ্ড দেখতে আর আমার ইচ্ছা হ’লো না। কাজেই তখনি আমি সেই স্থান ত্যাগ ক’রে আমার ঘরে আসিয়া শয্যার উপর শয়ন করিলাম।

আমি শয্যার উপর শয়ন করিলাম বটে, কিন্তু সর্ব্বসত্তাপহারিণী নিদ্রাদেবী আজ আমার নিকটস্থ হইলেন না। আমি ভাবিতে লাগিলাম যে, পতি অলিক আমোদপ্রিয় ও বারবনিতাসক্ত হইলে তাহার পত্নীর চরিত্র প্রায় এই প্রকার শোচনীয় হ’য়ে থাকে। স্বামী বাহিরে যাহা ঋণ করে, গুণবতী স্ত্রী ঘরে বসিয়া দ্বিগুণ সুদে সেই ঋণ পরিশোধ করিয়া থাকে। নিজের বস্তু যে যত্ন না ক’রে দুরাশাবশে অপ্রাপ্য বস্তুর আশা করে, তাহার পরিণামে কখনই শুভফল প্রসব করে না। মোহিতবাবু যদি ঈদৃশ উন্মার্গগামী যুবক না হ’তেন, পবিত্র প্রণয়ের মর্য্যাদা তিনি যদি প্রথম হ’তে বুঝতেন, সোণার পিঁজরার যদি দাঁড়কাককে না পুষতেন, তাহ’লে আজ তাহার ধর্ম্মপত্নী কখনই এই বেটা ইতর লোক খানসামার সহিত ভ্ৰষ্টা হইত না। প্রবল রিপুর প্রতাপে অভাগিনী দিক্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হ’য়ে, গাত্রদাহ নিবারণের জন্য প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে পতিত হ’য়েছে, কালসর্পকে কুসুমমালা ভ্রমে কণ্ঠে ধারণ ক’রেছে; সুতরাং এক সময়ে অভাগিনী তাহার এই ভ্রম বিশেষরূপে বুঝতে পারবে, কিন্তু তখন তীব্র অনুতাপের সেবা করা ভিন্ন আর তার কোন উপায়াত্তর থাকবে না। তবে এ ব্যাপারে অভাগিনী একা অপরাধিনী নহে; মোহিতবাবুর দোষে এই সর্ব্বনাশের সূত্রপাত হ’য়েছে। আজ বৌঠাকুরাণীর শ্রীমুখে যে প্রকার কথা শুনলাম, তাতে স্পষ্ট বোধ হইল যে, তিনি অধিক দিন আর এ বাড়ীর মোটা অন্ন ধ্বংশ করবেন না; কোন গতিকে গহনাগুলি কি কিছু টাকা হস্তগত করিতে পারিলে, গুণের সাগর খানসামাকুলতিলক রামকে সাথী ক’রে কাশীর দিকে বেলালুম গা-ভাসান্ দিবে। আহা! এই সংসারে যার স্ত্রী এ প্রকার কাল-সাপিনীসমা ও পর-পুরুষরতা, সেই অভাগা পুরুষই যথার্থ অসুখী। লক্ষ লক্ষ টাকা তাহার সিন্দুকে সঞ্চিত থাকলেও সুখ শান্তির অস্তিত্ব অনুভব করা তার পক্ষে অসম্ভব।

এই সকল চিন্তায় আমার অন্তরার্ণব উদ্বেলিত হইয়া উঠিল; কাজেই সম্পূর্ণ জাগ্রতভাবে সে নিশা যাপন করিলাম, একবারের জন্যও চক্ষুদ্বয় মুদ্রিত করিলাম না।