☼ অদ্রীশ বর্ধন ☼
আদিম আতঙ্ক
ষোল
দ্রুত ছায়া ঘনিয়ে আসছে। কোণে কোণে জমছে আঁধার। আকাশে কার্নিভালের রং লেগেছে—কমলা, লাল, হলুদ, বেগুনি। অথচ শিবালয় শহরে নামছে সামান্য আলো।
মোবাইল ল্যাবরেটরি পেছনে রেখে এগিয়ে গেল সবাই হোটেলের দিকে। মোড়ের মাথায় জ্বলে উঠল স্ট্রিটল্যাম্প।
গোঙানির আওয়াজটা শোনা গেল ঠিক এই সময়ে।
ওদিকের ফুটপাথে লেংচে লেংচে যাচ্ছে একটা মস্ত অ্যালসেশিয়ান কুকুর। বড় কষ্টে পেছনের জখম একটা পা ঘষটে ঘষটে নিয়ে যাচ্ছে ফুটপাতের ওপর দিয়ে।
স্তম্ভিত চোখে চেয়ে রইলেন সুরেশ সাইকিয়া। মাধবীও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কেননা, শিবালয় শহরে এই প্রথম দেখা গেল জীবন্ত প্রাণী।
টম ডিক্সন একদৃষ্টে চেয়েছিল কুকুরটার দিকে। সুরেশ সাইকিয়ার এই সঙ্গীটি আকার-আয়তনে দৈত্য সমান হলে কী হবে, স্বভাবে শিশুর মতন। গুলি চালায় নির্ভুল নিশানায় অথচ নিতান্ত নিরুপায় না হলে ট্রিগারে আঙুল চেপে বসে না। মায়া-দয়ার শরীর, মানুষ মারা তো দূরের কথা, মানুষ আর মনুষ্যেতর প্রাণীর তিলমাত্র কষ্ট দেখলেই তার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। অথচ সে পুলিশ সার্জেন্ট।
কুকুরের কাতরানি বিলক্ষণ বিচলিত করেছে তাকে। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তা পেরিয়ে যন্ত্রণাকাতর প্রাণীটির দিকে।
ধমকে উঠলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘যেও না।’
টম ডিক্সন যেন মন্ত্রমুগ্ধ। শুনতেই পেল না।
বামাকণ্ঠের চিৎকারটা শোনা গেল তারপরেই। চেঁচাচ্ছে মাধবী। সন্দেহটা তার মনের মধ্যেও ফণা তুলেছে, ‘ডোন্ট গো।’
রাস্তা পেরিয়ে ওদিকের ফুটপাতে পৌঁছে গেল টম ডিক্সন। হেঁট হয়ে সস্নেহে আহত সারমেয়কে তুলে নিল বুকে।
অবিশ্বাস্য ঘটনাটা ঘটল পরক্ষণেই। জিব বের করে টম ডিক্সনের হাত চাটতে লাগল অ্যালসেসিয়ান।
গা শিরশির করে উঠেছিল টম ডিক্সনের। জীবন্ত প্রাণী যে এত কনকনে ঠাণ্ডা হয়, তা তো তার জানা ছিল না। বিশেষ করে কুকুর। গা তো গরম নয়, উলটে কেমন যেন ভিজে ভিজে।
জিব যেন আরও ঠাণ্ডা, ঠিক যেন বরফ দিয়ে তৈরি।
পরিবর্তনটা দেখা গেল সঙ্গে সঙ্গে।
গলে যেতে লাগল অ্যালসেসিয়ান। লোম অন্তর্হিত হল, চামড়া থসথসে হয়ে গেল। একদলা অবয়বহীন জেলির পিণ্ড বুকের কাছে ধরে রইল টম ডিক্সন।
নিদারুণ আতঙ্কে টম ডিক্সনের চক্ষুও বিস্ফারিত হয়েছে। সেই সঙ্গে অবর্ণণীয় যন্ত্রণাবোধ গোটা শরীরকে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে চাইছে। ওর দুটো হাতই ঢুকে গেছে জেলির পিণ্ডর মধ্যে। বিষম যন্ত্রণার উৎস ওই দুটো হাত। যেন মাংস গলে যাচ্ছে কড়া অ্যাসিডে…
ঝটকান মেরে দুটো হাতই টেনে বের করে আনল টম ডিক্সন।
শুধু হাড় রয়েছে। আঙুলের ডগা থেকে কনুই পর্যন্ত শুধু সাদা হাড়। মাংস, চামড়া, টিসু সব অদৃশ্য হয়ে গেছে জেলিপিণ্ডর মধ্যে।
পরিত্রাহি আর্তনাদ বিরামবিহীনভাবে বেরিয়ে আসছে টম ডিক্সনের গলা চিরে। কেননা, জেলিপিণ্ডকে সে ধরে নেই দু’হাতে—জেলিপিণ্ড কিন্তু আঁকড়ে আছে তার বক্ষদেশ। সেখানেও শুরু হয়েছে অকথ্য যন্ত্রণা। চামড়া মাংস বিলীন হয়ে যাচ্ছে জেলিপিণ্ডর গর্ভে। কদাকার পিণ্ড ফুলে উঠছে, গুটি গুটি এগোচ্ছে টম ডিক্সনের গলা আর কাঁধের দিকে। গগনভেদী চিৎকার করে যাচ্ছে বেচারী। মরিয়া হয়ে কঙ্কাল হাত দিয়ে জেলিপিণ্ড আঁকড়ে ধরে ছিনিয়ে নিতে গেল বুকের ওপর থেকে।
কনুই পর্যন্ত হাত অদৃশ্য হয়ে গেল জীবন্ত জেলিপিণ্ডর মধ্যে। চকিতে হাড় পর্যন্ত হজম করে নিল অপার্থিব ভয়ঙ্কর সেই জেলি।
এ দৃশ্য আর দেখতে পারলেন না সুরেশ সাইকিয়া। এরপর কী ঘটবে, কী নারকীয় দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে হবে তা তিনি আঁচ করে নিয়েছেন। তাই, রিভলভার টেনে নিয়ে ধেয়ে গেলেন রাস্তার ওপর দিয়ে। জেলিপিণ্ড আর টম ডিক্সনের খুব কাছে গেলেন না। যদি অবয়বহীন পিণ্ড ছিটকে আসে তাকে লক্ষ করে?
রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে নিপুণ নিশানায় গুলি চালিয়ে দিলেন প্রিয় সার্জেন্টের খুলির মধ্যে। এবং, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে গোটা শরীরটার ওপর ছড়িয়ে গেল কালচে-হলুদ রঙের সর্বভুক জেলিপিণ্ড। ফুলে ফুলে উঠে টোল খেয়ে যেতে লাগল চারিদিকে। টম ডিক্সনকে আর দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তার কী হাল হচ্ছে, সেটা আঁচ করা যাচ্ছে।
দেখাও গেল কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড, তার বেশি নয়।
টম ডিক্সন বিলীন হয়ে গেছে জেলিপিণ্ডর অভ্যন্তরে। জেলিপিণ্ডও আয়তনে বৃহত্তর হয়েছে। টম ডিক্সনের গোটা শরীরটা যে এখন তার নিজস্ব উপাদান হয়ে গেছে।
স্বচক্ষে দেখেও বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলেন না অপরাজিতা সোম। টম ডিক্সনকে নিজের মধ্যে শুষে নিল যে জেলিপিণ্ড, তার যেন ডিএনএ-র ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। চেহারা পালটাতে পারে খুশিমতো, অবিশ্বাস্য গতিবেগে—হাড়গোড় পর্যন্ত পালটে নেয় নিজের উপাদানে।
এ ধরনের কোনও প্রাণী তো নেই। অসম্ভব। অপরাজিতা সোম জীববিজ্ঞানী। অপরাজিতা সোম বংশাণুবিদ। অথচ এহেন কাণ্ড তাঁর জ্ঞানবুদ্ধির সম্পূর্ণ বাইরে।
তাঁর বিস্ফারিত চক্ষুর সামনেই সহসা থলথলে জেলিপিণ্ড মাকড়সার আকার নিয়ে ছড়িয়ে পড়ল ফুটপাতের ওপর। অতিকায় অ্যামিবা আর ফাংগাসের মাঝামাঝি আকৃতি নিয়ে। ফুটপাতের ওপর দিয়ে মন্থরগতিতে পিছলে গেল অনতিদূরের খোলা ম্যানহোলের দিকে—যার ভেতরে ঢুকে রয়েছে ফিল্ড ল্যাবরেটরির ইলেকট্রিক পাওয়ার কেবল।
সুরেশ সাইকিয়া আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। উপর্যুপরি গুলিবর্ষণ করে গেলেন চলমান জেলিপিণ্ড লক্ষ করে। প্রত্যেকটা তপ্ত সিসে পিণ্ডদেহ ফুটো করে ভেতরে প্রবিষ্ট হল, তার বেশি কিছু না। জেলিদেহ কিম্ভূত আকার নিয়ে নির্বিকারভাবে এগিয়ে গেল ম্যানহোলের দিকে।
বিকট স্তম্ভটার আবির্ভাব ঘটল ঠিক তক্ষুণি, ম্যানহোলের ভেতর থেকে।
গোধূলি তখন ছায়াচ্ছন্ন করে তুলেছে রাজপথকে। অস্পষ্ট সেই আলোতে সহসা অবিশ্বাস্য গতিবেগে ম্যানহোলের ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে এল একটা জেলিপিণ্ড। নিমেষে ঠেলে উঠল ওপর দিকে থামের মতন। ম্যানহোলের গর্ত যতটা ব্যাসের, স্তম্ভের ব্যাসও ঠিক তাই। যেন গোটা ম্যানহোলের তলদেশ ঠাসা রয়েছে এই জেলিপিণ্ড দিয়ে। দেখতে দেখতে ঠেলে উঠল দশ ফুট ওপরে। স্তব্ধ হল ঊর্ধ্ববেগ। দুলতে লাগল সাপের মতন। পরক্ষণেই সপাং সপাং করে আছড়ে পড়ল রাস্তায় আর ফুটপাতে। বিষম সংঘাতের বিপুল শব্দ কাঁপিয়ে তুলল শহর…
ইতিমধ্যে ফুটপাত কামড়ে ধরে সর্বভুক থলথলে জেলিপিণ্ড আছাড়ি-পিছাড়ি খাওয়া বিপুলকায় জেলিস্তম্ভের কাছে গিয়ে নিজেকে মিশিয়ে দিল থামের মধ্যে— যেন একই সত্তা—এতক্ষণ ছিল আলাদা, ছিল অন্য এক কার্যভার নিয়ে, সে কাজ শেষ করে ফিরে গেল মূল দেহে।
সোঁ-ও-ও শব্দ তুলে বিরাট স্তম্ভ সাঁৎ করে ঢুকে গেল ম্যানহোলের মধ্যে—প্রকৃত নিবাসে।