☼ অদ্রীশ বর্ধন ☼
আদিম আতঙ্ক
পাঁচ
শিবালয় শহরের কর্তাব্যক্তিদের হেডকোয়ার্টার টিকেন্দ্রনগরে। যাঁর নামে নগরের নামকরণ, তাঁকে ইংরেজরা ফাঁসিতে লটকে দিয়েছিল ১৮৯১ সালে। তাঁর অপরাধ, বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে। যুদ্ধে তিনি হেরে যান। মণিপুরের রাজা কীর্তিচন্দ্রের ছেলে বলেও তাঁকে খাতির করেনি পাষণ্ড ইংরেজ শাসক। টিকেন্দ্রনগরের ঠিক মাঝখানে রয়েছে তাঁর মর্মর-মূর্তি। বছরের একবার ফুলের পাহাড় জমে সেখানে। তাঁর মৃত্যুদিবসে।
পুলিশপ্রধান সুরেশ সাইকিয়ার ঘরে ঢুকলেন ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর বিশু বোস, ‘মাধবী লাহা নামে কাউকে চেনেন?’
‘কেন বলুন তো?’
‘এইমাত্র ফোন করেছিলেন শিবালয় টাউন থেকে। ভদ্রমহিলা ডাক্তার?’
‘হ্যাঁ। খুব পপুলার।’
‘মাথা কি খারাপ?’
‘কেন?’
‘শিবালয় টাউনে নাকি কেউ বেঁচে নেই—উনি আর ওঁর বোন ছাড়া।’
জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিল মাধবী আর পরী। বেরিয়ে গেল জানলা দিয়েই।
রাত আরও শীতল হয়েছে। বাতাসের গোঙানি আবার বেড়েছে।
মাধবী আগে গেল নিজের বাড়ি। দুটো কোট নিয়েই বেরিয়ে এল বাইরে। গায়ে দিয়ে চলে এল পুলিশ অফিসের সামনে। কাঠের বেঞ্চি রয়েছে রাস্তার পাশে। বসল সেখানে। এখন শুধু প্রতীক্ষা। টিকেন্দ্ৰনগর থেকে আসুক পুলিশবাহিনী।
‘কতক্ষণ লাগবে, দিদি?’ পরীর প্রশ্ন।
‘পঁয়তাল্লিশ মিনিট তো বটেই। বড় জোর এক ঘণ্টা। তিরিশ মাইল পথ— চড়াই-উৎরাই— নিজেদের রেডি করা… সময় তো লাগবেই।’
‘ব্যানার্জীবাড়িতে কে টেলিফোন করেছিল?’
‘কেউ না।’
‘তুমি তো কান পেতে শুনছিলে?’
‘শুনছিলাম না— কান খাড়া করেছিলাম।’
‘তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে?’
‘ভয় পেয়েছিলাম কোনও আওয়াজ না পেয়ে। নো সাউণ্ড।’
কী বলবে মাধবী? ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় টের পেয়েছিল, একটা অপার্থিব সত্তা হাজির রয়েছে টেলিফোনের অপর প্রান্তে। পরীকে তা জানিয়ে লাভ কী?
খসখস করে একটা কাগজ উড়ে গেল রাস্তার ওপর দিয়ে। চাঁদের মুখ ঢেকে গেল কালো মেঘে।
ঝপ করে নিভে গেল শিবালয় টাউনের সমস্ত আলো।
লাল এমার্জেন্সি ফ্ল্যাশ দিয়ে যাচ্ছে তিনখানা পুলিশ গাড়ির মাথায়। ঝড়ের বেগে ধেয়ে যাচ্ছে চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে—শিবালয় শহরের দিকে। দু’পাশে ঘন জঙ্গল। মাথার ওপর চাঁদ।
প্রথম ধাবমান গাড়িটা চালাচ্ছেন বিশু বোস। তাঁর পাশেই বসে রয়েছেন সুরেশ সাইকিয়া।
দ্বিতীয় গাড়িটায় বসে আছেন টম ডিক্সন। পুলিশ সার্জেন্ট। নরাকৃতি দানব বললেই চলে। গুলি চালায় নির্ভুল। কিন্তু তার একটা দোষ আছে। ক্ষণিকের দুর্বলতা যখন তাকে পেয়ে বসে তখন সে খুন করতে চায় না, নিজে খুন হয়ে যাবে জেনেও।
একদল নরঘাতক শিবালয় শহরকে শ্মশান বানিয়েছে শুনে সুরেশ সাইকিয়া সঙ্গে নিয়েছেন টম ডিক্সনকে। এবং, এই শীতেও ভয়ে ঘামছে টম ডিক্সন।
গোটা শিবালয় শহরের সমস্ত আলো নিভে গেল অকস্মাৎ। কমে এসেছে হাওয়ার বেগ। কালো মেঘ সরে গেছে চাঁদের মুখ থেকে।
বুক ধড়াস ধড়াস করছে মাধবীর। তাকিয়েছিল পেছন দিকে। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলেছিল পেছনে তাকাতে।
পুলিশ ফাঁড়ি আর তার পাশের কফি হাউসের মাঝখানের জায়গাটা বড় অন্ধকার। গাছপাতায় ছাওয়া যেন একটা সুড়ঙ্গ। ঠিক যেমনটি দেখে এসেছিল বেকারিতে। অন্ধকারের আতঙ্ক যেন গুঁড়ি মেরে বসে আছে ওইখানে।
বেঞ্চি থেকে ছিটকে গেছিল মাধবী। টেনে নিয়ে গেছিল পরীকে রাস্তার ঠিক মাঝখানে। এখানে চাঁদের আলো ফুটফুট করছে।
আচমকা জ্বলে উঠল রাস্তার সব আলো। বিদ্যুৎ-দ্যুতিতে চোখ ধাঁধিয়ে যেতে না যেতেই ঝপ করে নিভে গেল আবার। সেই অন্ধকার। এখন আরও উৎকট।
একটা বিকট হাহাকার ভেসে গেল গোটা শহরটা ওপর দিয়ে—বুকচেরা এমন আর্তনাদ কোনও মানুষের গলা দিয়ে বেরতে পারে না। পরক্ষণেই সব নিস্তব্ধ। আবার সেই বিকট গোঙানি। নৈঃশব্দ্য।
এবার শব্দটাকে চিনেছে মাধবী। সাইরেন বাজছে। কখনও পুলিশ ফাঁড়িতে, কখনও দমকল-হাউসে। পরের মুহূর্তেই শোনা গেল ঢং… ঢং… ঢং… আওয়াজ! যেন, পাগলা-ঘণ্টি বাজছে। শিবমন্দিরে দড়ি ধরে টানা হচ্ছে… হচ্ছে… হচ্ছে…
বন্ধ দরজা আর জানলায় আছড়ে পড়ছে সেই শব্দ… মাথা কুটে ফিরে যাচ্ছে… শিবালয় এভিন্যু দিয়ে ধেয়ে যাচ্ছে…
আবার বেজে উঠল সাইরেন… থামতে না থামতেই ঘণ্টাধ্বনি… তারপরেই আবার সাইরেন… আবার ঘণ্টার সঙ্কেত…
সঙ্কেত! আসন্ন নতুন বিপর্যয়ের ছন্দময় সঙ্কেত!
দ্বিতীয় গাড়িটা চালাচ্ছে উজাগর সিং। ছিল আর্মিতে—এখন পুলিশে। চোখ শীতল। শরীর যেন পাথর কুঁদে তৈরি। রক্তে ডিসিপ্লিন।
উজাগরের পাশে গা এলিয়ে বসে রমেশ থাপা। চোখ মুখ শরীর কণ্ঠস্বর—সবই স্থূল। মোটা দাগের মানুষ। কথাবার্তা রুক্ষ।
ঝলসে উঠল রাস্তার ধারের মাইল পোস্ট হেডলাইটের ঘুরে যাওয়া আলোয়। মোড় নিয়েছে সামনের গাড়িটাও। আর মাত্র দু’মাইল বাকি…
তৃতীয় গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল এইখানেই, রাস্তা জুড়ে, প্ল্যানমাফিক। শহর থেকে যেন কেউ বেরতে না পারে।
এগিয়ে গেল সামনের গাড়ি দুটো।
ঘণ্টাধ্বনি আর সাইরেনের আর্তনাদ… ঘণ্টাধ্বনি আর সাইরেনের হাহাকার। তালে তাল মিলিয়ে আচমকা জ্বলে উঠছে সমস্ত আলো… নিভে যাচ্ছে পরক্ষণেই… আবার জ্বলছে… আবার নিবছে…
মাথা ঘুরছে দুই বোনের… গোটা শহরটা বুঝি মাতাল হয়ে গেছে… উন্মাদ হয়ে গেছে… আওয়াজ… আলো… অন্ধকার… পায়ে পা মিলিয়ে রক্ত জমানো লাইট অ্যাণ্ড সাউণ্ড ম্যাজিক রচনা করে চলেছে…
রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে দুই বোন। হঠাৎ সব স্তব্ধ হয়ে গেল। আওয়াজের স্রোত দূর হতে দূরে মিলিয়ে গেল। প্রতিধ্বনিও আর ফিরে আসছে না। শুধু জ্বলছে আলোর মালা রাস্তায়, ঘরে ঘরে—আর নিবছে না।
কবরখানার নৈঃশব্দ্যের মাঝে জাগ্রত হল একটা চাপা গজরানি… দূর থেকে এগিয়ে আসছে… আসছে…
দিদির হাত চেপে ধরেছে পরী। রিভলভার তুলে ধরেছে মাধবী শব্দ লক্ষ করে।
তারপরেই দেখা গেল শব্দের উৎস। রাস্তা বেয়ে উঠে আসছে দুটো গাড়ি। পুলিশের গাড়ি। মাথায় জ্বলছে আর নিবছে লাল আলো।
ওদের সামনেই ব্রেক কষল গাড়ি দুটো। টপাটপ নেমে দাঁড়াল ছ’জন পুরুষ। ঘিরে ধরল দুই বোনকে। কেউ কথা বলছে না। শুধু চেয়ে রয়েছে। দেখছে।
দেখছে মাধবীও। ওর মন বলছে, এরা কেউ জ্যান্ত ফিরে যাবে না। কেউ না।
সুমন্ত সেনের ডেডবডির পাশে এক হাঁটু পেতে বসে পড়েছিলেন সুরেশ সাইকিয়া। আঙুল ছোঁয়ালেন নীলচে-কালচে মুখে। অবাক হলেন।
‘চামড়া তো এখনও গরম।’
‘খুব বেশি আগে মারা যাননি,’ মাধবীর মন্তব্য।
‘কিন্তু মাত্র ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে কোনও বডি এভাবে ফুলে উঠতে পারে না। ডিসকালার্ড হয়ে যেতে পারে না,’ বললেন বিশু বোস।
‘এই শহরের সমস্ত ডেডবডির অবস্থা ঠিক এইরকম,’ মাধবীর শক্ত জবাব।
ডেডবডি উলটে দিলেন সুরেশ সাইকিয়া। পিঠে নেই কোনও ক্ষত চিহ্ন।
মাথার খুলির পেছনে চোট লাগেনি তো? আছড়ে পড়ার সময়ে খুলি ফেটে যায়নি তো? চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে খুলি পরখ করলেন সুরেশ সাইকিয়া। চোটের চিহ্ন নেই। খুলি অক্ষত।
উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘বেকারিতে চলুন। দল বেঁধে। এখানে কারও থাকার দরকার নেই।’
আহার্য-নিবাসে ঢুকল সবাই সামনের দরজা দিয়ে— পৌঁছোল পেছনের রান্নাঘরে। একতাল ময়দার ওপর বেলুন ধরে রয়েছে শুধু দুটো হাত— কব্জি পর্যন্ত। উনুনের মধ্যে রয়েছে শুধু দুটো মুণ্ডু। রক্ত নেই কোত্থাও। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে সবাই। অস্ফুটকণ্ঠে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘কশাই-ও এভাবে জবাই করতে পারে না। বডিগুলো গেল কোথায়?’
শুরু হল খোঁজা। কাবার্ডে, ড্রয়ারে, বাথরুমে, ফ্রিজে। কোথাও পাওয়া গেল না রজনী আর মনোরমা শিকদারের শরীরের বাদবাকি অংশ। বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘ডক্টর লাহা, চলুন সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গের মতন জায়গাটায়— যেখানে ভয় পেয়েছিলেন।’
পুরো দলটাই বেরিয়ে এল বাইরে। কেউ আর কাউকে ছেড়ে থাকতে চাইছে না। উৎকট এই দৃশ্য শিহরিত করেছে প্রত্যেককেই।
বাড়ির বাইরে সেই কাঠের গেট, ওপাশে একটা দোকান। মাঝে আলোহীন গলিপথ।
গেট খুলে ফেললেন সুরেশ সাইকিয়া। এখন তাঁর এক হাতে টর্চলাইট, আর এক হাতে রিভলভার।
ফিসফিস করে মাধবী বললে পেছন থেকে, ‘পরী বলছিল, কে যেন ওঁত পেতে রয়েছে দেওয়াল ঘেঁষে। আমার মনে হয়েছিল, তারা রয়েছে মাথার ওপরে মাচায়।’
কাঠের গেট খোলার ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ নিস্তব্ধ গলিপথে প্রতিধ্বনি জাগিয়েছিল। তা মিলিয়ে যেতেই জাগ্রত হল সুরেশ সাইকিয়ার বুটজুতোর শব্দ। অকুতোভয় পদক্ষেপে প্রবেশ করছেন অন্ধকার বিবরে। টর্চের আলোয় দেখা যাচ্ছে গলিপথের মাঝ পর্যন্ত। আলো ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে পাশের দেওয়াল আর মাথার মাচার ওপর দিয়ে। কংক্রিটের দেওয়ালে পোকামাকড় পর্যন্ত নেই।
রিভলভার তুলে ধরার দরকার ছিল না— গলিপথের মাঝবরাবর গিয়ে ভেবেছিলেন সুরেশ সাইকিয়া। আর ঠিক তখনই তাঁর শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠল। স্পষ্ট মনে হল, তিনি আর একা নন।
দাঁড়িয়ে গেলেন সেইখানেই। টর্চ ঘুরিয়ে ফের খুঁটিয়ে দেখলেন দেওয়াল আর সিলিং। পা টিপে টিপে হয়তো কেউ এসেছে পেছনে। কিন্তু কেউ নেই। গলিপথের সামনে আর পেছনে শুধু অন্ধকার চমকে চমকে উঠছে আলোর ঝলকানিতে। আর চমকে উঠছেন তিনি নিজে। কেউ নেই, অথচ মনে হচ্ছে, কে যেন তাঁকে দেখছে। বৈরীচোখে নজরে রেখেছে।
টর্চের আলোয় কী যেন চকচক করে উঠল মেঝেতে। পলকের জন্যে। মেঝের এই জায়গায় রয়েছে একটা ড্রেনের ঝাঁঝরি। লম্বায়-চওড়ায় ফুটখানেক। এগিয়ে গিয়ে টর্চ ফোকাস করলেন ভেতরে। দেড়ফুট ব্যাসের একটা ড্রেনপাইপ নেমে গেছে নিচে, জল নেই। শুকনো। চকচকে জিনিসটা তাহলে জল নয়।
ইঁদুর? শিবালয় শহরে পোকামাকড় ইঁদুর-ছুঁচো দমন করা হয় কঠোর হাতে। এ শহর বড়লোকদের শহর। দু-একটা ইঁদুর হয়তো থেকে গেছে।
নিশ্চিত হয়ে গলির শেষ পর্যন্ত হেঁটে গেলেন। ফিরেও এলেন।
‘কী দেখলেন?’ বিশু বোসের প্রশ্ন।
গেট টেনে বন্ধ করে দিয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সুরেশ সাইকিয়া বললেন, ‘চকচকে কী যেন দেখলাম ড্রেনের মধ্যে। আর মনে হল, কারা যেন দেখছে আমাকে—অথচ কেউ নেই।’
‘শিকদার-ফ্যামিলিকে যারা কেটেছে তারা নিশ্চয় ড্রেনের বাসিন্দা নয়।’
‘তা তো বটেই। এবার চলুন ব্যারিকেড দেওয়া ঘরে।’
জোড়া খুনের বাড়ি যে রাস্তায়, সেই রাস্তায় ঢোকবার আগে থমকে দাঁড়ালেন সুরেশ সাইকিয়া। বললেন, ‘ও বাড়িতে ঢোকার আগে আগের বাড়িগুলো দেখতে যাব। একসঙ্গে নয়—দুটো দল হয়ে। রাস্তার একপাশ ধরে এগোব। পাশাপাশি দুটো বাড়িতে ঢুকবে দুটো দল। কেউ কারও কাছ থেকে বেশি তফাতে যাবে না, চোখের আড়াল হবে না—কক্ষনো নয়। যদি কিছু ঘটে, যদি কিছু দেখা যায়, দু-তিনবার ফায়ার করলেই পাশের বাড়ি থেকে সেই আওয়াজ শোনা যাবে, তখন দৌড়ে যাওয়া যাবে। প্রথম দলে থাকব আমি, বিশু বোস, ডক্টর লাহা, আর তুমি—পরী। দ্বিতীয় দলে লিডার হবেন উজাগর সিং। মেক ইট এ পয়েন্ট—দলছাড়া হবেন না, কোনও অবস্থাতেই নয়।’
মাধবী বললে, ‘নতুন ডেডবডি যদি দেখা যায়, কাইণ্ডলি লক্ষ করবেন—চোখ কান নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে কি না।’
বিশু বোস বললেন, ‘রোগে মরলে যা হয়? কিন্তু কোনও রোগেই মুণ্ড বা হাত কাটতে পারে না।’
‘রোগ যখন মানুষকে উন্মাদ করে দেয় তখন সেই উন্মাদ অনেক কিছুই করতে পারে। যেমন, সাইকোপ্যাথিক কিলার। যেমন, র্যাবিড-ম্যানিয়াক।’
‘কোথায় সেই উন্মাদরা?’
‘লুকিয়ে আছে,’ বললে রমেশ থাপা।
খুনে পাগলরা মুখ বুজে ঘাপটি মেরে থাকে কি? এতক্ষণ ধরে?’
মাধবী বললে, ‘আমিও তাই বলি। পাগল নয়— অন্য কিছু। যা ভাবা যায় না।’
শুরু হল অভিযান।
প্রথম বাড়িটা রোগাটে ধরনের। পেছনদিকে লম্বাটে। এ বাড়ির একতলায় রয়েছে ছবি আর গিফট-এর দোকান। সামনের দরজার কাচ ভেঙে ভেতরে হাত ঢোকালেন উজাগর সিং, লক খুলে দরজা ঠেলে ঢুকে গেলেন। সুইচ টিপে আলো জ্বাললেন। দলের সবাইকে বললেন, ‘গায়ে গা লাগিয়ে থেকো না, ছড়িয়ে পড়ো। জোট বেঁধে থাকলে শত্রুর সুবিধে—সোজা টার্গেট। এক মারেই খতম করে দেবে।’
উজাগর সিংকে একসময়ে টেররিস্ট এলাকায় অপারেশন করতে হয়েছিল, গেরিলা অ্যাকটিভিটির মোকাবিলা করতে তিনি জানেন। আর্মি ট্রেনিং ভোলা যায় না।
দু’পাশের গ্যালারিতে ছবি আর গিফট সাজানো। লোকজন কেউ নেই। গ্যালারির শেষে ছোট্ট অফিসঘর। সেখানেও কেউ নেই। এই ঘরের পেছনে একটা দরজা। দরজা খুললেই সামনে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। মিলিটারি কায়দায় সিঁড়ি ভাঙলেন উজাগর সিং, এক হাতে রিভলভার। ওপরের চাতালে উঠে সুইচ টিপে আলো জ্বালালেন। সামনেই মালিকের ফ্ল্যাটের বসবার ঘর। ঘর ফাঁকা। নিশ্চিন্ত হওয়ার পর ইঙ্গিতে দলবলকে বললেন উঠে আসতে। নিজে সন্তর্পণে ঢুকলেন ঘরে। দাঁড়ালেন দেওয়াল ঘেঁষে। চোখে বিদ্যুতের ঝলক, সতর্ক শরীরের প্রতিটি অণুপরমাণু।
তন্ন তন্ন করে দেখা হল ফ্ল্যাটের খাবার ঘর। কেউ নেই। রান্নাঘরে রয়েছে একটা মৃতদেহ। ফ্রিজ খুলে রেখে হেলে রয়েছে ফ্রিজের গায়ে। ফোলা শরীর। নীলচে-কালচে চামড়া। চোখে বিস্ময় বা আতঙ্ক নেই। মরেছে খুব তাড়াতাড়ি। ফ্রিজ খুলেছিল টম্যাটো চীজ আর সালামি দিয়ে স্যাণ্ডউইচ বানাবে বলে। তিনটে জিনিসই ছড়িয়ে পায়ের কাছে।
‘রোগ নয়। হলে, স্যাণ্ডউইচ খাওয়ার ইচ্ছে হত না,’ আস্তে বললেন উজাগর সিং।
‘মরেছেও আচমকা,’ রমেশ থাপার মন্তব্য, ‘হাতভরতি খাবারদাবার নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েই খতম।’
শোবার ঘরে পাওয়া গেল আরও একটা ডেডবডি। একটি ছেলে। শুয়ে রয়েছে খাটে। শরীর জুড়ে অত কালসিটে থাকলে সঠিক বয়স ঠাহর করা যায় না। মুখ জুড়ে আতঙ্ক— যেমনটা দেখা গেছিল সুমন্ত সেনের মুখে। ভয়ানক ভয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে গেছিল, মাঝপথেই প্রাণ বেরিয়ে গেছে।
দলাই-মলাই করা চাদরে পড়ে একটা পয়েন্ট টু-টু অটোমেটিক। পকেট থেকে কলম বের করলেন উজাগর সিং। ট্রিগার গার্ডে ঢুকিয়ে তুলে নিলেন। ক্লিপ খুললেন। গুলি নেই ভেতরে। বেডল্যাম্পের দিকে নল ঘুরিয়ে এক চোখে তাকালেন ভেতরে। চেম্বারে নেই গুলি। নাকে ঠেকিয়ে শুঁকলেন। বারুদ পোড়ার গন্ধ পেলেন।
বললেন, ‘গুলি ছোঁড়া হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। ফায়ারিং যখন শুরু হয়েছিল, ধরে নেওয়া যাক, ক্লিপ তখন ভরতি ছিল। মোট দশ রাউণ্ড গুলি চালানো হয়েছে। ওই তো একটা বুলেট হোল।’
গুলির গর্তটা রয়েছে খাটের মাথার দিকে দেওয়ালের গায়ে। মেঝে থেকে প্রায় সাত ফুট হাইটে।
পাওয়া গেল আরও একটা বুলেট হোল। দেওয়ালে বসানো কাঠের মূর্তি ফাটিয়ে চৌচির করে ঢুকে গেছে ভেতরে। দশটা ফাঁপা খোল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মেঝেতে। কিন্তু পাওয়া গেল না বাকি আটটা বুলেটের গর্ত। বোঝা গেল না, সে গুলি লেগেছে কোথায় আর গেলই বা কোথায়।
আটটা গুলিই কি তাহলে লেগেছে আততায়ীর গায়ে? আটবার গুলিবিদ্ধ হয়ে সে মরে পড়ে নেই কেন? তা ছাড়া, একজনের গায়ে আটখানা বুলেট ঢুকিয়ে দেওয়া কি সম্ভব? শুয়ে শুয়ে?
অসম্ভব।
তা ছাড়া, রক্তই বা কোথায়? আটখানা বুলেট হজম করে কিছুটা রক্তপাত ঘটানো উচিত ছিল গুলিবিদ্ধ ব্যক্তির। কিন্তু তা হয়নি।
খাটের পায়ের কাছে গিয়ে ছেলেটার দিকে চেয়ে রইলেন উজাগর সিং। দুটো মাথার বালিশ পিঠে দিয়ে আধবসা অবস্থায় দু’পা ছড়িয়ে রয়েছে সামনে।
রান্নাঘরের নিহত মানুষটা বোধহয় এই ছেলের বাবা। ছেলের জন্যে খাবার আনতে গেছিল। তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে ঠিক সেই সময়ে। নিমেষে মারে পিতাকে। তাকে সময় দেননি। সময় দিয়েছে ছেলেটাকে—বুলেট বর্ষণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত।