গিরিজায়া কহিল, “গৃহে চল।”
মৃণালিনী বলিলেন, “নগরে এ কিসের গোলযোগ?” তখন যবনসেনা নগর মন্থন করিতেছিল।
তুমুল কোলাহল শুনিয়া উভয়ের শঙ্কা হইল। গিরিজায়া বলিল, “চল, এই বেলা সতর্ক হইয়া যাই।” কিন্তু দুইজন রাজপথের নিকট পর্যন্ত গিয়া দেখিলেন, গমনের কোন উপায়ই নাই। অগত্যা প্রত্যাগমন করিয়া সরোবর-সোপানে বসিলেন। গিরিজায়া বলিল, “যদি এখানে উহারা আইসে?”
মৃণালিনী নীরবে রহিলেন। গিরিজায়া আপনিই বলিল, “বনের ছায়ামধ্যে এমন লুকাইব-কেহ দেখিতে পাইবে না।”
উভয়ে আসিয়া সোপানোপরি উপবেশন করিয়া রহিলেন।
মৃণালিনী ম্লানবদনে গিরিজায়াকে কহিলেন, “গিরিজায়া, বুঝি আমার যথার্থই সর্বনাশ উপস্থিত হইল।”
গি। সে কি!
মৃ। এই এক অশ্বারোহী গমন করিল; ইনি হেমচন্দ্র। সখি-নগরে ঘোর যুদ্ধ হইতেছে; যদি নিঃসহায় প্রভু সে যুদ্ধে গিয়া থাকেন-না জানি কি বিপদে পড়িবেন!গিরিজায়া কোন উত্তর করিতে পারিল না। তাহার নিদ্রা আসিতেছিল। কিয়ৎক্ষণ পরে মৃণালিনী দেখিলেন যে, গিরিজায়া ঘুমাইতেছে।
মৃণালিনীও, একে আহারনিদ্রাভাবে দুর্বলা-তাহাতে সমস্ত রাত্রিদিন মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করিতেছিলেন, সুতরাং নিদ্রা ব্যতীত আর শরীর বহে না-তাঁহারও তন্দ্রা আসিল। নিদ্রায় তিনি স্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন। দেখিলেন যে, হেমচন্দ্র একাকী সর্বসমরে বিজয়ী হইয়াছেন। মৃণালিনী যেন বিজয়ী বীরকে দেখিতে রাজপথে দাঁড়াইয়াছিলেন। রাজপথে হেমচন্দ্রের অগ্রে, পশ্চাৎ, কত হস্তী, অশ্ব, পদাতি যাইতেছে। মৃণালিনীকে যেন সেই সেনাতরঙ্গ ফেলিয়া দিয়া চরণদলিত করিয়া চলিয়া গেল-তখন হেমচন্দ্র নিজ সৈন্ধবী তুরঙ্গী হইতে অবতরণ করিয়া তাঁহাকে হস্ত ধরিয়া উঠাইলেন। তিনি যেন হেমচন্দ্রকে বলিলেন, “প্রভু! অনেক যন্ত্রণা পাইয়াছি; দাসীকে আর ত্যাগ করিও না।” হেমচন্দ্র যেন বলিলেন, “আর কখন তোমায় ত্যাগ করিব না।” সেই কণ্ঠসবরে যেন-
তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইল, “আর কখনও তোমায় ত্যাগ করিব না” জাগ্রতেও এই কথা শুনিলেন। চক্ষু উন্মীলন করিলেন-কি দেখিলেন? যাহা দেখিলেন, তাহা বিশ্বাস হইল না। আবার দেখিলেন সত্য! হেমচন্দ্র সম্মুখে! হেমচন্দ্র বলিতেছেন-“আর একবার ক্ষমা কর-আর কখনও তোমায় ত্যাগ করিব না।”
নিরভিমানিনী, নির্লজ্জা মৃণালিনী আবার তাঁহার কণ্ঠলগ্না হইয়া স্কন্ধে মস্তক রক্ষা করিলেন।