» » আদিম আতঙ্ক

বর্ণাকার

অদ্রীশ বর্ধন

আদিম আতঙ্ক

বার

রেডিও মারফত আবদুল কিন্তু জানিয়ে গেছিল কার খপ্পরে সে পড়েছে।

খোলা ম্যানহোল থেকে যেটুকু  আলো আসছিল, সেই আলোতে বিকট বিভীষিকাকে দেখা গেছিল পলকের জন্যে। তারপরেই নিবিড় তিমিরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করা হয়েছিল তার পোশাক—উরু আর পেটে কামড় বসানো হয়েছিল সবার আগে।

কিন্তু তার যে বর্ণনা মরতে মরতে দিয়ে গেছিল আবদুল করিম, তা যে বিশ্বাসের একদম বাইরে।

তার চেহারার অতি সামান্যই দেখেছিল আবদুল। গিরগিটির মতন অথচ গিরগিটি নয়, অতিকায় পোকা-ও নয়। অর্থাৎ পোকার আদল আছে কিম্ভূত অবয়বে, পলকের জন্যে চোখে পড়েছিল ক্ষুরের মতন ধারালো দু’সারি বল্লম সাজানো তার পিঠে। দেখেছিল বিরাট থাবা, নখগুলো তীক্ষাগ্র আঁকশির মতন। চোখ তার ধোঁয়াটে লালচে, লম্বাটে কণীনিকা কবরের মতন নিশ্চল নিথর। গায়ে তার চামড়া নেই, আছে আঁশ। মাথায় একজোড়া শিং ঠেলে উঠছে নরকাগ্নি ঠাসা চোখ জোড়ার ঠিক ওপর থেকে। বাঁকানো শিং— ভোজালি বললেই চলে। চোয়াল কুমিরের চোয়ালের মতন। চেরা জিব লকলকিয়ে পিছলে যাচ্ছে সারিবদ্ধ ছোরার মতন দংষ্ট্রার ওপর দিয়ে।

সুড়ঙ্গের অন্ধকারে আবদুলকে টেনে নিয়ে গিয়ে যখন উন্মাদের মতন অর্থহীন অট্টহাসি হাসছে তিমিরাবৃত সেই বিভীষিকা আর টুকরো টুকরো করছে আবদুলের পোশাক, তখনও কর্তব্য করে গেছিল মানুষটা। যথাযথ বর্ণনা দিয়ে গেছিল আকুল কণ্ঠে। তারপর আর বার্তা ভেসে আসেনি রেডিও মারফত। সব শেষ হয়ে গেছিল।

ম্যানহোলের ঢাকনা টেনে এনে বন্ধ করে দিয়েছিলেন কর্নেল ডিসুজা নিজে। তখন তিনি ঘামছেন।

ইতিমধ্যে বিরামবিহীন পরীক্ষানিরীক্ষা চলছিল মোবাইল ফিল্ড ল্যাবরেটরি দুটোয়। সব নমুনা টেস্ট করা হয়েছে। সন্দেহজনক কিসসু পাওয়া যায়নি। এমনকী যে-জল থই থই করছিল মেঝেতে, উজাগর সিং যার নমুনা এনেছিলেন শিশিতে সেই জলও আলট্রা-পিওর! আশ্চর্য ব্যাপার! গ্যালন গ্যালন আলট্রা-পিওর  জল কে ঢেলে দিয়ে গেল শিবালয় শহরে?

শব ব্যবচ্ছেদও শেষ হয়েছে। নার্ভ গ্যাস অথবা জীবাণুর সন্ধান পাওয়া যায়নি। অজানা কোনও রসায়নের চিহ্নও নেই কোথাও।

 বৈজ্ঞানিক অপরাজিতা সোম ব্যাকটিরিয়া কালচার তৈরি করছিলেন মোবাইল ল্যাবোরেটরিতে বসে। নিহত ব্যক্তির রক্ত থেকে নমুনা নিয়ে চলছে পরীক্ষানিরীক্ষা, ইনি পেশায় বংশাণুবিদ। জিন উপাদানের পুনর্মিলন নিয়ে বারো বছর গবেষণা করেছেন। মানুষের হাতে গড়া অণুজীব শিবালয় শহরে অনর্থ সৃষ্টি করে চলেছে—এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেই তাঁর কাজ সোজা হয়ে যাবে।

তবে এইমাত্র যে খবর তাঁর কানে এসেছে, তা শোনবার পর তাঁর মনে হচ্ছে, পিশাচগুরুদের নয়া এক্সপেরিমেন্ট চলছে নাকি নির্জন শহরে?

মাধবী বসে আছে তাঁর পাশে।

কর্নেল ডিসুজা জিজ্ঞেস করলেন সুরেশ সাইকিয়াকে, ‘এমন কোনও বিস্ফোরণ সম্প্রতি ঘটেছিল যার কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না?’

‘বিস্ফোরণ?’

‘সুনাদী বিস্ফোরণ?’

‘তার মানে?’

‘সোনিক বুম।’

‘না।’

‘অস্বাভাবিক জোর কোনও আওয়াজ?’

‘না, না, না,’ ধোঁকায় পড়েছেন সুরেশ সাইকিয়া। কোন সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন কর্নেল, তা আন্দাজ করতে পারছেন না।

বলে চলেছেন কর্নেল, ‘অস্বাভাবিক কোনও উড়োজাহাজের খবর পেয়েছিলেন ধারেকাছে?’

‘না।’ একটু থেমে পাল্টা প্রশ্ন করলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘আপনি কি ফ্লাইং সসারের কথা ভাবছেন?’

‘ফ্লাইং সসার বলতে লোকে ধরে নিয়েছে, আকাশ থেকে অদ্ভুত একটা স্পেসশিপ এসে নামল বুঝি পৃথিবীতে। মানুষের সঙ্গে অন্য গ্রহের উন্নত জীবদের অন্যরকমভাবে যোগাযোগেও তো ঘটতে পারে?’

‘আপনার কথায় হেঁয়ালি স্পষ্ট হল না। তবে, ফ্লাইং সসার জাতীয় কোনও আজব মহাকাশযান কখনও আশেপাশে দেখা যায়নি।’

একটু থেমে বললেন কর্নেল, ‘অন্য গ্রহের অতি উন্নত জীব এক্কেবারে অন্য রকমও তো হতে পারে।’

‘মানে?’

‘টেলিপ্যাথিতে অসাধারণ ক্ষমতা রাখে। আমরা যে-সব ঘটনাকে ভুতুড়ে কাণ্ড বলে উড়িয়ে দিই—তাদের পেছনেও এই টেলিপ্যাথিক যোগাযোগের চেষ্টা থাকতে পারে। যেমন, ঘরের ফানির্চারের আচমকা শূন্যে ভেসে ওঠা, জিনিসপত্রর শূন্যে ছিটকে যাওয়া, দেওয়ালের গা ফুঁড়ে তোড়ে জল বেরিয়ে আসা—অথচ সেখানে নেই কোনও জলের পাইপ, আগুনের গোলার শূন্যে ছুটোছুটি…’

‘আপনি ভূত মানেন?’

‘না। কিন্তু টেলিপ্যাথি দিয়ে পাঠানো চিন্তাধারায় বিশ্বাস রাখি। সাইকিক এনার্জিকে ঠিকমতো গ্রহণ করতে না পারলে তা বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।’

‘শিবালয় শহরে এই রকম কিছু একটা ঘটেছে বলে আপনার বিশ্বাস?’

‘জৈবিক দূষণ তো ঘটতে পারে… ভিনগ্রহীর সঙ্গে পৃথিবীগ্রহীর প্রথম ছোঁয়াছুঁয়ির সংস্পর্শ দোষ। হয়তো মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।’

‘তাহলে সেই উন্নত ভিনগ্রহীকে পিশাচ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।’

‘ভিনগ্রহী হলেই যে পরোপকারী দেবতাবিশেষ হতেই হবে, এমন কোনও গ্যারান্টি আছে কি? গরিলা পরে মানুষ হয়েছে। কিন্তু গরিলারা মানুষের মতন এমন যুদ্ধপাগল নয়।’

চুপ মেরে গেলেন সুরেশ সাইকিয়া।