» » হরিদাসের গুপ্তকথা

বর্ণাকার

একাদশ পরিচ্ছেদ

ভূঁড়ো-কর্ত্তা।

যথাকালে আমরা বাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। তিনি আমাকে বরাবর উপরে ল’য়ে গেলেন এবং তাঁহার বৈঠকখানার পাশে একটি ছোট কুঠুরী আমার বাসের জন্য নিদ্দিষ্ট ক’রে দিলেন।

আমি মোহিতবাবুর এই বাড়ী দেখে মনে মনে বড় সন্তুষ্ট হ’লাম। কারণ বাড়ীখানা খুব প্রকাণ্ড ও বড়মানুষি ধরণের; তবে রীতিমত মেরামতের অভাবে অনেকটা মলিন মূর্ত্তি পরিগ্রহ ক’রেছে। বাড়ীটার সম্মুখে খুব মোটা মোটা যোড়া থাম, তারপর লোহার গুল মারা প্রকাণ্ড সদর দোর ও দেউড়ি, কিন্তু দরওয়ানের নাম মাত্র তাতে নাই, কেবল শীর্ণকায় পিলে রোগা একটা উড়ে মালী তথায় আড় হ’য়ে শুয়ে আছে। দেউড়ির পর প্রশন্ত উঠান, তিনদিকে চক্‌মিলানো ঘর ও একদিকে সাতফুকুরে ঠাকুরদালান যেন খাঁ খাঁ ক’চ্ছে। মারবেল পাথরে বাঁধানো সেই দালানের অবস্থা দেখলে স্পষ্ট বোধ হয় যে, বহুদিন যাবৎ জগদম্বার পবিত্র পদরজঃ ইহাতে পতিত হয় নাই, কাজেই দলে দলে কেলেগোলা, চামচিকে ও বাদুড় নির্ব্বিবাদে পুত্ত্র পৌত্র ল’য়ে বসবাস ক’চ্ছে এবং বহুদিন-সঞ্চিত তাহাদের বিষ্ঠা ও নানাপ্রকার আবর্জ্জনায় নীচেটা একেবারে পরিপূর্ণ হ’য়ে আছে।

বাড়ীটা প্রকাণ্ড বটে, কিন্তু তেমন সাজানো নয়, লোক জনের অভাবে যেন খাঁ খাঁ ক’চ্ছে। কারণ, বহু পরিবার না হ’লে এ রকম প্রকাণ্ড বাড়ী মানায় না। বাবুদের পরিবার খুব অল্প, কাজেই অধিকাংশ ঘর অব্যবহার্য্য অবস্থায় পড়ে আছে। তবে মোহিতবাবুর উপরের বৈঠকখানাটি বেশ সাজানো, কিন্তু আমার ঘরে একখানি পট্‌পটীর মাদুর ও তুলো বেরোনা ওয়াড় শূন্য একটা ছেঁড়া তাকিয়া ভিন্ন আর কিছুই ছিল না।

বেলা আন্দাজ দশটার সময় মোহিতবাবু আমার সেই ঘরে আসিয়া হাসি হাসি মুখে কহিলেন, “আমি বাবাকে তোমার কথা ব’লেছি, তিনি আমার কথায় সম্মত হ’য়েছেন; এখন তুমি একবার গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করগে। নীচের সিঁড়ির পাশের ঘরটায় তিনি বসেন; আমি পূর্ব্বেই তোমাকে ব’লে রেখেছি আমার বাবা একটু কৃপণ, তুমি তার কথা শুনে কিছু মনে ক’রো না। আমি যখন আছি, তখন তোমার কোন বিষয়ে কষ্ট হবে না। বেটার সামনে সূচ গলে না, কিন্তু পেছনে হাতী গলে যায়; সেই জন্য বেটার উপর আমি হাড়ে হাড়ে চটে গেছি। যাই হোক্‌ এই সময় তুমি তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করগে; তিনি যা বলবেন, তাতেই ‘যে আজ্ঞা’ বলবে, তারপর যা হয় আমি করবো।”

মোহিতবাবু আমাকে এই কথা ব’লে বাড়ীর ভিতর চ’লে গেলেন। আমিও কর্ত্তার সঙ্গে দেখা করবার জন্য নীচের দিকে চলিলাম।

মোহিতবাবুর কথামত সিঁড়ির পাশের সেই কক্ষ মধ্যে প্রবেশ ক’রে দেখি যে, কর্ত্তা খুব রেগে উঠে সপ্তমে গলা তুলে রাঁধুনী বামুনের চৌদ্দ পুরুষকে উদ্ধার ক’চ্ছেন ও তার বাপ-বেচারীর আহারের জন্য কতকগুলো দুর্গন্ধময় জঘন্য জিনিষের ব্যবস্থা ক’চ্ছেন। আমি একটু পরে কর্ত্তার ক্রোধের প্রকৃত কারণ বুঝতে পেরে মনে মনে একটু হাসিলাম; কারণ কর্ত্তা পুকুর ঘাটে বেড়াতে গিয়ে কতকগুলো ভাত ছড়ানো দেখতে পান, সুতরাং সিদ্ধান্ত করেন যে, বামুন বেশী বেশী চাল রেঁধে তাকে বরবাদ দেবার যোগাড়ে আছে; সেই জন্য কৰ্ত্তা রেগে জীবের লাগাম খুলে দিয়ে কথা কইছেন।

আমার সঙ্গে কর্ত্তার চোখোচোখি হ’লে আমি একটি নমস্কার করলাম। তিনি একবার মাথাটা একটু নীচু ক’রে নমস্কারটা ফিরিয়ে দিলেন ও হাত নেড়ে আমাকে বসতে বল্লেন; কিন্তু তখন তাঁহার ক্রোধের সমতা হয় নাই। বামন ঠাকুর তাঁহার সর্ব্বনাশ ক’রেছে ব’লে অনবরত গজ গজ করতে লাগলেন।

আমি কর্ত্তার আদেশমত আসন পরিগ্রহ ক’রে, সেই ঘরের চারিদিকটা একবার ভাল ক’রে দেখতে লাগলাম, দেখলাম যে, ঘরটায় কোন দামি আসবাবের নাম মাত্র নাই, একখানি বহুকেলে পুরাণো মোটা পাটি পাতা আছে এবং পায়ে পায়ে এক ইঞ্চি পুরু ধূলো তার উপর জমাট মেরে র’য়েছে। কর্ত্তার পেছনে একটা লাল খেরোর তাকিয়া আছে বটে, কিন্তু কালের করাল কবলে পতিত হ’য়ে উপরের লালবর্ণ-টুকুন ঘোর কৃষ্ণবর্ণে পরিণত হ’য়েছে। সেই দরজির হাতে জন্ম লওয়া অবধি তাকিয়া বাবাজি চিরকালটা কৌমার-ব্রত অবলম্বন ক’রে কাটালেন, এখন তাকিয়া-বাবাজির নেহাৎ অন্তিমকাল উপস্থিত হ’য়েছে, দাঁত পড়ার ন্যায় দু’ এক জায়গায় ফেঁসে তুলো বেরিয়েছে, সমস্ত অঙ্গটা শিথিল হ’য়ে প’ড়েছে; কিন্তু আজও প্রণয়িণী ওয়াড়-সুন্দরীর সঙ্গে একদিনের জন্য মিলন হ’লো না, কাজেই এই আইবুড়ো তাকিয়াটি তিথি নক্ষত্রের দোষে মরলে যে ভূত যোনি প্রাপ্ত হবে, তাহা নিতান্ত অসম্ভব নহে।

কর্ত্তার কাছে কতকগুলো কাগজের বাণ্ডিল এলোমেলো ভাবে ছড়ানো ছিল, আস্‌বাবের মধ্যে একটা কাঠের হাতবাক্স ও কলসীর কাণার ভাইরাভাই একটা কাঠের বৈঠকে মড়ার মাথা বিশেষ একটা ছোট থেলোহুঁকো ও তাতে একটা কাণাভাঙ্গা কল্কে ভিন্ন আর কিছুই ছিল না। তবে দেয়ালের দিকে বড় বড় তালায় আবদ্ধ সারি সারি চারিটা লোহার সিন্দুক ছিল, কর্ত্তা সেগুলির দিকে মাঝে মাঝে চেয়ে প্রাণ ঠাণ্ডা করতেন, কখন হাত দিতে ইচ্ছা হ’লো না। কেবল যক্ষের ন্যায় পরের জন্য এই ধনরাশি আগলাইয়া রাখিলেন, যাহার অদৃষ্টে আছে সেই ভোগ করিবে। তবে এ প্রকার আত্মবঞ্চক নীচাশয় কৃপণের পাপার্জ্জিত অর্থ যে সদ্ব্যয়ে নিঃশেষ হবে তাহা একপ্রকার অসম্ভব।

কর্ত্তার বয়স প্রায় ৬০ বৎসরের কাছাকাছি হবে, কিন্তু গায়ের মাংস বিন্দুমাত্র লোল হয় নাই। টাকার স্ফূর্ত্তিতে শাক কচু খেয়েও স্বাস্থ্যের পূর্ণ লক্ষণ সকল তাহার দেহে বর্ত্তমান আছে। তবে তিনি লোকটা একটু বেঁটে, তুলনায় প্রায় ঢাকাই জালার আধখান, আরদালি সাহেবের ন্যায় বাবুর দু’হাত আগে আগে গিয়ে থাকে, সেই জন্য সকলে আড়ালে “ভূঁড়ো কৰ্ত্তা” “কঞ্জুস বেটা” প্রভৃতি মিষ্ট সম্বোধনে আপ্যায়িত ক’রে থাকে।

কর্ত্তার হাত-পাগুলি তাহার দেহের অনুরূপ, মুখখানি কলি-হুঁকার ন্যায় বেঢপ্ লম্বা, চক্ষু দুটি ছোট ও ঈষৎ কোঠরগত, নাকটি বেশ টিকোলো, ভ্রুযুগল এবড়োখেবড়ো ও অধরদ্বয় কাফরিদের ন্যায় পুরু ছিল; তবে তাহার দৃষ্টি কুটিল ও বক্র, ললাটদেশ চিন্তারেখায় অঙ্কিত ও মুখমণ্ডলে অপ্রসন্নভাব বিদ্যমান থাকিত। এই বয়সে বিপুল বিভবের অধিপতি হ’য়েও সংসারে সার বস্তু সন্তোষের শরণাপন্ন হ’তে পারে নাই। কেবল বিষম উদ্বেগে, অব্যক্ত ত্রাসে, অনির্দ্দিষ্ট সন্দেহে, তাহার জীবন কাটিয়া গেল; সুখ শান্তি যে কাহার নাম, তাহা আর এজন্মে জানিতে পারিল না, চিনির বলদের মত কেবল বোঝা বহিয়াই দিন গেল।

কর্ত্তার বুক কাঁধ ঘন লোমে আচ্ছাদিত, হঠাৎ দেখলে একটি ছোট-খাটো পালংশাকের ক্ষেত ব’লে ভ্রম হয়। মাথার চুল কাঁচায় পাকায় মিশানো, মাঝখানে বুজরুকির চিহ্নস্বরূপ সৌখিন ধরণের খুব মিহি একটি টিকি বিদ্যমান ছিল।

কৰ্ত্তা একখানি ছোট পাঁচি ধুতি পরিধান করিয়াছেন, কাজেই সেই সাত হাত কাপড়খানিতে তাহার বারো আনা লজ্জা নিবারণ হ’য়েছে, সম্পূর্ণরূপে ভূঁড়িতে ফের দিতে কুলায় নাই, কাজেই এক রকন দিগম্বর বেশে বসিয়া আছে। তবে তাঁর কোমরে একটি খুব মোটা কারের ঘুনসিতে ন্যাটামাছের মত সারবন্দি লোহার সিন্দুকের চাবি র’য়েছে। তিনি এ জন্মে কেবল মোট বহিবার জন্য সংসারে আসিয়াছিলেন, কাজে‍ই চাবির মোট বহিয়া গেলেন। কষ্টার্জ্জিত অর্থের সদ্ব্যবহার কি উপভোগ তাহার ভাগ্যে ঘটিয়া উঠিল না। কর্ত্তার গতিক দেখে আমি বেশ বুঝতে পারলাম যে, জগতে বিপুল অর্থ লাভ হ’লেও মানুষ কখনই সুখী হ’তে পারে না। সুখভোগ একটা ভিন্ন পদার্থ, মানসজাত সন্তোষ-লতিকার সুধাময় ফল, কাজেই জীবের ভাগ্য সাপেক্ষ। কারণ অনেক স্থলে সসাগরা পৃথিবীর অধিশ্বর একজন সম্রাট রাত দিন বিবিধ মানসিক যাতনায় প্রপীড়িত হ’চ্ছেন, নিতান্ত উদ্বেগে ও আশঙ্কার কালাতিপাত ক’চ্ছেন, আবার স্বাস্থ্যের পূর্ণাবতার অভাব জ্ঞানহীন অনেক কৃষক সদানন্দ ভাবে দিনপাত ক’চ্ছেন। একমাত্র সন্তোষের কৃপায়, অন্যের সহিত অকপট-ব্যবহারের গুণে, নিৰ্ম্মল স্বভাবের কল্যাণে, সরল প্রকৃতি শ্রমসহিষ্ণু শ্রমজীবির হৃদয়-ভাণ্ডার যেরূপ বিমল, আনন্দে পরিপূর্ণ, দুরাশা-বাতিকগ্রস্ত মুকুটধারী নৃপতি তাহার কণামাত্র উপভোগের অধিকারী নহে। সেই জন্য বলতেছিলাম যে, সংসারে অর্থ হ’লেই মানুষ সুখী হ’তে পারে না।

কর্ত্তার ক্রোধের বেগ প্রশমিত হ’লে, “রামা রামা” ব’লে ডাক্‌লেন, অমনি “আজ্ঞে যাই” এই উত্তর দিয়ে কর্ত্তার সেই একোমেব ন দ্বিতীয়াং খানসামা রামা গৃহ প্রবেশ করিল।

এই খানসামা প্রবরের চালচলন ও ধরণধারণ দেখে আমার মনে কেমন একটা সন্দেহের উদয় হ’য়েছিল। কারণ এই খানসামা-রতন সর্ব্বদা বেশ ফিট্‌ফাট্ থাক্‌ত, হঠাৎ দেখিলে তাহাকে এই বাড়ীর ছোট বাবু ব’লে বোধ হইত। খাসা কালপেড়ে কাপড় কুঁচিয়ে পরে, প্রায় ছটাক-খানেক সরষের তৈল খরচ ক’রে মাথায় সরাসরি নর্দ্দমা কাটে, সাবান দিয়ে গা ধোয়, আতরের ফোয়া কাণে দেয়, ছোট এলাচ প্রভৃতি মসলা দিয়ে ছাচি পান খায়, কাজেই এ বাড়ীর মধ্যে এই বাবু খানসামার যে কোনরূপ মিষ্ট সম্বন্ধ বা গুড়ের গাছ আছে, তাহা অনেকটা আমার অনুমানে বোধ হইল।

খানসামা-কুলতিলক রামা গৃহে প্রবেশ করিলে, কর্ত্তা সেই কাঠের বাক্স খুলিয়া তাহার মধ্য হইতে কুলের আঁটীর ন্যায় এক ছিলিম তামাক বাহির ক’রে তাহার হাতে দিয়ে বল্লেন, “এই এক গপ্পা তামাক দিলুম, সবটুকু সেজে আনিস্; দেখিস্ বেটা, যেন কেটে রাখিস না, আমি গুল ঢেলে দেখবো।” রামা মুখে কোন উত্তর করিল না, কেবল একটু মুচকে হেসে, সেই কাণাভাঙ্গা কল্‌কেটি নিয়ে প্রস্থান করিল। আমি দেখিলাম যে, কর্ত্তার সেই বাক্সের একদিকে নোট ও হুণ্ডির তাড়া ও তার পাশে শালপাতা জড়ানো একটু তামাক র’য়েছে। বাহিরে রাখিলে পাছে এক আধ ছিলিম চুরি যায়, এই ভয়ে আধ পয়সার তামাকটুকু সযত্নে বাক্সের মধ্যে রাখিয়াছেন।

রামা তামাক সাজিয়া কল্‌কে আনিয়া দিল; কৰ্ত্তা সেই থেলো হুঁকায় কল্‌কে বসাইয়া টানিতে টানিতে আমাকে কহিলেন, “আমি খোকার মুখে তোমার সমস্ত কথা শুনেছি। আহা! কায়েতের ছেলে, বাপ মা কেউ নাই, কাজেই খুব কষ্টে পড়েছো। আজকালের মাগ্‌গি গণ্ডার দিনে একটা লোকের খোরাকি চালানো বড় সহজ কথা নয়, অনেক আমির আদমি ভয় পায়; কিন্তু আমি ধারধোর ক’রে তোমার খোরাকী খরচটা চালাবো, কিন্তু তুমি বাবা খোকার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে, বদলোকের সঙ্গে মিশতে দিও না। ছোড়া নেহাৎ বাঁদর হয়ে গেছে, অতো টাকা খরচ ক’রে সুন্দরী বউ বাড়ীতে আনলাম, তবুও ছোড়া বাড়ীতে থাকে না, বদলোকের সঙ্গে মিশে একেবারে মাটী হ’য়ে গেছে। আমার তো আর দু-পাঁচ হাজার টাকা নেই যে, বাবুগিরি করবে, কাজেই আখেরে ছোড়ার দুঃখে শিয়াল কুকুরে কাঁদবে। তুমি যদি ছোড়াকে শোধরাতে পার তাহ’লে তোমার যাতে ভাল হয় আমি তাই করবো।

আমি কর্ত্তার কথার ভাবে বুঝিলাম যে, তিনি মোহিতবাবুকে খোকা ব’ল্লেন। যদিও আজকাল মোহিতবাবুর বয়স খোকার পিতার যোগ্য কিন্তু তথাপি কর্ত্তা স্নেহরসে-সিঞ্চিত সাবেকের সেই মধুর খোকা সম্বোধন ভুলিতে পারেন নাই। কর্ত্তার কথা শেষ হ’লে খুব বিনীতভাবে আমি কহিলাম, “মোহিতবাবু স্বভাবতঃ লোক মন্দ নন, কেবল কুসংসর্গে মিশে তাহার চরিত্র মন্দ হইয়াছে। তবে তিনি নিজের ভ্রম বুঝিতে পারিয়াছেন এবং সেই সব বদমাইসদের সঙ্গ ত্যাগ ক’রেছেন, আর কখন তাদের সঙ্গে মিশিবেন না ব’লে আমার কাছে প্রতিজ্ঞা ক’রেছেন, সুতরাং বাবুর সেই সামান্য চরিত্রদোষটুকুন যে সম্পূর্ণরূপে সংশোধন হ’বে তাতে আর কোন সন্দেহ নাই।”

আমার এই কথা শুনে কৰ্ত্তা ভুঁড়ি নাচিয়ে হা হা ক’রে হাসতে হাসতে বল্লেন, বেশ বেশ, তুমি বড় ভাল ছোক্‌রা, তোমার সঙ্গে থাকলে খোকা ছোঁড়া শোধরাতে পারবে। তুমি একদণ্ড তার কাছ ছাড়া হ’য়ো না, রাতদিন সঙ্গে সঙ্গে থাকবে, আমি ধারধোর ক’রে খরচ চালাবো, তারপর কুঠিতে চাক্‌রী ক’রে দেব। তবে বাবা, আর পার্শীর তেমন চলন নাই, আজকাল যেটুকুন আছে, আর দিনকতক বাদে তাও থাকবে না। কাজেই একটু ইংরাজী না শিখলে সাহেবের কাছে চাকরী হওয়া দুষ্কর। আমি নিজে প্রায় আড়াইকুড়ি ইংরাজি কথা শিখে সাহেবদের কাছে চাক্‌রী বাগিয়েছিলাম; তারপর ক্রমে ক্রমে এখন একটা কুঠির দাওয়ান হ’য়েছি। হাত পা নেড়ে, আধা হিন্দি, সিকি বাঙ্গালা, দু-আনা পার্শীর সঙ্গে দু-একটা ইংরাজির বুক্‌নি দিয়ে একপ্রকার আজবতর ভাষার সৃষ্টি ক’রে সাহেব সুবকে বুঝিয়ে দিয়ে আস্‌ছি। কাজেই বাবা, তোমাকেও একটু ইংরাজি শিখতে হবে, আমি মাষ্টার ঠিক ক’রে দেব, তোমাতে ও খোকাতে দু-জনে ইংরাজি শিখবে, না হয় এ ব্যাপারে আমার কিছু ঋণ হবে, খেটেখুটে এক রকম ক’রে শোধ দেব। মোদ্দা বাবা, তুমি খোকাকে আর বদলোকের সঙ্গে মিশতে দিও না।”

আমি কর্ত্তার কথায় স্বীকার হ’লাম এবং তখনকার নত বিদায় প্রার্থনা কল্লাম, ভাবে বোধ হ’লো কর্ত্তা আমার উপর বিশেষ অসন্তুষ্ট হন নাই। তবে তাঁহার সংসারে একটা খরচ বাড়িল ব’লে তাঁহার মুখমণ্ডল অনেকটা ভার হইয়া উঠিল।

আমি এইখানেই রহিয়া গেলাম, সঙ্গে সঙ্গে কর্ত্তার কাছে একটু পসার হইল; কারণ মোহিতবাবু এই কয়দিন আর বাড়ীর চৌকাঠ পার হন নাই, লক্ষ্মীছেলেদের ন্যায় বাড়ীতেই রহিলেন এবং আমার সঙ্গে নানারূপ কথাবার্ত্তায় দিন কাটাইতে লাগিলেন।

কর্ত্তার পরিবারের মধ্যে তাঁহার এক শালী, পুত্ত্রবধূ ও পেটভাতার এক বুড়ো ঝি, একটা রসুয়ে মহারাজ ছিল বটে, কিন্তু তাহাকেও মাহিনা দিতে হইত না, কৰ্ত্তা কুঠিতে ৪৲ টাকা মাহিনায় একটা আর্দালির কাজ তাহাকে দিয়া ছিলেন, কাজেই কেবল খোরাকি দিয়া বামুন রাখা হইয়াছিল। মোহিত বাবুর বয়স যখন দেড় বৎসর সেই সময় তাহার মাতৃবিয়োগ হ’য়েছিল, কাজেই প্রতিপালনের জন্য কর্ত্তা মোহিত বাবুর মাসীমাতাকে আনিতে বাধ্য হন। এখন যদিও মোহিত বাবু বড় হ’য়েছেন, পূর্ব্বেকার গরজটুকুন ফুরায়েছে, কিন্তু তথাপি কেবলমাত্র চক্ষুলজ্জার খাতিরে আর মাগীকে তাড়াইতে পারেন নাই, কাজেই এই বাজে খরচটা অম্লানবদনে সহ্য করছেন।

কর্ত্তার সদর আমলার মধ্যে জানকীবল্লভ চক্রবর্ত্তী নামক একজন ব্রাহ্মণ, খানসামা-কুলতিলক শ্রীমান রামচন্দ্র মাইতি ও পিলেরোগা একটা উড়ে মালি ছিল। কৰ্ত্তা খানকয়েক তালুক ও অনেক জমিজমা কিনে ছিলেন। সেইজন্য ৭৲ সাত টাকা বেতনে এই চক্রবর্ত্তী মহাশয়কে আম্‌লা নিযুক্ত করতে বাধ্য হন ও নিজের উদারতাগুণে এগার বৎসরের মধ্যে দেড় টাকা বেতন বৃদ্ধি ক’রে দেন। তবে তাতে চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের বিশেষ কোন ক্ষতি হ’তো না, কারণ মাহিনাটা একরূপ ফাউ স্বরূপ ছিল, অন্য উপায়ে বেশ দশ টাকা উপার্জ্জন হইত, পরিবার প্রতিপালনের কোন কষ্ট হ’তো না, কেন না কর্ত্তার সামনে দিয়ে একগাছি কুটো পৰ্য্যন্ত নড়তে পারতো না, কিন্তু পিছনে বড় বড় ঢেঁকি অবধি পার হ’য়ে যেতো, তার উপরে নিজে একটা নিরেট মূর্খ, দেহের ন্যায় বুদ্ধির পরিধি, কাজেই কলমের মারপ্যাচে চক্রবর্ত্তী মহাশয় বেশ দু’টাকা উপার্জ্জন করিতেন।

কর্ত্তার পিয়ারের খানসামা রানার খোরাক পোষাক বাদে বার আনা হিসাবে মাহিনা ধার্য্য আছে, তবে চারি বৎসর হ’লো রামা মাহিনা হিসাবে একটা পয়সাও পায় নাই। কর্ত্তার কাছে মাহিনা চাহিলেই ভয়ানক অসন্তুষ্ট হ’তেন এবং মুখখানি ভার ক’রে গজ্ গজ্ করতেন। সেইজন্য চতুর চূড়ামণি রামধন কর্ত্তার কাণে আর মাইনের কথা তুলতো না, কাজেই কৰ্ত্তা এই বুদ্ধিমান চাকরের উপর বড় তুষ্ট ছিলেন। তবে নানা উপায়ে বুদ্ধি খাটিয়ে অসাক্ষাতে চেয়ে নিয়ে বেশ দু-পয়সা রোজগার করতো, কাজেই মাইনের আর বড় তোয়াক্কা রাখিত না। কৰ্ত্তা বাগান থেকে নারিকেল পাতাটি কুড়িয়ে আনতো, থোড় ডুমুর সজনাশাক প্রভৃতি তরকারী সংগ্রহ করতো, কিন্তু এদিকে গুণের সাগর রামচন্দ্র বাগানের ভাল ভাল ফল ও পুকুরের বড় বড় মাছ ধরাইয়া বাজারে বিক্রয় করিত। কারণ সে মনে মনে ঠিক জানিত যে, ভাল জিনিস কখনই কৰ্ত্তা পোড়ার-মুখে তুলিবে না। চিরকাল শাক কচু খেয়ে জীবন কাটাইল; বাড়ীতে কোন ভাল তরকারী হ’লে তাহার পাতে দিতে কাহার সাহস হইত না, তিনি মামুলি বন্দোবস্ত মতন সোণাহেন মুখ ক’রে প্রত্যহ আহার করিতেন। এক দিনের তরেও তাহার কোনরূপ পরিবর্ত্তন হইত না।

সংসারের সমস্ত বস্তুই পরিবর্ত্তনশীল, কিন্তু কর্ত্তার বাড়ীর আহারের বন্দোবস্তের কোনরূপ পরিবর্ত্তন নাই। বোল্লার-টিপের ন্যায় মোটা মোটা অন্ন, ঘৃতশূন্য খোসাপূর্ণ কলায়ের দাল ও ঝাটা চচ্চড়ি গোছের একটা ছ্যাঁচড়া, সেই অনন্তকাল হ’তে একভাবে চ’লে আসছে, একদিনের তরেও এই বাঁধা বন্দোবস্তেব কোন হ্রাস বৃদ্ধি হইত না। তবে রাত্রিত্তে খুব গোপনে মোহিতবাবুর জন্য খানকয়েক লুচি ভাজা হইত, আমিও তাহার অংশ পাইতাম, কিন্তু দরজা বন্ধ করিয়া আমরা আহার করিতাম এবং রাত্রির মধ্যে চাকরে থালা লইয়া যাইত, সুতরাং আমরা গোপনে গোপনে যে এমন ভয়ানক দুষ্কার্য্য করতাম তা কৰ্ত্তা কিছুতেই জানতে পারতেন না।

এইরূপ ভাবে আমার দিন কাটতে লাগলো, কৰ্ত্তা আমাদের ইংরাজি শিখাবার জন্য এন্টনি নামে একজন আরমিনিয়ানকে নিযুক্ত ক’রে দিয়েছেন। মাষ্টার মহাশয় প্রত্যহ প্রাতঃকালে আসেন, আমি তাহার কাছে একটু একটু ক’রে ইংরাজি শিখিতে লাগিলাম, কিন্তু মোহিত বাবু তাহার কাছে ঘেসিতেন না, কেন না, তিনি বড় মানুষের ছেলে, আলালের ঘরের দুলাল, কর্ত্তার বহু কষ্টে সঞ্চিত অর্থগুলি সদ্ব্যয়ে নিঃশেষ করবার জন্য এই ধরাতলে জন্মগ্রহণ ক’রেছেন; কাজেই ছোটলোকের ছেলেদের ন্যায় কষ্ট ক’রে পড়া মুখস্থ করা তাহার পোষাইয়া উঠিত না, মাষ্টার মহাশয় বাড়ী আসিলেই তাহার ঘুম পাইত, সুতরাং বুড়ো বাঁদরকে নাচ শেখাবার জন্য আর কেহ বড় পেড়াপেড়ি করিত না।

কর্ত্তার বাড়ীর মধ্যে এক চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের সঙ্গে আমার বিশেষ আলাপ পরিচয় হইল; আমি অধিকাংশ সময় তাহার কাছে বসিয়া গল্প করিতাম। তবে তাহার সাবকাশ খুব কম ছিল, কারণ দাওয়ানি হ’তে আরম্ভ ক’রে বাজার সরকারি পর্য্যন্ত সমস্ত কাৰ্য্য তাকে একলা করতে হ’ত, কাজেই সমস্ত দিন পরিশ্রম ক’রে কাজ শেষ করতে পারত না।

চক্রবর্ত্তী মহাশয় অনেক দিন হ’লো কর্ত্তার সরকারে চাকরী করছেন, সুতরাং তাহার নাড়ীর খপর পর্য্যন্ত জানতেন, আমি তাঁর কাছ থেকে ভূঁড়ো-কর্ত্তার বিদ্যা বুদ্ধি বংশমর্য্যাদা ও তাহার সমস্ত কাণ্ডকারখানা জ্ঞাত হ’য়েছিলাম।

চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের সঙ্গে আমার বেশ সদ্ভাব হ’য়েছিল; আমি অবসরকাল তাঁহারই কাছে অতিবাহিত করতাম, তিনি আমাকে বেশ স্নেহ-চক্ষে দেখতেন, কাজেই আমার নিকট কোন কথা গোপন করেন নাই, অকপটচিত্তে কর্ত্তার সম্বন্ধে সমস্ত কথা ব’লেছিলেন।

একদিন কথা প্রসঙ্গে চক্রবর্ত্তী মহাশয়কে কর্ত্তার দেশ কোথায় জিজ্ঞাসা ক’রেছিলাম। আমার কথা শুনে তিনি হাসতে হাসতে উত্তর করলেন, “কর্ত্তার দেশ সঙ্গে সঙ্গে।” কলিকালে কমলা যে নীচগামিনী, তাহা এই বেটাতেই সপ্রমাণ হয়েছে। আমি এই কথার কারণ জিজ্ঞাসা করলে, তিনি আমার নিকট আগাগোড়া সমস্ত পুরাণো কাহিনী আরম্ভ করলেন। যথা, —

বহরমপুরে নিধিরাম মাইতি নামে একজন দক্ষিণায়াড়ি কৈবৰ্ত্ত বাস করিত ও ঘরামীর কাজ করিয়া সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিত। তাহা ছাড়া তাহার প্রায় ৩০ বিঘা মালের জমী ছিল, নিধিরাম সেই সব ভূমি ভাগে করিত, নিজেরও দু-খানা লাঙ্গল ছিল, কাজেই তাহার অবস্থা নিতান্ত মন্দ ছিল না। নিজের শয্যাসঙ্গিনীকে রূপার নোয়া পৌচে ও সোণার পলাকাটী পৰ্য্যন্ত গড়িয়ে দিয়েছিল। বহরমপুরের আশপাশ প্রায় দু-ক্রোশ হইতে কৃষক কন্যা, যত তাহার বাটীতে পলাকাটী দেখিতে আসিত এবং সৌভাগ্যবতী নিধিরাম রমণীর সহিত নিজেদের ভাগ্যের সমালোচনা করিতে আরম্ভ করিত শেষে স্ব স্ব স্বামী বেচারীর উপর অজস্র বাক্যবাণ বরিষণ করিত।

নিধিরামের লক্ষ্মী-ভাগ্যের সঙ্গে সঙ্গে ষষ্ঠির কৃপা আসিয়া মিশিল, অর্থাৎ ক্রমে ক্রমে একটি কন্যা ও দুইটি পুত্ত্র জন্মগ্রহণ করিল; কাজেই নিধিরামের আর আনন্দের সীমা রহিল না। নিধিরামের মেয়েটীর নাম মালতী ও ছেলে দুইটির মধ্যে বড়টীর নাম মাণিকলাল ও ছোটটার নাম চুনিলাল।

ঈশ্বরেচ্ছায় নিধিরামের অবস্থা তেমন অসচ্ছল ছিল না, কাজেই পুত্ত্রটী লেখাপড়া শিখিয়া ভদ্রলোক হয়, এই ইচ্ছা তাহার মনে প্রবল হ’য়েছিল। সেই জন্য বড় ছেলেটীর হাতে পাচনবাড়ী না দিয়া একটা দিন দেখিয়ে হাতে খড়ি দিয়াছিল ও মাঠের বদলে পাঠশালায় ভক্তি ক’রে দিয়াছিল; কিন্তু নিধিরামের পুণ্যফলে অল্প বয়সেই বড় ছেলেটী ডাঙ্গুলিতে সিদ্ধহস্ত, হাডুডুডুতে পাকা ও কপাটীতে ওস্তাদ হ’য়ে উঠেছিল। খুব উঁচু উঁচু গাছের আগডালে উঠে পাখীর ছানা পাড়তে তার জোড়া ছেলে আর ছিল না। কাজেই পাড়াপড়শীর গাছের ফলপাকড় বড় আর কাহারও দৃষ্টিপথে পতিত হইত না। তবে নিধিরামের কাছে প্রত্যহ দশ পনেরো নম্বর দাওয়ানী ও ফৌজদারী উভয়বিধ নালিশ দায়ের হইত। নিধিরাম মিষ্টি কথা ব’লে, গায়ে হাত বুলিয়ে, কখন বা দু-এক পয়সা ক্ষতিপূরণ দিয়ে অধিকাংশ মামলা আপোষ ক’রে ফেলতো, কেবল দু’ একটা সঙ্গিন সঙ্গিন মোকদ্দমায় যথা,—পরাণ খাঁর ছ-বৎসরের মেয়েকে পুকুরে চুবাইয়া ধরা, রামধন তর্কবাগীশের তেল কুচ কুচে নেড়া মাথায় কতকগুলি কাকের ডিম ভাঙ্গিয়া ঢালন প্রভৃতি চার্জ্জে আসামীর পিঠে দু-চার ঘা কঞ্চি বসাইয়া দিয়াছিল, কিন্তু এই উপলক্ষে নিধিরামের অন্দর-মহলে ঘোর রবে রণবাদ্য বেজে উঠছিল, নিধিরাম মহিষী তিন দিন অন্ন জল ত্যাগ ক’রে শাপ দিয়েছিল, যে পোড়ামুখো আটগতর খেকো তার সোণারচাদের কচি গায়ে ছিপটীর দাগ বসিয়েছে, সে যে দিন মরবে, সেদিন সত্যনারায়ণের কাঁচা পাকা ডাসান সিন্নি ও পঞ্চানন্দের জোড়া পাঁঠা দিয়ে পূজা দিব। এই ঘটনার পর হ’তে আর কখন নিধিরামের এতদূর স্পর্দ্ধা হয় নাই; কেন না, পাছে বাড়ীর ভিতর আবার রণবাদ্য বেজে উঠে, শ্রীমতী রঙ্গিণী বেশে ঝাটারূপ অসি গ্রহণ করেন, এই আশঙ্কায় আর কখন ছেলেকে তুমি ছাড়া তুই বলিত না, কাজেই ছেলেটি প্রকৃতপক্ষে একটি শ্রাদ্ধ বাড়ীর দাগা ষাঁড় হইয়া উঠিল ও তার উপদ্রবে পাড়াপড়শীরা বিষম বিব্রত হইয়া পড়িল।

শ্রীমান্ তামাক সুপারি প্রভৃতি চুরি ক’রে প্রত্যহ দিত, কাজেই এই ভাল ছোকরাটি গুরুমহাশয়েরও খুব সুনজরে প’ড়েছিল, একে ছাড়া প্রায় আর কাহাকেও তামাক সাজিতে দিত না, তবে ফি বারেই শ্ৰীমান্ একেবারে গলগাল ধোঁ-বেরোন ধরানো কল্কে নিয়ে আসতো, এক একবারে কল্কের পোকে ডাঁটা সার ক’রে আনতো, গুরুমশায় রাগে মুখখানা বাঁকাতেন, মিছে অছিলায় অন্য একটা ছেলের পিঠে সপ্ সপ্ ক’রে বেত বসিয়ে দিতেন, কিন্তু নেহাৎ ভাল ছেলে শ্রীমান নিধিরামের পিণ্ডাধিকারীকে বড় কিছু বলিতেন না।

মাণিকলাল গুরুমহাশয়ের নেক্-নজরে পড়েছিল বটে, কিন্তু তার ক খ ক্যকিয় শিখতে সমস্ত গ্রামের তালগাছগুলো মুড়ো হ’য়ে গিয়েছিল; শ্রীমান্ যখন সিদ্ধি লিখিতে ধরেন, তখন নিধিরাম লোক পাঠিয়ে ভিন্ন গ্রাম হ’তে তালপাতা আনাইয়া দেয়।

অল্পদিনের মধ্যে শ্রীমান্ মাণিকলাল পাঠশালার সর্দ্দার-পোড়ো হ’য়ে পড়ল, তবে ডাকটাক পড়ানোর ভার অন্য ছেলেদের উপর ছিল, শ্রীমান্ কেবল গুরুমহাশয়ের হরদম্ তামাক সাজিত ও ছোট ছোট ছেলেদের উপর অযথা প্রভুত্ব ফলাইত; এ ছাড়া পাঠশালায় তার অন্য কোন কাজ করবার অবসর ছিল না, তাকে সমস্ত গ্রামটা মাঝে মাঝে পৰ্য্যটন করতে হ’তো।

শ্রীমানের বয়স যখন সতের আঠার বৎসর, সেই সময় গুরুমহাশয় নিধিরামকে বললেন, যে তার ছেলে বাঙ্গালায় লায়েক হ’য়েছে; আর কোন বেটা পাটোয়ার ওর কাছে কলম ধরতে পারবে না। আমার পেটে যত বিদ্যা ছিল, সমস্তগুলো একেবারে নিংড়ে দিয়েছি; এখন টোলের অধ্যাপক ছাড়া আর কেউ তোমার ছেলেকে পড়াতে পারবে না।

এই সংবাদ শ্রবণে নিধিরামের আর আনন্দের পরিসীমা রহিল না। তাহার চৌদ্দপুরুষের মধ্যে কাহারও অক্ষর পরিচয় হয় নাই, কিন্তু আজ সেই চাষা বংশে এত বড় একটা বিদ্বান ছেলে জন্মালো, এ আনন্দ আর কি রাখবার স্থান আছে? নিধিরাম বিপুল আনন্দে অধীর হ’য়ে শ্রীমানের গুরুমহাশয়কে গুরুদক্ষিণা স্বরূপ একটা বড় রকমের সিদা ও নূতন ধুতি, চাদর পাঠাইয়া দিলেন। পাড়ায় একটা গুজব উঠিল যে, নিধিরাম মাইতির ছেলে বাঙ্গলায় নেহাৎ লায়েক হ’য়ে উঠেছে।

যদিও সে সময় রাজলক্ষ্মী ইংরেজ বাহাদুরদের অঙ্কশায়িনী হ’য়েছিল, ইংরেজেরা যে দেশের সর্ব্বময় কর্ত্তা, নবাব সাহেব যে কেবল খেলাঘরের সাজানো পুতুল মাত্র, তা দেশের ইতর ভদ্র সকলে জেনেছিল, ইংরাজী শিখিবার ইচ্ছা অনেকের অন্তরে উদয় হ’য়েছিল, কিন্তু তথাপি ইংরাজীর কায়দায় সেই সাম্য-মন্ত্রের ঢেউ সমাজের উপর দিয়া তখন প্রবাহিত হয় নাই, অধিকার ভেদ একেবারে লুপ্ত হয় নাই, শাসনশৃঙ্খলা একেবারে চুর্ণ বিচূর্ণ হয় নাই, সুতরাং কৈবর্ত্ত নিধিরামের পুত্ত্র যে ব্রাহ্মণ বালকের সঙ্গে একত্রে সংস্কৃত শিখিবে, এরূপ দুরাশা নিধিরামের অন্তরে উদয় হইল না, বা সাহসে কুলাইল না। কাজেই ছেলেটীকে বাঙ্গালার ন্যায় ইংরাজীতে লায়েক করবার সাধ দুরাশা-বাতিকগ্রস্ত নিধিরামের হৃদয়ে প্রবল হ’য়েছিল। কিন্তু এই পুত্ত্ররত্ন সুশিক্ষিত হ’য়ে কার্য্যজগতে প্রবেশ ক’রে, এই ভ্ৰান্ত নিধিরামের অসীম স্নেহের ঋণ যে কিরূপভাবে পরিশোধ করবে, তাহা আমার ধৈর্য্যশীল কৃপাপরায়ণ পাঠকমহাশয়েরা স্পষ্ট বুঝতে পারবেন। অদৃষ্টের ফেরে, কুশিক্ষার ফলে, নিধিরামের ন্যায় কত অভাগ্য পিতা যে পরিণামে নৈরাশ্য-নীরে নিমগ্ন হ’য়েছে, তার আর ইয়াত্তা নাই। দেশে পাশ্চাত্য সভ্যতার যত প্রভাব বৃদ্ধি হবে, সমাজের শৃঙ্খলা ও শাসনশক্তি তত শিথিল হয়ে পড়বে, মানুষের কর্ত্তব্যজ্ঞান ও মনুষ্যত্ব উষার উদয়ে তমোরাশির ন্যায় অদৃশ্য হ’য়ে যাবে, কাজেই এ প্রকার বিষদৃশ্য দৃশ্য যে সর্ব্বত্র পরিদৃশ্যমান হবে, তাহার আর বিচিত্র কি?

সে সময় ইংরাজীর ততদূর চলন হয় নাই, যে দুই একজন সামান্য কিছু শিখিয়াছিল, তাহাদের পসার প্রতিপত্তি খুব ছিল, লোকের কাছে তাহাদের আদর আর ধরিত না। সে সময় রামকৃষ্ণ মাষ্টার নামে একজন ইংরাজি জানা লোক বহরমপুরে ছিল, গ্রামের ছোট বড় ইতর ভদ্র সকলের কাছে মাষ্টারমশায় খেতাব হ’য়েছিল, তাঁর আদত নাম ধ’রে প্রায় কেউ ডাকিত না। নিধিরাম কিঞ্চিৎ নগদ সহ বিস্তর অনুনয় বিনয় ক’রে পুত্ত্রকে ইংরাজী শিখাইতে এই মাষ্টার মহাশয়কে স্বীকার করাইল। কাজেই শ্রীমান মাণিকলাল রামকৃষ্ণ মাষ্টারের নিকট ইংরাজী শিখিতে আরম্ভ করিল।

চক্রবর্ত্তী মহাশয় এই পৰ্য্যন্ত ব’লেছেন, এমন সময় নড়েভোলা গোচের পেটভাতা সেই হিন্দুস্থানি ব্রাহ্মণ আহারের জন্য আমাকে ডাকিতে আসিল, কাজেই ভূঁড়ো-কর্ত্তা-চরিতামৃতের শেষভাগটা তখনকার মতন আর শোনা হ’লো না; অগত্যা আমাকে তাহার সঙ্গে বাড়ীর ভিতর যেতে হ’লো।