» » আদিম আতঙ্ক

বর্ণাকার

অদ্রীশ বর্ধন

আদিম আতঙ্ক

ঊনি

শিবালয় শহরের শিব মন্দিরের ঘণ্টা বেজে উঠল রাত ঠিক তিনটে বেজে বারো মিনিটের সময়ে। বেজেই চলল ঢং ঢং করে।

হোটেলের লবিতে বসেছিল ছ’জনে। একই সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে সিধে হয়ে দাঁড়াল তৎক্ষণাৎ। ককিয়ে উঠল সাইরেন। বেজেই চলেছে… দমকে দমকে যেন হাহাকার ছেড়ে যাচ্ছে।

বললে মাধবী, ‘উতঙ্ক চৌধুরী আসছেন মনে হচ্ছে।’

ছ’জনে বেরিয়ে গেল বাইরে।

শিবালয় শহরের নিচের দিকে কোণ ঘুরে আবির্ভূত হল একটা গাড়ি। হেডলাইটের আলো উঠে রয়েছে ওপর দিকে। রুপোলি চেকনাই জাগছে কুয়াশার পর্দায়।

ঢালু রাস্তা বেয়ে ধীর ধীরে উঠে আসছে গাড়ি। ব্রেক কষল ফুটপাত ঘেঁষে—সুরেশ সাইকিয়া যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে দশ ফুট দূরে। নিভে গেল হেডলাইট।

খুলে গেল ড্রাইভারের দরজা। নেমে এলেন উতঙ্ক চৌধুরী। পুরু চশমার লেন্সের মধ্যে দিয়ে ভদ্রলোকের চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকমের বড় মনে হচ্ছে। সাদা চুল এলোমেলোভাবে লেপটে রয়েছে কপাল আর কানের ওপর। হেড কোয়ার্টার থেকে এনেছেন একটা ইনসুলেটেড জ্যাকেট—গায়ে চাপানোর ফলে আরও বেঢপ হয়েছে আকৃতি।

স্তব্ধ হল ঘণ্টাধ্বনি। গোঁ-গোঁ করতে করতে থেমে গেল সাইরেন। এরপরের নৈঃশব্দ্য বর্ণনারও বাইরে।

এগিয়ে এলেন উতঙ্ক চৌধুরী, ‘সুরেশ সাইকিয়া?’

‘হ্যাঁ, আমি। চলুন, ভেতরে বসে কথা হবে।’

ছ’জোড়া চোখ নিবদ্ধ উতঙ্ক চৌধুরীর ওপর। তিনি বলে চলেছেন পৃথিবীর কোন কোন জায়গা থেকে অতর্কিতে রাতারাতি কিভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছে মানুষ আর জন্তু।

বললেন, দক্ষিণ আমেরিকার জয়া ভার্দি শহরের অবিশ্বাস্য কাহিনী। আমাজন নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছিল এই ব্যবসা কেন্দ্র। বাচ্চাকাচ্চা নারীপুরুষ মিলিয়ে সেখানে মানুষ ছিল ছ’শো পাঁচজন। সব্বাই অদৃশ্য হয়ে গেল এক অপরাহ্নে। মিশন স্কুলে ব্ল্যাকবোর্ডে চকখড়ি দিয়ে শুধু লেখা ছিল: এর কোনও আকার নেই— অথচ সবরকম আকার ধারণ করতে পারে।

কথাটার মানে কী হতে পারে, তা বুঝেছিলেন শুধু উতঙ্ক চৌধুরী। কেননা, তিনি যে জানেন, সুপ্রাচীন মায়াশহরেও পাওয়া গেছে অনুরূপ একটা বার্তা। রাতারাতি মায়াশহর পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ার সময়ে লেখা হয়েছিল সেই বার্তা: অশুভ দেবতারা রয়েছে এই পৃথিবীতে। তারা ঘুমিয়ে আছে পাহাড়-পর্বতে। ঘুম ভাঙলে তারা লাভাস্রোতের মতন বয়ে যায়— শীতল লাভা— বহু আকার ধারণ করতে পারে। গ্রাস করে ধনী মানী দরিদ্রকেও, রেখে যায় না কোনও চিহ্ন।

বললেন উতঙ্ক চৌধুরী, ‘যে সবকিছু গ্রাস করে নেয় কোত্থাও কোনও চিহ্ন না রেখে সে ‘আদিম শত্রু’ ছাড়া কেউ নয়।’

জানালেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘এখানেও পেয়েছি একটা মেসেজ। একটা শব্দের কিছুটা।’

‘আধখানা শব্দ?’ উৎসুক হলেন উতঙ্ক চৌধুরী।

‘হ্যাঁ,’ বলে গেল মাধবী, ‘এক প্রৌঢ়া মেমসাহেব দেওয়ালে আয়োডিন দিয়ে P R O লিখেছেন— এর আধখানা— হলেও হতে পারে।’

‘মেমসাহেব?’ কৌতূহলে ফেটে পড়লেন উতঙ্ক চৌধুরী, ‘নিশ্চয় গ্রীসদেশের।’

হাঁ হয়ে গেল মাধবী, ‘জানলেন কী করে?’

‘প্রাচীন গ্রীসদেশে Proteus নামে এক উপদেবতা ছিল। আর নিবাস মান্টিতে। নিজস্ব চেহারা বলতে কিছুই ছিল না। ইচ্ছেমতো যে কোনও মূর্তি ধারণ করতে পারত, যাকে খুশি তাকে খেতে পারত।’

তিক্ত স্বরে বলে উঠলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘আপনি বৈজ্ঞানিক হয়ে এই সব অলৌকিক কুসংস্কার কাহিনীতে বিশ্বাস করেন?’

‘অবশ্যই করি। আপনাকেও করতে হবে। নিজের চোখে তো দেখেছেন যার কোনও মূর্তি নেই, সে ইচ্ছেমতো যে কোনও মূর্তি ধারণ করতে পারে। পুরাকালে একেই বিভিন্ন উপদেবতা নামে ডাকা হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত দেশের সমস্ত পুরাণ কাহিনীতে এই ধরনের অদ্ভুত উদ্ভট উপদেবতার শারীরিক বর্ণনা পাবেন। দু’পাতা বিজ্ঞান পড়ে সব কিছুই আমরা উর্বর কল্পনাপ্রসূত বলে মনে করে এসেছি। কিন্তু এরা সব্বাই ছিল, এখনও আছে। আমাদের আদিম আতঙ্ক।

অপরাজিতা সোম বললেন, ‘ডক্টর চৌধুরী, যা বলে গেলেন, বৈজ্ঞানিক শব্দে যদি তা বলতেন, উপকৃত হতাম, কিন্তু আপনি এখনও বলেননি, জীববিজ্ঞানের শর্ত মেনে এ-প্রাণী নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে কিভাবে। আমি শুনতে চাই আপনার বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ, আপনার তত্ত্ব।

উতঙ্ক চৌধুরী জবাব দেওয়ার আগেই, ‘সে’ নিজে এল।

ডাইনিং রুমের বেসিনের কল ছিটকে বেরিয়ে এসে খটখটিয়ে গড়িয়ে গেল মেঝের ওপর দিয়ে। কল-হীন পাইপের মধ্যে দিয়ে সে বেরিয়ে এল গলগল করে অবিরাম স্রোতের আকারে। বেসিন ভরিয়ে গড়িয়ে গেল মেঝের ওপর। দেখতে দেখতে একমানুষ… দু’মানুষ… হাতির মতন দেখতে পেল্লায় আকার ধারণ করে কড়িকাঠ ছুঁয়ে ফেলল অবর্ণণীয় জেলিগোলক… ফুঁসছে… ফুলছে… ঘুরপাক খাচ্ছে…

আচমকা অনেকগুলো সরু মোটা শুঁড় বেরিয়ে এল জেলিপিণ্ড থেকে। একটা নিজেকে বাড়িয়ে ধরল সাতজনের দিকে। সাতজনেই তখন চেয়ার ছেড়ে দেওয়ালের গায়ে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। শুঁড়টা এগিয়েই থমকে গেল মাঝপথে। শুঁড়ের ডগায় আবির্ভূত হল ছোট্ট একটা ছেঁদা… টপটপ করে জলীয় পদার্থ বেরিয়ে এসে পড়ল মেঝেতে। হলুদ রঙের তরল আরক।

যেখানে যেখানে পড়ল, ধোঁয়া উঠতে লাগল সেইখান থেকে, ফুটো হয়ে যাচ্ছে সিমেন্টের মেঝে। অবরুদ্ধ কণ্ঠে বললে মাধবী, ‘অ্যাসিড।’

মাধবীর এই আত্মজ্ঞানটার জন্যেই যেন অপেক্ষা করছিল লকলকে শুঁড়। ওর মুখের কথা শেষ হতে না হতেই সপাং সপাং করে দু’বার আছড়ে পড়ল টেবিল আর চেয়ারের ওপর। খান খান হয়ে গেল অতবড় টেবিল আর সব ক’টা চেয়ার। তারপরই শূন্যপথে অ্যাসিড ঝরাতে ঝরাতে এগিয়ে গেল ওদের দিকে।

পরী জড়িয়ে ধরেছে মাধবীকে। সুরেশ সাইকিয়া এক হাত রেখেছেন হোলস্টারের রিভলভারে—টেনে বের করা সাহস নেই। অপরাজিতা সোমের মুখ ছাইয়ের মতন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। উতঙ্ক চৌধুরী ফ্যালফ্যাল করে চেয়েই আছেন— চোখের পাতা ফেলতে ভুলে গেছেন। বিশু বোস আর উজাগর সিং নিথর চোখে দেখছেন লকলকে শুঁড় টিপ করেছে কার দিকে।

দুজনে দাঁড়িয়ে ছিলেন পাশাপাশি। শুঁড় এসে থেমে গেল বিশু বোসের নাকের সামনে— মাত্র এক ইঞ্চি দূরে। পরক্ষণেই সরে গেল পাশে। পাক দিল উজাগর সিং-এর গলায়। নিমেষে টেনে নিয়ে গেল ঘরের মাঝখানে।

বিকট আর্তনাদ করে উঠেছিল উজাগর সিং। দু’হাতে শুঁড় জাপটে ধরেছিল। এক ঝটকায় তার গোটা শরীরটা উঠে গেল শূন্যে। দু’চোখ ঠেলে বেরিয়ে এল কোটর থেকে। বিরামবিহীন রক্ত-জল-করা চিৎকারে বুঝি কেঁপে কেঁপে উঠল গোটা শিবালয় শহর।

ঢোক গিলে বললে মাধবী, ‘আহার্য নিবাসে’ কাটামুণ্ড তৈরি হয়েছিল কিভাবে তা দেখাচ্ছে—অ্যাসিড দিয়ে।

কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে উজাগর সিং এর মুণ্ডটা সশব্দে আছড়ে পড়ল মেঝেতে। শুধু কবন্ধ দেহ ঝুলতে লাগল শূন্যে। পরমুহূর্তে কবন্ধও অদৃশ্য হয়ে গেল জেলিপিণ্ডর মধ্যে।

জেলিপিণ্ড এখন নব কলেবর ধারণ করছে অতিকায় মানুষ। দানব।

শুকনো গলায় বললেন অপরাজিতা সোম, ‘টিসু স্যাম্পেল যদি একটু পেতাম, মাইক্রোসকোপে দেখে নিতাম কোষের গড়ন। খতম করার অস্ত্র বের করা যেত।’

দানব বললে বজ্রকণ্ঠে, ‘ডক্টর উতঙ্ক চৌধুরী, ল্যাবরেটরিতে যান। আমার জীবনী লিখবেন, সব না জানলে লিখবেন কী করে?’

দানব শরীর থলথলে হয়ে গেল নিমেষে। আবার দেখা গেল জেলিপিণ্ড। সরু হয়ে পাইপের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে রইল না কিছুই।

উজাগরের মুণ্ডটা ছাড়া।

রাত তখন তিনটে বেজে চুয়াল্লিশ মিনিট।

সেকেণ্ড ল্যাবরেটরির দরজা দু’হাট করে খোলা রয়েছে। ছ’জন ঠেসাঠেসি করে ঢুকেছে তার মধ্যে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে চোখ রেখেছেন বিশু বোস। কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সুরেশ সাইকিয়া আর মাধবী। তিনটে উজ্জ্বল ভিডিও ডিসপ্লে টার্মিনালের সামনে বসে উতঙ্ক চৌধুরী, অপরাজিতা সোম আর পরী।

কমপিউটার স্ক্রিনে কথা ফুটে উঠল—পাঠালাম একটা মাকড়সা।

‘মানেটা কী?’ বলে উঠলেন উতঙ্ক চৌধুরী।

স্ক্রিনে ফুটল নতুন লেখা— পেছনে দেখ। পরীর পেছনে।

চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল পরী। ঘুরে দাঁড়িয়েই দেখল বিরাট একটা মাকড়সা। কুচকুচে কালো। স্থির হয়ে মেঝেতে দাঁড়িয়ে। এতগুলো মানুষের লাফিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো তাকে চঞ্চল করেনি।

কিন্তু পরিবর্তনটা ঘটল চোখের সামনে, খুব দ্রুত। লম্বা ঠ্যাংগুলো ঢুকে গেল শরীরের মধ্যে। এখন সে একটা ডেলা ছাড়া কিছুই নয়। কালচে রং পালটে গিয়ে হয়ে গেল ধূসর-লাল। মাকড়সা আকৃতি বিলীন হয়েছে থসথসে জেলিপিণ্ডর মধ্যে। চকিতে জেলি নিল নতুন আকার— আরশোলা হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই দেখা গেল, আরশোলা ফের জেলি হয়ে গিয়েই হয়ে গেল নেংটি ইঁদুর।

ভিডিও ডিসপ্লেতে ফুটে উঠল নতুন লেখা—‘ডক্টর অপরাজিতা সোম, টিসু স্যাম্পেল চেয়েছিলে, পাঠিয়ে দিলাম।’

বিশু বোস বললেন, ‘হঠাৎ এত সদয় হয়ে উঠল কেন?’

বিষন্ন কণ্ঠে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘কারণ ও জানে, ওকে খতম করার হাতিয়ার বার করার এলেম আমাদের নেই।’

মুহূর্তের জন্যেও স্থির নেই জেলিপিণ্ড, ফুঁসছে, ফুলছে, টোল খাচ্ছে, তেউড়ে যাচ্ছে।

স্ক্রিনে ফুটে উঠল শব্দের পর শব্দ:

চোখ মেলে দেখে নাও আমার শরীরের মাংসখণ্ডর অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ। এই ক্ষমতা আর অমরত্ব শুধু আছে আমার মধ্যেই। আমি অবিনশ্বর। আমি মৃত্যুঞ্জয়ী। আমি সর্বরূপী। আমি সর্বত্র বিরাজমান। আমি সর্বজ্ঞ। ছুঁয়ে দেখ—কোনও ভয় নেই।

সাহসে বুক বেঁধে হেঁট হলেন অপরাজিতা সোম। তর্জনী বাড়িয়ে ডগা দিয়ে স্পর্শ করলেন স্পন্দিত জেলিপিণ্ডকে। বললেন, দরকার তো একটু টুকরোর।

‘লাইট মাইক্রোসকোপির জন্যে,’ সায় দিল মাধবী।

‘সেই সঙ্গে ইলেকট্রন মাইক্রোসকোপের জন্যে। আরও একটু বেশি দরকার কেমিক্যাল আর মিনারেল বিশ্লেষণের জন্যে।’

দপদপ করে লেখা ফুটে উঠেই নিভে যেতে লাগল পরম উল্লাসে: চালাও… চালাও… চালাও এক্সপেরিমেন্ট।

ওয়ার্ক কাউন্টারে মাইক্রোসকোপ নিয়ে বসে আছেন অপরাজিতা সোম। বললেন অস্ফুট স্বরে, ‘অবিশ্বাস্য!’

মাধবী বসে তার পাশেই আর একটা মাইক্রোসকোপ নিয়ে। তার স্বরেও জাগল বিস্ময়, ‘এরকম কোষ-গঠন কখনও দেখিনি।’

উতঙ্ক চৌধুরী জীববিজ্ঞানী নন। কোষ-গঠনের ব্যাপারে জ্ঞানদান করতে অক্ষম। তাই শুধু জিজ্ঞেস করলেন, ‘অবাক হচ্ছেন কেন?’

অপরাজিতা সোম বললেন, ‘বেশির ভাগ টিসুতেই কোষের গঠন নেই।’

মাধবী বললে, ‘আমার স্যাম্পেলেও দেখছি একই ব্যাপার।’

‘অথচ জৈব বস্তুতে কোষ-গঠন থাকে—থাকতেই হবে।’

‘স্যাম্পেল দেখে তো মনে হচ্ছে অজৈব বস্তু। কিন্তু তা হওয়া তো উচিত নয়।’

‘তা তো নয়ই,’ বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘এ যে কতখানি জ্যান্ত, তা তো চোখে দেখেছি, হাড়ে হাড়ে বুঝেছি।’

অপরাজিতা সোম বললেন, ‘কয়েকটা কোষ রয়েছে আমার স্যাম্পেলে—কিন্তু একটা আর একটা থেকে আলাদা।’

সায় দিয়ে গেল মাধবী, ‘আমিও তো তাই দেখছি। রকমারি কোষ যেন সাঁতরে বেড়াচ্ছে অথই অজানা সমুদ্রে।’

অপরাজিতা সোম বললেন, ‘কোষের দেওয়াল তো ঘনঘন পালটে যাচ্ছে— নিউক্লিয়াসের রয়েছে তিনটে দাড়া। কোষের ভেতরে প্রায় অর্ধেক জায়গা জুড়ে রয়েছে। রহস্যময়।’

তিনটে কমপিউটারের স্ক্রিনেই একই সঙ্গে ফুটে উঠল একই কথা:

উজবুক কোথাকার! সর্বশক্তিমানের কোষ তো রহস্যময় হবেই।

স্যাম্পেলের অর্ধেক নিয়ে অপরাজিতা ও মাধবী পরীক্ষা করছিল। বাকি অর্ধেক ছিল একটা কাচের ডিশে। ঘনঘন কাঁপছিল সেই নমুনা। চেহারা পালটে উদ্ভট কীটপতঙ্গ হয়েই ফের জেলির আকারে ফিরে যাচ্ছিল।

অপরাজিতা সোম বললেন, ‘একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি। এই যে স্বরূপহীন টিসু, এই টিসু যখন খুশি যেরকম খুশি কোষ নকল করতে পারে। কিন্তু ওই যে ছাড়াছাড়া তিনটে দাড়াওয়ালা নিউক্লিয়াসের যে কোষ, ওইগুলোই কনট্রোল করছে সবকিছু। নিয়ন্ত্রণের হুকুম যাচ্ছে ওই কোষগুলো থেকেই, কিভাবে তা বলতে পারব না। স্বরূপহীন টিসু যখন কুকুরের চেহারা নিচ্ছে—তখন কুকুরের শরীরের কোষ গড়ে নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মাঝে সাঝে কয়েকটা ওই কোষ থাকছে, যাদের নিউক্লিয়াসের দাড়ার সংখ্যা তিন। যে কোষের দেওয়াল বেজায় নরম—স্থিতিশীলতা একদম নেই বললে চলে।’

‘তা থেকে কী বোঝা গেল?’ এতক্ষণে একটা প্রশ্ন নিক্ষেপ করলেন উতঙ্ক চৌধুরী।

‘আদিম শত্রু যখন জিরোয়, তখন তার টিসুর মধ্যে নিজের কোনও কোষ থাকে না, আর যখন জাগে, তখন ছড়ানো ছিটোনো ত্রিদাড়া বিশিষ্ট কোষগুলো যেভাবেই হোক এনজাইম বানিয়ে নেয়… কেমিক্যাল সিগন্যাল পাঠায়… স্বরূপহীন টিসুকে নিয়ন্ত্রণ করে।

‘শয়তানের নিধনের পন্থা কি বের করা গেল?’ খোঁচা দাড়ি চুলকে বললেন উতঙ্ক চৌধুরী।

‘না,’ সাফ জবাব দিলেন অপরাজিতা সোম।

কাচের ডিশে দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে চেহারা পরিবর্তন।

‘ব্রেন আছে কি?’ মাধবীর প্রশ্ন, ‘ধীশক্তির একটা কেন্দ্র নিশ্চয় আছে ‘আদিম আতঙ্ক’ নামক এই মহাপ্রভুর।’

‘ধরেছেন ঠিক। আমাদের ব্রেনের মতন না হলেও ওই জাতীয় কিছু একটা রয়েছে নিশ্চয়। যে জিনিসটা কন্ট্রোল করছে বিক্ষিপ্ত কোষদের, কোষগুলো কন্ট্রোল করছে নিরাকার প্রোটোপ্লাজম।’

উত্তেজিত হয়ে যায় মাধবী, ‘তাই যদি হয়, তাহলে বিক্ষিপ্ত কোষদের সঙ্গে ব্রেনের কোষদের একটা জায়গায় মিল থাকবেই। চেহারা পালটাচ্ছে না কেউই।’

‘যুক্তির দিক থেকে হক কথা বলেছেন। যে-কোষ হরদম চেহারা পাল্টায়, সে কোষ স্মৃতি, ধীশক্তি, যুক্তিশক্তির ভাঁড়ার হয়ে থাকতে পারে না। সিদ্ধান্তটা দাঁড়াচ্ছে এই—এগুলো জমা আছে যেখানে সে জায়গাটা স্থায়ী কোষদের মজবুত গঠন।’

মোলায়েম গলায় বললে মাধবী, ‘ব্রেনে তাহলে আঘাত হানা যায়। ব্রেন যখন স্বরূপহীন টিসু দিয়ে তৈরি নয়, তখন তা জখম হলে নিজেই নিজেকে মেরামত করে নিতে পারবে না। স্থায়ীভাবে জখম হবে ব্রেন। জখম যদি ভালভাবে করা যায়—অনেকখানি জায়গা জুড়ে করা যায়, তাহলে শরীর গড়া হয়েছে যে স্বরূপহীন টিসু দিয়ে, তাদের কন্ট্রোল করতে পারবে না, তার মানে, মৃত্যু হবে শরীরের।’

বিস্ফারিত চোখে মাধবীর পানে চেয়ে রইলেন অপরাজিতা সোম, ‘ইউ আর রাইট।’

‘অত উল্লসিত হবার কারণ দেখছি না,’ বিরসবদনে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘আদিম আতঙ্ক নামক এই প্রাণী এত বোকা নয় যে, ব্রেনকে এমন জায়গায় রেখে দিয়েছে যেখানে পৌঁছে যাবে আমাদের গুলিগোলা। ব্রেন আছে আমাদের নাগালের বাইরে— খুবই সুরক্ষিত জায়গায়… পাতালের সুগভীর কোনও গুহায়।’

নিভে গেলেন অপরাজিতা সোম, মন দিলেন টিসু স্যাম্পেলের কেমিক্যাল আর মিনারেল বিশ্লেষণের ফলাফলের দিকে। বললেন, ‘বহু রকমের হাইড্রোকার্বন রয়েছে দেখছি। কয়েকটা রয়েছে কণা পরিমাণে। হাইড্রোকার্বন দিয়ে ঠাসা। এমন তো দেখা যায় না।’

‘কার্বন কিন্তু সজীব টিসুর মৌলিক উপাদান। সুতরাং তফাতটা কোথায়?’ মাধবীর প্রশ্ন।

‘পরিমাপে। স্বাতন্ত্র্য মাত্রায়, এত রকমের হাইড্রোকার্বন এত অধিক পরিমাণে থাকাটা খুবই অস্বাভাবিক।’

‘তাতে কি আমাদের লাভ হচ্ছে?’

‘বুঝতে পারছি না,’ চিন্তাক্লিষ্ট চোখে বিশ্লেষণের ফলাফলের দিকে চেয়ে রইলেন অপরাজিতা সোম।

কাচের ডিশে ঘন ঘন রূপ পরিবর্তন করছে জেলিপিণ্ড। ফড়িং। শুঁয়োপোকা। পিঁপড়ে। মাকড়সা… একদৃষ্টে দেখে যাচ্ছে পরী।

‘পেট্রোলেটাম,’ বললেন অপরাজিতা সোম।

‘সেটা কী?’ সুরেশ সাইকিয়া উদ্‌গ্রীব হলেন।

‘পেট্রোলেটাম জেলি।’

‘ভেসেলিনের মতন?’

উতঙ্ক চৌধুরীর প্রশ্ন, ‘স্বরূপহীন টিসু কি পেট্রোলেটাম?’

‘না, না, না,’ জোরে মাথা নাড়লেন অপরাজিতা সোম, ‘মোটেই তা নয়। এ জেলি তো সজীব টিসু। কিন্তু হাইড্রোকার্বনের অনুপাতে সাদৃশ্য রয়েছে। পেট্রোলেটামের গঠনের চেয়ে অনেক বেশি জটিল এই টিসুর গঠন। মানুষের শরীরে খনিজ দ্রব্য আর রাসায়নিক দ্রব্য যত আছে, তার চেয়ে ঢের বেশি রয়েছে এই টিসুর মধ্যে। অ্যাসিড আর অ্যালকালির পঙ্‌ক্তি লক্ষণীয়… এদেরকে পুষ্টির কাজে লাগায় কিভাবে, ভেবে পাচ্ছি না… শ্বাসপ্রশ্বাস চালায় কিভাবে… রক্তসংবহনতন্ত্র নেই—অথচ সজীব রয়েছে কী করে… স্নায়ুতন্ত্র তো চোখে পড়ছে না—অথচ স্নায়ুর কাজ দিব্যি চলছে… কোষের নির্দিষ্ট গঠন বা আকার নেই অথচ নতুন টিসু গড়ছে কী করে! সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অতিরিক্ত মাত্রার হাইড্রোকার্বন…’

শেষের দিকে কথা ক্ষীণ হয়ে এল অপরাজিতা সোমের, শূন্য হয়ে এল চাহনি। চেয়ে আছেন টেস্ট রেজাল্টের দিকে কিন্তু কিছুই আর দেখছেন না।

ঠিক এই সময়ে শোনা গেল পরীর উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, ‘আসুন, আসুন দেখবেন আসুন।’

কাচের ডিশের দিকে চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে পরী—এতক্ষণ জেলিদেহ দ্রুত রূপ পালটে যাচ্ছিল এই ডিশে। অকস্মাৎ থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে স্থির হয়ে গেল জেলি—সাদাটে তরল পদার্থ বেরিয়ে এল তার গা থেকে। এখন তা নিষ্প্রাণ। নড়ছে না। অন্য মূর্তি ধারণ করছে না।

চামচে দিয়ে খোঁচা মারলেন অপরাজিতা সোম। নিষ্প্রাণ জেলি-জলীয় নড়েচড়ে গেল না। চামচে দিয়ে ঘেঁটে দিলেন। আরও পাতলা হয়ে গেল টিসু—কিন্তু সাড়া দিল না, নরম গলায় বললেন উতঙ্ক চৌধুরী— ‘মৃত্যু’ এর নাম মৃত্যু।

যেন তড়িতাহত হলেন সুরেশ সাইকিয়া। তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন অপরাজিতা সোমকে, ‘ডিশে স্যাম্পেল রাখবার আগে কী রেখেছিলেন?’

‘কিচ্ছু না।’

‘নিশ্চয় কিছু ছিল। ভাবুন, ভাবুন। আমাদের জীবন নির্ভর করছে আপনার মনে করার ওপর।’

‘বলছি তো কিছু ছিল না।’

‘কোনও কেমিক্যালের তলানি?’

‘পরিষ্কার করা ডিশ। তলানি ছিল না।’

‘হতেই পারে না। এমন কিছু ছিল ডিশে যার ছোঁয়ায় ‘আদিম শত্রু’র দেহাংশ পঞ্চত্ব লাভ করেছে,’ সুরেশ উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছেন।

‘সেই জিনিসটাই আমাদের হাতিয়ার,’ নিষ্কম্প স্বরে বলে গেলেন বিশু বোস।

‘অত সোজা নয়,’ নিরুত্তাপ গলায় বললেন উতঙ্ক চৌধুরী, ‘আমরা সকলে দেখেছি—ইচ্ছে মতন স্বরূপহীন শরীরের খানিকটা আলাদা করে অন্য চেহারা ধারণ করার জন্যে পাঠিয়ে দিতে পারে ‘আদিম শত্রু’। মূল শরীর থেকে আলাদা হয়ে ওই টুকরো শরীর বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না। সুতরাং কেমিক্যাল অস্ত্র দিয়ে তার স্বরূপহীন শরীরের খানিকটা ধ্বংস যদি করি— ‘আদিম শত্রু’ নিমেষে জখম অংশ ফেলে দিয়ে বাঁচিয়ে নেবে নিজেকে।’

মাধবীর রোখ চেপে গেল, ‘এটাও তো ঠিক যে, ‘আদিম শত্রু’র অংশবিশেষ নিজেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না। বিশেষ কতগুলো কোষ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় এনজাইম সাপ্লাই পায় বলেই কাজ করতে পারে। ‘আদিম শত্রু’ তার পুরো অবয়বকে কব্জায় রেখেছে এই এনজাইম দিয়ে। কিন্তু তা কিভাবে?’

‘ব্রেনের সাহায্যে,’ আস্তে বললেন অপরাজিতা সোম। ‘মানুষের ব্রেন এনজাইম আর হরমোন তৈরির গ্রন্থিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে বলেই মানুষের শরীর চালু রয়েছে। ‘আদিম শত্রু’র ব্রেনও নিশ্চয় সেই একই কাজ করে চলেছে।’

সুরেশ সাইকিয়া বললেন, ‘বুঝলাম। কিন্তু এই আবিষ্কারটা আমাদের কী কাজে লাগবে জানতে পারি?’

জবাবটা দিল মাধবী, ‘ব্রেনকে ধ্বংস করতে পারলেই ‘আদিম শত্রু’ তার শরীরকে টুকরো টুকরো করেও আলাদা অংশগুলোকে টিকিয়ে রাখতে পারবে না।’

‘ব্রেনটা কোথায় সেটাই জানা নেই যখন, এ আবিষ্কার কোনও কাজেই লাগবে না,’ সুরেশ সাইকিয়া যেন হতাশ হলেন।

‘অত হতাশ হবেন না,’ মুখে হাসি টেনে এনে বললেন অপরাজিতা সোম, ‘ডিশের জেলির মৃত্যু থেকে একটা তথ্য তো জানা গেল।’

‘কী তথ্য?’

‘একটা রাসায়নিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারলেই স্বরূপহীন শরীর বেঁচে থাকে—নইলে মরে।’

সুরাহার ক্ষীণ একটা আশা অপরাজিতা সোমের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু তা নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলা মানেই ‘আদিম শত্রু’র গোচরে এনে ফেলা। সে ঠিক জানবেই। তার চাইতে সমাধানসূত্র থাকুক মগজের মধ্যে।

তাঁকে এখনই একটা জরুরি ফোন করতে বেরুতে হবে।