- হরিদাসের গুপ্তকথা
- প্রথম পরিচ্ছেদ : কিসের মন্ত্রণা?
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : এরা কে?
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল!
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ : আজব চিঠি!
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাবু দেবীপ্রসাদ।
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : ভয়ানক ব্যাপার!
- সপ্তম পরিচ্ছেদ : বিষম সন্দেহ।
- অষ্টম পরিচ্ছেদ : আলেকসাই ফকির।
- নবম পরিচ্ছেদ : পীরের দরগা।
- দশম পরিচ্ছেদ : মোহিত বাবু।
- একাদশ পরিচ্ছেদ : ভূঁড়ো-কর্ত্তা।
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : গুণের খানসামা।
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মাষ্টার মহাশয়।
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : গোমিস্ সাহেব।
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : আখড়া।
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ : গ্রেপ্তার।
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : দারোগা সাহেব।
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : হাজত বা হাবুজখানা।
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল।
- বিংশ পরিচ্ছেদ : হাজতে দ্বিতীয় রাত্রিবাস।
- একবিংশ পরিচ্ছেদ : আমার বিচার।
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ : বিচারালয়।
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ : এ কথা কি সত্য?
- চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ : ব্রহ্মচারী মহাশয়।
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ : গুপ্তকথা।
- ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ : পাপের পরিণাম।
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ : নবাব বাহাদুর।
- অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ : নীলমণি বসাক।
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ : উদ্যোগপৰ্ব্ব।
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ : আশা মিটিল।
- একত্রিংশ পরিচ্ছেদ : দীক্ষা।
- দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ : লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু।
- উপসংহার
দশম পরিচ্ছেদ
মোহিত বাবু।
উন্মার্গগামী, কলুষিত-চিত্ত ঘোর অপব্যায়ী এই যুবকের নাম মোহিতকুমার সরকার। স্বনামধন্য মাণিকলাল সরকারের একমাত্র পুত্ত্র, বাল্যকালেই তার মাতৃবিয়োগ হয়েছিল; কাজেই অতিরিক্ত আদর লইয়া এই আদরের ঢেঁকি প্রকৃতপক্ষে আদত আলালের ঘরের দুলাল হ’য়ে পড়লো। অতি বাল্যকালে তাহার জ্বালায় বাড়ীর সকলে নিতান্ত বিব্রত হ’য়ে পড়তো, কারণ খোকাবাবু কখন কখন জ্যোৎস্না খাইবার জন্য বায়না ধরিত। তারপর ঈষৎ পিপুল পাকিলে কুসঙ্গে মিশিয়া একেবারে চারকলমে পুরু হ’য়ে উঠলো, কিঞ্চিৎ লেখাপড়া শিখ্বার আর অবসর হ’লো না, কাজেই একটী আদত ধর্ম্মের ষাঁড় হ’য়ে সংসার কাননে বিচরণ করতে লাগল এবং পাকা পাকা বদমাইসদের সঙ্গে মিশিয়া দিন দিন উৎসন্নের পথে অগ্রসর হ’তে লাগলো। হৃদয়সিংহাসনে শয়তানকে প্রতিষ্ঠা করল বলেই নীচ সহবাস, নিষ্ঠুর আমোদ, পৈশাচিক কাণ্ড যে নিতান্ত প্রিয় হ’য়ে উঠলো, তাহা বলাই বাহুল্য।
মোহিতবাবুর পিতা নূতন বড়মানুষ হ’য়ে অনেকগুলি রাজস্বের দায়ে বিক্রীত তালুক কিনিয়াছিল, কাজেই মামলা মোকদ্দমার সংখ্যা বেড়ে উঠেছে। তখনও নিজামতি আদালত কলিকাতায় উঠে আসে নাই, ট্যাকশাল ও আদালত মুর্শিদাবাদে ছিল, কাজেই মাণিকবাবু জয়গোপাল লাহিড়ী নামে একজন বারেন্দ্র শ্রেণীর ব্রাহ্মণকে স্বপক্ষে উকীল নিযুক্ত ক’রেছিলেন। তিনি নিজামতি আদালতে মামলা মোকদ্দমা চালাইতেন, মাঝে মাঝে তাহার গুণধর পুত্ত্র মামলা তদ্বির করবার উদ্দেশে এখানে আসিত ও বদমাইসদের সঙ্গে মিশিয়া নানাপ্রকার অভদ্রোচিত পশু প্রমোদে প্রমত্ত হ’তো!
আমি বুঝে দেখলাম যে, এই দেবীপ্রসাদ বেটা তার গুরুমশায় ও ধন স্থানে শনি স্বরূপ। এই পাষণ্ড হাতে ধ’রে পুরো দস্তুর মত বকামো শিখিয়েছে ও উৎসন্ন যাবার সোজা দেখিয়ে দিয়াছে। মোহিত বাবু বড় মানুষের ছেলে, খাজামূর্খ ও নিরেট নির্ব্বোধ; কাজেই দেবীপ্রসাদ এই কাপ্তেন-রত্নকে ঠিক পাকা কলার ন্যায় পেয়েছে। বাঁদরওয়ালারা যেমন বাঁদর নাচায়, তেমনি তোষামোদরূপ দড়ি গলায় দিয়ে শ্রীযুতকে তালে তালে নাচিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। ভাবে বোধ হয় যে অল্পদিন হ’লো দেবীপ্রসাদের সঙ্গে যুবকের আলাপ হ’য়েছে; মোহিত বাবু এই সমস্ত নামজাদা বদমাইসদের এখনো চেনে নাই, সেই জন্য সে রাত্রে ঠাকুরসাহেবকে জাল রাজা সাজিয়েছিল। ফলকথা ঘোর কপট দেবীপ্রসাদ বেটা যে কিরূপ দরের লোক, তাহা এখনো জানে নাই; বা তাহাকে ঠিক চিনিতে পারে নাই; সেইজন্য এরূপ অপাত্রে বিশ্বাস স্থাপন ক’রেছে।
এই সংসারে কেবল মাত্র সঙ্গীর দোষে কি গুণে মানব জীবন উন্নত কি অবনত হ’য়ে থাকে; হয় সুখ শান্তির বিমল কৌমুদী প্রভাবে অন্তরাকাশ আলোকিত হয়, আর নয়তো দুঃখ দারিদ্রের অনন্ত-অন্ধকারে চিত্তভূমি চিরকাল সমাচ্ছন্ন থাকে। সেইজন্য বিশেষ পরীক্ষা পূর্ব্বক সঙ্গী নিৰ্ব্বাচন করা বুদ্ধিমানদের পক্ষে কর্ত্তব্য। কারণ বিষপূর্ণ কলসের উপরিভাগে যেমন অল্প দুগ্ধ থাকে, তেমনি কপট ধূর্ত্তেরা মুখের মিষ্ট কথায় সংসারের জ্ঞানহীন নির্ব্বোধদের নিতান্ত অভিভূত করে; এবং মোল্লাসাহেব যেমন অতীব যত্নে পালিত মুরগীর গলায় ছুরি বসায়, তেমনি কাৰ্য্যকাল উপস্থিত হ’লে সেই অভাগার সর্ব্বনাশ সাধনে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হয় না। যেমন দুগ্ধে বিন্দুমাত্র গো-মূত্র পতিত হ’লে দুগ্ধের সমস্ত গুণ বিনষ্ট হ’য়ে যায়, তেমনি পাপাত্মার সহিত মিলন হ’লে নিতান্ত তত্ত্বজ্ঞানী সৎপুরুষদেরও অবনতি ঘ’টে থাকে। আবার জল কুসুমের সহযোগে যেমন সুরভিত হয়, অগ্নিকুণ্ডে পতিত হ’লে অঙ্গারের মলিন মূৰ্ত্তি যেমন তিরোহিত হ’য়ে থাকে, তেমনি সাধু সঙ্গের গুণে নিতান্ত মলিনবুদ্ধি মানবেরও বুদ্ধি বিকাশ পায়; এবং পরমার্থ পথের পথিক হবার স্পৃহা প্রবল হ’য়ে উঠে। কোন জলপূর্ণ বৃহৎ পাত্রের তলদেশে একটী সামান্য ছিদ্র থাকলে, সেই পথ দিয়ে সমস্ত জল যেমন নিঃশেষ হ’য়ে যায়, তেমনি একমাত্র কুসংসর্গের দোষে নিতান্ত গুণবান ব্যক্তির গুণাবলীও অচিরকাল মধ্যে বিলুপ্ত হ’য়ে থাকে। ফল কথা একমাত্র অসৎ সংসর্গে, এই হিতাহিত জ্ঞানহীন মানবের যে কতদূর অধঃপতন ঘটে, তাহা এই হতভাগ্য যুবকের অবস্থা দেখলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে। যদি নরপ্রেত সদৃশ এই সকল পাষণ্ডদের সঙ্গে মিলন না হ’তো, তাহ’লে ইহার স্বভাব এতদূর কলুষিত ও পরিণাম কখনই এতদূর শোচনীয় হ’তো না।
আমরা সে রাত্রি উকীল জয়গোপাল বাবুর বাড়ীতে যাপন করিলাম। দেবীপ্রসাদ ও অন্য মাতালটা পথ হ’তে বিদায় গ্রহণ করিল ও পরদিন পরস্পর দেখা করবার জন্য নিমন্ত্রণ ক’রে রাখলো; আমি তাদের সাক্ষাতে মোহিত বাবুকে কোন কথা কহিলাম না, নিতান্ত গোবেচারী হাবা নেকার মতন চুপ ক’রে রইলাম।
পরদিন প্রাতঃকালে মোহিতবাবুর সহিত আমার অনেক কথাবার্ত্তা হ’লো। তখন তিনি সজ্ঞানে আছেন, দুষ্ট শয়তান তাঁর কাঁধ হ’তে নামিয়াছে; হারাণ মনুষ্যত্বটুকু পুনরায় ফিরে এসেছে, কাজেই তিনি বেশ ভদ্রভাবে আমার প্রত্যেক কথার উত্তর দিলেন; আমি তাঁর সঙ্গে আলাপ ক’রে নিতান্ত প্রীত হ’লাম; কারণ দেখলাম অনেক সদ্গুণাবলী তাঁর হৃদয়াভ্যন্তরে সঞ্চিত আছে; অন্তর এখনো পাষাণের ন্যায় নীরস হয় নাই, বোঝালে বোঝবার ক্ষমতা এখনো আছে। বিশেষতঃ অন্তসারশূন্য মূর্খ ধনী পুত্ত্রদের ন্যায় তিনি দাম্ভিক নন, সহসা কাহারও মর্ম্মে আঘাত করেন না, বা দরিদ্র ভদ্র সন্তানদের ইতর জন্তু জ্ঞানে অবমাননা কর্ত্তে অগ্রসর হন না। সকলের সঙ্গে বেশ মিষ্টভাষায় কথা কন এবং সাধ্যমত অমায়িক ভাব দেখাইতে চেষ্টা ক’রে থাকেন। সেই জন্য আমার ন্যায় একটা সামান্য লোকের সঙ্গে বেশ সরলভাবে কথা কইতে লাগলেন এবং আমাকে ভাই বলে সম্বোধন করতে কুণ্ঠিত হ’লেন না। সিমূলফুল সদৃশ অনেক নির্গুন ধনী সন্তানেরা নিজের ধনমদে মত্ত হ’য়ে দরিদ্রদের মনুষ্য বলে জ্ঞান করে না, কিন্তু দেখলাম, মোহিতবাবু সেরূপ প্রকৃতির লোক নহেন। তিনি মিষ্টভাষী, বিনয়ী ও অমায়িক ভাব সম্পন্ন; কেবল বাল্যকাল হতে অসৎসঙ্গে পতিত হ’য়ে এ প্রকার ধর্ম্মজ্ঞানহীন নীচ আমোদপ্রিয়, কলুষিত চিত্ত, দুর্ব্বিনীত হ’য়ে উঠেছেন। তবে এখনো চেষ্টা করলে, দেবীপ্রসাদ প্রমুখ পাষণ্ডেরা কিরূপ দরের লোক বুঝাইয়া দিলে, ইহার চৈতন্য হ’তে পারে। কারণ হৃদয়খানি যখন এখনো পাষাণের ন্যায় নীরস ও লৌহসম কঠিন হয় নাই, তখন উপদেশ বীজ বপন করলে অঙ্কুরিত হবার নিতান্ত সম্ভাবনা আছে।
আমি উপযুক্ত অবসর বুঝে তাহার পরম হিতৈষী বন্ধু দেবীপ্রসাদের গুণ আগাগোড়া বর্ণনা করলাম। সেই বুধবার রাত্রে কর্ত্তার সহিত তাহার গুপ্ত পরামর্শ, ঠাকুরসাহেবের আখড়ায় পত্র ল’য়ে আমার গমন, ফুলকুমারীর সহিত সাক্ষাৎ, ঠাকুরসাহেবের রাজা সাজা, তারপর ফকির সাহেবের দ্বারা রহিম মোল্লার লাশ সাবাড় প্রভৃতি সমস্ত কথা আমি প্রকাশ ক’রে বল্লাম, কোন কথা গোপন করলাম না।
আমার এই সকল কথা শুনে, ক্রোধে অধীর হ’য়ে মোহিত বাবু কহিল, “বটে, শালা এতদূর পাজি বদমাইস! শালা আমার সর্ব্বনাশ করবার যোগাড় ক’রেছিল, ভাগ্যে ভাই তোমার সঙ্গে আলাপ হ’লো, তাই শালাকে ঝাঁ ক’রে চিনতে পারলাম, আর বেশী উড়তে পারলো না। যাই হোক্ শালা বদমাইস মিথ্যাবাদীকে সহজে ছাড়ছি না, শালাকে ভাল ক’বে জব্দ ক’রে তবে ছাড়বো; আমি যে কেমন ছেলে তা শালা ভাল ক’রে জানতে পারবে।”
আমি কহিলাম, “না, তাতে কোন আবশ্যক নাই; কারণ একটা ষাঁড় যদি আপনাকে গুঁতাইতে আসে, আপনিও কি তাহাকে গুঁতাইবেন? বক্সী প্রমুখ বদমাইসদের যে চিনতে পারলেন, ইহাই যথেষ্ট; আর তাদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখবার কি আখোচ বাড়াবার আবশ্যক নাই। এই জগতে একজন রাজার রাজা আছেন, তাঁর চক্ষে ধূলি দেওয়া কাহারো ক্ষমতার অধীন নহে, তিনিই পরিণামে পুণ্যবানদের পুরষ্কৃত ও পাপীদের উপযুক্ত দণ্ড প্রদান করে থাকেন। আপনি তাঁর উপর সমস্ত ভারার্পণ ক’রে নিশ্চিন্ত হউন; বিষবৎ বদমাইসদের সঙ্গ ত্যাগ করুন, আর তাদের সঙ্গে কোনরূপ সম্বন্ধ রাখবেন না। মনে ঠিক জানবেন, এই সংসারে কেহ কখন চিরকাল পাপ ক’রে পরিত্রাণ পায় না; পাপীদের ভাগ্য তৃণসংলগ্ন অগ্নির ন্যায় একবার প্রজ্জ্বলিত হ’য়ে চিরদিনের জন্য নিৰ্ব্বাণ হ’য়ে যায়, পাপপথে থেকে কেহ কোনকালেও সুখী হ’তে পারে না।
মেহিতবাবু অতীব মনযোগের সহিত আমার কথাগুলি শুনিলেন এবং একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেন, “দেখ ভাই! তুমি বয়সে ছোট বটে, কিন্তু আজ তোমার কথা শুনে আমার আক্কেল হ’লো। আমি আর কখন সে বেটাদের সঙ্গে বেড়াব না, কাছে এলে কুকুরের মতন দূর দূর ক’রে তাড়িয়ে দিব; আর কখন কোন বেটা বদমাইসকে কাছে আসতে দিব না। আমি নিতান্ত মূর্খ, তাই ওরকম সৰ্ব্বনেশে খুনে ডাকাতদের কথা সত্য ব’লে বিশ্বাস ক’রেছিলাম। কেবল ভগবানের ইচ্ছায় সে দিন ওরকম প্রাণসঙ্কট বিপদ হতে রক্ষা পেয়েছি। যাই হোক্ তোমাকে হরিদাস ব’লে ডাকে, কিন্তু তোমার উপাধি কি? সেই খুনে ডাকাত বেটার সঙ্গে তোমার সম্পর্কই বা কি?”
আমি বিনীতভাবে উত্তর করিলাম, “দেখুন বাবু! এই আশ্রয়হীন দরিদ্র অভাগাকে আপনি যখন এরূপ কৃপানেত্রে নিরীক্ষণ করলেন, এ অধম আপনার ভৃত্যের যোগ্য নয়; কিন্তু তথাপি আপনি দয়া ক’রে আমাকে যখন ভাই ব’লে সম্বোধন করলেন, অন্তরের দ্বার খুলে ঈদৃশ সরলভাবে যখন কথা কইলেন, তখন আপনার সমক্ষে আমি কখনই মিথ্যা কথা বলবো না; কি কোন বিষয় গোপন করবো না। আমি নিজে যে কোন্ জাতি তাহা আমি জানি না; সুতরাং আমার উপাধি যে কি তা আমি কিরূপে বলবো? কিষণজি বাবু নিজে কণোজি ব্রাহ্মণ ব’লে পরিচয় দেন বটে, কিন্তু তাঁহার কোন কথা সত্য ব’লে বিশ্বাস হয় না। তাঁর উপর তিনি আমার কেহ আপনার জন নহেন; শুনেছি তাঁহার গুরুদেব আমাকে প্রতিপালনের জন্য তাঁহার কাছে রেখে গেছেন; সম্ভবতঃ আমার সম্বন্ধে যে সকল কথা একমাত্র তিনিই জানেন, কিন্তু আমি এখনো কোন কথা শুনি নাই বা সেই মহাপুরুষের সঙ্গে কখন সাক্ষাৎ হয় নাই, কাজেই আমি সম্পূর্ণ অন্ধকারে আছি। কে পিতা, কে মাতা, কোথায় জন্ম, কি জাতি কিছুই জানি নাই, কেবল অনাথের ন্যায় পরের আশ্রয়ে বাস করছি।”
এই কথা বলিতে বলিতে সহসা আমার স্বর রুদ্ধ হ’য়ে এলো। জলভারাক্রান্ত মেঘের ন্যায় চক্ষু দু’টি ছল্ছল্ করলো এবং আমার অলক্ষে দু’ফোঁটা অশ্রুজল চিবুকদেশ দিয়া গড়াইয়া পড়িল।
আমাকে রোদন-পরায়ণ দেখে করুণ-হৃদয় যুবক প্রবোধ বচনে কহিল, “থাক্ ও সব কথা মনে হ’লে যদি প্রাণে কষ্ট পাও, তাহ’লে আর বলার কোন আবশ্যক নাই; তবে তুমি যেরূপ সৎ ছোকরা, তাতে তুমি কখনই চিরকাল অন্ধকারে থাকবে না, একদিন নিশ্চয় তোমার মনের সকল সন্দেহ মিট্বে, এখন আমাদের বাটীতে সকলের কাছে তুমি কায়স্থ ব’লে পরিচয় দিও; বামুন রান্না ভাত দু’বেলা খাবে, কাজেই সব দিক্ বজায় থাকবে। আমি খুব শীঘ্র বাবুকে বলে তোমার একটা চাকরী ক’রে দিব ও বিবাহ দিয়ে একটা হিল্লে ক’রে দিব।”
মোহিবাবুর শেষের কথাটা শুনেই সহসা আমার বুকটা ধড়াস্ ক’রে উঠলো, একটি মোহিনী মূৰ্ত্তি হৃদয় দর্পণে দেখা দিল। কিষণজি বাবুর অন্দর মহলের সেই বালিকাজহীন লোণাধরা ক্ষয়া ক্ষয়া ইষ্টকযুক্ত দরদালান চক্ষের উপর ভেসে উঠলো, স্মৃতির দ্বার খুলে গেল, কত পুরাতন ঘটনা, অন্তররাজ্যে প্রবেশ করল, কাজেই মনের মধ্যে একটা বিষম বিপ্লব উপস্থিত হ’লো, কিন্তু আমি তাহা দমন ক’রে ফেল্লুম, মোহিত বাবুকে আমার এই ভাবান্তরের বিন্দু বিসর্গ মাত্র জানতে দিলাম না।
আমি মোহিত বাবুকে অন্য সকল কথা বলিলাম বটে, কিন্তু কর্ত্তার সেই পারিবারিক কেলেঙ্কারীর কথা আদৌ তাহার নিকট প্রকাশ করিলাম না। কারণ এতদিন যাহার অন্নে প্রতিপালন হয়েছিলাম, যিনি আমাকে পুত্ত্রের ন্যায় স্নেহ করতেন, তাঁহার কুৎসা জগতে প্রচার করা সঙ্গত ব’লে বোধ করলাম না। তারপর মোহিত বাবু যদি কোনরূপ বিরুদ্ধ ভাবে, এই ভয়ে নির্ম্মলার সম্বন্ধে কোন কথা বলিতে সাহস হইল না।
প্রকৃতপক্ষে কর্ত্তা গিন্নি যে আমার মা বাপ নহেন, কেবল প্রতিপালক মাত্র এ কথা যদি জানতে না পারতাম, তাহ’লে কখনই এত শীঘ্র তাঁহাদের আশ্রয় ত্যাগ করতে পারতাম না। সে কথাবার্ত্তা শুনে ও এই সব লীলা খেলার পরিচয় পেয়ে, তাঁদের উপর ভক্তির স্থানে বিজাতীয় ঘৃণা আসিয়া উপস্থিত হ’য়েছিল। তাঁদের সহবাসে আর কিছুদিন থাকলে আমার যে ঘোর অবনতি ঘটবে, প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে তাঁদের পাপ কার্য্যের সহায়তা করতে হবে, তাহা একপ্রকার নিশ্চয়; সেই জন্য তাঁদের স্নেহপাশ ছেদন করতে আমার বিন্দুমাত্র কষ্ট বোধ হ’লো না। পূর্ব্ব হ’তেই আমার মন চটিয়াছিল, সেই জন্য এই সামান্য সূত্র পাইয়াই তাঁহাদের সংসর্গ ত্যাগ করলাম এবং স্রোতের মুখে তৃণের ন্যায় অকুল সাগরে ভাসিলাম, এখন দেখি ভাগ্য পবন আমাকে কোন্ দিকে নিয়ে যায়।
তবে একটা আশা আমার প্রাণের অন্দরমহল মধ্যে লুকানো ছিল, কিন্তু সম্প্রতি সে আশাসূত্রও ছিন্ন হ’য়ে গেছে। আমি এখন বেশ বুঝেছি যে, আমার সেই আশা দুরাশায় পরিণত হয়েছে; কারণ কর্ত্তার অমতে গিন্নি কখনই কিছু করতে পারবে না। তাহ’লে আর কিষণজির বাড়ীতে থাকবার আবশ্যক কি? এ প্রকার নিরন্তর দৃষ্টি আগুণে দগ্ধ হওয়া অপেক্ষা একটু দূরে বাস করা কৰ্ত্তব্য। তবে কখন যদি অর্থ উপার্জ্জন করতে পারি, আর তার উপর ভাগ্য অনুকুল হয়, তাহ’লে আমার এই আশালতা ফলে ফুলে সুশোভিত হ’তে পারে। কিন্তু আপাততঃ কিষণজি বাবুর বাড়ীতে থাকলে, আমার অবনতি ছাড়া উন্নতি হবে না; সেই জন্য এই যুবকের আশ্রয় গ্রহণ করেছি, দেখি ইহার দ্বারায় আমার অবস্থার কিরূপ পরিবর্ত্তন হয়।
মধ্যাহ্নে জামাই আদরে সেই উকীল মহাশয়ের বাড়ীতে আহারাদি শেষ করলাম। লাহিড়ি মহাশয় তাঁহার ধনী মক্কেল পুত্ত্রের খাতিরের জন্য ‘আমাকে বিশেষরূপে যত্ন করছিলেন, অধিকন্তু মোহিত বাবু আমাকে সম্পর্কে মামাতো ভাই বলে পরিচয় দিয়াছিলেন, কাজেই আমার ও আদর অপ্যায়নের ত্রুটী হ’লো না।
মোহিতবাবু সেদিন মুর্শিদাবাদে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, কিন্তু যদি রাত্রিকালে আবার সেই সব বদমাইসদেব সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, এই আশঙ্কায় আমি তাহাতে আপত্তি করিলাম, বাবু আমার কথা অগ্রাহ্য করিলেন না, কাজেই আমরা বেলা বারটার পর একজন মাত্র ভৃত্য সঙ্গে মোহিত বাবুর বাড়ী আজীমগঞ্জ উদ্দেশে যাত্রা করিলাম।