হেমচন্দ্র কিছু দিন উপবনগৃহে বাস করিলেন। জনার্দনের সহিত প্রত্যহ সাক্ষাৎ হইত; কিন্তু ব্রাহ্মণের বধিরতাপ্রযুক্ত ইঙ্গিতে আলাপ হইত মাত্র। মনোরমার সহিতও সর্বদা সাক্ষাৎ হইত, মনোরমা কখন তাঁহার সহিত উপযাচিকা হইয়া কথা কহিতেন, কখন বা বাক্যব্যয় না করিয়া স্থানান্তরে চলিয়া যাইতেন। বস্তুতঃ মনোরমার প্রকৃতি তাঁহার পক্ষে অধিকতর বিস্ময়জনক বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। প্রথমতঃ তাঁহার বয়ক্রমঃ দুরনুমেয়, সহজে তাঁহাকে বালিকা বলিয়া বোধ হইত, কিন্তু কখন কখন মনোরমাকে অতিশয় গাম্ভীর্যশালিনী দেখিতেন। মনোরমা কি অদ্যাপি কুমারী? হেমচন্দ্র একদিন কথোপকথনচ্ছলে মনোরমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মনোরমা, তোমার শ্বশুরবাড়ী কোথা?” মনোরমা কহিল, “বলিতে পারি না।” আর এক দিন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “মনোরমা, তুমি কয় বৎসরের হইয়াছ?” মনোরমা তাহাতেও উত্তর দিয়াছিলেন, “বলিতে পারি না।”

মাধবাচার্য হেমচন্দ্রকে উপবনে স্থাপিত করিয়া দেশপর্যটনে যাত্রা করিলেন। তাঁহার অভিপ্রায় এই যে, এ সময় গৌড়দেশীয় অধীন রাজগণ যাহাতে নবদ্বীপে সসৈন্য সমবেত হইয়া গৌড়েশ্বরের আনুকূল্য করেন, তদ্বিষয়ে তাঁহাদিগকে প্রবৃত্তি দেন। হেমচন্দ্র নবদ্বীপে তাঁহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। কিন্তু নিষ্কর্মে দিনযাপন ক্লেশকর হইয়া উঠিল। হেমচন্দ্র বিরক্ত হইলেন। এক একবার মনে হইতে লাগিল যে, দিগ্বিজয়কে গৃহরক্ষায় রাখিয়া অশ্ব লইয়া একবার গৌড়ে গমন করেন। কিন্তু তথায় মৃণালিনীর সাক্ষাৎ লাভ করিলে তাঁহার প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হইবে, বিনা সাক্ষাতে গৌড়যাত্রায় কি ফলোদয় হইবে? এই সকল আলোচনায় যদিও গৌড়যাত্রায় হেমচন্দ্র নিরস্ত হইলেন, তথাপি অনুদিন মৃণালিনীচিন্তায় হৃদয় নিযুক্ত থাকিত। একদা প্রদোষকালে তিনি শয়নকক্ষে, পর্যঙ্কোপরি শয়ন করিয়া মৃণালিনীর চিন্তা করিতেছিলেন। চিন্তাতেও হৃদয় সুখলাভ করিতেছিল। মুক্ত বাতায়নপথে হেমচন্দ্র প্রকৃতির শোভা নিরীক্ষণ করিতেছিলেন। নবীন শরদুদয়। রজনী চন্দ্রিকাশালিনী, আকাশ নির্মল, বিস্তৃত নক্ষত্রখচিত, ক্কচিৎ স্তরপরম্পরাবিন্যস্ত স্বেতাম্বুদমালায় বিভূষিত। বাতায়নপথে অদূরবর্তিনী ভাগীরথীও দেখা যাইতেছিল; ভাগীরথী বিশালোরসী, বহুদূরবিসর্পিণী, চন্দ্রকর—প্রতিঘাতে উজ্জ্বলতরঙ্গিণী, দূরপ্রান্তে ধূমময়ী, নববারি—সমাগম—প্রহ্লাদিনী। নববারি—সমাগমজনিত কল্লোল হেমচন্দ্র শুনিতে পাইতেছিলেন। বাতায়নপথে বায়ু প্রবেশ করিতেছিল। বায়ু গঙ্গাতরঙ্গে নিক্ষিপ্ত জলকণা—সংস্পর্শে শীতল, নিশাসমাগমে প্রফুল্ল বন্যকুসুমসংস্পর্শে সুগন্ধি; চন্দ্রকরপ্রতিঘাতী—শ্যামোজ্জ্বল বৃক্ষপত্র বিধূত করিয়া, নদীতীরবিরাজিত কাশকুসুম আন্দোলিত করিয়া, বায়ু বাতায়নপথে প্রবেশ করিতেছিল। হেমচন্দ্র বিশেষ প্রীতিলাভ করিলেন।

অকস্মাৎ বাতায়নপথ অন্ধকার হইল—চন্দ্রালোকের গতি রোধ হইল। হেমচন্দ্র বাতায়নসন্নিধি একটি মনুষ্যমুণ্ড দেখিতে পাইলেন। বাতায়ন, ভূমি হইতে কিছু উচ্চ—এজন্য কাহারও হস্তপদাদি কিছু দেখিতে পাইলেন না—কেবল একখানি মুখ দেখিলেন। মুখখানি অতি বিশালশ্মশ্রুসংযুক্ত, তাহার মস্তকে উষ্ণীষ। সেই উজ্জ্বল চন্দ্রালোকে, বাতায়নের নিকটে, সম্মুখে শ্মশ্রুসংযুক্ত উষ্ণীষধারী মনুষ্যমুণ্ড দেখিয়া, হেমচন্দ্র শয্যা হইতে লম্ফ দিয়া নিজ শাণিত অসি গ্রহণ করিলেন।

অসি গ্রহণ করিয়া হেমচন্দ্র চাহিয়া দেখিলেন যে, বাতায়নে আর মনুষ্যমুণ্ড নাই।

হেমচন্দ্র অসিহস্তে দ্বারোদ্ঘাটন করিয়া গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। বাতায়নতলে আসিলেন। তথায় কেহ নাই।

গৃহের চতুঃপার্শ্বে, গঙ্গাতীরে, বনমধ্যে হেমচন্দ্র ইতস্ততঃ অন্বেষণ করিলেন। কোথাও কাহাকে দেখিলেন না।

হেমচন্দ্র গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলেন। তখন রাজপুত্র পিতৃদত্ত যোদ্ধৃবেশে আপাদমস্তক আত্মশরীর মণ্ডিত করিলেন। অকালজলদোদয়বিমর্ষিত গগনমণ্ডলবৎ তাঁহার সুন্দর মুখকান্তি অন্ধকারময় হইল। তিনি একাকী সেই গম্ভীর নিশাতে শস্ত্রময় হইয়া যাত্রা করিলেন। বাতায়নপথে মনুষ্যমুণ্ড দেখিয়া তিনি জানিতে পারিয়াছিলেন যে, বঙ্গে তুরক আসিয়াছে।