» » আভা ও তার প্রথম পুরুষ

বর্ণাকার

তিন

ভাবলাম, আভা হয়ত লুকোচুরি খেলছে। নিজেকে বিলিয়ে দেবার জন্য হয়ত আড়ালে গিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। যৌবনের প্রথম সমর্পন। নারী চিরকাল রহস্যময়ী। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষিতা নারী পা টিপে টিপে প্রেমের পথে এগিয়ে আসে। শুধু হৃদয়ের উন্মোচন নয়, দেহাবরণের নির্লজ্জ উন্মোচন। শরমে-ঢাকা অনাস্বাদিত দেহের কামনা। প্রথম নগ্ন আলিঙ্গন— প্রথম সোহাগ চুম্বন আর প্রথম যৌন-আস্বাদন। কামনা যন্ত্রণায় মোহের বশে বুনোতৃপ্তির পরিণতি কি, জীবনের অনাবিল বাস্তব সাথী করে থাকবে কি— এতসব ভাবতে হয় নারীকে— নারীর কুমারীত্ব হারাবার শেষ মুহূর্ত্তেও ও সব ভাবতে হয় তাকে।

আভা পরিপূর্ণ। কানায় কানায় ভর্ত্তি ওর যৌবন। শুধু ভর্ত্তি নয়, সে যৌবনে যৌন অতৃপ্তির প্রচণ্ড প্লাবন। ওর প্রতি অঙ্গে কামনার করুণ-কান্না। ও পারছে না— নিজেকে কিছুতেই ধরে রাখতে পারছে না। যৌবনের বাঁধ-ভাঙ্গা বন্যায় ও প্লাবিত হবেই। প্রস্ফুটিত যৌবনের সাধারণ ধর্ম্ম থেকে ও কি করে মৃতের মত নিশ্চল আর নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকবে?

আভা বলেছে, পছন্দ করা প্রিয় অতিথি আমি। ও আমায় পছন্দ করে সাদর জানিয়ে এমন এক প্রাসাদে এনেছে যেখানে ও সর্ব্বেসর্ব্বা রাজকুমারী। ও মন-প্রাণ দিয়ে চেয়েছে— অথচ দেহ দিয়ে একাত্ম করে নিতে পারছে না কেন? ঠুনকো লজ্জা, পেয়ে হারাবার ভয়, কুমারীত্বের প্রথম ক্ষয়-ক্ষতির যন্ত্রণা— পুরুষ দেহের প্রচণ্ড নিপীড়ন। তারপর? আভা হয়ত ভাবতে পারছে না। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার কাছে।

তবু যৌবনের কান্না কতকাল থামিয়ে রাখবে সে? সে কান্না সরব হবেই— সে কান্নায় অভিভূত তাকে হ’তেই হবে। সে কান্না চিরকাল সভ্য নরনারীকে অসভ্য করে, বুনো ঝাপটায় পশু করে। যৌবনের সেই পশুত্বই ত সৃষ্টিকে রেখেছে আজও বাঁচিয়ে।

আভা আসবে— এখুনি নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। হয়ত দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে যৌবনের কান্নায় সে অস্থির হয়ে উঠেছে এতক্ষণে। আড়ালে থেকে ও হয়ত অনুভব করছে আমার প্রতিক্রিয়া। কান পেতে শুনছে আমার জীবনের অস্থিরতার চাপা কান্না। ও দাঁড়িয়ে আছে — দরজার ওপাশে নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে আছে। কারণ ওযে অশান্ত — ওযে অতৃপ্ত।

দরজার পাশে এগিয়ে গেলাম। আমার আগমন সাড়া পেয়ে  ও দরজা খুলে দেবে আর আবক্ষ টেনে নেব তাকে সবল বাহুতে। চুম্বনে সোহাগে ভরে দেব ওর বলিষ্ট কপোল।

কিন্তু দরজা বন্ধ। আস্তে আস্তে ধাক্কা মেরে ওর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। মৃদু স্বরে বললাম, আভা, দরজা খোল। এমন নিষ্ঠুর তুমি হবে কেন?

কোন উত্তর ফিরে এলো না। সাড়া মিলল না ওর। অগত্যা ফিরে এলাম বিছানায়। জানলা পথে বাইরের জগতের প্রতি দৃষ্টি দিলাম। চোখে পড়ল একজোড়া পায়রার প্রণয়-মধুর মাখামাখির দৃশ্য। আহা! ওরা মুক্ত। আমি শুধু আভার শয়ন কক্ষে এক অশান্ত বন্দী।

অনেক, অনেকক্ষণ কেটে গেল। কিন্তু আভা এলো না। অগত্যা মর্ম্মাহত হৃদয়ে ওর সুকোমল পালঙ্কে গা এলিয়ে দিলাম। তৃপ্তির দুয়ারে অতৃপ্তির দুঃসহ যন্ত্রণা! যৌবনে উষ্ণ স্রোত বইয়ে, সর্ব্বাঙ্গে জ্বালা ধরিয়ে দিয়ে আভা এমনি করে চলে গেল? কেন ও কাছে থাকলো না? একান্ত করে পাবার চরম মুহূর্ত্ত সৃষ্টি করে ও আমাকে কাঙ্গাল করে রেখে গেল। তবু শুয়ে শুয়ে নিজেকে প্রবোধ দিলাম। সামান্য কয়েক ঘণ্টার পরিচয়। অধিকারের কোন প্রশ্নই জাগে নি। শুধু অনুকূল আবহাওয়ায় মহাসাগর পাড়ি দিয়ে সৈকত ভূমিতে পেয়েছি আশ্রয়। সেই কি কম পাওয়া!

আভা ওর প্রভা ছড়িয়েছে আর আমি মেলেছি আমার থাবা। কবে সে থাবাতলে ওর পূর্ণ আত্মাহুতি হবে, কে জানে?

আভা বলেছে, “আমি এত সহজ লভ্যা?” সত্যি অতি সহজে যাকে পাওয়া যায় তার যে হারিয়ে যাবার ভয় অনেক।

কক্ষ-অভ্যন্তরে সব কিছু লক্ষ্য করলাম। দামী দামী আসবাপত্রে সাজানো গোছানো। এমন এক সম্ভারবহুল কক্ষে আমার অবস্থান। নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে হল। মনে হল এ প্রসাদ যেন আমার— এর বিপুল বিত্তের মালিক আমি। কিন্তু তারপরই সবকিছু স্বপ্নময় ধোঁয়াটে মনে হল। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে আমি। সামান্য সরকারী চাকুরে। কোন শুভলগ্নে মায়াকাঠির পরশ পেয়ে ও রাজপুরীতে এসে আটকা পড়েছি। আরব্য উপন্যাসের কোন মায়াবিনীর ছায়ার পেছনে আমার প্রাণান্তগতি।

নিজকে নানা ভাবে যাচাই করে দেখলাম। সশরীরে জীবন্ত আছি কিনা ঠাহর করেত পারলাম না। সবকিছু কেমন যেন আবছা আবছা মনে হল।

পাষাণবৎ নীরব প্রাসাদ। সবকিছু থাকা সত্ত্বেও প্রাণহীন, জৌলুষহীন প্রাসাদ। মহানগরীর বুকে কোলাহল থেকে গেছে। মহাবিচ্ছেদের পর নিথর, গুঁমোটবাঁধা আবহাওয়া। দিদিমা, শোভা, আভা—বয় বাবুর্চ্চি— সবাই মিশে গেছে নাকি?

ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অস্বস্তিকর হতাশ যন্ত্রণার ঘুম। হালকা স্বপ্নভরা ঘুম।

একসময় ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘড়িতে ঢং ঢং করে পাঁচটা বাজল। পশ্চিমী রোদে ভরে গেছে কক্ষের কিছু অংশ। দেওয়াল আয়নায় প্রতিবিম্বিত হয়েছে ক্লান্ত সূর্য্য। এতক্ষণে মহানগরীর কল-কোলাহল শ্রূত হল। মোটর গাড়ীর হর্ণের শব্দ, রিক্সাওয়ালার টুংটাং আওয়াজ আর মানুষের ব্যস্ততার কণ্ঠস্বর। সে সঙ্গে দু’একটা পাখির ডাক আর মিল কারখানার বাঁশীল একটানা ধ্বনি।

সুবিশাল প্রাসাদের অনুপম আরাম কক্ষ। তারই প্রশান্ত বুকে সুকোমল পালঙ্কে শুয়ে আমি আমার অস্তিত্বে সন্ধিহান হয়ে উঠেছিলাম। এ কোথায়, কোন অধিকারে এসে উঠেছি আমি? জীবনের ধারাবাহিক কর্ম্ম-ব্যস্ততা আমার স্তব্ধ হয়ে গেছে নাকি? আমি কি আলেয়ার পেছনে ছুটে এসেছি, না উল্লাসভরে নতুন পাখায় ভর করে পতঙ্গের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছি বিভীষিকার অগ্নিকুণ্ডে?

ছয়টা বাজল। বৈকালি রোদের উজ্জ্বল আভা এবারে সন্ধ্যার ছাড়া আড়ালে ফিকে হয়ে এলো। তারপর নেমে এলো আঁধারের বিপুল বন্যা।

জীবনের অবসানের মতো জীবন্ত পৃথিবীর মৃত্যু-ম্লান রূপ।

শয্যা ত্যাগ করে ওঠার গরজ নেই। বাইরের দিক থেকে দরজা বন্ধ। সুতরাং বন্দী আমি। তাই শুয়ে শুয়ে আভার আগমন প্রতীক্ষায় ছিলাম। অনেক, অনেকক্ষণ ধরেই ভাবছিলাম, ও আসবে। দুপুর বারোটা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা। দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা। ছয়টি যুগের যন্ত্রণা!

একটু পরে দরজা খোলার শব্দ পেলাম। একটু ফাঁক হল পাল্লা দুটো। কিন্তু ওই পর্য্যন্তই।

নগরীর ঘরে ঘরে তখন আলোর ছড়াছড়ি। রাস্তায় নানা রঙের আলো। আশপাশে শত সহস্র বাড়ীতে, টাওয়ারে, মিনারে অজস্র আলোর ঝিকিমিকি। কিন্তু এঘর অন্ধকার।

একবার উঠে আলো জ্বালাতে চাইলাম। কিন্তু উঠলাম না। অভিমানভরে তেমনিভাবেই শুয়ে থাকলাম। এতক্ষণেও আভা এলো না। মায়াবিনী! মায়াডোরে বেঁধে রেখে চলে গেছে। এলে শক্ত কথা শুনিয়   এ দেব।

আরও কিছুক্ষণ পরে শান্ত পদে আভা কক্ষে এলো। অন্ধকার কক্ষে। আমি ঘুমের ভান করে নিঃসার বিছানায় পড়ে রইলাম। একটু খানি এসে ও ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে রইল। জ্বাল্লোনা আলো। খোলা দরজা আর জানালা পথে বাইরের আলোয় ঘরখানা তখন খানিকটা স্বচ্ছ। আভা দূরে দাঁড়িয়েই গভীরভাবে আমার অবস্থান লক্ষ্য করলো। তারপর সন্তর্পণে কক্ষ ত্যাগ করার জন্য পা বাড়াল।

এবারে সক্রিয় হলাম। বললাম— যেয়ো না। আলো জ্বালাও।

—ও! জেগে আছ?

এক পাশে সরে গিয়ে আভা সুইচ বোর্ডে হাত দিল। আলো জ্বলে উঠলো। টিউব লাইটের শুভ্র উজ্জ্বল আলো। সে আলোয় আভাকে পরখ করে দেখলাম। কেমন এক পাগলিনীর বেশ। চুল এলোমেলো, পরিধেয় অযত্ন রক্ষিত। চোখ দুটো ফুলো ফুলো। বিষাদমাখা অচঞ্চল এক ছায়া মুর্ত্তি যেন।

উঠে এসে প্রশ্ন করলাম— কি হয়েছে, তোমার আভা?

—কই, কিছু হয়নি তো।

—বল কি! এতবড় পরিবর্তন তোমার মাঝে, অথচ বলছ, কিছু হয় নি। আশ্চর্য্য!

আভা মুখ ঘুরিয়ে নিল। বলল— ঘুমিয়ে ছিলাম, তাই—

—মিথ্যে কথা। সারা দুপুর তুমি কেঁদেছ। কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছ। এখনও তোমার চোখের কোনায় অশ্রু।

নিজেকে সজীব করে আভা একটু হাসল। তারপর অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করল। বলল— রাত হয়ে গেছে। এখানেই থেকে যাও, কেমন?

মনে মনে পুলক অনুভব করলাম। সারাদিন আভাকে কাছে না পাওয়ার অভিমান-ক্ষোভ এবারে স্বস্তি ফিরে পেল।

—কি?

নির্লজ্জের মতো বললাম— এভাবে একা থাকতে পারব না।

কোন কিছু না বলে আভা চলে গেল। তার মাঝে কোন ভাবান্তর দেখতে পেলাম না। মনে মনে নিজেকে অপরাধী ভাবলাম। ছি! ছি! এমন উলঙ্গ উক্তি শুনে আভা নিশ্চয়ই অপমান বোধ করেছে।

আহারাদির পর রাতে পৃথিবীজোড়া যুদ্ধের কথা নিয়ে আলোচনা হ’ল। অত্যন্ত প্রীতি মাখা সাবলিল ছিল তার ব্যবহার। কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত গভীর রাতে আমাকে একা রেখেই আভা পাশের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। যাবার আগে বলে গেল— শুভরাত্রি।

আমার সকল চিন্তা আর কল্পনার দুয়ারে আঘাত হেনে ও সরে গেল। বিজলী চমকের মতো উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত করে আমার জীবন আকাশকে মেঘান্ধ করে রেখে গেল। আমাকে ধরে এনে বন্দি করে ও নিজে ধরা দিতে চায় না কেন?

আমি যেন ওর খেয়াল খেলার সামগ্রী। না এখানে আর নয়। রাতখানা কেটে গেলেই দূরে সরে যাবো। মায়াবিনীর যাদু স্পর্শ থেকে মুক্ত আমাকে হতেই হবে।

রাত কেটে গেল। প্রায় বিনিদ্র ভাবেই সারাটা রাত কেটে গেল। প্রতিটি মুহুর্তে যার সান্নিধ্য কামনা করেছিলাম কামনার ইন্ধনরূপে, সে আর কাছে এলো না। হৃদয়হীনা নিষ্ঠুরা রাজকুমারী জীবনের আনাচে কানাচে শুধু তরঙ্গ তুলে মাতাল করে রেখে গেল।