☼ অদ্রীশ বর্ধন ☼
আদিম আতঙ্ক
চৌদ্দ
চাঞ্চল্যকর খবরের পর খবর এসে পৌঁছোচ্ছে মোবাইল ল্যাবরেটরি থেকে। শিবালয় শহরের আকাশে-বাতাসে-জলে-মাটিতে কোত্থাও কোনওরকম জৈব সংক্রমণ ঘটেনি।
সবচেয়ে তাজ্জব ব্যাপার, ডেডবডি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তাতে কোনও জীবাণু নেই! শরীর প্রাণশূণ্য হলেই তাতে জীবাণু বাসা বাঁধে, তাই শরীর পচতে থাকে। কিন্তু শিবালয় শহরের ডেডবডিতে কোনও ব্যাকটিরিয়া নেই। এমনকী সজীব শরীরের কোলন অঞ্চলেও যে ব্যাকটিরিয়া থাকে তাও নেই।
শরীর একেবারে জীবাণুশূন্য!
মাধবী আড়ষ্ট গলায় বললে, ‘তার মানে একটাই। বডিগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী প্রিজারভেটিভ, মানে, সংরক্ষণকর রসায়ন দিয়ে টাটকা রাখা হয়েছে।’
কর্নেল ডিসুজা দিশেহারা। ডেকন স্যুট খুলতে খুলতে বললেন, ‘কোথাও যখন জীবাণু সংক্রমণ ঘটেনি, তখন এই পোশাকের বোঝা নামিয়ে রাখা যাক।’
মরিয়া হয়ে গেছেন ভদ্রলোক।
পরী কফি এনে দিচ্ছে। মোট চার কাপ। ডক্টর অপরাজিতা সোম, মাধবী, সুরেশ সাইকিয়া আর নিজের জন্যে। ওরা এখন বসে আছে হোটেলের ডাইনিং রুমে। জানলার কাছে। পড়ন্ত রোদ ধুয়ে দিচ্ছে নিচের রাস্তা। রাত নামবে আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। শুরু হবে আবার এক আতঙ্কঘন দীর্ঘ রাত্রি।
শিহরিত হল মাধবী। চুমুক দিল কফিতে।
অপরাজিতা সোম এখন কর্ডুরয় জিনস আর হলুদ ব্লাউজ পরে আছেন। রেশমের মতন চুল লুটোচ্ছে কাঁধে। বলছেন, ‘এরকম কাণ্ড ওয়াল্ট ডিসনির ফিল্মে দেখেছি। কিছু মাকড়শা আর পোকা শিকার ধরে তাদের গায়ে প্রিজারভেটিভ পুরে দেয় পরে খাওয়ার জন্যে। এখানকার বডিগুলো কেটেকুটে দেখা যাচ্ছে সেই একই ব্যাপার। তবে, এই প্রিজারভেটিভ আরও কড়া, আরও উন্নত।’
মাধবীর মনের চোখে ভেসে উঠল বিশালকায় মথ পোকা। কয়েকশো মথ পোকা ঘরে ঘরে ঢুকে প্রিজারভেটিভ ফুঁড়ে দিয়ে যেতে পারে, কিন্তু বন্ধ গাড়ির মধ্যে তারা ঢুকল কী করে?
সুরেশ সাইকিয়া বললেন, ‘পোকার কামড়ে শহরসুদ্ধ লোক মারা গেছে, এই কি বলতে চান?’
‘সেরকম প্রমাণ এখনও পাইনি। পোকা যখন হুল ফোটায়, হুল ফোটানোর দাগ তো থাকবে শরীরের কোথাও না কোথাও। আমরা সেরকম কোনও পাংচার দেখতে পাইনি ডেডবডিতে।’
‘আর একটা ডেডবডি নিয়ে ফের দেখলে হয় না?’
‘নিশ্চয় দেখব। তবে আশ্চর্য এই যে, ডেডবডিতে এক্কেবারে পচন ধরেনি ব্যাকটিরিয়া একদম না থাকায়। টিস্যু-বোঝাই প্রিজারভেটিভ রয়েছে। অদ্ভুত!’
‘প্রিজারভেটিভ যদি ফুঁড়ে ঢোকানো না হয়, তাহলে শরীরে ঢুকল কী করে?’
‘অনুমান করতে পারি।’
‘কী অনুমান?’
‘চামড়া শুষে নিয়েছে। সেকেণ্ড কয়েকের মধ্যে টিসুতে পৌঁছে গেছে।’
‘নার্ভ গ্যাস নয় তো?’ মাধবীর প্রশ্ন, ‘প্রিজারভেটিভ এফেক্টটা স্রেফ সাইড এফেক্ট।’
‘না,’ অপরাজিতা জবাব দিলেন, ‘নার্ভ গ্যাস তো একধরনের বিষ-গ্যাস। জামাকাপড়ে লেশ লেগে থাকতই। তা পাওয়া যায়নি।’
‘তাহলে কী বলতে চান, মৃত্যুর কারণও এই প্রিজারভেটিভ?’ জানতে চাইলেন সুরেশ সাইকিয়া।
‘মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলতে পারেন,’ বললেন অপরাজিতা সোম, ‘অন্যান্য কারণের মধ্যে অক্সিজেনের অভাবও থাকতে পারে।’
‘দম বন্ধ করে মৃত্যু?’ ঝুঁকে বসলেন সুরেশ সাইকিয়া।
‘হ্যাঁ। কিন্তু কোনটা সঠিক কারণ, তা বলা যাচ্ছে না।’
‘যারা মরেছে, তারা দু’এক সেকেণ্ডের মধ্যেই মরেছে। দমবন্ধ মৃত্যুতে সময় লাগে তার চেয়ে বেশি। যার দম আটকে আসছে, সে ছটফট করবেই, কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই ছটফটানির চিহ্ন পাওয়া যায়নি।’
‘তা ঠিক,’ সায় দিলেন বংশাণুবিদ।
‘শরীর ফুলে ঢোল হয়েছে কেন?’ সুরেশ সাইকিয়া নাছোড়বান্দা।
‘প্রিজারভেটিভের বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ার দরুন হতে পারে।’
‘সারা শরীর থেঁৎলে যাওয়া?’
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারলেন না অপরাজিতা সোম। দিলেন কিছুক্ষণ পরে ভুরু কুঁচকে, ‘বাইরে থেকে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল শরীরের ওপর, পরীক্ষায় তা জানা গেছে। হয়তো প্রিজারভেটিভের আর একটা অ্যালারজিক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া। ফুলে উঠলে শরীরের সর্বত্র অমন কালসিটে পড়ে না। ঠিক যেন কিছু দিয়ে মারা হয়েছে। ঘনঘন মেরেই যাওয়া হয়েছে। অবিশ্বাসটা জাগছে সেইখানেই। এইভাবে পিটিয়ে গেলে অন্তত একটা হাড় ভো ভাঙবেই। অদ্ভুত ব্যাপার রয়েছে আর এক ক্ষেত্রে। গোটা শরীরের সমস্ত জায়গায় কালসিটের মাত্রা একই রকম, কম-বেশি কোথাও নেই। উরুতে যতখানি কালসিটে, বগলেও ঠিক ততখানি। অসম্ভব। বগলে মুগুর পৌঁছোয় না। জুতো পরে থাকা ডেডবডির পায়ের পাতায় কালসিটে পড়ল কী করে?’
মাধবী বললে, ‘কালসিটের কারণ তাহলে নির্ণয় করা যায়নি? মৃত্যুর কারণও জানা যায়নি?’
‘না,’ চেয়ারে ঠেসান দিয়ে বসলেন অপরাজিতা সোম। তাঁর মুখে এখন দুশ্চিন্তার ছাপ। অপরাহ্ন আরও গড়িয়েছে। রাস্তা একদম ফাঁকা। গাছগুলো নিস্পন্দ। গোটা শহরে কবরের নীরবতা। ‘কর্নেল ডিসুজারা এত দেরি করছেন কেন? দশ মিনিট আগেই ফিরে আসা উচিত ছিল।’
উঠে দাঁড়ালেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘আমি গিয়ে দেখছি।’
উঠে দাঁড়ালেন অপরাজিতা সোমও, ‘লক্ষণ সুবিধের ঠেকছে না।’
মাধবীও তা টের পাচ্ছে।
আতঙ্ক ফের খেল দেখাতে শুরু করেছে শিবালয় শহরে।