সেই দিন মাধবাচার্যের পর্যটন সমাপ্ত হইল। তিনি নবদ্বীপে উপস্থিত হইলেন। তথায় প্রিয় শিষ্য হেমচন্দ্রেকে দর্শনদান করিয়া চরিতার্থ করিলেন। এবং আশীর্বাদ, আলিঙ্গন, কুশলপ্রশ্নাদির পরে বিরলে উভয়ের উদ্দেশ্য সাধনের কথোপকথন করিতে লাগিলেন।
আপন ভ্রমণবৃত্তান্ত সবিস্তারে বিবৃত করিয়া মাধবাচার্য কহিলেন, “এত শ্রম করিয়া কতকদূর কৃতকার্য হইয়াছি। এতদ্দেশে অধীন রাজগণের মধ্যে অনেকেই রণক্ষেত্রে সসৈন্যে সেন রাজার সহায়তা করিতে স্বীকৃত হইয়াছেন। অচিরাৎ সকলে আসিয়া নবদ্বীপে সমবেত হইবেন।”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তাঁহারা অদ্যই এ স্থলে না আসিলে সকলই বিফল হইবে। যবনসেনা আসিয়াছে, মহাবনে অবস্থিতি করিতেছে। আজি কালি নগর আক্রমণ করিবে।”
মাধবাচার্য শুনিয়া শিহরিয়া উঠিলেন। কহিলেন, “গৌড়েশ্বরের পক্ষ হইতে কি উদ্যম হইয়াছে?”
হে। কিছুই না। বোধ হয়, রাজসন্নিধানে এ সংবাদ এ পর্যন্ত প্রচার হয় নাই। আমি দৈবাৎ কালি এ সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছি।
মা। এ বিষয় তুমি রাজগোচর করিয়া সৎপরামর্শ দাও নাই কেন?
হে। সংবাদপ্রাপ্তির পরেই পথিমধ্যে দস্যু কর্তৃক আহত হইয়া রাজপথে পড়িয়াছিলাম। এই মাত্র গৃহে আসিয়া কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিতেছি। বলহানিপ্রযুক্ত রাজসমক্ষে যাইতে পারি নাই। এখনই যাইতেছি।
মা। তুমি এখন বিশ্রাম কর। আমি রাজার নিকট যাইতেছি। পশ্চাৎ যেরূপ হয় তোমাকে জানাইব।
এই বলিয়া মাধবাচার্য গাত্রোত্থান করিলেন।
তখন হেমচন্দ্র বলিলেন, “প্রভু! আপনি গৌড় পর্যন্ত গমন করিয়াছিলেন শুনিলাম___”
মাধবাচার্য অভিপ্রায় বুঝিয়া কহিলেন, “গিয়াছিলাম। তুমি মৃণালিনীর সংবাদ কামনা করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছ? মৃণালিনী তথায় নাই।”
হে। কোথায় গিয়াছে?
মা। তাহা আমি অবগত নহি, কেহ সংবাদ দিতে পারিল না।
হে। কেন গিয়াছে?
মা। বৎস! সে সকল পরিচয় যুদ্ধান্তে দিব।
হেমচন্দ্র ভ্রূকুটি করিয়া কহিলেন, “স্বরূপ বৃত্তান্ত আমাকে জানাইলে, আমি যে মর্মপীড়ায় কাতর হইব, সে আশঙ্কা করিবেন না। আমিও কিয়দংশ শ্রবণ করিয়াছি। যাহা অবগত আছেন, তাহা নিঃসঙ্কোচে আমার নিকট প্রকাশ করুন।”
মাধবাচার্য গৌড়নগরে গমন করিলে হৃষীকেশ তাঁহাকে আপন জ্ঞানমত মৃণালিনীর বৃত্তান্ত জ্ঞাত করিয়াছিলেন। তাহাই প্রকৃত বৃত্তান্ত বলিয়া মাধবাচার্যেরও বোধ হইয়াছিল; মাধবাচার্য কস্মিন্কালে স্ত্রীজাতির অনুরাগী নহেন-সুতরাং স্ত্রীচরিত্র বুঝিতেন না। এক্ষণে হেমচন্দ্রের কথা শুনিয়া তাঁহার বোধ হইল যে, হেমচন্দ্র সেই বৃত্তান্তই কতক কতক শ্রবণ করিয়া মৃণালিনীর কামনা পরিত্যাগ করিয়াছেন-অতএব কোন নূতন মনঃপীড়ার সম্ভাবনা নাই বুঝিয়া, পুনর্বার আসনগ্রহণপূর্বক হৃষীকেশের কথিত বিবরণ হেমচন্দ্রকে শুনাইতে লাগিলেন।
হেমচন্দ্র অধোমুখে করতলোপরি ভ্রূকুটিকুটি ললাট সংস্থাপিত করিয়া নিঃশব্দে সমুদয় বৃত্তান্ত শ্রবণ করিলেন। মাধবাচার্যের কথা সমাপ্ত হইলেও বাঙ্কনিষ্পত্তি করিলেন না। সেই অবস্থাতেই রহিলেন। মাধবাচার্য ডাকিলেন, “হেমচন্দ্র!” কোন উত্তর পাইলেন না। পুনরপি ডাকিলেন, “হেমচন্দ্র!” তথাপি নিরুত্তর।
তখন মাধবাচার্য গাত্রোত্থান করিয়া হেমচন্দ্রের হস্ত ধারণ করিলেন; অতি কোমল, স্নেহময় স্বরে কহিলেন, “বৎস! তাত! মুখ তোল, আমার সঙ্গে কথা কও!”
হেমচন্দ্র মুখ তুলিলেন। মুখ দেখিয়া মাধবাচার্যও ভীত হইলেন। মাধবাচার্য কহিলেন, “আমার সহিত আলাপ কর। ক্রোধ হইয়া থাকে, তাহা ব্যক্ত কর।”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “কাহার কথায় বিশ্বাস করিব? হৃষীকেশ একরূপ কহিয়াছে। ভিখারিণী আর এক প্রকার বলিল।”
মাধবাচার্য কহিলেন, “ভিখারিণী কে? সে কি বলিয়াছে?”
হেমচন্দ্র অতি সংক্ষেপে উত্তর দিলেন।
মাধবাচার্য সঙ্কুচিত স্বরে কহিলেন, “হৃষীকেশেরই কথা মিথ্যা বোধ হয়।”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “হৃষীকেশের প্রত্যক্ষ।”
তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন। পিতৃদত্ত শূল হস্তে লইলেন। কম্পিত কলেবরে গৃহমধ্যে নিঃশব্দে পাদচারণ করিতে লাগিলেন।
আচার্য জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি ভাবিতেছ?”
হেমচন্দ্র করস্থ শূল দেখাইয়া কহিলেন, “মৃণালিনীকে এই শূলে বিদ্ধ করিব।”
মাধবাচার্য তাঁহার মুখকান্তি দেখিয়া ভীত হইয়া অপসৃত হইলেন।
প্রাতে মৃণালিনী বলিয়া গিয়াছিলেন, “হেমচন্দ্র আমারই।”