তৃতীয় পরিচ্ছেদ
ভিখারিণী
সখীদ্বয় এই সকল কথাবার্তা কহিতেছিলেন, এমন সময়ে কোমলকণ্ঠনি:সৃত মধুর সঙ্গীত তাঁহাদিগের কর্ণরন্ধ্রে প্রবেশ করিল।
“মথুরাবাসিনি, মধুরহাসিনি,
শ্যামবিলাসিনি-রে!”
মৃণালিনী কহিলেন, “সই, কোথায় গান করিতেছে?”
মণিমালিনী কহিলেন, “বাহির বাড়ীতে গায়িতেছে!”
গায়ক গায়িতে লাগিল।
“কহ লো নাগরি, গেহ পরিহরি,
কাহে বিবাসিনী-রে।”
মৃ। সখি! কে গায়িতেছে জান?
ম। কোন ভিখারিণী হইবে।
আবার গীত—
“বৃন্দাবনধন, গোপিনীমোহন,
কাঁহে তু তেয়াগী-রে;
দেশ দেশ পর, সো শ্যামসুন্দর,
ফিরে তুয়া লাগি-রে।”
মৃণালিনী বেগের সহিত কহিলেন, “সই! সই! উহাকে বাটীর ভিতর ডাকিয়া আন।”
মণিমালিনী গায়িকাকে ডাকিতে গেলেন। ততক্ষণ সে গায়িতে লাগিল—
“বিকচ নলিনে, যমুনা-পুলিনে,
বহুত পিয়াসা-রে।
চন্দ্রমাশালিনী, যা মধুযামিনী,
না মিটল আশা-রে।
সা নিশা-সমরি———”
এমন সময়ে মণিমালিনী উহাকে ডাকিয়া বাটীর ভিতর আনিলেন।
সে অন্তঃপুরে আসিয়া পূর্ববৎ গায়িতে লাগিল—
“সা নিশা সমরি, কহ লো সুন্দরি,
কাহা মিলে দেখা-রে।
শুনি যাওয়ে চলি, বাজয়ি মুরলী,
বনে বনে একা-রে।”
মৃণালিনী তাহাকে কহিলেন, “তোমার দিব্য গলা, তুমি গীতটি আবার গাও।”
গায়িকার বয়স ষোল বৎসর। ষোড়শী, খর্বাকৃতা এবং কৃষ্ণাঙ্গী। সে প্রকৃত কৃষ্ণবর্ণা। তাই বলিয়া তাহার গায়ে ভ্রমর আসিলে যে দেখা যাইত না, অথবা কালি মাখিলে জল মাখিয়াছে বোধ হইত, কিংবা জল মাখিলে কালি বোধ হইত, এমন নহে। যেরূপ কৃষ্ণবর্ণ আপনার ঘরে থাকিলে শ্যামবর্ণ বলি, পরের ঘরে হইলে পাতুরে কালো বলি, ইহার সেইরূপ কৃষ্ণবর্ণ। কিন্তু বর্ণ যেমন হউক না কেন, ভিখারিণী কুরূপা নহে। তাহার অঙ্গ পরিষ্কার, সুমার্জিত, চাকচিক্যবিশিষ্ট; মুখখানি প্রফুল্ল, চক্ষু দুটি বড়, চঞ্চল, হাস্যময়; লোচনতারা নিবিড়কৃষ্ণ, একটি তারার পার্শ্বে একটি তিল। ওষ্ঠাধর ক্ষুদ্র, রক্তপ্রভ, তদন্তরে অতি পরিষ্কার অমলশ্বেত, কুন্দকলিকাসন্নিভ দুই শ্রেণী দন্ত। কেশগুলি সূক্ষ্ম, গ্রীবার উপরে মোহিনী কবরী, তাহাতে যূথিকার মালা বেষ্টিত। যৌবনসঞ্চারে শরীরের গঠন সুন্দর হইয়াছিল, যেন কৃষ্ণপ্রস্তরে কোন শিল্পকার পুত্তল খোদিত করিয়াছিল। পরিচ্ছদ অতি সামান্য, কিন্তু পরিষ্কার- ধূলিকর্দমপরিপূর্ণ নহে। অঙ্গ একেবারে নিরাভরণ নহে, অথচ অলঙ্কারগুলি ভিখারীর যোগ্য বটে। প্রকোষ্ঠে পিত্তলের বলয়, গলায় কাষ্ঠের মালা, নাসিকায় ক্ষুদ্র তিলক, ভ্রূমধ্যে ক্ষুদ্র একটি চন্দনের টিপ। সে আজ্ঞামত পূর্ববৎ গায়িতে লাগিল—
“মথুরাবাসিনি, মধুরহাসিনি, শ্যামবিলাসিনি-রে।
কহ লো নাগরি, গেহ পরিহরি, কাহে বিবাসিনী-রে॥
বৃন্দাবনধন, গোপিনীমোহন, কাঁহে তু তেয়াগী-রে।
দেশ দেশ পর, সো শ্যামসুন্দর, ফিরে তুয়া লাগি-রে॥
বিকচ নলিনে, যমুনা-পুলিনে, বহুত পিয়াসা-রে।
চন্দ্রমাশালিনী, যা মধুযামিনী, না মিটল আশা-রে॥
সা নিশা সমরি, কহ লো সুন্দরী, কাঁহা মিলে দেখা-রে।
শুনি যাওয়ে চলি, বাজয়ি মুরলী, বনে বনে একা-রে॥”
গীত সমাপ্ত হইলে মৃণালিনী কহিলেন, “তুমি সুন্দর গাও। সই মণিমালিনী, ইহাকে কিছু দিলে ভাল হয়। একে কিছু দাও না?”
মণিমালিনী পুরস্কার আনিতে গেলেন, ইত্যবসরে মৃণালিনী বালিকাকে নিকটে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “শুন ভিখারিণি! তোমার নাম কি?”
ভি। আমার নাম গিরিজায়া।
মৃ। তোমার বাড়ী কোথায়?
গি। এই নগরেই থাকি।
মৃ। তুমি কি গীত গাইয়া দিনপাত কর?
গি। আর কিছুই ত জানি না।
মৃ। তুমি গীত সকল কোথায় পাও?
গি। যেখানে যা পাই তাই শিখি।
মৃ। এ গীতটি কোথায় শিখিলে?
গি। একটি বেণে আমাকে শিখাইয়াছে।
মৃ। সে বেণে কোথায় থাকে?
গি। এই নগরেই আছে।
মৃণালিনীর মুখ হর্ষোৎফুল্ল হইল— প্রাতঃসূর্যকরস্পর্শে যেন পদ্ম ফুটিয়া উঠিল। কহিলেন, “বেণেতে বাণিজ্য করে— সে বণিক কিসের বাণিজ্য করে?”
গি। সবার যে ব্যবসা, তারও সেই ব্যবসা।
মৃ। সে কিসের ব্যবসা?
গি। কথার ব্যবসা।
মৃ। এ নূতন ব্যবসা বটে। তাহাতে লাভালাভ কিরূপ?
গি। ইহাতে লাভের অংশ ভালবাসা, অলাভ কোন্দল।
মৃ। তুমিও ব্যবসায়ী বটে। ইহার মহাজন কে?
গি। যে মহাজন।
মৃ। তুমি ইহার কি?
গি। নগ্দাই মুটে।
মৃ। ভাল তোমার বোঝা নামাও। সামগ্রী কি আছে দেখি।
গি। এ সামগ্রী দেখে না; শুনে।
মৃ। ভাল-শুনি।
গিরিজায়া গায়িতে লাগিল—
“যমুনার জলে মোর, কি নিধি মিলিল।
ঝাঁপ দিয়া পশি জলে, যতনে তুলিয়া গলে,
পরেছিনু কুতূহলে, যে রতনে।
নিদ্রার আবেশে মোর গৃহেতে পলিশ চোর,
কণ্ঠের কাটিল ডোর মণি হরে নিল।”
মৃণালিনী, বাষ্পপীড়িতলোচনে, গদ্গদস্বরে, অথচ হাসিয়া কহিলেন, “এ কোন্ চোরের কথা?”
গি। বেণে বলেছেন, চুরির ধন লইয়াই তাঁহার ব্যাপার।
মৃ। তাঁহাকে বলিও যে, চোরা ব্যাপারে সাধু লোকের প্রাণ বাঁচে না।
গি। বুঝি ব্যাপারিরও নয়।
মৃ। কেন, ব্যাপারির কি?
গিরিজায়া গায়িল-
“ঘাট বাট তট মাঠ ফিরি ফিরনু বহু দেশ।
কাঁহা মেরে কান্ত বরণ, কাঁহা রাজবেশ।
হিয়া পর রোপনু পঙ্কজ, কৈনু যতন ভারি।
সোহি পঙ্কজ কাঁহা মোর, কাঁহা মৃণাল হামারি॥”
মৃণালিনী সস্নেহে কোমল স্বরে কহিলেন, “মৃণাল কোথায়? আমি সন্ধান বলিয়া দিতে পারি, তাহা মনে রাখিতে পারিবে?”
গি। পারিব— কোথায় বল।
মৃণালিনী বলিলেন,
“কণ্টকে গঠিল বিধি, মৃণাল অধমে।
জলে তারে ডুবাইল পীড়িয়া মরমে॥
রাজহংস দেখি এক নয়নরঞ্জন।
চরণ বেড়িয়া তারে, করিল বন্ধন॥
বলে হংসরাজ কোথা করিবে গমন।
হৃদয়কমলে মোর, তোমার আসন॥
আসিয়া বসিল হংস হৃদয়কমলে।
কাঁপিল কণ্টক সহ মৃণালিনী জলে॥
হেনকালে কাল মেঘ উঠিল আকাশে।
উড়িল মরালরাজ, মানস বিলাসে॥
ভাঙ্গিল হৃদয়পদ্ম তার বেগভরে।
ডুবিল অতল জলে, মৃণালিনী মরে॥”
কেমন গিরিজায়া, গীত শিখিতে পারিবে?
গি। তা পারিব। চক্ষের জলটুকু শুদ্ধ কি শিখিব?
মৃ। না। এ ব্যবসায়ে আমার লাভের মধ্যে ঐটুকু।
মৃণালিনী গিরিজায়াকে এই কবিতাগুলি অভ্যাস করাইতেছিলেন, এমন সময়ে মণিমালিনীর পদধ্বনি শুনিতে পাইলেন। মণিমালিনী তাঁহার স্নেহশালিনী সখী- সকলই জানিয়াছিলেন। তথাপি মণিমালিনী পিতৃপ্রতিজ্ঞাভঙ্গের সহায়তা করিবে, এরূপ তাঁহার বিশ্বাস জন্মিল না। অতএব তিনি এ সকল কথা সখীর নিকট গোপনে যত্নবতী হইয়া গিরিজায়াকে কহিলেন, “আজি আর কাজ নাই; বেণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও। তোমার বোঝা কাল আবার আনিও। যদি কিনিবার কোন সামগ্রী থাকে, তবে আমি কিনিব।”
গিরিজায়া বিদায় হইল। মৃণালিনী যে তাহাকে পারিতোষিক দিবার অভিপ্রায় করিয়াছিলেন, তাহা ভুলিয়া গিয়াছিলেন। গিরিজায়া কতিপয় পদ গমন করিলে মণিমালিনী কিছু চাউল, একছড়া কলা, একখানি পুরাতন বস্ত্র, আর কিছু কড়ি আনিয়া গিরিজায়াকে দিলেন। আর মৃণালিনীও একখানি পুরাতন বস্ত্র দিতে গেলেন। দিবার সময়ে উহার কানে কানে কহিলেন, “আমার ধৈর্য হইতেছে না, কালি পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে পারিব না; তুমি আজ রাত্রে প্রহরেকের সময় আসিয়া এই গৃহের উত্তরদিকে প্রাচীনমূলে অবস্থিতি করিও; তথায় আমার সাক্ষাৎ পাইবে। তোমার বণিক যদি আসেন সঙ্গে আনিও।”
গিরিজায়া কহিল, “বুঝিয়াছি, আমি নিশ্চিত আসিব।”
মৃণালিনী মণিমালিনীর নিকট প্রত্যাগত্যা হইলে মণিমালিনী কহিলেন, “সই, ভিখারিণীকে কাণে কাণে কি বলিতেছিলে?”
মৃণালিনী কহিলেন,
“কি বলিব সই—
সই মনের কথা সই, সই মনের কথা সই—
কাণে কাণে কি কথাটি বলে দিলি ওই॥
সই ফিরে ক’না সই, সই ফিরে ক’না সই।
সই কথা কোস কথা কব, নইলে কারো নই।”
মণিমালিনী হাসিয়া কহিলেন, “হলি কি লো সই?”
মৃণালিনী কহিলেন, “তোমারই সই।”