» » আদিম আতঙ্ক

বর্ণাকার

অদ্রীশ বর্ধন

আদিম আতঙ্ক

এক

চিৎকারটা ভেসে এল অনেক দূর থেকে।

ভয়ের চিৎকার। নিঃসীম আতঙ্ক ঠিকরে এল গলা চিরে। কিন্তু ওই একবারই। আর না। একবার চেঁচিয়েই বুঝি দম ফুরিয়ে গেল মেয়েটার। অথবা থেমে গেল কলজে।

ম্যাগাজিনের পাতা থেকে চোখ সরে এসেছিল সুমন্তর। সুমন্ত সেন। হাজত দারোগা। ছোট মাপের অফিসার। বয়েসেও ছোট। মাত্র আটাশ বছর। মনটা তাই এখনও গল্পের জগতে ভেসে যেতে ভালবাসে।

পড়ছিল একটা গা-ছমছমে গল্প। উদ্ভট। অবৈজ্ঞানিক। হোক। গায়ের লোম তো খাড়া হচ্ছিল।

ঠিক ওই সময়ে সৃষ্টিছাড়া ওই চিৎকার। নৈঃশব্দ্য খানখান করা। খুব অল্পক্ষণের জন্য।

ঘাড় কাৎ করে চোখ কুঁচকে রইল সুমন্ত। কিন্তু আর সে চেঁচাচ্ছে না। কণ্ঠে বুঝি কুলুপ পড়ে গেল নিমেষে।

চেয়ারে নড়ে উঠল সুমন্ত। সঙ্গে সঙ্গে কর্কশ আর্তনাদ করে উঠল চেয়ার। ভাঙা চেয়ারের চিৎকার।

খোলা জানলা দিয়ে বিকেলের রোদ এসে পড়েছে কাঠের টেবিলে। পালিশ-চটা খুবলে খুবলে যাওয়া সস্তা কাঠের টেবিল। থানার টেবিল এর চাইতে ভাল হয় না।

জানলা দিয়ে রাস্তার খানিকটা দেখা যাচ্ছে। এ তল্লাটের সব চাইতে চওড়া রাস্তা এটা। মূল সড়কও বটে। নাম, শিবালয় এভিন্যু।

রাস্তা এখন ফাঁকা। দু’পাশের গাছগুলোর পাতা নড়ছে হাওয়ায়। গোটা শহরে নিবিড় শান্তি ছড়িয়ে রয়েছে।

বেখাপ্পা ওই চিৎকারটা। ছন্দপতন ঘটিয়েছিল মুহূর্তের জন্যে।

এই সময়টা এইভাবেই ঝিমিয়ে থাকে টাউন। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর ফাঁকা যায়। পর্যটনবিলাসীরা তখন এদিকে আসে না। হাজত আর থানার কাজও কম। বসে বসে হাতে-পায়ে মর্চে ধরে যায়।

কাজ শুরু হবে অক্টোবর থেকে। দলে দলে পর্যটকরা আসবে পাহাড়ঘেরা নিরালা এই তল্লাটে।

অলস চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে সুমন্ত। নির্জন পথে গাড়ি নেই, মানুষ নেই, কুকুর পর্যন্ত নেই। একটামাত্র হোটেল খুলে রেখেছে বটে—অফ-সিজন বলে সেখানে তেমন লোকও নেই। দুটো মোটেলও খুলে রেখেছে—গাড়ি নেই সেখানেও।

পুরো টাউন এখন পাণ্ডব-বর্জিত। তা সত্ত্বেও কে অমন চেঁচাল?

জানলা থেকে চোখ সরিয়ে আনে সুমন্ত। চোখ ঘুরছে পত্রিকার পাতায়। এমন সময়ে আবার শোনা গেল একটা চিৎকার।

এবার বিষম আতঙ্ক বুঝি মূর্ত হয়ে উঠল কলজে-ছেঁড়া সেই চেঁচানির মধ্যে। আগের চিৎকারের চাইতেও লোমহর্ষক। আরও বিকট।

কিন্তু এ-চিৎকার তো নারী-কণ্ঠ ফুঁড়ে ঠিকরে এল না। এ যে পুরুষ-কণ্ঠ!

বহুদূর থেকে উত্থিত হয়েই নিমেষে স্তব্ধ হয়ে গেল বটে ঠিক আগের মতনই—কিন্তু ভয়ালতা অনুরণন জাগিয়ে চলল সুমন্তর কর্ণেন্দ্রিয় দিয়ে মস্তিষ্কের অণু পরমাণুতে…

পত্রিকা মুড়ে রাখল সুমন্ত। উৎকর্ণ হয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ—আবার যদি শোনা যায় বিশ্রী বিকট চিৎকার দুটোর যে কোনও একটা। কিন্তু টুঁটি-টেপা নৈঃশব্দ্য ফের চেপে বসেছে গোটা টাউনে।

একে তো হিমালয়ের কোল বলে এখানকার সবকিছুই বড় শব্দহীন। তার পর অফ-সিজন। অথচ দু’দুটো মানুষ একটু আগেই গলাবাজি করে গেল। দুজনেই ভয় পেয়েছে। তাই অমন অমানুষিক চেঁচিয়েছে। দুজনেই অকস্মাৎ নীরব হয়ে গেছে।

সুমন্ত সেন আর বসে থাকতে পারল না। পত্রিকা উলটে রাখল টেবিলে, চাপা দিল পেপারওয়েট দিয়ে। ফিরে এসে পড়বে। এখন একটু টহল দিয়ে আসা যাক।

উঠল চেয়ার ছেড়ে। আবার সেই কর্কশ চিৎকার। চেয়ারের চিৎকার।

রিভলভারটা সঙ্গে নেওয়া দরকার। যারা অমন বিকট চেঁচিয়েই গলায় কুলুপ লাগায়—নিশ্চয় তারা বিপদে পড়েছে। সব বিপদেরই মোকাবিলা করা যায় গুলিভরা রিভলভার হাতে থাকলে…

হোলস্টারশুদ্ধ বেল্ট আলমারি থেকে টেনে নামিয়ে কোমরে বেঁধে নিল সুমন্ত। এই বেল্টেই ঝোলে ছোট ছুরি। দু’মুখ ধারালো। এক হাতে ছুরি আর এক হাতে রিভলভার নিয়ে সুমন্ত একাই দশ-বিশ জনকে সামাল দিতে পারে।

চামড়ার বুট এবার তার নিজস্ব আওয়াজ তোলে মেঝের ওপর। সুমন্ত আকারে নাতিদীর্ঘ হতে পারে—কিন্তু ওর চলার মধ্যে ঠিকরে বেরোয় ব্যক্তিত্ব। বুটের এই খট খট আওয়াজ শুনলেই হৃৎকম্প হতে থাকে ক্রাইম-লিপ্ত মহাপুরুষদের। সেই সঙ্গে ওর রুদ্র চোখের চাহনি আর কাঠচেরা কণ্ঠের হুঙ্কার…

সব মিলিয়ে, অপরাধীদের কাছে সুমন্ত সেন একটা ত্রাস… একটা জীবন্ত বিভীষিকা। একাই পাকড়ায় দুষ্কৃতীদের — টেনে এনে ঢোকায় লক-আপে…

পাশাপাশি তিনটে খাঁচা। তিনটেই খালি। ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে খাঁচা তিনটের দিকে রুদ্রচক্ষু বুলিয়ে নেয় সুমন্ত। একটু পরেই নিশ্চয় খাঁচাদের খিদে মেটাতে পারবে। ওদের শূন্য উদর পূর্ণ করে দেবে।

খাঁচাঘরের পরেই বড় দরজা। এই দরজার পরে ভিজিটরদের ঘর। এ-ঘরে বড় বড় বেঞ্চি পাতা।

খট খট খট খট শব্দের পাদুকা-বাদ্য বাজিয়ে এই দরজার দিকে অগ্রসর হয় সুমন্ত। চৌকাঠ এখনও পাঁচ ফুট দূরে। খাঁচাগুলো বুঝি তৃষিত নয়নে পাশ থেকে দেখছে ওকে। এমন সময়ে অস্ফুট একটা শব্দ শোনা গেল পেছনে।

নিমেষ মধ্যে টানটান হয়ে গেল সুমন্ত সেনের সর্বাঙ্গ। কেননা, আওয়াজটা এল পেছনের যে-ঘর থেকে, সে-ঘরে তো এই মুহূর্তে কেউ নেই! একা বসেছিল সুমন্ত। সে ঘরে জানলা একটাই—গরাদ দেওয়া। দরজাও একটা—তাতে তালা ঝুলছে। ও ঘরে ঢুকতে হলে যেতে হয় এই খাঁচাঘরের মধ্যে দিয়ে।

কিন্তু কেউ ওর পাশ দিয়ে যায়নি— ঢোকেনি অফিসঘরে। কেউ ছিলও না সে ঘরে। অথচ, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে না আসতেই এ কিসের আওয়াজ?

ক্ষীণ হলেও কান এড়ায়নি সুমন্তর। জুতোর খটখটানিতেও চাপা পড়েনি। হাওয়ায় ম্যাগাজিনের পাতা উলটে যাওয়ার আওয়াজও নয়—ম্যাগাজিন তো ও উলটে রেখে এসেছে—ওপরে চাপা দেওয়া আছে ভারী পেপারওয়েট…

এতগুলো চিন্তা একযোগে খেলে গেল সুমন্তুর সজাগ ব্রেনের মধ্যে দিয়ে। কোমরে রিভলভার ঝোলালেই পালটে যায় ওর চেহারা—ব্যক্তিত্ব শত-মুখ ছুরির মতন ফলা উঁচিয়ে ধরে।

তাই সজাগ হয়ে গিয়ে মুহূর্তের জন্যে নিথর দেহে দাঁড়িয়ে রইল সুমন্ত। পেছনের আওয়াজের দিকে ফিরে তাকানোর আগে সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করল হাতে-পায়ে-চোখে। ঘুরে দাঁড়াল পরক্ষণেই…

বিস্ফারিত হল দুই চক্ষু! আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল দুই চোখের রুদ্র কটাক্ষে… শূন্য কক্ষ আর শূন্য নয়, এবং…!