» » ষড়্‌বিংশতিতম অধ্যায়-দয়া

গুরু। ভক্তি ও প্রীতির পর দয়া। আর্ত্তের প্রতি যে বিশেষ প্রীতিভাব, তাহাই দয়া। প্রীতি যেমন ভক্তির অন্তর্গত, দয়া তেমনই প্রীতির অন্তর্গত। যে আপনাকে সর্ব্বভূতে এবং সর্ব্বভূতকে আপনাতে দেখ, সে সর্ব্বভূতে দয়াময়। অতএব ভক্তির অনুশীলনেই যেমন প্রীতির অনুশীলন, তেমনই প্রীতির অনুশীলনেই দয়ার অনুশীলন। ভক্তি, প্রীতি, দয়া, হিন্দুধর্ম্মে এক সূত্রে গ্রথিত-পৃথক্ করা যায় না। হিন্দুধর্ম্মের মত সর্ব্বাঙ্গসম্পন্ন ধর্ম্ম আর দেখা যায় না।
শিষ্য। তথাপি দয়ার পৃথক্ অনুশীলন হিন্দুধর্ম্মে অনুজ্ঞাত হইয়াছে।
গুরু। ভূরি ভূরি, পুনঃ পুনঃ। দয়ার অনুশীলন যত পুনঃ পুনঃ অনুজ্ঞাত হইয়াছে, এমন কিছুই নহে। যাহার দয়া নাই, সে হিন্দুই নহে। কিন্তু হিন্দুধর্ম্মের এই সকল উপদেশে দয়া কথাটা তত ব্যবহৃত হয় নাই, যত দান শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। দয়ার অনুশীলন দানে, কিন্তু দান কথাটা লইয়া একটা গোলযোগ ঘটিয়াছে। দান বলিলে সচরাচর আমরা অন্নদান, বস্ত্রদান, ধনদান ইত্যাদিই বুঝি। কিন্তু দানের এরূপ অর্থ অতি সঙ্কীর্ণ দানের প্রকৃত ত্যাগ। ত্যাগ ও দান পরস্পর প্রতিশব্দ। দয়ার অনুশীলনার্থ ত্যাগ শব্দও অনেক স্থানে ব্যবহৃত হইয়াছে। এই ত্যাগ অর্থে কেবল ধনত্যাগ বুঝা উচিত নহে। সর্ব্বপ্রকার ত্যাগ-আত্মত্যাগ পর্য্যন্ত বুঝিতে হইবে। অতএব যখন দানধর্ম্ম আদিষ্ট হইযাছে, তখন আত্মত্যাগ পর্য্যন্ত ইহাতে আদিষ্ট হইল বুঝিতে হইবে। এইরূপ দানই যথার্থ দয়ার অনুশীলনমার্গ। নহিলে তোমার অনেক টাকা আছে, তাহার অত্যল্পাংশ তুমি কোন দরিদ্রকে দিলে, ইহাতে তাহাকে দয়া করা হইল না। কেন না, যেমন জলাশয় হইতে এক গণ্ডূষ জল তুলিয়া লইলে জলাশয়ের কোন প্রকার সঙ্কোচ হয় না, তেমনি এইরূপ দানে তোমারও কোন প্রকার কষ্ট হইল না, কোন প্রকার আত্মোৎসর্গ হইল না। এরূপ দান যে না করে, সে ঘোরতর নরাধম বটে, কিন্তু যে করে, সে একটা বাহাদুর নয়। ইহাতে দয়া বৃত্তির প্রকৃত অনুশীলন নাই। আপনাকে কষ্ট দিয়া পরের উপকার করিবে, তাহাই দান।
শিষ্য। যদি আপনিই কষ্ট পাইলাম, তবে বৃত্তির অনুশীলনে সুখ হইল কৈ? অথচ আপনি বলিয়াছেন-সুখের উপর ধর্ম্ম।
গুরু। যে বৃত্তিকে অনুশীলিত করে, তাহার সেই কষ্টই পরম পবিত্র সুখে পরিণত হয়। শ্রেষ্ঠ বৃত্তিগুলি-ভক্তি, প্রীতি, দয়া; ইহাদের একটি লক্ষণ এই, ইহাদের অনুশীলনজনিত দুঃখ সুখে পরিণত হয়। এই বৃত্তিগুলি সকল দুঃখকেই সুখে পরিণত করে। সুখের উপায় ধর্ম্মই বটে, আর সেই যে কষ্ট, সেও যত দিন আত্ম-পর ভেদজ্ঞান থাকে, তত দিনই লোক তাহাকে কষ্ট নাম দেয়। ফলতঃ ধর্ম্মানুমোদিত যে আত্মপ্রীতি, তাহার সহিত সামঞ্জস্যযুক্ত পরের জন্য যে আত্মত্যাগ, তাহা ঈশ্বরানুমোদিত; এ জন্য নিষ্কাম হইয়া তাহার অনুষ্ঠান করিবে। সামঞ্জস্যবিধি পূর্ব্বে বলিয়াছি।
এক্ষণে দানধর্ম্ম যে ভাবে সাধারণ হিন্দুশাস্ত্রকারদিগের দ্বারা স্থাপিত হইয়াছে, তৎসম্বন্ধে আমার কিছু বলিবার আছে। হিন্দুধর্ম্মের সাধারণ শাস্ত্রকারেরা (সকলে নহে) বলেন, দান করিলে পুণ্য হয়, এজন্য দান করিবে। এখানে “পুণ্য”-স্বর্গাদি কাম্য বস্তু লাভের উপায়। দান করিলে অক্ষয় স্বর্গ লাভ হয়, এই জন্য দান করিবে, ইহাই সাধারণ হিন্দুশাস্ত্রকারের ব্যবস্থা। এরূপ দানকে ধর্ম্ম বলিতে পারি না। স্বর্গলাভার্থ ধন দান দিয়া রাখা মাত্র। ইহা ধর্ম্ম নহে, বিনিময় বা বাণিজ্য। এরূপ দানকে ধর্ম্ম বলা ধর্ম্মের অবমাননা।
দান করিতে হইবে, কিন্তু নিষ্কাম হইয়া দান করিবে। দয়াবৃত্তির অনুশীলন জন্য দান করিবে; দয়াবৃত্তিতে প্রীতিবৃত্তিরই অনুশীলন, এবং প্রীতি ভক্তিরই অনুশীলন; অতএব ভক্তি, প্রীতি, দয়ার অনুশীলন জন্য দান করিবে, বৃত্তির অনুশীলন ও স্ফূর্ত্তিতে ধর্ম্ম, অতএব ধর্ম্মার্থেই দান করিবে, পুণ্যার্থে বা স্বর্গার্থ নহে। ঈশ্বর সর্ব্বভূতে আছেন, অতএব সর্ব্বভূতে দান করিবে, যাহা ঈশ্বরের, তাহা ঈশ্বরকে দেয়, ঈশ্বরে সর্ব্বস্ব দনই মনুষ্যত্বের চরম। সর্ব্বভূতে এবং তোমাতে অভেদ, অতএব তোমার সর্ব্বস্বে তোমার, এবঞ্চ সর্ব্বলোকের অধিকার; যাহার সর্ব্বলোকের, তাহা সর্ব্বলোককে দিবে। ইহাই যথার্থ হিন্দুধর্ম্মের অনুমোদিত, গীতোক্ত ধর্ম্মের অনুমোদিত দান। ইহাই যথার্থ দানধর্ম্ম। নহিলে তোমার অনেক আছে, তুমি ভিক্ষুককে কিছু দিলে, তাহা দান নহে। বিস্ময়ের বিষয়, এমন অনেক লোকও আছে যে, তাহাও দেয় না।
শিষ্য। সকলকেই কি দান করিতে হইবে? দানের কি পাত্রাপাত্র নাই? আকাশের সূর্য্য সর্ব্বত্র করবর্ষণ করেন বটে, কিন্তু অনেক প্রদেশ তাহাতে দগ্ধ হইয়া যায়। আকাশের মেঘ সর্ব্বত্র জলবর্ষণ করেন বটে, কিন্তু তাহাতে অনেক স্থান হাজিয়া ভাসিয়া যায়। বিচারশূন্য দানে কি সেইরূপ আশঙ্কা নাই?
গুরু। দান, দয়াবৃত্তির অনুশীলন জন্য। যে দয়ার পাত্র, তাহাকেই দান করিবে। যে আর্ত্ত, সে-ই দয়ার পাত্র, অপরে নহে। অতএব যে আর্ত্ত, তাহাকে দান করবে-অপরকে নহে। সর্ব্বভূতে দয়া করিবে বলিলে এমন বুঝায়না যে, যাহার কোন প্রকার দুঃখ নাই, তাহার দুঃখমোচনার্থ আত্মোৎসর্গ করিবে। তবে কোন প্রকার দুঃখ নাই, এমন লোকও সংসারে পাওয়া যায় না। যাহার দারিদ্র্যদুঃখ নাই, তাহাতে ধনদান বিধেয় নাই, যাহার রোগদুঃখ নাই, তাহার চিকিৎসা বিধেয় নহে। ইহা বলা কর্ত্তব্য, অনুচিত দানে অনেক সময়ে পৃথিবীর পাপ বৃদ্ধি হয়। অনেক লোক অনুচিত দান করে বলিয়া, পৃথিবীতে যাহারা সৎকার্য্যে দিন যাপন করিতে পারে, তাহারাও ভিক্ষুক বা প্রবঞ্চক হয়। অনুচিত দানে অনেক সময়ে আলস্য, বঞ্চনা, এবং পাপক্রিয়া বৃদ্ধি পাইয়া থাকে, পক্ষান্তরে, অনেকে তাই ভাবিয়া কাহাকেও দান করেন না। তাঁহাদের বিবেচনায় সকল ভিক্ষুকই আলস্যবশতঃই ভিক্ষুক অথবা প্রবঞ্চক। এই দুই দিক্ বাঁচাইয়া দান করিবে। যাহারা জ্ঞানার্জ্জনী ও কার্য্যকারিণী বৃত্তি বিহিত অনুশীলিত করিয়াছে, তাহাদের পক্ষে ইহা কঠিন নহে। কেন না, তাহারা বিচারক্ষম অথচ দয়াপর। অতএব মনুষ্যের সকল বৃত্তির সম্যক্ অনুশীলন ব্যতীত কোন বৃত্তিই সম্পূর্ণ হয় না।
গীতার সপ্তদশ অধ্যায়ে দান সম্বন্ধে ভগবদুক্তি আছে, তাহারও তাৎপর্য্য এইরূপ-
দাতব্যমিতি যদ্দনং দীয়তেহনুপকারিণে।
দেশে কালে চ পাত্রে চ তদ্দানং সাত্ত্বিকং স্মৃতং ||
যত্তু প্রত্যুপকারার্থং ফলমুদ্দিশ্য বা পুনঃ।
দীয়তে চ পরিক্লিষ্টং তদ্দানং রাজসং স্মৃতং ||
অদেশকালে যদ্দানমপাত্রেভ্যশ্চ দীয়তে।
অসৎকৃতমবজ্ঞাতং তত্তামসমুদাহৃতং ||
অর্থাৎ “দেওয়া উচিত, এই বিবেচনায় যে দান, যাহার প্রত্যুপকার করিবার সম্ভাবনা নাই, তাহাকে দান, দেশ কাল পাত্র বিবেচনা করিয়া যে দান, তাহাই সাত্ত্বিক দান। প্রত্যুপকারপ্রত্যাশায় যে দান, ফলের উদ্দেশ্যে যে দান, এবং অপ্রসন্ন হইয়া যে দান করা যায়, তাহা রাজস দান। দেশ কাল পাত্র বিচারশূন্য যে দান, অনাদরে এবং অবজ্ঞাযুক্ত যে দান, তাহা তামস দান।”
শিষ্য। দানের দেশ কাল পাত্র কিরূপে বিচার করিতে হইবে, গীতায় তাহার কিছু উপদেশ আছে কি?
গুরু। গীতায় নাই, কিন্তু ভাষ্যকারেরা সে কথা বলিয়াছেন। ভাষ্যকারদিগের রহস্য দেখ। দেশ কাল পাত্র বিচার করিবে, এ কথাটার বাস্তবিক একটা বিশেষ ব্যাখ্যা প্রয়োজন করে না। সকল কর্ম্মই দেশ কাল পাত্র বিচার করিয়া করিতে হয়। দানও সেইরূপ। দেশ কাল পাত্র বিচার না করিয়া দান করিলে, দান আর সাত্ত্বিক হইল না, তামসিক হইল। কথাটার অর্থ সোজা বুঝিবার জন্য হিন্দুধর্ম্মের কোন বিশেষ বিধির প্রয়োজন করে না। বাঙ্গালা দেশ দুর্ভিক্ষে উৎসন্ন যাইতেছে; মনে কর, সেই সময়ে মাঞ্চেষ্টরে কাপড়ের কল বন্ধ-শিল্পীদিগের কষ্ট হইয়াছে। এ অবস্থায় আমার কিছু দিবার থাকিলে দুই জায়গায় কিছু কিছু দিতে পারিলে ভাল হয়, না পারিলে কেবল বাঙ্গালায় যা পারি দিব। তাহা না দিয়া, যদি আমি সকলই মাঞ্চেষ্টরে দিই, তবে দেশ-বিচার হইল না। কেন না, মাঞ্চেষ্টরে দিবার অনেক লোক আছে, বাঙ্গালায় দিবার লোক বড় কম। কালবিচারও ঐরূপ। আজ যে ব্যক্তির প্রাণ তুমি আপনার প্রাণপাত করিয়া রক্ষা করিলে, কাল হয়ত তাহাকে তুমি রাজদণ্ডে দণ্ডিত করিতে বাধ্য হইবে, তখন সে প্রাণদান চাহিলে তুমি দিতে পারিবে না। পাত্রবিচার অতি সহজ-প্রায় সকলেই করিতে পারে। দুঃখীকে সকলেই দেয়, জুয়াচোরকে কেহই দিতে চাহে না। অতএব “দেশে কালে চ পাত্রে চ” এ কথার একটা সূক্ষ্ম ব্যাখ্যার বিশেষ প্রয়োজন নাই-যে উদার জাগতিক মহানীতি সকলের হৃদয়গত, ইহা তাহারই অন্তর্গত। এখন ভাষ্যকারেরা কি বলেন, তাহা দেখ। “দেশে”-কি না “পুণ্যে কুরুক্ষেত্রাদৌ।” শঙ্করাচার্য্য ও শ্রীধর স্বামী উভয়েই ইহা বলেন। তার পর “কালে” কি? শঙ্কর বলেন, “সংক্রান্ত্যাদৌ” – শ্রীধর বলেন, “গ্রহণাদৌ”। পাত্রে কি? শঙ্কর বলেন, “ষড়ঙ্গবিদ্বেদপারাগ ইত্যাদৌ আচারনিষ্ঠায়”-শ্রীধর বলেন, “পাত্র ভূতায় তপঃব্রতাদিসম্পন্নায় ব্রাহ্মণায়।” সর্ব্বনাশ! আমি যদি স্বদেশে বসিয়া মাসের ‍১লা হইতে ২৯শে তারিখের মধ্যে কোন দিনে, অতি দীনদুঃখী পীড়িত কাতর এক জন মুচি কি ডোমকে কিছু দান করি, তবে সে দান ভগবদভিপ্রেত দান হইল না! এইরূপে কখন কখন ভাষ্যকারদিগের বিচারে অতি উন্নত, উদার এবং সার্ব্বলৌকিক যে হিন্দুধর্ম্ম, তাহা অতি সঙ্কীর্ণ এবং অনুদার উপধর্ম্মে পরিণত হইয়াছে। এখানে শঙ্করাচার্য্য ও শ্রীধর স্বামী যাহা বলিলেন, তাহা ভগবদ্বাক্যে নাই। কিন্তু তাহা স্মৃতিশাস্ত্রে আছে। ভগবদ্বাক্যকে স্মৃতির অনুমোদিত করিবার জন্য সেই উদার ধর্ম্মকে অনুদার এবং সঙ্কীর্ণ করিয়া ফেলিলেন। এই সকল মহাপ্রতিভাসম্পন্ন, সর্ব্বশাস্ত্রবিৎ মহামহোপাধ্যায়গণের তুলনায় আমাদের মত ক্ষুদ্র লোকেরা পর্ব্বতের নিকট বালুকাকণাতুল্য, কিন্তু ইহাও কথিত আছে যে,-
কেবলং শাস্ত্রমাশ্রিত্য ন কর্ত্তব্যো বিনির্ণয়ঃ।
যুক্তিহীনবিচারে তু ধর্ম্মহানিঃ প্রজায়তে || *
বিনা বিচারে, ঋষিদিগের বাক্যসকল মস্তকের উপর এত কাল বহন করিয়া আমরা এই বিশৃঙ্খলা, অধর্ম্ম এবং দুর্দ্দশায় আসিয়া পড়িয়াছি। এখন আর বিনা বিচারে বহন করা কর্ত্তব্য নহে। আপনার বুদ্ধি অনুসারে সকলরেই বিচার করা উচিত। নহিলে আমরা চন্দনবাহী গর্দ্দভের অবস্থাই ক্রমে প্রাপ্ত হইব। কেবল ভারেই পীড়িত হইতে থাকিব-চন্দনের মহিমা কিছুই বুঝিব না।
শিষ্য। তবে এখন ভাষ্যকারদিগের হাত হইতে হিন্দুধর্ম্মের উদ্ধার করা আমাদের গুরুতর কর্ত্তব্য কার্য্য। হ
গুরু। প্রাচীন ঋষি এবং পণ্ডিতগণ অতিশয় প্রতিভাসম্পন্ন এবং মহাজ্ঞানী। তাঁহাদের প্রতি বিশেষ ভক্তি করিবে, কদাপি অমর্য্যাদা বা অনাদর করিবে না। তবে যেখানে বুঝিবে, যে, তাঁহাদিগের ভক্তি ঈশ্বরের অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধ, সেখানে তাঁহাদের পরিত্যাগ করিয়া, ঈশ্বরাভিপ্রায়েরই অনুসরণ করিবে।

—————
* মনু, ১২ অধ্যায়, ১১৩শ শ্লোকের টীকায় কুল্লূকভট্ট-ধৃত বৃহস্পতি-বচন।

Leave a Reply