দুই
দরজার পাশে গিয়ে সে উচ্চকণ্ঠে ডাকলো— বয়!
বয় বাজারে গেছে। আভার ছোট বোনটি উত্তর দিল পাশের ঘর থেকে।
—ও! একটু বসুন আপনি।
ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে আভা অন্য কক্ষে চলে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই ফিরে এসে বলল— কী যে ভুলো মন! ততক্ষণে হাতমুখ ধুয়ে নিন। কিছু নাস্তা খেয়ে দুজনে গল্প করব।
—গল্প! কী যে বলেন? আমাকে যে অফিসে যেতে হবে।
—অফিস! কোথায়?
—বালিগঞ্জের অসামরিক সরবরাহ বিভাগে। সেখান থেকে যেতে হবে লেক মার্কেটে। চাউল, চিনি, তেল, আটা প্রভৃতি বিলি করতে হবে লাইনবন্দী ক্রেতাদের কাছে।
উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আভা বললে— তাই নাকি? আপনি এত সব দুষ্প্রাপ্য খাদ্য খাবার দেবার মালিক? ভালই হলো। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে আশান্বিত হলাম।
—তার মানে?
—মানে পরে হবে। আজ আর আপনার অফিসে যাওয়া হবে না।
—তাই কি হয়! আমি না গেলে যে খাদ্য-দ্রব্যের বিলি-ব্যবস্থাই বন্ধ থাকবে। শত শত মানুষের দুর্ভোগের অন্ত থাকবে না। তাছাড়া অসৎ দোকানদাররা সুযোগ পেলে সব মাল কালোবাজারে বিক্রী করে দেবে।
আভা উল্লাসভরে সশব্দে হেসে বললে— ভালই হবে। সারা দেশে অনাহারজনিত কান্নার রোল। ঘরে ঘরে হাহাকার। এর মাঝে সুযোগ সন্ধানী দোকানদারদের ঘরে যদি কালোবাজারীর ফলে স্বচ্ছলতার আনন্দ বয়ে যায় তবে দোষ কি?
—কি যে বলেন।
—ঠিকই বলেছি। তাছাড়া আমার আর আপনার একান্ত অবসর, জীবনের অব্যক্ত সহস্র কথার বিনিময়, কল্পনাতীত অভাবনীয় মধু মিলনের পুলক উল্লাস। না, থাক ওসব বাজে কথা। জানেন, প্রচুর অর্থ থাকতেও আমরা আজ অনাহারে। খাদ্য বিভাগের চাকুরে আপনি। দিদিমা এ খবর পেলে কী যে খুশী হবেন।
—খুশী।
—হ্যাঁ, একটু অপেক্ষা করুন। এখুনি তাকে খবরটা দিয়ে আসি।
সাবলিল গতিতে আভা কক্ষ ত্যাগ করে চলে গেল। একটু পরেই খুশীতে টগমগ হয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন সেই বৃদ্ধা। আমাকে প্রথমে দেখে যিনি বিরক্তিভরে কক্ষ ত্যাগ করেছিলেন তিনিই এখন অত্যন্ত হাসিখুশী।
সামনে এসেই আগ্রহভরে প্রশ্ন করলেন— হ্যাঁ ভাই, তুমি নাকি সিভিল সাপ্লাই বিভাগে চাকুরী কর? চাউল, চিনি, আটা প্রভৃতি নাকি তোমার হাত দিয়েই হাজার হাজার মানুষের মাঝে বিলি হয়?
বললাম— হ্যাঁ।
—তাহলে অনেক খাদ্য খাবারের মালিক তুমি?
—অনেক না হলেও প্রতিদিন প্রায় দেড়শ’ মন বিলি করে থাকি।
—দেড়শ’ মন! আমরা পাঁচ সের পেলেই খেয়ে বাঁচতাম। গত তিন চার দিন চাউলের একটা দানাও চোখে দেখি নি। চিনির অভাবে তিন সপ্তাহ চা পর্যন্ত—
বললাম—বুঝেছি। সারা দেশ জুড়ে এই একই অবস্থা। বিশেষ করে কলকাতায়। আপনাদের জন্য এখুনি কিছু এনে দিতে পারলে ধন্য মনে করতাম। কিন্তু যে ভয়াবহ অবস্থা তাতে কাউকে দুসের লুকিয়ে দেবারও উপায় নেই। সবাইকে লাইন করে দাঁড়াতে হবে। একটু দোষ-ত্রুটি হলেই মারপিট শুরু হয়ে যায়।
—তা’ত হবেই। পৃথিবী জোড়া যুদ্ধে যেখানে হত্যার তাণ্ডব লীলা হয়ে চলেছে সেখানে বিশৃঙ্খলার ফলে মারপিট হওয়াই এ স্বাভাবিক। হ্যাঁ ভাই, লাইনে দাঁড়ালেই যদি চাউল আর চিনি অন্ততঃ পাওয়া যায়, তবে কাল সকালেই তোমার দোকানের সামনে আমরা গিয়ে দাঁড়াব।
বললাম— তাহলে ভালই হবে। লাইনে দাঁড়াতে পারলে আমি আমার কর্ত্তব্যের চেয়ে হয়ত কিছু বেশী দিতে পারব।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বৃদ্ধা বললেন— তাই হবে। আভা, শোভা আর আমি। আমরা নিশ্চয়ই যাবো।
প্রায় আশি বছরের বৃদ্ধা। লোল চর্ম্মা। তিনিও দুসের চাউল বা একসের চিনির জন্য ঠেলাঠেলি করে লাইনে দাঁড়াতে প্রস্তুত। হায়রে নিয়তি!
বললাম— আপনিও অমন ভিড়ের মাঝে—
বৃদ্ধা উত্তর দিলেন— হ্যাঁ, উপায় কি? লাখ লাখ টাকা আছে আমাদের ঘরে আর ব্যাঙ্কে। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে দুসের চাউল বা এক পোয়া চিনিও যোগাড় করতে পারি নি। কি হবে টাকার গাদায় শুয়ে থেকে? টাকা ত আর খাওয়া যায় না।
বললাম— তা ঠিক।
বৃদ্ধা দৃঢ় কণ্ঠে বললেন— একশ’বার ঠিক। গতকাল দেড়শ’ টাকা দিয়েও পনেরো সের চাউল কিনতে পারি নি। শেষ পর্য্যন্ত লোকটি বললে, আসলে তার কাছে এক সের চাউলও নেই। পাঁচশ’ টাকা দিয়েও নাকি একমন চাউল পাওয়া যায় না। সুতরাং টাকা-পয়সা থাকা আর না থাকা সমান। তা ভাই তুমি আমাদের বাঁচাও। এ সংসারে একটা পুরুষ মানুষও নাই। আমি বৃদ্ধ, একেবারে অকর্ম্মণ্য। শোভা ত খুবই ছোট। শুধু আভা যা কিছু দৌড়াদৌড়ি করে। কিন্তু অমন ভরা বয়েসে ওর কি যেখানে সেখানে যাওয়া উচিৎ?
বললাম— কেন নয়? আজকাল মেয়েরা অনেক এগিয়ে গেছে।
বৃদ্ধাআ খেঁকিয়ে উঠলেন— খু-ব এগিয়ে গেছে। মেয়েরা লাঠিয়াল হয়েছে—কুস্তিগীর হয়েছে, গাড়ী এমন কি এরোপ্লেন চালক পর্য্যন্ত হয়েছে। কিন্তু আসলে হয়েছে ছাই। কড়া আঘাত এলে ওরা আশ্রয় খোঁজে পুরুষদের কাছে। সব বাহাদুরী তখন উবে যায়।
কথাগুলো বলে বৃদ্ধা আবেগভরে আমার হাত আঁকড়ে মিনতির সঙ্গে বললেন— গত তিনদিন ভাতের মুখ দেখিনি। তেঁতুল বিচির ভষ্ম মেশানো শুকনো আটার রুটি আর চিবুতে পারি না। অনেক খোঁজা-খুজির পর আভা কোথা থেকে যেন দু’পাউণ্ড পাউরুটি এনেছে আজ।
—পাউরুটি! হ্যাঁ, আভা গেলে পাবে বৈ কি!
—ঠিকই বলেছ ভাই। সুন্দরীদির সবাই খাতির করে।
এবার আমার প্রতি চেয়ে ফোকলা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন— দেখো, তুমি আবার এটা ওটা দেবার অছিলায় ওর প্রতি শুভদৃষ্টি দিও না। ওকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলে আমার যে কেউ থাকবে না।
হেসে বললাম— ভয় নেই। ওকে ছিনিয়ে নেবার সামর্থ আমার নেই। ওর আপনার কাছেই থাকবে— এবং আমৃত্যু।
আভা কখন যেন পেছনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার কথার রেশ ধরে বললে— আমৃত্যু শুধু নয়, মৃত্যুর পরেও। জীবনটা আমার বিষিয়ে তুলবে। আর কত কাল এভাবে থাকতে বল? নতুন সংসার করার জন্য আমি আজই কারও সাথে চলে যাবো।
এসব অবশ্য আভার মনের কথা নয়। শুধু বৃদ্ধা দিদিমাকে ভয় দেখাবার জন্য তার এ খেদোক্তি। কিন্তু বৃদ্ধা ভীত কণ্ঠে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন— কি যে বলিস তুই? কার সাথে কোথায় গিয়ে ঘর বাঁধবি? তুই না এতদিন ধরে বলে আসছিস, বে’থা করবি না।
—হ্যাঁ, বলেছিলাম। কিন্তু আর পারি না। আমিও ত রক্ত মাংসের তৈরি মানুষ।
চোখ টিপে হেসে আমার প্রতি চেয়ে আভা বলে— আপনিই বলুন, কতকাল আর এভাবে একা একা থাকা যায়?
কথাগুলো বলেই লাজ-রক্তিম হয়ে ওঠে আভা। আমার কামনা-জাগা চোখে চোখ পড়তেই ও ঝড়ের বেগে অন্য কক্ষে চলে যায়। নারী প্রেমের রহস্যময় প্রমত্ত খেলায় আমাকে আলোড়িত করে— উন্মাদ করে ইঙ্গিতে ইশারায় দুরন্ত আহ্বান জানিয়ে ও পাশের ঘরে চলে যায়। আমরা সারা দেহে বয়ে চলে কামনার তৃপ্ত স্রোত। বিদ্যুৎ খেলে যায় শিরাউপশিরায়। এমন দূর্লভ তরুণীকে একান্ত ভাবে পাবার এইত প্রশস্ত সময়। এখুনি এর নিবৃত কক্ষে প্রবেশ করে হাত বাড়ালেই ওকে পাওয়া যাবে। যৌবনের এক আবেগঘন চরম মুহূর্ত্তের জন্য ও প্রস্তুত হয়ে আছে। ওর অঙ্গ প্রত্যঙ্গে আত্মসমর্পনের নিদারুণ যন্ত্রণা।
কিন্তু আমি? আমার পক্ষে ওর কক্ষে ছুটে যাওয়া সম্ভব ছিল না। বৃদ্ধার সতর্ক দৃষ্টির সীমানা পার হয়ে এ মুহূর্ত্তে নব পরিচিতা আভাকে একান্ত করে কাছে টানবার সাহস আমার ছিল না। তাছাড়া মনে হ’ল আভার এ ক্ষ্যাপামী ক্ষণিকের। মন জানাজানির সীমান্ত শেষে থাকে দেহ ভোগের কিঞ্চিত আশা। যার কিছুই জানা হয় নি, তাকে পেয়ে হারাবার ভয় আমার অনেক। তাই দেহ-মনের যন্ত্রণায় অস্থির হয়েও আমি স্থানুর মতই বসে থাকলাম।
বৃদ্ধা এবারে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন— সত্যিই তাই। ও কত কাল আর এমনিভাবে আইবুড়ো হয়ে থাকবে? বিশ বছর বয়স হল। এ বয়সে মেয়েরা দু’তিন সন্তানের মা হয়। অথচ—
—অথচ কি, বলুন?
—না। থাক এসব কথা। এ একেবারে আমাদের ঘরোয়া ব্যাপার। যাক্ তুমি ভাই আমাদের বাঁচাও। কিছু চাউল আর চিনির বন্দোবস্ত করে দাও। তা হলেই আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।
বললাম— আমার সাধ্যমত নিশ্চয়ই চেষ্টা করব। তবে কথা কি জানেন? সারা দেশ জুড়ে দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া। প্রতিটি পরিবারের অন্নাভাব। অর্থ আজ আর উদরান্ন যোগাবার মাধ্যম নয়। অর্থ আজ সত্যিই অর্থহীন।
একটু পরেই আভা ফিরে এল।
দেখলাম, ওর ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্দ মনের জগতে এখন আর ক্ষ্যাপা-তরঙ্গ নেই। সেখানে বিরাজ করছে বিপুল প্রশান্তি।
আভা শান্ত কণ্ঠে আহ্বান জানাল— আসুন। বুড়ো মানুষের সঙ্গে আর কতক্ষণ শুধু মুখে আলাপ করবেন?
বৃদ্ধা এবারে রসিকতা করে বললেন— হ্যাঁ, পেটপুরে মিষ্টি খেয়ে এবারে তোরা জোয়ানে জোয়ানে মাখামাখি করগে।
আভা চোখ টিপে চটুল হাসি হেসে উত্তর দিল— সুন্দর বলেছ দিদি মা। আসরে যৌবনটাই জীবন কিন্তু। আমার বয়সে তুমি কি কম করেছ? শুনেছি তোমার চারপাশে নাকি জোয়ান ছেলেরা ভিঁড় করে থাকত।
আর এক মুহূর্ত্ত দেরী না করে আমাকে একরূপ ঠেলেই আভা নিয়ে গেল শ্বেত পাথরে মোড়া সুন্দর এক বাথরুমে। বললে— হাত মুখ ধুয়ে নিন। সাবান, তোয়ালে আর প্রসাধন সামগ্রী— সব কিছু রয়েছে।
বাধা দিয়ে বললাম— অতসবের দরকার নেই।
হাত মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে বসলাম। সুন্দর ভাবে পরিপাটি করে সবকিছু সাজানো। মিঠে সুগন্ধীতে ঘরখানা ভরপুর। শান্ত সমাহিত পরিবেশ নগরীর কল-কোলাহল এ কক্ষে প্রবেশ করতে পারে নি। দু’টি তরুণ-তরুণীর উষ্ণ নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে যা কিছু তরঙ্গ-আলোড়ণ। প্রেমানুভূতির আবেগ তলে গোপন কান্নার অব্যক্ত বেদনা।
একটা প্রচণ্ড ঝাপটা এসে কখন যেন সবকিছু তছনছ করে দেবে। এমন নিরালা কক্ষে, ভয়ভীতির গন্ধলেশহীন পরিবেশে বিপরীত মুখী দুটি প্রজ্জ্বলিত যৌবনের অতৃপ্তির আগুন কি ব্যবধান রেখেই পুড়ে শেষ হবে? না, না, না। এ যন্ত্রণা অসহ্য, দুঃসহ। কিন্তু হাত বাড়িয়ে কাছে টানতে উভয়েই অক্ষম কেন?
রাজপ্রাসাদে সম্মানিত অতিথি আমি। পরিচর্য্যারত দুর্লভ সুন্দরী রাজকুমারী আভা। আভা শরমে শিহরিত, অসুস্থ নয়। বলিষ্ট সবল, পরিপূর্ণ প্রষ্ফুটিত। তবে দু’বাহু বাড়িয়ে আমার মত পছন্দ করা কামনা পাগল যুবকের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে তার এত সঙ্কোচ কেন?
খাবার টেবিলে মাংস, ডিম, মিষ্টি আর কয়েক টুকরো পাউরুটি। সে সঙ্গে কয়েক রকমের বিস্কুট আর কফি। আভা আমার একান্তে দাঁড়িয়ে খাবার গুলো পরিবেশন করছিল। ওর আঁচলের উষ্ণ পরশ বারে বারে আমাকে ক্ষিপ্ত করে তুলছিল। নিজেকে ধরে রাখা আর যেন সম্ভব ছিল না। কোন রকম বিচার বিবেচনা না করে সহসা সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম। পরিচর্য্যায় বাধা দেওয়ার অছিলায় বাম হাতে আঁকড়ে ধরলাম ওর কুসুম-কোমল শুভ্র-সুন্দর বলিষ্ঠ মসৃণ হাত খানা। আভা বাধা দিল না, বিস্মিতও হলো না। অচঞ্চল দাঁড়িয়ে রইল। মনে হ’ল, আমার পরশ আকর্ষণের জন্য ও আগে থেকেই প্রস্তুত হয়েছিল।
আমার হাতের উষ্ণ তালুতে তখনও ওর সুপুষ্ট হাতের কব্জি। আমি আহার বন্ধ করে মৃদু চাপ দিলাম। ও মুখ তুলে প্রশান্ত দৃষ্টিতে চাইল আমার প্রতি। শরম কুণ্ঠিত কণ্ঠে বললে— দুঃসাহস তোমার কম নয়। এরই মাঝে এতখানি করতে পারলে?
প্রতিরোধ ছিল না, প্রতিবাদও শক্ত নয়। কেমন এক মিঠে আমেজের কণ্ঠ। শঙ্কা দূর্ব্বল হৃদয়ে সাহস ফিরে এলো। প্রেমের প্রথম খেলায় বিজয়ীর ভূমিকায় আমি তখন উৎরে গেছি। তাই উল্লাসভরা সহজ কণ্ঠেই বললাম— কেন নয়, বল? কুঁড়ির বুকে সুগন্ধি যখন বাতাসকে উতালা করে, মধুলোভী ভ্রমর তখন কি দিশেহারা না হয়ে পারে?
আভার চোখে মুখে ফুটে উঠল অদ্ভূত দীপ্তি। প্রথম পুরুষের স্পর্শে শিহর-রাঙা তার মুখ। মৃদু হেসে সে বললে— বটে! তোমার মাঝে কবিত্বও আছে দেখছি।
উত্তরে বললাম— কবিত্ব! কোনদিন ছিল না। অপরূপার সংস্পর্শে এসে এখুনি জেগেছে বোধ হয়। কম বেশী কবিত্ব সবার মাঝেই থাকে। উপযুক্ত পরিবেশে তা শুধু বাঙ্ময় হয়।
—কিন্তু তোমার জানা উচিৎ যে আমি এক সম্ভ্রান্ত ঘরের অবিবাহিতা কুমারী।
—কুমারী শুধু নও, রাজকুমারী। বিরাট বিশাল এ রাজ প্রাসাদে তুমি এক বিশ্ব-সুন্দরী। মনে হয় কোন নিষ্ঠুর দুঃশাসনে অবরোধবাসিনী তুমি। আমি এসেছি তোমাকে উদ্ধার করতে— তোমার জীবন ক্ষুধার সকল আহার্য্যের সংস্থান করে দিতে।
কথাগুলো বলে ওর হাতে আর একটু বেশী চাপ দিলাম— নিবিড় করে কাছে টানতে চাইলাম। কিন্তু না। ও পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
বললাম— তোমার সাথে নাটকীয় পরিচয়ে আমি যেন সৌর জগতকে পেয়েছি হাতের মুঠোয়।
আভা হাত ছাড়িয়ে নিল। বলল— তাই নাকি? আমি কি এতই সহজ লভ্যা।
উত্তরে বললাম— শুধু তুমি নও। যৌবন দীপ্ত প্রতিটি নরনারী ঠিক এমনিভাবেই সহজলভ্য। শুধু সংকোচ আর লোক নিন্দার ভয়ে অতৃপ্তির বেদনা। রক্ত মাংসের মানুষ সবাই। কামনা-অনুভূতির উষ্ণ পরশ-তরঙ্গ সবার মাঝে একই স্রোতে প্রবাহিত।
খাবার সেষ হলে আভা নিয়ে গেল আর এক কক্ষে। বললে— এটি আমার শোভার ঘর। পাশের ঘরে থাকেন দিদি মা আর শোভা। তারপরের ঘরে থাকে চাকর চাকরাণীরা।
বললাম— তাহলে মোট পাঁচ খানা ঘর তোমাদের?
—হ্যাঁ। উত্তর দিল আভা।
—এত ঘর তোমাদের কি কাজে লাগে?
—কোন কাজেই লাগে না। বাকী গুলো তালাবন্ধ করে রাখি। বাবা মা বেঁচে থাকতে অনেক আত্মীয় স্বজন এসে থাকতেন। এখন কেউ আসে না।
দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজল। আভা বললে— এবারে বিশ্রাম নাও।
—কিন্তু—
—কিন্তু আবার কি? চাকরী ক্ষেত্রে যাবার কথা? নির্দ্ধারিত সময় কখন তোমার শেষ হয়ে গেছে। ঘুমাও অথবা বই পড়।
আভা চলে যাচ্ছিল। আমি বাধা দিয়ে বললাম— শোন।
ঘুরে দাঁড়াল আভা— বল।
এখানে, এ ঘরে বিশ্রাম নেব? এ যে তোমার শোবার ঘর?
—হ্যাঁ, তাইত প্রিয় অতিথির জন্য ছেড়ে দিলাম।
কথা গুলো বলে ত্বরিত গতিতে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে আভা চলে গেল। অনুচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম— শুধু ঘরই ছেড়ে দিলে, আর কিছু নয়। নিষ্ঠুর!