» » আদিম আতঙ্ক

বর্ণাকার

অদ্রীশ বর্ধন

আদিম আতঙ্ক

এগার

শিবালয় শহর ভোরের আলোয় এখন শুচিস্নিগ্ধ। রাতের বিভীষিকার লেশমাত্র নেই আকাশে বাতাসে। আকাশ নির্মেঘ।

সিভিলিয়ান ডিফেন্স ইউনিট এসে গেছে শহরে। টেলিফোনে খবর পেয়ে রান্নাঘরের কাণ্ড দেখে মুহ্যমান সকলেই সে অবস্থা কাটিয়ে উঠেছেন।

কর্নেল ডিসুজার টিম এখনও দেখা যাচ্ছে না। রাস্তা নেমে গেছে নিচের দিকে—সব্বার চোখ সেইদিকে।

একটু পরেই আবির্ভূত হল একটা বড় গাড়ি। হাঁপ-ধরা ইঞ্জিনের আওয়াজ বাড়তে লাগল একটু একটু করে।

রাস্তা বেয়ে যেন গুঁড়ি মেরে উঠে এল মোট তিনটে গাড়ি। সবার আগে রয়েছে ঝকঝকে সাদা মোবাইল হোম। ছত্রিশ ফুট লম্বা বিশাল দানব। দু’পাশে নেই কোনও দরজা বা জানলা। প্রবেশ পথ নিশ্চয় একটাই—যা রয়েছে পেছনে। বিশাল বেঁকানো উইণ্ডশিল্ড কালচে রঙের—ভেতরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, কাচ বেশ পুরু, সাধারণ মোবাইল হোমে যে রকম কাচ থাকে, তার চাইতে মোটা আর মজবুত।

দ্বিতীয় গাড়িটা রয়েছে এর পেছনে। তার পেছনে আসছে একটা ট্রাক— পেছনে টেনে আনছে তিরিশ ফুট লম্বা একটা ট্রেলার। ট্রাকের জানলার কাচও গাঢ় কালচে রঙের—বুলেট-প্রুফ নিশ্চয়।

রাস্তার মাঝে গিয়ে দাঁড়ালেন সুরেশ সাইকিয়া। দু’হাত মাথার উপর তুলে নেড়ে গেলেন—ড্রাইভারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।

মোবাইল হোম আর ট্রাক নিশ্চয় মালপত্র বোঝাই—এত ভারী যে চড়াই রাস্তা বেয়ে উঠতে হাঁফ ধরে যাচ্ছে শক্তিশালী ইঞ্জিনগুলোর। ইঞ্জিনে কর্কশ শব্দ হচ্ছে। উঠছে এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে, হোটেলের সামনে এসে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আড়াআড়িভাবে রাখল মোড় ঘুরে পাশের রাস্তায়—যাতে গাড়ি গড়িয়ে নেমে না যায়। এখানকার রাস্তা সমতল, ঢালু নয়।

অতি-গরম ইঞ্জিন তিনটে বন্ধ করে দেওয়া হল একে একে।

মাধবীর মনে উল্লাস। বিশেষজ্ঞরা এসে গেছে, আর ভয় কী।

ট্রাকের পেছনের দরজা খুলে গেল প্রথমে। লাফিয়ে নেমে এল কয়েকজন পুরুষ। প্রত্যেকের পরনে এয়ারটাইট ভিনাইল স্যুট। মাথায় মস্ত হেলমেট— বড় সাইজের প্লেক্সিগ্লাস ফেসপ্লেট রয়েছে সামনে। নিজস্ব এয়ার সাপ্লাই ট্যাঙ্ক রয়েছে প্রত্যেকের পিঠে। আবর্জনা পরিশোধনের ব্রীফকেস সাইজের বাক্সও রয়েছে পিঠে।

ঠিক যেন মহাকাশচারীরা নামছে ট্রাক থেকে। ছ’জন চটপটে পুরুষ নামল পর-পর। নামছে আরও। প্রত্যেকেই বিলক্ষণ সশস্ত্র। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল ক্যারাভানের দু’পাশে, গাড়িগুলোর দিকে পিঠ ফিরিয়ে। বিজ্ঞানী নয় এরা। সৈন্যবাহিনী। হেলমেটের ওপর লেখা প্রত্যেকের নাম—ফেসপ্লেটের ঠিক ওপরে। অস্ত্র উঁচিয়ে রয়েছে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে।

এগিয়ে গেলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘এটা কী হচ্ছে?’

ওঁর সামনেই দাঁড়িয়েছিল যে সার্জেন্ট, তার অস্ত্র তৎক্ষণাৎ টার্গেট করল আকাশকে। নিক্ষিপ্ত হল একটা বুলেট। আওয়াজে কেঁপে উঠল শিবালয় শহর।

থমকে গেলেন সুরেশ সাইকিয়া। তার পাশের প্রহরীদের হাত চলে গেল কোমরের অস্ত্রের দিকে।

গুলিবর্ষণ শুরু হওয়ার আগেই গলার শির তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘নো শুটিং!’

এগিয়ে এল একজন সোলজার। এর বুকে লাগানো একটা ছোট্ট রেডিও অ্যামপ্লিফায়ার—লম্বায়-চওড়ায় ছ’ইঞ্চি। পিঁক পিঁক কণ্ঠস্বর বেরিয়ে এল অ্যামপ্লিফায়ার থেকে, ‘দয়া করে গাড়ির কাছ থেকে সরে দাঁড়ান। ল্যাবরেটরির ক্ষতি যাতে না হয় আমাদের তা দেখতে হবে। যে আসবে, সে মরবে, সে যেই হোক।’

‘আরে, আমিই তো ডেকে আনলাম তোমাদের।’

‘পিছিয়ে যান,’ সোলজারের জবাব একটাই।

এই সময়ে খুলে গেল প্রথম মোবাইল হোমের পেছনের দরজা। এয়ারটাইট পরিচ্ছদ পরে বেরিয়ে এল চার ব্যক্তি। কিন্তু তারা সোলজার নয়। এগিয়ে এল মন্থর চরণে। নিরস্ত্র প্রত্যেকেই। এদের একজন মহিলা। মাথার হেলমেটে লেখা নাম অপরাজিতা সোম।

দ্বিতীয় মোবাইল হোম থেকে নেমে দাঁড়াল ছ’জন পুরুষ।

মোট দশজন। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সোলজারদের পেছনে। নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিল ইন্টার স্যুট রেডিও মারফত। প্লেক্সিগ্লাসের পেছনে তাদের ঠোঁট নড়ছে দেখা যাচ্ছে—কিন্তু কথা ভেসে আসছে না বাইরে। বুকের বাক্স নীরব। তার মানে, প্রাইভেট আলোচনা করতে পারে ইচ্ছে করলে, তখন পাবলিক শুনতে পাবে না তাদের কথা।

এই মুহূর্তে ওরা চাইছে ওদের কথা যেন কেউ শুনতে না পায়। কিন্তু কেন? অবাক হয় মাধবী। এত লুকোছাপার কী আছে?

কর্নেল ডিসুজা এগিয়ে এলেন ঠিক এই সময়ে। দশজনের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে লম্বা।

খেঁকিয়ে উঠলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘আগে জানতে চাই গান পয়েন্টে কেন রাখা হয়েছে আমাদের।’

‘সরি,’ নিরুত্তাপ স্বরে বললেন কর্নেল ডিসুজা। ঘুরে দাঁড়ালেন সোলজারদের দিকে, ‘রেস্ট।’

নিমেষে সাবমেশিন কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে গেল সৈনিক পুরুষরা।

বললেন কর্নেল ডিসুজা, ‘মিঃ সাইকিয়া, অযথা রাগ করবেন না। আমরা রিসার্চ টিম। মড়কের কারণ অনুসন্ধান করতে এসেছি, চিকিৎসার সরঞ্জাম নিয়ে আসিনি। ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে কেউ যদি আমাদের মধ্যে সংক্রমণ শুরু করে দেয়, এত আয়োজন মাঠে মারা যাবে। তাই এত হুঁশিয়ারি।’

‘প্লেগের ভাইরাস পাছে আপনাদের মধ্যে চালান করে দিই, তাই তো এত ভয়?’ এই প্রথম কথা বলল মাধবী।

বললেন কর্নেল ডিসুজা, ‘আপনিই ডক্টর মাধবী লাহা? হ্যাঁ, ভয় সেইখানেই। ভাইরাসের প্রতিষেধক বের করার আগে নিজেরাই যদি সংক্রামিত হই তাহলে যে গোটা দেশটা ছারখার হয়ে যাবে। সময় নষ্ট করবেন না। কাল রাতে যা-যা বলেছেন, আগে সব দেখান। তারপর শুরু করব ময়না-তদন্ত। ডক্টর লাহা, শুধু আপনি চলুন মিঃ সাইকিয়ার সঙ্গে। ডেডবডি আগে দেখেছিলেন আপনি। এতক্ষণে যদি কিছু পালটে গিয়ে থাকে, ধরতে পারবেন আপনি। চলুন।’

আহার্য নিবাস। রান্নাঘরে তিলধারণের স্থান নেই। অস্বস্তির-মধ্যে রয়েছেন সুরেশ সাইকিয়া। অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণ আচমকা আরম্ভ হয়ে গেলে বেরোতে পারবেন তো?

দুটো উনুনের মধ্যে বসানো মুণ্ডু দুটোকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে—রয়েছে ঠিক আগের অবস্থায়। কাউন্টারের ওপর কাটা হাত দুটো ধরে রয়েছে বেলুনটা।

কর্নেল ডিসুজার ফটোগ্রাফার শাটার টিপে যাচ্ছে ক্যামেরায়। নানান দিক থেকে তুলে রাখছে অবিশ্বাস্য দৃশ্যের ছবি। তারপর ডজনখানেক ছবি তুলল খুব কাছ থেকে। ফটোগ্রাফিক রেকর্ড শেষ হলেই শুরু হবে ফোরেন্সিক কাজকর্ম।

কর্নেল ডিসুজা বলে উঠলেন, ‘মুজিব, তুমি তো নার্ভ গ্যাস স্পেশালিস্ট। দেখে কী মনে হচ্ছে?’

যাঁকে বললেন, তাঁর হেলমেটে লেখা রয়েছে পুরো নাম, মুজিব রহমান।

তিনি বললেন, ‘জবাবটা এত তাড়াতাড়ি দেওয়া যাবে না। তবে বিষ গ্যাস প্রয়োগ করা হয়েছে বলেই মনে হয়। যে কোনও নার্ভ গ্যাস চামড়ার সংস্পর্শে এলেই তিরিশ সেকেণ্ড থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে খতম করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।’

‘কিভাবে?’ প্রশ্নটা করলেন সুরেশ সাইকিয়া।

‘চামড়ার মধ্যে দিয়ে ঢুকে মিশে যায় রক্তস্রোতে—দশ সেকেণ্ডের মধ্যেই। চলে যায় ব্রেনে। সঙ্গে সঙ্গে জখম করে ব্রেনের টিস্যু। আর তার মেরামত হয় না। পাঁচ-ছ’ঘণ্টা হাত-পা নাড়ার পুরো ক্ষমতা থাকে, গায়ে শক্তিও থাকে। কিন্তু ভোগে মন।’

‘ডিমেনসিয়া প্যারানয়েড,’ বললেন কর্নেল ডিসুজা, ‘বুদ্ধিশুদ্ধি গোলমাল হতে থাকে, আতঙ্ক আর ক্রোধ জাগে, ভাবাবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার ক্ষমতা লোপ পায়। মনে হয়, প্রত্যেকেই বুঝি ষড়যন্ত্র করছে। খুনখারাপির ইচ্ছেটা তখন মাথাচাড়া দেয়। মন বলে কোনও বস্তু আর থাকে না, খুনের মেশিন হয়ে যায়। এই অবস্থা থাকে চার থেকে ছ’ঘণ্টা পর্যন্ত। বিষ-আক্রান্ত ব্যক্তিরাই খুন করতে থাকে পরস্পরকে—যারা আক্রান্ত হয়নি, তাদেরও ছেড়ে দেয় না।’

‘মিউটেশনগ্রস্ত জলাতঙ্ক-ও তো হতে পারে,’ বললে মাধবী।

‘নার্ভ গ্যাস সে জিনিস নয়,’ জবাবটা দিলেন মুজিব। ‘গ্যাস একবার ছড়িয়ে উড়ে গেলে, আর ভয় নেই। শরীরের যা ক্ষতি করে যায়, তা কল্পনা করাও কঠিন।’

‘গ্যাস-ই যদি হয়, অনেক আগেই ছড়িয়ে উবে গেছে,’ বললেন ডিসুজা, ‘তবে সব কিছুর ওপরেই তার লেশ নিশ্চয় আছে। সেটাই পরীক্ষা করে দেখতে হবে।’

জিজ্ঞেস করলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘খুনখারাপির ইচ্ছেটা থাকে চার থেকে ছ’ঘণ্টা পর্যন্ত। তারপর কী হয়?’

‘তারপরের অবস্থাটা চলে ছয় থেকে বারো ঘণ্টা পর্যন্ত,’ বললেন কর্নেল ডিসুজা, ‘নার্ভের দফারফা হতে শুরু করে। প্যারালিসিস ছড়িয়ে পড়ে ব্রেনের বিশেষ সেন্টারেও।’

‘খুলে বলুন।’

‘শরীরের অটোমেটিক ফাংশানগুলোর ওপর ব্রেনের নিয়ন্ত্রণ একটু একটু করে কমে যেতে থাকে। নিঃশ্বাস আটকে যায়, হার্ট চলতে চায় না, রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হয়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেচাল হয়ে যায়। ছয় ঘণ্টা থেকে বারো ঘণ্টা নারকীয় যন্ত্রণার মধ্যে থাকে আক্রান্ত ব্যক্তি—’

‘হার্ট বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত চলে এই যন্ত্রণা?’

‘হ্যাঁ। বমি আর পায়খানাও লেগে থাকে।’

মাধবী বলে উঠল, ‘কিন্তু আমি যাদের মরতে দেখেছি, তাদের কেউ বমি বা পায়খানা করে মরেনি।’

‘বিশেষ জাতের নার্ভ গ্যাস বলেই নিশ্চয় তা হয়নি,’ জবাব দিলেন কর্নেল ডিসুজা।

‘তাহলে শচীনের অমন অবস্থা হল কেন?’

‘মথ-এর গল্প বলছেন?’ ডিসুজার স্বর একটু বেঁকা।

‘আগে সব দেখুন, তারপর মন্তব্য করবেন,’ মাধবীর স্বর এখন কঠিন।

‘তাহলে কাজ শুরু করা যাক,’ বলেই ইশারা করলেন ডিসুজা।

কাটা মুণ্ডু দুটোকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল পোর্সিলেন বালতিতে— এয়ারটাইট ডালায় পড়ল তালা। কাটা হাত দুটোকে রাখা হল আর একটা বালতিতে। একটু ময়দা চেঁছে ঢোকানো হলে ছোট্ট প্লাস্টিক শিশিতে। নার্ভ গ্যাস নিশ্চয় লেগে আছে শুকনো ময়দায়। ভ্যাকুম ক্লিনার দিয়ে উনুন দুটোর ভেতরের সবকিছু টেনে নিয়ে ঢোকানো হল দুটো প্লাস্টিক ব্যাগে।

আগাগোড়া একটা টেপরেকর্ডার চলতে লাগল কর্নেল ডিসুজার বেল্টে। বৈজ্ঞানিকরা কাজ করছে— যা করছে, তা মুখে মুখে বলে যাচ্ছে। সব টেপ রেকর্ডারে উঠে যাচ্ছে। দৈবাৎ যদি এই দল খতম হয়ে যায়, পরবর্তী দল যেন জানতে পারে আগের ঘটনা।

এরপর যাওয়া হল রোগাটে ধরনের সেই বাড়িটায় যার একতলায় রয়েছে ছবি আর গিফটের দোকান।

রান্নাঘরে রয়েছে সেই মৃতদেহটা। ফ্রিজ খুলে রেখে হেলে রয়েছে ফ্রিজের গায়ে। ফুলে ঢোল শরীর। প্যাটপেটে শূন্য চাহনি।

ডিসুজা হুকুম দিলেন, ময়না তদন্ত করার জন্যে এই লাশ নিয়ে যাওয়া হোক।

বিড়বিড় করে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘যে তদন্তই করুন না কেন, নার্ভ গ্যাসের সন্ধান পাবেন না। কোনও নার্ভ গ্যাসই শরীর ফুলিয়ে এরকম অবস্থা করে না।’

‘অ্যালার্জির জন্যেও হতে পারে। নার্ভ গ্যাসের অ্যালার্জি,’ কর্নেল ডিসুজা অম্লানবদনে এই কথা বলে ঢুকে গেলেন পাশের ঘরে, যে-ঘরে খাটে শুয়ে পয়েন্ট টু-টু অটোমেটিকে গুলিবর্ষণ করে গেছে পঁচিশ বছরের যুবক। আটটা গুলি লাগিয়েছে আততায়ীর গায়ে, অথচ রক্তপাত ঘটেনি।

বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘নার্ভ গ্যাস লক্ষ করে নিশ্চয় গুলিবর্ষণ করে যায়নি?’

‘গ্যাস নিশ্চয় ব্রেন বিগড়ে দিয়েছিল—দৃষ্টিবিভ্রম ঘটেছিল, ছায়াশরীর দেখেছে বিকল ব্রেনের কারসাজিতে। গুলি চালিয়েছে এলোপাতাড়ি।’

‘তাহলে আটটা কার্তুজ গেল কোথায়? ছায়াশরীরের গায়ে?’

‘আটখানা গুলি হজম করে হেঁটে বেরিয়ে যেতে পারে যে, সে কে কর্নেল ডিসুজা?’ মাধবীর স্বর এখনও কঠিন।

নিরুত্তর রইলেন কর্নেল। তাঁর সঙ্গীদের চোখে আতঙ্ক জাগছে একটু একটু করে। যুবকের মুখভাব অতিশয় বিকট—মরে গিয়েও ত্রাস বিকিরণ করে যাচ্ছে।

ফুলে ওঠা বডি দুটোকে প্লাস্টিক ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গিয়ে সুরেশ সাইকিয়ার মুখে সব শুনলেন কর্নেল ডিসুজা।

বললেন, ‘আপনারা প্রত্যেকেই হ্যালিউসিনেশনে ভুগছেন। আগে আপনাদের পরীক্ষা করা দরকার।’

‘এতগুলো মানুষ কি একই সঙ্গে একই হ্যালিউসিনেশন দেখছে?’ মাধবী বললে কড়া গলায়।

‘ডাক্তার, মাস হলিউসিনেশন নতুন ব্যাপার কি?’

‘কয়েক সেকেণ্ডে অন্ধকারে মধ্যে রমেশ থাপা অদৃশ্য হয়ে গেল কী করে?’ সুরেশ সাইকিয়ার প্রশ্ন।

‘পালিয়েছে। শহর ছেড়ে পালিয়েছে,’ কর্নেলের জবাব।

‘শচীনের অবস্থা অমন হল কেন? ডেডবডি উধাও হয়ে গেল কিভাবে?’

‘মাস হ্যালিউসিনেশন।’

ঠিক এই সময়ে ঠক ঠক আওয়াজ শোনা গেল মাংস রাখার লকারের (কোল্ড স্টোরেজের) মধ্যে। ভেতরে থেকে কে যেন হাতুড়ি ঠুকে চলছে। সেই সঙ্গে শোনা গেল রমেশ থাপার কাতরানি, ‘উঃ! আর যে পারছি না! কী ঠাণ্ডা! কী ঠাণ্ডা! খুলুন—পাল্লাটা খুলুন।’

 থ হয়ে গেলেন সুরেশ সাইকিয়া। চোখের পাতা পড়ল না মাধবীর। কটমট করে চেয়ে রইলেন কর্নেল ডিসুজা।

বললেন, ‘ভেতরে কে?’

জবাবটা এল লকারের ভেতর থেকেই, ‘আমি… রমেশ থাপা।’

‘ভেতরে ঢোকা হল কী করে?’

‘আমিই লুকিয়ে পড়েছিলাম, আর বেরোতে পারছি না।’

‘ঠাণ্ডায় তো এতক্ষণে মরে যাওয়া উচিত ছিল।’

‘বরফ জমানোর ঠাণ্ডা তো নেই… উ… হু হু… খুলুন-না পাল্লাটা।’

চোখের ইঙ্গিত করলেন কর্নেল। এগিয়ে গেল দু’জন হেলমেট পরা সান্ত্রী। রুখে দাঁড়ালেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘খুলবেন না।’

‘জ্যান্ত একটা লোককে মেরে ফেলতে চান?’ কর্নেল এখন প্রকৃতই মিলিটারি রুক্ষতা দেখাচ্ছেন।

‘কেউ নেই লকারে। গত রাতে আমি নিজে খুলে চেক আপ করেছি।’

‘তাহলে রমেশ থাপা ভেতরে গেল কী করে?’

‘ওটা রমেশ থাপা নয়।’

‘ননসেন্স। খোলো পাল্লা!’

একজন সান্ত্রী সাবমেশিন গান উচিয়ে দাঁড়ালো পাল্লার এক পাশে, আর একজন এক হাতে অস্ত্র বাগিয়ে আর এক হাত রাখল পাল্লার হ্যাণ্ডেলে।

 আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না সুরেশ সাইকিয়া। চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘প্লীজ! প্লীজ! পাল্লা খুলবেন না।’

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই কিন্তু পাল্লার হ্যাণ্ডেল আপনা থেকেই নেমে গেল নিচের দিকে। অথচ সান্ত্রীর হাতের চাপ তখনও পড়েনি হ্যাণ্ডেলে। নিমেষে খুলে গেল পাল্লা। লকলকে কালো বিদ্যুৎশিখার মতন কী যেন ফাঁক দিয়ে ঠিকরে এসে পাকসাট দিল সান্ত্রীকে। পলক ফেলার আগেই তাকে এক হ্যাঁচকা টানে সাবমেশিন গান সমেত টেনে নিয়ে গেল ভেতরে। দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল পাল্লা।

প্রকৃতই হতভম্ভ হয়ে গেলেন কর্নেল ডিসুজা এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। লকারের ভেতর থেকে ভেসে এল দুমদাম শব্দ। যেন ঠিকরে ঠিকরে গিয়ে লকারের গায়ে আছড়ে আছড়ে পড়ছে সান্ত্রীর দেহ। ভেতরটা তো অনেক বড়। আট ফুট বাই ন’ফুট। গুলিবর্ষণও চলছে অবিরাম। তারপর সব চুপ।

ঢোক গিললেন কর্নেল ডিসুজা। বিমূঢ় চোখে তাকালেন সুরেশ সাইকিয়ার দিকে। ভাবখানা, ‘এখন কী করব?’

জবাব দিলেন সুরেশ শুষ্ককণ্ঠে, ‘সব ক’টা সাবমেশিনগান তাক করুন, তারপর পাল্লা খুলুন। সাবধান, এরপর কী ঘটতে পারে, আমার জানা নেই।’

ফের ঢোক গিললেন কর্নেল। কাজ হল অবশ্য সুরেশ সাইকিয়ার নির্দেশ মতোই। খোলা হল পাল্লা। ভেতরে জ্বলছে আলো। ছাদ থেকে ঝুলছে সান্ত্রীর দেহ—মাংস গেঁথে রাখার আঁকশি দিয়ে গাঁথা হয়েছে তার দেহ।

কিন্তু ঝুলছে শুধু তার কঙ্কাল। কঙ্কাল পরে আছে হেলমেট আর বিচিত্র পোশাক। এমনকী পায়ের মজবুত বিশেষ বুটজুতোও।

লকারের মেঝেতে পড়ে নেই একফোঁটা রক্ত! খালি কার্তুজের কিছু খোল গড়াগড়ি যাচ্ছে মেঝেতে। সীসের বুলেট কিন্তু পড়ে নেই কোথাও। যার দিকে ছোঁড়া হয়েছে গুলি, যেন তার গায়ে লেগেছে এবং স্রেফ হজম করেছে।

চকচকে খোলগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘ক’টা গুলি ছিল অতবড় ম্যাগাজিনে? দু’শো?’

চোখ বড় বড় করে খালি খোলগুলোর দিকে চেয়ে রইলেন কর্নেল ডিসুজা। কথা বললেন না।

বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘খামোকা সময় নষ্ট করছেন। এটা নার্ভ গ্যাসের কেস নয়। আপনাকে সেই শিক্ষা দেওয়ার জন্যে আপনারই লোককে খতম করা হল তিল তিল করে। তাকে নিমেষে শেষ করে দিতে পারত, ভ্যানিশ করেও দিতে পারত। কিন্তু চোখে না দেখলে আর কানে না শুনলে তো আপনার বিশ্বাস হবে না। তাই গুলি ছোঁড়ার সুযোগ তাকে দেওয়া হয়েছে, গুলিবর্ষণের শব্দও আপনাকে শোনানো হয়েছে। তারপরেই দেহ চাঁছাপোছা হয়ে গেল কী করে? কোন ম্যাজিকে? সীসের গুলিগুলো গেল কার গায়ে? কর্নেল ডিসুজা, নার্ভ গ্যাস নয়, অপদেবতাও নয়, আরও ভয়ঙ্কর অশ্রুতপূর্ব কিছুর রাজত্ব শুরু হয়েছে শিবালয় শহরে। তাদের হাতে আমরা খেলনার পুতুল ছাড়া আর কিছু নই।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কর্নেল বললেন, ‘কিন্তু রমেশ থাপার গলা তো আপনি চিনতে পেরেছিলেন?’

‘গলা নকল করা হয়েছে, যেমন টেলিফোনে শচীনের গলা শুনেছেন ডক্টর লাহা। জন্তু-জানোয়ারদের গলাবাজিও পুরো নকল।’

‘তাহলে তো বলব অতিপ্রাকৃত ব্যাপার।’

‘আমি বলব ঠিক উল্টো, একেবারে প্রাকৃতিক বাস্তব ঘটনা।’

‘তাহলে বলুন সেটা কী?’

‘জানলে তো বলব?’ তেতো হয়ে গেল সুরেশ সাইকিয়ার গলা। ‘জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবরেটরি থেকে হয়তো কোনও ন্যাচারাল মিউটেশন বেরিয়ে পড়েছে। কিছু জানোয়ারের ডিএনএ থেকে এমন দানব বানিয়েছে যারা ভূতের মতন অদৃশ্য থেকে গোটা আর্মি নিকেশ করে দিতে পারে—বাতাসে মিলিয়ে দিতেও পারে। টারানটুলা আর কুমির, ভিমরুল আর বাঘ—এদের ডিএনএ স্ট্রাকচার মিলিয়ে মিশিয়ে একটা কল্পনাতীত সত্তা বানিয়ে তার মধ্যে মানুষের বুদ্ধি হয়তো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কী ভাবছেন, আমি পাগল হয়ে গেছি? ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের আধুনিক সংস্করণ দেখছেন মনে হচ্ছে? ডিএনএ রিসার্চ কদ্দূর গড়িয়েছে, সে খবর আপনিও তো রাখেন কর্নেল। এক কথায় তাই বলব, এমন এক অজানা শক্তির সঙ্গে মহড়া দিতে নেমেছি, যে শক্তি আমাদের যাবতীয় দুঃস্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে।’

ঢোক গিলে বললেন কর্নেল ডিসুজা, ‘প্রথমে ডেডবডিটার ময়না তদন্ত তো করা যাক—’

‘ঝটপট করুন,’ বললে মাধবী, ‘সময় ফুরিয়ে আসছে।’

লকারের মধ্যে যে ব্যক্তি নিমেষে কঙ্কালে পরিণত হল, তার নাম সার্জেন্ট জোশী।

এখন যাকে ম্যানহোল দিয়ে রাস্তার তলার পাইপে নামানো হল, তার নাম করপোরাল রহমান। লোহার মই নেমে গেছে নিচ পর্যন্ত। পাইপ কিন্তু শুকনো, জল যায় না এখান দিয়ে, জলের ড্রেন-পাইপ আলাদা।

এ পাইপ দিয়ে গেছে ইলেকট্রিকের গোছা গোছা তার। আধুনিক শহর। টেলিফোন, ল্যাম্পপোস্ট অথবা বাড়ির ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের তার শূন্যে ঝোলে না—সবই রাস্তার তলা দিয়ে, এই পাইপের মধ্যে দিয়ে।

শুকনো খটখটে পাইপে মাথা সিধে করে দাঁড়ানো যায় না, কর্পোর‍াল রহমানকেও দাঁড়াতে হল সেইভাবে। মাথার মধ্যে ঘুরছে কিন্তু সেই দুশ্চিন্তা। সার্জেন্ট জোশী অত গুলি চালিয়েও আচমকা কঙ্কাল হয়ে গেল কী করে?

কংক্রিট মেঝেতে দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বেলে চারিদিক দেখে নিল রহমান। একটু ভিজে ভিজে ভাব। দেওয়ালে ছাতা ধরেছে। তারের গোছা পাতা রয়েছে পলিথিন পাইপের মধ্যে দিয়ে।

সিঁড়ির তলা থেকে সরে এল রহমান। সিঁড়ি বেয়ে এখন নামছে আব্দুল করিম। কর্নেল ডিসুজার আর এক ডাকাবুকো স্যাঙাৎ। কংক্রিট মেঝেতে পা দিতেই রহমান টর্চের আলোয় তাকে দেখিয়ে দিল ভয়ের কিছু নেই পাতাল-সুড়ঙ্গে।

বুক কাঁপছে কিন্তু আবদুলেরও। সার্জেন্ট জোশীর কঙ্কাল কলেবর সে-ও দেখেছে।

ইলেকট্রিক কেবল নেমে এল ওপর থেকে। এই কেবল টেনে নিয়ে গিয়ে নামিয়ে দিতে হবে ইলেকট্রিক জাংশন বক্সে—যা রয়েছে একটু দূরে শিবালয় সড়কের তলার টানেলের ক্রশিংয়ে।

দু’পাশে টর্চ ফেলতে ফেলতে এগোচ্ছে দুই জওয়ান। কিম্ভূত পোশাক তাদের চলায় মন্থরতা এনে দিচ্ছে। টর্চের ফোকাস যতদূর যায়—ভয় পাওয়ার মতন কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।

এসে গেছে ইলেকট্রিক জাংশন বক্স। শিবালয় সড়কের নিচের সুড়ঙ্গ কিন্তু সমান্তরাল নয়। নিচের দিক থেকে উঠে গেছে ওপর দিকে। যেন নরক থেকে উঠছে স্বর্গে।

খসখস… খসখস… খড়মড় খড়মড় আওয়াজটা শোনা গেল ঠিক তখনই। গুরুভার ডেকন স্যুট পরে শব্দের দিকে তাকিয়ে এবং টর্চ মেরেই থ হয়ে গেল দুজনেই!

পালে পালে জন্তু উল্কাবেগে ধেয়ে আসছে শিবালয় সড়কের পাতালের দিক থেকে! খসখস খড়মড় আওয়াজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাদের ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ের দরুন ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ। এ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই। কারও কণ্ঠ চিরে ঠিকরে আসছে না পাশবিক গজরানি।

তারা ধেয়ে আসছে নক্ষত্ৰবেগে ক্রশিংয়ের দিকে। প্রত্যেকেই সোজা চেয়ে রয়েছে সামনে… টানেল যেখানে ওপর দিকে উঠে গেছে সেইদিকে। কারোরই চাহনি নিবদ্ধ নয় দুই আগন্তুকের ওপর।

ওরা সরে এল পেছনের টানেলে—যে টানেল দিয়ে এসেছে সেইখানে।

নিমেষে ক্রশিং পেরিয়ে গেল ধাবমান পশুবাহিনী। শ’য়ে শ’য়ে পশু। ধেয়ে আসছে স্রোতের আকারে, রকমারি কুকুর বেড়াল—কিন্তু ঘেউ ঘেউ অথবা মিউ মিউ করছে না। আসছে কাঠবেড়ালি, খরগোশ। শিয়াল আর বেজি। ইঁদুর আর ছুঁচো। নেকড়ে আর বুনো বেড়াল।

 রেডিওতে খবরটা দিয়ে দিল রহমান কর্নেল ডিসুজাকে। বললে, ‘পশুনদী দেখছি যেন, কিন্তু তেড়ে আসছে না। পাগলের মতন ছুটছে টানেলের ওপর দিকে।’

বলা শেষ হতে না হতেই এসে গেল সাপ। হাজারে হাজারে সাপ। জন্তুদের পাশে পাশে ধেয়ে আসছে। লম্বা কালো সাপ থেকে খুদে সবজেটে সাপ—সর্প বাহিনীর সব প্রজাতি হাজির এই প্রতিযোগিতায়।

কোনও সাপই দেখছে না দুই আগন্তুককে। তাদের শীতল চাহনি নিবদ্ধ সামনের দিকে—সুড়ঙ্গ যেদিকে একটু একটু করে উঠে গেছে ওপর দিকে—সেইদিকে।

রক্ত-জল করা হুঙ্কারটা আচম্বিতে ভেসে এল সেইদিক থেকেই।

মানুষের আর্তনাদ তাকে বলা যায় না, পাশবিক গজরানিও নয়। অথচ তা নিঃসৃত হচ্ছে সজীব কোনও কণ্ঠ চিরে। রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে সেই চিৎকারে। অথচ তার মধ্যে নেই আতঙ্ক অথবা যন্ত্রণা। ক্রোধ, ঘৃণা আর রক্ততৃষ্ণা ফেটে পড়ছে অমানবিক, অপাশবিক সেই বিকট নিনাদের মধ্যে।

লোম-খাড়া করা সেই চিৎকারের উৎস কাছাকাছি কোথাও নয়। অনেক দূর থেকে—পাহাড়ের ওপর দিক থেকে কল্পনাতীত সেই চিৎকার অন্তরের সমস্ত বিদ্বেষ, বিতৃষ্ণা, আক্রোশ উজাড় করে দিচ্ছে—এক-একটা ভয়াল হুঙ্কারের মধ্যে দিয়ে। সে কিন্তু থেমে নেই এক জায়গায়। বিপুল বেগে ধেয়ে আসছে এই দিকেই। তাই মুহুর্মুহু সুড়ঙ্গ প্রকম্পিত হচ্ছে, উচ্চ থেকে উচ্চতর মাত্রায়। দ্রুত, অতিদ্রুত লোমহর্ষক নিনাদের স্রষ্টা নিকটবর্তী হয়েই চলেছে। কানের মধ্যে দিয়ে যেন গোছ গোছ শলাকা ব্রেনের মধ্যে গেঁথে গেঁথে যাচ্ছে—অসাড় করে তুলছে মস্তিষ্ককে। একটু পরেই শোনা গেল গুরুভার শরীরের পদধ্বনি। ধুপধাপ আওয়াজে কাঁপছে সুড়ঙ্গ। অথচ মন্থর সে নয় মোটেই, বিপুলাকার কলেবরকে উড়িয়ে নিয়ে আসছে বিদ্যুৎসম গতিবেগে।

রহমান আর আবদুলের দুজনেরই মনে হল, স্বয়ং শয়তানও বুঝি এমন অপার্থিব হুক্কার সৃষ্টি করতে পারবে না সমগ্র শয়তানি বিদ্বেষ উজাড় করে দিয়েও। সুতরাং আর দেরি করা যায় না।

রহমান আগে ছুটল লোহার সিঁড়ির দিকে। জবরজং পোশাক নিয়ে লম্বা লাফ তো দেওয়া যাচ্ছে না। পেছনে আগুয়ান পাতাল-কাঁপানো পদধ্বনি আর কণ্ঠনিঃসৃত হুঙ্কার শুনতে শুনতে মইয়ের সামনে পৌঁছেই আগে উঠে গেল নিজে। পেছনে খানিকটা উঠেই পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিল আবদুল, হাত বাড়িয়ে তার হাত খামচে ধরল রহমান। কিন্তু ধরে রাখতে পারল না…

হ্যাঁচকা টানে আবদুল করিম ছিটকে গেল মই থেকে টানেলের অন্ধকারে। অন্ধকারের আতঙ্ক তার নাগাল ধরে ফেলেছে…