» » আদিম আতঙ্ক

বর্ণাকার

অদ্রীশ বর্ধন

আদিম আতঙ্ক

দুই

এখন সেপ্টেম্বর সবে শুরু হয়েছে। বাতাসে সামান্য টান ধরেছে। অপরাহ্ন মিলিয়ে যাবার ফিকিরে আছে—জায়গা ছেড়ে দেবে সন্ধ্যাকে।

বিকেল আর সন্ধ্যা। ভাই আর বোন। এরা যখন হাত ধরাধরি করে, তখনই তো গোধূলি লগ্ন। বড় মিষ্টি এবং বড় রহস্যময়। পৃথিবীর প্রথম মুহূর্ত থেকে গোধূলির বড়ই সমাদর অন্ধকার দুনিয়ায়। রাতের চারটে প্রহরেই অশুভ অশরীরীরা নিজেদের বের করে আনে খাঁচার ভেতর থেকে। চলে তাদের অট্টরোল আর হট্টমেলা। প্রত্যূষের প্রভায় তারা গুটি গুটি কেটে পড়ে নিজেদের কন্দরে।

অশুভ বাসনাদের ফুর্তি শুধু তামসিক অন্ধকারেই—রজনীর তিমির অবগুণ্ঠনেই। তাদের উল্লোলনৃত্য—প্রভাতে সব নিরুদ্দেশ।

প্রকাণ্ড পৃথিবীর অজস্র অন্ধকার কারাগারে তখন তারা বন্দী। তাদের হদিশ আজও কেউ পায়নি। পৃথিবী আজও পরম রহস্যময় এদেরই জন্যে।

এরা ছিল, আছে, থাকবে।

শিবালয় টাউনেও নেমেছে গোধূলি। চারদিকের পাহাড়ে পাহাড়ে তার চোখজুড়োনো সুষমা ছড়িয়ে পড়ছে।

এ বড় সুন্দর জায়গা। ভূস্বর্গ বললেই হয়। যেদিকে দু’চোখ যায়, সেদিকেই শুধু পাহাড়। ঘন সবুজ ক্রমশ আরও ঘন হয়েছে পেছনের পাহাড়গুলোয়—একটু একটু করে কালচে হয়েছে, ধূসর হয়েছে, তারপর ধোঁয়াটে হয়ে দিগন্তে বিলীন হয়েছে।

সবুজ রঙের মধ্যে থেকে আরও একটা রং ঠেলে উঠছে। নীল রং। বড় বড় পাইন, ফার—যত রকমের চিরহরিৎ বৃক্ষ আছে— প্রত্যেকেরই গা মুড়ে দেওয়া হয়েছে যেন একই রকমের পুরু ফেল্ট কাপড় দিয়ে— যে-ফেল্ট পেতে দেওয়া হয় বিলিয়ার্ড টেবিলে। ঘন, মোলায়েম, স্নিগ্ধ। ছায়াগুলোও তাই যেন বড় ঠাণ্ডা। গোধূলি যতই সন্ধ্যার হাতে নিজেকে ছেড়ে দিচ্ছে— নরম শীতল ছায়াগুলো ততই লম্বা হচ্ছে— নিজেদের আকার আয়তন বাড়িয়ে চলেছে। মিনিটে মিনিটে গাঢ়তর হচ্ছে। এখুনি তো শুরু হবে তাদেরই রাজত্ব। ছায়া সাম্রাজ্য। তমিস্র-অধীশ্বরের আবির্ভাবের পথ চেয়ে তাই তারা ছায়ার কার্পেট পেতে দিচ্ছে গাছ আর পাহাড়ের পাশে পাশে।

মুগ্ধ চোখে মাধবী লাহা দেখে যাচ্ছে অবর্ণনীয় এই রূপরাশি। স্টিয়ারিং হুইলে দু’হাত রেখে তন্ময় হয়ে দেখছে প্রকৃতিকে। প্রকৃতি এমনই একটা সত্তা, যে নিতান্ত অ-কবিকেও কবি বানিয়ে দেয়। হিপনোটিক এফেক্ট ছড়িয়ে পড়ে কাঠখোট্টা ব্যক্তিরও অণু-পরমাণুতে।

গাড়ি ছুটছে… ছুটছে মাধবীর মনও। ছুটছে সেইখানে—যেখানে রয়েছে ওর গৃহ। সুইট হোম।

মাধবী বাড়ি ফিরছে। দীর্ঘ সময় পর।

শিবালয় শহরের হর্তাকর্তা বিধাতারা শহরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে রেখেছেন শহরে প্রবেশের বহু আগে থেকেই। এখানকার রাস্তা তাই বেশ চওড়া। পাশাপাশি তিনটে গাড়ি নক্ষত্ৰবেগে যাতে ধেয়ে যেতে পারে—তার ব্যবস্থা।

মাধবী স্টিয়ারিং হুইলে একটু মোচড় দিয়ে গাড়ি ঢুকিয়ে দিল এহেন একটি রাস্তায়। কিছুদূর গিয়েই রাস্তা একটু সরু হয়েছে—কেননা এ রাস্তা এখন গিরিপথ হয়ে গেছে। দু’পাশে উদ্দাম উত্তুঙ্গ পাহাড়। মাঝখানে পাথর উড়িয়ে তৈরি হয়েছে এই পথ। দুটো গাড়ি এখন পাশাপাশি যেতে পারে।

এইভাবেই পাঁচ মাইল পথ পেরিয়ে এল মাধবী। শিবালয় শহর আর বেশি দূরে নেই। পেছনের সিটের মেয়েটি এতক্ষণে একটি কথা বলল, ‘কী সুন্দর!’

দুই বোন, গাড়ি চালাচ্ছে মাধবী। পেছনে বসে পরী।

পনেরো বছর ছাড়াছাড়ি ছিল, দুই বোনে। মাধবী ডাক্তারি পাশ করে চাকরি করেছে। মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল শুধু চিঠির মধ্যে দিয়ে। বাবা আগে মারা গেল— একদিন পরেই মা। তাই পরীকে নিয়ে এসেছে মাধবী। শিবালয় টাউনে অনেক আগে একটা নিবাস রচনা করেছিল—বোনকে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে। পরীর বয়স তেরো, মাধবীর আটাশ।

গাড়ি ঢুকে পড়েছে শহরে। চলেছে শিবালয় এভিন্যুর ওপর দিয়ে। দু’পাশের কটেজগুলো নানা ঢঙের—কিন্তু কংক্রিটের জঙ্গল হতে দেয়নি শহরকে। পাথর, স্লেট, ইট, কাঠ, টালি—এই, দিয়েই পাহাড়ি কুঁড়ের গড়নে তৈরি প্রতিটি আস্তানা।

এ-শহরের নিয়ম তাই। নিয়নের চোখ ধাঁধানো দ্যুতি পর্যন্ত বরবাদ। মামুলি কাঠের সাইনবোর্ড। ঠিক যেন একটা সাজানো পাহাড়ি গ্রাম। স্নিগ্ধতায় হাত পড়েনি আজ।

অথচ, মাধবীর মনে হল, এই মুহূর্তে শিবালয় শহর যেন মড়ার শহর হয়ে রয়েছে…

গা শিরশির করা এই নিস্তব্ধতা নাড়া দিয়েছিল পরীকেও। বলেছিল, ‘কথাও বলতে জানে না।’

‘কে রে?’

‘এই শহর।’

‘বড্ড চুপচাপ বলে?’

‘এত চুপচাপ ভাল্লাগে না।’

মাধবী নিজেও অবাক হয়েছে। বছরের এই সময়ে শিবালয় শহর ঠাণ্ডা মেরে থাকে ঠিকই—কিন্তু মড়ার মতন নিথর হয়ে থাকে না। কোথাও এতটুকু শব্দ নেই। আশ্চর্য!

খটকা লেগেছিল বলেই স্পীড কমিয়ে এনেছিল মাধবী। এমনিতেই স্পীড কমাতে হত। কেননা, রাস্তা পাহাড়ের গা বেয়ে সটান ওপর দিকে উঠে গেছে। রাস্তার শেষ যেখানে শহরেরও শেষ সেখানে। তারপরেই স্কি-লিফট। তুষার জমে যখন বরফ হয়ে যায়, তার ওপর দিয়ে তীরবেগে ধেয়ে যাওয়ার আর লাফিয়ে ছিটকে যাওয়ার মারাত্মক মঞ্চ।

স্কি-লিফট এই শহরের মূল আকর্ষণ। রয়েছে শহরের একদম মাথায়। সেখান থেকে পাহাড় আরও উঁচুতে উঠে গেছে। ওইটাই পশ্চিম দিক। পুব দিকটা নিচে। যেদিক থেকে ঠেলে উঠছে মাধবীর গাড়ি।

সাজানো শহর। ধনকুবেরদের চাঁদার টাকায় পরিচ্ছন্ন শহর। পুব থেকে পশ্চিমে খাড়াই উঠে গেছে এই যে রাস্তা শিবালয় এভিন্যু—এর দু’পাশে চতুষ্কোণ ব্লক। মাঝে মাঝে চৌমাথা। ডাইনে-বায়ে রাস্তা চলে গেছে। শহরের সর্বত্র যাওয়া যায় সহজেই। রাস্তা হারানোর ভয় নেই।

অথচ খাঁ খাঁ করছে দু’পাশ। বিচিত্র ব্যাপার।

শীতের আগের এই মিষ্টি বিকেলটায় কেউ বাড়ি বসে থাকতে চায় না। বারো মাস যারা এখানে থাকে, তারা এই নিরিবিলি অপরাহ্নকে হারাতে চায় না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে সব্বাই—বসে থাকে পথের পাশে বাঁধানো বেদীতে, বেঞ্চিতে, ব্যালকনিতে।

বারো মাসের মানুষ এখানে অবশ্য খুবই কম। বাড়ি খালি করে বেরিয়ে এলেও রাস্তায় লোক গিজগিজ করে না কোনও সময়ে। অথচ মনে হয়, বড় জীবন্ত শহর এই শিবালয় টাউন।

দার্জিলিং-এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এর জন্ম। দার্জিলিং-এর রাজনীতি এ শহরকে ছুঁতে পারেনি। পারবেও না।

পথের দু’পাশে দোকানগুলো তো খোলা রয়েছে। আলোও জ্বলছে। অথচ কেউ নেই দোকানে। বাড়িগুলোও প্রোজ্জ্বল—অথচ বারান্দায় কেউ নেই। গোল-গোল পাথর বাঁধানো বাহারি রাস্তায় কুকুর পর্যন্ত টহল দিচ্ছে না। শহরের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত বিলকুল ফাঁকা। অদ্ভুত!

একটা চৌমাথা এসে গেছে। এখান থেকে ডাইনে আর বাঁয়ে দুটো রাস্তা চলে গেছে। ঠিক এইখানেই আস্তে ব্রেক কষল মাধবী। তাকাল বাঁয়ে— পরপর তিনটে ব্লক এখান থেকেই দেখা যায়। কেউ নেই রাস্তায়। তাকাল ডাইনে। এদিকে রয়েছে চারটে ব্লক। দেখা যাচ্ছে গাড়ির জানলা থেকেই। এদিকেও পথ জনহীন।

স্টার্ট দেয় মাধবী। পরের চৌমাথায় দাঁড়ায়। তাকায় ডাইনে-বাঁয়ে। কেউ নেই। পরের চৌমাথাতেও একই অভিজ্ঞতা।

পরী এতক্ষণ চুপ করে দিদির কাণ্ড দেখছিল। চৌমাথায় চৌমাথায় থেমে থেমে এগোচ্ছে দিদি, আর একটু একটু করে বাড়ছে ভুরু কুঁচকোনো। শেষকালে বলেই ফেলল, ‘অত থামছ কেন?’

‘আলো-টালো জ্বলছে, অথচ কেউ কোথাও নেই।’

‘ঘরে বসে রয়েছে।’

‘এ-সময়ে ঘরে কেউ থাকে না।’

‘নিশ্চয় দারুণ প্রোগ্রাম আছে টিভিতে।’

‘তা হবে।’

‘তুষার খানাঘর’ও এসে গেল পরের চৌমাথায়। এখানেও ব্রেক কষল মাধবী।

পরী বলল, ‘বেড়ে নাম তো।’

‘এ-শহরের সব কিছুই বাংলা। খাঁটি বাংলা। ইংরিজির নো অ্যাডমিশন।’

‘অথচ ফরেন টুরিস্ট আসে?’

‘তাদের জন্য ছোট বোর্ড আছে নিচের দিকে—দেখেছিস? বাংলা নামটা ইংরিজিতে লিখে তার ইংরিজি মানে দেওয়া হয়েছে।’

পরী যখন ছোট সাইনবোর্ড দেখছে, মাধবী তখন খানাঘরের ভেতরে চোখ চালিয়েছে।

আলো জ্বলছে এখানেও। কোণের জানলাগুলো ঝলমল করছে ভেতরের আলোয়। কাউকেই কিন্তু দেখা যাচ্ছে না।

অথচ ‘তুষার খানাঘর’ খুব পপুলার রেস্তোরাঁ। বাইরের মানুষের ভিড় শুরু হয় টুরিস্ট মরশুমে—কিন্তু বারো মাস এখানে আড্ডা মারতে আসে শহরের মানুষরা। খাবারদাবার সস্তা বলেই শুধু নয়—লোকজনের ব্যবহারও বড় ভাল। খাবার দিয়ে যায় মেয়েরা—হাসিমুখে। দোকানের মালিক নিজেও টেবিলে টেবিলে ঘুরে সবার খোঁজ খবর নেয়। সব মিলিয়ে, মনে হয়, বাড়ির বৈঠকখানায় এসে পড়লাম। কিন্তু এই মুহূর্তে কেউ নেই। না মালিক, না খদ্দের।

মেয়েগুলোও নিপাত্তা।

পরী বলেছিল—টিভি-র দারুণ প্রোগ্রাম আছে নিশ্চয়। সায় দিয়েছিল মাধবী। কিন্তু মন থেকে দেয়নি। প্রোগ্রাম যতই টেরিফিক হোক, রাস্তা আর দোকানপাট খাঁ-খাঁ করবে কেন?

গাড়ি উঠছে একটু একটু করে। ভুরু কুঁচকে দু’পাশে বাড়িগুলোর জানলা আর বারান্দা দেখতে দেখতে চলেছে মাধবী—কাউকেই উঁকি দিতে দেখছে না—দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখছে না। রাস্তার একটামাত্র চলমান গাড়ি দেখে কেউ ছুটে বেরিয়েও আসছে না। কুকুরদের ঘেউ ঘেউ ডাকও শোনা যাচ্ছে না।

এই যে ঢালু রাস্তা পুব থেকে পশ্চিমে উঠে গেছে— এইটাই এই শহরের শিরদাঁড়া! এরই শেষের দিকে বাড়ি কিনেছে মাধবী। মূল রাস্তা থেকে একটু বাঁদিকে— স্কি-লিফট এর কাছেই। টুরিস্ট সিজনে বাড়ি থেকেই দেখা যায় স্কি-পাগলদের। আট ফুট লম্বা আর চার ইঞ্চি চওড়া কাঠের জুতো পায়ে বেঁধে কী পাগলামিই না করে বরফের ওপর।

মাধবীর গাড়ি এসে গেল বাড়ির সামনে।

দোতলা বাড়ি। পাথর আর কাঠ দিয়ে তৈরি। চমৎকার ডিজাইন। দাঁড়িয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। একতলায় তিনটে বড় জানলা— রাস্তার ওপরেই। ছাদ ঢালু— নীল আর কালো টালি দিয়ে ছাওয়া। সামনের দিকে বিশ ফুট চওড়া বাগান। বুক চিরে চলে গেছে গোল পাথর বাঁধাই রাস্তা। কোমর সমান উঁচু সবুজ ঝোপের বর্ডার দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে এই বাগান আর বাড়িটাকে।

ঝোপের মাঝামাঝি জায়গা থেকে শুরু হয়েছে বাগানের রাস্তা। রাস্তার শেষে বাড়ির উঠোন। সেখানকার নেমপ্লেট রাস্তা থেকেই দেখা যায় : ডা. মাধবী লাহা। নামের পাশে খানকয়েক ডিগ্রী।

মাধবীর গাড়ি এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে। কিন্তু দরজা খুলে কেউ বেরিয়ে এল না। যদিও মাধবী খবর পাঠিয়েছিল আগেই।

বাসন্তী কি ঘুমোচ্ছে? এই অবেলায়?

গাড়ি রাখার ছোট্ট জায়গায় গাড়ি ভিড়িয়ে দিল মাধবী। পরী বললে, ‘ফুটফুটে বাড়ি তো!’

মন্দ বলেনি পরী। শুধু ফুটফুটে নয়, টুকটুকেও বলা যায় ছোট্ট এই বাড়িটাকে। নিজের বাড়ি বলতে তো এতদিন কিছুই ছিল না মাধবীর। এই তার প্রথম নিজস্ব বাড়ি। এ বাড়ির দিকে তাকালেই মনটা শান্ত হয়ে যায়।

এখনও তাই হচ্ছে। এতক্ষণ ভুগছিল চাপা টেনশনে। এখন রিল্যাক্সড। আশপাশের অদ্ভুত পরিবেশ মুহূর্তের জন্যে মুছে গেল মন থেকে।

বললে, ‘একতলার অর্ধেক আমার। অফিস আর ওয়েটিং রুম। বাকি অর্ধেক ব্যাঙ্কের দখলে। তাহলেও সুন্দর বাড়ি। দেখলে মনে হয়, শুধু চেহারায় নয়— চরিত্রেও এ-বাড়ি আর পাঁচটা বাড়ির থেকে আলাদা। তাই নয় কি?’

‘ঠিকই তো।’

এতক্ষণ কথা হচ্ছিল গাড়ির মধ্যে বসে। এবার নেমে আসে বাগানের রাস্তায়। পড়ন্ত রোদ হিমেল হাওয়াকে যেন আয়-আয় করে ডেকে আনছে। কনকনে শৈত্য বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। মাধবীর গায়ে ফুলহাতা সবুজ সোয়েটার। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত জিনস ট্রাউজার্স। তা সত্ত্বেও হাড়সুদ্ধ যেন কেঁপে উঠছে। এ-সময়ে অবশ্য এখানকার আবহাওয়ায় এই খেলাই দেখা যায়। দিনে মোলায়েম ভাব— রাতে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা।

একটানা অনেকক্ষণ ড্রাইভিং হয়েছে। আড়ষ্ট হয়ে গেছে মাসল। আড়মোড়া ভাঙে মাধবী। মাসল খিঁচে-ধরা তাতে যদি কমে। তারপর ঠেলে বন্ধ করে দেয় গাড়ির দরজা। খটাং আওয়াজটার প্রতিধ্বনি ফিরে আসে ওপরের পাহাড় থেকে, গড়িয়ে নেমে যায় নিচের শহরে। গোধূলির নিথরতায় জাগায় সামান্য শিহরণ— একটিমাত্র শব্দের শিহরণ।

ডাক্তার মাধবী লাহার কানের মধ্যে দিয়েই সেই শব্দ বিচিত্র এক বৈদ্যুতিক তরঙ্গ সৃষ্টি করে মগজের মধ্যে। গোটা মগজটা থমথম করে ওঠে সেই আশ্চর্য ইলেকট্রিক সিগন্যালে। একটিমাত্র শব্দ। মস্ত এক সঙ্কেত।

থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মাধবী। মনে পড়ে যায়, ফ্রেড হয়েলের লেখা বিখ্যাত সেই কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসের সংলাপটা। এ সংলাপ মানুষের নয়— এক ইনটেলিজেন্ট কালো মেঘপুঞ্জের। আক্রমণ হেনেছিল সৌরজগতে। ধ্বংস করে এনেছিল পৃথিবীকে। কিন্তু ভাল লেগেছিল বিঠোফেনের বি-ফ্ল্যাট-মেজর সোনাটা।

বলেছিল, ‘শব্দকে আমরা ব্যবহার করি শুধু মনের মতন বৈদ্যুতিক ছন্দের প্যাটার্ন গড়ে নিয়ে ব্রেনকে আরও বেশি কাজে লাগানোর জন্যে।’

শব্দ! ইলেকট্রিক্যাল প্যাটার্ন! সিগন্যাল!

শৈত্যবোধটা আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়ে মাধবীর সারা গায়ে। আস্তে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ায় গাড়ির পেছনে। তাকায় শিবালয় শহরের দিকে। শহরের মাঝের দিকে। কোথাও কিছু নড়ছে না।

পরীও তাকিয়েছিল নিচের শহরের দিকে। মুখে ভাসছে খুশি। কথাতেও ঠিকরে আসে উচ্ছ্বাস, ‘দিদিরে, এইখানেই আমি থাকব চিরকাল।’

জবাব দিল না মাধবী। তার মন তখন ছুটছে প্রতিধ্বনির পেছনে। ফিরে তো এল না প্রতিধ্বনির ঢেউ। নামতে নামতে হারিয়েই গেল। বাতাসের নরম শব্দ ছাড়া এখন আর কোনও শব্দ নেই।

সাইলেন্স, সাইলেন্স… খণ্ড খণ্ড নৈঃশব্দ্য বিরাজমান চারিদিকে। কসমিক সাইলেন্সও বুঝি এত ভয়াবহ নয়। নৈঃশব্দ্য তো একরকম হয়—একই চেহারার আর চরিত্রের হয়—সাহিত্যিকরা এককথায় বলেন : অখণ্ড নৈঃশব্দ্য।

কিন্তু মাধবীর তো তা মনে হচ্ছে না। যেন অগুন্তি নৈঃশব্দ্য খণ্ড খণ্ড চেহারা আর চরিত্র নিয়ে ভাসছে তার চারপাশে। রাতের শ্মশানে টের পাওয়া যায় এই নৈঃশব্দ্যকে— টের পাওয়া যায় গোরস্থানে— মৃতদেহকে ঘিরে গড়ে ওঠে যে কালান্তক নৈঃশব্দ্য— এ যেন তাই।

ধাঁধায় পড়ে মাধবী। হঠাৎ এ-ধরনের ভাবনা মনের মধ্যে চেপে বসছে কেন, তা বুঝে ওঠে না। নৈঃশব্দ্য তো তার কাছে নতুন কিছু নয়। শব্দের উৎপাত অসহ্য লাগে তার কাছে বরাবরই। কিন্তু কখনও তো এমনভাবে ভাবেনি যে নৈঃশব্দ্যরও অনেক চেহারা, অনেক চরিত্র থাকতে পারে। এই মুহূর্তে টুঁটি টিপে ধরা বিশেষ এই নৈঃশব্দ্যটাকেই বা শ্মশানে অথবা গোরস্থানের নৈঃশব্দ্য বলে মনে হচ্ছে কেন? এই পাহাড়ি অঞ্চলে গরমকালের রাতের নৈঃশব্দ্য সে উপভোগ করেছে মনপ্রাণ দিয়ে। সে বড় মিঠে নৈঃশব্দ্য। যদিও তা নিরেট নৈঃশব্দ্য নয় মোটেই। ঝাঁকে ঝাঁকে পোকাদের উৎপাত চলে জানালার বন্ধ সার্সির ওপর। বাইরের বাগানে সমানে গান গেয়ে যায় ঝিঁঝিঁ পোকা। নিশাচর পাখি মাঝে মাঝে ডানা ঝাপটায়। হাওয়ায় মাঝে মাঝে অদ্ভুত আলোড়ন। সব আওয়াজ মিলে মিশে গিয়ে ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে যখন তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে— তখন তা নিছক নৈঃশব্দ্য না হলেও— শব্দের জগতে তার ঠাঁই নেই। এছাড়াও শহরের নিদ্রা যখন গাঢ় হয়, তখন জাগ্রত হয় আর একরকম নৈঃশব্দ্য। গোটা শহরটা ঘুমিয়ে থেকেও যেন জেগে থাকে। নিঃশব্দে বলতে থাকে— দেখ, দেখ, ঘুমন্ত নগরীকেও তুমি টের পাচ্ছ মনের কান দিয়ে।… এই নৈঃশব্দ্যকেও ভালবেসেছে মাধবী। অতীন্দ্রিয় অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করেছে, নিশীথ নগরীর নীরব সংলাপ।

কিন্তু এইমাত্র যে নৈঃশব্দ্য করাল দাঁতের কামড় মেরে বসে গেল তার অণু পরমাণুতে— এই রকম নৈঃশব্দ্য তো কখনও শোনেনি মাধবী। শীতের রাতের হাড় হিমকরা নৈঃশব্দ্যের চেয়েও এর কামড় অনেক বেশি ভেতরে প্রবেশ করেছে শুধু একটাই কারণে…

অতলান্তই শুধু নয়— এর অতলে রয়েছে আতঙ্ক— অজানা আতঙ্ক— মুখ বুজে ঘাপটি মেরে রয়েছে তারা নৈঃশব্দ্যের মধ্যে… সুযোগ পেলেই মাথা তুলবে— নৈঃশব্দ্যকে খান খান করে ছাড়বে…

আর ঠিক এই কারণেই নার্ভাস হয়ে যায় মাধবী। ভয়-ভয় ভাবটা প্রকটতর হয়ে ওঠে। অবাঙমানসগোচর ভয় সহস্র প্যাঁচ মেরে ঘিরে ধরে ওর তনুমনকে…

যেন এক দানবিক অট্টহাসির পৈশাচিক অট্টরোল ফেটে পড়ার আগে শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে নৈঃশব্দ্য নিতলের অন্ধকূপে।

গলা ফাটিয়ে চেঁচাবে মাধবী? সে সাহসও হচ্ছে না। প্রতিবেশীরা যদি দলে দলে বেরিয়ে আসে? ওর নার্ভাসনেস দেখে অনুকম্পার চোখে তাকায়? সে যে ডাক্তার— ভয় পাওয়া তো তাকে সাজে না।

মুগ্ধ নয়নে পাহাড়ি গাঁয়ের দিকে চেয়ে থেকে বললে পরী, ‘এমন সুন্দর জায়গা ছেড়ে আমি কিন্তু যাচ্ছি না কোথাও। শান্তি… শুধু শান্তি!’

শান্তি? তা রয়েছে বটে। উপদ্রবের ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। তবে কেন অনাহূতদের অস্তিত্ব টের পেয়ে এমন সিঁটিয়ে যাচ্ছে মাধবী? ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়? অতীন্দ্রিয় অতি-অনুভূতি বোধ? পাঁচটা ইন্দ্রিয়র বাইরের বিরাট জগৎ ওঁত পেতে থাকে তো অহোরাত্র— জীবজন্তুরা টের পায়— মানুষ সবসময় টের পায় না— মাধবীর মনের মধ্যে সেই শক্তির অকস্মাৎ উদয় ঘটছে কেন?

বোগাস! ছায়া দেখে চমকে উঠছে মাধবী। অল ননসেন্স!

গাড়ির পেছনকার ট্রাঙ্ক খোলে মাধবী। তুলে আনে পরীর একটা বড় সুটকেস। তারপর আর একটা। দ্বিতীয় সুটকেসটা ধরে নামিয়ে নেয় পরী। হাত বাড়ায় ট্রাঙ্কের মধ্যে বাইরের ব্যাগটার দিকে।

‘বেশি বোঝা নিসনি। বারে বারে নিয়ে যাবি।’

বইয়ের ব্যাগ আর সুটকেস নিয়ে লন পেরিয়ে চলে আসে দু’জনে পাথর দিয়ে বাঁধানো পথে। পথের শেষে গাড়িবারান্দা। ছায়া জমছে সেখানেও। যেন ছায়ার ফুল ফুটছে। একে-একে পাপড়ি মেলে ধরছে।

সামনের দরজা খুলে ধরল মাধবী। পা ফেলল ভেতরে। হাঁক দিল, ‘বাসন্তী?’ জবাব নেই।

‘বাসন্তী, আমরা এসে গেছি।’

আওয়াজ মিলিয়ে গেল বাড়ির মধ্যেই। ভেতরের নৈঃশব্দ্য টুক করে গিলে নিল চড়া গলার ডাককে।

হলঘরের শেষ প্রান্তে জ্বলছে একটা আলো। বাড়ির আর কোথাও কোনও আলো জ্বলছে না। আলোটা জ্বলছে রান্নাঘরে। দরজাটা দু’হাট করে খোলা।

হাতের সুটকেস মেঝেতে নামিয়ে রাখল মাধবী। সুইচ টিপে জ্বালল হলঘরের আলো। ডাকল, ‘বাসন্তী?’

‘বাসন্তী কে, দিদি?’ হাতের বই-ব্যাগ আর সুটকেস মেঝেতে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললে পরী।

‘বলতে পারিস আমার হাউস-কীপার। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সবই করে। ও তো জানে এখন আমরা আসব। সাড়া দিচ্ছে না কেন? হয়তো রাতের রান্না নিয়ে মশগুল।’

‘কানে কালা বোধহয়?’

‘আরে না।’

‘এখানেই থাকে?’

‘হ্যাঁ। গ্যারেজের ওপরে মেজানিন ফ্লোরে,’ কথা বলতে বলতে গাড়ির চাবি আর মানিব্যাগ ড্রয়ারের মধ্যে রেখে দেয় মাধবী। আয়না লাগানো দেওয়ালে সাঁটানো ছোট বাহারি টেবিলের ড্রয়ার। পেতলের ফ্রেম দিয়ে বাঁধানো আয়না।

দেখেই ভাল লাগে পরীর, ‘খুব বড়লোক তো তুমি। এমন সুন্দর আয়না— চব্বিশ ঘণ্টা কাজের লোক—’

হাসে মাধবী, ‘তোর মাথা! বাসন্তীর জন্যে খরচ তো করতেই হবে রুগি দেখব, না হাঁড়ি ঠেলব?’

‘বাসন্তী বোধহয় ওর ঘরে রয়েছে—চলো যাই।’

‘তাহলে রান্নাঘরের আলো জ্বলবে কেন? আগে চল রান্নাঘরে।’

হলঘর পেরতে থাকে মাধবী— পেছনে পরী।

এসে গেছে রান্নাঘর। বেশ বড়। সিলিং বেশ উঁচুতে। ঘরের মাঝখানে রান্নার জন্যে বড় টেবিল। চারটে ইলেকট্রিক বার্নার রয়েছে সেখানে, একটা গ্রিল, খানিকটা জায়গা কুটনো কাটা আর ময়দা মাখার জন্যে। মাথার ওপর থেকে ঝুলছে চকচকে স্টেনলেস স্টিলের ইউটিলিটি র‍্যাক। হাতা, চামচে, খুন্তি, বাটি, থালা— সবই লাগানো রয়েছে সেখানে— হাত বাড়ালেই যাতে পাওয়া যায়। টেবিল-কাউন্টারের ওপরটা সেরামিক টালি দিয়ে বাঁধানো। নিচের ক্যাবিনেটগুলো কালচে পালিশের কাঠ দিয়ে তৈরি। ঘরের শেষপ্রান্তে রয়েছে একজোড়া ওয়াটার বেসিন, একজোড়া গ্যাস উনুন, একটা মাইক্রোওয়েভ উনুন, আর একটা রেফ্রিজারেটর।

ঘরে ঢুকেই বাঁয়ে মোড় নিয়েছিল মাধবী, এগিয়ে গেছিল দেওয়ালের গায়ে লাগানো ছোট্ট লেখবার টেবিলটার দিকে। এই টেবিলে বসেই খাবারের মেনু বানায় বাসন্তী, বাজারের ফর্দ তৈরি করে, হিসেব লেখে। বাইরে কোথাও গেলে, এইখানেই চিরকুট লিখে রেখে যায়— যাতে মাধবী বাড়ি ফিরেই পড়ে নেয়। কিন্তু সেরকম চিরকুট নেই টেবিলে। ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছে মাধবী, এমন সময়ে কানে ভেসে এল পরীর অস্ফুট চিৎকার। জোরে নিঃশ্বাস নিয়েই থেমে গেল হঠাৎ।

পরী মাঝের রান্নার টেবিল ঘুরে এগিয়ে গেছিল ভেতর দিকে— টেবিলের শেষের দিকে। সে এখন দাঁড়িয়ে আছে রেফ্রিজারেটারের পাশে, চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে কোটর থেকে, চেয়ে আছে মেঝের দিকে। বিস্ফারিত চাউনি নিবদ্ধ রয়েছে জোড়া বেসিনের মাঝে—তলার মেঝেতে।

দূর থেকে এইটুকু দেখেই আতঙ্ক ফেটে পড়ল মাধবীর অণু-পরামাণুতে। জোরে পা চালিয়ে এগিয়ে গেছিল মাঝের বড় টেবিল ঘুরে পরীর দিকে।

মেঝেতে শুয়ে রয়েছে বাসন্তী। চিৎ হয়ে মারা গেছে। দু’চোখের পাতা পুরো খোলা, কিন্তু সে চোখে প্রাণ নেই। ফুলে ঢোল হয়ে রয়েছে ওপরের ঠোঁট আর নিচের ঠোঁট। চেপে বসেছে জিবের ওপর। ঠেলে বেরিয়ে রয়েছে জিব—তাতে গোলাপি ভাব নেই—বিবর্ণ।

চকিতে এই দৃশ্য দেখেই চোখ সরিয়ে নিয়েছিল মাধবী। তাকিয়েছিল ছোট বোনের দিকে।

মাধবীর পায়ের আওয়াজ পেয়ে পরীর ঘোর কেটে গেছিল। ডেডবডির দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে চেয়েছিল দিদির দিকে।

মাধবী ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল টেবিলের অন্যদিকে— ডেডবডি যেখান থেকে দেখা যায় না। বসাল টেবিলের সামনের চেয়ারে।

আস্তে আস্তে সহজ হয়ে আসে পরীর দুই ঠোঁট। এতক্ষণ ছিল শক্ত। বললে, ‘ওই কি বাসন্তী?’

‘হ্যাঁ।’

‘কি রকম চেয়ে রয়েছে বলো? ফোলা সমস্ত শরীর… কালসিটে সারা গায়ে মুখে… চাউনিটা কী ভীষণ… অত কালসিটে কেন, দিদি?’

‘বেশ কয়েকদিন মড়া পড়ে থাকলে অমন তো হবেই।’

‘পচা গন্ধ তো নেই!’

ভুরু কুঁচকে যায় মাধবীর। দিন কয়েক আগে মারা গেলে শরীর কালচে মেরে যেতে পারে, ফুলেও উঠতে পারে—পচা গন্ধ তো থাকা উচিত।

ফের বলে পরী, ‘মুখের ভাব অমন বিকট কেন? চাউনি অমন কেন? দেখছে কাকে?’

কী বলবে মাধবী?

পরীই বলে গেল, ‘চেঁচিয়ে উঠেছিল বাসন্তী—মরে গেছে চেঁচানি শেষ হওয়ার আগেই।’

না, এরকম মড়া মাধবী লাহা কক্ষনো দেখেনি। পাশে হাঁটু গেড়ে বসে একদৃষ্টে চেয়েছিল মাধবী। চেনা মানুষের ডেডবডি এত বিকৃত হলে মনের মধ্যে কষ্ট তো জাগবেই।

গোটা মুখখানা ফুলে গেছে। ফুলে উঠেছে শরীরটাও। বাসি মড়া ফুলে ওঠে ঠিকই, কিন্তু সেই ফোলা আর এই ফোলায় আকাশ-পাতাল তফাৎ। তার চেয়েও বড় কথা, বাসি মড়ার পাশে বসলে নাকে দুর্গন্ধ ভেসে আসবেই। বাসন্তীর মড়া থেকে কোনও বাজে গন্ধ বেরচ্ছে না।

আরও খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে মাধবী দেখল, কালচে আর ফেটে-ফেটে যাওয়া চামড়ার এহেন অবস্থা তো টিস্যু পচন থেকে হয়নি। পচন যদি শুরু হয়ে থাকে, তাহলে তার জের এখনও চলা উচিত। অথচ এত ঠাহর করেও সেরকম কোনও লক্ষণ মাধবীর চোখে ধরা পড়ছে না। ফোস্কা নেই, ফুসকুড়ি নেই, গলে যাওয়া নেই, ক্ষত নেই। রস পর্যন্ত গড়াচ্ছে না। শরীরে পচন ধরলে তার প্রথম প্রকাশ ঘটে চোখে— কেননা শরীরের অন্য টিস্যুদের চেয়ে অনেক নরম টিস্যু দিয়ে তৈরি হয় চোখ। কিন্তু বাসন্তীর চোখ তো চমৎকার রয়েছে। পচনের চিহ্নমাত্র নেই। চোখের মণিদুটোও পরিষ্কার। ঘোলাটে ভাব দেখাই যাচ্ছে না— মৃত্যুর পর যেরকম দেখা যায়।

এই চোখ যখন জীবন্ত ছিল, তখন সেখানে অষ্টপ্রহর খুশির জোনাকি নেচে নেচে বেড়াত। আর ভাসত মমতা। বয়সে বাষট্টি হতে পারে, মাথার সব চুল পেকে সাদা হয়ে যেতে পারে—তবুও মুখখানা ভারী মিষ্টি ছিল বাসন্তীর। ঠাকুমা-দিদিমাদের মতন মায়া-মমতায় ভরা সিগ্ধ শীতল। কখনও নরম, কখনও শক্ত গলায় শাসন করে গেছে মাধবীকে— যেন দুষ্টু নাতনি। কথার টানে নেপালি ছোঁয়া থাকত— কিন্তু বাঙালিয়ানা ছিল বেশির ভাগ। গান গাইত বড় মিষ্টি গলায়। রান্না করতে করতে করতে গান, বেসিন ধুতে ধুতে গান— গান ছাড়া বুড়ির জীবনে যেন আর কিছুই ছিল না। সেই গান এ বাড়িতে আর শোনা যাবে না।

মাধবী যতই চায় ততই মনে হয়, চামড়া যেন থেঁৎলে গেছে। সারা গায়ে বুঝি কালসিটে ছড়িয়ে পড়েছে। কোথাও কালো, কোথাও নীল, কোথাও কালচে-হলদে— কোথাও একটা রঙের ওপর আর একটা চেপে বসেছে। চামড়াকে ভয়ানক ভাবে থেঁৎলানো না হলে এরকম রং ফুটে ওঠে না। কিন্তু থেঁৎলানি তো শরীরের এক-আধটা জায়গায় থাকা উচিত— শরীরময় এরকম থেঁৎলানি যে একেবারেই নতুন ঘটনা। চামড়ায় এক ইঞ্চি জায়গাও বাদ নেই। প্রতি বর্গ ইঞ্চি চামড়াকে থেঁৎলে পিটিয়ে ঘা দিয়ে কালসিটে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

মুখের প্রতি সেন্টিমিটারেও সেই থেঁৎলানির চিহ্ন। নোড়া দিয়ে যেন ধরে ধরে পেটানো মুখের সমস্ত চামড়া— এতটুকু ফাঁক রাখা হয়নি কোত্থাও। ভাঙচোর নেই কোনওখানে—গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট ঘটলে যেমন দেখা যায়— এই রকম কালসিটে মেরে যায় গোটা মুখ— কিন্তু হাড়গোড় তো আস্ত থাকে না— যা রয়েছে এই মুখে— নাক চিবুক ঠোঁট চোয়াল— সবই রয়েছে আস্ত।

মেপে মেপে পিটিয়ে গেলে এইরকম কালসিটে দেখা দিতে পারে। কিন্তু তা কি সম্ভব?

আর একভাবে এই কালসিটে দেখা দিতে পারে। গোটা শরীরটাও বিরং হয়ে যেতে পারে। চাপটা যদি আসে শরীরের ভেতর থেকে। চামড়ার ঠিক নিচেই যে টিস্যু রয়েছে, সেই টিস্যু ফুলে উঠলে চামড়ার রং এইভাবে পালটে যেতে পারে। কিন্তু আপাদমস্তক এইরকম নিখুঁত থেঁৎলানি আর কালসিটের ভাবকে ফুটিয়ে তুলতে হলে ফোলানিটা হওয়া উচিত আচমকা— ভয়ানক বেগে— অবিশ্বাস্য জোরে যদি না হয়, চামড়ায় সেরকম চাপ তো পড়বে না— কালসিটে আর থেঁৎলানি জাগানোর মতন চাপ সৃষ্টি হবে না।

কিন্তু তা কি সম্ভব? না, কক্ষনো না।

শরীর কখনও দুম করে ফুলে বেলুন হতে পারে না— চামড়ায় অ্যাকসিডেন্টের এফেক্ট ফেলতে পারে না। জীবন্ত টিস্যু কখনওই এত বেগে হু-উ-উ-স করে ফুলে ওঠে না। কিছু কিছু অ্যালার্জি-কেসে হঠাৎ ফুলুনি বিচিত্র নয়— সবচেয়ে প্রকট ঘটনাটা দেখা গেছে পেনিসিলিনে যাদের অ্যালার্জি আছে, তাদের ক্ষেত্রে। কিন্তু এমন কোনও কারণের সন্ধান আজও পায়নি মাধবী যা মানুষের শরীরকে ধাঁ করে ফুলিয়ে তুলতে পারে, চক্ষের নিমেষে শরীরময় কুৎসিত কদাকার কালসিটের ছাপ মেরে যেতে পারে… প্রতি বর্গ সেন্টিমিটার চামড়াকে থেঁৎলে দিতে পারে…

গোটা শরীরটার এইভাবে ফুলে ওঠাকে ময়না-তদন্ত স্ফীতি বলেও চালিয়ে দেওয়া যায় না। এরকম স্ফীতি অবশ্য কালেভদ্রে দেখা যায়— তখন তাকে ক্লাসিক কেস বলা যায়।

কিন্তু এ কেস সে কেস নয়; এ বিষয়ে তিলমাত্র সন্দেহ নেই মাধবীর মনে। থেঁৎলানির জন্যেও যদি বা হয়, শরীর ফুলবে কেন? প্রথম খটকা তো সেইখানেই।

তাহলে কি বিষ প্রয়োগ? খুবই বিরল বিশুদ্ধ বিজাতীয় বিষ না হলে তো এমন কাণ্ড সম্ভব নয়। বিষবিজ্ঞানে আজও এমন বিষের কথা লেখা হয়েছে বলে মাধবীর মনে হয় না। তার চাইতেও বড় কথা, আশ্চর্য এই বিষের সান্নিধ্যে এল কি করে বাসন্তী? বিষ ওর শরীরে ঢুকল কি করে? বাসন্তীর তো কোনও শত্রু নেই।

বিষ নয়, বিষ নয়— অন্য কিছু।

বেকুব বনে যাচ্ছে মাধবী। আজ পর্যন্ত চিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধে যতটুকু জেনেছে সেই জ্ঞানের নিরিখে বাসন্তীর মৃত্যুর কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণই খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ মাথার মধ্যে একটা চমক। নতুন কোনও সংক্রামক রোগ নয় তো?

‘দিদি!’ পরীর গলায় উৎকণ্ঠা।

সাড়া দিল না মাধবী। ওর চেতনা জুড়ে তখন সাইক্লোন উঠেছে।

ডেডবডিতে এখনও আঙুল ছোঁয়ায়নি মাধবী। এখন মনে হল, জামাকাপড় না ছুঁলেও বুঝি ভাল হত। ছিটকে গিয়ে সিধে হয়ে দাঁড়ায় তক্ষুণি— সরে আসে মৃতদেহের কাছ থেকে।

হিমেল স্রোত নেমে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে।

সেই প্রথম চোখ পড়ে বেসিনের পাশে কাটিং বোর্ডের ওপর। সেখানে রয়েছে চারটে বড় আলু, অর্ধেক কাটা কপি, একটা থলি, খানকয়েক গাজর, একটা লম্বা ছুরি, খোসা ছাড়ানোর একটা বিশেষ ছুরি। রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত ছিল বাসন্তী— মরেছে তক্ষুণি। আচমকা। জিনিসপত্র সরিয়ে রাখবারও অবসর পায়নি। খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে হঠাৎ আছড়ে পড়েছে দুই বেসিনের মাঝের জায়গায়।

প্লেগ নয় তো?

প্লেগ— বিউবোনিক অথবা অন্য ধরনের— মানুষের আস্তানায় হানা দিয়েছে বহুবার পৃথিবীর নানান অঞ্চলে। এ অঞ্চলে তার আদিম নৃত্য কখনও ঘটেছে বলে মাধবীর জানা নেই— সম্প্রতিও কোনও কেস মাধবীর গোচরে আসেনি। এলেও তার চিকিৎসা আজকাল আর দুর্ঘট নয়। কিছু প্লেগের ক্ষেত্রে চামড়ায় পেটেকিয়া দেখা দেয়। ছোট ছোট লালচে-বেগুনি স্পট। রক্তক্ষরণের জন্যে। কখনও দাগগুলো কালচে মেরে যায়— গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যযুগে একেই বলা হত ‘ব্ল্যাক ডেথ’— কালো মৃত্যু। কিন্তু বাসন্তীর গোটা দেহ যেভাবে কালো হয়ে গেছে— যেভাবে মসীবর্ণ ধারণ করেছে— নিশ্চয় অগুন্তি পেটেকিয়া থুকথুক করছে চামড়ার প্রতিটি লোমকূপে। তা কি সম্ভব?

তা ছাড়া, হঠাৎ মারা গেছে বুড়ি। প্লেগ কক্ষনো নয়। কোনও সংক্রামক ব্যাধিই নয়।

মারধরের চিহ্ন নেই। রক্ত ঝরছে না কোত্থাও। গুলিবিদ্ধ হলে ক্ষত থাকত— তা-ও নেই। ছুরিকাঘাতের ছিদ্রও নেই। গলা টিপে ধরা হয়নি। পিটিয়ে নিকেশ করার কোনও লক্ষণ নেই।

ডেডবডিকে একপাক ঘুরে নিয়ে বেসিনের পাশে কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ায় মাধবী। ফুলকপির গায়ে আঙুল ছুঁইয়েই চমকে ওঠে। এখনও কনকনে ঠাণ্ডা। খুব জোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফ্রিজ থেকে বের করে রাখা হয়েছে কাটিং বোর্ডে।

বুড়ি মরেছে একঘণ্টার মধ্যেই। শরীর এখনও উষ্ণ থাকা উচিত। কিন্তু মরল কিভাবে? মারল কে?

পরীকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে এল মাধবী। একটা অনিশ্চিত নৈঃশব্দ্য চেপে বসেছে গোটা বাড়িতে। হলঘরের কার্পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ে জুতোর ঘষটানি লেগে যে ফিসফিসানি—তাও যেন বজ্রধ্বনির মতন জোরালো শোনাচ্ছে কানে।

মাধবীর এই অফিসঘর ইদানীংকালের ডাক্তারদের মতন নয়। অত্যাধুনিক। ঘরের মাঝখানে একটা মস্ত টেবিল। পরীকে সেখানে বসিয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিল মাধবী— উদ্দেশ্য, শিবালয় টাউনের শেরিফকে ফোন করবে। কিন্তু ডায়ালটোন পাওয়া গেল না। খুব নরম একটা হিস-হিস শব্দ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই। রিসিভার রেখে দিয়ে ফের তুলল মাধবী। সেই একই হিসহিস আওয়াজ। টেলিফোনও মরে গেছে।

এ বাড়িতে আর নয়। একটা মুহূর্তও আর নয়। উঠে দাঁড়ায় মাধবী, ‘পরী, চল।’

‘কোথায়?’

‘পাশের বাড়িতে। ফোন করব। এ ফোন ডেড।’

আস্তে আস্তে দরজা ঠেলে খুলে দেয় মাধবী। বুক ধড়াস ধড়াস করছে। বিকটদেহী নিশ্চয় কাউকে দেখবে দাঁত খিচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে।

কেউ নেই। ঘর ফাঁকা।

দ্রুত এগিয়ে গেল দু-জনে। হলঘরের বাঁদিকে রয়েছে দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি। মাধবী চেয়ে ছিল সেই দিকেই। কিন্তু সিঁড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে এল না কোনও নরখাদক।

কেউ নেই সিঁড়িতে। কেউ নেই হলঘরে। কেউ নেই গাড়িবারান্দায়।

বাইরের গোধূলি দ্রুত ম্লান হয়ে যাচ্ছে রজনীর আবির্ভাবে। লক্ষ লক্ষ বিবর থেকে লক্ষ লক্ষ ছায়া দানবরা গুটি গুটি বেরিয়ে আসছে দিবসের অবসান ঘটাবে বলে। এখুনি নিশ্ছিদ্র তমিস্রার আবির্ভাব ঘটবে গোটা শহরে।

বড়জোর আর দশ মিনিট।