বুদ্ধ অথবা কার্ল মার্কস
কার্ল মার্কস
(৫ মে ১৮১৮-১৪ মার্চ ১৮৮৩) ছিলেন একজন জার্মান দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক এবং বিপ্লবী সমাজবাদী। অর্থনীতিতে মার্ক্সের কাজ বতর্মান যুগে প্রচলিত শ্রম ও পুঁজির সাথে তার সম্পর্ককে বোঝার ভিত্তি এবং পরবর্তী যুগের অর্থনৈতিক ভাবনা-চিন্তাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে। জীবদ্দশাতেই কার্ল মার্কস অসংখ্য বই প্রকাশ করেছেন, এবং সেসবের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত বইগুলো হলো: ‘দ্য কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো-১৮৪৮’ এবং ‘ডাস ক্যাপিটাল (১৮৬৭- ১৮৯৪)।’ প্রুশিয়ান রাইনল্যান্ডের ট্রিয়েরের এক স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিয়ে ‘ইউনিভার্সিটি অফ বন’ এবং ‘ইউনিভার্সিটি অফ বার্লিন’-এ তিনি পড়াশোনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই তিনি তরুণ হেগেলীয়দের দার্শনিক ভাবনা-চিন্তায় আগ্রহী হন। পড়াশোনা শেষে, মার্কস কোলন শহরের এক বিপ্লবী সংবাদপত্রের জন্য লিখতে থাকেন এবং তাঁর নিজের তত্ত্ব ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে’র উপর কাজ করা শুরু করেন। ১৮৪৩ সালে তিনি পারি শহরে যান যেখানে মার্কস অন্যান্য নানা বিপ্লবী সংবাদপত্রের জন্য লিখতে শুরু করেন এবং সেখানেই তাঁর সাথে দেখা হয় ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলসের, যিনি পরবর্তী সময়ে মার্ক্সের সারা জীবনের বন্ধু ও সহযোগী হয়ে যাবেন। ১৮৪৯ সালে মার্কস নির্বাসিত হন এবং তখন তিনি লন্ডনে স্ত্রী ও সন্তান- সন্ততি সহ পাড়ি জমান। লন্ডনে তিনি তাঁর লেখালেখি অব্যাহত রাখেন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাঁর তত্ত্বাদি পরিগঠন করা শুরু করেন। একইসাথে তিনি সমাজতন্ত্রের জন্য প্রচারণা শুরু করেন এবং ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংসদ’-এ একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন।
সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনীতি বিষয়ে মার্ক্সের তত্ত্বসমূহ- সামগ্রিকভাবে যা মার্কসবাদ নামে পরিচিত- একথাই বলে যে মানব সমাজ মূলত: শ্রেণিসংঘাতের মাধ্যমে অগ্রসর হয়: উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণকারী সমাজের অধিপতি শ্রেণি এবং অধিকারহারা শ্রমিক শ্রেণি যারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রম দান করেন, এই উভয়ের দ্বন্দের মধ্য দিয়েই সমাজ অগ্রসর হয়। পুঁজিবাদকে মার্কস আখ্যায়িত করেছিলেন বুর্জোয়াদের একনায়কত্ব’ বলে, এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে এই ব্যবস্থাটি পুঁজিপতি শ্রেণি চালায় নিজস্ব লাভের লক্ষ্যেই, মার্কস আরো পূর্বানুমান করেছিলেন যে অতীতের সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলোর মতো পুঁজিবাদও তৈরি করে অনেক অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা যা আত্ম-বিনাশ ডেকে আনবে এবং নতুন আর একটি ব্যবস্থা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে। তিনি আরো যুক্তি দেখান যে পুঁজিবাদের আওতায় বুর্জোয়া এবং সর্বহারার ভেতরকার এই দ্বন্দ্ব কালক্রমে সর্বহারাশ্রেণি কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিকার এবং ‘সর্বহারাশ্রেণির একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শেষ হবে এবং কালক্রমে একটি শ্রেণিহীন সমাজ ব্যবস্থা, সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ এবং উৎপাদনকারীদের মুক্ত সংসদ কর্তৃক পরিচালিত একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে। সমাজতন্ত্র এবং সাম্যবাদের অপরিহার্যতায় বিশ্বাসের পাশাপাশি মার্কস তাদের বাস্তবায়নের জন্যও সক্রিয় ভাবে লড়াই করেছেন এবং এই লক্ষ্যে তর্ক করেছেন যে সমাজতাত্ত্বিক এবং সুযোগবঞ্চিত মানুষদের উচিত সংগঠিত বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে বহন করে পুঁজিবাদের পতন ঘটানো এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক পালা-বদল আনা।
মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী চরিত্রসমূহের একজন হিসেবে কার্ল মার্কস বর্ণিত। মার্কসবাদকে সমর্থন করা বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী সরকারগুলো বিশ শতকে পৃথিবীর নানা দেশে ক্ষমতা দখল করে, এবং এজাতীয় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর ভেতর সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯২২) এবং গণপ্রজতান্ত্রী চীনের (১৯৪৯) নাম করা যায়। অসংখ্য শ্রমিক ইউনিয়ন এবং শ্রমিকশ্রেণির রাজনৈতিক দল বিশ্ব জুড়ে মার্কসবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে এবং লেনিনবাদ, স্টালিনবাদ, ট্রটস্কিবাদ এবং মাওবাদের মতো তত্ত্বগুলো মূলত মার্কসবাদ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। এমিল ডুরখেইম এবং ম্যাক্স ওয়েবারের সাথে মার্কসকেও আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের তিন প্রধান স্থপতির একজন মনে করা হয়।