» » আদিম আতঙ্ক

বর্ণাকার

অদ্রীশ বর্ধন

আদিম আতঙ্ক

নয়

ভুজঙ্গ বোনাৰ্জী কলকাতায় এসেছেন দিল্লি থেকে বিজনেসের ব্যাপারে।

এখন সকাল আটটা। দিনটা বড় বিষন্ন ধূসর মেঘ ভেসে যাচ্ছে শহরের ওপর দিয়ে। ভোর থেকেই ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিও চলছে। ভিজে গাছগুলোর ডালপালা নেতিয়ে নিঝুম। ফুটপাত দিয়ে যারা হাঁটছে, তাদের সবার মাথায় ছাতা।

রকফেলার হোটেলের জানলার কাচে বৃষ্টি আছড়ে পড়ে গড়িয়ে নামছে। ডাইনিং রুম থেকে দেখা যাচ্ছে না বাইরের দৃশ্য।

জানলার কাছের টেবিলে বসে আছেন ভুজঙ্গ বোনার্জী। ব্রেকফাস্ট বিলের কৈফিয়ৎ দেবেন কিভাবে ম্যানেজমেন্টকে—তাই ভাবছেন। যে অতিথির আপ্যায়নের জন্যে এলাহি খাবার-দাবারের অর্ডার দিয়েছেন, তাঁর অর্ডার দেওয়া এখনও শেষ হয়নি।

ডক্টর উতঙ্ক চৌধুরী বসে আছেন টেবিলের ওদিকে। ভুজঙ্গ বোনার্জী তাজ্জব হয়েছেন ওঁর খিদের বহর দেখে। উতঙ্ক চৌধুরীর চশমার ব্রিজ ভেঙে গেছিল—ঝালাই করা হয়েছে। নিশ্চয় নিজেই করেছেন, পয়সা বাঁচানোর জন্যে। দক্ষ মিস্ত্রীর হাতে পড়লে ঝালাই দেখা যেত না। বয়স আটান্ন, কিন্তু বেশি বুড়িয়েছেন। সাদা চুল কানের ওপর লতিয়ে নেমেছে। ঘাড় সরু, চামড়ায় অজস্র ভাঁজ। শরীরে হাড় আর তরুণাস্থি বেশি—মাংস কম। এত যে অর্ডার দিলেন, সব খাবার খেতে পারবেন কি না সন্দেহ।

কিন্তু তিনি খেয়েই যাচ্ছেন। খেতে খেতেই শুধোলেন ভুজঙ্গ বোনার্জীকে, ‘দিল্লি থেকে উড়ে এলেন শুধু আমার সঙ্গে কথা বলতে? প্লেন ফেয়ার তো সাড়ে চার হাজার, তাই না?’

‘শুধু আপনার সঙ্গে নয়, আরও কয়েকজন লেখকের সঙ্গে কথা বলব,’ অমায়িক গলায় বললেন ভুজঙ্গ। ‘বইয়ের বাজার মার খাচ্ছে। বৈচিত্র দরকার। লেখকের নাম নয়, চাই বিষয়।’

‘তার মানে, বিষয়ের কথা ভেবেই এসেছেন আমার কাছে?’

‘আপনার “আদিম শত্রু” বইটা আমি পড়েছি। প্রথম সংস্করণ। অসাধারণ।’

‘অসাধারণই বটে।’ বিষন্ন এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল ডঃ চৌধুরীর ওষ্ঠে। ‘ওই বই প্রকাশ পাওয়ার আঠারো মাসের মধ্যে শেষ হয়ে গেলাম আমি। গণ্যমান্য পণ্ডিতরা রায় দিলেন আমার থিয়োরিগুলো নাকি অবাস্তব, বিজ্ঞানসম্মত নয়। জোর করে উত্তেজনা সৃষ্টি করে আমি নাকি সাধারণ মানুষের কাছে রাতারাতি বিখ্যাত হতে চাইছি। ঘরে-বাইরে জুটল কেবল বিদ্রুপ আর অবজ্ঞা। বাধ্য হয়ে ইউনিভার্সিটির চাকরিটা ছাড়তে হল। ভাবলাম কোপারনিকাসকেও তো একদিন উপহাস করেছিল লোকে। গ্রহ-তারা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে বলেছিলেন বলে চার্চের রোষের শিকার হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরে জানা গেল তাঁর কথাই ঠিক।

কফিতে চুমুক দিলেন ভুজঙ্গ। বললেন, ‘আপনার থিয়োরি এখনও চালু আছে বলে কি মনে হয় আপনার?’

‘নিশ্চয়। ইতিহাস হাতড়ালেই দেখবেন, অজস্র রহস্যময় অন্তর্ধানের কোনও সমাধান যুগিয়ে উঠতে পারেনি ঐতিহাসিক আর প্রত্নতত্ববিদ পণ্ডিতরা।’

টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়লেন উতঙ্ক চৌধুরী। ঝোপের মতন পুরু ভুরুর নিচে ছলছলে চক্ষুযুগলে যেন সম্মোহনী শক্তি জাগ্রত করলেন। বললেন, ‘১৯৩৯ সালে দশই ডিসেম্বর নানকিং পাহাড়ের বাইরে দশ হাজার চীনে সৈন্য অদৃশ্য হয়ে গেছিল। কোনও চিহ্ন রেখে যায়নি। যুদ্ধ করেও মরেনি। একটা দেহও দেখতে পাওয়া যায়নি। জাপানিজ মিলিটারি ঐতিহাসিকরা এই দশ হাজার সৈন্যের আর কোনও হদিস পায়নি। স্রেফ ভ্যানিশড। যেখান দিয়ে গেছিল এই দশ হাজার সৈন্য, সেখানকার চাষারাও তাদের যাওয়ার আওয়াজ শোনেনি। একটা বন্দুক ছোঁড়ার আওয়াজও পায়নি, স্রেফ বাতাসে মিশে গেল গোটা একটা আর্মি। আবার দেখুন, ১৭১১ সালে স্প্যানিশ যুদ্ধে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল চার হাজার সৈন্যের একটা বাহিনী!’

জ্বলজ্বল করছে প্রফেসরের চোখ। বইতে লেখা প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন দেখতে পাচ্ছেন, ‘মায়া শহরে একই কাণ্ড ঘটেছে আরও ব্যাপকভাবে। শুধু একটা শহরে নয়—শহরের পর শহরে। হাজারে হাজারে, লাখে লাখে শহর ছেড়ে চলে গেছে আন্দাজ ৬১০ খ্রিস্টাব্দে। খুব সম্ভব এক সপ্তাহের মধ্যে—একদিনেই, কেউ পালিয়েছে উত্তরে—নতুন শহরের পত্তন ঘটিয়েছে। তবে অসংখ্য মানুষ যে অদৃশ্য হয়ে গেছে, সে প্রমাণও আছে। রান্নার বাসনপত্র পর্যন্ত নিয়ে যায়নি। উর্বর জায়গা পেলে মানুষ সেদিকে চলে যায় ঠিকই, কিন্তু দরকারি জিনিসপত্র ফেলে যাবে কেন? ফেলে গেলে, পরে এসে নিয়ে যায়নি কেন? কয়েকটা শহর দেখা গেছে, খাবার সাজিয়ে বসেছিল কিন্তু না খেয়ে চলে গেছে। একমাত্র আমার থিয়োরি ছাড়া আর কোনও থিয়োরি দিয়ে অদ্ভুত এই ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা করা যায় না।’

‘শুনেও তো ভয় লাগছে,’ বলেলেন ভুজঙ্গ।

‘লাগবেই তো।’

আর কোনও কথা না বলে খাবার নিয়ে তন্ময় হয়ে রইলেন প্রফেসর। যেন, দীর্ঘদিন ভাল জায়গায় ভাল খাবার-দাবার জোটেনি।

তারপর শুরু করলেন, ‘পৃথিবীতে যত রকম রহস্যজনক অন্তর্ধান ঘটেছে, সব ক’টার ব্যাখ্যা আমার এই একটা থিয়োরি দিয়ে করার চেষ্টা করেছিলাম। সেটাই অন্যায় করেছিলাম। আর কিচ্ছু করিনি। লাখে লাখে মানুষ আর ইতর জীব রাতারাতি কেন শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে—তার যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মরেছি।’

ভুজঙ্গ বললেন, ‘আপনার বই পাবলিশড হওয়ার পর সেরকম ঘটনা আর ঘটেছে?’

‘ঘটেছে, ঘটেছে, ভ্যানিশ হওয়ার ঘটনা আবার ঘটেছে।’

‘সে কী! তাহলে তো খবরের কাগজে তা ছাপা হত!’

‘হয়নি তো কী করব! তবে দুটো ঘটনার খবর আমি জানি। একটা খবর ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছিল নিউজ পেপারে— কেননা অদৃশ্য হয়েছিল মাছ— মানুষ নয়। আমি জেনেছিলাম সায়েন্টিফিক জার্নালে। বছর আষ্টেক আগে প্রশান্ত মহাসাগরের একটা অঞ্চলে বেশ কয়েক প্রজাতির মাছ নাটকীয়ভাবে কমে যায়। সংখ্যায় অর্ধেক হয়ে যায়।’

‘জলদূষণ,’ বললেন ভুজঙ্গ।

‘কয়েকশো বর্গমাইল জুড়ে জলদূষণ ঘটা সহজ নয়। সেরকম কোনও পদার্থও আবিষ্কার করা যায়নি। তা ছাড়া, মরা মাছগুলো তীরে ভেসে আসেনি, স্রেফ অদৃশ্য হয়ে গেছিল। চিহ্ন না রেখে।’

উত্তেজিত হলেন ভুজঙ্গ বোনার্জী। টাকার গন্ধ পেলেন। ভদ্রলোকের নাকে বেস্টসেলারের গন্ধ ঠিক ধরা পড়ে—আজও ভুল হয়নি। উতঙ্ক চৌধুরীকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, “আদিম শত্রু” বইটার শুষ্কতা পরিহার করে সরসভাবে সাধারণ পাঠকের জন্যে লিখতে হবে, এবং অবশ্যই ইংরেজি ভাষায়। নাম দেবেন “দি অ্যানসিয়েন্ট এনিমি”। ওয়ার্ল্ড মার্কেট অবধারিত।

মুখে বললেন, ‘আর একটা কেস কী?’

‘১৯৮০-তে ঘটেছিল আফ্রিকায়। মধ্য আফ্রিকার একটা দুর্গম জায়গা থেকে বাতাসে মিলিয়ে গেছিল তিন-চার হাজার জংলি মানুষ। গ্রাম খালি, জিনিসপত্র যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে, খাবারদাবার পর্যন্ত। যেন, সব ফেলে দিয়ে হঠাৎ পালিয়েছে জঙ্গলে। খানকয়েক মাটির পাত্র শুধু ভাঙা অবস্থায় পাওয়া গেছিল। রাজনৈতিক কারণে গণহত্যা হয় ওই অঞ্চলে। সেক্ষেত্রে লাশ পড়ে থাকে। এ গ্রামে তা নেই। কয়েক সপ্তাহ পরে জানা গেল, ওই অঞ্চলে জন্তু জানোয়ারের সংখ্যাও অবিশ্বাস্যভাবে কমে গেছে। দুটো ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র আছে, কিন্তু কারুর মাথায় তা আসেনি।’

‘আপনি কিছু জানেন?’

‘আঁচ করেছি।’

‘অদৃশ্য হওয়ার ঘটনাগুলো কিন্তু ঘটছে বহু দূরের অঞ্চলে—যাচাই করা কঠিন।’

‘ঠিক। বেশির ভাগ ঘটনা ঘটছে সমুদ্রে— কেননা, ভূগোলকের সবচেয়ে বেশি জায়গা জুড়ে আছে সমুদ্র। চাঁদ যেমন নাগালের বাইরে, সমুদ্রও তাই। আর, সমুদ্রের তলায় কী ঘটছে, তা তো জানার বাইরে।’

‘আপনার কি মনে হয়, সভ্য দুনিয়ায়, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এমন ঘটনা আজও ঘটতে পারে?’

‘নিঃসন্দেহে।’

‘কলকাতায় বা দিল্লিতে?’

‘নিশ্চয়। আমার বইতে ভূত্বকের নিচে কোথায় এমন জায়গা রয়েছে, তার ম্যাপ এঁকে দেখিয়ে দিয়েছি।’

সার্সির গায়ে আরও জোরে আছড়ে পড়ল বৃষ্টি।

উতঙ্ক চৌধুরীর থিয়োরী বিশ্বাস করেননি ভুজঙ্গ বোনার্জী। তবে বুঝেছিলেন, এই বিষয়ের বইয়ের কাটতি আছে।