» » আদিম আতঙ্ক

বর্ণাকার

অদ্রীশ বর্ধন

আদিম আতঙ্ক

আট

সুরেশ সাইকিয়া আলো নেভার আগেই টেলিফোনের কাজ সেরে নিয়েছিলেন। কর্নেল ডিসুজার বাড়িতে ফোন করেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন, শিবালয় শহরের এই বিপর্যয়ের মূলে রয়েছে কী ধরনের এজেন্ট, কেমিক্যাল না বায়োলজিক্যাল। ডিসুজা শুধু বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ।’ তার বেশি কিছু না। তবে সাবধান করেছিলেন সুরেশকে। টেলিফোনে সব কথা বলা যায় না। যা বলবার, সামনাসামনি বলবেন। ভোরের দিকে ফিল্ড ল্যাব আর তদন্তকারীদের নিয়ে হাজির হবেন।

আলো কেঁপে উঠে নিভে গেল তারপরেই।

আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, এই জাতীয় বিভ্রাট ঘটলে কী করতে হবে। ঠিক তাই করা হল এখন।

সাতজনে গোল হয়ে কাঁধে কাঁধ আর পিঠে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল ঘরের ঠিক মাঝখানে। দেওয়াল থেকে দূরে, জানলা থেকে তফাতে। বাড়তি দুটো লম্বা টর্চলাইট পাওয়া গেছিল ফাঁড়িতে। এখন সব ক’টা জ্বলছে আর ঘুরছে।

থপ শব্দটা পাওয়া গেল সেই সময়ে… আলো ঠিকরে গেল দেওয়ালে, কড়িকাঠে, মেঝেতে। কিন্তু কোথাও কিছু নেই।

আবার শব্দ ভেসে এল—থপ… থপ… থপ…

শব্দ বাড়ছে…

টর্চ ঘুরে গেল জানলার দিকে। বন্ধ কাচের বাইরে পাখনা ঝাপটাচ্ছে একটা আতঙ্ক।

দুটো চোখ তার জ্বলছে টর্চের আলোয়। দেহ প্রকাণ্ড—দুটো ফুটবল পাশাপাশি জুড়লে যত বড় হয় তত বড়। তার দু’পাশের পাখনা আরও বড়—গোটা জানলা জুড়ে রয়েছে। সবেগে আছড়ে পড়ছে কাচের ওপর কিন্তু কাচ ভাঙবার মতন দেহভার তার নেই। অতীব সূক্ষ্ম কলেবর। তাকে ফুঁড়ে বাইরের আলো দেখা যাচ্ছে।

ঠিক যেন একটা অতিকায় মথ পোকা!

থপ থপ থপ থপ…

মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ছে… পড়ছে… পড়ছে… নারকীয় জিঘাংসা ঠিকরে যাচ্ছে বহুরঙা দুই চোখ থেকে!

আচমকা বিদায় নিল সে।

কিছুক্ষণ কেউ নড়ল না।

জ্বলে উঠল সমস্ত আলো। ঠিকরে ঘর থেকে রাস্তায় নেমে এল সকলেই। কেউ নেই রাস্তায়। পতঙ্গ ওঁত পেতে নেই। কোত্থাও।

অথবা হয়তো আলোয় সে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

বৈঠক বসল তারপরেই। নানা মুনির নানা মত শোনা গেল সেই বৈঠকে। উড়ুক্কু বিভীষিকাকে কেউ বলল অতিকায় মথ পোকা, কেউ বলল অজানা এক পাখি। কিন্তু রমেশকে নিশ্চয় তুলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই এই উড়ুক্কু বিভীষিকার। জানলার কাচ ভাঙবার ক্ষমতাও তো তার নেই। তবে সে এল কোত্থেকে? গেলই বা কোথায়?

সুরেশ সাইকিয়া তখন বললেন, টেলিফোনে যা-যা শুনেছিলেন।

গুম হয়ে রইল মাধবী। তারপর বললে, ‘পাহাড়ের কোনও গুহা থেকে এই আতঙ্কের আবির্ভাব ঘটেনি তো? সেখানেই হয়তো মাকড়সার মতন জাল পেতেছে… শিবালয়ের বাসিন্দাদের আটকে রেখেছে জ্যান্ত। খিদে পেলে খাবে। তাদেরই গলা শুনলেন টেলিফোনে।’

হাসতে পারলেন না সুরেশ সাইকিয়া। শুধু বললেন, ‘ও সব সায়েন্স ফিকশনে মানায়। এতগুলো মানুষকে জবাই করা বা বয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ওই পোকার নেই।’

পরী বলে উঠল, ‘কুকুরদের ধরবার ক্ষমতাও নেই।’

মনে পড়ে গেল মাধবীর। শিবালয় শহরে বেশ কয়েকটা জার্মান শেফার্ড আছে, একটা ডোবারম্যান আর একটা গ্রেটডেন আছে। এরা এখনও হাঁকডাক করছে না কেন? শহর এক্কেবারে নিস্তব্ধ। এদেরকে কাবু করাও তো সহজ নয়।

সবচেয়ে কঠিন হল বেড়ালদের কব্জায় আনা। বৃহৎ শক্তিও পারে না। তবে এরা গেল কোথায়?

সুরেশ সাইকিয়া মাধবীকে বললেন, ‘বেশ কিছু লোক আসছে। তাদের থাকার জায়গা দরকার। এক ঘরে একসঙ্গে থাকতে চাই। হেডকোয়ার্টার করব সেখানেই। অপারেশন চলবে সেখান থেকেই। এরকম ঘরের সন্ধান দিতে পারবেন?’

ভেবে নিয়ে মাধবী বললে, ‘একটু দূরেই একটা বড় কাফেটেরিয়া আছে। নিচের তলায় বড় বড় দু’খানা ঘর। একটায় শোয়া যাবে আর একটায় খাওয়া যাবে।’

‘চলুন, দেখে আসি।’

‘এখন?’ মাধবীর চোখ ঘুরে গেল জানলার দিকে। যেখানে একটু আগেই রহস্যময় কালো পতঙ্গ ডানা ঝাপটে গেছে।

সুরেশ সাইকিয়া উঠে পড়ে বললেন, ‘চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব নয়। তা ছাড়া, এখানে বসে থেকেও আপনি নিরাপদ নন।’

‘তা নই,’ উঠে পড়ল মাধবী, ‘নিরাপত্তা এই শহরের কোত্থাও নেই। শহরটাকে চেনাই যাচ্ছে না।’

শচীন আর সুধাকরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সুরেশ সাইকিয়া। তিনজনের হাতেই শটগান। এদের গা ঘেঁষে চলেছে মাধবী। স্ট্রিট ল্যাম্পের অম্বর-প্রভার বাইরে চাঁদের আলোয় ধোওয়া পথ মাড়িয়ে চলেছে চারজনে।

শহর যেন দমবন্ধ করে রয়েছে। গাছগুলোও রুদ্ধশ্বাস। দু’পাশের বাড়িগুলো বাষ্প-স্বচ্ছ প্রতিকৃতির মতন যেন ঝুলছে দু’পাশে।

সুরেশ সাইকিয়া চলেছেন সবার আগে। কী যেন পায়ে মাড়িয়ে ফেললেন। চমকে উঠলেন। শুকনো ঝরাপাতা।

চারতলা বাড়িটা এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে। মাধবী চিনিয়ে দিয়েছে ওই বাড়িতেই বসবে হেডকোয়ার্টার। গোটা বাড়িটা অন্ধকার। আলো নেই ভেতরে।

চারজনেই যখন রাস্তার ঠিক মাঝখানে, ঠিক তখন অন্ধকারের ভেতর থেকে কী যেন ছিটকে এল ওদের দিকে। সুরেশ সাইকিয়া চাঁদের আলোয় দেখলেন, যেন জলের ওপর ঢেউ খেলে গেল—ফুটপাতের চাঁদের আলোকে জল বলেই ভ্রম হচ্ছিল। হেঁট হয়ে টুপ করে বসে পড়েছিলেন তৎক্ষণাৎ। কানে শুনলেন, ডানার আওয়াজ। আলতোভাবে মাথা ঘষটে কী যেন বেরিয়ে গেল।

আর্ত চিৎকার ঠিকরে এল শচীনের গলা চিরে।

তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়েই ঘুরে দাঁড়ালেন সুরেশ সাইকিয়া।

মথ পোকা!

নিবিড়ভাবে বেষ্টন করে রয়েছে শচীনের মুণ্ড। কিভাবে, তা বুঝতে পারলেন না সুরেশ।

এখন চেঁচিয়ে উঠেছে সবাই, ছিটকে সরে গেছে শচীনের কাছ থেকে। কুঁই-কুঁই ডাক ছাড়ছে মথ পোকা—উচ্চনিনাদী। কানে যন্ত্রণা ধরানো ডাক।

চাঁদের রুপোলি আলোয় মখমল কোমল ডানা আরও ভালভাবে লেপটে ধরল শচীনের গোটা মুণ্ড আর ঘাড়।

টলতে টলতে পেছিয়ে যাচ্ছে শচীন। অন্ধের মতন। দু’হাতে মুখমণ্ডলে লেপটে থাকা উৎপাতকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে। আস্তে আস্তে কমে আসছে আতীক্ষ্ণ হাহাকার। সেকেণ্ড দুয়েক পরে কুলুপ পড়ল গলায়।

যেন পক্ষাঘাতে পঙ্গু সুরেশ সাইকিয়া, মাধবী আর সুধাকর।

দৌড়তে গেল শচীন। কয়েক পা গিয়েই থমকে গেল। দু’হাতে মুখ আঁকড়ে ছিল এতক্ষণ, এবার ঝুলে পড়ল দু’পাশে। এখন ওর হাঁটু ভেঙে যাচ্ছে।

পক্ষাঘাত কাটিয়ে উঠেছেন সুরেশ সাইকিয়া। শটগান বাগিয়ে দৌড়েছেন শচীনের দিকে।

দু’হাঁটু ভেঙে গেলেও পড়ে গেল না শচীন। কম্পমান দুই হাঁটুকে গায়ে গায়ে ঠেকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঝাঁকুনি দিয়ে দুই কাঁধ বেঁকিয়ে নিয়েছে। মুচড়োচ্ছে গোটা শরীর, ঠিক যেন ইলেকট্রিক কারেন্ট বয়ে যাচ্ছে শরীরের মধ্যে দিয়ে।

এক হাত বাড়িয়ে শচীনের মুখ থেকে মথ পোকাকে টেনে ছিঁড়ে আনতে গেছিলেন সুরেশ। তার আগেই নেচে উঠেছিল শচীন—যন্ত্রণা আর শ্বাসকষ্ট আর যেন সইতে পারছে না। দু’হাতে খামচে ধরছে বাতাস। নেচে নেচে রাস্তার ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে, কাঁধ দুলছে ডাইনে-বাঁয়ে—যেন পুতুলনাচিয়ের সুতোর টানে নেচে চলেছে গোটা শরীর। দু’হাত শিথিল হয়ে ঝুলছে শরীরের দু’পাশে। হাতের মুঠি খুলছে, ফের বন্ধ হচ্ছে, কিন্তু কখনওই উঠে এসে খামচে ধরছে না মুখ-ঘিরে-থাকা কদাকার আতঙ্ককে। এই মুহূর্তে তার নাচ যেন পরম সুখের—যন্ত্রণার নয়। পেছন পেছন এগিয়েছিলেন সুরেশ তবে কাছে যাওয়ার আগেই…

রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছিল শচীন।

সেই মুহূর্তে শূন্যে উঠে পড়ল মথ। স্বল্পক্ষণের জন্যে ভেসে রইল বাতাসে দুই ডানায় ভর দিয়ে। দুই চোখ অমনিশাকালো অসীম ঘৃণায় পরিপূর্ণ। ছোঁ মারল সুরেশের দিকে।

পিছিয়ে এসেই দুই বাহু দিয়ে নিজের মুখ চাপা দিয়েছিলেন—পড়ে গেছিলেন রাস্তায়।

তাঁর মাথার ওপর দিয়ে পিছলে বেরিয়ে গেল মথ।

মোচড় মেরে শরীর ঘুরিয়ে সেদিকে তাকিয়েছিলেন সুরেশ। ঘুড়ির সাইজের মথ নিঃশব্দে পিছলে চলে যাচ্ছে শূন্যপথে রাস্তা বরাবর। ওদিকের বাড়ির সারির দিকে।

শটগান তুলে ধরেছে সুধাকর, নির্ঘোষ ধ্বনি কামান গর্জনের মতো কাঁপিয়ে দিল শহরকে।

সোজা যেতে যেতে হেলে গিয়ে ঠিকরে গেল মথ। লটপটিয়ে রাস্তায় আছাড় খেতে খেতেও সিধে হয়ে উঠে গেল ওপরে—মিলিয়ে গেল বাড়ির ছাদের ওপর দিয়ে।

চিৎপাত হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে শচীন। নড়ছে না।

তার মুখ নেই। মুখটা যেন ছিড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চুল আছে, কপাল ঘিরে চামড়ার ফিতে দেখা যাচ্ছে সাদা হাড়ের ওপর। কঙ্কাল মুখ চেয়ে আছে আকাশপানে।

সোফায় শোয়ানো রয়েছে শচীনের মৃতদেহ। চাদর দিয়ে ঢাকা ঘরের মাঝখানে ছ’জনে বসে মুখোমুখি। কেউ কারও চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। দম আটকানো অস্বস্তি সইতে পারল না মাধবী। টর্চ হাতে উঠে গেল মৃতদেহের কাছে। চাদর সরিয়ে টর্চ ফেলে দেখল। চাদর টেনে দিয়ে এসে বসল চেয়ারে।

বললেন সুরেশ সাইকিয়া ধরা গলায়, ‘কী দেখলেন?’

কেশে গলা সাফ করে নিয়ে মাধবী বললে, ‘এরকম মৃত্যু কী করে সম্ভব হয়, তাই ভাবছি। রাস্তায় রক্ত পড়ে থাকতে দেখেছিলেন? দেখেননি। চোখ নেই কোটরে—রক্ত পড়েছে কি জামায়? নেই। থই থই রক্তের মধ্যে পড়ে থাকা উচিত ছিল যার, তার শরীরের মধ্যে একফোঁটা রক্ত নেই। শিরাগুলো দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। শুধু রক্ত নয়—গোটা ব্রেন উধাও। চোখ, নাকের তরুণাস্থি, দাঁতের মাড়ি, জিব—গোড়া পর্যন্ত সমস্ত দশ থেকে বারো সেকেণ্ডের মধ্যে নিমেষে পান করেছে ওই পোকা। হ্যাঁ, হ্যাঁ, পান করেছে। সবই অ্যাসিড জাতীয় কিছু দিয়ে গালিয়ে পুড়িয়ে চোখের পলক ফেলবার আগেই গিলে ফেলেছে। আমি আর ভাবতে পারছি না।’

সুরেশ সাইকিয়া ম্লানস্বরে বললেন, ‘দোষটা আমারই। রাস্তায় না বেরলেই হত।’

মাধবী বললে, ‘রাস্তায় পরে বেরলেও একই ঘটনা ঘটত। অন্তত একজনের অবস্থা এই রকম হত। দেখিয়ে দিল ওদের ক্ষমতা কতখানি। ফোর্স নিয়ে এসে করবেন কী? শটগান নির্ভুল লক্ষ্যে আঘাত হেনেছে। টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হয়নি। চোখে আঙুল দিয়ে ওরা দেখিয়ে দিয়ে গেল—ওদের খপ্পর থেকে পরিত্রাণ নেই। হয়তো ডাইনোসরদের আমলে ছিল এমন পতঙ্গ, কিন্তু হঠাৎ এখানে এল কিভাবে?’

ঘর নিস্তব্ধ। ক্ষণপরেই শোনা গেল দূরায়ত ক্ষীণ গুঞ্জন।

জানলায় দৌড়ে গেল ছ’জনেই। দূর রাস্তায় লাল আলোর ফ্ল্যাশ দেখিয়ে আসছে। তিনটে গাড়ি।

আলো কাঁপল এই সময়ে। নিভু নিভু হয়ে ফের জ্বলে উঠল।

রাত এগারোটা বেজে পনেরো মিনিট।

শুরু হল ডাকিনী মুহূর্তের প্রতীক্ষা…