রজনীকে বিষয় ছাড়িয়া দিলাম, কিন্তু কেহ ত সে বিষয় দখল করিল না।
রাজচন্দ্র দাস একদিন দেখা করিতে আসিল। তাহার মুখে শুনিলাম, সে শিমলায় একটি বাড়ী কিনিয়া সেইখানে রজনীকে লইয়া আছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, টাকা কোথায় পাইলে? রাজচন্দ্র বলিল, অমরনাথ কর্জ দিয়াছেন, পশ্চাৎ বিষয় হইতে শোধ হইবে। জিজ্ঞাসা করিলাম যে, তবে তোমরা বিষয়ে দখল লইতেছ না কেন? তাহাতে সে বলিল, সে সকল কথা অমরনাথ বাবু জানেন। অমরনাথ বাবু কি রজনীকে বিবাহ করিয়াছেন? তাহাতে রাজচন্দ্র বলিল, “না।” পরে রাজচন্দ্রের সঙ্গে কথোপকথন করিতে করিতে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “রাজচন্দ্র, তোমায় এতদিন দেখি নাই কেন?”
রাজচন্দ্র বলিল, একটু গা ঢাকা হইয়া ছিলাম।”
আমি। কার কি চুরি করিয়াছ যে, গা ঢাকা হইয়া ছিলে?
রা। চুরি করিব কার? তবে অমরনাথ বাবু বলিয়াছিলেন যে, এখন বিষয় লইয়া গোলযোগ হইতেছে, এখন একটু আড়াল হওয়াই ভাল। মানুষের চক্ষুলজ্জা আছে ত?
আমি। অর্থাৎ পাছে আমরা কিছু ছাড়িয়া দিতে অনুরোধ করি। অমরনাথ বাবু বিজ্ঞ লোক দেখিতেছি। তা যাই হৌক, এখন যে বড় দেখা দিলে?
রা। আপনার ঠাকুর আমাকে ডাকাইয়াছেন।
আমি। আমার ঠাকুর? তিনি তোমার সন্ধান পাইলেন কি প্রকারে?
রা। খুঁজিয়া খুঁজিয়া।
আমি। এত খোঁজাখুঁজি কেন? তোমায় বিষয় ছাড়িয়া দিতে অনুরোধ করিবার জন্য নয় ত?
রা। না—না—তা কেন—তা কেন? আর একটা কথার জন্য। এখন রজনীর কিছু বিষয় হইয়াছে শুনিয়া অনেক সম্বন্ধ আসিতেছে। তা কোথায় সম্বন্ধ করি—তাই আপনাদের জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি।
আমি। কেন, অমরনাথ বাবুর সঙ্গে ত সম্বন্ধ হইতেছিল? তিনি এত করিয়া রজনীর বিষয় উদ্ধার করিলেন, তাঁকে ছাড়িয়া কাহাকে বিবাহ দিবে?
রা। যদি তাঁর অপেক্ষাও ভাল পাত্র পাই?
আমি। অমরনাথের অপেক্ষা ভাল পাত্র কোথায় পাইবে?
রা। মনে করুন, আপনি যেমন, এমনই পাত্র যদি পাই?
আমি একটু চমকিলাম। বলিলাম, “তাহা হইলে অমরনাথের অপেক্ষা ভাল পাত্র হইল না। কিন্তু ছেঁদো কথা ছাড়িয়া দেও—তুমি কি আমার সঙ্গে রজনীর সম্বন্ধ করিতে আসিয়াছ?”
রাজচন্দ্র একটু কুণ্ঠিত হইল। বলিল, “হাঁ তাই বটে। এ সম্বন্ধ করিতেই কর্তা আমাকে ডাকাইয়াছিলেন।”
শুনিয়া, আকাশ হইতে পড়িলাম। সম্মুখে, দারিদ্র্য রাক্ষসকে দেখিয়া, ভীত হইয়া, পিতা যে এই সম্বন্ধ করিতেছেন, তাহা বুঝিতে পারিলাম—রজনীকে আমি বিবাহ করিলে ঘরের বিষয় ঘরে থাকিবে। আমাকে অন্ধ পুষ্পনারীর কাছে বিক্রয় করিয়া, পিতা বিক্রয়মূল্যস্বরূপ হৃত সম্পত্তি পুনঃপ্রাপ্ত হইবেন। শুনিয়া হাড় জ্বলিয়া গেল।
রাজচন্দ্রকে বলিলাম, “তুমি এখন যাও। কর্তার সঙ্গে আমার সে কথা হইবে।”
আমার রাগ দেখিয়া, রাজচন্দ্র পিতার কাছে গেল। সে কি বলিল, বলিতে পারি না। পিতা তাহাকে বিদায় দিয়া, আমাকে ডাকাইলেন।
তিনি আমাকে নানা প্রকারে অনুরোধ করিলেন,—রজনীকে বিবাহ করিতেই হইবে। নহিলে সপরিবারে মারা যাইব—খাইব কি? তাঁহার দুঃখ ও কাতরতা দেখিয়া আমার দুঃখ হইল না। বড় রাগ হইল। আমি রাগ করিয়া চলিয়া গেলাম।
পিতার কাছে হইতে গিয়া, আমার মার হাতে পড়িলাম। পিতার কাছে রাগ করিলাম, কিন্তু মার কাছে রাগ করিতে পারিলাম না—তাঁহার চক্ষের জল অসহ্য হইল। সেখান হইতে পলাইলাম। কিন্তু আমার প্রতিজ্ঞা স্থির রহিল—যে রজনীকে দয়া করিয়া গোপালের সঙ্গে বিবাহিত করিবার উদ্যোগ করিয়াছিলাম—আজি তাহার টাকার লোভে তাহাকে স্বয়ং বিবাহ করিব?
বিপদে পড়িয়া মনে করিলাম, ছোট মার সাহায্য লইব। গৃহের মধ্যে ছোট মাই বুদ্ধিমতী। ছোট মার কাছে গেলাম।
“ছোট মা, আমাকে কি রজনীকে বিবাহ করিতে হইবে? আমি কি অপরাধ করিয়াছি?”
ছোট মা চুপ করিয়া রহিলেন।
আমি। তুমিও কি ঐ পরামর্শে?
ছোট মা। বাছা, রজনী ত সৎকায়স্থের মেয়ে?
আমি। হইলই বা?
ছোট মা। আমি জানি, সে সচ্চরিত্রা।
আমি। তাহাও স্বীকার করি।
ছোট মা। সে পরম সুন্দরী।
আমি। পদ্মচক্ষু!
ছোট মা। বাবা—যদি পদ্মচক্ষুই খোঁজ, তবে তোমার আর একটা বিবাহ করিতে কতক্ষণ?
আমি। সে কি মা! রজনীর টাকার জন্য রজনীকে বিবাহ করিয়া, তার বিষয় লইয়া, তার পর তাকে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিয়া আর একজনকে বিবাহ করা, কেমন কাজটা হইবে?
ছোট মা। ঠেলিয়া ফেলিবে কেন? তোমার বড় মা কি ঠেলা আছেন?
এ কথার উত্তর ছোট মার কাছে করিতে পারা যায় না। তিনি আমার পিতার দ্বিতীয় পক্ষের বনিতা, বহুবিবাহের দোষের কথা তাঁহার সাক্ষাতে কি প্রকারে বলিব! সে কথা না বলিয়া, বলিলাম, “আমি এ বিবাহ করিব না—তুমি আমায় রক্ষা কর। তুমি সব পার।”
ছোট মা। আমি না বুঝি, এমন নহে। কিন্তু বিবাহ না করিলে, আমরা সপরিবারে অন্নাভাবে মারা যাইব। আমি সকল কষ্ট সহ্য করিতে পারি, কিন্তু তোমাদিগের অন্নকষ্ট আমি চক্ষে দেখিতে পারিব না। তোমার সহস্র বৎসর পরমায়ু হউক, তুমি ইহাতে অমত করিও না।
আমি। টাকাই কি এত বড়?
ছোট মা। তোমার আমার কাছে নহে। কিন্তু যাহারা তোমার আমার সর্বস্ব, তাঁহাদের কাছে বটে। সুতরাং তোমার আমার কাছেও বটে! দেখ, তোমার জন্য আমরা তিন জনে প্রাণ দিতেও পারি। তুমি আমাদিগের জন্য একটি অন্ধ কন্যা বিবাহ করিতে পারিবে না?
ছোট মাও দম্ভ করিয়া বলিলেন, “তুমিও যাই বল না কেন, আমি যদি কায়েতের মেয়ে হই, তবে তোমার এ বিবাহ দিবই দিব।”
আমি হাসিয়া বলিলাম, “তবে বোধ হয়, তুমি গোয়ালার মেয়ে। আমায় এ বিবাহ দিতে পারিবে না।”
ছোট মা বলিলেন, “না বাবা, আমি কায়েতের মেয়ে।”
ছোট মা বড় দুষ্ট। আমাকে বাবা বলিয়া গালি ফিরাইয়া দিলেন।