» » আদিম আতঙ্ক

বর্ণাকার

অদ্রীশ বর্ধন

আদিম আতঙ্ক

চার

শিবালয় এভিন্যু ধরে হেঁটে চলেছে দুই বোন। মাধবীর হাতে রয়েছে সুমন্তর রিভলভার। তিনটে গুলি ভরা আছে। তাই যথেষ্ট। বাড়ির পর বাড়িতে উঁকি মেরে যাচ্ছে, বেল বাজাচ্ছে, কড়া নাড়ছে— কেউ সাড়া দিচ্ছে না। আলো জ্বলছে বাড়ির মধ্যে— অথচ শ্মশান— নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে ভেতরে।

পরী বলল, ‘দিদি, হঠাৎ সবাই মরে গেছে। কেন?’

মাধবী বললে, ‘সেটাই ভাবছি। রেডিয়েশনের জন্যে নিশ্চয় নয়— সেক্ষেত্রে শরীর পুড়ে যেত। দগদগে ঘা দেখা যেত। বিষের জন্যেও নয়— গোটা শহরটায় একসঙ্গে বিষের কাজ হতে পারে না। ফুড পয়জনিং-ও নয়— শহরের সমস্ত লোক একই পয়জনড্‌ ফুড একই সময়ে খেয়ে ফেলল, তা হয় না। জলের বিষও নয়— ঘড়ি ধরে শহরসুদ্ধ লোক বিষ-জল খেল একই সময়ে? অসম্ভব।’

কথা বলতে বলতে ‘আহার্য নিবাস’-এর সামনে এসে পড়েছে দুই বোন। এখানকার কেক, ব্রেড, প্যাসট্রি, প্যাটিস খুব নামকরা। মালিক রজনী শিকদার নিজেই বানান। দোতলায় থাকেন। ওঁর বউয়ের নাম মনোরমা।

বড় জানালার কাচে কপাল ঠেকিয়ে দেখল মাধবী— সেলস রুমের টেবিল-চেয়ার দেখা যাচ্ছে, কিন্তু কেউ নেই।

পরী বললে, ‘বিষাক্ত গ্যাসের জন্যে নয় তো?’

মাধবী বললে, ‘এদিকের পাহাড়ে কোনও ফ্যাক্টরি নেই। টক্সিক জঞ্জাল নেই। বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হবে কী করে?’

আলো জ্বলছে ‘আহার্য নিবাস’-এর রান্নাঘরে। ঢুকতে গেল মাধবী। কিন্তু তালা দেওয়া ভেতর থেকে।

‘পেছন দিক দিয়ে ঢুকব,’ বলে কাঠের ফটকের দিকে পা বাড়ায় মাধবী। তৈলহীন কব্জা আর্তনাদ করে ওঠে ঠেলা খেয়ে।

ভেতরে একটা টানা লম্বা গলিপথ। একদিকে বিউটি পার্লার। আর একদিকে আহার্য নিবাস। ঘুটঘুটে অন্ধকার। বহুদূরে টিমটিম করে জ্বলছে একটা আলো।

অন্ধকার গলিপথ নিছক তমিস্রায় ঠাসা নয়। তমিস্রার গর্ভে ওঁৎ পেতে রয়েছে যেন আরও অনেক কিছু। প্রতি পদক্ষেপে সঙ্কীর্ণতর হচ্ছে গলিপথ— বাড়ছে দুই বোনের বুকের মধ্যে ঢেঁকির পাড় পড়ার আওয়াজ।

সিকিপথ এসেই মনে হল, সুড়ঙ্গে শুধু ওরা দু’জন নেই আরও অনেকে আছে। মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন সজীব হয়ে উঠল মাথার ওপরকার ছাদ। দশ-বারো ফুট ওপরকার কড়িকাঠে কারা যেন সঞ্চরমান হয়েছে। অন্ধকার সবচেয়ে জমাট হয়েছে মাথার ওপরেই। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অথচ মনে হচ্ছে, কিছু একটা রয়েছে সেখানে— একটা নয়, অনেক… অগুন্তি… চোখ নিয়ে না দেখেও তাদের অস্তিত্ব উপলব্ধি করা যাচ্ছে। পেছনে না তাকিয়েও পিছু নেওয়া বদমাশ লোককে যেমন টের পাওয়া যায়— ঠিক সেইভাবে। অস্বাভাবিক নৈঃশব্দ্য চমকে চমকে উঠছে শুধু দুই বোনের পা ফেলার আওয়াজে। সুড়ঙ্গের শেষের দিকে ম্যাড়মেড়ে আলোর দিকে জোরে পা চালিয়ে মাধবী ঘাড় বেঁকিয়ে তাকিয়েছিল ওপরের কয়লার মতন কালো কড়িকাঠের দিকে—আড়ষ্টভাবে। সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট দেখেছিল— তরল আলকাতরার মতনই সরে সরে যাচ্ছে নিরেট অন্ধকার। কায়া পাল্টাচ্ছে।

অন্ধকারের কায়া। শিউরে ওঠে মাধবী। কিন্তু চোখ নামাতে পারে না। সঞ্চরমান তরল তমিস্রা দেখেই যাচ্ছে আতঙ্ক-অবশ দুই চোখে। মাথার ওপর আছে মাচা— কড়িকাঠের দু’পাশে। এই দুই সারি মাচার মধ্যেই চলেছে পুঞ্জীভূত ছায়াদের নড়াচড়া— কায়াগ্রহণ…

মনের ভুল অবশ্যই। চোখের ভুল নিশ্চয়। দৃষ্টিভ্রম নির্ঘাৎ। এরকম ভুল সব মানুষই দেখে—ভয়-পঙ্গু মন চোখকে দিয়ে দেখায়— যার অস্তিত্ব নেই সেই ভয় ধরানো ভয়ানককে।

সুড়ঙ্গপথের অর্ধেক অতিক্রম করে এসেছে মাধবী। বাকি আর অর্ধেক। কিন্তু অকস্মাৎ পা বিদ্রোহী হচ্ছে কেন? কেন প্রচণ্ড বাসনা হচ্ছে, পেছন ফিরেই চম্পট দেওয়ার? অন্তরের গোপন গুহা থেকে নিরন্তর উঠে আসছে একটাই সতর্কবাণী— আর এগিও না… আর এগিও না… ওখানে আছে বিপদ— আছে মহা ভয়ঙ্কর… আছে অপার্থিব বিভীষিকা…

ছুটে বেরিয়ে গেলেই হয়। এই সুড়ঙ্গে আর এক মুহূর্তও নয়। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে— দৌড়োও!

অসম্ভব! মাধবী লাহা পাশ করা এবং পশার জমানো সফল চিকিৎসক। প্যানিক জিনিসটা ডাক্তারদের মানায় না।

দূরের বিষণ্ণ আলো এখন অনেক কাছে এগিয়ে এসেছে। পেছনের অন্ধকারই বরং অনেকটা পথ জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। অজান্তেই পদক্ষেপ দ্রুততর করে মাধবী। তারপর দৌড়ায়। ঊর্ধ্বশ্বাসে বাকি পথটুকু পেরিয়ে এসে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে আলোর রাজ্যে।

পরী হুমড়ি খেয়ে পড়ে মাধবীর গায়ে। এক হাতে তাকে সিধে করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে, আর এক হাতে রিভলভার তুলে মাধবী ঘুরে দাঁড়ায় অন্ধকার ঢাকা সুড়ঙ্গপথের দিকে।

হাঁপাতে হাঁপাতে পরী বলে, ‘টের পেয়েছ?’

‘পেয়েছি। কড়িকাঠের ঠিক নিচে। পাখি-টাখি হবে, অথবা বাদুড়।’

‘না… না… সিলিং-এর নিচে নয়। দেওয়ালের গা ঘেঁষে… গুঁড়ি মেরে ছিল।’

‘কিন্তু আমি তো দেখলাম, মাচার মধ্যে কী যেন নড়ছে।’

‘না দিদি, দেওয়ালের গা ঘেঁষে।’

‘কী?’

‘স্পষ্ট দেখিনি।’

‘শুনেছিস কিছু?’

‘গন্ধ-টন্ধ কিছু?’

‘না… তবে… অন্ধকার কি নড়ে?’

‘আমিও তাই দেখেছি— মাচায়।’

নির্নিমেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে সুড়ঙ্গের দিকে। ঘাপটি মেরে যারা এতক্ষণ অবলোকন করেছে দুই সহোদরাকে— এবার নিশ্চয় বায়ুবেগে তাদের আবির্ভাব ঘটবে সুড়ঙ্গের বাইরে। ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই যাতে অনলবর্ষী চোঙা থেকে মারণ বুলেট ধেয়ে যেতে পারে, তার জন্যে তৈরি মাধবী। চোয়াল শক্ত। কিন্তু তমিস্রার জঠর ফুঁড়ে ধেয়ে এল না কোনও বিভীষিকাই।

মাধবী বললে, ‘শুধু শুধু দৌড়োলাম। সত্যিই যদি কিছু থাকত, এতক্ষণে বেরিয়ে আসত বাইরে।’

‘হয়তো।’

‘এখনও ঘোর কাটেনি তোর?’

এক ঝাপটা ঠাণ্ডা হাওয়া আচমকা তোলপাড় করে দিয়ে যায় সুড়ঙ্গ পথ।

‘বেড়াল নিশ্চয়,’ বললে মাধবী।

‘বেড়াল নয়,’ পরীর জবাব।

‘বেড়ালের চেয়ে বড়… অনেক বড়।’

‘ঠিক আছে। চল, ভেতরে ঢোকা যাক,’ আহার্য নিবাসের খিড়কির দরজার দিকে এগোয় মাধবী— পরী বারবার পেছন ফিরে চাইছে।

দরজা খোলা রয়েছে। ভেতরে আলো জ্বলছে। সরু লম্বা ভাঁড়ার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে দু-জনে। পাশের ছোট দরজার পরেই বিরাট কিচেন। মশলার সুবাস ভেসে আসছে। সুগন্ধে ঈষৎ ফিকে হয়ে আসে টেনশন।

রয়েছে দুটো ওয়াশ-বেসিন, একটা ফ্রিজ, কয়েকটা ওভেন, বেশ কয়েকটা স্টোরেজ ক্যাবিনেট, ময়দা ঠাসবার একটা মেশিন— এ ছাড়াও বেশ কিছু যন্ত্রপাতি। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা লম্বা কাউন্টার। বেশ চওড়া। খুচখাচ কাজ করা হয় এর ওপরেই। এই কাউন্টারের একটা দিক চকচকে স্টেনলেস স্টিলের পাত দিয়ে ঢাকা—আর একটা দিকে কাঠের পাটাতন পাতা। মাংস কাটার জায়গা। চকচকে স্টিল রয়েছে যেদিকে ভাঁড়ার ঘরও সেদিকে। এই দিক দিয়েই কিচেনে ঢুকছে দুই বোন। ইস্পাতের পাতের ওপর সাজানো বিস্তর বাসনকোসন—পরিষ্কার ঝকঝক করছে। গোটা কিচেন জুড়ে শুধু চেকনাই।

কেউ নেই ঘরে।

গোটা শরীরে যেন ইলেকট্রিক শক বয়ে গেল সেই মুহূর্তে। জড়ো করা বাসনকোসনের ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে কাউন্টারের মাঝখানটা। এক তাল ময়দার ওপরে গাঁথা একটা কাঠের বেলুন—লেচি পাকানোর আগের অবস্থা। দুটো হাত ধরে রয়েছে বেলুনের দু’দিক। শুধু দুটো হাত কব্জি পর্যন্ত রয়েছে। কব্জির পর থেকে হাতের বাকি অংশ আর নেই।

সবেগে পেছিয়ে এসেছিল পরী। মেটাল ক্যাবিনেটে পিঠ আছড়ে পড়ায় ঝনঝন করে উঠেছিল ভেতরকার জিনিসপত্র। ধারালো ক্ষুরের মতই নিদারুণ আতঙ্ক অকস্মাৎ বুঝি গলা চিরে দিয়ে যায় মাধবীর। এ কী সম্ভব?

স্তম্ভিত মাধবী এবার দু-পা এগিয়ে গেছিল ময়দার মণ্ডর দিকে। পা চলতে চাইছে না। কিন্তু যেন সম্মোহনের ঘোরে তাকে এগিয়ে যেতেই হচ্ছে। আরও কাছ থেকে দেখবার আত্যন্তিক বাসনায়।

শুধু দুটো হাত মণিবন্ধ পর্যন্ত। থেঁৎলানো নয়, কালসিটে খাওয়া নয়, ফুলেও ওঠেনি। চামড়ার আভা সুস্পষ্ট— একটু যা ফিকে। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়েছে সাদা ময়দায়।

এই প্রথম রক্ত দর্শন করল মাধবী। কিন্তু রক্ত ওর চোখ টানছে না, টানছে হাতের উল্টো পিঠের সাদা লোম, মোটা গাঁটওলা বেঁটে আঙুল। পুরুষের হাত। রজনী শিকদারের।

‘দিদি!’

ডাক শুনে চমকে ওঠে মাধবী। হাত তুলে আঙুল-এর সঙ্কেতে কিচেনের আর একটা দিক দেখাচ্ছে পরী।

তিনটে ওভেন রয়েছে সেদিকে— মাংসের কিমা বানানোর প্রান্ত যেদিকে— তারও ওদিকে— ঘরের একদম শেষদিকের দেওয়ালের গায়ে। একটা খুব বড়; নিরেট দুটো দরজার একটা ওপর দিকে, আর একটা নিচের দিকে, রয়েছে আরও দুটো ওভেন— সাইজে প্রথমটার চেয়ে ছোট— দুটোরই সামনে একটা করে পাল্লা— পাল্লার মাঝে কাচের চাকতি বসানো। এই চাকতি দিয়ে দেখা যাচ্ছে, দুটো উনুনেরই ভেতরে বসানো রয়েছে দুটো মুণ্ড। গলা থেকে কাটা মুণ্ডু। একজন রজনী শিকদার। সাদা চুলে লেগে লাল রক্ত। বিষম যন্ত্রণায় চেপে ধরেছে দুই ঠোঁট। আর একটা মনোরমা শিকদারের। মুখ হাঁ করে রয়েছে— যেন চোয়াল খুলে ঝুলে পড়েছে।

বুক ধড়াস ধড়াস করছে। মাধবী চোখে ঝাপসা দেখছে। ময়দার মণ্ডর ওপর হাত দুটো বেলুন ধরে স্থির হয়ে রয়েছে বটে, কিন্তু আচমকা জীবন্ত কাঁকড়ার মতন শূন্যপথে ধেয়ে এলেও মাধবী আর অবাক হবে না।

গেল কোথায় শিকদারের কাটা ধড়গুলো? বড় উনুনের ভেতরে? দরজা বন্ধ তাই দেখা যাচ্ছ না? নাকি, ফ্রিজের মধ্যে?

দলা পাকিয়ে ওঠে মাধবীর গলায়। আগের সেই ভয়াল অনুভূতিটা ফের ফিরে এসেছে। কারা যেন নিষ্পলক চাহনি মেলে ওদের দেখে যাচ্ছে। সবেগে তাই ঘুরে দাঁড়ায় পরীর দিকে, ‘চ, এখানে আর নয়।’

বলেই, পরীর হাত ধরে দৌড়ায়— অন্ধকার গলির দিকে নয়— সেলস রুমের দিকে। পৌঁছে যায় বাইরের দরজায়। ল্যাচ ঘুরিয়ে দরজা খুলে ছিটকে গেল বাইরের খোলা বাতাসে। ছুটে গিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় পাইন গাছের গুঁড়িতে।

ফিসফিস করে মাধবী বললে, ‘আশ্চর্য! মাত্র কয়েক ফোঁটা রক্ত রয়েছে কিচেনে। অথচ রক্ত থই থই করা উচিত ছিল।’

পরী বললে, ‘ধস্তাধস্তির চিহ্নও নেই।’

‘একটা জিনিসও ভাঙেনি— সরেনি,’ ঢোক গিলল মাধবী।

যেন কলজে-মুক্ত হাওয়ার দমক ভেসে আসে শহরের দিক থেকে।

পরীকে পাশে নিয়ে হনহন করে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে মাধবী। মনের চোখ থেকে তাড়াতে পারছে না সারিবদ্ধ বীভৎস দৃশ্যগুলো।

ওরা এখন শিবালয় এভিন্যুর পুব ব্লকে। হিসেব-বিশেষজ্ঞ শান্তনু ব্যানার্জীর বাড়ির সামনে দাঁড়ায় মাধবী। ওঁর স্ত্রী শান্তা টুরিস্ট সিজনে কফি হাউস খুলে বসে। দুজনের ছোট্ট সংসার।

দুজনেই বাড়তি সময় কাটান শখের রেডিও নিয়ে, এই তাঁদের একমাত্র হবি।

বেতার বিজ্ঞানে দক্ষ দুজনেই। ওঁদের শর্টওয়েভ রেডিওটার কথা মনে পড়তেই মাধবী ছুটে এসেছে।

এক পাল্লার সদর দরজাটা ভেতর থেকে লক করা। আলো জ্বলছে ভেতরে অথচ পুশবেল টিপলেও কেউ সাড়া দিচ্ছে না।

ঘুরে গিয়ে পৌঁছোল বাড়ির পেছনে। এখানেও আলো ঠিকরে আসছে হলুদ কাচের মধ্যে দিয়ে। রান্নাঘরের দরজাও লক করা ভেতর থেকে। জানলায় পর্দা টানা থাকায় ভেতরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না।

কাচে টোকা দিল মাধবী। সাড়া নেই।

শান্তনু ব্যানার্জী মিতব্যয়ী পুরুষ। গ্রীলের খরচ বাঁচিয়েছেন— জানলায় শুধু কাচের পাল্লা বসানো। এ শহরে চোর-ছ্যাঁচোড়ের উপদ্রবও নেই।

রিভলভারের বাঁট দিয়ে জানলার কাচ ভেঙে ফেলল মাধবী। হাত ঢুকিয়ে খুলল ছিটকিনি। পাল্লা টেনে খুলে আগে ঢুকল নিজে— পেছনে পরী।

ব্যানার্জী পরিবার রয়েছে এই ঘরেই। শান্তা চিত হয়ে শুয়ে মেঝেতে। শান্তনু বসে রয়েছেন চেয়ারে। সামনের টেবিলে তাঁর রেডিও। মাথা হেলে পড়েছে তার ওপর। ঘাড় কাত হয়ে রয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে খোলা চোখের আতঙ্ক। একই আতঙ্ক জেগে রয়েছে শান্তার চোখেও। দুজনেরই সারা শরীর থেঁৎলানো। কালসিটে পড়া ফুলে ঢোল। কিন্তু মরবার পরেও মুখের মাসল ঢিলে হয়ে যায়নি কারুরই।

শান্তনু ডান হাতের মুঠোয় ধরে রয়েছেন একটা মাইক্রোফোন। রেডিও মেসেজ পাঠানোর চেষ্টা করেছিলেন। নিশ্চয় পারেননি, পারলে, এতক্ষণে পুলিশ এসে পৌঁছোত। রেডিও নিষ্প্রাণ।

বিশেষ একটা দরজার গায়ে রচনা করা হয়েছে একটা ব্যারিকেড। এ দরজা ভেতর থেকে ঠেলে খুলতে হয়— ঘরটা ছোট্ট, বাজে জিনিসপত্র থাকে। ব্যারিকেড তৈরি হয়েছে এই দরজার গায়ে, যাতে ভেতর থেকে খোলা না যায়। চেয়ার, সোফা, টিভি এনে ঠেসে রাখা হয়েছে কপাটের গায়ে। নাইট-ল্যাচও নিশ্চয় আঁটা হয়েছে।

এত ভয় কেন? কাকে? কী আছে ওই ছোট্ট ঘরে? অথচ তাকে আটকে রাখা যায়নি। চেষ্টার কসুর করেননি কর্তাগিন্নি। আতঙ্ক কিন্তু ঢুকে পড়েছে এই ঘরে। সেই মুহূর্তেই বোধহয় শেষ চেষ্টা করেছিলেন। শখের রেডিও সেট মারফত মেসেজ পাঠানোর শেষ চেষ্টা।

কিন্তু ঢুকল কী করে? জানলা তো বন্ধ ছিল ভেতর থেকে। দরজার নিচে আধ ইঞ্চির মতন একটা ফাঁক রয়েছে বটে, কিন্তু সেখান দিয়ে এমন কী মহা আতঙ্ক প্রবেশ করল যে কলজে বন্ধ হয়ে গেল স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই? কড়িকাঠের কাছে লম্বায় চওড়ায় ইঞ্চিছয়েক ঘুলঘুলিটাতেও লোহার জাল বসানো।

মাধবী বললে, ‘বাইরে চ, পরী।’

চৌকাঠ পেরতে যাচ্ছে দুজনে, ঠিক এই সময়ে বেজে উঠল টেলিফোন। গোরস্থান-নৈঃশব্দে এই প্রথম আওয়াজ। হৃৎপিণ্ড ধড়াস করে উঠল দুজনেরই।

টেলিফোন বসানো রয়েছে রেডিওর পাশে। এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলল মাধবী, ‘হ্যালো?’

কোনও প্রত্যুত্তর নেই। কে যেন কান খাড়া করে শুনছে মাধবীর কণ্ঠস্বর। দূরায়ত ক্ষীণ সমুদ্রোচ্ছাসের মতন অদ্ভুত একটা আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ ভেসে আসছে না কানে।

তর্ক-বিতর্ক চলছে মাধবীর মনের মধ্যে।

টেলিফোন করছে যে, সে মানুষ নয়!

ননসেন্স!

সে মানুষ নয়, জড়পদার্থও নয়, তার চেতনা আছে!

তোমার মাথা খারাপ হয়েছে!

ভাষা দিয়ে তার কুটিলতাকে প্রকাশ করা যায় না— সে নিখাদ নির্মমতা!

থামো!

মনের সমস্ত জোর দিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখতে যাচ্ছে মাধবী, এমন সময়ে ক্লিক করে উঠল টেলিফোন— ডায়াল টোন ফিরে এল পরক্ষণেই।

নিথর হয়ে যায় মাধবী। কী করবে এখন? পরক্ষণেই টিপে ধরে জিরো বাটন। রিং-এর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মিষ্টি স্বাভাবিক আওয়াজ।

‘অপারেটর স্পিকিং।’

‘এমার্জেন্সি,’ রুদ্ধশ্বাসে বলে যায় মাধবী, ‘টিকেন্দ্রনগরে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে দিন— এখুনি।’