তৃতীয় দৃশ্য
বিজয়ার বাড়ির নীচে হলঘর
[বেলা পূর্বাহ্ন। বিজয়ার অট্টালিকার নীচের বড় ঘরটি ফুল-লতা-পাতা দিয়া কিছু কিছু সাজানো হইয়াছে, মাঝখানে দাঁড়াইয়া রাসবিহারী ও বিলাসবিহারী এই-সকল পরীক্ষা করিতেছিলেন, এমন সময়ে সদ্যসমাগত অতিথিগণ একে একে প্রবেশ করিলেন]
রাসবিহারী। (বদ্ধাঞ্জলিপূর্বক) স্বাগতম্! স্বাগতম্! আজ শুধু এই গৃহ নয়, আজ আমাদের সমস্ত গ্রামখানি আপনাদের চরণধূলিতে চরিতার্থ হলো। আজ আমি ধন্য। আপনার আসন গ্রহণ করুন।
১ম। আমরাও তেমনি ধন্য হয়েছি রাসবিহারীবাবু, এমন পুণ্যকর্মে আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দিতে পারা জীবনের সৌভাগ্য।
রাস। পথে কোন ক্লেশ হয়নি ত?
সকলে। না না, কিছুমাএ না। কোন ক্লেশ হয়নি।
রাস। হবার কথাও নয় যে। এ যে তাঁর সেবা তাঁর কর্ম নিয়েই আপনাদের আগমন,—মানবজাতির পরম কল্যাণের জন্যই ত সকলে সমবেত হয়েছি।
১ম ব্যক্তি। ওঁ স্বস্তি! ওঁ স্বস্তি! ওঁ স্বস্তি!
রাস। স্বর্গগত বনমালীর কন্যা বিজয়া এবং তাঁর ভাবী জামাতা বিলাসবিহারী—এ মঙ্গল অনুষ্ঠান তাঁদেরই। আমি কেউ নয়—কিছুই নয়। শুধু চোখে দেখে পুণ্য সঞ্চয় করে যাব এই আমার একমাত্র বাসনা। বাবা বিলাস, মা বিজয়া বুঝি এখনও খবর পাননি। কালীপদকে ডেকে বলে দাও পূজনীয় অতিথিরা পৌঁচেছেন।
বিলাস। কিন্তু খবর পাওয়া তাঁর উচিত ছিল।
[বিলাসের প্রস্থান
২য় ব্যক্তি। শুনেছি দয়ালবাবু ইতিপূর্বেই এসেচেন, কৈ তাঁকে ত—
রাস। দুর্ভাগ্যক্রমে এসেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আজ ভাল আছেন। তিনি এলেন বলে।
১ম ব্যক্তি। আচার্যের কাজ ত?—
রাস। হাঁ তিনিই সম্পাদন করবেন স্থির হয়েছে—এই যে নাম করতেই তিনি—আসুন, আসুন, দয়ালবাবু আসুন। দেহটা সুস্থ হয়েছে?
[দয়ালচন্দ্রের প্রবেশ ও সকলকে অভিবাদন]
শরীর দুর্বল, নিজে গিয়ে সংবাদ নিতে পারিনি, কিন্তু ওঁর কাছে (ঊর্ধ্বমুখে চাহিয়া) নিরন্তর প্রার্থনা করছি আপনি শীঘ্র নিরাময় হন, শুভকর্মে যেন বিঘ্ন না ঘটে।
[ইহার পরে কিয়ৎকাল ধরিয়া সকলের কুশল-প্রশ্নাদি ও প্রীতিসম্ভাষণ চলিল। সকলে পুনরায় উপবেশন করিলে]
রাস। আমার আবাল্য সুহৃদ বনমালী আজ স্বর্গগত। ভগবান তাঁকে অসময়ে আহ্বান করে নিলেন—তাঁর মঙ্গল ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার নালিশ নেই, কিন্তু তিনি যে আমাকে কি করে রেখে গেছেন আমার বাইরে দেখে সে আপনারা অনুমান করতে পারবেন না। আমাদের উভয়ের সাক্ষাতের ক্ষণটি যে প্রতিদিন নিকটবর্তী হয়ে আসছে সে আভাস আমি প্রতিমুহূর্তেই পাই। তবুও সেই পরমব্রহ্মপদে এই প্রার্থনা আমার, সেই দিনটিকে যেন তিনি আরও সন্নিকটবর্তী করে দেন। (রাসবিহারী জামার হাতায় চোখটা মুছিয়া আত্মসমাহিতভাবে রহিলেন। উপস্থিত অভ্যাগতরাও তদ্রূপ করিলেন। আবার কিছুকাল চুপ করিয়া থাকিয়া) বনমালী আমাদের মধ্যে আজ নেই—তিনি চলে গেছেন; কিন্তু আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই, ওই তিনি মৃদু মৃদু হাস্য করছেন। (সকলেই চোখ বুজিলেন। এই সময় বিজয়া ও বিলাস প্রবেশ করিলেন। বিজয়ার মুখের উপর বিষাদ ও বেদনার চিহ্ন ঘনীভূত হইয়া উঠিয়াছে তাহা স্পষ্ট দেখা যায়) ওই তাঁর একমাত্র কন্যা বিজয়া, পিতার সর্বগুণের অধিকারিণী! আর ঐ আমার পুত্র বিলাসবিহারী, কর্তব্যে কঠোর, সত্যে নির্ভীক। এঁরা বাইরে এখনো আলাদা হলেও অন্তরে—হাঁ আরও একটি শুভদিন আসন্ন হয়ে আসছে, যেদিন আবার আপনাদের পদধূলির কল্যাণে এঁদের সম্মিলিত নবীন জীবন ধন্য হবে।
দয়াল। (অস্ফুটস্বরে) ওঁ স্বস্তি!
রাস। মা বিজয়া, ইনিই তোমার মন্দিরের ভাবী আচার্য দয়ালচন্দ্র, এঁকে নমস্কার কর। আর এঁরা তোমার সম্মানিত পূজনীয় অতিথিগণ, এঁরা বহু ক্লেশ স্বীকার করে তোমাদের পুণ্যকার্যে যোগ দিতে এসেছেন,—এঁদের সকলকে নমস্কার কর।
[বিজয়া হাত তুলিয়া নমস্কার করিল। বৃদ্ধ দয়াল বিজয়ার কাছে গিয়া দাঁড়াইলেন। হাত ধরিয়া বলিলেন।]
দয়াল। এসো মা, এসো। মুখখানি দেখলেই মনে হয় যেন মা আমাদের কতকালের চেনা!
[এই বলিয়া টানিয়া নিজের পাশে বসাইলেন—অনেকে মুখ টিপিয়া হাসিল]
রাস। দয়ালবাবু, আমার সহোদরের অধিক স্বর্গীয় বনমালীর এই শুভকর্ম—একমাত্র কন্যার বিবাহ—চোখে দেখে যাবার বড় সাধ ছিল, শুধু আমার অপরাধেই তা পূর্ণ হতে পারেনি। (কিছুকাল নীরব থাকিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া) কিন্তু এবার আমার চৈতন্য হয়েছে, তাই নিজের শরীরের দিকে চেয়ে এই আগামী অঘ্রাণের বেশি আর বিলম্ব করবার সাহস হয় না। কি জানি আমিও না পাছে চোখে দেখে যেতে পারি।
দয়াল। (অস্ফুটস্বরে) ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি!
রাস। (বিজয়ার প্রতি) মা, তোমার বাবা, তোমার জননী সাধ্বী সতী বহু পূর্বেই স্বর্গারোহণ করেছেন, নইলে এ কথা আজ আমার তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে হতো না। লজ্জা করো না মা, বল আজ এইখানেই আমাদের এই পূজনীয় অতিথিগণকে আগামী অঘ্রাণ মাসেই আবার একবার পদধূলি দানের আমন্ত্রণ করে রাখি।
বিজয়া। (অব্যক্ত-কণ্ঠে) বাবার মৃত্যুর এক বৎসরের মধ্যেই কি—(কথা বাধিয়া গেল)
রাস। ওহো—ঠিক ত মা, ঠিক ত। এ যে আমার স্মরণ ছিল না। কিন্তু তুমি আমার মা কিনা, তাই এ বুড়ো ছেলের ভুল ধরিয়ে দিলে। (বিজয়া আঁচলে চোখ মুছিল) তাই হবে। কিন্তু তারও ত আর বিলম্ব নেই। (সকলের দিকে চাহিয়া) বেশ আগামী বৈশাখেই শুভকর্ম সম্পন্ন হবে। আপনাদের কাছে এই আমাদের পাকা কথা রইল। বিলাসবিহারী, বাবা বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে, এঁদের ও-বাড়িতে যাবার ব্যবস্থা করে দাও। আসুন আপনারা।
[বিজয়া ব্যতীত সকলেই প্রস্থান করিলেন, দয়াল ক্ষণকাল পরেই ফিরিয়া আসিলেন]
দয়াল। মা বিজয়া!
বিজয়া। (চমকিত হইয়া নিজেকে সংবরণ করিয়া) আসুন।
দয়াল। এঁরা সবাই দিঘ্ড়ার বাড়িতে চলে গেলেন। বিলাসবাবু তাঁদের ব্যবস্থা করে দিয়ে তাঁর আফিসঘরে গিয়ে ঢুকলেন। আমাকেও সঙ্গে যেতে বলেছিলেন, কিন্তু যেতে আমার ইচ্ছে হলো না—ভাবলুম এই অবসরে মা বিজয়ার সঙ্গে দুটো কথা কয়ে নিই। (এই বলিয়া নিজে একটা চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন) দাঁড়িয়ে কেন মা, তুমিও বসো।
বিজয়া। (সম্মুখের আসনে উপবেশন করিয়া শঙ্কিত-কণ্ঠে কহিল) আপনি গেলেন না কেন? আপনার ত বেলা হয়ে যাবে!
দয়াল। তা যাক। একটু বেলাতে আর আমার ক্ষতি হবে না। তোমার সঙ্গে দু’দণ্ড কথা কইবার লোভ সামলাতে পারলুম না। অনেক দেখেছি, কিন্তু তোমার মত অল্প বয়সে ধর্মের প্রতি এমন নিষ্ঠা আমি দেখিনি। ভগবানের আশীর্বাদে তোমাদের মহৎ উদ্দেশ্য দিনে দিনে শ্রীবৃদ্ধি লাভ করুক। কিন্তু মা, তোমার মুখ দেখে মনে হলো যেন মনে তোমার আজ সুখ নেই। কেমন মা?
বিজয়া। কি করে জানলেন?
দয়াল। (মৃদু হাসিয়া) তার কারণ আমি যে বুড়ো হয়েছি মা! ছেলেমেয়ে অসুখী থাকলে বুড়োরা টের পায়।
বিজয়া। কিন্তু সকলেই ত টের পায় না দয়ালবাবু।
দয়াল। তা জানিনে মা। কিন্তু আমার ত তাই মনে হলো। এর জন্যেই চলে যেতে পারলুম না। আবার ফিরে এলুম।
বিজয়া। ভালই করেছেন দয়ালবাবু।
দয়াল। কিন্তু একটা বিষয়ে সাবধান করে দিই। বুড়োরা বকতে বড় ভালবাসে—ইচ্ছে করে তোমার কাছে বসে খুব খানিকটা বকে নিই, কিন্তু ভয় হয় পাছে বিরক্ত করে তুলি।
বিজয়া। না—না, বিরক্ত হব কেন? আপনার যা ইচ্ছে হয় বলুন না—শুনতে আমার ভালই লাগছে।
দয়াল। কিন্তু তাই বলে বুড়োদের অত প্রশ্রয়ও দিয়ো না মা। থামাতে পারবে না। আরও একটা হেতু আছে। আমার একটি মেয়ে হয়ে অল্প বয়সেই মারা যায়—বেঁচে থাকলে সে তোমার বয়সই পেতো। তোমাকে দেখে পর্যন্ত কেবল আমার তাকেই আজ মনে পড়ছে।
বিজয়া। আপনার বুঝি আর মেয়ে নেই?
দয়াল। মেয়েও নেই, ছেলেও নেই, শুধু বুড়ো-বুড়ী বেঁচে আছি। একটি ভাগনীকে মানুষ করেছিলুম, তার নাম নলিনী। কলেজের ছুটি হয়েছে বলে সেও আমার সঙ্গে এসেছে। একটু অসুস্থ নইলে—
[সহসা বিলাস প্রবেশ করিল]
বিলাস। (বিজয়ার প্রতি কঠিনভাবে) তাঁরা চলে গেলেন, তুমি একটা খোঁজ পর্যন্ত নিলে না? একে বলে কর্তব্যে অবহেলা। এ আমি অত্যন্ত অপছন্দ করি। (দয়ালের প্রতি ততোধিক কঠোরভাবে) আপনাকে বলেছিলুম ওঁদের সঙ্গে যেতে। না গিয়ে এখানে বসে গল্প করচেন কেন?
দয়াল। (অপ্রতিভভাবে) মা’র সঙ্গে দুটো কথা কইবার জন্যে—আচ্ছা, আমি তা হলে যাই এখন।
বিজয়া। না, আপনি বসুন। বেলা হয়ে গেছে, এখানে খেয়ে তবে যেতে পাবেন। (বিলাসের প্রতি) উনি সঙ্গে গেলে তাঁদের কি বেশী সুবিধে হতো?
বিলাস। তাঁদের দেখাশুনা করতে পারতেন।
বিজয়া। সে ওঁর কাজ নয়। তাঁদের মত দয়ালবাবুও আমার অতিথি।
বিলাস। না, ওঁকে অতিথি বলা চলে না। এখন উনি এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত। ওঁকে মাইনে দিতে হবে।
বিজয়া। (ক্রোধে মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল কিন্তু শান্ত-কঠিনকণ্ঠে কহিল) দয়ালবাবু আমাদের মন্দিরের আচার্য। ওঁর সে সম্মান ভুলে যাওয়া অত্যন্ত ক্ষোভের ব্যাপার বিলাসবাবু।
বিলাস। (কটুকণ্ঠে) সে সম্মানবোধ আমার আছে, তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না। কিন্তু দয়ালবাবু শুধু আচার্যই নন, ওঁর অন্য কাজও আছে। সে স্বীকার করেই উনি এসেছেন।
দয়াল। (ব্যস্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইয়া) মা, আমার অপরাধ হয়ে গেছে, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।
বিজয়া। না, আপনি বসুন, আপনাকে খেয়ে যেতে হবে। আর মাইনে ত উনি দেন না, দিই আমি। আমার সঙ্গে দু’দণ্ড গল্প করাটাকে আমি যদি অকাজ না মনে করি, তবে বুঝতে হবে আপনার কর্তব্যে ত্রুটি হয়নি। বিলাসবাবুর কর্তব্যের ধারণা যাই কেন না হোক।
বিলাস। না, কর্তব্যের ধারণা আমাদের এক নয়। এবং তোমাকে বলতে আমি বাধ্য যে তোমার ধারণা ভুল।
বিজয়া। তা হলে সেই ভুল ধারণাটাই আমার এখানে চলবে বিলাসবাবু।
বিলাস। তোমার ভুলটাকেই আমায় স্বীকার করে নিতে হবে নাকি?
বিজয়া। স্বীকার করে নিতে ত আমি বলিনি, আমি বলেচি সেইটেই এখানে চলবে।
বিলাস। তুমি জানো এতে আমার অসম্মান হয়।
বিজয়া। (অল্প হাসিয়া) সম্মানটা কি কেবল একলা আপনার দিকেই থাকবে নাকি?
দয়াল। (ব্যস্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইয়া) মা, এখন আমি যাই, দেখি গে তাঁদের কোন অসুবিধা হচ্ছে নাকি।
বিজয়া। না, সে হবে না। আমাদের গল্প এখনও শেষ হয়নি। আপনি বসুন।(একটু উচ্চকণ্ঠে) কালীপদ!
কালীপদ। (দ্বারের কাছে মুখ বাড়াইয়া সাড়া দিল) কি মা?
বিজয়া। পরেশের মাকে বলো গে দয়ালবাবু এখানে খাবেন। আমার শোবার ঘরের বারান্দায় তাঁর ঠাঁই করে দিতে বলে দাও। চলুন দয়ালবাবু, আমরা ওপরে গিয়ে বসি গে।
[বিজয়া ও তাহার পিছনে দয়ালবাবু সভয়-মন্থরপদে প্রস্থান করিলেন। বিলাস সেইদিকে ক্ষণকাল আরক্তনেত্রে চাহিয়া বাহির হইয়া গেল]