» » দুরঙা প্রজাপতি

বর্ণাকার

অদ্বৈত মল্লবর্মণ

তিতাস একটি নদীর নাম

দুরঙা প্রজাপতি

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

গ্রামে ফিরিয়া অনন্ত লেখাপড়ায় মন দিল। গোঁসাই বাবাজী যেদিন তাকে প্রথম ‘কালা আখর’ শিখাইল, সেদিন তার আনন্দ উপছাইয়া উঠিল। একটি নূতন জগৎ তাকে দ্বার খুলিয়া ডাকিয়া নিয়া গেল। তারপর দুই আখরে তিন আখরে মিলিয়া এক একটা কথা হইল। এ সকল কথা মুখে যেমন বলা যায় তেমনি লিখিয়াও প্রকাশ করা যায়। দেখিয়া তার বিস্ময়ের অবধি রহিল না। তিনকোণা, চারকোণা, গোল, নানারকমের আখরগুলি কলাপাতায় নক্সা করিতে কি যে ভাল লাগে। রাতে শুইলেও সেগুলি আকার নিয়া চোখের সামনে জ্বলজ্বল করিতে থাকে।

দেখিতে দেখিতে শিশুশিক্ষা শেষ হইয়া যায়। বনমালীর গর্ব হয়। সে বইটার যে-কোন একটা জায়গা আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া বলে, এইখানে পড় দেখি। অনন্ত পড়ে। আবার অন্য জায়গায় দেখায়, এইখানে কি লেখা আছে পড় দেখি। অনন্ত পড়ে। কোথাও ঠেকে না। মাঝে মাঝে বনমালার দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে। বলে, ‘কালা আখর কেমুন জিনিস সময় থাকতে জানলাম না, অখন তা-ই শিখলাম।’

শিশুশিক্ষা শেষ করিয়া বাল্যশিক্ষা ধরে। তার সঙ্গে ধারাপাত। ঘোড়ায় চড়িল আবার পড়িল, কথাগুলি নূতন কিন্তু আখরগুলি চেনা। শিশুশিক্ষাতেই এ সবই পাওয়া গিয়াছে। এখানে একটা ছবি আছে। লোকটা ঘোড়া ছুটাইয়াছে। পড়িয়া যাওয়ার ছবি নাই। কোন সময় পড়িয়া গিয়া উঠিয়া পড়িয়াছে, সেটা দেখিতে পায় নাই বলিয়াই ছবি দেয় নাই। তারপর আসিল যুক্তাক্ষর। এগুলি কঠিন এবং জটিল। কিন্তু এই কঠিনতায় জটিলতায় যে একটা মোহ আছে, অনন্তকে তাহা  পাইয়া বসিল। তারা নূতন নূতন রূপ নিয়া তার মানসলোকে আপনা থেকে আসিয়া ধরা দিতে লাগিল।

অনন্তবালাকেও তার কাছে পড়িতে দেওয়া হইল। কিন্তু মেয়েটার পড়াতে বিশেষ মন নাই। কিছুই শিখিতে পারে না। পড়েই না শিখিবে কি করিয়া। সে কেবল একবার অনন্তর দিকে চাহিয়া থাকে, আবার বাহিরে যেখানে ধানক্ষেতের সঙ্গে আকাশ মিশিয়াছে সেইদিকে চাহিয়া থাকে। হয়তো দূরে যেখানে আরেকটা গাঁ আছে তার দিকে চোখ মেলিয়া ধরে। আর সুযোগ পাইলেই কেবল কথা বলে। কোন অর্থ হয় না, কোন দরকারে লাগে না এমন সব কথা বলিতে থাকে। একবার বলিতে থাকিলে থামানে মুশকিল হয়।

কোনদিন বলে, আজ আমাদের বাড়িতে অনেক কথা হইয়াছে। তোমারে আমারে নিয়া। নামে নামে মিল আছে কিন্তু অত মিল ভাল নয়। তাই তোমার নামটা বদলাইলে আমার নামও বদলাইতে বলিব। জান, তোমার কি নাম রাখিবে। মা বলিয়াছিল হরনাথ রাখিতে। কিন্তু ছোটখুড়ির পছন্দ হইল না, বলে পীতাম্বর রাখিতে। কিন্তু এ নাম আবার বড়খুড়ির পছন্দ না হওয়াতে অনেক তর্কাতর্কির পর বড়খুড়ি যে-নাম রাখিতে বলিল তাহা রাখ। হইবে স্থির হইল। তোমার নাম হইবে গদাধর।

—এ নাম আমার মাসীর পছন্দ হইবে না।

—কিন্তু রাখা যখন হইয়া গিয়াছে, আর ত বদলাইতে পারিবে না।

—আমার নাম বদলাইবার আবার কি দরকার পড়িল।

—তুমি বুঝি জান না। মা জানে, বাবা জানে, আমি জানি। আর তুমি জান না। তোমাকে বলিতে আমায় নিষেধ করিয়াছে তাই বলিব না। তোমাকে নিয়া আমাদের বাড়িতে অনেক কথা হয়। তোমাকে চিরদিনের জন্য আমাদের বাড়িতে থাকিতে হইবে। তারা কোথাও যাইতে দিবে না। তারা বলে তোমাকে কেবল আমার সঙ্গেই মানাইবে, আর কারো সঙ্গে না।

—আমি যদি না থাকি।

—জোর করিয়া রাখিবে। বাঁধিয়া রাখিবে।

—হে, আমাকে বাঁধিয়া রাখিবে। এক সময় হুট্‌ করিয়া কোথায় চলিয়া যাইব। জানিলে ত।

অনন্ত সত্যই যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছে। পাঠশালার ফিরতি-পথে এক নাপিত-বাড়িতে পেয়ারা গাছ ছিল। নাপিতানী একদিন তাকে পেয়ারা খাইতে দিয়াছিল আর ছুটির দিন তাকে গিয়া রামায়ণ পড়িয়া শুনাইতে বলিয়াছিল। রামায়ণ শুনিতে শুনিতে নাপিতানী তার মনে এক অনির্বাণ অগ্নি জ্বালাইয়া দিল।

—অনন্ত তোর রামায়ণ-পড়া আমার খুব ভাল লাগে। তোকে আমি ভাল পরামর্শ দিই। তুই চলিয়া যা। এখানে তোকে দ্বিতীয় শ্রেণী পড়াইয়া জেলে-নৌকায় তুলিবে। অধিক পড়া তোর হইবে না। কিন্তু তোকে আরো শিখিতে হইবে, বিদ্বান হইতে হইবে। বামুন কায়েতের ছেলেদের মত এলেবিয়ে পাশ করিতে হইবে। এই তিনকোণা পৃথিবী চন্দ্র সূর্য ভূমণ্ডল সব তোকে জানিতে হইবে। সাতসমদ্দুর তের নদীর কথা, পাহাড় পর্বত হাওর প্রান্তরের কথা তোকে জানিতে হইবে। এ সংসারে কত বই আছে। হাজার হাজার বই লক্ষ লক্ষ বই। এক এক বইয়ে এক এক রকম কথা। তোকে সব পড়িতে হইবে, পড়িয়া সব শিখিতে হইবে।

‘অত বই আছে সংসারে?

—আছে। এখানে থাকিয়া তা তুই কি করিয়া বুঝিতে পারিবি। এখানে থাকিলে তুই আর কখানা বই পড়িতে পাইবি। শহরে চলিয়া যা। কাছের শহরে নয়। দূরের। তুই একেবারে কুমিল্লা শহরে চলিয়া যা।

‘যামু যে, খামু কি কইর। পড়ার টাকা পামু কই।’

—পরের মাকে মা ডাকিবি, পরের বোনকে বোন ডাকিবি। ভগমানে তোকে না খাওয়াইয়া রাখিবে না। তোর লেখাপড়াতে মন আছে দেখিলে তারা তোর নিকট পড়ার বেতন লইবে না। নিজের খরচে তোকে বই কিনিয়া দিবে।

অনন্ত এসব কথা শুনিয়া আসিত আর রাতদিন কেবল ভাবিত। অজানা একটা রহস্যলোক তাকে নিরবধি হাতছানি দিয়া ডাকিত। আনন্দের একটা অনাস্বাদিত উন্মাদনায় তার মন এক এক সময় ভয়ানক চঞ্চল হইয়া পড়িত।

শেষে শীঘ্রই একদিন সে তার প্রার্থিত বস্তুর সন্ধানে পথে পা বাড়াইল।

মালোদের একতায় যেদিন ভাঙ্গন ধরিল, সেইদিন হইতে তাদের দুঃসময়ের শুরু। এতদিন তাদের মধ্যে ঐক্য ছিল বজ্রের মত দৃঢ়; পাড়াতে তারা ছিল একটা আঁটসাট সামাজিকতার সুদৃঢ় গাথুনির মধ্যে সংবদ্ধ। কেউ তাদের কিছু বলিতে সাহস করে নাই। পাড়ার ভিতর যাত্রার দল ঢুকিয়া সেই ঐক্যে ফাটল ধরাইয়া দিল।

যাত্ৰাদলের যারা পাণ্ডা, তারা অর্থে ও বুদ্ধিতে মালোদের চেয়ে অনেক বড়। তারা অনেক শক্তি রাখে। কিন্তু একসঙ্গে সর্বশক্তি প্রয়োগ না করিয়া, অল্পে অল্পে প্রয়োগ করিতে লাগিল। যেদিন বিরোধের সূত্রপাত হইয়াছিল তার পরের দিন তারা তামসীর-বাপের বাড়িতে আরও জাকিয়া বসিল। এতদিন ছিল শুধু তবলা, এবার আসিল হারমনিয়ম, বাঁশি ও বেহালা। গীতাভিনয়ের তিন রকমের তিনটা বই আসিল। আগে কেউ নামও শুনে নাই এমনি একটা পালার তালিম দেওয়া সুরু হইল। তামসীর বাপ আগে সেনাপতি সাজিত, তাকে দেওয়া হইল রাজার পাঠ। জানাইয়া দিল মালোপাড়ার ছেলেদের তারা সখীর পাঠ দিবে। অভিভাবকেরা ছেলেদের যাত্ৰাদলে যোগ দিতে নিষেধ করিল। তারা বিড়ি খায়, ঘাড়কাটা করিয়া চুল ছাটে, গুরুজনের সামনে বেলাহাজ কথা বলে। ঠাকুর দেবতার গান ছাড়িয়া পথেঘাটে সখীর গানে টান দেয়, এতে তাদের স্বভাবচরিত্র খারাপ হইয়া যায়।

অন্য পাড়া হইতে সখী সংগ্ৰহ হইল। কিন্তু সাজ-মহড়া হইল মালোপাড়াতে। তামসীর-বাপের উপর মালোর চাটল। কিন্তু মালোর মেয়ের মহড়া দেখিতে গিয়া মুগ্ধ হইল, কাঁদিয়া ভাসাইল এবং ছেলেদের সখী সাজিতে দিবে বলিয়া সঙ্কল্প করিল। পরের মহড়ায় মালোপাড়ার কয়েকটি ছেলে অন্ত পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে সখী সাজিয়া নাচিল। বাম হাত কোমরে রাখিয়া ডান হাতের আঙ্গুল চিবুকে লাগাইয়া গাহিল, ‘চুপ, চুপ চুপ লাজে সরে যাবে, ধীরে ধীরে চল সজনীলো। ধূলা দিয়ে সখী আমাদের চোখে গোপনে প্রণয় রেখেছে ঢেকে, এবার ভোমর যাবে লো ছুটে, চল, না যেতে যামিনী লো, চুপ, চুপ’ ইত্যাদি।

তাদের মায়ের দিদির মুগ্ধ হইল। নাচখানা যেমন অপূর্ব গানখানাও তেমনি নূতন। এর ভাব, এর ভাষা, এর ভঙ্গি মালোদের গানের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এর স্বরও অন্য রাজ্যের। তারা মুগ্ধ হইল এবং পরদিন হইতে যাত্র দলের প্রতি অনুরক্ত হইল।

অন্যান্য মালোরা তাদের বাঁধা দিল। একঘরে করিবার ভয় দেখাইল। বুঝাইতে চেষ্টা করিল যাত্রার ঐ গান গানই নহে। উহার ভাব খারাপ, অর্থ খারাপ। এতে ছেলেদের মাথা বিগড়াইবে। মেয়েদেরও মন খারাপ হইবে। কিন্তু তারা বিচলিত হইল না। বরং বলিল; আরে রাখ রাখ, মালোদের গান আবার একটা গান ৷ এও গান আর আমরা যা গাই তাও গান। আমরা তো গাই— ‘আজো রাতি স্বপনে শ্যামরূপ লেগেছে আমার নয়নে। ফুলের শয্যা ছিন্নভিন্ন ছিন্ন রাধার বসনে ॥ কিবা গানের ছিরি। যাত্রার ঐ গানের কথা যেমন সুন্দর, সুর ও তেমনি, শোনা মাত্রই মুগ্ধ করে। আমরা ছেলে যাত্ৰাদলে দিবই, তোমরা একঘরে কর আর যাই কর।

ফলে মালোদের মধ্যে দুইটা পক্ষ হইয়া গেল।

মঙ্গলার বউ একদিন ঘাটে পাইয়া জানাইল, ‘পথে বিপদ আছে ভইন, একটু সাবধানে পা বাড়াইও। একজন নাকি তোমারে ‘আজ্‌নাইবে’। কথাখান আমার মহনের কানে আইছে।’

সে কে, জিজ্ঞাসা করাতে মঙ্গলার বউ যার নাম করিল সে পাটনী-পাড়ার অশ্বিনী। বেটে-খাট চেহারা। মাথায় ঝাঁকড়া  চুল। আগে গয়নার নৌকা বাহিত। এখন যাত্ৰাদলে রাজার ভাই সাজে।

এর প্রমাণও একদিন পাওয়া গেল। সুবলার বউ কলসী ও কাপড় লইয়া ঘাটে গেলে, সহস দেখিতে পাইল অশ্বিনী একটু দূরে থাকিয়া তাহাকে দেখিতেছে। চোখাচোখি হওয়া মাত্রই সে গান তুলিল, ‘যেইনা বেলা বন্ধুরে ধইল-ঘোড়া দৌড়াইয়া যাও, সেই বেলা আমি নারী সিনানে যাই। কুখেনে বাতাস আইলো বুকের কাপড় উড়াইল, প্রাণবঁধু দেখিল সর্ব গাও।’

গানের অর্থ সহজেই হৃদয়ঙ্গম হইল।

দুপুরে ঘরে বসিয়া রাঁধিতেছিল। এমন সময় সেই গানেরই আর একটা কলি শোনা গেল। উঠান দিয়া হাঁটিয়া যাইতেছে আর গান করিতেছে, ‘যেই না বেলা বন্ধুরে রাজ-দরবারে যাও, সেই বেলা আমি রান্ধি। কাচা চুলা আর ভিজা কাষ্ঠরে বন্ধু, ধুয়ার ছলনা কইরে কান্দি।’

এতদূর পর্যন্তও সহ্য করা গিয়াছিল। কিন্তু আরেকদিন যখন খাইতে বসিয়া সুবলার বউ আবার সেই গানেরই আরেক কলি শুনিল, ‘যেইনা বেলা বন্ধুরে বাঁশিটি বাজাইয়া যাও, সেই বেলা আমি নারী খাই। শাশুড়ী ননদীর ডরে কিছু না বলিলাম তোরে, অঞ্চল ভিজিল আঁখির জলে।’ তখন সে আর সহ্য করিতে পারিল না। এঁটো হাতেই ছুটিয়া বাহিরে আসিল, চীৎকার করিয়া বলিল, ‘আমার ঘরে শাশুড়ীও নাই ননদীও নাই। আমি কুন বেটারে ডরাই না। নিৰ্ভয়েই কই, তুই আয়। বাপের ঘরের হইয়া থাকিস তো, অখনই আয়। আশপড়সীর সামনে দিনে পরেই তরে আমি ঘরে নিতে পারি, তুই আয়।’

তার গলা শুনিয়া মঙ্গলার বউ, দয়ালচাঁদের বিধবা ভগিনী, কালোবরণের মা সকলেই বাহির হইল। তার চীৎকারের কারণ শুনিয়া ওদিকে মঙ্গলার ছেলে মহন, রামদয়াল গুরুদয়াল তারা দুই ভাই, লাঠি লইয়া ছুটিয়া আসিল। কিন্তু অশ্বিনী ততক্ষণে পাড়া ছাড়াইয়া বাজারে পা দিয়াছে।

‘কিরে মহন, কি অ সাধুরবাপ মধুরবাপ! ইটা আমার বাপের দেশ ভাইয়ের দেশ। ইখানে আমি কারুরে ডরাইয়া কথা কই না। ইখানে আমারে যেজন আজ্‌নাইব, এমন মানুষ মার গর্ভে রইছে। আমার কথা ছাড়ান দেও, আমি কই মালোপাড়ার কথা। দিনে দিনে কি হইল কও দেখি।’

রামদয়াল গুরুদয়াল সকলেই খুব চটিল এবং পাড়ার লোককেও চটাইল, আর তাকে সমুচিত শাস্তি দিবে বলিয়া সকলে সঙ্কল্পও করিল। কিন্তু যাত্রার মহড়াতে সে যখন দরাজ গলায় গানে টান দিল, ‘হরির নামে মজে হরি বলে ডাক, অবিরাম কেন কাঁদবে বেটী-ঈ-ঈ-।’ তখনই মালোদের রাগ পড়িয়া গেল। কেবল মোহনের মনে সুবলার বউয়ের কথাগুলি জ্বলন্ত অঙ্গারের মত জ্বলজ্বল করিতে লাগিল।

মালোদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি ছিল। গানে গল্পে প্রবাদে এবং লোকসাহিত্যের অন্যান্ত মালমসলায় সে সংস্কৃতি ছিল অপূর্ব। পূজায় পার্বণে, হাসি ঠাট্টায় এবং দৈনন্দিন জীবনের আত্মপ্রকাশের ভাষাতে তাদের সংস্কৃতি ছিল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। মালো ভিন্ন অপর কারে পক্ষে সে সংস্কৃতির ভিতরে প্রবেশ করার বা তার থেকে রস গ্রহণ করার পথ সুগম ছিল না। কারণ মালোদের সাহিত্য উপভোগ আর সকলের চাইতে স্বতন্ত্র। পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত তাদের গানগুলি ভাবে যেমন মধুর, সুরেও তেমনি অন্তরস্পর্শী। সে ভাবের, সে সুরের মর্ম গ্রহণ অপরের পক্ষে স্বসাধ্য নয়। ইহাকে মালোর প্রাণের সঙ্গে মিশাইয়া নিয়াছিল, কিন্তু অপরে দেখিত ইহাকে বিক্রপের দৃষ্টিতে। আজ কোথায় যেন তাদের সে সংস্কৃতিতে ভাঙ্গন ধরিয়াছে। সেই গানে সেই সুরে প্রাণ ভরিয়া তান ধরিলে চিত্তের নিভৃতিতে ভাব যেন আর আগের মত দানা বাধিতে চায় না, কোথায় যেন কিসের একটা বজ্রদূঢ় বন্ধন শ্লথ হইয়া খুলিয়া খুলিয়া যায়। যাত্রার দল যেন কঠোর কুঠারাঘাতে তার মূলটুকু কাটিয়া দিয়াছে।

অনেকেই নিরাশ হইয়া কালের স্রোতে গাঁ ভাসাইয়া দিল। নিরাশ হইল না কেবল মোহন। তার গলা ভাল। গানেও সে অনুরাগী। বাপ পিতামহের কাছ থেকে ভাটিয়ালী গান, হরিবংশ গান, নামগান অনেক শিখিয়াছিল। অধুনা মালোর সে সব গান ভুলিয়া যাইতেছে। নূতন ধরণের হাল্কা ভাবের হাল্কা কবির গান আসিয়া সে সব গাম্ভীর্যপূর্ণ, প্রাণময়, ভাব-সম্পদময় গানের স্থান অধিকার করিতেছে। এ দুঃখ সে মনের গভীরে বহুদিন অনুভব করিয়াছে। কিন্তু কালের স্রোত রুধিবার শক্তি কার আছে। এখন কালই পড়িয়াছে এই রকম। ভাল জিনিস পুরানো হইয়া হইয়া বাতিল হইয়া যাইবে আর হালকা জিনিস আসিয়া দশজনের আসরে জাকিয়া বসিবে। সে লোক ডাকিয়া খঞ্জনি ও রসমাধুরী যন্ত্র লষ্টয়া দুপুর বেলাতেই গান গাহিতে বসিল।

কিন্তু তারা যখন গাহিল, ‘গউর রূপ অপরূপ দেখলে না যায় পাসর। আমি, গিয়াছিল সুরধুনী, ডুবল তুই নয়নতারা।’ তখন অপর দুইজন মালোরছেলে আর দুইটি যুগী ছেলের সঙ্গে সুর মিলাইয়া পাশের বাড়ির উঠান হইতে তারস্বরে গাহিয়া উঠিল, ‘সাজ সাজ সৈন্যগণ সাজ সমরে। তোমরা যত সৈন্যগণ যুদ্ধের কর আয়োজন, সাজ সাজ সৈন্যগণ সাজ সমরে।’ দেখিয়া মোহনের মনে খেদ উপস্থিত হইল যে, তার গান ঐ গানের মধ্যে কোথায় তলাষ্টয়া যাইতেছে। তার দলের লোকেরাও যেন অন্তমনা হইয়া গিয়াছে। মনে মনে যেন সেই গানেরই তারিফ করিতেছে। আজকাল দুপুরবেলা আর গান জমে না, এই বলিয়া তারা বৈঠক ভাঙ্গিয়া উঠিয়া পড়িল।

কিন্তু এখনো পর্যন্ত যাহা শুনিতে বাকি ছিল, একদিন বৈকালে তাহাও শুনিতে পাওয়া গেল; আজ রাতে যাত্রার নূতন পালার মহড়া হইবে কালোবরণের বাড়িতে।

মালোদের এখনো যারা নিজেদের সংস্কৃতিকে বাঁচাইতে তৎপর তারা শুনিয়া হায় হায় করিতে লাগিল। কেউ কেউ কালোবরণকে গিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিল; দেখ বেপারী, মালোপাড়ার যারা মাথা, সেই দয়ালচাঁদ, কৃষ্ণচন্দ্র, হরিমোহন সবইত যাত্রার দিকে ঝু কিয়াছে। ছিলাম এক, হইয়া গেলাম দুই, নিত্য রেষারেষি, নিত্য খোচাখুচি। কোন দিন আমরা নিজেরাই লগি-বৈঠা লইয়া মারামারি করিতে লাগিয়া যাইব তার ঠিক নাই। মালো পাড়ার মাথায় যারা এই বজ্র ডাকিয়া আনিল, শেষ পর্যন্ত তুমি তাদের পথেই পা বাড়াইলে। না বেপারী, তুমি আমাদের দলে থাক। চল, মাতবরদের বুঝাইয়া সুঝাইয়া আবার মালোপাড়াতে আগের মত একতা ফিরাইয়া আনি। আমরা যাত্রা গাহিব কেন। আমাদের কি গান নাই! ময়-মুরুবিবর কি আমাদের জন্য গান কিছু কম রাখিয়া গিয়াছে। সে সব গানের কাছে যাত্রা গানতো বাদী। সামনে ঘোর দুর্দিন দেখিতেছি। যাত্রা লইয়া পাড়াতে যাহা শুরু হইয়াছে, তাহার শেষ না জানি কত ভয়ানক হইবে, সেই চিন্তাই করি। এখন তুমিই ভরসা। আজ তোমার বাড়িতে যাত্রা গাহিয়া যাওয়ার অর্থই সারা মালোপাড়ার বুকের উপর বসিয়া যাত্রা গাহিয়া যাওয়া।

কিন্তু কালোবরণ কথাগুলি শুনিয়াও যেন শুনিল না এইরকম ভাব দেখাইয়া চুপ করিয়া রহিল।

তারা ক্ষুন্নমনে ফিরিয়া আসিল।

‘অ, মহন, আ মনমহন, আর ভরসা নাই। কালনাগে দেখি তারেও খাইছে।’

মনমোহন নিস্তেজ কণ্ঠে বলিল, আমাদিগকে ফেলিয়া সকলেই লঙ্কা পার হইতেছে। দয়ালচাঁদ গিয়াছে, কৃষ্ণচন্দ্র গিয়াছে। গৌরকিশোর গিয়াছে, কালোবরণও গেল। সব যাইবে।

না না, মহন, সব যাইব না। সুবলার বউয়ের দৃঢ় কণ্ঠস্বরে সকলেই যেন সচকিত হইয়া উঠিল।

—দয়ালচাঁদ গিয়াছে, কৃষ্ণচন্দ্র গিয়াছে। আরে মহন, তুইত যাস নাই। তুই আছিস, সাধুর বাপ মধুর বাপ আছে। ছ’কুড়ি ঘরের তিনকুড়ি গিয়াছে। আরো ত তিনকুড়ি আছে। এই নিয়াই আমরা শেষ পর্যন্ত টিকিয়া থাকিব। বেনালে বেঘোরে আমরা গাঁ ভাসাইব না। যে ক’ ঘর থাকিবে, তাই নিয়া আমরা শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করিয়া যাইব। মালোপাড়াতে যারা বিপদ ডাকিয়া আনিয়াছে, এক গুয়া কাটিয়া যারা দুইভাগ করিয়াছে, আমরা কিছুতেই তাদের নিকট নতি স্বীকার করিব না। কালোবরণ বেপারীর বাড়িতে আজ যদি যাত্রা দেয় ত, তোর বাড়িতেও আসর জমা। আজ একটা পরীক্ষা হইয়া যাক।

সুবলার বউ মোহনকে লইয়া বসিল। দুইজনেই স্মৃতির হয়ার খুলিয়া যে সকল ভাল ভাল গান বিস্মরণ হইয়াছিল, মনের মধ্যে সেগুলিকে ডাকিয়া আনিল। তারমধ্যে আবার যেগুলি খুব জমে, সেগুলিকে লইয়া মুখে মুখে একটা তালিকা প্রস্তুত করিল।

এই-এইগুলি বিচ্ছেদ গান। দেহতত্ত্বের পরেই গাইবি। আর নিশি-রাতে গাইবি ভাইট্যাল গান। হরিবংশ গাইবি রাত পোহাইবার অল্প বাকি থাকতে। ভোরে ভোরগান আর সকালে গোষ্ঠগান গাইয়া তারপর মিলন গাইয়া আসর ভঙ্গ করবি।