তা, সে দিন গঙ্গারামের কোন কাজ করা হইল না। রমার মুখখানি বড় সুন্দর! কি সুন্দর আলোই তার উপর পড়িয়াছিল। সেই কথা ভাবিতেই গঙ্গারামের দিন গেল। বাতির আলো বলিয়াই কি অমন দেখাইল? তা হলে মানুষ রাত্রিদিন বাতির আলো জ্বালিয়া বসিয়া থাকে না কেন? কি মিস্ে‍মিসে কোঁকড়া কোঁকড়া চুলের গোছা! কি ফলান রঙ! কি ভ্রূরু! কি চোখ! কি ঠোঁট-যেমন রাঙা, তেমনই পাতলা! কি গড়ন! তা কোন্ি‍টাই বা গঙ্গারাম ভাবিবে? সবই যেমন দেবীদুর্লভ! গঙ্গারাম ভাবিল, “মানুষ যে এমন সুন্দর হয়, তা জানতেম না! একবার যে দেখিলাম, আমার যেন জন্ম সার্থক হইল। আমি তাই ভাবিয়া যে কয় বৎসর বাঁচিব, সুখে কাটাইতে পারিব |”
তা কি পারা যায় রে মূর্খ! একবার দেখিয়া, অমন হইলে আর একবার দেখিতে ইচ্ছা করে। দুপুর বেলা গঙ্গারাম ভাবিতেছিল, “একবার যে দেখিয়াছি, আমি তাই ভাবিয়া যে কয় বৎসর বাঁচি, সেই কয় বৎসর সুখে কাটাইতে পারিব |”-কিন্তু সন্ধ্যা বেলা ভাবিল, “আর একবার কি দেখিতে পাই না?” রাত্রি দুই চারি দণ্ডের সময়ে গঙ্গারাম ভাবিল, “আজ আবার মুরলা আসে না!” রাত্রি প্রহরেকের সময়ে মুরলা তাঁহাকে নিভৃত স্থানে গিরেফতাকর করিল।
গঙ্গারাম জিজ্ঞাসা করিল, “কি খবর?”
মু। তোমার খবর কি?
গ। কিসের খবর চাও?
মু। বাপের বাড়ী যাওয়ার।
গ। আবশ্যক হইবে না বোধ হয়। রাজ্য রক্ষা হইবে।
মু। কিসে জানিলে?
গ। তা কি তোমায় বলা যায়?
মু। তবে আমি এই কথা বলি গে?
গ। বল গে।
মু। যদি আমাকে আবার পাঠান?
গ। কাল যেখানে ধরিয়াছিলে, সেইখানে আমাকে পাইবে।
মুরলা চলিয়া গিয়া, রাজ্ঞীসমীপে সংবাদ নিবেদন করিল। গঙ্গারাম কিছুই খুলিয়া বলেন নাই, সুতরাং রমাও কিছু বুঝিতে পারিল না। না বুঝিতে পারিয়া আবার ব্যস্ত হইল। আবার মুরলা গঙ্গারামকে ধরিয়া লইয়া তৃতীয় প্রহর রাত্রে রমার ঘরে আনিয়া উপস্থিত করিল। সেই পাহারাওয়ালা সেইখানে ছিল, আবার গঙ্গারাম মুরলার ভাই বলিয়া পার হইলেন।
গঙ্গারাম রমার কাছে আসিয়া মাথা মুণ্ড কি বলিল, তাহা গঙ্গারাম নিজেই কিছু বুঝিতে পারিল না, রমা ত নয়ই। আসল কথা, গঙ্গারামের মাথা মুণ্ড তখন কিছুই ছিল না, সেই ধনুর্ধর ঠাকুর ফুলের বাণ মারিয়া উড়াইয়া লইয়া গিয়াছিলেন। কেবল তাহার চক্ষু দুইটি ছিল, প্রাণপাত করিয়া গঙ্গারাম দেখিয়া লইল, কান ভরিয়া কথা শুনিয়া লইল, কিন্তু তৃপ্তি হইল না।
গঙ্গারামের এতটুকু মাত্র চৈতন্য ছিল যে, চন্দ্রচূড় ঠাকুরের কলকৌশল রমার সাক্ষাতে কিছুই সে প্রকাশ করিল না। বস্তুতঃ কোন কথা প্রকাশ করিতে সে আসে নাই, কেবল দেখিতে আসিয়াছিল। তাই দেখিয়া, দক্ষিণাস্বরূপ আপনার চিত্ত রমাকে দিয়া চলিয়া গেল। আবার মুরলা তাহাকে বাহির করিয়া দিয়া আসিল। গমনকালে মুরলা গঙ্গারামকে বলিল, “আবার আসিবে?”
গ। কেন আসিব?
মুরলা বলিল, “আসিবে বোধ হইতেছে |”
গঙ্গারাম চোখ বুজিয়া পথে পা দিয়াছে-কিছু বলিল না।
এ দিকে চন্দ্রচূড়ের কথায় তোরাব খাঁ উত্তর পাঠাইলেন, “যদি অল্প স্বল্প টাকা দিলে মুলুক ছাড়িয়া দাও, তবে টাকা দিতে রাজি আছি। কিন্তু সীতারামকে ধরিয়া দিতে হইবে |”
চন্দ্রচূড় উত্তর পাঠাইলেন, “সীতারামকে ধরাইয়া দিব, কিন্তু অল্প টাকায় হইবে
না |”
তোরাব খাঁ বলিয়া পাঠাইলেন, “কত টাকা চাও?” চন্দ্রচূড় একটা চড়া দর হাঁকিলেন; তোরাব খাঁ একটা নরম দর দিয়া পাঠাইলেন। তার পর চন্দ্রচূড় কিছু নামিলেন, তোরাব খাঁ তদুত্তরে কিছু উঠিলেন। চন্দ্রচূড় এইরূপে মুসলমানকে ভুলাইয়া রাখিতে লাগিলেন।

Leave a Reply