» » আদিম আতঙ্ক

বর্ণাকার

অদ্রীশ বর্ধন

আদিম আতঙ্ক

ছয়

আর্ট গ্যালারির পাশের দোকানটায় ম্যাগাজিন, টোব্যাকো আর বইয়ের দোকান। আলো জ্বলছে ভেতরে, দরজা রয়েছে খোলা। বইয়ের দোকানের দরজা রোববারেও খোলা থাকে।

সুরেশ সাইকিয়া আগে ঢুকলেন, তাঁর পেছনে মাধবী আর পরী, একদম পেছনে বিশু বোস।

জনপ্রাণী নেই দোকানঘরে, নেই অফিসঘরে, নেই ওপরতলায়। শুধু জল থইথই করছে মেঝেতে। অথচ পাইপ ফুটো হয়নি। কুলার থেকে জল উপচে বেরিয়ে আসেনি।

নির্নিমেষে এই জলের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বেরিয়ে এলেন সুরেশ সাইকিয়া। জলটা তাঁর ভাল লাগেনি।

জল দেখা গেল পাশের বাড়িতেও। ও বাড়ির একতলায় ওষুধের দোকান। ওপরের তলায় মালিকের ফ্ল্যাটে। বসবার ঘরের কার্পেটে ফুলে উঠেছে জলে। অথচ জল এসেছে কোত্থেকে, তা ধরতে পারছেন না উজাগর সিং।

এর পাশেই ছোট্ট হোটেলে দেখা গেল অন্য দৃশ্য।

তিনতলা বাড়ি খাঁ-খাঁ করছে। একতলায় বসবার ঘর, কাউন্টার ফাঁকা। দোতলায় মালিকের ফ্ল্যাট ফাঁকা। তিনতলায় ছ’টা ঘরই ফাঁকা। অথচ সেখানে অতিথি ছিল। তাদের থাকার চিহ্ন ছড়ানো রয়েছে ঘরময়। নেই কেবল মানুষগুলো।

 ষষ্ঠ ঘরের বাথরুমের দরজা বন্ধ ছিল ভেতর থেকে। ল্যাচ লাগানো দরজা—লক টানতে হয় ভেতর থেকে। নিশ্চয় মানুষ আছে ভেতরে।

হেঁকে বলেছিলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘পুলিশ। দরজা খুলুন।’

সাড়া নেই।

ধাক্কা দিলেন।

সাড়া নেই।

রিভলভারের এক গুলিতে লক উড়িয়ে দিলেন।

কলতলা ফাঁকা।

জানলা নেই। সুতরাং কলতলায় যে ঢুকেছিল, সে ঘরেই আছে। তবে উবে গেছে। শুধু একটা নিশানা রেখে গেছে বেসিনের ওপকার আয়নায়। আঠালো কালি দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে: আদিম শত্রু। উতঙ্ক চৌধুরী।

বিশু বোস আর সুরেশ সাইকিয়ার মাঝে দাঁড়িয়ে মাধবী আর পরী যখন লেখাটা পড়ছে, ঠিক তখন পাশের দোকানে আবার রহস্যময় জলের ওপর দাঁড়িয়ে পড়েছেন উজাগর সিং…

শুধু জল। মেঝে ভরতি জল। পাইপ ছেঁদা নেই, অথচ জল জমে রয়েছে মেঝেতে।

মালিকের কিচেনে ঢুকে একটা প্লাস্টিকের খালি শিশি পেলেন উজাগর সিং। আর একটা চামচে। জল তুলে ভরলেন শিশিতে।

স্যাম্পেল সংগ্রহ করলেন। খটকা যখন লেগেছে, কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করাবেন।

এ জল সাধারণ জল নয়।

চোখের পাতা নামাতে পারছে না মাধবী। চক্ষুগোলক ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে কোটর থেকে।

পরী বললে শুকনো গলায়, ‘দিদি, উতঙ্ক চৌধুরী কে?’

‘যে লিখেছে,’ বিশু বোস জবাব দিলেন।

‘এ ঘর যে ভাড়া নিয়েছিল?’ সুরেশ সাইকিয়ার প্রশ্ন।

‘রেজিস্টার দেখে এসেছি আসবার সময়ে,’ বললেন বিশু বোস, ‘এ নাম পাইনি। নেমে গিয়ে ফের দেখব।’

পরী বললে, ‘খুনীদের একজনের নামও তো হতে পারে? ঘরে যে ছিল, সে চিনতে পেরেছিল। তাই নামটা লিখে রেখেছে।’

মাথা নাড়লেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘খুনী কখনও নিজের নাম রেখে যায়? খুন করার পর নাম মুছে দিয়ে যেত।’

 ‘হয়তো জানত না এ নাম লেখা আছে আয়নায়। জানলে তো মুছবে,’ পরীর গলায় আশ্চর্য জোর এসেছে।

‘অথবা হয়তো জানত, জেনেও মোছেনি। রোগ-জীবাণু যখন মানুষকে পাগল করে দেয়, তখন সূত্র পড়ে রইল কি রইল না এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না,’ আস্তে বললেন বিশু বোস। ‘তোমার দিদি কিন্তু বলেছেন, র‍্যাবিড ম্যানিয়াকদের হাত থাকতে পারে শহরজোড়া এই খুনখারাপিতে।’

‘উতঙ্ক চৌধুরী নামে কেউ আছে শিবালয় টাউনে?’ মাধবীকে সুরেশ সাইকিয়ার প্রশ্ন।

‘অদ্ভুত নাম। একবার শুনলে মনে থাকত।’

‘এ টাউনের সবাইকে আপনি চেনেন?’

‘নিশ্চয়।’

‘পাঁচশো জনকেই?’

‘প্রায়।’

‘তাহলে জনাকয়েককে এখনও চেনেন না। উতঙ্ক চৌধুরী এই জনাকয়েকের মধ্যে তো থাকতে পারে?’

‘চোখের দেখা না দেখলেও নাম নিশ্চয় শুনতাম। ছোট্ট শহর। পাড়াপড়শির গল্পগুজব আমার সামনেই হয় বিশেষ করে, এই নামের কেউ থাকলে তাকে নিয়ে জমিয়ে হাসিঠাট্টা হত নিশ্চয়। না, না, এ নামে এ টাউনে কেউ নেই।’

‘আশপাশের কোনও অঞ্চলের মানুষ কি? তারাও তো আসে আপনার কাছে?’

চুপ করে রইল মাধবী। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। শুধু ভাবতে চাইছে। লেখাটা নিয়ে ভাবনা এখানে আটকে যাচ্ছে, ফাঁকা কোথাও গেলে হত। এই ঘরের পরিবেশ সহ্য হচ্ছে না। গা শিরশির করছে। মন বলছে—পালাও! পালাও! মাধবী লাহা, এই বাড়িরই আর এক জায়গায় তোমাদের জন্য তৈরি হচ্ছে আর এক আতঙ্ক!

পরী চেয়েই ছিল আয়নার দিকে। এখন বললে, ‘আদিম শত্রু কে?’

‘উতঙ্ক চৌধুরী—আবার কে? লিখেই তা জানাতে চেয়েছে লেখক,’ বললেন বিশু বোস।

‘লিখেছে তো গোঁফ কালো করবার পেন্সিল দিয়ে। কোথায় সেই পেন্সিল?’ জিজ্ঞেস করলেন সুরেশ সাইকিয়া।

পাওয়া গেল না বাথরুমের কোত্থাও।

এখন ওরা নিচের তলায়। গেস্ট রেজিস্টারে নাম পাওয়া গেল ভদ্রলোকের—বিনয় চৌধুরী, কলকাতা।

কলতলায় ঢুকে যিনি ভ্যানিশ হয়ে গেছেন! সঙ্গে নিয়ে গেছেন শুধু গোঁফ কালো করার পেন্সিল।

রেজিস্টারের অন্য নামগুলোয় চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন বিশু বোস— ‘উতঙ্ক চৌধুরী নামে কেউ এখানে থাকেননি।’

‘তাহলে বেরিয়ে পড়া যাক,’ বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘দেখা যাক কী পেলেন উজাগর সিং।’

গলিপথ ধরে দরজার দিকে যাওয়ার পথে সামনে পড়ল একটা টেবিল। সিলিং থেকে আলো ঝুলছে তার ওপর। পরীকে টেনে নিয়ে সবার আগে ওইদিকেই পা চালিয়েছিল মাধবী—এ-বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার মতলবে। আচমকা চিৎকারটা বেরিয়ে এল ওরই গলা চিরে।

একই সঙ্গে প্রত্যেকে দেখল সেই দৃশ্য।

আলোর নিচে যেন একটা শিল্পসামগ্রী বসানো রয়েছে টেবিলের ওপর। কব্জি থেকে কাটা একটা হাত। বুড়ো আঙুল, তর্জনী আর মধ্যমা দিয়ে ধরে রয়েছে একটা পেন্সিল—গোঁফ কালো করার পেন্সিল।

যে পেন্সিল পাওয়া যায়নি কলতলায়।

কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বিশু বোস বললেন, ‘এখান দিয়ে যাবার সময়ে টেবিলে কিছু ছিল কি?’

‘না,’ সুরেশ সাইকিয়ার প্রশান্ত জবাব, ‘নিচে নেমে আসছি যখন, তখন এনে রাখা হয়েছে আমাদের দেখানোর জন্যে।’

উনি স্তব্ধ হতেই ওপরতলা থেকে ভেসে এল একটা আওয়াজ—ক্যাঁচ… ক্যাঁচ।

পাল্লা ঘোরানো হচ্ছে, খোলা হচ্ছে, ফের বন্ধ হচ্ছে… আবার… আবার…

আপনা থেকে নিশ্চয় হচ্ছে না। কেননা, হাওয়া তো নেই।

মাধবীর দিকে ফিরলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘মন্দিরের ঘণ্টা আর সাইরেনের আওয়াজ যখন শুনেছিলেন, তখন কি আপনার মনে হয়েছিল ঘটনা আবার ঘটবে, আমরা এলে?’

‘হয়েছিল।’

‘ইওর প্রিমনিশন ইজ কারেক্ট, ডক্টর লাহা। ঘটনা আবার ঘটতে চলেছে।’

রমেশ থাপার মেজাজ খিঁচড়েছে। সে এখন দাঁড়িয়ে আছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স-এর সামনে। তার একপাশে উজাগর সিং, আর একপাশে শচীন আর সুধাকর।

চারজনেই চেয়ে আছে রাস্তার উল্টোদিকের ছোট্ট হোটেলটার দিকে। দরজা দিয়ে এইমাত্র বেরিয়ে এলেন সুরেশ সাইকিয়া আর বিশু বোস। মাধবী আর পরী তাঁদের পেছনে। চারজনেরই হাঁটতে যেন কষ্ট হচ্ছে।

উজাগর সিং অর্ডার দিয়েছেন একই সঙ্গে ঢোকা হবে এই দোকানটায়। গতিক সুবিধের মনে হচ্ছে না। ভয়ানক কিছু ঘটেছে দোকানঘরে। নইলে সামনের শোকেসের পেল্লায় কাচ দু’খানা বাইরে ঠিকরে এসে ফুটপাতের ওপর ভেঙে পড়বে কেন?

উজাগর তাই প্ল্যান করেছেন, দল ভারী করে ঢুকতে হবে ভেতরে। অনেক অভিজ্ঞতাই তো হল, সৃষ্টিছাড়া অনেক কিছুই দেখা হল।

এসে গেছেন সুরেশ সাইকিয়া। প্লাস্টিক শিশিতে আনা অদ্ভুত জলের নমুনা তাঁকে দেখাচ্ছেন উজাগর সিং। সুরেশ সাইকিয়া বলছেন, এমনই জলের সাক্ষাৎ তিনিও পেয়েছেন। দু-জনেই চেয়ে আছেন শোকেসের ভাঙা কাচের দিকে। কী এমন ঘটল দোকানের ভেতরে যে দু-দু’খানা কাচ ভেঙে পড়ল বাইরের দিকে? ভেতরে ঢোকার ফন্দি আঁটছেন খাটো গলায়।

এই হ্যাপায় ঢোকবার কোনও ইচ্ছেই নেই রমেশ থাপার। পুলিশের চাকরি বড় ঝঞ্ঝাটের। দোকানের ভেতরে নিশ্চয় নারকীয় কিছু ঘটেছে। বড় দোকান। শোকেসে যা কিছু সাজানো ছিল, ভাঙা কাচের ওপর সেসবও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ফুটপাতে। কাচ যে অথবা যারা ভেঙেছে, তারা নিশ্চয় ওঁত পেতে বসে রয়েছে ভেতরেই। রমেশ ঠিক করল, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা!

মতলব স্থির হয়ে গেছে সুরেশ সাইকিয়ার। লাইন দিয়ে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন দোকানের দরজার দিকে। রমেশ রইল সবার পেছনে।

তছনছ হয়ে রয়েছে মনোহারী দোকান। তাকভরতি সমস্ত জিনিস ঝটকান মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছে মেঝেতে। বিষম আক্রোশে যেন তাথৈ তাথৈ নৃত্য চলেছে ঘর জুড়ে। ভারী জিনিস শূন্যে তুলে আছড়ে ফেলা রয়েছে—আস্ত কাচ কোত্থাও নেই।

দোকানের পেছনদিকে শুধু বস্তা আর বাক্স। প্রত্যেকটা বস্তা ছিঁড়ে ফালা ফালা করা, বাক্সগুলো ভেঙে ফুটিফাটা—ভেতরের সব জিনিস বাইরে ছড়ানো।

সুরেশ সাইকিয়া বললেন, ‘এবার স্টোররুমটা দেখা যাক।’

আলো নিভে গেল ঠিক তখুনি।

রাস্তার আলোও নিভে গেছে—তাই সামনের জানলা দিয়ে আসছে না আলো। স্টোররুমের সামনে নিচ্ছিদ্র তমিস্রা ওদের গিলে ফেলেছে…

একই সঙ্গে শোনা গেল অনেকগুলো গলা।

‘টর্চ।’

‘দিদি!’

‘টর্চ কোথায়?’

তারপরেই খুব দ্রুত ঘটে গেল পর-পর কয়েকটা ঘটনা।

টর্চ জ্বলে উঠল বিশু বোসের হাতে। বর্শাফলকের মতন আলো ধেয়ে গেল মেঝের ওপর দিয়ে। কে যেন তাঁকে প্রচণ্ড ধাক্কা মারল পেছন থেকে। সেই মুহূর্তে তাঁর পেছনে কারও থাকার কথা নয়। থাকলেও সে ছিল অদৃশ্য অবস্থায়। তার গতিবেগও অবিশ্বাস্য। বিশু বোসকে আছড়ে ফেলল শচীনের ওপর, শচীন তাঁকে নিয়েই ঠিকরে পড়ল সুধাকরের ওপর। তিন জনেরই দেহ একই সঙ্গে গড়িয়ে গেল মেঝের ওপর— সেই সঙ্গে বোতাম টিপে রাখা জ্বলন্ত টর্চবাতি। গড়াতে গড়াতে আলোর ঝলক ফেলে যাচ্ছে এলামেলোভাবে।

গড়ানে বিদ্যুৎ-মশালকে মেঝে থেকে তুলে নিতে গিয়েও পারলেন না সুরেশ সাইকিয়া।

ইতিমধ্যেই শূন্যে উঠে পড়েছে রমেশ থাপার শরীর। যে অদৃশ্য শক্তি তিন-তিনটে মনুষ্যদেহকে হেলায় ঠিকরে দিয়েছে মেঝের ওপর, সেই শক্তিই আচমকা রমেশের কাঁধ খামচে তাকে তুলে নিয়েছে শূন্যে।

রমেশের পা এখন মেঝেতে ঠেকছে না। তার কাঁধে অতি-শীতল বস্তুর ছোঁয়া, একটু ভিজে ভিজে। বস্তু বলে মনে হলেও তা সজীব…

শূন্যে পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে কোমরের টর্চের দিকে হাত বাড়িয়েছিল রমেশ।

পাইথনের পাক যেন চেপে বসল গলা ঘিরে। দম আটকে এল রমেশের। টর্চ টেনে আনার কথা আর মনে রইল না। দু’হাত তুলে অদৃশ্য নাগপাশকে খামচে ধরতে যেতেই…

দু’হাতকে জাপটে ধরে অবশ করে দিল আততায়ী। হিমশীতল আলিঙ্গন—বাহু, ধড় সবকিছুর ওপর দিয়ে।

শিশুর মতন কেউ তাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে শূন্যপথে। গলা ফাটিয়ে চেঁচানোর চেষ্টা করেছিল রমেশ… মুখের ওপর চেপে বসেছিল থাবা। থাবা ছাড়া তাকে আর কিছু মনে করতে পারেনি রমেশ। মুখ ঠুসে ধরায় কোনও আওয়াজ আর বেরোয়নি।

 নাকে ভেসে এসেছিল দুর্গন্ধ। খুব উৎকট নয়, কিন্তু অসহ্য। এরকম বদ গন্ধ রমেশকে জীবনে শুঁকতে হয়নি।

গোটা শরীরে পাক দিচ্ছে। বমি ঠেলে উঠে আসতে চাইছে। অবিশ্বাস্য এক দুঃস্বপ্ন রমেশকে পেঁচিয়ে ধরে নিয়ে চলেছে কল্পনাতীত পরিণতির দিকে। রমেশ বুঝেও কিছু করতে পারছে না…

টর্চ লাইট গড়িয়ে গিয়ে ধাক্কা খেতেই কাচ আর বাল্ব ভেঙে গেল। এখন এখানে নরকের একাকার।

সঙ্গীদের হাঁকডাক শুনতে পাচ্ছে রমেশ কিন্তু যেন বহুদূর থেকে!

রমেশ থাপাকে আর পাওয়া গেল না।

নিভে যাওয়া টর্চলাইট কুড়িয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দপ দপ করে জ্বলে উঠেছিল মনোহারী দোকানের সমস্ত আলো। খুব জোর পনেরো থেকে বিশ সেকেণ্ডের মতন অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছিল সবাইকে। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেছে রমেশ। আলো জ্বলবার পর দেখা গেল শুধু সে নেই— সবাই আছে।

খোঁজা হয়েছিল সব জায়গাতেই। পাওয়া যায়নি। রাস্তাতেও নেই রমেশ, নেই ফুটপাতে। শিবালয় শহর যেন নিঃশব্দে বিদ্রুপের হাসি হেসে চলেছে।

‘গেল কোথায়?’ প্রশ্নটা উজাগর সিং-এর।

‘নিজে যায়নি, নিয়ে গেছে,’ সুরেশ সাইকিয়ার জবাব।

চেঁচাল না কেন?’

‘চান্স পায়নি বলে।’

‘জ্যান্ত অবস্থায়, না, মরা অবস্থায়?’ পরী আর মুখ বুজে থাকতে পারল না।

‘মরে কাঠ না হলে রমেশকে নিয়ে যাওয়া যেত না,’ দাড়ির জঙ্গল চুলকোলেন উজাগর, ‘ডেডবডি দেখতে পাব শীগগিরই।’

এই কথার জবাবেই যেন সহসা জ্বলে উঠল রাস্তার সমস্ত আলো। হঠাৎ বেড়ে গেল হাওয়ার বেগ— ভেসে এল গাছের পাতাদের নড়াচড়ার আওয়াজ। নুয়ে পড়েছে ডালপালা, দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে রাস্তার ওপর দিয়ে হু হু করে…

উজাগর বললেন, ‘রমেশের ডেডবডি যদি দেখতে পেতাম—’

কথা শেষ হল না, বেজে উঠল মন্দিরের ঘণ্টা। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে শিবমন্দির। রাস্তার মোড়ে। চুড়োয় মস্ত পিতলের ঘণ্টা। ঘণ্টা দুলছে রাস্তার—আলো ঝিলিক তুলে ঠিকরে যাচ্ছে তার পেতলের বপু থেকে। ঘণ্টা নাড়ানো হচ্ছে নিচ থেকে। দড়ি ধরে কেউ টানছে… ঘণ্টা নড়ছে… বাজছে…

‘কে টানছে?’ পরী হাত চেপে ধরল দিদির।

‘উজগর সিং যার ডেডবডি দেখতে চেয়েছিলেন, হয়তো সে,’ ফিসফিস করে বললে মাধবী।

কথাটা শুনল সবাই। কিন্তু হাসতে পারল না কেউই। সবারই মনের চোখে যুগপৎ ভেসে উঠল একটা শবদেহের ছবি। ফুলে ঢোল হয়ে ওঠা, নীলচে-কালচে রঙের একটা শবদেহ মন্দিরের ঘণ্টা ঘরের তলায় দাঁড়িয়ে দু’হাতে দড়ি ধরে টানছে… টানছে… টানছে…। ঘণ্টাধ্বনির সম্মোহনী শক্তি একটু করে সবাইকে আচ্ছন্ন করে আনছে। যেন টানছে সব্বাইকে। পা চুলবুল করছে মন্দিরের দিকে যাওয়ার জন্যে… মনের শক্তি লোপ পাচ্ছে ধীরে ধীরে।

দাঁতে দাঁত পিষে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘ডাকছে, আমাদের ডাকছে।’ উনি নিজের মনোবল জাগ্রত করছেন—ইচ্ছাশক্তিকে লোপ পেতে দিচ্ছেন না।

আচ্ছন্নের সুরে বলে গেলেন উজাগর, ‘হ্যাঁ, আমাদের ডাকছে…।’

উসখুস করছে আর সকলেই। যেন মন্ত্র-অবশ অঙ্গ প্রত্যেকেরই।

‘যাবেন না,’ ক্ষীণ কণ্ঠে বললে মাধবী।

সুরেশ সাইকিয়া শক্ত করে নিয়েছেন নিজেকে, ‘রাইট। এখান থেকে গিয়ে রমেশ থাপা-ই যদি ঘণ্টা বাজায়—’

‘উদ্ভট চিন্তা,’ আধবোজা চোখে বিড় বিড় করে গেলেন উজাগর সিং।

কঠোর কণ্ঠ সুরেশ সাইকিয়ার, ‘যেই বাজাক, আর একটা লোককেও বলি দিতে রাজি নই। আসুক নতুন ফোর্স, তখন দেখব কে বাজাচ্ছে ঘণ্টা। তার আগে চলুন থানায়। মার্চ।’

সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল ঘণ্টাধ্বনি। উজাগরের কথায় সায় দিয়ে যে প্রবল উৎসাহে ঘণ্টা বাজাচ্ছিল, সুরেশ সাইকিয়ার সিদ্ধান্তে হতাশ হয়ে সে যেন ঘণ্টার দড়ি ছেড়ে দিল। শব্দের শেষ ঢেউটা কাঁপতে কাঁপতে দূর হতে দূরে মিলিয়ে গেল একসময়ে। আবার দম আটকানো নীরবতা।

জুতোর আওয়াজে নৈঃশব্দ্য ভাঙতে ভাঙতে ওরা এগিয়ে গেল থানার দিকে। বড় রাস্তা ছেড়ে নামল না গলিতে। শর্টকাটের আর দরকার নেই, দরকার শুধু জোরালো আলোর।

জুতোর শব্দ এসে থামল থানার সামনে। আগে ঢুকলেন সুরেশ সাইকিয়া। সবশেষে উজাগর সিং।

চেয়ে রইলেন সবাই মেঝের দিকে। সুমন্ত সেনের দেহ কিছুক্ষণ আগেও এখানে পড়েছিল। এখন নেই। জায়গাটা খালি।