এদিকে ফ্রান্সিসকে নিয়ে রহমান চলে আসার পর ফ্রান্সিসের বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করতে লাগল। পরামর্শমত সবাই যে যার জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। একটু পরেই হঠাৎ একজন উঠে পরিত্রাহি চীৎকার শুরু করল। যেন সেই চীৎকার শুনেই উঠে পড়েছে, এমনি ভঙ্গি করে বেশ কয়েকজন ওর দিকে ছুটে এল। লোকটা তখন পেটে হাত দিয়ে গোঙাতে লাগল, আর মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগল। একজন পাহারাদার ওদের চীৎকার চ্যাঁচামেচি শুনে কাঁটাতারের দরজা দিয়ে মুখ বাড়াল কি হয়েছে?
– দেখছ না, পেটের ব্যথায় কাতরাচ্ছে।
– ও কিছু হয়নি।
– বেশ, তুমি নিজেই দেখে যাও।
– হুঁ। পাহারাদারটা ঘুরে দাঁড়াল।
তখন সবাই মিলে ওকে চটাতে লাগল– ব্যাটা সবজান্তা, তালপাতার সেপাই।
পাহারাদারটা ভীষণ চটে গেল। হেঁকে উঠল– এ্যাই!
কে মুখ ভেংচে ওর হাঁকের নকল মুখে করে বলে উঠল– এ্যাই!
আর যায় কোথায়! পাহারাদারটা তালা খুলে ভেতরে ছুটে এল। কিন্তু খাপ থেকে তরোয়াল খোলবার আগেই পাঁচ-ছয়জন একসঙ্গে ওর ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বেচারা টু শব্দটিও করতে পারল না। মাটিতে ফেলে কয়েকজন চেপে ধরল। বাদবাকিরা পাহারাদারের কোমর বন্ধনীর কাপড়টা খুলে ফেলল তারপর ঐ কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে কোণায় ফেলে রাখল।
এবার খোলা দরজা দিয়ে একজন বেরিয়ে বাইরের অবস্থাটা দেখতে গেল। দেখল, ওদের যে আর একজন পাহারা দিচ্ছিল সে দেউড়ির কাছে অন্য পাহারাদারদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। প্রাসাদের সম্মুখে দুজন পাহারাদার শুধু টহল দিচ্ছে। দেউড়ি দিয়ে পালানো যাবে না। ওখানে পাহারাদার সৈন্যদের সংখ্যা বেশি। একমাত্র পথ প্রাচীর ডিঙিয়ে প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে যদি অন্য কোন দিক দিয়ে পালানো যায়। শেষ পর্যন্ত তাই স্থির হল। পা টিপে টিপে সবাই বেরিয়ে এল। অসুস্থ হ্যারিকেও ওরা ধরাধরি করে সঙ্গে নিয়ে চলল। আস্তে আস্তে নিঃশব্দে ওরা প্রাচীর টপকাল। প্রাচীরের ওপাশেই দেখা গেল, একটা ছোট্ট বাগান মত। ফোয়ারাও আছে তাতে। তারপরেই একটা দরজা। দরজাটা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। কয়েকটা ঘর পেরোতেই দেখা গেল লম্বামত একটা ঘর। টানা টেবিলের মত দেয়ালে কাঠের তক্তা লাগানো। কতরকম খাবার ঢাকা দেওয়া রয়েছে। কোর্মা, কোপ্তা, শিক কাবাবের গন্ধে ঘরটা ম-ম করছে। এতক্ষণে বোঝা গেল, ওরা রসুই ঘরে ঢুকে পড়েছে। পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল ওরা। তারপরেই পাগলের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল খাবারের ওপর। দুহাত ভরে যে যতটা পারল নিয়ে খেতে আরম্ভ করল। কামড়ে কামড়ে মাংস খেতে লাগল। এক সঙ্গে এত লোক, তার ওপর খাওয়ার আনন্দ। অল্প সল্প শব্দ হতে হতে একেবারে হইচই শুরু হয়ে গেল। ওরা বোধহয় ভুলেই গেল, যে ওদের পালাতে হবে। খাবারের ঘরের দরজা দিয়ে তরোয়াল হাতে সৈন্যদল ঢুকতে লাগল। সৈন্যরা ঘিরে ফেলে ওদের পিঠে তরোয়ালের খোঁচা দিয়ে হুকুম করল– চলো।
এতক্ষণে এরা সম্বিত ফিরে পেল। কিন্তু এখন আর কিছু করবার নেই। আবার সেই ফিরে আসতে হল কাটার তার ঘেরা বন্দীশালায়।
ফ্রান্সিস ফিরে এসে দেখল, প্রাসাদের সামনের চত্বরে সৈন্যরা খোলা তরোয়াল হাতে ছুটোছুটি করছে। কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়ই। একজন সৈন্য রহমানকে এসে কি যেন বলল। রহমান ফ্রান্সিসকে বলল– কাণ্ড শুনেছ?
– কি?
– তোমার বন্ধুরা পালিয়েছে।
ফ্রান্সিস হাসল, যাক, সমস্যার সমাধান ওরা নিজেরাই বুদ্ধি খাঁটিয়ে বের করেছে তাহলে। রহমান আড়চোখে ফ্রান্সিসকে হাসতে দেখে বলল– কিন্তু ফিরে আসতে হবে। এখান থেকে পালানো অত সহজ নয়।
ফ্রান্সিসকে কাঁটাতারের বন্দীশালায় ঢুকিয়ে দেওয়া হল। ফ্রান্সিস দেখল, পাহারাদারের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। পালাবার সব পথই বন্ধ। যাক সান্ত্বনা, বন্ধুরা তো পালাতে পেরেছে। হঠাৎ পাথরে বাঁধানো চত্বরে অনেক মানুষের পায়ের শব্দ শোনা গেল। ফ্রান্সিস চমকে উঠল– তবে কি ওরা ধরা পড়ল?
দরজার তালা খোলার শব্দ হল। দরজা খুলে গেল। দেখা গেল ফ্রান্সিসের বন্ধুরা ঢুকছে। তখনও কারও হাতে পাঁঠার ঠ্যাং, কোর্মার মাংসের টুকরো, শিক-বেঁধা শিক কাবাব। ফ্রান্সিস ছুটে গিয়ে অসুস্থ হ্যারিকে ধরল। তারপর ধরে এনে ওকে শুইয়ে দিল। কেউ কোন কথা বলল না। পরদিন যে তাকে ফাঁসি দেওয়া হবে, একথা ফ্রান্সিস কাউকে বলল না। শুধু, বাইরের সৈন্যদের টহল দেওয়ার শব্দ শোনা গেল– টক্-টক্।
* * *
তখন সকাল হয়েছে। দেউড়ির কাছে যেখানে ফাঁসিকাঠ তৈরী হয়েছে, সারা আমদাদ শহরের মানুষ সেখানে এসে ভেঙে পড়ল। দুর্গে তুরী বেজে উঠল। একটু পরেই ফাঁসিকাঠের পাশে ফ্রান্সিসের বন্ধুদের এনে দাঁড় করানো হল। ভীড়ের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। সবাই বন্দীদের দেখতে চায়। ফ্রান্সিসকে দাঁড় করানো হল ফাঁসিকাঠের মঞ্চের ওপর। একটা সাদা ঘোড়ায় চড়ে সুলতান এলেন। পেছনে রহমান। রমহানের পেছনে ও কে? এ কি! এ যে সেনাপতিমশাই।
এদিকে হয়েছে কি, ফ্রান্সিসরা যখন ভোরের দিকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন সেনাপতি একজন পাহারাদারকে ডেকে বলেছিল– আমি রহমানের সঙ্গে দেখা করতে চাই। পাহারাদারটি প্রথমে রাজী হয়নি। সেনাপতি তখন বলেছিল– রহমানকে শুধু বলবে ভাইকিং দেশের নৌবাহিনীর সেনাপতি দেখা করতে চায়। পাহারাদারটি কি ভেবে রাজি হল। একটু পরেই ফিরে এসে সেনাপতিকে নিয়ে গেল।
সবাই তখন অঘোর ঘুমে। শুধু অসুস্থ হ্যারি জেগেছিল। সে সবই দেখল। বুঝল– সেনাপতি নিজের জীবন বাঁচাবার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এতে যদি অন্যদের প্রাণও যায়, ও ফিরে তাকাবে না। হ্যারি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে শুয়ে রইল! কাউকে ডাকলও না। ভোর থেকেই সেনাপতিকেও ওরা দেখতে পায়নি। এবার মানে বোঝা গেল। সেনাপতি সুলতানের দলে ভিড়ে গিয়েছে।
সুলতান আসতেই দর্শকদের মধ্যে উল্লাসের বন্যা বইল। চীৎকার করে সবাই সুলতানের জয়ধ্বনি করল। সুলতান ঘোড়া থেকে নেমে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে এলেন। ফ্রান্সিসকে লক্ষ্য করে বললেন, ফ্রান্সিস, গলায় দড়ির ফাঁস পরাবার আগে এখনও সময় আছে; বলো– সেই মোহর দুটো কোথায়?
– আমি জানি না।
– জাহাজ নিয়ে এসেছ, সোনার ঘণ্টা নিয়ে যাবে বলে। এবার জাহান্নামে যাও, সেখানে সোনার ঘণ্টার বাজনা শুনতে পাবে।
ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না।
সুলতান চীৎকার করে বলতে লাগলেন– আমাদের দরিয়ায় এসে আমাদেরই চোখের সামনে দিয়ে সোনার ঘণ্টা নিয়ে যাবে, তোমাদের দুঃসাহস তো কম নয়? সুলতান এবার ফ্রান্সিসের বন্ধুদের দিকে তাকাল। বলল, আমি জাহাজ নিয়ে যাব, তোমাদের জাহাজও মেরামত করিয়ে দেব। তোমরা যদি জাহাজ চালানোর ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করো, তবে তোমাদের আমি মুক্তি দেব।
সবাই চুপ করে রইল। হঠাৎ হ্যারি চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল– আমরা যেতে রাজি, কিন্তু আমাদের ক্যাপটেন হবে কে?
সুলতান হাসলেন এবং বললেন– তোমাদেরই দেশের নৌবাহিনীর সেনাপতি।
— ওকে আমরা নেতা মানি না, আমরা ফ্রান্সিসকে চাই। হ্যারি বলল।
– হ্যাঁ-হ্যাঁ, আমরা ফ্রান্সিসকে চাই সবাই চীৎকার করে উঠল।
সুলতান মুশকিলে পড়লেন। এই ভাইকিংদের মত দক্ষ জাহাজ-চালকদের ছাড়া তার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু নিজের এই সমস্যার আভাসও তিনি প্রকাশ পেতে দিলেন না। চীৎকার করে বলে উঠলেন– তোমরা যদি না যাও, তাহলে তোমাদের সকলের ফ্রান্সিসের দশা হবে। তাকিয়ে দেখ, ওকে কি ভাবে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে।
সুলতান রহমানকে কি যেন বললেন। রহমানের ইঙ্গিতে কালো কাপড়ের আলখাল্লা পরা, কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা একজন লোক ফাঁসির মঞ্চে উঠে এল। সে এসে ঘাড়ধাক্কা দিতে দিতে ফ্রান্সিসকে দড়ির ফাঁসের কাছে নিয়ে এল। কালো কাপড়ের ফুটো দিয়ে লোকটার চোখ দুটো যেন জ্বলজ্বল করছে।
ফ্রান্সিস সম্মুখের সেই দর্শকদের ভিড়ের দিকে তাকাল। বন্ধুদের দিকে তাকাল। দেখল, হ্যারি চোখের জল মুছছে। আরও কেউ-কেউ অন্যদিকে তাকিয়ে আছে, পাছে চোখের জল দেখে ফ্রান্সিস দুর্বল হয়ে পড়ে। ফ্রান্সিস আকাশের দিকে তাকাল। ঝকঝকে নীল আকাশ। সাদা সাদা হালকা মেঘ উড়ে যাচ্ছে। পাখি উড়ছে। কি সুন্দর পৃথিবী। ফ্রান্সিসের চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল। মা’র কথা, বাবার কথা মনে পড়ল। ছোট ভাইটাও কি ওর মতই আধপাগলা হবে? বাড়ির গেটের সেই লতা গাছটা একদিন সমস্ত দেওয়ালটায় ছড়িয়ে পড়বে। অজস্র নীল ফুল ফুটিয়ে জায়গাটাকে সুন্দর করে তুলবে। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ, তারাভরা আকাশ, ঢেউয়ের মাথায় সূর্য ওঠা– এসব আর কোনদিন দেখবে না সে।
কিন্তু ফ্রান্সিসের চিন্তায় বাঁধা পড়ল। কালো কাপড়ের মুখ ঢাকা লোকটা ফাঁসের দড়ি টেনে-টেনে পরীক্ষা করতে করতে বিড়বিড় করে বলছে– ফাঁসটা আলগা, হাতের বাঁধনটা সময়মত কেটে নিও। পাটাতনের নীচে গর্তটা বুজিয়ে রেখেছি, নেমেই মাটি পাবে।
ফ্রান্সিসের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল– ফজল!
ফজল ধমকের সুরে বলল– তোমার মুখে যেমন খুশীর ভাব ফুটে উঠেছে, যেন ফাঁসি হবে না, বিয়ে হবে তোমার। হুঃ।
ফ্রান্সিস সাবধান হল। ফজল বলতে লাগল– নীচে পড়েই দড়িটা ধরে দু’চারবার জোরে হ্যাঁচকা টান দেবে। তারপর চুপচাপ বসে থাকবে। রাত হলে পেছনের পাটাতনটা খুলে বেরোবে। সামনেই একটা ঘোড়া পাবে।
ফজল থামল। তারপর দুহাত তুলে সুলতানের দিকে ইঙ্গিত করল– সব ঠিক আছে। এবার সুলতানের হুকুম। সব গোলমাল থেমে গেল।
ফ্রান্সিস হঠাৎ হাত তুলে এগিয়ে এল। সুলতান জিজ্ঞেস করল– কি ব্যাপার।
– মরবার আগে আমার বন্ধুর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
– কে সে?
– হ্যারি।
সুলতানের হুকুমে হ্যারিকে ধরে ধরে মঞ্চে নিয়ে আসা হল। হ্যারি আর নিজেকে সংযত করতে পারল না। ওর ছেলেবেলার বন্ধু ফ্রান্সিস। কত হাসি কান্না মান-অভিমানের জীবন কাটিয়েছে ওরা। হ্যারি ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ফ্রান্সিস নীচুস্বরে বলতে লাগল– হ্যারি, ভয় নেই, আমি মরবো না। যা বলছি, শোন। তোমরা কেউ সুলতানের বিরোধিতা বা সেনাপতির হুকুমের অবাধ্য হয়ো না। আমি আমাদের ভাঙা জাহাজটায় থাকব। পরে দেখা হবে।
হ্যারি কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারল না। চোখ মুছে অবাক হয়ে ফ্রান্সিসের দিতে তাকাতে-তাকাতে মঞ্চ থেকে নেমে এল।
ফজল ফ্রান্সিসের মাথায় কালো কাপড়ের ঢাকনা পরিয়ে দিল। কাপড়টা পরাবার সময় সকলের অলক্ষ্যে ফ্রান্সিসের হাতের বাঁধনটা আলগা করে দিল। তারপর গলায় দড়ির ফাঁসটা পরিয়ে সুলতানের দিকে তাকাল। আবার চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কি হয় দেখবার জন্যে সবাই উদ্গ্রীব হয়ে আছে। সুলতান হাত তুলে ইঙ্গিত করল। ফজল ফ্রান্সিসের পায়ের নীচের পাটাতনটা এক টানে সরিয়ে দিল। ফ্রান্সিস ঝুপ করে নিচে পড়ে গেল। সকলেই দেখল দড়িটায় কয়েকটা হ্যাঁচকা টান পড়ল। দুলতে-দুলতে দড়িটা থেমে গেল।
ফ্রান্সিসের ফাঁসি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বধ্যভূমিতে উপস্থিত আমদাদবাসীরা উল্লাসে চীৎকার করে উঠল। ওদের ফাঁসি দেখা হয়ে গেল। সুলতান, রহমান আর ভাইকিং সেনাপতিকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন। দর্শকরাও সব আস্তে-আস্তে চলে গেল। ভাইকিং বন্দীরে নিয়ে সৈন্যরা চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বধ্যভূমি নির্জন হয়ে গেল।
* * *
দুপুর গেল। সন্ধ্যে পার হল। রাত্রি বাড়তে লাগল। চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। ফ্রান্সিস হাতের দড়ির বাঁধনটা খুলে ফেলল। তারপর আস্তে আস্তে পেছনের পাটতনটা ধরে নাড়া দিল। সত্যিই আলগা। ওটা খুলে এল। সামনেই প্রাচীরের ধার ঘেঁষে একটা ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে, লেজ ঝাঁপটাচ্ছে। ঘোড়াটার পিঠে জিন বাঁধা। ফ্রান্সিস এক লাফে ঘোড়ায় চড়ে বসল। তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে দ্রুত বেগে একটা গলিপথে ঢুকে পড়ল। আন্দাজে দিক ঠিক করে দুর্গের দিকে চলল। সমুদ্র ঐ দিকেই। একসময় হু-হুঁ হাওয়া এসে লাগল। সেই সঙ্গে সমুদ্রের মৃদু গর্জন। ঐ তো সমুদ্র। ওপাশে দুর্গের টানা প্রাচীর। সমুদ্রের ধার দিয়ে ফ্রান্সিস বিদ্যুৎবেগে ঘোড়া ছোটাল। অল্প অল্প চাঁদের আলোয় জল ঝিকমিক করছে। হুহু হাওয়া শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। সারাদিনের বন্দীদশা, উপবাস, একফোঁটা জলও খেতে পায়নি। তবু মুক্তির আনন্দ, বেঁচে থাকার আনন্দ। ফ্রান্সিস প্রাণপণে ঘোড়া ছোটাল। একটু পরেই দূর থেকে দেখা গেল, একটা প্রকাণ্ড কালো জন্তুর মত ওদের ভাঙা জাহাজটা কাত হয়ে পড়ে আছে জলের ধারা।
কেবিন ঘরে ঢুকে নিজের বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল ফ্রান্সিস। সারাদিন যে উত্তেজনা গেছে, শরীর আর চলছে না। কিন্তু খিদেও পেয়েছে ভীষণ। এতক্ষণে ও সেটা বুঝতে পারল। রসুই ঘরটা একবার দেখলে হয়। ফ্রান্সিস উঠে পড়ল। রসুইঘর খুঁজে পেতে দেখল একজনের পক্ষে যথেষ্ট খাদ্য মজুত রয়েছে। যাক কয়েকদিনের জন্য নিশ্চিন্ত। উনুন ধরিয়ে ময়দা-আটা-চিনি দিয়ে এক অদ্ভুত খাবার তৈরী করল ফ্রান্সিস। খিদের জ্বালায় তাই খেলো গোগ্রাসে। তারপর একেবারে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুম।
সকাল হয়েছে। রোদ্দুরের তেজ তখনও বাড়েনি। ফ্রান্সিস ডেক-এ পায়চারি করছে আর ভাবছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাহাজটা মেরামত করতে হবে। আবার সমুদ্রে ভেসে পড়তে হবে। সোনার ঘণ্টা আনতেই হবে। কিন্তু কি করে হবে?
ফ্রান্সিস ভেবে-ভেবে কোন কুলকিনারা পেল না। পায়চারি করতে করতে হঠাৎ ফ্রান্সিস থমকে দাঁড়াল। একটা জাহাজ আসছে এই দিকে। খুব সুন্দর ঝকঝকে একটা জাহাজ। বাতাসের তোড়ে ফুলে ওঠা সাদা পালগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেন উড়ন্ত রাজহাঁস। মাস্তুলে একটা পতাকা উড়ছে পত পত করে। ফ্রান্সিস ভাল করে লক্ষ্য করল– হ্যাঁ, সুলতানের জাহাজ। পতাকায় বাদশাহী চিহ্ন ছুটন্ত ঘোড়া আর সূর্য আঁকা।
ফ্রান্সিস আর ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ মনে করল না। কেবিন ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। রাজ্যের চিন্তা মাথায় ভিড় করে এল। সুলতানের জাহাজ এদিকে আসছে কেন? তবে কি হ্যারি বিশ্বাসঘাতকতা করল? অত্যাচারের মুখে সব বলে দিল? ফ্রান্সিসের হদিশ জানিয়ে দিল? কিন্তু ওকে ধরিয়ে দিয়ে হ্যারির কি লাভ? লাভ আছে বৈকি? তাহলে সুলতান ওদের মুক্তি দেবে। সবাই দেশে ফিরে যেতে পারবে।
সুলতানের জাহাজটা বালিয়াড়িতে এসে ভিড়ল। ফ্রান্সিসের সব বন্ধুরা হইহই করতে করতে জাহাজ থেকে নেমে এল। ফ্রান্সিস অনেকটা আশ্বস্ত হল। ওরা যখন এত আনন্দ হই-হুল্লা করছে, তখন নিশ্চয়ই অন্য কারণে জাহাজটা এখানে আনা হয়েছে। গা ঢাকা দিয়ে ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে ডেক এ উঠে এল। মাস্তুলের আড়ালে লুকিয়ে সব দেখতে লাগল। ফ্রান্সিসের বন্ধুরা নেমে আসতেই সৈন্যের দল নেমে এসে ওদের ঘিরে দাঁড়াল; তারপর সবাই দল বেঁধে এই জাহাজটার দিকে আসতে লাগল। আরো কিছু লোক তখন সুলতানের জাহাজ থেকে হাতুড়ী, পেরেক বড়-বড় কাঠের পাটাতন নামাতে লাগল। তাহলে ওদের ভাঙা জাহাজটা মেরামত হবে। ঐ লোকগুলো কাঠের মিস্ত্রী। ফ্রান্সিস স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
মালপত্র নামানো হল। ফ্রান্সিসদের জাহাজটায় মেরামতির কাজ শুরু হল। ভাইকিংরাও হাত লাগাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্জন সমুদ্রতীর বহুলোকের হাঁকডাকে ভরে উঠল। ফ্রান্সিস আড়াল থেকে লক্ষ্য করল, হ্যারি কাজ করার ফাঁকে আড়চোখে এই জাহাজটার দিকে তাকাচ্ছে। বোধহয় ফ্রান্সিসের সঙ্গে দেখা করবার সুযোগ খুঁজছে।
* * *
দুপুর নাগাদ সুলতানের জাহাজ থেকে কার হাঁক শোনা গেল– ‘খানা তৈরি। সবাই চলে এসো।’ সবাই কাজ রেখে দল বেঁধে জাহাজে খেতে চলল। শুধু হ্যারি থেকে গেল। কেউ কেউ হ্যারিকে ডাকল। হ্যারি বলল— হাতের কাজটা শেষ করেই যাচ্ছি। তোমরা এগোও।
জাহাজে ভাঙা হালের জায়গাটায় হ্যারি কাজ করছিল। সে জাহাজের আড়ালে পড়ে গেল। সুলতানের সৈন্যরাও খেয়াল করল না। সবাই জাহাজে উঠে গেল। হ্যারি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। যখন দেখল কেউ ওকে লক্ষ্য করছে না; তখন দড়ি বেয়ে ভাঙা জাহাজটায় উঠে এল। সুলতানের জাহাজ থেকে যাতে পাহারাদার সৈন্যরা দেখতে না পায়, তার জন্যে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চাপাস্বরে ডাকল— ফ্রান্সিস!
ফ্রান্সিস মাস্তুলের আড়াল থেকে সবই দেখছিল। এবার ছুটে এসে হ্যারিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। হ্যারি প্রথমে একটু চমকেই উঠেছিল; পরক্ষণে গভীর আবেগে ফ্রান্সিসকে আলিঙ্গন করল। দুজনেরই চোখ জলে ভরে উঠল। আঃ! ফ্রান্সিস তাহলে সত্যিই বেঁচে আছে! সময় অল্প। বেশি কথা হল না। ফ্রান্সিস বলল– তোমরা কেউ সুলতান বা সেনাপতির হুকুমের বিরোধিতা করো না।
– সেসব আমরা ভেবে রেখেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাহাজ নিরাপদে নিয়ে যেতে পারব তো?
– হ্যাঁ, আমি দিনরাত শুধু ঐ ভাবনা নিয়েই আছি।
– তোমার কি মনে হয়? পারবে?
– নিশ্চয়ই পারব, পারতেই হবে। কলবর শোনা গেল। হ্যারি দ্রুত উঠে দাঁড়াল। বলল– এখন চলি। নিশ্চয়ই ওরা আমাকে খুঁজতে বেরিয়েছে।
– আবার দেখা হবে। ফ্রান্সিস হেসে হাত বাড়াল। হ্যারি আবেগে ওকে চেপে ধরল। এক মুহূর্ত। তারপরেই দ্রুত ডেকের রেলিঙে দাঁড়িয়ে তীরে বন্ধুদের জটলার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। সবাই হইহই করে উঠল। যাক, হ্যারির কোন বিপদ হয়নি। হ্যারি দড়ি বেয়ে নেমে এল। তারপর বন্ধুরা ওর জন্যে যে খাবার নিয়ে এসেছিল, বালির ওপর বসে তাই খেতে লাগল। সঙ্গে সৈন্য আর মিস্ত্রীরা। সারাদিন মেরামতির কাজ চলে। সন্ধ্যে নাগাদ আবার ওদের নিয়ে জাহাজটা আমদাদ বন্দরে ফিরে যায়। জাহাজ রঙ করা হল। দেখতে হল যেন, ঝকঝকে নতুন জাহাজ একটা।
সেদিন হ্যারি লুকিয়ে ফ্রান্সিসের সঙ্গে দেখা করল। বলল– কালকে জাহাজ ছাড়বে।
– কখন? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
– সকালবেলা।
– সুলতান যাচ্ছে নিশ্চয়ই।
– সে আর বলতে। সুলতানের নাকি ভালো করে ঘুমই হচ্ছে না।
– খুবই স্বাভাবিক— নিরেট সোনা দিয়ে তৈরি ঘণ্টা তো।
– মরুক গে। তুমি কিন্তু ডেকে উঠবে না।
— হুঁ। ফ্রান্সিস অন্যমনস্কভাবে কি যেন ভাবতে লাগল। তারপর জিজ্ঞেস করল– আচ্ছা, সুলতান সঙ্গে কত সৈন্য নিয়ে যাচ্ছে।
– ঠিক বলতে পারব না। তবে রহমান বলেছিল, বাছাই করা সৈন্য নেওয়া হবে।
– হুঁ। ফ্রান্সিস নিজের চিন্তায় ডুবে গেল।
– লড়বে নাকি?
– সে সব সময় সুযোগ বুঝে।
হ্যারি আর বসল না। ওকে না দেখতে পেলে সৈন্যদের মনে সন্দেহ জাগতে পারে। হ্যারি চলে গেল।
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইল ফ্রান্সিস। কত চিন্তা মাথায়। ঘুম আসতে চায় না। এক সময় ফ্রান্সিস উঠে পড়ল। দড়ি বেয়ে বালির ওপর নেমে এল। আকাশে চাঁদ, চারদিক ভেসে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। নতুন রঙ করা জাহাজটার দিকে তাকিয়ে রইল ফ্রান্সিস। সকালেই তো সমুদ্র যাত্রার শুরু। হয়তো এই যাত্রাই তার শেষ যাত্রা। হয়তো সবাই ফিরে যাবে দেশে, তার আর কোন দিন ফেরা হবে না। দেশ থেকে বহুদূরে এক অজানা সমুদ্রে তার মৃতদেহ ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেসে যাবে। হয়তো তার মৃত্যু নিয়ে দেশের লোকেরা কয়েকদিন জল্পনা কল্পনা করবে। তারপর আস্তে আস্তে সবাই তাকে একদিন ভুলে যাবে।
ফ্রান্সিস শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জাহাজটার দিকে। চাঁদের আলো যেন ঠিকরে পড়ছে জাহাজটার গা থেকে। চারদিকে সেই অসীম শূন্যতার মাঝখানে জাহাজটাকে মনে হতে লাগল, যেন কোন স্বপ্নপুরী থেকে ভেসে এসেছে। বালিয়াড়িতে কিছুক্ষণ পায়চারী করে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল ফ্রান্সিস।
* * *
তখন সবে সকাল হয়ে সূর্য উঠেছে। ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। ওপরের ডেক-এ অনেক লোকের চলাফেরার শব্দ। দাড়িদড়া বাঁধছে। পাল খাটাচ্ছে। ওদের কর্মচাঞ্চল্যে ঘুমন্ত জাহাজটা জেগে উঠল।
ফ্রান্সিস উঠে বসল। তাড়াতাড়ি বিছানাপত্র গুটিয়ে নিয়ে যে ঘরটায় হ্যারিকে আটকে রাখা হয়েছিল, সেই ঘরটায় চলে এল। এখন থেকে এই ঘরটাই হবে তার আস্তানা। সুলতানের সৈন্যদের চোখের আড়ালে থাকতে হবে। ওরা যাতে ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে, ফ্রান্সিস বেঁচে আছে, আর এই জাহাজেই আছে।
রহমানের কথাই ঠিক। সুলতান ভাইকিংদের চেয়ে বেশিসংখ্যক বাছাই করা সৈন্য সঙ্গে নিয়েছেন। কিছু রেখেছেন তার নিজের জাহাজে আর বাকি সব ফ্রান্সিসদের জাহাজে। ভাইকিংদের পাহারা দিতে হবে তো! যদি জলে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যায়।
পাল খাঁটিয়ে দড়িদড়া বেঁধে দুটো জাহাজই যাত্রার জন্য প্রস্তুত হল। দুটো জাহাজেই সুলতানের বাদশাহী চিহ্ন ছুটন্ত ঘোড়া আর সূর্য আঁকা পতাকা ভোরের হাওয়ায় পৎপৎ করে উড়ছে।
তখন সূর্য দিগন্তের একটু ওপরে উঠেছে। আলোর তেজ তখনও প্রখর হয়নি। সুলতান নিজের জাহাজের ডেক-এ এসে দাঁড়ালেন। সঙ্গে রহমান আর ভাইকিংদের সেই সেনাপতি। সুলতানের সামনে দাঁড়িয়ে বেঢপ পোশাক পরা দাড়িওলা একটা লোক সুর করে কি যেন দ্রুত ভঙ্গিতে বলতে লাগল। বোধহয় ঈশ্বরের কাছে দয়া প্রার্থনা করা হচ্ছে। সুলতান মাথা নীচু করে শুনতে লাগলেন। লোকটা বলা শেষ করে এক পাশে সরে দাঁড়াল। এবার সুলতান মাথা তুললেন। খাপ থেকে তরবারি খুলে নিলেন। তারপর তরবারিটা সমুদ্রের দিকে তুলে যাত্রার ইঙ্গিত করলেন। সকালের আলোয় সোনাবাঁধানো হাতলওলা তরবারিটা ঝকঝক করতে লাগল। একটা ঝাঁকুনি খেয়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলতে শুরু করল। দাড়িরা দাঁড় বাইতে লাগল। জাহাজটা মাঝসমুদ্রের দিকে চলল। সুলতানের জাহাজটা চলল পেছনে পেছনে। সমুদ্রের বুকে কিছুটা এগোতেই হাওয়া লাগল পালে। পালগুলো দুলে উঠল। পরিষ্কার আকাশের নীচে শান্ত সমুদ্রের বুকে দুটো জাহাজ, একটা সামনে আর একটা পেছনে। চলল জাহাজ দু’টো।
দিন যায়, রাত যায়। একা বদ্ধ ঘরে ফ্রান্সিসের দিন কাটে, রাত কাটে। হ্যারি সারাদিন একবার করে আসে। সব খবরাখবর দেয়। ভাইকিংদের মধ্যে বিশ্বস্ত কয়েকজন মাত্র জানে, ফ্রান্সিস এই ঘরে আছে। তারা কিন্তু ফ্রান্সিসের কাছে আসে না। ফ্রান্সিসের ঘরের বাইরে পালা করে দিনরাত পাহারা দেয়। ওর খাবার-টাবার দিয়ে যায়। সবাই খুব সাবধান– সুলতানের লোক যাতে ফ্রান্সিসের কোনো কথা না জানতে পারে।
* * *
একদিন এক কাণ্ড হল। সেদিন গভীর রাত। ফ্রান্সিসের ঘরের সামনে পাহারাদার ভাইকিংটা ঘুমে ঢুলছে। হঠাৎ একটা খুট্ করে শব্দ হতেই সে চমকে উঠে দেখল, একটা ছায়া পিপের আড়ালে সাঁৎ করে সরে গেল। ও তাড়াতাড়ি পাটাতনের আড়ালে লুকনো তরবারি বের করল। কিন্তু আর কোন সাড়াশব্দ নেই। হঠাৎ একটা গড়গড় শব্দ হতেই ও চমকে ফিরে তাকাল। দেখল, অন্ধকার থেকে দু-তিনটে পিপে ওর দিকে গড়াতে-গড়াতে ছুটে আসছে। প্রথম পিপেটার ধাক্কায় সে, কাঠের মেঝেটায় উপুড় হয়ে পড়ে গেল। অন্ধকার থেকে ছায়ামূর্তিটা ছুটে এসে পাহারাদারটার পিঠের ওপর চড়ে বসল। তারপর নিজের কোমরবন্ধনীর কাপড় দিয়ে পাহারাদারের মুখটা বেঁধে ফেলল।
বাইরের পিপের গড়গড় শব্দে, পাহারাদারের উপুড় হয়ে পড়ার শব্দে ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। ও নিঃশব্দে বিছানার তলায় লুকানো তরোয়ালটা বের করে পা টিপেটিপে দরজার দিকে এগোল। কোনরকম শব্দ না করে দরজাটা খুলে বাইরে এসে দেখল, একটা ছায়ামূর্তি পাহারাদারের পিঠের ওপর চড়ে বসে আছে। ফ্রান্সিস তরোয়ালটা ছায়ামূর্তির পিঠে ঠেকিয়ে বলল– উঠে পড়ো বাছাধন।
পাহারাদারের মুখ আর বাঁধা হল না। ছায়ামূর্তি আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়াল। পাহারাদারটা গোঙাতে লাগল। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল– ঘুরে দাঁড়াও। ছায়ামূর্তি ঘুরে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসের চোখে তখন অন্ধকারটা সয়ে এসেছে। সে চোখ কুঁচকে ভালো করে দেখল। আরে? এ কি? এ যে ফজল। ফ্রান্সিস তরোয়াল ফেলে ফজলকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। পাহারাদারটা তখনও গোঙাচ্ছে। ফজল তাড়াতাড়ি তার মুখ থেকে কাপড়টা খুলে দিল। পাহারাদারটা ওদের দুজনকে দেখেই হেসে উঠল। ফ্রান্সিস পাহারাদারকে বলল– যাও ভাই ঘুমিয়ে নাও গে!
ফ্রান্সিস আর ফজল কাঁধ ধরাধরি করে ঘরে এসে বিছানায় বসল। ফ্রান্সিস বলল– ফজল ভাই, তোমার ঋণ আমি জীবনেও শোধ করতে পারব না।
– কি যে বল— তোমার কাছেও কি আমার ঋণ কিছু কম।
– অবাক কাণ্ড– তুমি এখানে এলে কি করে?
– তোমাকে চাবুক মারা, ফাঁসি দেওয়া, এসব দেখে রহমান আমাকে বেশ বিশ্বাসী লোকবলে ধরে নিয়েছিল। তারপর কিছু ঘুষও দিয়েছি। কাজেই সুলতানের সৈন্যদলে জায়গা পেতে খুব অসুবিধে হল না।
– আমি এই জাহাজেই যাচ্ছি, তুমি বুঝলে কি করে?
ফজল হাসল। বলল– সোনার ঘণ্টা আনতে জাহাজ যাচ্ছে, আর তুমি বেঁচে থাকতে সেই জাহাজে যাবে না, এ কি হয়। ভাল কথা তোমাকে যে দুটো মোহর দিয়েছিলাম, সেগুলো আছে?
ফ্রান্সিস দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোহর বিক্রির কথা, মকবুলের মোহর চুরির কথাও বলল।
– মকবুল? ফজল বেশ চমকে উঠল।
– হ্যাঁ, লোকটা নিজের নাম বলেছিল মকবুল।
– কেমন দেখতে বল তো?
– মোটাসোটা। গোলগাল বেশ হাসিখুশী।
– হুঁ। ফজল দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
– তুমি মকবুলকে চেন? ফ্রান্সিস জিজ্ঞাসা করল।
– ফজল ম্লান হেসে কপালের কাটা দাগটা আঙ্গুল দিয়ে দেখাল– মকবুলের তরোয়ালের কোপের দাগ।
ফজল বলতে লাগল, ভাই মকবুল আমার খুড়তুতো দাদা। বাবা আর খুড়ো মারা গেল। তারপর বিষয়সম্পত্তি নিয়ে লাগল গণ্ডগোল। বিষয়সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারর সময় পাওয়া গেল একটা পুরানো বাক্স। তাতে সেই মোহর দুটো। বংশপরম্পরায় ঐ বাক্সটা প্রাপ্য ছিল মকবুলেরই, কিন্তু সে ভীষণ লোভী। একটা ছোট মরূদ্যান আমার ভাগে পড়েছিল। ঐ মরুদ্যানটার ওপর ওর লোভ ছিল বরাবর। সে বলল– তুই বরং এই মোহরের বাক্স বদলে আমাকে ঐ মরুদ্যানটা দে। আমি রাজী হলুম, কি হবে ঐ মরুদ্যানটা নিয়ে। আমি তো আর ব্যবসা করব না। তার চেয়ে বরং আমাদের বংশের একটা স্মৃতি মোহরের বাক্সটাই আমি রাখি। মকবুলের হাতে পড়লে বিক্রি করে দেবে। আমি রাজী হলাম। মোহরের বাক্সটা আমার কাছেই রইল।
– তারপর?
– মককুল পাওয়া সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যবসার ধান্ধায় আমদাদ গেল, হায়াৎ গেল, আরো কত জায়গায় ঘুরে বেড়াল। আফ্রিকাও নাকি গিয়েছিল। তারপর হঠাৎ একদিন বাড়ি এল। মোহরের বাক্সটা আমার কাছ থেকে ফেরৎ চাইল। আমি দেব কেন? ওকে তো চিনি। নিশ্চয়ই মোহর দুটো বিক্রি করে দেবে। আমি স্পষ্ট বলে দিলাম এই বাক্স আমার, আমি দেব না।
– তারপর?
– সেই রাত্রেই মকবুল আমাকে খুন করতে এল। খুব ভাগ্যিস আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তবু তরোয়ালের কোপ এড়াতে পারিনি। কপালে সেই চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি।
– মকবুল মোহর দুটোর জন্যে এত পাগল হয়ে উঠেছিল কেন?
– কারণটা আমি পরে জেনেছি। সোনার ঘণ্টা যে দ্বীপে রয়েছে, সেই দ্বীপে যাবার এবং ফিরে আসার দুটো পথেরই নকশা আঁকা আছে সেই মোহর দুটোতে।
– তাহলে কথাটা সত্যি? ফ্রান্সিস চিন্তিত স্বরে বলল।
– কি সত্যি?
– জানো ফজল, আমিও ঠিক এই কথা শুনেছি।
– তাই নাকি?
– হ্যাঁ।
– যা হোক এই কথাটা জানবার পরই আমি বাড়ি ছাড়লাম। মোহর দুটো রুমালে বেঁধে সব সময় আমার কোমরে রাখতাম। ইচ্ছে ছিল, ঐ নকশাটা কারো কাছে থেকে বুঝে নেব, তারপর কিছু টাকা জমিয়ে জাহাজ কিনে একদিন সোনার ঘণ্টা আনতে যাব। কিন্তু–
– কেন যেতে পারলে না?
– আচ্ছা ফজল, তুমি আমাকে মোহর দুটো দিয়েছিলে কেন?
– মকবুলের হাত থেকে মোহর দুটো বাঁচাবার জন্যে।
ফ্রান্সিস দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল– আশ্চর্য! নিজের জীবন বিপন্ন করেও তুমি যে মোহর দুটো হাতছাড়া করো নি– আমি খিদের জ্বালায় সেটা বিক্রি করে দিলাম।
– তোমার দোষ নেই ভাই। আমারই বোঝা উচিত ছিল। তুমি বিদেশী— কে তোমাকে চেনে? কে খেতে দেবে তোমাকে? আশ্রয়ই বা দেবে কে? যাকগে যা হবার হয়ে গেছে।
– তোমার কি মনে হয়? মকবুল সোনার ঘণ্টার দ্বীপে যেতে পেরেছে?
– মনে হয় না। কারণ ও একটা মোহরই পেয়েছে। দুটো মোহর আছে জেনে নিশ্চয়ই অন্যটার খোঁজে আছে। জহুরী ব্যাটা সোনার লোভে অন্যটা বোধহয় এতদিনে গালিয়েই ফেলেছে।
গল্প করতে করতে দুজনের কারোরই খেয়াল নেই যে, রাত শেষ হয়ে এসেছে। ভোর হয় হয়। হ্যারি ফ্রান্সিসের খোঁজখবর নিতে এল। তখন দুজনের খেয়াল হল যে ভোর হয়েছে। ফজল তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। যে ঝোলানো দড়িটা বেয়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজে উঠে এসেছিল সেটা বেয়েই নেমে গেল সমুদ্রের জলে। আবছা অন্ধকারের মধ্যে সাঁতরাতে সাঁতরাতে সুলতানের জাহাজের কাছে গেল। ওখানে একটি দড়ি ঝুলিয়ে নেমে এসেছিল। সেই দড়িটা বেয়ে জাহাজে উঠে গেল। তারপর দড়িটা তুলে রেখে পা টিপে টিপে কেবিন ঘরের দিকে চলে গেল।
* * *
জাহাজ দুটো চলল। দিন যায়, রাত যায়। এদিকে ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। এক চিন্তা কি করে ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে, ডুবো পাহাড়ের ধাক্কা এড়িয়ে সে সাদা মন্দিরের দ্বীপটায় জাহাজ নিয়ে যাবে।
হ্যারি আসে। দুজনে পরামর্শ হয়।
একদিন গভীর রাত্রে ফজল এল। তাকে বেশ উত্তেজিত মনে হল। ফ্রান্সিস বেশ অবাকই হল। কি ঘটল এমন? ফজল কোন কথা না বলে কোমর বন্ধনী থেকে সাবধানে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করল। আস্তে-আস্তে ভাঁজ খুলে ফ্রান্সিসের সামনে পাতল। পার্চমেন্ট কাগজের মত শক্ত পুরোনো কাগজ। হলদেটে হয়ে গেছে। ফ্রান্সিস কিছুই বুঝতে না পেরে ফজলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। ফজল বলল— যে বাক্সটাতে মোহর দুটো ছিল, সেই বাক্সে এই কাগজটা পেলাম।
– কিছু লেখা আছে এটাতে?
– না। তবে আমার বেশ মনে আছে, মোহর দুটো এই কাগজটায় জড়ানো ছিল। একটু লক্ষ্য করে দেখ— অনেকদিন জড়ানো ছিল বলে দুটো মোহরের দুপিঠের আবছা ছাপ পড়েছে কাগজটাতে।
ফ্রান্সিস এবার উৎসুক হল। হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। সত্যিই তাই। কাগজটার দুপাশে দুটো অস্পষ্ট ছাপ। একটাতে মাথার ছাপের মত। অন্যটাতে কয়েকটা ত্রিকোণের আভাস। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি পাহারাদারকে ডাকল। বলল– রসুইঘর থেকে একটু কাঠকয়লার গুঁড়ো নিয়ে এস।
খুব সন্তর্পণে ফ্রান্সিস সেই কাগজটায় কাঠকয়লার গুঁড়ো ঘষল। আস্তে আস্তে কালো ছাপগুলো স্পষ্ট হল। একটাতে মাথা আঁকা। অন্যটাতে কয়েকটা ত্রিকোণ নকশা দেখা গেল। ফ্রান্সিস বলল– এটা উলটো ছাপ আলোয় ধরলে সোজা ছাপ পাব।
ফ্রান্সিস কাগজটাকে আলোর সামনে ধরল। একটা অস্পষ্ট নকশা ফুটে উঠল।
ফজল একটু উসখুস করে ডাকল— ফ্রান্সিস?
– কি হল?
– এটা যাওয়ার পথের নকশা।
– হ্যাঁ। কিন্তু কয়েকটা চিহ্নের মানে বুঝতে পারছি না। ভাবতে হবে।
– কিন্তু আমি তো এখন–
– হ্যাঁ তুমি জাহাজে ফিরে যাও। কাগজটা থাক আমার কাছে।
– বেশ– ফজল চলে গেল।
পরের দিন ফ্রান্সিস হ্যারিকে নকশাটা দেখাল। হ্যারি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। গম্ভীর মুখে বলল– ভুতুরে নকশা।
ফ্রান্সিস হাসল। বলল– এই দেখ, তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি– বলে ফ্রান্সিস ‘ক’ ‘খ’ করে প্রত্যেকটি চিহ্নের আলাদা নামকরণ করল। প্রত্যেকটি চিহ্নের অর্থ কি তাও বলল। ক = জাহাজ। খ ও গ = ডুবো পাহাড়। ঙ = সোনার ঘণ্টার দ্বীপ। য ও ঘ = পাথুরে দ্বীপ।
হ্যারি হতবাক হয়ে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তারপর বলল– তুমি কি করে বুঝলে ত্রিকোণগুলো পাথুরে দ্বীপ?
– ঝড়ের সময় মাস্তুলে উঠে ঠিক যা-যা দেখেছিলাম– নকশাটাতে তাই আঁকা আছে।
– তাহলে এটাই যাওয়ার পথের নকশা?
– নিশ্চয়ই। কিন্তু গোলমাল বাধিয়েছে ‘ক’ থেকে ‘ঘ’ পর্যন্ত এই অস্পষ্ট রেখাটা। রেখাটা আবার ‘ঘ’ দ্বীপটার চারদিকেও রয়েছে।
– এ তো সোজা।
– সোজা?
– হ্যাঁ, জাহাজটা এই পথে যাবে।
– ধোৎ ধোৎ, এ তো শিশুও বুঝবে– কিন্তু, প্রশ্ন হল– কি করে?
হ্যারি এবার ঠাট্টা করার লোভ সামলাতে পারল না। বলল– দাগটা মনে হয় সুতো।
– সুতো?
– হ্যাঁ– সুতো দিয়ে জাহাজটা টেনে নিয়ে যেতে বলছে।
ফ্রান্সিস এক মুহূর্ত হ্যারির দিকে তাকিয়ে রইল। পরক্ষণেই ওর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে আচমকা এক রদ্দা কষালো হ্যারির ঘাড়ে। হ্যারি বিছানা থেকে প্রায় ছিটকে পড়ে আর কি। ফ্রান্সিসের সেদিকে নজর নেই। সে তখন বিছানায় উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে শুরু করেছে। হ্যারি ঘাড়ে হাত বুলোতে বুলোতে অবাক চোখে ফ্রান্সিসের নাচ দেখতে লাগল। নাচ থামিয়ে ফ্রান্সিস ডাকল– হ্যারি ঘাড়ে লেগেছে খুব?
– নাঃ– এমন আর কি! কিন্তু তোমার এই হঠাৎ পুলকের কারণটা কি?
– সুতো।
– সুতো?
– তুমি যে বললে, সুতো দিয়ে জাহাজ টেনে নিয়ে যাওয়া।
– তুমি কি তাই করতে চাও নাকি?
– হ্যাঁ, তবে সুতো নয়, মোটা কাছি। দ্বীপটার চারদিকে গোল দাগ মানে কাছিটা দ্বীপের, পাথরের সঙ্গে বাঁধতে হবে।
ফ্রান্সিস হ্যারির পাশে এসে বসল। শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল– আচ্ছা, হ্যারি, আমাদের জাহাজে কাঠের পাটাতন কত আছে।
– আর একটা জাহাজ তৈরি করার মত নেই।
– কিন্তু একটা বেশ শক্ত নৌকো!
– হ্যাঁ, তা তৈরি করা যাবে।
– আর দড়িকাছি এসব?
– যথেষ্ট আছে।
– আজ থেকে তাহলে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের দলের লোকদের ডেকে বলে দাও– সবাইকে হাত লাগাতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা শক্ত নৌকো তৈরি করতে হবে, আর একটা শক্ত লম্বা কাছি।
– কতটা লম্বা?
– যতটা লম্বা হতে পারে?
– বেশ।
* * *