» » প্রথম খণ্ড : নারী না পরী

বর্ণাকার

পাঁচকড়ি দে

মায়াবিনী

প্রথম খণ্ড : নারী না পরী


দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দেবেন্দ্রবিজয় বলিতে লাগিলেন, “আরবদেশের ফকিরের দ্রব্যগুণ প্রক্রিয়ায় আপনাদিগকে এমন নিম্পন্দন নিশ্চেতন করে যে, বড় বড় ডাক্তারের বিশেষ পরীক্ষায় জীবনের কোন চিহ্নই বাহির করিতে পারে না। তার পর সকলের সম্মুখে সেই ফকিরকে সমাধিস্থ করা হয়। ফকির ইতিপূৰ্ব্বে এমন একজন চেলা ঠিক ক’রে রাখে যে, ফকিরের স্থিরীকৃত দিবসাবধি—সম্ভবতঃ একমাস সেই কবরের উপর সতত দৃষ্টি রাগে। তার পর নির্দিষ্ট দিনে ফকিরের পুনরুত্থান হয়। পরক্ষণেই সেই ফকিরের মৃতকল্প দেহে চৈতন্তচিহ্ন প্রকাশ পায়; তার পর সে ওঠে, বসে, কথা কহে, স্বচ্ছন্দচিত্তে এদিকে ওদিকে বেড়াইতে পারে; মোট কথা—সে পূৰ্ব্বে যেমন ছিল, ঠিক তেমনই হইয় উঠে।”

রা। [ সহাস্তে ] যাদের সমক্ষে এ কাও হয়, তারা গাধা।

দে। আমাকেও কি ‘গাধা’ ব’লে তোমার বিবেচনা হয়?

রা। না।

দে। না কেন? আমিই স্বচক্ষে এমন কাগু অনেক দেখেছি; আমি এ ঘটনা অন্তরের সহিত বিশ্বাস করি; এ ঘটনা অসম্ভব নয়।

রা। বেশ, এখন ব্যাপার কি বল? তোমার সুদীর্ঘ গৌরচন্দ্রিক যে আর ফুরায় না!

দে। ডাক্তার ফুলসাহেব অনেক দিন আরবদেশে ছিল; তার পর কামরূপ ঘুরে আসে। সে নানা প্রকার দ্রব্যগুণ ও মন্ত্রাদি জানত— তার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল।

রা। তা’ সে সকলকে প্রচুর পরিমাণে দেখিয়ে মরেছে।

দে। জুমেলিয়া তারই ছাত্রী—শুধু ছাত্রী নয়, স্ত্রী।

রা। হ্যাঁ জানি, জুমেলিয়া বড় সহজ মেয়ে ছিল না।

দে। শিক্ষকের চেয়ে ছাত্রীর শিক্ষা আরও বেশি।

রা। হ’তে পারে, কি হয়েছে তা’?

দে। জুমেলিয়া—সেই নারী-পিশাচী এখনও মরে নি।

রা। [ সবিস্ময়ে ] বল কি হে!

দে। আমি সেই কথাই তোমাকে বলতে এসেছি। যদি সে বেঁচে থাকে, অবশ্যই তুমি শীঘ্রই তা জানতে পারবে। সে বড় সহজ স্ত্রীলোক নয়, নিজের হাতে সে অসংখ্য নরহত্যা করেছে। সে এখন জীবিত কি মৃত, তুমি তার কবর খুঁড়ে দেখলেই জানতে পারবে।

রা। কতদিন তাকে গোর দেওয়া হয়েছে?

দে। আজ বৈকালে ঠিক উনচল্লিশ দিন পূর্ণ হবে।

রা। না না; যে মৃতদেহ এতদিন গোরের ভিতর রয়েছে—তা’ আবার টেনে বের করা যুক্তিসিদ্ধ ব’লে বিবেচনা করি না।

দে। মৃতদেহ! মৃতদেহ পাবে কোথায় তুমি? দেখবে কবর শূন্য প’ড়ে আছে।

রা। এ খেয়াল বোধ হয়, তোমার সম্প্রতি হ’য়ে থাকবে।

দে। হ্যাঁ, সম্প্রতি।

রা। দেবেন্দ্র বাবু, ব্যাপারটা কি হয়েছে বল দেখি?

দে ৷ শ্ৰীশচন্দ্র নামে একটি চতুর ছোকরা আমার কাছে শিক্ষানবীশ আছে। “১৭—ক” পুলিন্দার কেসে সে আমার অনেক সহায়তা করেছে। যে গোরস্থানে” জুমেলিয়াকে গোর দেওয়া হয়েছে, সেই গোরস্থানে কাল শ্ৰীশচন্দ্র বেড়াতে যায়। ফিরে আসার সময়ে জুমেলিয়ার কবর দেখতে যায়। জুমেলিয়া তাকে যেরূপ বিপদে ফেলেছিল, তাতে সে জুমেলিয়াকে কখনও ভুলতে পারবে বলে বোধ হয় না। শ্ৰীশচন্দ্রের যদিও বয়স বেশি নয়, বেশ চতুর বটে—আর দৃষ্টিটাও যে বেশ তীক্ষ্ণ আছে, এ কথা স্বীকার করা যায়। জুমেলিয়ার কবরটার উপরকার মার্টিগুলো আলগা আলগা দেখে তার মনে কেমন একটা সন্দেহ হয়; তার পর সে এক টুক্‌রা কাগজ সেইখানে কুড়িয়ে পায়; তাতে তার সেই সন্দেহ বদ্ধমূল হয়। সেই কাগজ টুক্‌রায় জুমেলিয়ার, নাম লেখা ছিল। তার পর সে অপর টুকরাগুলির সন্ধান করতে লাগল; সেইরূপ ছোট ছোট টুক্‌রা কাগজ চারিদিকে অনেক ছড়ান রয়েছে দেখতে পেলে। সেদিন সে কেবল সেই কাগজ টুকরাগুলি বেছে বেছে সংগ্ৰহ ক’রে বাড়ী ফিরে আসে। সে আমাকেও সকল কথা তখন কিছুই বলে নাই, নিজেই সে সেই ছোট ছোট কাগজগুলি ঠিক ক’রে সাজিয়ে আর একখানা কাগজে গদ দিয়ে জুড়ে রাখে।

রা। শ্ৰীশচন্দ্র টুক্‌রা কাগজগুলো ঠিক সাজাতে পেরেছিল?

দে। পেরেছিল।

রা। কেমন লোকের ছাত্ৰ! ভাল, তার পর?

দে। কাল রাত্রে আমার হাতে সে সেই পত্ৰখানা এনে দেয়, তেমন আশ্চৰ্য্য পত্র আমি কখনও দেখি নাই।

রা। কিরূপ আশ্চৰ্য্য শুনতে পাই না কি?

দে। আমার কাছেই আছে, শ্ৰীশ সেই ছিন্নপত্ৰখানা বেশ পাঠোপযোগী ক’রেই আমার হাতে দিয়েছে। আগেকার টুকরাগুলি পাওয়ার যায় নাই; মধ্যেরও দু-এক টুকরা পাওয়া যায় নাই। শ্ৰীশ নিজে সেই-সেইখানে কথার ভাবে আন্দাজ ক’রে ঠিক কথাগুলিই বসিয়েছে; প’ড়ে দেখ। [পত্র প্রদান]