ভগবদ্গীতা-স্থূল উদ্দেশ্য

শিষ্য। এক্ষণে গীতোক্ত ভক্তিতত্ত্বের কথা শুনিবার বাসনা করি।
গুরু। গীতার দ্বাদশ অধ্যায়ের নাম ভক্তিযোগ। কিন্তু প্রকৃত ভক্তির ব্যাখ্যা দ্বাদশ অধ্যায়ে অতি অল্পই আছে। দ্বিতীয় হইতে দ্বাদশ পর্য্যন্ত সকল অধ্যায়গুলি পর্য্যালোচনা না করিলে গীতোক্ত প্রকৃত ভক্তিতত্ত্ব বুঝা যায়না।যদি গীতার ভক্তিতত্ব বুঝিতে চাও, তাহা হইলে এই এগার অধ্যায়ের কথা কিছু বুঝিতে হইবে। এই এগার অধ্যায়ে জ্ঞান কর্ম্ম এবং ভক্তি, তিনেরই কথা আছে-তিনেরই প্রশংসা আছে। যাহা আর কোথাও নাই, তাহাও ইহাতে আছে, জ্ঞান কর্ম্ম ও ভক্তির সামঞ্জস্য আছে। এই সামঞ্জস্য আছে বলিয়াই ইহাকে সর্ব্বোৎকৃষ্ট ধর্ম্মগ্রন্থ বলা যাইতে পারে। কিন্তু সেই সামঞ্জস্যের প্রকৃত তাৎপর্য্য এই যে, এই তিনের চরমাবস্থা যাহা, তাহা ভক্তি। এই জন্য গীতা প্রকৃত পক্ষে ভক্তিশাস্ত্র।
শিষ্য। কথাগুলি একটু অসঙ্গত লাগিতেছে। আত্মীয় অন্তরঙ্গ বধ করিয়া রাজ্যলাভ করিতে অনিচ্ছুক হইয়া অর্জ্জুন যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত হইতেছিলেন, কৃষ্ণ তাঁহাকে প্রবৃত্তি দিয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত করিয়াছিলেন-ইহাই গীতার বিষয়। অতএব ইহাকে ঘাতকশাস্ত্র বলাই বিধেয় উহাকে ভক্তিশাস্ত্র বলিব কি জন্য?
গুরু। অনেকের অভ্যাস আছে যে, তাঁহারা গ্রন্থের একখানা পাতা পড়িয়া মনে করেন, আমরা এ গ্রন্থের মর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছি। যাঁহারা এই শ্রেণীর পণ্ডিত, তাঁহারাই ভগবদ্গীতাকে ঘাতকশাস্ত্র বলিয়া বুঝিয়া থাকেন। স্থূল কথা এই যে, অর্জ্জুনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করাই এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য নহে। কিন্তু সে কথা এখন থাক। যুদ্ধ মাত্র যে পাপ নহে, এ কথা তোমাকে পূর্ব্বে বুঝাইয়াছি।
শিষ্য। বুঝাইয়াছেন যে, আত্মরক্ষার্থ এবং স্বদেশরক্ষার্থ যুদ্ধ ধর্ম্মমধ্যে গণ্য।
গুরু। এখানে অর্জ্জুন আত্মবক্ষায় প্রবৃত্ত। কেন না, আপনার সম্পত্তি উদ্ধার- আত্মরক্ষার অন্তর্গত।
শিষ্য। যে নরপিশাচ অনর্থক যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়, সেই এই কথা বলিয়া যুদ্ধপ্রবৃত্ত হয়। নরপিশাচপ্রধান প্রথম নেপোলেয়ন্ ফ্রান্স রক্ষার ওজর করিয়া ইউরোপ নরশোণিতে প্লাবিত করিয়াছিল।
গুরু। তাহার ইতিহাস যখন নিরপেক্ষ লেখকের দ্বারা লিখিত হইবে, তখন জানিতে পারিবে, নেপোলেয়নের কথা মিথ্যা নহে। নেপোলিয়ন্ নরপিশাচ ছিলেন না। যাক-সে কথা বিচার্য্য নহে। আমাদের বিচার্য্য এই যে, অনেক সময় যুদ্ধও পুণ্য কর্ম্ম।
শিষ্য। কিন্তু সে কখন?
গুরু। এ কথার দুই উত্তর আছে। এক ইউরোপীয় হিতবাদীর উত্তর। সে উত্তর এই যে, যুদ্ধে যেখানে লক্ষ লোকের অনিষ্ট করিয়া কোটি কোটি লোকের হিতসাধন করা যায়, সেখানে যুদ্ধ পুণ্য কর্ম্ম। কিন্তু কোটি লোকের জন্য এক লক্ষ লোককেই বা সংহার করিবার আমাদের কি অধিকার? এ কথার উত্তর হিতবাদী দিতে পারেন না। দ্বিতীয় উত্তর ভারতবর্ষীয় এই উত্তর আধ্যাত্মিক এবং পারমার্থিক। হিন্দুর সকল নীতির মূল আধ্যাত্মিক ও পারমার্থিক সেই মূল, যুদ্ধের কর্ত্তব্যতার ন্যায় এমন একটা কঠিন তত্ত্ব অবলম্বন করিয়া যেমন বিশদরূপে বুঝান যায়, সামান্য তত্ত্বের উপলক্ষে সেরূপ বুঝান যায় না। তাই গীতাকার অর্জ্জুনের যুদ্ধে অপ্রবৃত্তি কল্পিত করিয়া, তদুপলক্ষে পরম পবিত্র ধর্ম্মের আমূল ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন।
শিষ্য। কথাটা কিরূপে উঠিতেছে?
গুরু। ভগবান্ কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য সম্বন্ধে অর্জ্জুনকে প্রথমে অনুষ্ঠান বুঝাইতেছেন। প্রথমে আধ্যাত্মিকতা, অর্থাৎ আত্মার অনশ্বরতা প্রভৃতি যাহা জ্ঞানের বিষয়। ইহা জ্ঞানযোগ বা সাংখ্যযোগ নামে অভিহিত হইয়াছে। তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি বলিতেছেন,-
লোকেহস্মিন্ দ্বিবিধা নিষ্ঠা পুরা প্রোক্তা ময়ানঘ।
জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাং কর্ম্মযোগেন যোগিনাম্ || ৩।৩
ইহার মধ্যে জ্ঞানযোগ প্রথমতঃ সংক্ষেপে কর্ম্মযোগ সবিস্তারে বুঝাইয়াছেন। এই জ্ঞান ও কর্ম্ম যোগ প্রভৃতি বুঝিলে তুমি জানিতে পারিবে যে, গীতা ভক্তিশাস্ত্র-তাই এত সবিস্তারে ভক্তির ব্যাখ্যায়, গীতার পরিচয় দিতেছি।

Leave a Reply