বলিয়াছি, চন্দ্রচূড় ঠাকুরের সে রাত্রিতে ঘুম হইল না। অতি প্রত্যূষে তিনি রাজপ্রাসাদের উচ্চ চূড়ে উঠিয়া চারি দিক নিরীক্ষণ করিতেছিলেন। দেখিলেন, নদীর অপর পারে, ঠিক তাঁহার সম্মুখে, বহুসংখ্যক নৌকা একত্র হইয়াছে। তীরে অনেক লোকও আছে বোধ হইতেছে, কিন্তু তখনও তেমন ফরসাি হয় নাই, বোঝা গেল না যে, তাহারা কি প্রকারের লোক। তখন তিনি গঙ্গারামকে ডাকিতে পাঠাইলেন।
গঙ্গারাম আসিয়া সেই অট্টালিকাশিখরদেশে উপস্থিত হইল। চন্দ্রচূড় জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও পারে অত নৌকা কেন?”
গঙ্গারাম নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, “কি জানি?”
চ। দেখ, তীরে বিস্তর লোক। এত নৌকা, এত লোক কেন?
গ। বলিতে ত পারি না।
কথা কহিতে কহিতে বেশ আলো হইল। তখন বোধ হইল, ঐ লোক সৈনিক। চন্দ্রচূড় বলিলেন, “গঙ্গারাম! সর্বনাশ হইয়াছে। আমাদের চর আমাদের প্রতারণা করিয়াছে। অথবা সেই প্রতারিত হইয়াছে। আমরা দক্ষিণ পথে সৈন্য পাঠাইলাম, কিন্তু ফৌজদারের সেনা এই পথে আসিয়াছে। সর্বনাশ হইল। এখন রক্ষা করে কে?”
গ। কেন, আমি আছি কি করিতে?
চ। তুমি এই কয় জন মাত্র দুর্গরক্ষক লইয়া এই অসংখ্য সেনার কি করিবে? আর তুমিও দুর্গরক্ষার কোন উদ্যোগ করিতেছ না। কাল বলিয়াছিলাম বলিয়া আমাকে কড়া কড়া শুনাইয়াছিলে। এখন কে দায় ভার ঘাড়ে করে?
গঙ্গা। অত ভয় পাইবেন না। ও পারে যে ফৌজ দেখিতেছেন, তাহা অসংখ্য নয়। এই কয়খানা নৌকায় কয় জন সিপাহী পার হইতে পারে? আমি তীরে গিয়া ফৌজ লইয়া দাঁড়াইতেছি। উহারা যেমন তীরে আসিবে, অমনি উহাদিগকে টিপিয়া মারিব।
গঙ্গারামের অভিপ্রায়, সেনা লইয়া বাহির হইবেন, কিন্তু এখন নয়, আগে ফৌজদারের সেনা নির্বিঘ্নে পার হউক। তার পর তিনি সেনা লইয়া দুর্গদ্বার খুলিয়া বাহির হইবেন, মুক্ত দ্বার পাইয়া মুসলমানেরা নির্বিঘ্নে গড়ের ভিতর প্রবেশ করিবে। তিনি কোন আপত্তি করিবেন না। কাল যে মূর্তিটা দেখিয়াছিলেন, সেটা কি বিভীষিকা! কৈ, তার আর কিছু প্রকাশ নাই।
চন্দ্রচূড় সব বুঝিলেন। তথাপি বলিলেন, “তবে শীঘ্র যাও। সেনা লইয়া বাহির হও। বিলম্ব করিও না। নৌকা সকল সিপাহী বোঝাই লইয়া ছাড়িতেছে |”
গঙ্গারাম তখন তাড়াতাড়ি ছাদের উপর হইতে নামিল। চন্দ্রচূড় সভয়ে দেখিতে লাগিলেন যে, প্রায় পঞ্চাশখানা নৌকায় পাঁচ ছয় শত মুসলমান সিপাহী এক শ্রেণীবদ্ধ হইয়া যাত্রা করিল। তিনি অতিশয় অস্থির হইয়া দেখিতে লাগিলেন, কতক্ষণে গঙ্গারাম সিপাহী লইয়া বাহির হয়। সিপাহী সকল সাজিতেছে, ফিরিতেছে, ঘুরিতেছে, সারি দিতেছে-কিন্তু বাহির হইতেছে না। চন্দ্রচূড় তখন ভাবিলেন, “হায়! হায়! কি দুষ্কর্ম্ম করিয়াছি-কেন গঙ্গারামকে বিশ্বাস করিয়াছিলাম! এখন সর্বনাশ হইল। কৈ, সেই জ্যোতির্ম্ময়ী রাজলক্ষ্মীই বা কৈ? তিনিও কি ছলনা করিলেন?” চন্দ্রচূড় গঙ্গারামের সন্ধানে আসিবার অভিপ্রায়ে সৌধ হইতে অবতরণ করিবার উপক্রম করিতেছিলেন, এমন সময়ে গুড়ুম্ করিয়া এক কামানের আওয়াজ হইল। মুসলমানের নৌকাশ্রেণী হইতে আওয়াজ হইল, এমন বোধ হইল না। তাহাদের সঙ্গে কামান আছে, বোধ হইতেছিল না। চন্দ্রচূড় নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন, মুসলমানের কোন নৌকায় কামানের ধূঁয়া দেখা যায় না। চন্দ্রচূড় সবিস্ময়ে দেখিলেন, যেমন কামানের শব্দ হইল, অমনি মুসলমানদিগের একখানি নৌকা জলমগ্ন হইল; আরোহী সিপাহীরা সন্তরণ করিয়া অন্য নৌকায় উঠিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
“তবে কি এ আমাদের তোপ!”
এই ভাবিয়া চন্দ্রচূড় নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন। দেখিলেন, একটি সিপাহীও গড় হইতে বাহির হয় নাই। দুর্গপ্রাকারে, যেখানে তোপ সকল সাজান আছে, সেখানে একটি মনুষ্যও নাই। তবে এ তোপ ছাড়িল কে?
কোনও দিকে ধূম দেখা যায় কি না, ইহা লক্ষ্য করিবার জন্য চন্দ্রচূড় চারি দিকে চাহিতে লাগিলেন,-দেখিলেন, গড়ের সম্মুখে যেখানে রাজবাটীর ঘাট, সেইখান হইতে ঘুরিয়া ঘুরিয়া, ধূমরাশি আকাশমার্গে উঠিয়া পবন-পথে চলিয়া যাইতেছে।
তখন চন্দ্রচূড়ের স্মরণ হইল যে, ঘাটের উপরে, গাছের তলায় একটা তোপ আছে। কোন শত্রুর নৌকা আসিয়া ঘাটে না লাগিতে পারে, এ জন্য সীতারাম সেখানে একটা কামান রাখিয়াছিলেন-কেহ এখন সেই কামান ব্যবহার করিতেছে, ইহা নিশ্চিত। কিন্তু সে কে? গঙ্গারামের একটি সিপাহীও বাহির হয় নাই-এখনও ফটক বন্ধ। মৃণ্ময়ের সিপাহীরা অনেক দূর চলিয়া গিয়াছে। মৃণ্ময় যে কোন সিপাহী ঐ কামানের জন্য রাখিয়া যাইবেন, ইহা অসম্ভব; কেন না, দুর্গরক্ষার ভার গঙ্গারামের উপর আছে। কোন বাজে লোক আসিয়া কামান ছাড়িল-ইহাও অসম্ভব; কেন না, বাজে লোকে গোলা-বারুদ কোথা পাইবে? আর এরূপ অব্যর্থ সন্ধান-বাজে লোকের হইতে পারে না-শিক্ষিত গোলন্দাজের। কার এ কাজ? চন্দ্রচূড় এইরূপ ভাবিতেছিলেন, এমন সময়ে আবার সেই কামান বজ্রনাদে চতুর্দিক শব্দিত করিল-আবার ধূমরাশি আকাশে উঠিয়া নদীর উপরিস্থ বায়ুস্তরে গগন বিচরণ করিতে লাগিল-আবার মুসলমান সিপাহীপরিপূর্ণ আর একখানি নৌকা জলমগ্ন হইল।
“ধন্য! ধন্য!” বলিয়া চন্দ্রচূড় করতালি দিতে লাগিলেন। নিশ্চিত এই সেই মহাদেবী! বুঝি কালিকা সদয় হইয়া অবতীর্ণ হইয়াছেন। জয় লক্ষ্মীনারায়ণজী! জয় কালী! জয় পুররাজলক্ষ্মী! তখন চন্দ্রচূড় সভয়ে দেখিলেন যে, যে সকল নৌকা অগ্রবর্তী হইয়াছিল-অর্থাৎ যে সকল নৌকার সিপাহীদের গুলি তীর পর্যন্ত পৌঁছিবার সম্ভাবনা, তাহারা তীর লক্ষ্য করিয়া বন্দুক চালাইতে লাগিল। ধূমে সহসা নদীবক্ষ অন্ধকার হইয়া উঠিল-শব্দে কান পাতা যায় না। চন্দ্রচূড় ভাবিলেন, “যদি আমাদের রক্ষক দেবতা হয়েন-তবে এ গুলিবৃষ্টি তাঁহার কি করিবে? আর যদি মনুষ্য হয়েন, তবে আমদের জীবন এই পর্যন্ত-এ লোহাবৃষ্টিতে কোন মনুষ্যই টিকিবে না |”
কিন্তু আবার সেই কামান ডাকিল-আবার দশ দিক্ কাঁপিয়া উঠিল-ধূমের চক্রে চক্রে ধূমাকার বাড়িয়া গেল। আবার সসৈন্য নৌকা ছিন্ন ভিন্ন হইয়া ডুবিয়া গেল।
তখন এক দিকে-এক কামান-আর এক দিকে শত শত মুসলমান সেনায় তুমুল সংগ্রাম বাধিয়া গেল। শব্দে আর কান পাতা যায় না। উপর্যুপরি গম্ভীর, তীব্র, ভীষণ, মুহুর্মুহুঃ ইন্দ্রহস্তপরিত্যক্ত বজ্রের মত, সেই কামান ডাকিতে লাগিল,-প্রশস্ত নদীবক্ষ এমন ধূমাচ্ছন্ন হইল যে, চন্দ্রচূড় সেই উচ্চ সৌধ হইতে উত্তালতরঙ্গসংক্ষুব্ধ ধূমসমুদ্র ভিন্ন আর কিছু দেখিতে পাইলেন না। কেবল সেই তীব্রনদী বজ্রনাদে বুঝিতে পারিলেন যে, এখনও হিন্দুধর্মরক্ষিণী দেবী জীবিতা আছেন। চন্দ্রচূড় তীব্রদৃষ্টিতে ধূমসমুদ্রের বিচ্ছেদ অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন-এই আশ্চর্য্য সমরের ফল কি হইল-দেখিবেন।
ক্রমে শব্দ কম পড়িয়া আসিল-একটু বাতাস উঠিয়া ধূঁয়া উড়াইয়া লইয়া গেল-তখন চন্দ্রচূড় সেই জলময় রণক্ষেত্র পরিষ্কার দেখিতে পাইলেন। দেখিলেন যে, ছিন্ন, নিমগ্ন নৌকা সকল স্রোতে উলটি পালটি করিয়া ভাসিয়া চলিয়াছে। মৃত ও জীবিত সিপাহীর দেহে নদীস্রোত ঝটিকাশান্তির পর পল্লবকুসুমাকীর্ণ উদ্যানবৎ দৃষ্ট হইতেছে-কাহারও অস্ত্র, কাহারও বস্ত্র, কাহারও বাদ্য, কাহারও উষ্ণীষ, কাহারও দেহ ভাসিয়া যাইতেছে-কেহ সাঁতার দিয়া পলাইতেছে-কাহাকেও কুম্ভীরে গ্রাস করিতেছে। যে কয়খানা নৌকা ডোবে নাই-সে কয়খানা, নাবিকেরা প্রাণপাত করিয়া বাহিয়া সিপাহী লইয়া অপর পারে পলায়ন করিয়াছে। একমাত্র বজ্রের প্রহারে আহতা আসুরী সেনার ন্যায় মুসলমান সেনা রণে ভঙ্গ দিয়া পলাইল।
দেখিয়া চন্দ্রচূড় হাতজোড় করিয়া ঊর্ধ্বমুখে, গদ্গদকণ্ঠে, সজলনয়নে বলিলেন, “জয় জগদীশ্বর! জয় দৈত্যদমন, ভক্ততারণ, ধর্মরক্ষণ হরি! আজ বড় দয়া করিলে! আজ তুমি স্বয়ং সশরীরে যুদ্ধ করিয়াছ, নহিলে এই পুররাজলক্ষ্মী স্বয়ং যুদ্ধ করিয়াছেন, নহিলে তোমার দাসানুদাস সীতারাম আসিয়াছে। তোমার সেই ভক্ত ভিন্ন এ যুদ্ধ মনুষ্যের সাধ্য নহে |”
তখন চন্দ্রচূড় প্রাসাদশিখর হইতে অবতরণ করিলেন।
গঙ্গারাম আসিয়া সেই অট্টালিকাশিখরদেশে উপস্থিত হইল। চন্দ্রচূড় জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও পারে অত নৌকা কেন?”
গঙ্গারাম নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, “কি জানি?”
চ। দেখ, তীরে বিস্তর লোক। এত নৌকা, এত লোক কেন?
গ। বলিতে ত পারি না।
কথা কহিতে কহিতে বেশ আলো হইল। তখন বোধ হইল, ঐ লোক সৈনিক। চন্দ্রচূড় বলিলেন, “গঙ্গারাম! সর্বনাশ হইয়াছে। আমাদের চর আমাদের প্রতারণা করিয়াছে। অথবা সেই প্রতারিত হইয়াছে। আমরা দক্ষিণ পথে সৈন্য পাঠাইলাম, কিন্তু ফৌজদারের সেনা এই পথে আসিয়াছে। সর্বনাশ হইল। এখন রক্ষা করে কে?”
গ। কেন, আমি আছি কি করিতে?
চ। তুমি এই কয় জন মাত্র দুর্গরক্ষক লইয়া এই অসংখ্য সেনার কি করিবে? আর তুমিও দুর্গরক্ষার কোন উদ্যোগ করিতেছ না। কাল বলিয়াছিলাম বলিয়া আমাকে কড়া কড়া শুনাইয়াছিলে। এখন কে দায় ভার ঘাড়ে করে?
গঙ্গা। অত ভয় পাইবেন না। ও পারে যে ফৌজ দেখিতেছেন, তাহা অসংখ্য নয়। এই কয়খানা নৌকায় কয় জন সিপাহী পার হইতে পারে? আমি তীরে গিয়া ফৌজ লইয়া দাঁড়াইতেছি। উহারা যেমন তীরে আসিবে, অমনি উহাদিগকে টিপিয়া মারিব।
গঙ্গারামের অভিপ্রায়, সেনা লইয়া বাহির হইবেন, কিন্তু এখন নয়, আগে ফৌজদারের সেনা নির্বিঘ্নে পার হউক। তার পর তিনি সেনা লইয়া দুর্গদ্বার খুলিয়া বাহির হইবেন, মুক্ত দ্বার পাইয়া মুসলমানেরা নির্বিঘ্নে গড়ের ভিতর প্রবেশ করিবে। তিনি কোন আপত্তি করিবেন না। কাল যে মূর্তিটা দেখিয়াছিলেন, সেটা কি বিভীষিকা! কৈ, তার আর কিছু প্রকাশ নাই।
চন্দ্রচূড় সব বুঝিলেন। তথাপি বলিলেন, “তবে শীঘ্র যাও। সেনা লইয়া বাহির হও। বিলম্ব করিও না। নৌকা সকল সিপাহী বোঝাই লইয়া ছাড়িতেছে |”
গঙ্গারাম তখন তাড়াতাড়ি ছাদের উপর হইতে নামিল। চন্দ্রচূড় সভয়ে দেখিতে লাগিলেন যে, প্রায় পঞ্চাশখানা নৌকায় পাঁচ ছয় শত মুসলমান সিপাহী এক শ্রেণীবদ্ধ হইয়া যাত্রা করিল। তিনি অতিশয় অস্থির হইয়া দেখিতে লাগিলেন, কতক্ষণে গঙ্গারাম সিপাহী লইয়া বাহির হয়। সিপাহী সকল সাজিতেছে, ফিরিতেছে, ঘুরিতেছে, সারি দিতেছে-কিন্তু বাহির হইতেছে না। চন্দ্রচূড় তখন ভাবিলেন, “হায়! হায়! কি দুষ্কর্ম্ম করিয়াছি-কেন গঙ্গারামকে বিশ্বাস করিয়াছিলাম! এখন সর্বনাশ হইল। কৈ, সেই জ্যোতির্ম্ময়ী রাজলক্ষ্মীই বা কৈ? তিনিও কি ছলনা করিলেন?” চন্দ্রচূড় গঙ্গারামের সন্ধানে আসিবার অভিপ্রায়ে সৌধ হইতে অবতরণ করিবার উপক্রম করিতেছিলেন, এমন সময়ে গুড়ুম্ করিয়া এক কামানের আওয়াজ হইল। মুসলমানের নৌকাশ্রেণী হইতে আওয়াজ হইল, এমন বোধ হইল না। তাহাদের সঙ্গে কামান আছে, বোধ হইতেছিল না। চন্দ্রচূড় নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন, মুসলমানের কোন নৌকায় কামানের ধূঁয়া দেখা যায় না। চন্দ্রচূড় সবিস্ময়ে দেখিলেন, যেমন কামানের শব্দ হইল, অমনি মুসলমানদিগের একখানি নৌকা জলমগ্ন হইল; আরোহী সিপাহীরা সন্তরণ করিয়া অন্য নৌকায় উঠিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
“তবে কি এ আমাদের তোপ!”
এই ভাবিয়া চন্দ্রচূড় নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন। দেখিলেন, একটি সিপাহীও গড় হইতে বাহির হয় নাই। দুর্গপ্রাকারে, যেখানে তোপ সকল সাজান আছে, সেখানে একটি মনুষ্যও নাই। তবে এ তোপ ছাড়িল কে?
কোনও দিকে ধূম দেখা যায় কি না, ইহা লক্ষ্য করিবার জন্য চন্দ্রচূড় চারি দিকে চাহিতে লাগিলেন,-দেখিলেন, গড়ের সম্মুখে যেখানে রাজবাটীর ঘাট, সেইখান হইতে ঘুরিয়া ঘুরিয়া, ধূমরাশি আকাশমার্গে উঠিয়া পবন-পথে চলিয়া যাইতেছে।
তখন চন্দ্রচূড়ের স্মরণ হইল যে, ঘাটের উপরে, গাছের তলায় একটা তোপ আছে। কোন শত্রুর নৌকা আসিয়া ঘাটে না লাগিতে পারে, এ জন্য সীতারাম সেখানে একটা কামান রাখিয়াছিলেন-কেহ এখন সেই কামান ব্যবহার করিতেছে, ইহা নিশ্চিত। কিন্তু সে কে? গঙ্গারামের একটি সিপাহীও বাহির হয় নাই-এখনও ফটক বন্ধ। মৃণ্ময়ের সিপাহীরা অনেক দূর চলিয়া গিয়াছে। মৃণ্ময় যে কোন সিপাহী ঐ কামানের জন্য রাখিয়া যাইবেন, ইহা অসম্ভব; কেন না, দুর্গরক্ষার ভার গঙ্গারামের উপর আছে। কোন বাজে লোক আসিয়া কামান ছাড়িল-ইহাও অসম্ভব; কেন না, বাজে লোকে গোলা-বারুদ কোথা পাইবে? আর এরূপ অব্যর্থ সন্ধান-বাজে লোকের হইতে পারে না-শিক্ষিত গোলন্দাজের। কার এ কাজ? চন্দ্রচূড় এইরূপ ভাবিতেছিলেন, এমন সময়ে আবার সেই কামান বজ্রনাদে চতুর্দিক শব্দিত করিল-আবার ধূমরাশি আকাশে উঠিয়া নদীর উপরিস্থ বায়ুস্তরে গগন বিচরণ করিতে লাগিল-আবার মুসলমান সিপাহীপরিপূর্ণ আর একখানি নৌকা জলমগ্ন হইল।
“ধন্য! ধন্য!” বলিয়া চন্দ্রচূড় করতালি দিতে লাগিলেন। নিশ্চিত এই সেই মহাদেবী! বুঝি কালিকা সদয় হইয়া অবতীর্ণ হইয়াছেন। জয় লক্ষ্মীনারায়ণজী! জয় কালী! জয় পুররাজলক্ষ্মী! তখন চন্দ্রচূড় সভয়ে দেখিলেন যে, যে সকল নৌকা অগ্রবর্তী হইয়াছিল-অর্থাৎ যে সকল নৌকার সিপাহীদের গুলি তীর পর্যন্ত পৌঁছিবার সম্ভাবনা, তাহারা তীর লক্ষ্য করিয়া বন্দুক চালাইতে লাগিল। ধূমে সহসা নদীবক্ষ অন্ধকার হইয়া উঠিল-শব্দে কান পাতা যায় না। চন্দ্রচূড় ভাবিলেন, “যদি আমাদের রক্ষক দেবতা হয়েন-তবে এ গুলিবৃষ্টি তাঁহার কি করিবে? আর যদি মনুষ্য হয়েন, তবে আমদের জীবন এই পর্যন্ত-এ লোহাবৃষ্টিতে কোন মনুষ্যই টিকিবে না |”
কিন্তু আবার সেই কামান ডাকিল-আবার দশ দিক্ কাঁপিয়া উঠিল-ধূমের চক্রে চক্রে ধূমাকার বাড়িয়া গেল। আবার সসৈন্য নৌকা ছিন্ন ভিন্ন হইয়া ডুবিয়া গেল।
তখন এক দিকে-এক কামান-আর এক দিকে শত শত মুসলমান সেনায় তুমুল সংগ্রাম বাধিয়া গেল। শব্দে আর কান পাতা যায় না। উপর্যুপরি গম্ভীর, তীব্র, ভীষণ, মুহুর্মুহুঃ ইন্দ্রহস্তপরিত্যক্ত বজ্রের মত, সেই কামান ডাকিতে লাগিল,-প্রশস্ত নদীবক্ষ এমন ধূমাচ্ছন্ন হইল যে, চন্দ্রচূড় সেই উচ্চ সৌধ হইতে উত্তালতরঙ্গসংক্ষুব্ধ ধূমসমুদ্র ভিন্ন আর কিছু দেখিতে পাইলেন না। কেবল সেই তীব্রনদী বজ্রনাদে বুঝিতে পারিলেন যে, এখনও হিন্দুধর্মরক্ষিণী দেবী জীবিতা আছেন। চন্দ্রচূড় তীব্রদৃষ্টিতে ধূমসমুদ্রের বিচ্ছেদ অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন-এই আশ্চর্য্য সমরের ফল কি হইল-দেখিবেন।
ক্রমে শব্দ কম পড়িয়া আসিল-একটু বাতাস উঠিয়া ধূঁয়া উড়াইয়া লইয়া গেল-তখন চন্দ্রচূড় সেই জলময় রণক্ষেত্র পরিষ্কার দেখিতে পাইলেন। দেখিলেন যে, ছিন্ন, নিমগ্ন নৌকা সকল স্রোতে উলটি পালটি করিয়া ভাসিয়া চলিয়াছে। মৃত ও জীবিত সিপাহীর দেহে নদীস্রোত ঝটিকাশান্তির পর পল্লবকুসুমাকীর্ণ উদ্যানবৎ দৃষ্ট হইতেছে-কাহারও অস্ত্র, কাহারও বস্ত্র, কাহারও বাদ্য, কাহারও উষ্ণীষ, কাহারও দেহ ভাসিয়া যাইতেছে-কেহ সাঁতার দিয়া পলাইতেছে-কাহাকেও কুম্ভীরে গ্রাস করিতেছে। যে কয়খানা নৌকা ডোবে নাই-সে কয়খানা, নাবিকেরা প্রাণপাত করিয়া বাহিয়া সিপাহী লইয়া অপর পারে পলায়ন করিয়াছে। একমাত্র বজ্রের প্রহারে আহতা আসুরী সেনার ন্যায় মুসলমান সেনা রণে ভঙ্গ দিয়া পলাইল।
দেখিয়া চন্দ্রচূড় হাতজোড় করিয়া ঊর্ধ্বমুখে, গদ্গদকণ্ঠে, সজলনয়নে বলিলেন, “জয় জগদীশ্বর! জয় দৈত্যদমন, ভক্ততারণ, ধর্মরক্ষণ হরি! আজ বড় দয়া করিলে! আজ তুমি স্বয়ং সশরীরে যুদ্ধ করিয়াছ, নহিলে এই পুররাজলক্ষ্মী স্বয়ং যুদ্ধ করিয়াছেন, নহিলে তোমার দাসানুদাস সীতারাম আসিয়াছে। তোমার সেই ভক্ত ভিন্ন এ যুদ্ধ মনুষ্যের সাধ্য নহে |”
তখন চন্দ্রচূড় প্রাসাদশিখর হইতে অবতরণ করিলেন।