» » হরিদাসের গুপ্তকথা

বর্ণাকার

নবম পরিচ্ছেদ

পীরের দরগা।

আমি ফকির সাহেবের সঙ্গে দরগা দেখবার জন্য যাত্রা করলাম। তিনি আপাততঃ আমার মুরুব্বির পদ গ্রহণ করলেন এবং দরগার সম্বন্ধে দুশো সুখ্যাতি করতে আরম্ভ করলেন। তার কথার ভাবে বোধ হ’লো, যেন আমরা পাপতাপময় জগৎ পরিত্যাগ ক’রে শান্তির-নিকেতন তুল্য স্বর্গধামে গমন করছি। সেখানে একবার মাথা গলালে কোনরকম ভয় ও ভাবনার নাম মাত্র থাকবে না; গোটা প্রাণটা কেবল সুখ-সাগরে ডুব সাঁতার কাটতে থাকবে।

আমরা প্রশস্ত রাজপথ ত্যাগ ক’রে একটা গলির মধ্যে প্রবেশ করলাম। তখন সপ্তমীর চাঁদ আকাশপটে দেখা দিয়েছেন এবং বিমল কৌমুদী প্রভায় স্বভাব সুন্দরীর মলিন মুখ উজ্জ্বল হ’য়ে উঠেছে।

আমরা যে গলিটার মধ্যে প্রবেশ করলাম, সেটা নিতান্ত অপ্রশস্ত, অপরিষ্কৃত ও জঘন্য; মরা ইঁদুর, পচা ছুঁচো, মুরগীর পালক, হাসের ডিম ও পিয়াজের খোসা চারিদিকে ছড়ানো আছে এবং মাঝে মাঝে আবৰ্জ্জনা-রাশির স্তূপ যেন ছোট ছোট পাহাড়ের ন্যায় শোভা পাচ্ছে; দু-ধারে অধিকাংশই খোলার ঘর, মধ্যে মধ্যে দু-চারখানি জীর্ণ দোতলা বাড়ী আজন্ম উলঙ্গ অবস্থায় শত শত দত্তবিকাশ পূৰ্ব্বক দাঁড়িয়ে আছে। দোর জানলা প্রায় কাহারো নাই, দু-এক জায়গায় গরাণ ও বাঁখারি গরাদের একটীং হ’য়েছে ও ছেঁড়া কাপড়ের গোছলা জানলার কপাটের বদলি খাটছে। ফলকথা দারিদ্রতা ও কুরুচীর পূর্ণ নিদর্শন সেই স্থানে বিদ্যমান আছে।

অন্যান্য রাজপথের ন্যায় এই রাত্রিকালেও এ গলিটা সম্পূর্ণরূপে নিস্তব্ধ হয় নাই। অনেকগুলি বাড়ীর গবাক্ষপথ দিয়ে ক্ষীণ আলোক বহির্গত হচ্ছে এবং পতি বা উপপতির পীড়নে রমণীর করুণ ক্রন্দন, মাতালের বিকট চীৎকার বেতালা অশ্লীল সঙ্গীত ও উচ্চ হাসির রোল মধ্যে মধ্যে উত্থিত হচ্ছে।

আমরা যে কোন ভদ্র-পল্লীর মধ্যে আসি নাই, এই সব বাড়ীতে যে পতিতা স্ত্রীলোক ও ভয়ানক প্রকৃতির বদমাইসেরা বাস করে, তাহা আমি মনে মনে বেশ বুঝতে পারলাম; কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বললাম না, কেবল নীরবে ফকির সাহেবের সঙ্গে অগ্রসর হ’তে লাগলাম।

সেই গলিটার মোড়ের মাথায় একটা প্রকাণ্ড বটগাছের নীচে একটা ছোট একতালা ঘর রয়েছে এবং তাহার মধ্যে একটা মাটীর প্রদীপ মিট্‌মিট্‌ ক’রে জ্বলছে, কিন্তু তার মধ্যে কোন জনমানবের নাম মাত্র নাই।

ফকির সাহেব সেই ঘরটীর সামনে দাঁড়াইল এবং লম্বা ধরণের একটি সেলাম ঠুকে কহিল, “এ ভেইয়া, সেলাম কিয়ো, এই জুম্মা পীরকা দরগা।” ফকিরের কথামত আমি একটা লোক দেখানো সেলাম করলাম বটে, কিন্তু বিষম খট্‌কা উপস্থিত হ’লো। কারণ ফকির সাহেব এই দরগার যেরূপ সুখ্যাতি ক’রেছিল, ইহাতে তাহার কিছুই দেখতে পেলাম না। আমি সেই ক্ষীণ আলোকের সাহায্যে দেখলাম যে, সেই ঘরের ঠিক মধ্যস্থলে কাপড়ে মোড়া একটি ছোট ঢিপি শোভা পাচ্ছে এবং ছড়া কয়েক শুকনো ফুলের মালা তার উপর র’য়েছে। ঢিপির ঠিক কোলে রকম বেরকম ছোট বড় প্রভৃতি কড়ি ও মাটীর ছোট ছোট ঘোড়া ও খানকয়েক বাতাসা, অনেকটা এলোমেলো ভাবে সাজানো আছে। এক ধারে একটি ছোট কুলুঙ্গিতে সেই মাটির দুর্গাপ্রদীপটি মিট্‌মিট্ ক’রে জ্বলছে।

আমি ঘরের এই সব আসবাব দেখছি ও ফকিরের কথা মনে মনে ভাবছি, এমন সময় ফকির সাহেব আমার ডান হাতখানি ধ’রে বলেন, “আও ভেইয়া! আবি অন্দর দেখ।” এই কথা বলে তিনি হো হো ক’রে হেসে উঠলেন।

আমি ফকিরের সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম, তিনি আমাকে সেই দরগা ঘরের পিছনে লইয়া আসিলেন। আমি দেখলাম যে, সেখান দিয়ে একটি খুব সরু গলি পড়েছে এবং একদিকে সেই প্রকাণ্ড বটগাছ ও অন্যদিকে খুব উঁচু উঁচু নিম ও দেবদারু গাছ শোভা পাচ্ছে; কাজেই চন্দ্রদেবের ক্ষীণ রশ্মি কোনকালেও তথায় প্রবেশ করতে পারে না, পর্ব্বত গুহার ন্যায়, নিবিড় অন্ধকার নিরবছিন্নভাবে তথায় রাজত্ব করে থাকে। আমি অন্ধের ন্যায় ফকির সাহেবের কাঁধে হাত দিয়া ধীর-পদবিক্ষেপে অগ্রসর হ’তে লাগলাম; কিন্তু খানিক দূর গিয়া আমার যেন চমক ভাঙ্গিল, কোথা হ’তে সহসা ভয় এসে আমার হৃদয়-মন্দিরে বিগ্রহরূপে দেখা দিল, বুক গুরগুর্ ক’রে উঠলো, এবং রবিতাপে ম্রিয়মান কিশলয়সম মুখখানি শুকায়ে গেল। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম, “আমি কি মূর্খ, তুচ্ছ কৌতুহল তৃপ্তির জন্য এই অপরিচিত ছদ্মবেশী বদমাইসের সঙ্গে কোথায় যাচ্ছি? এ বেটার মনে যে কোনরূপ অসৎ অভিসন্ধি নাই, তাহারই বা প্রমাণ কি? সর্প বিবর তুল্য বদমাইসের সেই আড্ডার মধ্যে প্রবেশ করলে কোনরূপ বিপদ যে ঘটবে না, তাহাই বা কে বলিল? অগ্র পশ্চাৎ বিবেচনা না ক’রে বাল-স্বভাব-সুলভ চাপল্যের বশীভূত হ’য়ে, এই রাত্রিকালে এরূপ ভয়ানক প্রকৃতি লোকের সহিত এ প্রকার ভয়ানক স্থানে এসে ভাল করি নাই। জানি না, আমার অদৃষ্টে আজ কি নিগ্রহভোগ সঞ্চিত আছে।

সহসা এইরূপ চিন্তার আক্রমণে আমি নিতান্ত ব্যথিত হ’লাম; কি যে উপায় করি, তাহা স্থির করতে পারলাম না, কাজেই আর অগ্রসর না হ’য়ে সেইখানে দাঁড়ালাম।

ভাবে বেশ বোধ হ’ল যে, আমার অন্তরের এই ভাবান্তর চতুর চূড়ামণি ফকির সাহেবের কাছে প্রচ্ছন্ন থাকলো না; কারণ তিনি একবার হো হো ক’রে হেসে উঠে, অপেক্ষাকৃত নম্রস্বরে কহিলেন, “কেঁও ভেইয়া! কুচ্ ডর্ মালুম্ হুয়া?  তোম্‌রা পাশ তো আস্‌রুফিকা তোড়া নেহি যো লুট লেগা? হাম্ জান্‌তা তোমরা পাশ এক্‌ঠো কৌড়ি বি নেহি, হাম্ তোম্‌কো ওয়াস্তে কুচ্ খরচ কর্‌নে তৈয়ার হুয়া। তোম্ দোস্ত আদ্‌মি, বাবু সাব্‌কা ভাতিজা, রাত্‌মে বহুত তক্‌লিফ হুয়া, জেরা স্ফুৰ্ত্তিকা ওয়াস্তে চল, তোম্‌কো কুচপরওয়া নেহি; মেরা সাথ যব্‌তক রহেগা, কোইকো এয়সা তাকত নেহি যো তোমরা আগে খাড়া হোয়, তোম্ বেপরোয়ায় মেরা সাথ চলিয়ে।”

ফকির সাহেবের এই সকল অভয় বাক্যে আমি অনেকটা আস্বস্ত হ’লাম বটে, কিন্তু অন্তরের সেই সন্দেহ টুকুন্ কিছুতেই নিরাকৃত হ’লো না; তবে তখন আর কোন উপায় নাই, নিজে ইচ্ছা ক’রে সম্পূর্ণরূপে এই পাপিষ্ঠের কবলে পতিত হ’য়েছি, এখন ইহার সঙ্গ ত্যাগ ক’রে একাকী এ স্থান হ’তে নির্বিঘ্নে সে বাটী ফিরে যাব, তাহা কিছুতেই সম্ভবপর নহে। কাজেই ফকির সাহেবের কথায় আর কোন প্রতিবাদ করলাম না, কলের পুতুলের ন্যায় পুনরায় তাহার কাঁধ ধরিয়া সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকার-রাশির মধ্য দিয়া ক্রমে ক্রমে অগ্রসর হ’তে লাগলাম; মনে করলেম যখন না বুঝে ডুব দিয়াছি, তখন পাতাল অবধি দেখি, তারপর ভাগ্যে যা আছে কেহই তার বিন্দুমাত্র অন্যথা কর্ত্তে পারবে না।

অন্ধের ন্যায় সাইজির কাঁধে হাত দিয়ে যেতে লাগলাম, কিছুই দৃষ্টিগোচর হ’লো না। কোথায় যে যাচ্ছি, তাহাও বুঝতে পারলাম না। এমন সময় ফকির সাহেবের গতিরোধ হ’ল; এবং তিনি দরজার একটা কড়া ধ’রে খুব জোরে বারকয়েক নাড়লেন। আমি মনে মনে বেশ বুঝতে পারলাম যে, আমরা নির্দ্দিষ্ট স্থানে এসেছি; কিন্তু এই সময় সহসা আমার সর্ব্ব শরীর যেন কণ্টকিত হ’য়ে উঠলো, বুক গুরগুর্ করতে লাগলো, একপ্রকার অব্যক্ত ত্রাসে অন্তরার্ণব উদ্বেলিত হ’য়ে উঠলো, কিন্তু আমি তাহা গ্রাহ্য করলাম না, অতি কষ্টে প্রাণের এই বিপ্লবকে প্রশমিত করলাম। এমন সময় বাতি হস্তে একটি স্ত্রীলোক আসিয়া, অগ্রে নাম জিজ্ঞাসা ক’রে দরজা খুলে দিল।

আমরা উভয়ে সেই বাড়ীটার মধ্যে প্রবেশ করলাম। ফকির সাহেবের সঙ্গে আমাকে দেখে বিস্ময়ের লক্ষণ সকল এই রমণীর মুখমণ্ডলে প্রকটিত হ্’লো, কিন্তু মুখে কোন কথা না ব’লে সেই বাতি হস্তে অগ্রে অগ্রে যাইতে লাগিল, আমরা তাহার পশ্চাদগামী হইলাম।

আমি বাতির আলোতে দেখিলাম যে, বাড়ীটার চারিদিক খুব উঁচু প্রাচীর দ্বারায় বেষ্টিত; তাহার মাঝখানে বেশ বাহারের একখানি কাঠের দোতলা বাড়ী শোভা পাচ্ছে এবং বাহির দিক দিয়ে খুব সরু একটি কাঠের সিঁড়ি রয়েছে। রমণী আলো হস্তে আগে আগে সেই সিঁড়ির উপর উঠলো, আমরাও তাহার পশ্চাদ্‌গামী হ’লাম; কাজেই নীচেকার ঘরগুলি দেখবার কোন অসুবিধা হ’লো না।

আমরা তিনজনে উপরে উঠিলাম এবং শ্রীমতীর নির্দ্দেশক্রমে একটা কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করিলাম।

আমরা যে কক্ষ মধ্যে প্রবিষ্ট হ’লাম, সেটী বেশ লম্বা চওড়া ও নিমখাসা রকমের সাজানো। মেজের প্রায় অর্দ্ধেকটা একটা ঢালা বিছানায় মোড়া এবং গুটিকয়েক খোকা তাকিয়া তার উপর মলিনবেশে শোভা পাচ্ছে। একটি ছোট পিক্‌দানি, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাটী সংযুক্ত পানের ডাবর, কলকেরূপ পাগড়ি মাথায় একটি গুড়্‌গুড়ি সেই বিছনার প্রতিবেশী স্বরূপ চিরকাল বসবাস ক’রে থাকে। এক ধারে একখানি ছোট টেপায়া র’য়েছে, একখানি খোলা আয়না, ছোট বড় গুটিকয়েক কাচের গেলাস, একটা কানাভাঙ্গা ফুলদানি, খানকয়েক সান্‌কি তার উপর সোয়ার হ’য়ে ব’সে আছে। ঘরের ঠিক মাঝখানে মান্ধাতার আমলের একটা গোলোক-লণ্ঠন ঝুল ও মাকড়সার জালে জড়িত হ’য়ে ঝুল্‌ছে। লণ্ঠনটীর অবস্থা দেখলে স্পষ্ট বোধ হয় যে, বহুদিন যাবৎ প্রাণপ্রিয়া বাতি-সুন্দরীর সহিত তাহার দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই, কাজেই ঢাকের বায়ার ন্যায়, কেবল ঘরের আসবাব স্বরূপ বিদ্যমান আছে।

আমরা সেই গৃহমধ্যে প্রবেশ করলেই সেই রমণী ফকির সাহেবের কাণে কাণে কি কথা বলিল। ফকির সাহেব কিছু উত্তর করিল না বটে, কিন্তু তাহার মুখমণ্ডলে ঘোর বিরক্তির লক্ষণ সকল প্রকাশ পাইল। ফকির সাহেব আমাকে খুব ব্যস্তভাবে কহিল, “তোম্ ভেইয়া হিঁয়া বৈঠ! তোম্‌রা কুচ্ ডর্ নেহি। এই বিবিজান্ হ্যায় তোম্‌রা খাতির করেগা, সব আয়েসকা চিজ উস্কো পাশ মিলেগা, হাম ঘণ্টা খানেক কি বিচমে আয়েগা, বহুত জরুরী কাম হ্যায়।”

ফকির সাহেব এই কথা ব’লে আর উত্তরের অপেক্ষা না ক’রে সাঁ ক’রে সেখান থেকে স’রে গেল। আমি তাহার এই ব্যবহারে নিতান্ত বিস্মিত হলাম, অন্তরে অনেকটা ত্রাসের সঞ্চার হ’লো; কিন্তু মুখে কোন কথা প্রকাশ না ক’রে, নূতন লাজুক জামাই বাবুর মতন আস্তে আস্তে সেই বিছানার এক ধারে ঘাড় হেঁট ক’রে ব’সে পড়লাম। সেই রমণী রত্ন আমার হাতখানেক অন্তরে বসিল এবং সেই সট্‌কার নলটা বারকয়েক টেনে, বেশ গোল ধোঁয়া বাহির ক’রে, আমার দিকে নলটা ফিরিয়ে একটু মুচ্‌কে হেসে চোখ দুটো এক পাল্টা ঘুরিয়ে কহিল, “বাবু সাব তামাকু সখ ফরমাইয়ে।”

আমি মুখে কোন উত্তর করিলাম না, কেবল মাথা নাড়িয়া আমার অসম্মতি জানাইলাম; কিন্তু তাহাতে ঐ রমণী নিরস্ত না হ’য়ে পুনরায় বত্রিশটা দত্ত বিকাশ পূৰ্ব্বক কহিল, “কেন হে, তাতে আর হরজ কি? কত গোচ্ছা গোচ্ছা পৈতা গলায় বামুনেরা মোর সট্‌কায় মুখ দিয়া জান ঠাণ্ডা করে। তোমার যদি পছন্ না হয়, একটা তোমাগারের নেড়েল মাঙ্গিয়ে দিচ্ছি।”

আমি উত্তর করিলাম, আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না, তামাক খাওয়া আমার আদৌ অভ্যাস নাই।”

রমণী অমনি সুর ফিরাইয়া কহিল, “বেশ ক’রেছো, বেফয়দা ঝুট্‌মুট্ তামাক পিনা আচ্ছা নেহি। তার চেয়ে সাজের বেলা একটান ক’রে গাঁজা টানলে মেজাজ ঠাণ্ডা থাকবে।”

আমি তার এই সকল অসার কথায় কোন উত্তর না দিয়া, ফকির সাহেব কোথায় অন্তর্দ্ধান হ’লেন জিজ্ঞাসা করলাম। রমণী আমার কথা শুনে কলের চোখ দুটো ঘুরিয়ে হাসি হাসি মুখে কহিল, “একটা জরুরী কামের জন্য তিনি গেছেন, এখুনি লট্‌বেন; তুমি মরদ মানুষ তোমার আবার ভয় কি, তুমি এ রকম বদ্‌রসিকের ঢিপি কেন?”

আমি কোন কথা না বলিয়া চুপ করিয়া রহিলাম এবং এক দৃষ্টে সেই রমণীরত্নকে দেখিতে লাগিলাম।

এই রমণী যে মুসলমানি, তাহা তাহার কথাবার্ত্তা শুনিয়া ও কাপড় চোপড় পরার কায়দা দেখিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম। বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসরের কাছাকাছি হবে, কিন্তু সাজগোজে ধরণ ধারণে, যৌবনটাকে অতি কষ্টে ঠেকে দিয়ে রেখেছে। রমণীর বর্ণ টুকুন বেশ ফরসা, মুখখানি বাটীর ন্যায় গোল, নাকটি ঈষৎ থাবড়া, কপালখানি বেঢপ্ উঁচু, চক্ষু দু’টী ছোট এবং কাজল পরা খোকার ন্যায় সুর্ম্মায় শোভিত, রমণী ঈষৎ ঘাড়ে গর্দ্দানে ও একটু বেঁটে, কাজেই মাটীর আহ্লাদি পুতুলের সঙ্গে তুলনা করলে কোন অসঙ্গত হয় না।

রমণী বসন্তি রঙে ছোপান একখানি থান্ ফেরতা দিয়া পরেছে; গায়ে একটি পাতলা কাপড়ের সলুকা ও তস্য উপর লাল রঙে ছোপান একখানি বুটীদার চাদর শোভা পাচ্ছে। চুল্‌টা বিনুনি ক’রে ঝুলিয়ে রেখেছে ও ডগায় জরির একটা ঝাপটা ঝুলছে। রমণীর শ্রীঅঙ্গে অলঙ্কারের তেমনি বিশেষ পরিপাট্য নাই। কেবল হাতে গাছ কয়েক গালার চুড়ি কাণে বীরবৌলির ন্যায় বড় বড় দু’টী মাকড়ী, নাকে একটি নাকছাবি ও দু’হাতের আঙ্গুলে পণখানেক ঝুটো পাথর বসান রূপার আংটী ছিল।

আমি পূর্ব্ববৎ চুপ ক’রে ব’সে আছি, এমন সময় সেই সুন্দরী একটু বিরক্তির স্বরে কহিল, “কি হে ঝুট্‌ট্‌ ব’সে রাত কাটাবে—কিছু খানাপিনা করবে না?”

আমি উত্তর করিলাম, “না আমার কিছুর আবশ্যক নাই, ফকির সাহেব এলে, তার সঙ্গে বাড়ী যাবার জন্য ব্যস্ত হ’য়েছি। ক্রমে রাত্রিও অধিক হইল।”

রমণী তাহার স্বভাবসিদ্ধ চাঞ্চল্যভাব কিঞ্চিৎ দমন করিয়া, ঈষৎ গম্ভীরভাবে কহিল, “তেনার আসিবার আর বেশি দেরি নাই। ততক্ষণ তুমি মোর একটা গান শোন।”

এবার আমি বলতে পারলাম না, কাজেই সেই রমণী একটা গান গাইতে আরম্ভ করিল।

রাগিণী খাম্বাজ—তাল কাওয়ালী।

নিজের প্রাণ আগে না দিলে, প্রেম কি সহজে মিলে।

কে কোথায় পেয়েছে মুক্তা, না ডুবে সিন্ধু জলে॥

দেওয়া লওয়া প্রেমের ধারা, না দিলে দেয় না ধরা,

প্রাণের মায়ায় কাতর যারা, জানে না প্রেম কারে বলে॥

বিবি সাহেবের গান থামলেই কোণের ঘর থেকে মাতালের সুরে কুক্কুর রাগিণীতে এক গান ধরিল।—

আম পাড়্‌গে যা মজা ক’রে,            কোন্ শালা বারণ করে,

শ্রীরামপুরে ছিরে দত্ত,                     সে বলে ঐ চোর ধর্‌তো,

বেটা দিনেতে মাল মারতো             দে ফটকে আটক করে॥

এক জনে এই গান্‌টা প্রথমে ধরিল, তারপর তিন জনে সপ্তমে সুর তুলে দোহারকি করতে লাগলো, কাজেই ডাকাত পড়ার ন্যায় শব্দ আরম্ভ হ’ল, সমস্ত বাড়ীতে তাদের বিকট চীৎকারে যেন গম্ গম্ করতে লাগলো।

বিবিসাহেব কড়া রকমের একটি ধমক দিয়ে কহিল, “তোমরা কি বাউরা হ’লে না কি? অমন ক’রে চেল্লাচ্ছ কেন? এই ভাল মানুষের ছাওয়াল কি মনে করবে? সরাপ পিয়ে ‘বেহুদ্দপনা কেন কর!”

বিবির ধমকে সকলে চুপ করিল, কেবল একটা মাতাল জড়িত স্বরে কহিল, “এই রাত দুপুরে লুট্‌বিবি, ভালমানুষের ছেলে কোথায় পেলে বাবা! যাই হোক্ জিনিসখানা দেখতে হ’লো।”

এই কথা শুনিয়া আমি চাইয়া উঠিলাম, যেন আমার চেনা চেনা বলিয়া বোধ হইতে লাগিল; কিন্তু আমাকে আর ভাবিতে হইল না, কারণ খোদ দেবীপ্রসাদ সুখমত্ত অবস্থার তুফানে বোঝাই নৌকার ন্যায় টলিতে টলিতে দরজার উপর আসিয়া দাঁড়াইল।

পথিক এক মনে চলিতে চলিতে হঠাৎ পথে একটা কেউটে সাপ দেখিলে যেমন চমকিত হইতে হয়, আমারও সেইখানে দেবীপ্রসাদকে দেখিয়া সেইরূপ হ’লো, কিন্তু সে মুখে কিছু না ব’লে আবার সুড়সুড় চ’লে গেল।

যদিও আমাদের কোন কথাবার্ত্তা হয় নাই, কিন্তু তথাপি ভাব দেখে চতুরা বিবি বুঝতে পারলো যে, আমি দেবীপ্রসাদের অপরিচত নহি; সেইজন্য দেবীপ্রসাদ অদৃশ্য হ’লে একটু ব্যগ্রভাবে কহিল, “দেখ বাবু, তোমায় খোদার কিরে, তুমি এনাদের কাছে ফকির সাহেবের নাম নিও না। এনারা তেনার দুষমন আছে, না হ’ক্ একটা বখরা খাড়া হবে।”

আমি কিছু উত্তর দিবার পূর্ব্বে দেবীপ্রসাদ পুনরায় সেই দরজার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল এবং আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকিতে লাগিল। আমি ব্যাপারখানা দেখিবার জন্য উঠিয়া দাঁড়াইলাম, শ্রীমতী বিবিসাহেব কোনরূপ বাধা দিলে না, কেবল একবার সকরুণ দৃষ্টিপাত ক’রে তার পূর্ব্বেকার অনুরোধটি আর একবার মনে ক’রে দিল।

আমি দেবীপ্রসাদের সঙ্গে সেই কোণের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম এবং দেখলাম আর তিনজন লোক মদে চুর হ’য়ে ব’সে আছে। ইহাদের মধ্যে এক জনকে দেখবামাত্র অপার বিস্ময়-হ্রদে নিমগ্ন হ’লেম। কারণ গত শনিবার রাত্রে যাহার সর্ব্বনাশ সাধনের জন্য দেবীপ্রসাদ আমাদের কর্ত্তার সহিত ষড়যন্ত্র ক’রেছিলেন, সৌভাগ্য বশতঃ যিনি রহিম মোল্লাকে খুন ক’রে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হ’য়েছিলেন, সেই বার্লো সাহেবের কুঠির দাওয়ান, হালে বড় মানুষ মাণিকলাল সরকারের পুত্ত্র মদে চুর হ’য়ে ব’সে আছে; আর দু-জনের মধ্যে একজন লাশ হ’য়ে প’ড়ে আছে ও অন্য জন কান্নি থেকো ঘুড়ির মতন ব’সে ব’সে ঝুক্‌ছে।

আমি সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেই মাতালগুলো, “হুররে হো, লেগে যারে গুরো”, ব’লে এক সঙ্গে বিকট স্বরে চীৎকার ক’রে উঠলো, আমি অবাক্ হ’য়ে মাতালদের এই আজব কাণ্ড কারখানা দেখিতে লাগিলাম।

সেই কক্ষে প্রবেশ করিয়া, বাবুদের অবস্থা দেখিয়া আমার অন্তর ঘৃণায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল, বাবুদের নিকট বসিতে পর্য্যন্ত ইচ্ছা হইল না। হায়! যে বস্তুর প্রভাবে এই বিবেকসম্পন্ন মনুষ্যের ঈদৃশ দুর্গতি হয়, মনুষ্য উচ্চাসন হ’তে ভ্রষ্ট হ’য়ে একেবারে পশুর অধম হ’য়ে পড়ে, উম্মাদের পূর্ব্ব লক্ষণ সকল প্রকাশ পায়, কাণ্ডজ্ঞান আদৌ থাকে না, শান্তি ও স্বাস্থ্যধনে চিরবঞ্চিত হ’তে হয়, দুঃখ দারিদ্রতা চিরসহচর হ’য়ে উঠে, সেই গরল পানে যাহাদের আগ্রহ, তাহাদের তুল্য হতভাগ্য আর কে আছে? এই ভবে দুল্লর্ভ মানব জন্ম ধারণ সেই অভাগ্যদের পক্ষে যথার্থ ব্যর্থ হ’য়ে থাকে। বোধ হয় সে অভাগ্যদের প্রতি ভগবানের কোপদৃষ্টি পড়ে, শ্রমার্জ্জিত অর্থ উপভোগ হবে না ব’লে তাদের প্রতি কঠোর অভিসম্পাত দেন, কাজেই সেই সব ভাগ্যহীন অভাগারা এই সুরা-রাক্ষসীর কবলে পতিত হ’য়ে দিন দিন উৎসন্নের পথে অগ্রসর হ’য়ে থাকে। সেই জন্য আৰ্য্যমনীষিগণ এই জঘন্য দ্রব্যকে নিতান্ত অপেয় ব’লে নিৰ্দেশ ক’রেছেন; কারণ যে অপকৰ্ম্ম সাধনে পিশাচ কুণ্ঠিত হয়, সয়তানের নীরস অন্তরে করুণার সঞ্চার হয়, সুরামত্ত ব্যক্তির দ্বারায় সেই ঘোর অকাৰ্য্য অনায়াসে সাধন হ’য়ে থাকে। অভক্ষ্য ভক্ষণ, অগম্যাগমন ব্যবহার প্রভৃতি ঘোর পৈশাচিক কাণ্ড সুরার সাহায্য ভিন্ন কিছুতেই সম্পন্ন হয় না। হায়! যে বিষ ব্যবহারের পরিণাম ফল ঈদৃশ বিষময়, সুদারুণ দারিদ্রানলে দগ্ধ হওয়া, শেষে তীব্র অনুতাপ ভিন্ন যার উপায়ান্তর নাই, সতীর মনোকষ্ট, মাতার মর্ম্ম জ্বালা, পুত্ত্রের চির বিষাদ, যাহার অবশ্যম্ভাবি ফল, আত্মার ঘোর অবনতি, বিবিধ ব্যাধির যন্ত্রণা ভোগ, চিত্তে চির অবসাদ, বুদ্ধির বিপর্য্যয় যাহার শেষ পরিণাম, বিষবৎ তাকে ত্যাগ করাই বুদ্ধিমান মাত্রেরই কর্ত্তব্য। কারণ নিবিড় মেঘে সুধাকরের সুধাসম কান্তি যেমন সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত হয়, তেমনি একমাত্র সুরার প্রসাদে নিতান্ত বুদ্ধিজীবীর বিদ্যা বুদ্ধি জ্ঞান ও প্রতিভা জন্মের মত অন্তমিত হয়ে থাকে; কাজেই ধনে মানে শ্রেষ্ঠ আদর্শ সৎপুরুষেরা একেবারে পশুর অধম ও পিশাচের হেয় হ’য়ে পড়ে এবং পরিণামে বৃক্ষতল সার করতে বাধ্য হ’য়ে থাকে, কমলার সুদৃষ্টি কখনই সেই সব অভাগাদের উপর নিপতিত হয় না।

সেই কক্ষ মধ্যে সুরার অপূর্ব্ব মহিমার স্পষ্ট নিদর্শন সকল বিদ্যমান আছে, বাবুরাও বেশ পেকে টুসটুসে হ’য়েছেন। লোক লজ্জা কাণ্ডজ্ঞান ও মনুষ্যত্ব মুখে কাপড় দিয়ে দশ হাত অন্তরে স’রে দাঁড়িয়েছে, কাজেই সেখানে বাবুরা যে অবিকল প্রেতের হাট বসিয়েছেন, তাহা বলাই বাহুল্য।

পূর্ব্বে বাবুরা ঢালা বিছানায় বসেছিলেন, কিন্তু এক্ষণে চাদরখানি গুড়িয়ে এক জায়গায় তাল হ’য়ে র’য়েছে। মজলিসের মাঝখানে গোটা দুই খালি বোতল আদুরে ছেলের মতন গড়াগড়ি দিচ্ছে, গেলাস বাবাজি কাত হ’য়ে ঢ’লে পড়েছে ও লুচি, কচুরি, পাঠার হাড়, খালি পানের দোনা এলোমেলো ভাবে ছড়ানো র’য়েছে। বাবুরা ব’সে ব’সে ঝড়ে ঝাক্‌নি নারিকেল গাছের ন্যায় দুলছে, মুখে বুজকুড়ি কাট্‌ছে ও দু’কস দিয়ে পানের পিচ্ গড়িয়ে ঠিক যেন রক্তদন্তি সেজেছে। প্রত্যেকের ঘাড়ে শয়তান এসে সোয়ার হ’য়েছে, কাজেই বাবুরা যে এক্ষণে এক প্রকার নূতন ধরণের জীব হ’য়ে প’ড়েছেন তাহা বলাই বাহুল্য।

ঘরটা একটু নিস্তব্ধ হ’লে মাতালদের সেই বিকট চীৎকার একটু থাম্‌লো, সেই যুবক ঢুলু ঢুলু নেত্রে একবার আমার দিকে চেয়ে জড়িতস্বরে কহিল, “আরে ব’সো হে ছোক্‌রা! এ সময় ভগবান তোমায় মিলিয়ে দিয়েছেন। তুমি যদি আমাদের পক্ষ হ’য়ে শালাকে ফাঁসিয়ে দাও, তাহ’লে তোমাকে ভাল ক’রে খুসী করবো, আখেরে আর ভাবতে হবে না।”

বাবুর কথা শেষ হ’লে শ্ৰীযুত দেবীপ্রসাদ ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমা শ্যাম নটবরের ন্যায় বেঁকেচুরে দাঁড়িয়ে, যুবকের দিকে আঙ্গুল ফিরিয়ে কহিল, “লোকটা কে জান বাবা! এ নেহাৎ কেউকেটা নয়, একটা দিক্‌পাল বল্লেও হয়; বাঙ্গালার ভিতর এঁর জোড়া লোক নাই, সিন্ধুকে টাকায় ছাতা ধর্‌ছে, দু’চার লক্ষ টাকা খপরে আসে না। আহা, সে দিন এমন খোমেজাজী একটা আমীর আদ্‌মীর উপর কিষণজি শালা গুণ্ডা লাগিয়েছিল। হুজুরের কাছে মুখ ফুটে চাইলে যে, দু’পাঁচ হাজার টাকা অম্‌নি দিতে পারে। শালা যেমন পাজি, হুজুরালি তেমনি জব্দ ক’রেছেন। বেটাতো হুজুরালির ক্ষমতা জানে না, অমন পঞ্চাশ জন গুণ্ডা হুজুরালি মনে করলে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারেন। বেটা যেমন কুকুর তার উপযুক্ত মুগুর হ’য়েছে, এখন শালাকে যোগাড় ক’রে ফাঁসি কাঠে ঝোলাতে পারলে, তবে আমার মনের দুঃখ যায়। তুমি বাবা আমাদের পাল্লায় থাক, তোমার কোন ভয় নাই; হুজুরালির হাতে পড়লে হাজার হাজার আদ্‌মির দুঃখ চিরদিনের মতন ঘুচে যেতে পারে। হুজুরের নজরে পড়লে চিরকাল রাজ-পুত্ত্রের মতন সুখে দিন কাটাবে, আর কখন কোন শালাকে পরোয়া ক’রে চলতে হবে না।

আমি দেবীপ্রসাদের খোসামোদের কায়দা দেখে, না হেসে থাকতে পারলাম না। তবে পাপিষ্ঠের দু’একটা কথার ভাবে বেশ বুঝতে পারলাম যে, সে দিনকার রাত্রের সেই পৈশাচিক কাণ্ডের সমস্ত দোষ আমাদের কর্ত্তার ঘাড়ে চাপাইয়া এই যুবকের কাছে সাধু সাজিয়াছে, কিন্তু আমার নিকট পাপিষ্ঠের বিদ্যা ছাপা নাই। আমি এই ব্যাপারের সকল কথা জানি, গত বুধবার কর্ত্তার সহিত ইহার গুপ্ত পরামর্শ স্বকর্ণে শুনিয়াছিলাম, এই বেটাই এই নির্ব্বোধ যুবককে প্রতারণাজালে আবদ্ধ ক’রে আমাদের বাটীতে এনেছিল, এই বেটাই ঠাকুর সাহেব ওরফে রাজাবাহাদুরকে কাত করবার যোগাড় ক’রেছিল। যদি কাজ হাসিল হ’ত, তাহ’লে মোহরের ভাগ নিত, কিন্তু যেই ঘটনা স্রোত অন্যদিক দিয়ে প্রবাহিত হ’লো, অমনি পাপাত্মা সমস্ত দোষ কর্ত্তার উপর চাপিয়ে নিজে একেবারে হয় হবু ন্যাকা সাজিল। কিন্তু এই যুবক কি ভয়ানক হস্তীমুর্খ ও হিতাহিত জ্ঞানশূন্য; এই সংসারে কে শত্রু, কে মিত্র তাহা বুঝিবার ক্ষমতা ইহার আদৌ নাই। ভাগাড়ে গরু পড়লে শকুনি গৃধিনী প্রভৃতি মাংসাশী পক্ষীরা যেমন মনের আনন্দে ভক্ষণ করে, তেমনি এইরূপ দরের একো-বোকা বড় মানুষের ছেলে সংসার-সাগরে ভেসে উঠলে, দেবীপ্রসাদের ন্যায় ধূর্ত্ত বদমাইসদের আর আনন্দের পরিসীমা থাকে না। নানারকমের ভোল ফেরানো বিবিধ ধরণের ভদ্র অভদ্র প্রভৃতি জোচ্চরেরা যে যার ন্যায্য অংশ গ্রহণ ক’রে থাকে। সালের সাম্‌লা মাথায়, এটর্ণি উকীল হ’তে আরম্ভ ক’রে শত শত তালি শোভিত, মধুর ফটর ফটর শব্দযুক্ত চটী জুতা পায়ে হ্যাণ্ডনোটের খুচরো দালাল পর্য্যন্ত বঞ্চিত হয় না, সকলেই দু’চার খাবল ভক্ষণ ক’রে থাকে; কিন্তু রাঘববোয়াল বিশেষ তেমন মহাজনের খপ্পরে একবার পড়লে, সমস্তটা একেবারে আড়ে গিলে ফেলে এবং অসীম পরিপাক শক্তির গুণে বেমালুম হজম হ’য়ে যায়, কাঁটাটি পর্য্যন্ত অবশিষ্ট থাকে না। কাজেই দু’চার দিন লীলা খেলা করে বাবু সাগু খোকা রোগীর মতন একেবারে কাবু হ’য়ে পড়ে, কেউ বা আত্মহত্যা ক’রে সুদারুণ যন্ত্রণা ও অনুতাপের কবল থেকে মুক্তি পায়।

পণ্ডিতদের মতে এই সংসার, জীবের পক্ষে পরীক্ষার প্রশস্তক্ষেত্র সত্য, কিন্তু সময়ে সময়ে এইখানেই মানবদের স্বর্গ নরক ভোগ হ’য়ে থাকে। পাপের শোচনীয় পরিণাম, সহিষ্ণুতার সুখময় ফল, হাতে হাতে পাওয়া যায়; সেই জন্য বঞ্চক নিৰ্ম্মম-হৃদয় সুদখোর ধর্ম্মজ্ঞান বর্জ্জিত পাপাত্মা ধনীদের সুদারুণ পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য তাহাদের গৃহে এই প্রকার একো বোকা হস্তীমুর্খ পুত্ত্ররত্ন জন্মগ্রহণ ক’রে থাকে। এই হুজুরেরা প্রার ষষ্ঠি পূজার দিন কয়েক পরেই সাবালক হ’য়ে উঠেন, এঁচড়ে পাকিয়া যান, চারা কলমে পুরু ইয়ার হন্ এবং বিবি ও মোসাহেবদের হাতের খেলানা হ’য়ে পড়েন। এই সব হুজুরেরা প্ৰায় বিদ্যায় মা ভগবতী, ধৰ্ম্মজ্ঞানে কালাপাহাড় ও বুদ্ধিতে হাবা-তাঁতির পিতামহ হন্; কেবল পূর্ব্বপুরুষের কষ্টোপার্জ্জিত টাকাগুলি শেষে কিরূপে ব্যয় হয়, সেই টুকুন জগতকে দেখিয়ে দিয়ে, হুজুরেরা বৃক্ষতল সার করেন। যার খুব কপাল জোর হয়, সেই সর্ব্বসত্তাপহারিণী মৃত্যুর অঙ্কে স্থান পেয়ে, অল্পেই পার্থিব যাতনার কবল হ’তে মুক্ত হ’য়ে থাকে।

এই যুবকের উপর আমার নিতান্ত অশ্রদ্ধা হ’লো। যুবক এই সহরের মধ্যে একজন ধনীর সন্তান সত্য, কিন্তু ইনি যে একজন ঘোর নির্ব্বোধ, নিতান্ত অন্তসার শূন্য, মূর্খ ও চপলপ্রকৃতি, তাহাতে আর আমার অনুমাত্র সন্দেহ রহিল না। ইনি যখন এত কাণ্ডে এখনো দেবীপ্রসাদকে চিনতে পারেন নাই, তাহার সকল কথা সত্য ব’লে বিশ্বাস ক’রেছেন, তখন ইহার তুল্য অপদার্থ নির্ব্বোধ আর কে আছে? ছেলেদের হাতে পীঠা থাকলে যেমন চতুর কাকে তা ছোঁ মেরে নেয়, তেমনি এদের হাতে বিষয় পড়লেই, দলে দলে রকমারি ধূর্ত্তলোক জুটে তিন দিনেই রসটুকুন চুষে খেয়ে ফেলে এবং ছোবড়া হ’লেই যে যার পথ দেখে। ফলকথা পাপকার্য্যে ঘৃণা একপ্রকার মানবের স্বভাবসিদ্ধ ধৰ্ম্ম; অপাত্রে দান বা ভয়ানক অপব্যয় কাহার অনুমোদনীয় নহে; সেইজন্য বাবুদের বাহনবিশেষ মোসাহেব, কি হৃদয়ের কল্‌জে বিবিসাব, কেহই বাবুদের উপর আন্তরিক তুষ্ট নহে। কেহই বিদ্যা বুদ্ধির প্রশংসা করে না, বরং আড়ালে দুশো নিন্দে করে এবং কবে উৎসন্নে যাবে, একেবারে পথের ভিখারী হ’য়ে পড়বে, তার দিন গুণতে থাকে। সামান্য স্বার্থের জন্য পাপাত্মা স্বার্থপরদের যে ক্ষণিক মিলন; যাকে বন্ধুত্ব ব’ল্লে বন্ধুত্ব কথাটার অপমান করা হয়, তাহা প্রায় পদ্মপত্রস্থিত জলের ন্যায় চঞ্চল ও জলের তিলকের মতন অসার হ’য়ে থাকে। উদ্যেশ্য সফল হ’লে কি পিপাসা মিট্‌লে, আর তার সঙ্গে কোন সম্পর্ক থাকে না; তখন আবরণহীন কর্পূরের ন্যায় সেই সাধের প্রণয়টুকু এক কথায় উধাও হয়ে যায়। ফলতঃ প্রতারণা যে প্রণয় স্থাপনের মূল মন্ত্র, কপটতা ও মিথ্যাকথা প্রধান সম্বল, তাহা পরিণামে কখন স্থায়ী হয় না বা সুফলরাশি প্রসব করে না।

সংসারে যারা ধর্ম্মজ্ঞান শূন্য, ঘোর স্বার্থপর ও দয়ামায়া বর্জ্জিত পাষণ্ড হয়, কেবলমাত্র তারাই স্ব স্ব গরজ হাসিল করবার জন্য পরস্পর পরস্পরের সহিত এইরূপ কপটতামূলক অসার প্রণয়পাশে আবদ্ধ হন, কাজেই সামান্য আবশ্যক হ’লে তাহা ছিন্ন করতে তাদের প্রাণে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না, কেন না হৃদয়-রাজ্যের সহিত তাহার কোন সম্পর্ক নাই; কেবল মুখের আলাপ মুখের কথামাত্রেই পর্য্যবসিত হ’য়ে থাকে। সেইজন্য আমাদের সর্ব্বত্র প্রাণের বন্ধু ডাইনের দোহার দেবীপ্রসাদ এক কথায় তাহার পরমশত্রু হ’য়ে উঠল, নিজের নিরাপদের জন্য তাহাকে ভীষণ নরহত্যার দায়ে ফেলতে কুণ্ঠিত হ’লো না। এই সংসারে কেবলমাত্র গরজ হাসিল করবার অভিপ্রায়ে শঠের সহিত শঠের মিত্রতা প্রায় এইরূপ অকিঞ্চিৎকর ও ক্ষণস্থায়ী হ’য়ে থাকে।

যুবকের অনুরোধে নিতান্ত অনিচ্ছাস্বত্বেও তার পাশে আমাকে বসতে হ’লো। যুবক সেইরূপ জড়িতস্বরে কহিল, “তুমি ভদ্রলোকের ছেলে হ’য়ে ঐ ডাকাত শালার বাড়ীতে কেন থাক? ওখানে থাকতে গেলে নিশ্চয় একদিন একটা ফ্যাসাদে প’ড়ে যাবে। খেলাতে জিতেছিলেম ব’লে শালা আমাকে খুন ক’রে সব কেড়ে নেবার যোগাড় ক’রেছিল; আমার কাছে লুকানো পিস্তল ছিল ব’লে পেরে উঠলো না, এক শালা গুণ্ডাকে মেরে ফেলে পালিয়ে এলুম। বোধ হয় আগে থেকে একটা পরামর্শ হ’য়েছিল, বক্সীজিও ভিতরকার কথা কিছু কিছু জানতো।”

বক্সীজি রক্ষাকালীর মতন আধ হাত জিব বার ক’রে মাতলামির ঢঙ্গে উত্তর করিল, “বলেন কি হুজুর! এ গোলাম তেমন নীচ লোক নয়; আজ যেন গরীব হ’য়ে প’ড়েছি, কিন্তু এক সময় এই হাতে লাখ দু-লাখ টাকা ইয়ারকিতে খরচ ক’রেছি। কিষণজি শালা যে এমন সৰ্ব্বনেশে লোক তা আগে জানতাম না, জানলে কখন কি সে জায়গায় হুজুরকে নিয়ে যাই। সে দিন তেমন তেমন হ’লে এ গোলাম চুপ ক’রে থাকতো না; লাঠি হাতে নিয়ে তৈয়ার ছিলাম, শেষে হুজুর নিজেই কায ফায়ার করলেন, কাজেই আর গোলামকে মাথা দিতে-হ’লো না।”

কাণ্ডজ্ঞানশূন্য নির্ব্বোধদের বোঝানো ধূর্ত্তদের পক্ষে অনায়াসসাধ্য। কাজেই শঠচূড়ামণি দেবীপ্রসাদের তোষামোদ-রসে সিঞ্চিত কৈফিয়তে এই মূর্খ যুবক যে প্রীত হবে, তাহার অন্তরের সন্দেহানল যে নিৰ্ব্বাণ হ’য়ে যাবে, তার আর বিচিত্র কি? যুবক তখন অনেকটা প্রসন্নভাবে কহিল, “আচ্ছা বক্সীজী! সেদিনকার সেই বুড়ো শালা সত্য সত্য কি কৃষ্ণনগরের রাজা?”

বক্সী খুব মোলাম ভাবে কহিল, “সত্য মিথ্যা রাতদিনের কর্ত্তা সেই ভগবানই জানেন। তবে ঐ ডাকাত শালাই আমাকে বলেছিল যে, কৃষ্ণনগরের রাজা এই সহরে এসেছেন, আমার এখানে লুকিয়ে বেড়াতে আসবেন। রাজার প্রেমারা খেলায় খুব সখ আছে; যদি রেস্তওয়ালা কোন লোককে আনতে পার, তাহ’লে রাজার কাছ থেকে দু’এক হাজার টাকা জিতে নেওয়া যেতে পারব। আমি শালার কথা সত্য জ্ঞান ক’রে হুজুরকে নিয়ে গিয়েছিলাম। এর ভিতর শালাদের যে কোন কুমতলব ছিল, তা আমিতো আমি, আমার বাবা পর্য্যন্ত জান্‌তো না। এখন হুজুরের মতন আমার মনেও সন্দেহ হ’চ্ছে, বোধ হয় ঐ শালা একজনকে জাল রাজা সাজিয়ে রেখেছিল; তবে লোকটাকে আগে কখন দেখি নাই, বোধ হয় এই সহরে থাকে না। ঐ শালা আমাদের ঠকাবার জন্য অন্য কোন জায়গা হ’তে এসেছে; ও বেটা ডাকাতের অসাধ্য কাজ এই জগতে কিছু নাই।”

আমি বক্সীর মুখে এই সকল মিথ্যা কথা শুনে হাসি আর রাখতে পারলাম না। তবে পাছে এরা দেখে ও কারণ জিজ্ঞাসা করে, সেইজন্য চাদর মুখে পুরে অতি কষ্টে সেই উচ্ছ্বলিত হাসির বেগ সম্বরণ করলাম। আমি আগাগোড়া সব কথা জানি, কর্ত্তার আদেশমত ঠাকুর সাহেবের আখড়ায় ঐ বেটার নিকট আমিই পত্র নিয়ে গিয়েছিলাম; ঐ বেটাই যোগাড় ক’রে জাল রাজা সাজায়; এক কথায় বলতে গেলে এই বেটাই ষড়যন্ত্রের মূল নায়ক, কিন্তু এখন এই মূর্খ যুবককে ভোলাবার জন্য কেমন হয়হবু ন্যাকা সাজলে, আমার সাক্ষাতে এরূপ অনর্গল মিথ্যা কথা বলতে কিছুমাত্র কুন্ঠিত হ’লো না। আমি বহুরূপী দেবীপ্রসাদের ঈদৃশ ঘোর কপটতা দেখে ও অনর্গল মিথ্যা কথা শুনে একেবারে অবাক হ’য়ে পড়লাম, কিন্তু এই ভয়ানক নির্ব্বোধ ও নিতান্ত অপদার্থ যুবকের জন্য বড়ই দুঃখিত হ’লাম। নিরীহ গো-বধের ন্যায় এরূপ কাণ্ডজ্ঞান শূন্য অন্ধবিশ্বাসী মূর্খ নির্ব্বোধদের সর্ব্বনাশ সাধন যাদের প্রধান উদ্দেশ্য, এই সংসার মধ্যে তারাই শ্রেষ্ঠ কসাই। দয়া মায়া প্রভৃতি মনুষ্যোচিত কোমল প্রবৃত্তি, তাদের পাষাণসম নীরস অন্তরে আদৌ স্থান পায় নাই। ফলফথা কাঁচা মাটীর পুতুল বালকের হাতে পড়লে যেমন অচিরকাল মধ্যে ভগ্ন হ’য়ে যায়, তেমনি এইরূপ ঘোর নির্ব্বোধ যুবকের হাতে বিষয় পড়লেই তিন দিনেই তাহা নিঃশেষ হ’য়ে যাবে; এরূপ অপব্যায়ী নরাধমের উপর কমলার রূপা স্থায়ী হওয়া একান্ত অসম্ভব।

পাপাত্মা দেবীপ্রসাদের উপর আমার বিজাতীয় ঘৃণার উদ্রেক হ’লো বটে, কিন্তু প্রকাশ্যে কোন কথা ব’ল্লাম না, কেবল নূতন-আগত লাজুক জামাইবাবুর মতন ঘাড় হেঁট ক’রে বসে রইলাম। আমার ঈদৃশ ব্যবহারে দেবীপ্রসাদ নিতান্ত পরিতৃপ্ত হ’লো, পূর্ব্বাপেক্ষা তার বিকট মুখমণ্ডল অনেকটা প্রসন্ন হ’লো। আমি তাহার এই ভাবান্তরের প্রকৃত কারণ অনেকটা আঁচে বুঝিতে পারিলাম। পাছে আমি তার কোন কথার প্রতিবাদ করি, বা বেফাস ক’রে দিই, বোধ হয় প্রথমে এই আশঙ্কা তার মনে প্রবল হ’য়েছিল, কিন্তু আমাকে নীরব দেখে তার ফাঁড়া কেটে গেল, কাজেই পাপিষ্ঠ আমার উপর যে অনেকটা প্রসন্ন হ’লো, তাহা বলা বাহুল্য।

আমাকে আরো সন্তুষ্ট করবার অভিপ্রায়ে পাপাত্মা আমাকে লক্ষ্য ক’রে যুবককে কহিল, “হুজুর! এই ছোক্‌রা নেহাৎ সৎ, প্রাণের মধ্যে কোন কোরকাপ নাই, এরে প্রাণ দিয়েও বিশ্বাস করা যায়; স্বভাব চরিত্র বড় ভাল, এক রকম চলনসই লেখা পড়া শিখেছে, কিষণজি শালার বাড়ীতে থাকলে কিছুই হবে না, কেবল দিন দিন নানা রকমের বদমাইসি শিখবে। সেইজন্য আপনাকে বিশেষ ক’রে অনুরোধ করছি যে, আপনি দয়া ক’রে ইহাকে আপনার বাটীতে স্থান দিন; এ বেচারার মা বাপ কেউ নাই, কিষণজি শালা দূর সম্পর্কের খুড়ো হতো। আহা! বেচারীকে দুটো ভাত দিয়ে রাতদিন চাকরের মতন খাটায়; সেইজন্য হুজুরকে ধরেছি, আপনি দয়া ক’রে এই ছোকরাটিকে মানুষ ক’রে দিন।”

যুবক যদিও তখন চুর মাতাল, কিন্তু তথাপি সাধ্যমত ঈষৎ গম্ভীরভাবে ও মুরুব্বিয়ানা ধরণে কহিল, “বেশতো, আমার কথামত থাক্‌লে নিশ্চয় আখেরে তোমার ভাল করবো, আমার বাবাকে ব’লে সাহেবের কুঠিতে একটা চাক্‌রী ক’রে দেবো। আপাততঃ তুমি আমাদের বাড়ীতে থাকবে, কোন বিষয়ে কোন কষ্ট হবে না। বাড়ীর ছেলের মতন পরম সুখে থাকবে, চাকর-বাকরেরা তোমার হুকুমে চলবে। তবে আমার বাপ বেটার স্বভাবটা বড় নীচ, একের নম্বরের কৃপণ, বেটার সামনে দিয়ে একটা সূচ চলে না, কিন্তু পেছনে কত হাতী গ’লে যায়; বেটা অনেক টাকা রোজগার ক’রেছে বটে, কিন্তু আমাদের মতন খাঁটী ভদ্রলোক হ’তে পারে নাই। বেটার প্রায় মরবার বয়স হয়েছে, কিন্তু এখনো বড় লোকের কায়দা, কি ভদ্রলোকের ধরণ-ধারণ শিখলে না। সেই ইতর বাপটার জন্য সময়ে সময়ে আমাকে অবধি জ্বালাতন ও ভদ্রলোকের কাছে লজ্জিত হ’তে হয়। ইয়ারদের কাছে বেটাকে বাড়ীর সরকার বলে পরিচয় দিয়ে, কোন রকমে নিজের মানটাকে ঠেকো দিয়ে রেখেছি। বেটা একবার ম’লেই দু’হাত দিয়ে টাকার ছিনিমিনি খেলবো এবং আমি হব একটা উঁচুদরের ভদ্রলোক, তেতো পল্‌তা গাছে মিষ্টি পটোল হ’য়ে জন্মেছি, তা এই সহরের ছোট বড় সকল বেটাকে জানাবো।”

যুবকের এই সারগর্ভ বক্তৃতা শেষ হ’লে, দেবীপ্রসাদ প্রাণ খুলে খুব বাহবা দিল ও অন্য মাতালটা আহ্লাদের বেগে অধীর হ’য়ে একটা তাকিয়া চাপড়াতে আরম্ভ করলো; এমন কি যে মাতালটা লাস হ’য়ে পড়েছিল সে বেটাও ঘুমের ঘোরে বার দুই গোঁ গোঁ করে উঠলো। কেবল আমি বাবুর এই অপূর্ব্ব পিতৃভক্তির পরিচয় পেয়ে নিতান্ত বিস্মিত হ’লাম এবং কলুষিত চিত্ত এই যুবক যে একটি আস্ত নরপ্রেত তাহার আর কোন সন্দেহ রইলো না। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, সেই কৃপণ পিতার অসীম পুণ্য এই পুত্ত্ররত্নে প্রকাশ পেয়েছে; ভবিষ্যতে এই পুত্ত্রের দ্বারায় তাহার সকল পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে।

বাহবা দেবার গোল থামলে দেবীপ্রসাদ কহিল, “এইতো বাবা মত ঠিকঠাক হ’য়ে গেল, আর তোমাকে ডাকাত শালার বাড়ী যেতে হবে না। হুজুরের আজীমগঞ্জের বাটীতে রাজপুত্ত্রের মতন থাকবে, দুদিনের মধ্যে কর্ত্তা একটা চাকরীতে লাগিয়ে দেবেন, তোমার চিরকালের মতন অন্ন সংস্থান হবে, এখন কেবল আমাদের একটা সন্ধান বলে দাও।”

আমি মনের ভাব প্রচ্ছন্ন ক’রে খুব বিনীতভাবে উত্তর করলাম, “কিসের সন্ধান বলবো স্পষ্ট ক’রে বলুন।”

দেবী। সেই নেড়ে বেটার লাস কোথায় গাপ করলে তাই ব’লে দাও। আমরা কোতোয়ালির দারোগা সাহেবকে হাত ক’রে সব ঠিকঠাক ক’রে রেখেছি, এখন লাসটা পেলেই শালাকে ফাঁসিয়ে দি, তুমি আমাদের এই উপকারটি কর, বাবু তোমাকে চিরদিনের মতন প্রতিপালন করবেন।

মিথ্যা কথা বলা নিরর্থক জ্ঞান ক’রে আমি অকপটে সমস্ত সত্য কথা বলিলাম। আমার কথা শেষ হ’লে দেবীপ্রসাদ কহিল, “তাহ’লে দাতা সাহেব শালা টাকার লোভে এই কাজ করেছে; তাই শালা ভয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করলে না। আচ্ছা বাবা, ওক্ত এলে সব বেটাকে দেখে নিব।”

দেবীপ্রসাদ হাত পা নেড়ে কিঞ্চিৎ বীররসের অভিনয় করলে বটে, কিন্তু আমার মুখে এই সংবাদ শুনে খোদ বাবুর রাজা দুর্যোধনের ন্যায় হরিষে বিষাদ উপস্থিত হ’লো। তিনি একটি ছোট গোচের দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে কহিলেন, “তাহ’লে এ মতলব তো এক রকম ফেঁসে গেল; লাস না পেলে কিছুই হবে না, কেবল অনর্থক কতকগুলো টাকা খরচ হ’য়ে গেল।”

দেবীপ্রসাদ নিজের বুকে গোটা দুই কুলো চাপড় মেরে কহিল, “কুচ পরওয়া নেহি বাবু! আমরা পেছপাও হবার ছেলে নই। শালা যখন হুজুরের গায়ে হাত লাগাবার যোগাড় ক’রেছিল তখন শালাকে সহজে ছাড়ছি না, যে কোন উপায়ে হোক্, শালাকে নিশ্চয় জব্দ করবো; দরকার হ’লে দোসরা লাস পর্য্যন্ত যোগাড় ক’রে ফেলবো। টাকাতে কি না হয়, টাকাতে বাঘের দুধ মেলে; টাকা ছড়ালে খোদ কাজী সাহেবকে পৰ্য্যন্ত গাঁথা যেতে পারবে। এ গোলাম না পারে, এমন কাজ এ জগতে নাই; আমি এমন মতলব বাতলে দিব যে, কিষণজি শালাকে আর উঠে ধানের পত্তি করতে হবে না।”

চতুর-চূড়ামণি ধূর্ত্তপ্রধান দেবীপ্রসাদের এই মোলায়েম বক্তৃতা এ ক্ষেত্রে বিশেষ কোন ফলপ্রদ হ’লো না ব’লে বোধ হ’লো। কারণ সেই যুবক আর কোন উত্তর না ক’রে উঠে দাঁড়াইল এবং আমাকে কহিল, “এসো হে ছোকরা! আমার সঙ্গে এসো, আজ আমাদের উকীলের বাসায় থাকবে; তারপর কাল তোমাকে বাড়ীতে সঙ্গে ক’রে লয়ে যাব।”

যুবক এই কথা ব’লে ডান হাতখানি আমার কাঁধে দিয়ে বাহিরে আসিল; অমনি সেই রমণী মূর্ত্তি সম্মুখে এসে খাড়া হ’লো। যুবক জামার জেব হ’তে দু’টি টাকা বাহির ক’রে তাহার হাতে দিল, সুন্দরী অমনি হাসি হাসি মুখে সেলাম করিল এবং বার দুই চোখ টিপিয়া আমাকে ইসারায় কি বলিল, কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ আমি তাহা ঠিক বুঝতে পারলাম না; কেবল আন্দাজে একবার ঘাড় নাড়িয়া তাহার ইসারার উত্তর দিলাম। আমি এই অবসরে একবার ঘরের ভিতর চেয়ে দেখলাম যে, ঘর শূন্য প’ড়ে আছে; ফকির সাহেব তখন ফেরেন নাই। সম্ভবতঃ ইহারা এ স্থান হ’তে প্রস্থান না করলে তিনি প্রবেশ করবেন না।

বিবি সাহেব প্রদত্ত একটা জ্বলন্ত বাতি হাতে ক’রে সেই তৃতীয় মাতালটা অগ্রগামী হ’লো, বাবু বক্সী ও আমি তাহার পেছনে পেছনে যেতে লাগলাম। কেবল একটা মাতাল গঙ্গাতীরের মড়ার মতন সেইখানে প’ড়ে রইলো, একদল মাছি তার মুখের উপর ব’সে লুকোচুরি খেলতে আরম্ভ করলে। বোধহয় লোকটা পেট ভ’রে স্ফূর্ত্তি করেছে, সেইজন্য উত্থানশক্তি রইলো না, কালে খাঁর কামানের মতন আড় হ’য়ে পড়ে রইলো। হায়! এই গরল পানের ঈদৃশ শোচনীয় পরিণাম প্ৰত্যক্ষ ক’রেও যারা সাবধান না হয়, এই সংসারে তাদের অপেক্ষা নির্ব্বোধ আর কে আছে?

আমরা চার জনে সেই আড্ডা বাড়ী হ’তে বেরুলাম, সেই রমণী সম্ভবতঃ যিনি এই বাটীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী সঙ্গে সঙ্গে আসিয়া সদর দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। আমরা সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকাররাশি ভেদ করিয়া গন্তব্য স্থান উদ্দেশে যাত্রা করিলাম।