☼ অদ্বৈত মল্লবর্মণ ☼
তিতাস একটি নদীর নাম
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সুবলার বউর মতিগতি খারাপ হইয়া যাইতেছে। একদিন তার মা ইহা আবিষ্কার করিল। পশ্চিম পাড়াতে থাকে, বাঁশের ধনু মাটির গুলি লইয়া পাখি মারিয়া বেড়ায়, মাথায় বাবরি চুল, নাম তার ময়না। আঁস্তাকুড়ের পাশের ছিটুকি গাছের জঙ্গল। ময়না সেখানে একটা পাখিকে তাক করিয়াছিল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়াতে গুন গুন করিয়া গান ধরিয়াছিল, ‘টিয়া পাললাম, শালিখ পাললাম, আরও পাললাম ময়না রে। সোনামুখী দোয়েল পাললাম, আমার কথা কয় না রে।’ সুবলার বউ আঁস্তাকুড়ে জঞ্জাল ফেলিতে গিয়া তার সঙ্গে হাসিয়া কথা কহিয়াছে। আর তার মা নিজের চোখে দেখিতে পাইয়াছে। দেখিয়া, রাগে গরগর করিতে করিতে, বুড়া বাড়ি আসিলে তাহাকে বলিয়া দিয়াছে।
দুইজনের ঝগড়া বকুনির পর সুবলার-বেয়েরও মুখ খুলিয়া গেল, ‘আমি ময়নার সাথে কথা কমু, তার সাথে পুরীর বাইর হইয়া যামু। তোমরা কি করতে পার আমার। খাইতে দিব না, খামু না, পরতে দিব না, পরুম না। কিন্তুক আমি বাইর হইয়া যামুই। তোমরার মুখে চুনকালি পড়ব, আমার কি। আমার তিন কুলে কারুর লাগি ভাবনা নাই। একলা গতর আমি লুটাইয়া দেমু, বিলাইয়া দেমু, নষ্ট কইরা দেমু, যা মনে লয় তাই করুম, তোমরা কথা কইতে পারব না। মনে কইরা দেখ কোন শিশুখালে বিয়া দিছল। মইরা গেছে। জানলাম না কিছু, বুঝলাম না কিছু। সেই অবুঝকালে ধর্মে কাঁচারাড়ি বানাইয়া থুইছে। সেই অবধি পোড়া কপাল লইয়া বনেবনে কাইন্দা ফিরি। তোমরা ত সুখে আছে। তোমরা কি বুঝ বা আমার দুঃখের গাঙ, কত গহীন। আমার বুঝি সাধ আহ্নাদ নাই। আমার বুঝি কিছুর দরকার লাগে না।’
‘হারামজাদী পোড়ামুখী কয় কি রে, বলিয়া দীননাথ আগুন হইয়া খড়ম আনিতে গেল। পরিবার তাহাকে মানাইয়া বলিল, ‘তুমি অখন বাইর হইয়া যাও। আমার মাইয়ারে আমি সমঝামু।’
মা সান্ত্বনার স্বরে মেয়েকে বলিল, ‘পোড়াকপালি, তুই কি দশজনের বৈঠকে তোর বাপেরে ভক্তি দেওয়াইতে চাস। তার মান ইজ্জত আছে না?’
‘আছে ত আছে। তাতে আমার কি এমন সাতবংশ উদ্ধাব পাইছে? ভাবছিলাম আমারই দুঃখের দুঃখী অনন্তর মার মত সার্থী পাইয়া, অনন্তর মত ছাইলা কোলে পাইয় সব জ্বালাযন্ত্রণা জুড়ামু। তোমরা আমারে তার কাছে যাইতে দিবা না। দিবা না যখন, আমি মানুষ ধরুম। দেখি তোমরা কদিন আমারে ঘরে বাইন্ধা রাখতে পার।’
‘অ-লো পোড়াকপালি, অখনই যা। অনন্তর মার কাছে তুই অখনই যা। তবু পুরুষ মানুষ থাইক্য মনটারে ফিরাইয়া রাখ।’
‘মা, তুমি ত জান, আজ দুই দিন অনন্তর মার পেটে দানাপানি নাই।’
‘লইয়া যা। দুই টুরি চাউল লইয়া যা। একটা ঝাগুর মাছ আছে, লইয়া যা। আর যা যা তোর মনে লয়, লইয়া যা। অ-লো, অখনই যা।’
‘মা! অনন্তর মার কাপড়খানা ছিড়া রোঁয়া রোঁয়া হইয়া গেছে। আমার ত তিনখান কাপড়। একখান দেই?’
‘তোর ঠাকুরের কাছে জিগাইয়া পরে কমু, তুই অখন যা। না না, শুন, তোর ঠাকুরেরে জানাইবার কাম নাই। অনন্তর মারে একটা কাপড় তুই দিয়া দে।’
সুবলার বউয়ের পুরুষমানুষের অভাব সেই মুহুর্তেই মিটিয়া গেল।
ভাদ্রমাসে মাছের পুরা জো। এ সময় কাটা সূতার দর বাড়িয়া গেল। মাছের গুঁতায় অনেক নূতন জাল ছিন্নভিন্ন হইয়া যায়। জেলেরা দামের দিকে চায় না। মোটা চিকন মাঝারি সবরকম সূতা। তার যে-কোন দামে কিনিয়া নেয়। অনন্তর মার সকল সূতা একদিনে বিক্রি হইয়া গেল। তার একদণ্ড কথা বলার অবসর নাই। টেকো তার ঘুরিয়াই চলিয়াছে। একদিন লক্ষ্য করিয়া দেখিল, টেকোতে পাক দিতে দিতে তার গৌরবর্ণ উরুতে কালো দাগ বসিয়া গিয়াছে। এত সূতা সে কাটিয়াছে। এত সব সূতায় তারই ঘরে জাল তৈয়ার হইতে পারিত। সে জালে সারারাত মাছ ধরার পর বিহানে তার ঘরে ঝাঁকাভরা মাছ আসিত! কোঁচড়ভরা টাকা পয়সা আসিত! আর-সব লোকের বাড়িতে কত সমারোহ। তাদের পুরুষেরা কিসিম বলিয়া দেয়, নারীরা সেই অনুযায়ী সূতা। কাটে। ভাল হইলে পুরুষেরা কত সুখ্যাতি করে। পাকাইতে গিয়া, ছিঁড়িয়া গেলে, মিষ্ট কথায় কত গালি দেয়। নারীরা মুখ ভার করিয়া বলে, যে-জন ভাল সূতা কাটে তারে নিয়া আসুক। কোন্দলের পরে ভাব হইয়া ঘরখানা মধুময় হইয় উঠে। সে-সকল ঘরে পাঁচ রকমের কাজ হয়। আর তার ঘরে হয় কেবল এক রকম কাজ। সূতা কাটা।
সুবলার বউকে পাইয়া অনন্তর মা মনের আবেগ ঢালিয়া দেয়, ‘তুমি না কইছিল ভইন আমার একজন পুরুষ চাই। হ, চাই-ইত। পুরুষ ছাড়া নারীর জীবনের কানাকড়ি দাম নাই।’
‘পুরুষ একটা ধর না।’
‘কই পাই।’
‘পাগলারে ধর।’
‘ধরতে গেছলাম। ধরা দিল না।’
‘ঠিসারা কইর না দিদি।’
‘আমি ভইন ঠিসারা করি না। সত্য কথাই কই। পাগল। যদি আমারে হাতে ধইরা টান দেয়, আমি গিয়া তার ঘরের ঘরনী হই। আর ভাল লাগে না।’
সুবলার বউ হতবুদ্ধি হইয়া যায়, ‘অত মানুষ থাকতে এই পাগলার দিকে নজর গেল তোমার? অত যদি মন উচাটন হইয়া থাকে, জল আনতে গিয়া যারে মনে ধরে চোখের ঠার দিয়ো!’
‘পুরুষ কি ভইন কেবল এর-ই লাগি? পরের ঘরে চাইয়া দেখ, সংসার চালায় পুরুষে। নারী হয় তার সঙ্গের সাখী। আমার যত বিড়ম্বনা।’
‘না দিদি, তুমি পাগলের লাগি পাগলিনী হইয়া গেছ। এই পাগলেই একদিন তোমারে খাইব। আচ্ছা, সত্য কইরা কও তো দিদি, পাগলে যারে হারাইছে, সে জনা কি তুমি?’
‘পাগলে কারে কই হারাইছে, তার আমি কি জানি। আমি কেবল জানি, এক্লাজীবন চলে না। পাগলেরে পাইলে তারে লখ্ কইরা জীবন কাটাই।’
সুবলার বউ দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া বলে, ‘আমারও দিদি সময় সময় মন অচল হইয়া পড়ে। কিন্তু আমি পতিজ্ঞা কইর রাখ্ছি, এই ভাবেই চালামু।’
তার সঙ্গে অনন্তর মার তফাৎ আছে। ভবানীপুরে যতদিন ছিল তখন তার বুক ভরিয়া ছিল একদিকে অনন্ত, আর একদিকে শিশুর মত সরল দুই বুড়া। তিলেকের জন্যও কোনদিন অনন্তর মার মন বিচলিত হয় নাই। মন তার বিচলিত আজকেও হয় নাই। নিজেকে শুধু সে শ্রান্ত ক্লান্ত বোধ করিতেছে। যে আলোক-স্তম্ভ লক্ষ্য করিয়া এতদিন সে পথ চলিয়াছিল আজ তার পাদদেশের অন্ধকারে দাঁড়াইয়া দেখে, তার আর এখন চলার শক্তি নাই। পাগল নিজে আসিয়া তার ভার নিক, নয় তো তাকে ঘরে ডাকিয়া নিয়া মারিয়া ফেলুক। সুবলার-বউর মধ্যে বিপ্লবী নারী বাস করে। কিন্তু অনন্তর মার মনে বাসা বাঁধিয়াছে এক সর্বনাশ৷ সাংসারিক কামনা। সে সংসারী হইতে চায়। সে আসিয়া তাহাকে লইয়া ঘর বাঁধুক। কিন্তু পাগল কি কোনদিন কারো মনের কথা বোঝে।
সুবলার বউ একদিন বলিয়াছিল, তিন বছর আগে দুইজন বিদেশী নারীপুরুষ আসিয়াছিল। খালের পারে তার বাপকে পাইয়া তারা জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, রামকেশবের ছেলে কিশোর কোন বাড়িতে থাকে। আমাদিগকে সেই বাড়িতে নিয়া চল। সেই বাড়িতে আসিয়া দেখে ঘরে এক যম-কালে বুড়া আর এক শুকনা বুড়ি, আর, এক পাগল বারান্দাতে বসিয়া প্রেতকীর্তন করিতেছে। যাকে দেখিতে আসিয়াছে, তাকে দেখে না। পাগলকে চিনিতে পারিয়া তার হাত দুটি ধরিয়া বলে, ‘অ কিশোর, আমার মাইয়ারে কষ্ট লুকাইয়া রাখছ বাবা, কও।’ পাগল তখন ঠিক ভাল মানুষের মত বলে, ‘নয়া গাঙ্গের মুখে তারে ডাকাইতে লইয়া গেছে।’ তারা আর তিলেক বিলম্ব করে নাই। তখনই স্টেশনে গিয়া গাড়ি ধরিয়াছিল।
তার বাপ মা যাহা জানিয়া গিয়াছে, তারপর আর কোনদিন তারা এদিকে আসিবে না।
এক বুড়া আছে। তাকে বাপ বলিয়া ডাক দিলে মেয়ের মত তুলিয়া নিবে। বলিবে আমার ঘরের লক্ষ্মী ঘরে আসিয়াছে। কিন্তু সব কথা শুনিয়া বলিবে ডাকাতে তোমাকে নষ্ট করিয়াছে। আমার ঘরে তোমার স্থান হইবে না। পাগল যদি কোনদিন ভাল হয়, সেও বলিবে, ডাকাতে তোমারে অসতী করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছে। তুমি যে সতী, তার কোন প্রমাণ নাই। তখন আমার অনন্তর যে কোন উপায়ই থাকবে না। অথচ ভগবান সাক্ষী, নৌকার ভিতর হইতে তুলিয়া নিবার সময় তারা একবার মাত্র ছু ইয়াছিল। তারপর তাকে বসাইয়া নৌকা চালাইবার সময় সে ঝুপ করিয়া জলে পড়িয়া গেল। জেলের মেয়ে। নদীর পারে বাপের বাড়ি। শিশুকাল হইতে সাতারের অভ্যাস। দম বন্ধ করিয়া এক ডুবে অনেক দূর যাইতে পারে। ডাকাতেরা তাকে আর পায় নাই। নদীর কিনারাতে গিয়া সে অচৈতন্য হইয়া পড়িয়াছিল। ভাগ্যে সে আর কারে হাতে না পড়িয়া গৌরাঙ্গ আর নিত্যানন্দ দুষ্ট বুড়ার হাতে পড়িয়াছিল। তারা দুই ভাই, ছোট নৌকায় বড় নদীতে মাছ কিনিতে যাইতেছিল। সকালবেলা তীরের দিকে চাহিয়া দেখে এই অবস্থা। জ্ঞান ফিরিয়া আসিলে তারা তাকে বলিয়াছিল, তুমি কি মা কোন বামুন কায়েতের মেয়ে। সে বলিয়াছিল না বাবা আমি জেলের মেয়ে। তারা বলিয়াছিল তোমার বাপের বাড়ী কোথায়, কি করিয়া পাঠাইব। সে বলিয়াছিল সেখানে আর পাঠাইবার কাজ নাই। তোমাদের সঙ্গে লইয়া চল। এই তার ইতিহাস।
সে কি সব থাকিতেও এই অপরিচয়ের মধ্যেই নিঃশেষ হইয়া যাইবে। কিন্তু অনন্ত! সে তার বাপকে চিনিল না, তার বাপও তাকে চিনিল না, এ যে বড় নিদারুণ। সুবলার বউ কেবল একটা দিক বুঝিয়াই নাড়াচাড়া করে। সেও বুঝিবে না অনন্তর মার কতদিক ভাবিয়া দেখিতে হয়।
একটা ধারণা কি জানি কেন তার মনে বদ্ধমূল হইয়াছে যে পাগল একদিন ভাল হইয়া যাইবে। রোজ রোজ অনন্তর মাকে দেখিতে দেখিতেই তার মাথা ঠিক হইয়া যাইবে। তাকে দেখিয়া মুগ্ধ হইবে, পরোক্ষে তার সেবা পাইয়া তার প্রতি দরদী হইয়া উঠিবে। অনন্তর মাকে ভাল করিয়া কোনদিন সে দেখে নাই। সে নিজে বলিয়া না দিলে ও কিছুতেই চিনিতে পারিবে না। যারা চিনিতে পারিত সেই তিলক, সুবল,— তারা এখন স্বর্গে। কি ভাল মানুষ তারা ছিল। কতভাবে তার সাহায্য করিয়াছে। ওর সঙ্গে তারা কত আত্মজনার মত কাজ করিয়াছে। তারা স্বর্গ হইতে আশীৰ্বাদ করুক, পাগল যেন তাকে না চিনিয়া ভালবাসিয়া ফেলে। সেই ভালবাসারই সূত্র ধরিয়া সে যেন পাগলের ঘরনী হইতে পারে একটা নতুন কাজ হইবে। লোকে নিন্দা করিবে। কিন্তু এ নিন্দ সহ করা অসাধ্য হইবে না। তা ছাড়া, দেশে দেশে একটা কথা উঠিয়াছে বিধবাদের বিবাহ দেও। পুরুষ যদি বউ মরিলে আবার বিবাহ করিতে পারে, নারী কেন স্বামী মরিলে আবার বিবাহ করিতে পারিবে না। তার স্বামী কি মরিয়াছে? হা, তার স্বামী স্মৃতির দিক দিয়া মনের দিক দিয়া এখন মরিয়া আছে। সেই দিন তার পুর্নজন্ম হইবে। সে নিজেও সব জানিয়া শুনিয়া জড়ভরত হইয়া আছে। তাও প্রায় মরিয়া থাকারই মত। সেদিন তার ও নবজন্ম হইবে। আর অনন্ত। তার কি হইবে। অনন্ত কার পরিচয়ে সংসারে মুখ দেখাইবে। সে সমস্যার ও সমাধান হইবে। তাকে একটা রূপকথা শুনাইব।—অর্থাৎ আসল কথাটাই, যা ঘটিয়াছে সেই সত্য কথাটাই তাকে শুনাইয়া রাখিব। সে তাতে আমোদই শুধু পাইবে না, মার সাহসের কথা, কষ্ট সহ করার ক্ষমতার কথা শুনিতে শুনিতে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া যাইবে। গৌরব বোধ করিবে মার জন্য। পাগলকেও তুনিয়ার অজানা এমন সব স্মৃতিকথা শুনাইব যে, সে তার মনের গভীরে বিশ্বাসকে ঠাঁই না দিয়া পরিবে না, এই তার সেই মালাবদলের বউ। সেবায় যত্নে মুগ্ধ করিয়া, হাসিতে খুশিতে তার মন পূর্ণ করিয়া, ওর জীবনে তার অপরিহার্যতাকে কায়েম করিয়া নিয়া, একদিন সে সত্যের মূর্ত ব্যঞ্জনার মধ্যে দিয়া জানাইবে ডাকাতেরা তার কেশাগ্রও স্পর্শ করে নাই। সেই রাত্রিতেই সে নদীতে পড়িয়া সব কিছু বাঁচাইয়াছে। তার পাগল নিশ্চয়ই ভাল হইয়া উঠিবে।
শীতের সময়ে পাগলের অবস্থা নিদারুণ খারাপ হইয়া গেল। বাঁধিয়া রাখা যায় না। ঘরের জিনিসপত্র তো আগেই ভাঙ্গিয়াছে। এখন পরের জিনিসপত্রও ভাঙ্গিতে শুরু করিয়াছে। পথের মানুষকে ডাকিয়া আনিয়া মারে। পাগলামির এ অবস্থা বড় ভয়ানক।
তার বাপ গলা ছাড়িয়া কাঁদে। সহিতে না পারিলে মারে। মারের দরুণ দেহে জখমের অন্ত নাই।
একদিন কোথা হইতে আর এক পাগল আসিয়া জুটিল। দুই পাগলে মিলিয়া তামাক খাইল এবং অনেক হাসির কাণ্ড করিল। সে-পাগল যাইবার সময় কিশোরের জখমগুলির উপর আরও জখম করিয়া গেল। সেই হইতে কিশোরের মাথায় এক দুবুদ্ধি চাপিয়াছে। সে নিজের গায়ে নিজে জখম করিয়া চলিল। তার গায়ে এত জখম হইল যে, তার দিকে আর তাকানোই যায় না। অনন্তর মা কুলের বাধা লাজের বাধা ঠেকাইয়া কাজে নামিল। সে নিজে ঘোরাঘুরি করিয়া এক কবিরাজের কাছ হইতে গাছগাছড়ার ওষুধ আনিল। সাবানে গরমজলে ঘা ধুইয়া সে ওষুধের প্রলেপ দিল। প্রথম প্রথম তাকেও খুব মারধর করিত। শেষে শ্রান্ত হইয়া আত্মসমর্পণ করিল। লোকে দেখিল এক সুন্দরী একটা পোষা জানোয়ারকে সেবা যত্নে আবেগে দরদে ভাল করিয়া তুলিতেছে। মুখে কেউ কিছু বলিল না। অনন্তর মার বড় দয়ার শরীর, এই সুমন্তব্য করিয়াই নীরব রহিল। একটা লোক মরিতে যাইতেছে, মানবতার খাতিরে এক নারী পর হইয়াও আপন জনের মত ভাল সেবা যত্নে বাঁচাইয়া তুলিতেছে, এতে দোষ নাই, ঈশ্বর সন্তুষ্ট হয়। এতে ধর্ম হয় পুণ্য হয়, আর, একজনার পুণ্যের জোরে সারা গায়ের কল্যাণ হয়—সুবলার বউ পরিচিত অপরিচিত সকল মহলে এই কথা জোর গলায় প্রচার করাতে কারও মুখ দিয়া কোন বিপরীত কথা বাহির হইল না।
শীতের শেষে পাগলের রূপ বদলাইয়া গেল। আশায় অনন্তর মার বুক ভরিয়া উঠিল। সুবলার বউ মুখে বিরক্তি প্রকাশ করিল, কয়েকটা ধারালো মন্তব্যে অনন্তর মাকে বিদ্ধ করিল। কিন্তু মন পড়িয়া রহিল কি এক দুজ্ঞেয় রহস্যকে হৃদয়ঙ্গম করার দিকে।
আবার বসন্ত আসিল।
অনন্তর মা একদিন তার মাকে বলিয়া দুই নারীতে ধরাধরি করিয়া তাকে ঘাটে লইয়া গেল। সাবান মাখাইয়া ঝাপাইয়া বুপাইয়া স্নান করাইল। প্রকাশু দিবালোকে। সারা গায়ের নারী-পুরুষে চাহিয়া চাহিয়া দেখিল। অনন্তর মা ক্ৰক্ষেপ করিল না। কেবল ভাবিল, সে তারই ছেলের বউ, বুড়ি যদি একথাটা একটিবার মাত্র বুঝিত।
একটা ভিন্-রমণীর সেবাযত্ন পাইয়া কিশোর যেন ক্রমেই আমোদিত হইয়া উঠিতেছে। অনন্তর মার বুক তুরু দুরু করিতে থাকে।
কিশোর তার সকল অত্যাচার সহানুভূতি দিয়াই সহ করিয়া ছিল, বাকিয়া বসিল নাপিত ডাকিয়া চুলদাড়ি সাফ করিবে শুনিয়া। পীড়াপীড়ি করিলে পাগলামি বাড়িয়া যায়। অনন্তর মা আর বেশি আগাইল না।
তারপর আসিল দোলের দিন। অনন্তর মার কাছে এটি একটি শুভযোগের দিন। এই দিনটি তার জীবনের পাতায় গভীর দাগ কাটিয়া লেখা হইয়া আছে।
মালোরা সেদিন সকাল সকাল জাল তুলিয়া বাড়ি আসিল, আসিয়া তারা হোলির আসরে বসিয়া গেল। ঢোলক বাজাইয়া গান ধরিল, বসন্ত তুই এলিরে, ওরে আমার লাল ত এলো না? এগানের পর আর একজন ঘাড় কাত করিয়া গালে হাত দিয়া ওস্তাদি ভঙ্গিতে যে গান গাহিল, তার ধুয়া হইতেছে, ‘তালে লালে লালে লালে লালে লালে ল’লে লাল? যেন তার আকাশ ভুবন একেবারে লাল হইয়া গিয়াছে। কিন্তু এটা বোল। আগে শুধু বোলটাই গাহিয়া, শেষে উহাকে কথা দিয়া পূরণ করিল, ব-স-ন-তে-রি জ্বালায় আমার প্রাণে ধৈ-র্য মানে না। মূল গায়েন আবার বোল চালাইল, তালে লালে লালে লালে ইত্যাদি।
অনন্তর মার কুটির খানাও লালে লাল। তার ঘরে অনেক আবির আসিয়াছে। সুবলার বউ বহু যত্ন করিয়া আবিরের থালা সাজাইয়া আনিয়াছে। অনন্তকে আজ একেবারে লালে লাল করিয়া দিবে। বেচারা না বলিবার অবসর পাইবে না। আবির দিতে গিয়া তার বুক কাঁপিয়া উঠিল। ছেলেটা যেন অনেক খানি বড় হইয়াছে। গালেমুখে আবির মাখাইতে চোখ দুটির দিকে দৃষ্টি পড়িল। সে চোখ যেন আরেক রকম হইয়া গিয়াছে। সহজ ভাবে যেন চাওয়া যায় না। সুবলার বউ দুরন্ত। সে দমিতে জানে না। সব কিছু অগ্রাহ করিয়া চলিতে ভালবাসে। এবারও সে তাকে বুকে চাপিয়া চুমু খাইল। কিন্তু এবার সে আর তাকে ছোট গোপালটির মত সহজ ভাবে নিতে পারিল না। এবার যেন আব এক রকমের অনুভূতি আসিয়া তার মনের যত সরলতা কাড়িয়া নিতেছে। তার চোখ বুজিয়া হাত দুটি আলগা হইয়া আসিল। কিন্তু অনন্তর হাত দুটি একখানি ফুলের মালার মত তখনও মাসির গলা জড়াইয়া রাখিয়াছে।
অনন্তর মা ভাবিতেছে আরেক কথা। তাদের প্রথম প্রেমাভিষেকের দিনটিকে সে কি ভাবে সার্থক করিয়া তুলিবে। সে পাগলকে এমন রাঙানো রাঙাইবে যে, তাতে করিয়া তার সে দিনের সেই স্মৃতি মনে জাগিয়া উঠিবে, তার পাগলামি সে নিঃশেষে ভুলিয়া গিয়া পরিপূর্ণ প্রেমের দৃষ্টিতে তার প্রেয়সীর দিকে নয়নপাত করিবে। সে বড় সুখের বিষয় হইবে। তখনকার অত আনন্দ অনন্তর মা সহিতে পারিবে ত? সেদিনের মত আজও তার পা কাঁপিয়া বুক তুরু হুরু করিয়া উঠিবেন ত?
সুবলার বউ আর অনন্তর দৃষ্টি এড়াইয়া এক সময়ে অনন্তর মা পথে নামিল। ওদিকে দোলের উৎসব বাড়িতে হোলির গান তখন তালে-বেতালে বেসামাল হইয়া চলিয়াছে।
কিশোর রঙ পাইয়া প্রথম প্রথম খুব পুলকিত হইয়া উঠিল। অনন্তর মার চোখে তাকে আজ কত সুন্দর দেখাইতেছে। আজ যদি সেই দিনটি তার মাধুর্য লইয়া, ঠিক ঠিক প্রতিরূপ লইয়া, ফিরিয়া আসে। অনন্তর মা অনেক কিসসা-কাহিনী শুনিয়াছে প্রিয়জনের শোকে মানুষ পাগল হইয়া যায়, প্রিয়জনকে পাইলে আবার তার পাগলামি দূৰ হয়। এও শুনিয়াছে, প্রিয়দিনগুলির স্মৃতি জাগাইতে পারিলেও পাগলামি দূর হইয়া যায়। পাগলামি ত আর দেহের অসুখ নয় যে ডাক্তার কবিরাজের ওষুধ লাগিবে। ওটা আসলে অসুখই নয়, মনের একটা অবস্থা মাত্র। এই অবস্থার গতিবেগ ফিরাইয়া দিতে পারিলে পাগল আর পাগল থাকে না। অনন্তর মা আরও ভাবিয়া বাহির করিয়াছিল। পাগল যদি ভাল হইবার হয় তো এভাবেই ভাল হইবে। শুধু তার নিজেব পাগল নয়। দুনিয়ার সব পাগল যেন এভাবেই ভাল হইয়া যায়। এ ছাড়া পাগল ভাল করার আর কোন পথ নাই। যদি থাকিত, সকল পাগলই ভাল হইত। কিন্তু ভাল হয় না!
সেও কেন আমাকে দুই মুঠ আবির মাখাইয়া দিতেছে না। সে কি পাষাণ। সে কি বোঝে না তার মন কি চায়। হঁ বুঝিতে পারিতেছে ত। সেও ত একমুঠা আবির অনন্তর মার কপালে আর গালে মাখাইয়া দিল। কেউ ধারে কাছে নাই। বুড়ি ঝাঁপের ওপাশে ঝিমাইতেছে। বুড়া তার শ্বশুর গিয়াছে হোলি গাহিতে। এখানে কেউ নাই। এই বেড়া দেওয়া বারান্দা। তারা দুজনে এখানে একা। অনন্তর মা শক্তি সঞ্চয় করিয়া আপনাকে অটল করিয়া তুলিল।
কিন্তু শেষ দিকে কিশোর একেবারে পরিবর্তিত হইয়া গেল। তার পাগলামি আবার মাথা চাড়া দিয়া উঠিল। সে এক সাংঘাতিক কাণ্ড করিয়া বসিল।
সে ক্ষিপ্রগতিতে হাত বাড়াইয়া তার প্রেয়সীকে পাজাকোলা করিয়া তুলিল। তুলিয়া ঝড়ের বেগে উঠানে নামিয়া চীৎকার জুড়িল, লাঠি বাইর কর, ওরে লাঠি বাইর কর। সতীর গায়ে হাত দিছে, আইজ আর নিস্তার নাই। মার, কাট, খুন কর। একজন ও পলাইতে না পারে। কই, আমার লাঠি কই। দম নিয়া আবার গলা ফাটাইয়া বলিল, ‘তেল আনি, জল আন, তোমার মাইয়া মূর্ছা গেছে।’
হোলির আসর ভাঙ্গিয়া লোকজন তখন ছুটিয়া আসিয়া পড়িয়াছে। কিশোর একবার লোকজনের দিকে আর একবার মেয়েটার দিকে চাহিতে লাগিল। তার চোখ দুটি আরও বড়, তার ও লাল হইয়াছে। মেয়েটার খোপ খুলিয়া গিয়া, সাপের মত লম্বা চুল মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়াছে। বুকটা চিতাইয়া উঁচু হইয়া উঠিয়াছে। এত উঁচু যে, কিশোরের নাকের নিশ্বাসে তার আবরণটুকুও সরিয়া যাইতেছে। সে মূর্ছা গিয়াছে। তার বুকের কাপড় শীঘ্রই সরিয়া গেল। কিশোর পুরাপুরি পাগল হইয়া সে বুকে মুখ ঘষিতে লাগিল। দাড়ি গোফের জবর জঙ্গিমায় বুঝিবা সেই নরম তুলতুলে বুকখানা উপড়াইয়া যায়।
‘কি দেখতাছ রামকান্ত, কি দেখতাছ গঙ্গাচরণ, ধর ধর। পাগলের পাগলামি ছাড়াও?’
হোলির উদ্দীপনায় লোকগুলি আগে থেকেই উত্তেজিত ছিল। এবার সকলে মিলিয়া কিশোরকে আক্রমণ করিল। লাথি, চড়, কিল, ঘুষি, ধাক্কা এসব তো চলিলোই, আরো অনেক কিছু চলিল। যেমন, কয়েকজনে লাঠি আনিয়া তার দেহের জোড়ায় জোড়ায় ঠকিয়া ঠুকিয়া মারিল। তারপর কয়েকজনে বাহুতে ধরিয়া উপরে তুলিয়া উঠানের শক্ত মাটি দেখিয়া আছাড় মাড়িল। কয়েকজনে আবার চুলদাড়ি ধরিয়া উপরে তুলিল, তুলিয়া গোটা শরীরটা চারি পাশে ঘুরাইল। শেষে একবার দাড়ির গোড়া ছিঁড়িয়া, কিশোরের স্পন্দবিহীন দেহ উঠানের এক কোণে ছিটকাইয়া পড়িলে, মেয়ে লোকের গায়ে হাত দেওয়ার উচিত শাস্তি হইয়াছে, বলিতে বলিতে লোকগুলি নিরস্ত হইল। তারা এবার মূৰ্ছিত মেয়েটাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়াছে।
আক্রান্ত হওয়ার পূর্বক্ষণে কিশোরের চমক ভাঙ্গিয়াছিল। কি করিতেছে বুঝিতে পারিয়া মেয়েটাকে আস্তে মাটিতে নামাইয়া দিয়াছিল। মেয়ের তখন মূর্ছার চরম অবস্থা। কতকগুলি স্ত্রীলোক তেলজল পাখা লইয়া তার সংজ্ঞা ফিরাই বার চেষ্টা করিতেছে। এমন সময় সে চোখ মেলিয়া দেখে বাড়িঘর লোকে লোকারণ্য। কয়েকজনে তাকে সোজা করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিলে সে আবার পড়িয়া যাইতেছিল। মুবলার বউ এতক্ষণ কোথায় ছিল কে জানে; উধ্বশ্বাসে ছুটিয়া আসিল, আসিয়া, নরনারীর মহারণ্য ভেদ করিয়া অনন্তর মাকে কোন রকমে কাঁধের উপর এলাইয়া তার ঘরে আনিয়া তুলিল।
লোকগুলি তখন দলে দলে চলিয়া গেল। কিশোর উঠানের এক কোণে পড়িয়া ছিল। তার সংজ্ঞা ফিরাইবার জন্য কেউ চেষ্টা করিল না। এক সময় আপনার থেকেই সংজ্ঞা ফিরিয়া আসিল। উঠিতে চেষ্টা করিল, পারিল না। এত দিন পরে এই প্রথম সে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলিল, ‘বাবা, আমারে একটু জল দে। জল খাইয়া বলিল, ‘বাবা, আমারে ঘরে নে; আমি উঠতে পারি না।’
কিশোর রাত্রিটা কোন রকমে বাঁচিয়া ছিল। পরের দিন ভোর হওয়ার আগেই মরিয়া গেল। তার মা-বুড়ি এতদিন বোবা হইয়া ছিল। চোখের জল বুকের কান্না জমাট বাঁধিয়া গিয়াছিল। এবার তাহা গলিয়া প্রবাহের বেগে ছুটিল। সে অনেক কথা বলিয়া বলিয়া বিলাপ করিল, যেমন, মরিবার আগে জল খাইতে চাহিয়াছিল, সে জল সে ত খাইয়া গেল না। মরিবার আগে কি কথা যেন কহিতে চাহিয়াছিল, সে কথা সে ত কহিয়া গেল না।
অনন্তর মা মরিল চারদিন পরে। সেইদিনই তার জর হইয়াছিল। আর হইয়াছিল কি রকম একটা জ্বালা, কেউ জানে না কি রকম।
সারারাত ছটফট করিয়া সে মরিল ভোর হওয়ার পরে। সুবলার বেয়ের কোলে মাথা রাখিয়া চুপ করিয়া ছিল। আলো ফুটিতেছে, তারই দিকে চোখ মেলিয়া ছিল। . যে আলো ফুটিতেছে অনন্তর ভোরের আকাশ রাঙাইয়া।
জন্ম মৃত্যু বিবাহ এ তিনেতেই মালোরা পয়সা খরচ করে। সে পয়সাতে কাঠ আসিল, বাঁশ আসিল, তেল ঘি আসিল, আর আসিল মাটির একটি কলসী। সমারোহ করিয়া নৌকায় তুলিয়া তারা অনন্তর মাকে পোড়াইতে লইয়া গেল।
চিতাতে আগুন দিতে দিতে একজন বলিল, ‘পাগলে মানুষ চিন্তাই ধরছিল। চাইর দিন আগে মরলে এক চিতাতেই দুজনারে তুইল্যা দিতাম। পরলোকে গিয়া মিল্য। যাইত।’
এক সময়ে তিনজনে মিলিয়া প্রবাসে গিয়াছিল। সেখান থেকে আরেকজনকে লইয়া তারা ফিরিয়া আসিতেছিল। এই চারিজন এইভাবে আগে পিছে মরিয়া গেল। তারা যে প্রবাসে গিয়া অত কিছু দেখিয়াছিল শুনিয়াছিল, অত আমোদ আহ্লাদ করিয়াছিল, অত বিপদে আপদে পড়িয়াছিল, সে ছিল একটা কাহিনীর মত বিচিত্র। এইকাহিনী যারা সৃষ্টি করিয়াছিল তারা এখন চলিয়া গিয়াছে। এ সংসারে আর তাদের দেখা যাইবে না।
…