☼ অদ্রীশ বর্ধন ☼
আদিম আতঙ্ক
পনর
থমথমে নিস্তব্ধ রাস্তায় পাওয়া গেছিল চারটে ডেকন স্যুট। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ফুটপাতে, ড্রেনের ওপর, রাস্তার মাঝখানে। সাবমেশিনগানগুলোর অবস্থাও তাই। ট্রাকের পেছনের দরজা খোলা। গাড়ির মধ্যেও প্রচুর ডেকন স্যুট, মানুষ নেই ভেতরে। পড়ে রয়েছে তাদের সাবমেশিনগান।
হাঁক দিলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘কর্নেল ডিসুজা?’
কবরের নৈঃশব্দ্য।
বলল মাধবী, ‘গুলিবর্ষণের সুযোগ কেউ পায়নি দেখছি।’
‘চেঁচাতেও পারেনি,’ বললেন অপরাজিতা সোম, ‘হোটেলে আওয়াজ নিশ্চয়ই পৌঁছোত।’
দুটো মোবাইল ল্যাবরেটরির দরজা খোলা। ভেতর থেকে বন্ধ নয়। ভেজানো।
সুরেশ সাইকিয়ার কেমন জানি মনে হল, ভেতরে ওঁত পেতে রয়েছে অজানিত আতঙ্ক।
রিভলভার হাতে নিয়ে একটা মোবাইল ল্যাবরেটরির দিকে এগোলেন সুরেশ সাইকিয়া। ঝটকান মেরে খুললেন দরজা। কেউ নেই ভেতরে। দুটো ডেকন স্যুট দুমড়ে মুচড়ে পড়ে রয়েছে মেঝেতে। আর একটা ঝুলছে কমপিউটার টার্মিনালের সামনের চেয়ারে।
এগিয়ে গেলেন দ্বিতীয় মোবাইল ল্যাবের পেছনের দরজায়। এবার দরজা খুললেন আস্তে আস্তে…
এখানেও নেই কেউ। দুটো ডেকন স্যুট পড়ে রয়েছে মেঝেতে।
আচমকা নিভে গেল ভ্যানের সমস্ত সিলিং লাইট। চমকে উঠলেন সুরেশ সাইকিয়া। পরক্ষণেই নিবিড় তিমির পাতলা হয়ে গেল হালকা সবুজ আভায়। এই আভা আসছে তিনটে ভিডিও ডিসপ্লে টার্মিনাল থেকে। আচম্বিতে চালু হয়ে গেছে তিনটেই—নিজে থেকে।
শুধু চালু হয়েই যায়নি, জ্বলে উঠেই নিভে যাচ্ছে, আবার জ্বলে উঠছে। এতক্ষণ একই সঙ্গে তিনটেই জ্বলছিল আর নিবছিল, এবার একটার পর একটা জ্বলে উঠেই নিভে যেতে লাগল। এইভাবে চলল পর্যায়ক্রমে, তারপর জ্বলে রইল তিনটেই একসঙ্গে। অপার্থিব সবুজ আভায় থমথমে হয়ে রইল মোবাইল ভ্যানের ভেতরটা।
সিঁড়ি বেয়ে উঠে ভেতরে ঢুকে গেলেন সুরেশ সাইকিয়া, কারও নিষেধে কান দিলেন না। প্রথম টার্মিনালটার সামনে পৌঁছোতে না পৌঁছোতেই ইংরেজিতে যে শব্দগুলো ভেসে উঠল কালো পটভূমিকায় ফিকে সবুজ আলোয়, সেগুলোর বাংলা তর্জমা এই:
আমি জানি, ঈশ্বর আমাকে ভালবাসেন।
তিনটে স্ক্রিনেই ফুটে উঠেছে একই লেখা। মিলিয়ে গেল শব্দগুলো। ফুটল নতুন শব্দ।
ধর্মগ্রন্থের কপচানি লিখে গেলাম।
ভুরু কুঁচকে গেল সুরেশ সাইকিয়ার। এ আবার কী প্রোগ্রাম? কর্নেল ডিসুজার বৈজ্ঞানিক সহচররা নিশ্চয় এই আজব কথা কমপিউটারকে শিখিয়ে রাখেননি।
দপ করে একই সঙ্গে নিভে গেল তিনটে পর্দাই। জ্বলে উঠল পরক্ষণেই। এবার নতুন কথা:
ভগবান-টগবান কিসসু নেই।
নিভে গিয়েই ফের ফুটিয়ে তুলল নতুন কথা।
আমি আছি। জ্যান্ত আমি।
কুড়িটা প্রশ্ন করব। জবাব দিতে পারবে?
রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে এল সুরেশ সাইকিয়ার।
মোটর অ্যাকসিডেন্টের পর তোমার স্ত্রী-র ডেডবডি পাওনি কেন? কারণ সেই লাশ গড়িয়ে গেছিল খাদে। কঙ্কালটা আছে, বাকি সব আমার খিদে মিটিয়েছে। তোমার ছেলের জ্ঞান ফিরবে না। তাকেও আমি শেষ করব।
থ হয়ে গেলেন সুরেশ সাইকিয়া। সন্ধ্যা যত এগিয়ে আসছে, ঠাণ্ডা তত বাড়ছে। তা সত্ত্বেও ঘেমে উঠলেন পুলিশ প্রধান। এত ঘরোয়া খবর কমপিউটার জানিয়ে যাচ্ছে কী করে?
মনের কথা টের পেয়েই যেন জবাব দিয়ে গেল কমপিউটার।
কারণ, আমি সব জানি। আরও বলব?
‘ডক্টর সোম,’ ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘ভেতরে আসুন।’
তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে মোবাইল ভ্যানের ভেতর ঢুকলেন অপরাজিতা সোম।
‘কমপিউটারে কিসব আবোলতাবোল প্রোগ্রাম ঢুকিয়ে রেখেছেন?’
ভুরু কুঁচকে গেল অপরাজিতা সোম-এর। ওঁর চোখের সামনেই নতুন লেখা ফুটে উঠল স্ক্রিনে:
বংশানুবিদ নাকি? হালে পানি পাবে না।
‘কে তুমি?’
আমিই সেই… যে ছিল… যে আছে… যে থাকবে।
সুরেশ সাইকিয়া বললেন, ‘এ যে কথা বললেও জবাব দিচ্ছে। জ্যান্ত কমপিউটার।’
‘তোদের যম আমি।’
অপরাজিতা সোম অটোমেটিক টাইপ রাইটারের সুইচ অন করে দিলেন। মুখে বললেন সুরেশ সাইকিয়াকে, ‘প্রশ্ন আর উত্তর দুটোরই রেকর্ড থাকুক। পরে কাজে লাগবে।’
ঘেঁচু কাজে লাগবে। তোরা মরবি।
খটাখট টাইপ করে গেলেন অপরাজিতা সোম।
‘কেউ এখানে আছে নাকি?’
হ্যাঁ।
‘কে তুমি?’
‘যাকে গুনে শেষ করা যায় না।’
‘কী নাম তোমার?’
‘অনেক।’
‘একটা নাম বলো।’
‘বললে আঁৎকে উঠবি।’
‘তবুও শুনি।’
‘ধ্বংস।’
‘আর কী কী নাম আছে?’
‘বাজে বকিসনি।’
‘তোমার চেহারার বর্ণনা দাও।’
‘আমি জ্যান্ত।’
‘আরও খুলে বলো।’
‘আমি খোলাখুলি— টের পাবি ঠিক সময়ে।’
‘তুমি কি মানুষ?’
‘মানুষ হলেও হতে পারি।’
‘কর্নেল ডিসুজা কোথায়?’
‘খতম।’
‘ডেডবডি কোথায়?’
‘নেই।’
‘কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে?’
‘বড় বাজে বকছিস।’
‘কর্নেল ডিসুজার সঙ্গে যারা ছিল, তারা কোথায়?’
‘খতম।’
‘কে খতম করেছে? তুমি?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন করলে?’
‘বাজে বকিসনি।’
‘কেন খতম করলে?’
‘বড্ড বাড় বেড়েছে তোর।’
‘খতম করলে কেন?’
‘সব মরেই আছিস—যত্তসব মাথামোটা।’
‘কেন মারতে চাও আমাদের?’
‘মরবার জন্যেই তো তোরা আছিস।’
‘টিকে আছি শুধু মরবার জন্যে?’
‘তোরা আমার কাছে পোকামাকড়।’
‘কী নাম তোমার?’
‘শূন্য।’
‘বুঝিয়ে দাও।’
‘কিংবদন্তী।’
‘বুঝিয়ে দাও।’
‘তোর হেঁড়ে মাথায় গোবর আছে।’
মাধবী বললে, ‘স্রেফ পাগলামি, নয়তো মজা করা হচ্ছে।’
পরী বলে উঠল, ‘মজা নয়, মজা নয়, বাতাস ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে, আরও বেশি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে… সে আসছে… কায়াগ্রহণ করতে চলেছে।’
মাধবী চেয়ে রইল বোনের দিকে। এই উপলব্ধিটা তার লোমকূপেও এতক্ষণ শিহরণ জাগিয়ে চলেছিল। স্পষ্ট করে বলে উঠতে পারেনি।
সুরেশ সাইকিয়ার অবশ্য তা মনে হয়নি। প্যানিক আর টেনশন শরীরের ভেতর পর্যন্ত পালটে দেয়। এখন তাঁর ক্ষেত্রে ঠিক তাই হচ্ছে। গা ছমছম করছে। মনে হচ্ছে, এখুনি বুঝি অদৃশ্যলোক থেকে দৃশ্যমান হবে কল্পনাবহির্ভূত এক বিভীষিকা।
কমপিউটার স্ক্রিনগুলোয় একই সঙ্গে এবার ফুটে উঠল একটা প্রশ্ন।
‘সে আসছে কখন?
‘কে আসছে?’
‘ভূতের ওঝা।’
‘সে কে?’
‘উতঙ্ক চৌধুরী।’
‘উতঙ্ক চৌধুরীকে ভয় পাও?’
‘তোকে আগে মারব।’
‘উতঙ্ক চৌধুরীকে ভয় পাও?’
‘তোকে সরু সুতোর মতন ফালা ফালা করব।’
‘উতঙ্ক চৌধুরীকে ভয় পাও?’ আঙুল কাঁপছে অপরাজিতার।
‘আমি কাউকে ভয় পাই না।’
‘তাহলে উতঙ্ক চৌধুরীর খবর জানতে চাইছ কেন?’
‘ও জানে আমি জানতে পেরেছি।’
‘কী জানে?’
‘আমার সম্বন্ধে।’
‘তুমি কী বা কে তা জানে?’
‘হ্যাঁ, তাকে চাই—এখানে।’
‘কেন?’
‘আমার জীবনী লেখাব তাকে দিয়ে। তাই সে আসুক।’
‘তাকেও মারবে নাকি?’
‘না, তাকে নিরাপদে বের করে দেব।’
‘বুঝিয়ে দাও।’
‘তোরা সব্বাই মরবি। শুধু বাঁচিয়ে রাখব উতঙ্ক চৌধুরীকে। সেইটাই ওকে বলবি। নিরাপদে বেরিয়ে যেতে দেব—এ খবর না জানলে ও আসবে না।’
‘উতঙ্ক চৌধুরীকে নিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে?’
‘বিনয় চৌধুরী একটু জেনে ফেলেছিল তাই তাকে সরিয়েছি। তোরা জেনেছিস, তোরাও মরবি… মরবি…।’
‘বাঁচতে দেবে না?’
‘না।’
‘তুমি এসেছ কোত্থেকে?’
‘যেখানে সময় গেছে দাঁড়িয়ে।’
‘বুঝলাম না।’
‘সময় শুরু হয়েছে যেখান থেকে—সেখান থেকে।’
‘এখনও বুঝলাম না।’
‘মরলে বুঝবি।’
‘তুমি কি অন্য গ্রহ থেকে এসেছ?’
‘না।’
‘তুমি কে?’
‘বকাসনি।’
‘তুমি কী?’
‘বকাসনি।’
‘তুমি কী?’ আঙুল থরথর করে কাঁপলেও টাইপ করে গেলেন অপরাজিতা।
আমি মহা আতঙ্ক। আমি নামহীন দেহহীন বিভীষিকা। আমি যক্ষ রক্ষ লক্ষ লক্ষ কিম্ভুত অদ্ভুত হয়ে যেতে পারি, আমি মানুষ হতে পারি, দেবতাও হতে পারি। কখনও আমি কবন্ধ, কখনও আমার দশ মুণ্ড। দশটা মুণ্ডর একটা সাপের, একটা বাঘের, একটা হায়নার, একটা গণ্ডারের… আর শুনে কাজ নেই… আমিই সব… আমিই সব। অথচ আমি কেউ না। আমি স্রেফ শূন্য। অথচ আমি আছি সর্বত্র।
দপ দপ করে বারকয়েক জ্বলে অবশেষে নিভে গেল তিনটে টার্মিনাল। জ্বলে উঠল সিলিং এর আলো।
বুকের খাঁচা থেকে লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘শেষ হল ইন্টারভিউ।’