☼ অদ্রীশ বর্ধন ☼
আদিম আতঙ্ক
আঠার
উতঙ্ক চৌধুরীর টেলিফোন এল টিকেন্দ্ৰনগর থেকে। কলকাতার এয়ারপোর্টে রিপোর্টাররা তাঁকে ছাড়েনি। জোঁকের মতন জেঁকে বসেছিল। নিরুপায় হয়ে উতঙ্ক চৌধুরী তাঁদের জানিয়েছিলেন রোয়ানোক আইল্যাণ্ডের কাহিনী, মায়া সভ্যতার অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কথা, সামুদ্রিক প্রাণীদের রহস্যজনক অন্তর্ধান উপাখ্যান, ১৭১১ সালে গোটা একটা সৈন্যবাহিনীর তিরোধান প্রহেলিকা। শুনে রোমঞ্চিত হয়েছে প্রতিটি সাংবাদিক। তাই দেখে উৎসাহিত হয়ে আরও কাহিনী শুনিয়েছেন উতঙ্ক চৌধুরী। এস্কিমোদের গ্রাম আঞ্জিকুনিতে ১৯৩০ সালের নভেম্বর মাসে পা দিয়ে হতভম্ব হয়ে গেছিলেন এক ফরাসী পণ্যব্যাবসায়ী। গ্রাম খাঁ-খাঁ করছে। জীবন্ত প্রাণী কেউ নেই, না মানুষ, না কুকুর। আধ-খাওয়া খাবার ফেলেও পালিয়েছে প্রত্যেকেই। কিন্তু পালাতে গেলে তো স্লেজগাড়ি চড়ে যাবে। গাড়িগুলো রয়েছে যথাস্থানে, নেই শুধু কুকুরগুলো যারা টেনে নিয়ে যায় স্লেজগাড়ি। তার মানে একটাই, আচমকা যেন বাতাসে গলে মিলিয়ে গেছে সমস্ত পশু আর মানুষ। কবরখানার দম আটকানো নীরবতা বুকে নিয়ে বিরাজ করছে শূন্য গ্রাম।
রিপোর্টারদের অবহিত করার জন্যেই সবশেষে নিজের তত্ত্ব হাজির করেছিলেন উতঙ্ক চৌধুরী। রহস্যাবৃত এই সব ঘটনার মূলে রয়েছে আদিম শত্রু।
টেলিফোনে সুরেশ সাইকিয়া প্রথমেই বললেন, ‘আপনার ‘আদিম শত্রু’কে মনে হয় দেখলাম। অতিকায় অ্যামিবা বললেই চলে। যখন তখন চেহারা পালটাতে পারে, যে কোনও আকার ধারণ করতে পারে। কী, ঠিক বলেছি? এই কি আপনার ‘আদিম শত্রু’?’
‘হ্যাঁ। অতীতের কোন এক যুগের বাসিন্দা কোনমতে টিকে গেছে। লক্ষ কোটি বছর বয়স।’
টম ডিক্সন আর রমেশ থাপার বীভৎস মৃত্যুকাহিনীর বর্ণনা দিয়ে গেলেন সুরেশ সাইকিয়া। মৃত রমেশ থাপার ফিরে আসার কথাও বললেন। সবশেষে বললেন, ‘এরপরও কি আসতে চান?’
হতভম্ব কণ্ঠে বললেন উতঙ্ক চৌধুরী, ‘এত দেখেও বেঁচে আছেন?’
‘বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে আপনাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এখানে এনে ফেলতে পারি।’
‘আপনার কথার মানে বুঝতে পারছি না। আমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওখানে নিয়ে ফেলতে চায় ‘আদিম শত্রু’?’
‘হ্যাঁ। নির্বিঘ্নে বেরিয়ে যেতে পারবেন শহর থেকে—এই অভয় আপনাকে দিয়েছে আপনার ‘আদিম শত্রু’।’
‘গ্যারান্টি?’
‘হ্যাঁ,’ বলে সুরেশ সাইকিয়া শোনালেন সেই অতীব বিস্ময়কর কাহিনী—কমপিউটারের মাধ্যমে আদিম শত্রুর সঙ্গে কথোপকথন।
শুনতে শুনতে ঘেমে গেলেন উতঙ্ক চৌধুরী। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল আর মুখ মুছলেন। তোতলাতে তোতলাতে বললেন, ‘ক-কখনও ভাবিনি—’ আর বলতে পারলেন না।
‘কী ভাবেননি?’
‘আদিম শত্রু যে কোনও মানুষের বুদ্ধির স্তরে পৌঁছোতে পারে কখনও ভাবিনি।’
‘অতি-মানুষের বুদ্ধির স্তরে পৌঁছে গেছে।’
‘আমি ভেবেছিলাম বোবা জন্তু, শুধু নিজেকে নিয়েই সজাগ।’
‘একদম না।’
‘তাই যদি হয়, বিপদ আরও বাড়ল।’
‘আসবেন কি?’
‘মুশকিলে ফেললেন।’
‘আসবেন কি না বলুন।’
‘সত্যিই যদি ইনটেলিজেন্ট হয় আদিম শত্রু, আমার ফিরে আসার গ্যারান্টি দেয়…’
টেলিফোনে শোনা গেল একটা শিশুকণ্ঠ, ‘আসুন না কাকু, কত খেলব দু’জনে।’
উতঙ্ক চৌধুরী জবাব দেওয়ার আগেই ধ্বনিত হল এক নারীকণ্ঠ, ‘ভয় নেই, ভয় নেই… চলে আসুন। যথাসময়ে ঠিক বের করে দেব শহর থেকে।’
পরমুহূর্তেই ধীর স্থির গম্ভীর কণ্ঠে বলে গেল এক বয়স্ক পুরুষ, ‘ডক্টর চৌধুরী, অনেক খবর পাবেন আমার সম্বন্ধে। অনেক জ্ঞান, অনেক তথ্য। আসুন, দেখুন, জ্ঞানের ভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন। নিরাপত্তার গ্যারান্টি মিথ্যে নয়, সশরীরে বেরিয়ে যাবেন শহর থেকে।’
আর কোনও শব্দ নেই টেলিফোনে। ঘাবড়ে গিয়ে বললেন উতঙ্ক চৌধুরী, ‘হ্যালো… হ্যালো… এটা কি ইয়ার্কির সময়?’
ভেসে এল সুরেশ সাইকিয়ার কণ্ঠস্বর, ‘না, ইয়ার্কি নয়। আপনি যা শুনলেন, আমিও তা শুনেছি। কথা আমি বলিনি, বলেছে আপনার আদিম শত্রু, যাদের গ্রাস করেছে, তাদের গলা নকল করে।’
দরদর করে ঘামছেন উতঙ্ক চৌধুরী। মানুষের গলায় কথা বলে গেল অ্যামিবা?
রুমাল দিয়ে ফের মুখ মুছলেন। বললেন কাঁপা গলায়, ‘আমি যাব।’
‘প্রাণ নিয়ে ফিরে যাবেন, সে গ্যারান্টি সত্যি নাও হতে পারে।’
‘ইনটেলিজেন্ট প্রাণী যদি হয়—’
‘ইনটেলিজেন্স অবশ্যই আছে, সেইসঙ্গে আছে অশুভ ইচ্ছে। শুভ বলতে যা বোঝায় এর মধ্যে তা নেই।’
সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এল সেই শিশুকণ্ঠ, ‘আসুন কাকু, আসুন। কোন ভয় নেই। যদি আসেন, তাহলে শুধু আপনি নন—এই ছ’জনও প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। আর যদি না আসেন, এদেরকে পিষে মারব, তারপর কাজে লাগাব—আমার কাজে।’
খুব মিষ্টি গলায় কথাগুলো বলা হলেও যে নিষ্ঠুর নির্মমতা ছিটকে ছিটকে গেল প্রতিটি শব্দ থেকে, তা আর এক দফা ঘামিয়ে দিল ডক্টর চৌধুরীকে। এবার শুধু ঘাম নয়, ধড়াশ ধড়াশ করছে হৃদ্যন্ত্র। কথা বললেন কিন্তু থেমে থেমে, ‘আমি আসছি।’
বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘আমাদের জন্যে আসবেন না। আপনাকে ছেড়ে দেবার কারণ আছে। আপনি ওর জীবনী লিখবেন, গোটা পৃথিবীকে জানাবেন। তাই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। আমাদের প্রাণের কোনও দাম এর কাছে নেই।’
গোঁয়ারের মতো উতঙ্ক চৌধুরী বললেন, ‘আমি যাচ্ছি।’
‘ড্রাইভিং জানেন?’
‘জানি।’
‘শিবালয়ের বর্ডারে আপনাকে ছেড়ে দেবে একটা গাড়ি। আমাদের অন্য গাড়ি ওখানেই আছে। আপনি নিজে চালিয়ে আসবেন। রাজি?’
‘রাজি।’