» » আদিম আতঙ্ক

বর্ণাকার

অদ্রীশ বর্ধন

আদিম আতঙ্ক

সাত

সুমন্ত সেনের টেবিলে বসে আছেন সুরেশ সাইকিয়া। যুদ্ধকালীন আয়োজন চলছে তাকে ঘিরে। ছোট্ট দলের প্রত্যেককে কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। সুমন্তর ম্যাগাজিন সরিয়ে সেখানে বড় কাগজ পেতেছেন তিনি। টুকটাক পয়েন্ট, কেস হিস্ট্রি আর অ্যাকশন প্রোগ্রাম লিখছেন।

এবার টেনে নিলেন টেলিফোন, তুললেন রিসিভার। এসে গেল ডায়াল টোন। মাধবী লাহার মতন বেগ পেতে হল না।

ডায়াল করলেন এমার্জেন্সি নাম্বার—টিকেন্দ্ৰনগর হেডকোয়ার্টারে। জবাব দিল ডিউটি সার্জেন্ট অ্যান্টনি, ‘ইয়েস, স্যার?’

সংক্ষেপে ঘটনাবলীর সারাংশ বলে গেলেন সুরেশ সাইকিয়া।

‘রমেশ তাহলে খতম?’

‘সেটা বলা যাবে না যতক্ষণ না ডেডবডি দেখছি। এবার কাজের কথা। প্রথমেই একটা পাসওয়ার্ড তৈরি থাকা দরকার। শিবসুন্দর—এই পাসওয়ার্ড না শোনা পর্যন্ত মুখ খুলবে না কারও কাছে। শিবালয় টাউন থেকে কোনও খবর যেন বাইরে না যায়, বাইরের খবর যেন এখানে না আসে। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে শিবালয়কে।’

‘হয়ে যাবে। শিবালয় শহরে ফ্যাক্স মেশিন নেই, আমি জানি। টেলিফোন কাট-অফ করে দেব।’

‘তা সত্ত্বেও, খবরটা ছড়িয়ে যাওয়ার পর পাহাড় টপকে রিপোর্টার আসতে শুরু করবে। তাদের কাছে কোনও খবর যেন না যায়। রাইট?’

‘ইয়েস, স্যার।’

‘বারোজন লোক চাই। দু’জন থাকবে টাউনে ঢোকার মুখে। দশজন চলে আসবে আমার কাছে। এদের কারোরই যেন ঘরসংসার বলে কিছু না থাকে। প্রাণের মায়া অবশ্যই থাকবে না। শিবালয় শহরে যাদের আত্মীয়স্বজন আছে, সেরকম কাউকে নেবে না। দিন দুয়েকের মতন খাবার জল আর খাবার সঙ্গে আনবে প্রত্যেকেই। এই দু’দিন এখানকার জল বা খাবার তাদের দেওয়া যাবে না, ক্লিয়ার?’

‘ইয়েস, স্যার?’

‘বারোজনই নিজেদের সাইড আর্ম আনবে সঙ্গে, এ ছাড়াও একটা করে রায়ট গান আর টিয়ার গ্যাস।’

‘নেক্সট?’

‘শিবালয়ের ম্যাপ দেখলাম এখুনি। এ শহরের ঢোকবার পথ দুটো। একটা মেন রোড—সেখানে পাহারা বসিয়েছি। আর একটা রাস্তা পেছনের জঙ্গল দিয়ে নেমেছে। ডেসপারেট রিপোর্টাররা এদিক দিয়েও ঢুকতে পারে। দু’জনকে পাহারায় রাখব এখানে। ঠিক আছে? আমি জানি, তুমি এদিককার পাহাড়-পর্বতের খবর রাখো।’

‘রাখি।’

‘কর্নেল ডিসুজার নাম তুমি জানো। ঠিকানা ফাইলে পাবে। তাঁর সঙ্গে কথা বলার দরকার হতে পারে—ভিড় সামলানোর জন্যে। তৈরি থেকো।’

‘এনিথিং মোর?’

‘উতঙ্ক চৌধুরী নামটা লিখে রাখো। উ-ত-ঙ্ক চৌধুরী। কী তাঁর পরিচয়? পেশা? ঠিকানা? পুলিশ ফাইলে রেকর্ড আছে কি না, খোঁজ নেবে। কলকাতায় খোঁজ নেবে সবার আগে। বাঙালি নাম। আরও একটা নাম লেখো—বিনয় চৌধুরী। হোটেলের রেজিস্টারে নাম পেয়েছি। ডিটেলস জানো। আর একটা কথা। যে বারোজন আসবে, তাদের সঙ্গে দুশো পলিথিন ব্যাগ দিয়ে দেবে ডেডবডি রাখবার জন্যে।’

‘দুশোটা?’

‘পাঁচশোটাও লাগতে পারে। শিবালয়ে লোক থাকত পাঁচশো।’

‘ও মাই গড!’

টেলিফোন নিয়ে সুরেশ সাইকিয়া যখন তন্ময়, তখন পুলিশ রেডিও খুলে ফেলা হচ্ছে—রেডিও বিগড়েছে কেন, তা জানার জন্যে। থানার সমস্ত আগ্নেয়াস্ত্র নামানো হচ্ছে আলমারি থেকে—গুলি ঠাসা হচ্ছে প্রত্যেকটাতে।

সুরেশ সাইকিয়া এবার ফোন করলেন গভর্নর হাউসে।

গভর্নর জ্যাক সাংঘুলানা আর পুলিশ প্রধান সুরেশ সাইকিয়া এক সময়ে একই ক্লাসে স্কুলে পড়েছিলেন। সেই বন্ধুত্ব আজও আছে। জ্যাক চলে গেছিলেন পলিটিক্সে। ধাপে ধাপে উঠে এসেছেন গভর্নরের পোস্টে। দিল্লি তাঁকে খাতির করে। কারণ অত্যন্ত সেন্সিটিভ এই পাহাড়ি অঞ্চলে তাঁর হুকুমে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়। পুরো জায়গাটা তাঁর নখদর্পণে।

জ্যাক সাংঘুলানাকে এত রাতে টেলিফোন করে পাওয়া যায় না। কিন্তু সুরেশ সাইকিয়া জানেন, কী করে তাঁর ঘুম ভাঙাতে হয়। এখানেও আছে ‘চিচিং ফাঁক’ পাসওয়ার্ড। নিতান্ত প্রয়োজন হলে সুরেশ ব্যবহার করেন এই গুপ্ত পরিচয়।

টেলিফোন ধরলেন গভর্নর। ঘুমজড়ানো গলায় বললেন, ‘কী ঝামেলায় পড়েছিস?’

সুরেশ গুছিয়ে বললেন ঝামেলার বৃত্তান্ত।

জ্যাক বললেন, ‘কী চাস?’

‘টেলিফোন সেন্টার কাট-অফ করে দিক শিবালয় টাউনকে। খবরটা কাল ছড়িয়ে পড়লেই ঘরে ঘরে টেলিফোন যেন না বাজে। বাজুক শুধু এইখানে—থানায়।’

‘তাই হবে। আর?’

‘হেলথ ডিপার্টমেন্ট যেন নাক না গলায়। জীবাণু সংক্রমণ না পরিবেশ দূষণ—এটা যখন জানা যায়নি তখন তাদের হল্লাবাজির দরকার নেই।’

‘কিন্তু সুরেশ, গোটা টাউনের সমস্ত মানুষ যদি মরে যায় হঠাৎ, হেলথ ডিপার্টমেন্টকে তো আটকানো যায় না। যাকগে, তুই যখন বলছিস, তাই হবে। জার্মস না পয়জন—এটা আগে ঠিক কর।’

‘দুটো জেনারেটর চাই। পাওয়ার কন্ট্রোল আমাদের হাতে নেই, যখন তখন লোডশেডিং হচ্ছে।’

‘জেনারেটর সমেত ভ্যান পাঠাচ্ছি। আর্থকোয়েক রিসার্চ ডিপার্টমেন্টে খানকয়েক আছে বলে জানি। আর কী?’

‘কর্নেল ডিসুজাকে দরকার।’

‘কর্নেল ডিসুজা! কেন?’

‘চমকে উঠলি? যদিও ব্যাপারটা খুব সিক্রেট তবুও আমি জানি কেমিক্যাল অ্যাণ্ড বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার সংক্রান্ত একটা প্রোজেক্টের উনি কর্ণধার। এই পাহাড়ি অঞ্চলে গোপনে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন আর্মির হয়ে। যেহেতু তিনি রিটায়ার্ড, তাই সন্দেহ তাঁকে ছুঁতে পারছে না। কিন্তু আমি জানি, আমাকে জানতে হয়। ওঁকে আমার চাই। একমাত্র উনিই ধরতে পারবেন কেন কাটাছেঁড়া আর ফুলে ঢোল বডি পাওয়া যাচ্ছে যেখানে-সেখানে, কী কারণেই বা অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে একটা মানুষ।’

ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন জ্যাক, ‘ওঁর এক্সপেরিমেন্টের নার্ভ গ্যাস অথবা পয়জন এই কাণ্ড ঘটিয়েছে বলে কি তোর মনে হচ্ছে?’

‘কর্নেল ডিসুজাই তা বলতে পারবেন। যেহেতু উনি এই প্রোজেক্টের সিভিলিয়ান ডিফেন্স ইউনিটের কম্যান্ডিং অফিসারও বটে, তাই তাঁর গোচরে আনা দরকার এখানকার পুরো ব্যাপারটা। ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে উনি সায়ান্টিস্টদের এনে ফেলতে পারবেন শিবালয় টাউনে। বায়োলজিস্ট, ভাইরাস-এক্সপার্ট, ব্যাকটিরিয়োলজিস্ট, ফোরেনসিক মেডিসিনে এক্সপার্ট প্যাথোলজিস্ট, নিউরোলজিস্ট, এমনকী নিউরো-সাইকোলজিস্টকেও আনতে পারবেন উনিই। ওঁর ডিপার্টমেন্টেই আছে মোবাইল ফিল্ড ল্যাবরেটরি। গাড়িগুলো রয়েছে নানা অঞ্চলের গ্যারেজে—শিবালয়ের কাছাকাছি গ্যারেজে নিশ্চয় আছে। আমি একটু পরেই তাঁকে ফোন করছি। তার আগে তুই তাঁকে জানিয়ে রাখ—’

‘রাখছি। আর কী চাহিদা?’

‘একটা শর্টওয়েভ রেডিও। এখানকার রেডিও বিগড়েছে। টেলিফোনও যখন তখন বন্ধ হচ্ছে—’

‘যাচ্ছে—রেডিও ভ্যানেই থাকবে। আর কী?’

‘টেলিফোনের কাছে হাজির থাকিস। শিবালয় ওয়ার্ল্ড নিউজ হয়ে যেতে পারে রাত ভোর হলেই। তোকে যেন পাই।’

‘নিউজ যাতে না হয়, সে চেষ্টা করছি। পেজার আর সেলুলার ফোনও পাঠিয়ে দিচ্ছি। বিনিময়ে তোকে শুধু একটা কথা দিতে হবে। এমন কিছু ঝুঁকি নিবি না যাতে সুরেশ সাইকিয়া হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে।’

‘কথা দেওয়া সম্ভব নয়। ছাড়ছি।’

রিসিভার রেখে দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন পুলিশ প্রধান। দেখলেন রেডিওর সামনের প্লেট খোলা হয়ে গেছে। ফায়ার আর্মসগুলোয় কার্তুজ ঠাসা চলছে। পরী কফি বানাচ্ছে।

ফের টেলিফোন তুললেন। ডায়াল টোন এল না। অথচ কে যেন রয়েছে অপর প্রান্তে। সে কান পেতে শুনছে।

‘হ্যালো,’ বললেন সুরেশ। জবাব নেই।

মাধবী লাহাও ঠিক এই পরিস্থিতিতে পড়েছিল। উপলব্ধি করেছিল, কে যেন বোবা হয়ে রয়েছে ওদিককার রিসিভারে।

‘কে তুমি?’ আস্তে বললেন পুলিশ প্রধান।

জবাবের আশা করেননি—কিন্তু জবাব পেলেন।

কণ্ঠস্বর নয়। খুব চেনা একটা শব্দ। পাখি ডাকছে। খুব সম্ভব গাংচিল। হ্যাঁ, গাংচিলের ডাক। জোর হাওয়া বইছে সমুদ্রতীরে—সেই আওয়াজের ওপর গলা চড়িয়ে ডাকছে গাংচিল।

পালটে গেল আওয়াজ। খটখটাখট খটখটাখট শব্দ হচ্ছে। ফোঁপরা লাউয়ের খোলে কাঁইবিচি রেখে যেন নাড়া হচ্ছে। কোথায় যেন এ-আওয়াজ শুনেছেন সুরেশ।

র‍্যাটলস্নেক!

হ্যাঁ। বিষধর র‍্যাটলস্নেকের ওয়ার্নিং সিগন্যাল। না, ভুল হয়নি। ওই সাউণ্ড ভোলা যায় না।

সে শব্দও পালটে গেল। ইলেকট্রনিক গুঞ্জন। না, ইলেকট্রনিক নয়। মৌমাছির গুঞ্জন। ঝাঁক বেঁধে গুনগুন করছে।

আবার শোনা গেল গাংচিলের চিৎকার। গান গেয়ে উঠল আর একটা পাখি—ভারী মিষ্টি ডাক। সেই সঙ্গে জিব বের করে হাঁপানির আওয়াজ। কুকুর নাকি?

চাপা গজরানি। না, কুকুর নয়। আরও বড় জানোয়ার। ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে আঁচড়াচ্ছে কামড়াচ্ছে লড়ছে একাধিক বেড়াল।

গা হিম হয়ে এল সুরেশ সাইকিয়ার।

থেমে গেল ইতর প্রাণীদের চেঁচানি।

কান পেতে রইলেন সুরেশ। বললেন খাটো গলায়, ‘কে তুমি?’

জবাব নেই।

‘কী চাও?’

যেন বরফ দিয়ে তৈরি ছুরির মতন অনেকগুলো তীক্ষ্ণ চিৎকার তারের মধ্যে দিয়ে ভেসে এসে বিঁধে গেল কানে। কলজে-ছেঁড়া চিৎকার করে যাচ্ছে পুরুষ, নারী, শিশু। বহুজনে। অ্যাকটিং নয়—রিয়্যাল। আতঙ্কে যন্ত্রণায় এইভাবে চেঁচায় মানুষ।

রক্ত উত্তাল হল সুরেশ সাইকিয়ার—উদ্দাম হল হৃৎপিণ্ড, মনে হল যেন নরকের দরজা খুলে গেছে কানের পর্দায়। চেঁচাচ্ছে কারা? শিবালয় শহরে যারা ছিল, যারা মরে গেছে—তারা?

টেপরেকর্ডে ধরা ছিল চিৎকারগুলো? কে ধরে রেখেছে? এই স্মৃতির দরকার কী?

চরম চিৎকারটা একক হয়ে বেজে উঠল সবশেষে। বাচ্চা গলায় আকুল সেই চিৎকার শুনে মনে হল যেন টেনে টেনে তার হাত-পা ছেঁড়া হচ্ছে। পাক খেয়ে খেয়ে চিৎকারটা চূড়ান্ত হয়ে যেতেই থেমে গেল হঠাৎ।

আবার সেই নৈঃশব্দ্য। এবার আরও ভয়াবহ। আরও স্পষ্টভাবে টের পাচ্ছেন সুরেশ সাইকিয়া তারের অপর প্রান্তের সত্তাকে। অতিশয় অশুভ সত্তা। নীরব।

আস্তে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন পুলিশ প্রধান। লোম খাড়া হয়ে গেছে তাঁর। আঙুল কাঁপছে। ঘাম জমেছে কপালে—গড়াচ্ছে ঘাড়ের পেছনে।

ঘরের কেউ তাঁর এই অবস্থা লক্ষ করছে না। ব্যস্ত যে যার কাজ নিয়ে। এই মুহূর্তে মুখ খুলতেও চান না পুলিশ প্রধান। গলা কেঁপে যাবে। তিনি যে লীডার…

আবার হাত বাড়ালেন রিসিভারের দিকে। তুলে নিলেন।

ফিরে এসেছে ডায়াল টোন।

ডাক দিলেন কেমিক্যাল অ্যাণ্ড বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার প্রোজেক্টের সিভিলিয়ান ডিফেন্স ইউনিটকে।

পরী খেতে দিল সবাইকে। সুমন্তর টেবিলে। ঠিক তখনই আলো কেঁপে উঠল মাথার ওপর। একবার… দু’বার… তিনবার…

আলো কাঁপছে বাইরেও… রাস্তায়… একবার… দু’বার… তিনবার…

নিভে গেল সমস্ত আলো।