☼ অদ্রীশ বর্ধন ☼
আদিম আতঙ্ক
সতর
থমথমে মুখে ওরা ফিরে এসেছিল হোটেলে আর এক দফা শিহরিত হবার জন্যে। হোটেলে সান্ত্রীদের কেউ নেই। জিনিসপত্র অস্ত্রশস্ত্র যেখানে থাকার সেখানেই আছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে দশজন মানুষ!
হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছ’জন। এসেছিল অনেকজন, বেঁচে রয়েছে শুধু এই ছ’জন।
‘আহার্য নিবাস’এর পাশের গলিতে গতরাতে সঞ্চরমান তমালপুঞ্জ দেখেছিল মাধবী। মনে হয়েছিল মাথার ওপর মাচায় কী যেন নড়ছে। পরীর মনে হয়েছিল, দেওয়ালে গুঁড়ি মেরে কী যেন বসে রয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, দু’জনেই ঠিক দেখেছে। মুহুর্মুহু দেহ পালটায় যে, সে নিশ্চয় ওঁত পেতে ছিল সুড়ঙ্গের অন্ধকারে, ড্রেনের ভেতরে। নিঃশব্দে পিছলে যাচ্ছিল মাচার ওপর দিয়ে, দেওয়ালের কোণ ঘেঁষে। সুরেশ সাইকিয়াও পরে দেখেছিলেন, কী যেন চকচক করছে ড্রেনের মধ্যে। নিশ্চয় দেখেছিলেন তাল তাল প্রোটোপ্লাজম—ওঁত পেতে ছিল ড্রেনের ফোকরে, নজর রাখছিল ঘরের সবার ওপরে।
প্রথম মুখ খুলল মাধবী। বললে, ‘বন্ধ ঘরের রহস্য আর রহস্য নেই। দরজার তলার ফাঁক দিয়ে অথবা পাইপের মধ্যে দিয়ে পথ করে নিতে পারে কুৎসিত এই বহুরূপী জেলি।’
বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘কাচতোলা বন্ধ-দরজা গাড়িগুলোর ভেতরের রহস্যের সমাধান হয়ে গেল। গোটা গাড়িগুলোই হয়তো চারিদিক থেকে আঁকড়ে ধরেছিল, ফুটোফাটা দিয়ে ঢুকে পড়েছে ভেতরে।’
বাইরে কুয়াশা জমছে রাস্তার ওপর। স্ট্রিটল্যাম্পের আলোক-বলয় ঘিরে গড়ে উঠছে অস্বচ্ছ কুয়াশাপুঞ্জ।
সুরেশ সাইকিয়া বললেন, ‘পাঁচটা টহলদার গাড়ি যখন রয়েছে, পাঁচ দিক দিয়ে বেরিয়ে যাব শহর থেকে।’
‘মাঝপথেই আটকে দেবে,’ মাধবীর মন্তব্য।
‘সব শুনছে কিন্তু আড়াল থেকে,’ পরীর চোখ ঘুরছে চারদিকে, ভয় ভাসছ চোখে। বারান্দা থেকে সরে এসে এখন বসে আছে ওরা ডাইনিংরুমে টেবিল ঘিরে। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে প্রত্যেকে প্রত্যেকের মনের কথা বোঝার চেষ্টা করছে।
শুরু করলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘আশ্চর্য ক্ষমতা বটে। ইচ্ছে করলে পেল্লায় মথও হতে পারে।’
‘কুকুর হতেও আপত্তি নেই,’ পরীর মন্তব্য।
‘যা খুশি, তাই হতে পারে। আমার তো মনে হয়, যাকে গ্রাস করছে, তার চেহারা নিচ্ছে,’ মাধবী বুঝিয়ে দিলে।
‘অতবড় মথ কি পৃথিবীতে আছে?’ বললেন সুরেশ সাইকিয়া।
‘হয়তো ডাইনোসর আমলে ছিল।’
অবুঝের মতন বলে ওঠে পরী, ‘কী যে বলো। ম্যানহোল থেকে যার আবির্ভাব সে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে রয়েছে ম্যানহোলের নিচে পাতালে?’
‘জীববিজ্ঞানের হিসেবে সেটা সম্ভব নয়,’ বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘ডক্টর সোম, আপনি কী বলেন?’
‘না, বায়োলজি তা মানতে পারে না,’ অপরাজিতা সোম বিলক্ষণ ধোঁকায় পড়েছেন।
‘তাহলে কি সর্বভুক সর্বজ্ঞ সর্বরূপী এই জেলি অমর?’
চোখ নামিয়ে ভেবে নিলেন অপরাজিতা সোম। তারপর বললেন চোখ তুলে, ‘হতে পারে মেসোজোয়িক পিরিয়ডেও ছিল, ক্রমাগত নিজেকে পালটে নিয়ে প্রকৃতপক্ষে অমর হয়ে রয়েছে।’
বলে উঠলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘ভ্যামপায়ার নাকি?’
‘মানে?’ চমকে উঠলেন অপরাজিতা সোম।
‘প্রাণশক্তি শুষে নিয়ে অমর হয়ে থাকে ভ্যামপায়ার, বই পড়ে জেনেছি। এটাও কি সেই জাতীয় কিছু? যাকে গ্রাস করছে, তার প্রাণশক্তি, তার মেদ-মজ্জা-মাংস, তার জ্ঞান, তার স্মৃতি—সবই আত্মসাৎ করে অমর হয়ে রয়েছে?
থমকে গেলেন অপরাজিতা, ‘মনে তো হচ্ছে তাই। একটা এক্সপেরিমেন্টের কথা বলি শুনুন। বিশেষ একটা পোকাকে একটা গোলকধাঁধায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। গোলকধাঁধায় ঘুরে খাবারের জায়গায় পৌঁছোতে তার সময় লেগেছিল অনেক। তাকে মেরে, চটকে খাবারের সঙ্গে খাইয়ে দেওয়া হয়েছিল আর একটা পোকাকে। সেই পোকাকে ছেড়ে দেওয়া হয় একই গোলকধাঁধায়। অনেক সহজে, অনেক কম সময়ে খাবারের কাছে পৌঁছে গেছিল সেই পোকা। ঠিক যেন আগের পোকার অভিজ্ঞতা আর স্মৃতি তার মনের ভাঁড়ারে জমা পড়ে গিয়েছে—’
ঢোক গিলে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘তাহলে তো বলতে হয়, বিনয় চৌধুরীকে নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে ভদ্রলোকের মগজের জ্ঞান আর স্মৃতিও আত্মসাৎ করেছে এই বিভীষিকা। বিনয় চোধুরী জানতেন উতঙ্ক চৌধুরীর নাম। আরও জানতেন একমাত্র উতঙ্ক চৌধুরীই জানেন, এই পাতাল-বিভীষিকা আসলে কী। ফলে, পাতাল-বিভীষিকাও জেনে গেছে উতঙ্ক চৌধুরীর নাম—খুঁজছে তাঁকে।’
‘বুঝলাম,’ শক্ত গলায় বললে মাধবী, ‘কিন্তু উতঙ্ক চৌধুরী জানলেন কী করে, পাতাল-বিভীষিকা আসলে কী?’
‘জবাবটা শুধু উতঙ্ক চৌধুরীই দিতে পারবেন।’
‘পরীকে হাতে পেয়েও ছেড়ে দিল কেন? আমরাই বা এখনও টিকে আছি কেন?’
‘টোপ, টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে আমাদের।’
‘কাজ শেষ হলেই—’
‘আমরাও শেষ হব।’
ধুম করে বিচ্ছিরি শব্দ শোনা গেল বাইরে। তেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সুরেশ সাইকিয়া। আবার হল সেই শব্দ। আরও জোরে।
কান পেতে রইলেন সুরেশ সাইকিয়া। আওয়াজটা আসছে বাড়ির উত্তরের দেওয়াল থেকে মাটির লেভেলে শুরু হয়ে দ্রুত উঠে যাচ্ছে ওপরের দিকে।
কড়মড়-খটমট-খটখটাং শব্দ। যেন শুকনো নরকঙ্কালরা দল বেঁধে দেওয়াল বেয়ে উঠছে।
‘নতুন রূপ ধারণ করেছে পাতাল বিভীষিকা,’ বললেন সুরেশ সাইকিয়া।
ছ’জনে এগিয়ে গেল জানলার সামনে। কুয়াশা আরও ঘন হয়েছে।
হঠাৎ দেখা গেল রাস্তার ওপর এক আশ্চর্য আকৃতি। মাকড়সার জালের মতন তন্তুময় পা। কুয়াশায় দৃষ্টিভ্রম ঘটছে—অর্ধেক দেখা যাচ্ছে, বাকি অর্ধেক রহস্যময়। মস্ত গাড়ির মতন কিছু একটা হবে। খাঁজকাটা দাড়া—কাঁকড়ার দাড়ার মতন, কিন্তু আকারে দানবিক। অন্ধকারে মিলিয়ে গেল পরমুহূর্তেই। তারপরই দেখা গেল লিকলিকে শুঁড়, অ্যান্টেনার মতন দুলছে শূন্যে অনেকগুলো। পরক্ষণেই সবই হারিয়ে গেল অন্ধকারে।
শুষ্ক কণ্ঠে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘এদেরই একজন উঠছে ছাদে।’
খটখট-কড়কড় আওয়াজ হচ্ছে এখন ছাদে। যেন হাতুড়ি পেটা হচ্ছে মাঝে মাঝে।
বলে উঠল পরী, ‘বিচ্ছিরি বিকট চেহারা ধারণ করছে কেন, দিদি?’
‘ভয় দেখানোর জন্যে।’
থেমে গেল ছাদের আওয়াজ। ঢোক গিলে বললেন অপরাজিতা সোম, ‘সারা গায়ে কালসিটের কারণটা এবার বোঝা গেল। পুরো দেহ মুড়ে নিয়ে চাপ দিয়ে গেছে, নিংড়ে নিয়েছে। প্রচণ্ড চাপ সমানভাবে পড়েছে, তাই অমন কালসিটে। দম আটকে গেছে এই কারণেই।’
‘প্রিজারভেটিভ প্রয়োগ করেছে একই সঙ্গে,’ বললে মাধবী।
‘সেইজন্যেই ইঞ্জেকশন দেওয়ার দাগ কোত্থাও দেখা যায়নি। গোটা শরীরের প্রতি বর্গইঞ্চিতে প্রতিটি লোমকূপের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রিজারভেটিভ। বলতে পারেন, এক ধরনের অসমোটিক প্রেসার—অভিস্রবণ চাপ।’
বাসন্তীর ডেডবডির কথা মনে পড়ে গেল মাধবীর। শিউরে ওঠে সর্বাঙ্গ। অভিস্রবণ শক্তি কতখানি জোরদার হলে নিমেষে এমন কাণ্ড ঘটতে পারে?
‘জলটা কিসের?’ মাধবীকে চমকে দিয়ে বলে উঠল পরী।
‘জল?’
থই থই জল দেখা গেছে অনেক জায়গায়। সর্বরূপী আতঙ্ক নিংড়ে ফেলে রেখেছে ওই জল।’
‘এমন ভাবনা মাথায় আসছে কেন?’
বিজ্ঞের গলায় বললে পরী, ‘মানুষের শরীরে জলই তো বেশি। মানুষগুলোকে নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে তাদের মেদ-মজ্জা-মাংস ক্যালরি দিয়ে নিজেকে আরও শক্তিমান করে তুলেছে। যেটা তার কাছে ছিবড়ে, সেটা ফেলে দিয়েছে। জল—জলই তার কাছে ছিবড়ে। এই জন্যে হাড় পাইনি, শরীরের চুল পর্যন্ত পাইনি, রয়েছে শুধু জল। বেশি জল যেখানে বেরিয়েছে সেখানে উবে যেতে সময় লেগেছে বলেই আমাদের চোখে পড়েছে। অল্প জল উবে গেছে।’