এক
—দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের চতুর্থ বছর। বৃটিশ সরকারের নাভিশ্বাস শুরু হয়েছে। যুদ্ধ শেষে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিতে হবে। কিন্তু তার আগে পুঙ্গু করে রেখে যেতে হবে স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রপথিক বাংলাকে। সন্ত্রাসবাদি অনেক আন্দোলন চালিয়েছে বাংলা। বহু ইংরেজের অকাল মৃত্যু ঘটিয়েছে বাঙ্গালীরা। সুতরাং বাংলার প্রতি তাদের সীমাহীন ক্রোধ।
মহাসমরের সর্ব্বগ্রাসী আগুন সারা ইউরোপ জুড়ে। সে আগুন ছড়িয়ে পড়ল এশিয়া মহাদেশেও। যুদ্ধবাজ বৃটিশের ঘরে তখন নিধারুণ অন্নাভাব। আর সে অভাব মেটাবার জন্য তারা হাত বাড়াল বাংলার শস্য ভাণ্ডারের বুকে।
শত শত জাহাজ ভর্ত্তি হয়ে খাদ্যশস্য চলে গেল রণাঙ্গণে আর বৃটেনে। ফলে বাংলার ঘরে ঘরে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। গ্রামে, গঞ্জে, শহরে, রাজধানীতে বুভুক্ষু মানুষের মৃতদেহ এক ভয়াবহ দৃশ্যের সৃষ্টি করল। অনাহারী কৃশ-মলিন মানুষের কাতর আহাজারিতে বাংলার আকাশ বাতাস নিষ্ঠুর যন্ত্রনায় মৃতপ্রায়।
কলকাতা মহানগরীর অলিতে গলিতে অজস্র অভুক্ত নরনারীর ভীড়। প্রতিদিন তারা মরছে। শত সহস্র মৃতদেহ রাজপথে। জাপানী বোমার আঘাতে ভীত সন্ত্রস্থ নরনারী। কলকাতা ত্যাগ করেছে অসংখ্য মানুষ। ব্যবসাকেন্দ্র, সরকারী অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাঙ্ক, বীমা করপোরেশন আর যাবতীয় কল-কারখানা জনশূন্য। প্রাণভয়ে ভীত প্রতিটি স্বচ্ছল মানুষ চলে গেছে রাজধানী ত্যাগ করে। কিন্তু অন্য দিকে মহানগরীর পূর্ণ হয়ে উঠেছে গ্রাম বাংলা থেকে ছুটে আসা বুভুক্ষু নরনারীতে। তারা বরাভয়। একমুঠো অন্নের জন্য তারা জীবন বিপন্ন করে এগিয়ে এসেছে কলকাতায়। বাঁচতে এসেছিল তারা কিন্তু বাঁচতে পারে নি। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে তারা মরেছে হাজারে হাজারে। তাদের গলিত মৃতদেহের দুর্গন্ধে বিষিয়ে উঠেছে মহানগরীর বাতাস। চতুর্দ্দিকে ক্ষুধীতের কান্না, মৃত্যুর থাবাতলে জীবনের সে এক অসহায় প্রণতি।
সমগ্র বাংলার মানুষ যখন এমনিভাবে মরনের পথে, ঠিক তখনই খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহন করেন জনাব হোসেন শহীদ সহরওয়ার্দ্দী সাহেব। তাঁর সুযোগ্য কর্ম্ম-পরিচালনায় কলকাতা মহানগরীতে প্রবর্ত্তিত হয় রেশনিং প্রথা। ফলে জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অবাধ সুযোগ হারাতে বাধ্য হয় আজরাইল।
তবু স্বস্তি কোথায়? চাউল, চিনি, আটা, তেল এমন কি জ্বালানী প্রভৃতির জন্য লাইন করে দাঁড়াতে হয় রেশন দোকান সমূহের সামনে। সর্ব্বস্তরের মানুষের জন্য একই নিয়ম। মান অভিমানের কোন বালাই নেই সেখানে। অবিভক্ত বাংলার এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতির আড়ালে আমার জীবনে ঘটেছিল বিস্ময়কর এক ঘটনা। ছিল প্রেম-মধুর এক নতুন উপন্যাস লেখার জীবন-কাহিনী।
বেলা প্রায় সাড়ে আটটা।
সরকারী সরবরাহ বিভাগে আমি তখন ক্ষুদে এক অফিসার। খাদ্যশস্য বিতরণ তদারকীর জন্য যেতে হবে বালিগঞ্জে— লেক মার্কেটে। সকালে কিছু সময় কাজ করেছি পার্ক সার্কাসে।
অদম্য কর্ম্মতৎপরতায় সক্রীয় আমি। বয়স পঁচিশের কোঠায়। পরনে শাদা জিনের ফুল প্যান্ট, গায়ে কলারওয়ালা জাপানী গেঞ্জী। হেমন্তের প্রভাতে এ পোষাক বাইরের জগতে কাজ করার পক্ষে সত্যি উপযোগী। উদ্দাম চঞ্চলতায় আমার বলিষ্ঠ দেহ-সৌষ্ঠব প্রতিটি মানুষের মনে ঈর্ষা জাগায়। অপূর্ব্ব নয়ন ঝলসানো যৌবনজ্যোতি আমার অঙ্গশ্রীতে।
সার্কুলার রোডের সঙ্গে বেগবাগান রোড যেখানে মিশেছে সেই মোড় থেকে চলন্ত বাসের পা-দানিতে উঠে দাঁড়ালাম। কন্ডাক্টরের নিষেধ সত্ত্বেও বেপরোয়া ভাবেই গাড়ীতে উঠতে হল। সময় মত লেক মার্কেটে গিয়ে পৌঁছাতে হবে। সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করে লাইন দাঁড়িয়ে আছে শত শত নরনারী। তাদের মাঝে খাদ্য শস্য আর জ্বালানী কয়লা বিতরণ করতে হবে যে।
তিল ধারনের স্থান নেই বাসে। উপবিষ্ট যাত্রী ছাড়াও ঠাসাঠাসী করে দাঁড়িয়ে আছে আরও বিশ ত্রিশ জন। অস্বস্তিকর অবস্থান সবারই।
গাড়ী ছুটে চলেছে। প্রবল বেগে বইছে হাওয়া। দণ্ডায়মান মানুষের চাপ সহ্য করে গাড়ীর পা-দানিতে দাঁড়িয়ে থাকা অত্যন্ত কষ্টকর। যে কোন মুহূর্তে হাত ফস্কে পড়ে যাবার ভয় আছে। তাই এক সুযোগে কোনমতে চাপ প্রয়োগ করে দু’ধাপ ওপরে উঠে যেখানে দাঁড়ালাম ঠিক তার পাশেই ছিল মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন।
প্রথম দৃষ্টিতেই সে আসনে দেখতে পেলাম এক জোড়া স্বপ্ন-মাখা চোখ। সে চোখে অমর জ্যোতি— সে চোখ মধুময়, প্রশান্ত। দৃষ্টি বিনিময়ের অনুভূতি-চেতনা আমাকে সঞ্জীবিত করে মুহূর্ত্তে তৃপ্তি সুখে ভরিয়ে দিল। যৌবনময়ী অপরূপ নারীমুর্ত্তি। এত লাবনী, সুঠাম সতেজ এমন দেহলতা, চোখ-ঝলসানো জ্যোতির্ম্ময় ত্বক সৌন্দর্য্য, মায়াবী স্বপ্নিল চাহনি আর রুচিকর পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যবহার বিন্যাস আমাকে একেবারে মুগ্ধ করে দিল।
আত্মহারা বিহ্বলতায় আমি যেন সত্তাহীন। যাদুকরের মায়াকাঠির ইঙ্গিত-স্পর্শে সম্মোহিত আমি। চোখ ফিরাতে পারি না। তবু জনাকীর্ণ গাড়ীর মাঝে নিজেকে ফিরে পাবার চেষ্টা করলাম। ও দুটি স্নিগ্ধ চোখের দৃষ্টি থেকে সরিয়ে নিলাম নিজের চোখ। কিন্তু থাকতে পারলাম না। পরক্ষণেই আবার তাকালাম। দেখলাম, তরুণী তখনও পলকহীন মায়াময় দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে আমার প্রতি। লাজ-নম্র অথচ শান্ত সমাহিত সে দৃষ্টি। মৃদু হাসির আবেশ ছড়িয়ে আছে তরুণীর স্নিগ্ধ-সুন্দর মুখাবয়বে। মিনতিমাখা প্রশান্ত তার চোখ-মুখ।
মহিলা আসন ছিল দুজনের উপযোগী। দ্বিতীয় কোন মেয়ে যাত্রী না থাকায় একজনের স্থান শূণ্য পড়ে ছিল। এত মানুষের ঠাসাঠাসির আঙিনায় শূণ্য স্থানটি যেন নীরবে হাহাকার করছিল। কিন্তু উপায় কি? মহিলাদের আসনে পুরুষদের বসবার অধিকার থাকবে কেন? তবু ভদ্রতার চিন্তায়, চক্ষু লজ্জার খাতিরে খানিকটা যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়েছিল তরুণীর সুকোমল অন্তরে। এই দুরন্ত দুর্ভোগে অন্ততঃ একজন মানুষ বসে যেতে পারেন। একথা ভেবে তরুণী স্বাভাবিকভাবেই মনে মনে অনেকক্ষণ ধরে অস্বস্তিবোধ করছিলেন।
মাঝে মাঝে তার ওষ্ঠাধরে কাঁপন লক্ষিত হল। মুখ ফুটে বলতে কেমন যেন জড়তা তার কণ্ঠে। হৃদয়ের নীরব আহ্বান মূক-যন্ত্রণায় অস্থির করে তুলছিল তাকে। শূণ্য আসনের পাশে নিজেকে অপরাধী ভাবছিল সে।
তরুণীর চোখে বারে বারে চোখ পড়ল। বারে বারে আহত হলাম আমি। হয়ত বা সে-ও। তারপর চকিত হরিণীর মতো পলক-ইশারায় খালি আসনে বসবার জন্য আমাকে আহ্বান জানালো সে। অনুচ্চ কণ্ঠে ধন্যবাদ জানিয়ে তেমনিভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। এবারে সুন্দরী আরও সক্রীয় হল। আমাকে লক্ষ্য করে মুখফুটে বললে— বসুন না, জায়গা যখন রয়েছে।
সৌজন্যতার খাতিরে বললাম— অশেষ ধন্যবাদ। এভাবেই যেতে পারব।
মৃদু হেসে প্রতিবাদের সুরে তরুণী বললে— কেন এভাবে যাবেন? বসে পড়ুন।
বাসভর্ত্তি অনেক মানুষ। আমারও আশে পাশে বাদুড় ঝোলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেকে। আমি বাসে ওঠার অনেক আগে থেকেই তারা বহু কষ্টে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অথচ সৌভাগ্যবান শুধু আমি। আমার প্রতি সুন্দরীর কেন এ সদয় আহ্বান?
আমার চিন্তার দ্বারে আঘাত করে তরুণী এবারে দৃঢ়তার সঙ্গে আদেশের কণ্ঠে বললেন— বসুন।
তবু পারলাম না বসতে। অজানা অস্বস্তিতে মন আমার দুর্ব্বল। স্বাভাবিক সংকোচ আর লজ্জাশীলতা আমাকে স্থানুর মতো আবদ্ধ করে রাখল। তাই অমন বলিষ্ট এবং প্রকাশ্য আহ্বান স্বত্ত্বেও আমি দাঁড়িয়েই রইলাম।
কিন্তু আশ-পাশের যাত্রীরা এবারে সক্রীয় হলেন। আমার সংকোচ ও দ্বিধা লক্ষ্য করে একজন বললেন— উনি যখন নিজেই আহবান জানাচ্ছেন, তখন আর বসতে দোষ কি? বসে পড়ুন।
শুধু ওই একজন নয়। আরও বেশ কয়েকজন আমাকে বসতে বললেন।
আমি তখনও ভাবছিলাম, বহুক্ষণ ধরেই ত আসনটি খালি পড়ে ছিল। এর আগে কাউকেই এমন ভাবে সাদর জানানো হয় নি। আর হলেও অমন ভূবন-ভোলানো তন্বী-তরুণীর অঙ্গ-মাধুর্য্যের একান্ত সান্নিধ্যে গিয়ে কেউ কি অঙ্গ মিলিয়ে বসতে সাহস পেত?
যাত্রীদের অনুরোধে নিজেকে খানিকটা প্রস্তুত করে তুললাম। ভাবলাম, অমন রূপসী নারীর দুর্লব আহ্বানকে নীরবে উপেক্ষা করার মতো নির্ব্বোধ কেন আমি হব? সহসা সিংহ পুরুষের বীরত্ব নিয়ে নিজেকে ঝাড়া দিলাম। দুঃসাহসীর মতো সবার উৎসুক ও হিংসুক দৃষ্টিতে চমক লাগিয়ে যেন আপন অধিকারেই যুবতির পাশে আসন নিলাম। যৌবনে জাগল অদ্ভূত চেতনা-অনুভূতির জোয়ার। সারা অঙ্গে খেলে গেল রোমাঞ্চকর বিদ্যুৎ। তরুণীর সুপুষ্ট নিতম্বের প্রান্ত ছুঁয়ে বেশ খানিকটা চাপ প্রয়োগ করেই আমাকে বসতে হল। দু’জনের আসন হলেও অপ্রসস্ততার জন্য ব্যবধান রেখে বসা সম্ভবপর ছিল না মোটেই।
অমন দূর্লভ সুন্দরীর দেহ সান্নিধ্যে জমাট হয়ে বসে আমি তখন বাস ভর্ত্তি মানুনের ঈর্ষার দৃষ্টিশরে বারে বারে বিদ্ধ হতে লাগলাম। কিন্তু আহত না হয়ে বরং অদ্ভুত পুলক-আনন্দ অনুভব করলাম আমার শিরাউপশিরায়। ওর প্রসাধনের মিঠে-আমেজে আমি তখন পরিপূর্ণ। দেহের প্রতিটি লোম কূপে শিহর জাগরণ। পথ-চলার অনিশ্চিত আঙ্গিনায় এযে কল্পনাতীত অবিশ্বাস্য মণিহার কুড়িয়ে পাওয়া। জীবন আমার সার্থক হয়ে গেছে। স্বপ্ন রাজ্যে আমি তখন বিভোর।
সহসা কি যেন ঘটে গেল। মনে হল, গোটা পৃথিবী অন্য কোন গ্রহের সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষে উল্টে গেল যেন। একি অভাবিত-বিশৃঙ্খলা আমার স্বপ্ন জগতে? গাড়ী থেমে গেছে। লণ্ড-ভণ্ড হয়ে গেছে অভ্যন্তরের সবকিছু। চোখ মেলে চাইতেই দেখতে পেলাম নিজের এবং অন্যান্য আরোহীদের বেসামাল অবস্থান। লুটিয়ে পড়েছে সবাই। সৌর জগতের আহ্নিকগতিতে আঘাত লাগেনি, লেগেছে আমাদের গতিশীল বাসটাতে। আচমকা দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাবার জন্য ড্রাইবার জোরে ব্রেক কস্তেই যাত্রীরা ছিটকে পড়েছে বেসামাল ভাবে। আমার আর তরুণীর মাঝেও হয়ে গেছে গোটা দেহের নিবিড় কোলাকুলি। আকস্মিক প্রচণ্ড ধাক্কার ফলে তরুণী দু’হাতে জাপ্টে ধরেছিল আমাকে। আমিও তাকে। অভাবিত, অবাঞ্ছিত, অতি আকস্মিক আলিঙ্গন।
দুর্যোগ সর্ব্বকালে দূর্ভাগ্যেরই সূচনা করে। কিন্তু এ দুর্যোগ নির্ল্লজ্জ আকস্মিকতায় দিয়ে গেল অপার আনন্দ। যাকে স্পর্শ করার দুঃসাহসও হতে পারে না, তাকে আবক্ষ নিবিড় আবেষ্ঠনের একি আকস্মিকতা! বিশ্ব গ্রাসী কামনা ক্ষুধার মরু প্রান্তরে সুন্দর সুখাদ্যের একি অজস্রতা! ধন্য হয়ে গেলাম। পথ চলার ক্ষণিক আঙ্গিনায় দুর্লভ রাজকুমারীর সজীব পরশ অনুভূতির শিহর মাদকতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ওই একটু পরশই মহাজ্যোতির্ম্ময়ের জীবন জুড়ানো অমর প্রেমের অমূল্য পরশ যে।
সর্ব্বদেহে নতুন এক উন্মাদনা অনুভব করলাম। শিরা উপশিরায় উত্তাল তরঙ্গে জেগেছে রক্ত কণিকারা। আমি যেন ওর সব পেয়ে গেছি। ও আমার, একান্তভাবে আমার। ওর আর আমার মাঝে মধু-মিলনের কোন ব্যবধানই নেই। একটা প্রবল আলোড়নে ভেঙ্গে গেছে সংকোচের সকল আড়াল— সকল বাধার দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর।
সাহস সঞ্চয় করে চাপা স্বরে বললাম— লাগে নি ত?
শরম-সংকোচিত কণ্ঠে তরুণী উত্তর দিল— না।
নিজের অসংযত গাত্রাবাস এবারে আরও একটু টেনে বসল সে। বাস ভর্ত্তি যাত্রীদের বেসামাল অবস্থা লক্ষ্য করলাম। তারা সবাই এ ওর গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। টাল সামলে নিয়ে ততক্ষণে উত্তেজিত কণ্ঠে অনেকেই ড্রাইভারকে গালি দিতে শুরু করেছে। কেউ কেউ আবার সমূহ বিপদ থেকে যাত্রীদের প্রাণ রক্ষা করার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। ক্ষণিকের বাক-বিতণ্ডা আর গণ্ডগোল থেমে গেল। শুরু হলো নানা ঠাট্টা বিদ্রূপ। হাস্য-রসিকতায় সুখর হল গাড়ীর অভ্যন্তরভাগ।
আমাদের দু’জনের প্রতি তখন বাঁকা হাসির বিদ্রূপ কটাক্ষ। যাত্রীদের দৃষ্টি তখন আমাদের প্রতি বিশেষভাবে নিবদ্ধ। ওরা চোখ টিপে হাসছে। তরুণী এবং আমি সলজ্জ। উভয়ে উভয়কে অমন করে জড়িয়ে ধরার দৃশ্য রসিক এবং হিংসুক জনদের চোখে মুখে বিদ্রূপ হাসির উদ্রেক করে বই কি!
গাড়ী আবাব গতিশীল হয়েছে। এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে পদ্মপুকুর রোড ধরে। বেল তলার মোড়ে অনেক মানুষের ভিড়। ওখানে নিশ্চয় বাসটি থামবে।
নীরবে বসে ছিলাম। সহসা মৃদু কণ্ঠে সুন্দরী প্রশ্ন করলো— যাবেন কোথায়?
চাপা কণ্ঠেই উত্তর দিলাম— বালিগঞ্জে। উত্তর দিয়েই নিজে আবার প্রশ্ন করলাম— আপনি?
মুখ তুলে আপ্যায়ণের সুরে তরুণী বলল— আমি? সামনে ওই বেল তলার মোড়ে নামব। আসুন না, একটু চা খেয়ে যাবেন।
ক্ষণিকের নৈকট্য। যুবতীর স্পর্শ-দোলায় নিজেকে কেমন যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম। সে সঙ্গে অন্তরের গহীনে কান্না শুরু হয়েছিল কখন যেন বিচ্ছেদ ঘনিয়ে আসে। বেলতলার মোড়ে ও নেমে যাবে। তারপর দীর্ঘ পথ একা বসে থাকতে হবে অথবা অন্য কোন মেয়ে যাত্রীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াতে হবে। বাস ভর্ত্তি যাত্রীর সামনে আমাকে হতে হবে উপহাসের পাত্র। কেউ মুখ ফুটে হয়ত কিছু বলবে না। কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে থাকবে নীরব ব্যঙ্গ। অসহ্য! অসহ্য! তার চেয়ে—
—হ্যাঁ, তার চেয়ে—। ইতস্ততঃ করে বললাম— কিন্তু—
—কিন্তু আবার কি? আমার সাথেই নেমে পড়ুন।
যাত্রীদের উঠানামা শুরু হয়েছে। বেল তলার মোড়ে অনেক যাত্রী। তরুণী নামবার আগে তার রেশমী শাড়ীর আড়ালে হাত রেখেই আমার হাতে মৃদু চাপ দিল। মুহূর্তে বিদ্যুৎ খেলে গেল সারা দেহে। উঠে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে আবাব বললে— কই, আসুন।
কেমন এক শক্তিশালী অধিকারের আহ্বান যেন। সে আহ্বান কোন কিছু ভাববার সময় দেয় না। সম্মোহনী মাদকতায় আপনা থেকেই টেনে নিয়ে যায় কাঙ্খিত স্রোতে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। বিহ্বল অভিভূতির মাঝে ওর পদাঙ্ক অনুসরণ করলাম। অজানিত এক চুম্বক শক্তির বিপুল আকর্ষণে আমি তখন প্রবলভাবে আকর্ষিত। কারও সাধ্য ছিল না আমাকে ধরে রাখে।
তবু বাসভর্ত্তি মানুষগুলোর সকৌতুক দৃষ্টির তলে এভাবে নামতে গিয়ে খানিকটা বিব্রতবোধ করলাম। সে শুধু ক্ষণিকের দুর্ব্বলতা। বিশ্বসুন্দরী যেখানে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছে, সেখানে আবার শঙ্কা কিসের?
পরশ্রীকাতর হিংসুক আরোহীদের নিয়ে বাস চলে গেল। মুক্ত হাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবারে নিজেকে সহজ করে তুললাম। প্রিয় বান্ধবীকে লক্ষ্য করে বললাম— আঃ! এতক্ষণে রাহু মুক্ত হ’লাম। বাসের যাত্রী গুলো আমাদের দিকে কেবল বিশ্রী চোখেই না তাকাচ্ছিল!
সুন্দরী থেমে মুখ ঘুরিয়ে বললে— কেন? আমরা কি অশোভন কিছু করেছি? আসুন।
প্রশ্ন করলাম— কোথায়, কত দূরে?
—অনেক দূরে —জাহান্নামে। চোখ টিপে রহস্যময় হাসি হাসল সে।
বললাম— জাহান্নামে! তা মন্দ নয়। যে জাহান্নামে এমন অনিন্দ্য সুন্দরীর অবস্থান, সে জাহান্নামে যন্ত্রণা দেয় না, দেয় জীবন ক্ষুধায় সুপেয় সুধাই শুধু।
—তাই নাকি? মৃদু হাসল যুবতী।
পায়ে হেঁটে চলেছি। বন হরিণীর পেছনে অব্যর্থ সন্ধানী ব্যাধ যেন। মনের আঙিনায় অভিনব প্রেমের রঙিন ছবি। জীবনে এমন একটা মুহুর্ত্ত আমার জন্য অপেক্ষা করে ছিল তা ভাবতেও বিস্ময়বোধ হল। এ যেন এক স্বপ্নে-পাওয়া রাজকুমারী। জীবন জুড়ানো তৃপ্তি-সুখের অমূল্য সম্পদ। এ সম্পদ কোথায় লুকিয়ে ছিল এতকাল? নিজেকে ধন্য মনে করলাম। এতবড় সৌভাগ্য আমার!
পাশাপাশি এগিয়ে চলেছি। ওর অঙ্গ প্রত্যঙ্গের গতি তরঙ্গ আমার রক্ত কণিকায় দিচ্ছে উষ্ণ আবেশ। ওর সুবাসিত কেশদাম, চঞ্চল চাহনি, মায়াবী হাসি, এমন কি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে দুলে-ওঠা সুঠাম বুক আমাকে প্রলুব্ধ করে তুলেছিল বারে বারে। উন্মত্ত নেশায় উন্মাদ আমি। ভুলে গেছি আমার সরকারী কাজের দায়িত্ববোধের কথা। ভুলে গেছি নিজেকেই যেন।
কিছুক্ষণ চলার পর সুরম্য সুদৃশ্য এক চারতলা প্রাসাদের সামনে এসে তরুণী থেমে গেল। স্মিতহাস্যে সাদর জানিয়ে বললে— ভেতরে আসুন। এটি আমার বাড়ী।
চোখ মেলে চেয়ে দেখলাম। বাড়ী নয়, সে এক বিশাল সুউচ্চ রাজ-প্রাসাদ। প্রশস্ত রাজপথের ধারে শত শত দালান বাড়ীকে উপহাস করে সমুন্নত শিরে দাঁড়িয়ে আছে মহিমাম্বিত রাজ-প্রাসাদ।
সম্মুখের প্রাঙ্গণ পার হয়ে প্রাসাদের সোপান শ্রেণী বেয়ে চার তলায় উঠে গেলাম। তারপর প্রবেশ করলাম এমন এক সুন্দর কক্ষে যার আভ্যন্তরীণ রঙচঙ আর মূল্যবান আসবাবপত্র দর্শনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। এমন সুসজ্জিত কক্ষ আমি কোথাও দেখিনি। তারপর অন্য এক কক্ষে আমাকে নিয়ে গেল। সেটিও পরিপাটি করে সাজানো। সবকিছু তক্তকে ঝকঝকে। যেন সেদিনই পালিশ করে রঙ তুলির প্রলেপ দিয়ে রাখা হয়েছে। দেওয়াল থেকে মেঝে পর্য্যন্ত সব ঘরই কার্পেটে মোড়া। ঝোলানো রয়েছে দেশ-বিদেশের নয়নাভিরাম বেশ কয়েকটা তৈলচিত্র। স্থাপত্য-শিল্পের নানা নিদর্শন। একপাশে বিশ্বসাহিত্য থেকে ছিনিয়ে আনা বিভিন্ন গ্রন্থাদি। মিঠে সুগন্ধে কক্ষ অভ্যন্তর আমোদিত।
নির্জন কক্ষে আমাকে বসিয়ে তরুণী চলে গেল।
এবার শান্তপদে সামনে এসে দাঁড়াল নয়দশ বছরের এক বালিকা। প্রশান্ত তার চাহনী, সুন্দর তার মুখশ্রী। আমাকে পরখ করে দেখে সে প্রশ্ন করল— দিদির সাথে এসেছেন বুঝি?
বললাম— হ্যাঁ, কিন্তু তোমার দিদি গেলেন কোথায়?
—ও ঘরে। এখুনি আসবেন।
চশমা পরিহিতা এক বৃদ্ধা এগিয়ে এলেন কক্ষ মাঝে। সন্ধানী দৃষ্টি তার চোখে। আমাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে বালিকাকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করলেন— এ আবার কে রে?
বালিকা বললে— দিদির বন্ধু।
—ওর আবার বন্ধু কে?
আমার প্রতি বৃদ্ধার সতর্ক দৃষ্টি। বারে বারে তিনি লক্ষ্য করছিলেন আমাকে। তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল তিনি আমার উপস্থিতি পছন্দ করেন নি। কেমন এক বিরক্তির ভাব প্রকাশ করে তিনি চলে গেলেন।
বালিকাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম— তোমার দিদির নাম কি?
—কার কথা বলছেন, আভা দি?
ঠিক সে মুহূর্ত্তে প্রিয় বান্ধবী সামনে এসে দাঁড়াল। সে যেন এক নতুন মানুষ। পরনের রেশমী শাড়ী ত্যাগ করে পরেছে একখানা লাল পেড়ে সাদা শাড়ী। গ্রন্থীবদ্ধ কেশদাম বিস্তার মেলে এলাইত। জাম-রঙয়ের আঁট-সাঁট বক্ষবন্ধনীর আড়াল তলে নাভি প্রদেশের বলিষ্ঠ শুভ্র অংশ অনাবৃত। উজ্জ্বল মসৃণ মুখশ্রীতে কমনীয় প্রশান্তি। ব্লাউজের দুর্গতোরণ ভেদ করে সুপুষ্ট সুঠাম সুন্দর বাহু দুটি সাবলিল সোহাগে জানায় উন্মাদ আহ্বান। বাম হাতের অনামিকায় মূল্যবান পাথর বসানো স্বর্ণাঙ্গুরীয়। মেহেদী রঞ্জিত হাতের তালু। আঙ্গুলগুলোর প্রান্ত সীমায় নখগুলি হাল্কা লাল রঙে সুদৃশ্য।
আভা তার আপন ভূবনে শান্ত মধুর নববধূ যেন। ও নীরবে এসে দাঁড়িয়েছে কক্ষমাঝে। তবু মনে হল ও বিজয়িনী। হ্যাঁ, মুক্ত পৃথিবী থেকে ও আমায় ধরে এনে আবদ্ধ করেছে ওর আপন ঘরে। ওর অপরূপ রূপ-সৌন্দর্য্যে আমি একেবারে বন্ধী। ও আমাকে জয় করেছে।
অদ্ভূত গ্রীবাভঙ্গে হাসির আমেজ ছড়িয়ে ও প্রশ্ন করলো— ছোট বোনটি এতক্ষণ খুব দুষ্টুমী করেছে বুঝি?
—না, না। খুব শান্ত মেয়ে। ওর কাছে শুনলাম ওর দিদির নাম।
—তাই নাকি? এরই মাঝে আমার নামটি জেনে নিয়েছেন?
—হ্যাঁ, সুন্দর মিষ্টি নাম।
—মিষ্টি কিনা জানি না, তবে—
—কি?
—থাক ও কথা। এখন কি খাবেন বলুন ত? ঝাল, নোনতা, মিষ্টি অথবা অন্য কিছু।
বললাম— কিছুই খাব না।
—তাই কি হয়! আপনি অতিথি। আমার পছন্দ করা প্রিয় অতিথি। মুখ তুলে হাসল আভা।
বললাম— পছন্দ করা এবং প্রিয়। কি যে বলেন! রাজনন্দিনীর সান্নিধ্যে আমার ক্ষণিক অবস্থান আনন্দের, না যন্ত্রণার, জানি না।
আভা কোন কিছু চিন্তা না করেই বলল— হয়ত উভয় প্রকারের।