» » » একাদশ পরিচ্ছেদ : পূর্ব পরিচয়

প্রভাতে হেমচন্দ্র মাধবাচার্যের অনুসন্ধানে যাত্রা করিলেন। গিরিজায়া আসিয়া মৃণালিনীর নিকট বসিল।

গিরিজায়া মৃণালিনীর দুঃখের ভাগিনী হইয়াছিল, সহৃদয় হইয়া দুঃখের সময় দুঃখের কাহিনী সকল শুনিয়াছিল। আজি সুখের দিনে সে কেন সুখের ভাগিনী না হইবে? আজি সেইরূপ সহৃদয়তার সহিত সুখের কথা কেন না শুনিবে? গিরিজায়া ভিখারিণী, মৃণালিনী মহাধনীর কন্যা-উভয়ে এতদূর সামাজিক প্রভেদ। কিন্তু দুঃখের দিনে গিরিজায়া মৃণালিনীর একমাত্র সুহৃৎ, সে সময়ে ভিখারিণী আর রাজপুরবধূতে প্রভেদ থাকে না; আজি সেই বলে গিরিজায়া মৃণালিনীর হৃদয়ের সুখের অংশাধিকারিণী হইল।

যে আলাপ হইতেছিল, তাহাতে গিরিজায়া বিস্মিত ও প্রীত হইতেছিল। সে মৃণালিনীকে জিজ্ঞাসা করিল, “তা এতদিন এমন কথা প্রকাশ কর নাই কি জন্য?”

মৃ। এতদিন রাজপুত্রের নিষেধ ছিল, এজন্য প্রকাশ করি নাই। এক্ষণে তিনি প্রকাশের অনুমতি করিয়াছেন, এজন্য প্রকাশ করিতেছি।

গি। ঠাকুরাণি! সকল কথা বল না? আমার শুনিয়া বড় তৃপ্তি হবে।

তখন মৃণালিনী বলিতে আরম্ভ করিলেন, “আমার পিতা একজন বৌদ্ধমতাবলম্বী শ্রেষ্ঠী। তিনি অত্যন্ত ধনী ও মথুরারাজের প্রিয়পাত্র ছিলেন-মথুরার রাজকন্যার সহিত আমার সখিত্ব ছিল।

আমি একদিন মথুরায় রাজকন্যার সঙ্গে নৌকায় যমুনার জলবিহারে গিয়াছিলাম। তথায় অকস্মাৎ ঝড়বৃষ্টি আরম্ভ হওয়ায়, নৌকা জলমধ্যে ডুবিল। রাজকন্যা প্রভৃতি অনেকেই রক্ষক ও নাবিকদের হাতে রক্ষা পাইলেন। আমি ভাসিয়া গেলাম। দৈবযোগে এক রাজপুত্র সেই সময়ে নৌকায় বেড়াইতেছিলেন। তাঁহাকে তখন চিনিতাম না-তিনিই হেমচন্দ্র। তিনিও বাতাসের ভয়ে নৌকা তীরে লইতেছিলেন। জলমধ্যে আমার চুল দেখিতে পাইয়া স্বয়ং জলে পড়িয়া আমাকে উঠাইলেন। আমি তখন অজ্ঞান! হেমচন্দ্র আমার পরিচয় জানিতেন না। তিনি তখন তীর্থদর্শনে মথুরায় আসিয়াছিলেন। তাঁহার বাসায় আমায় লইয়া গিয়া শুশ্রূষা করিলেন। আমি জ্ঞান পাইলে, তিনি আমার পরিচয় লইয়া আমাকে আমার বাপের বাড়ী পাঠাইবার উদ্যোগ করিলেন। কিন্তু তিন দিবস পর্যন্ত ঝড়বৃষ্টি থামিল না। এরূপ দুর্দিন হইল যে, কেহ বাড়ীর বাহির হইতে পারে না। সুতরাং তিন দিন আমাদিগের উভয়কে এক বাড়ীতে থাকিতে হইল। উভয়ে উভয়ের পরিচয় পাইলাম। কেবল কুল-পরিচয় নহে – উভয়ের অন্তঃকরণের পরিচয় পাইলাম। তখন আমার বয়স পনের বৎসর মাত্র। কিন্তু সেই বয়সেই আমি তাঁহার দাসী হইলাম। সে কোমল বয়সে সকল বুঝিতাম না। হেমচন্দ্রকে দেবতার ন্যায় দেখিতে লাগিলাম। তিনি যাহা বলিতেন, তাহা পুরাণ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। তিনি বলিলেন, বিবাহ কর।’ সুতরাং আমারও বোধ হইল, ইহা অবশ্য কর্তব্য। চতুর্থ দিবসে, দুর্যোগের উপশম দেখিয়া উপবাস করিলাম; দিগ্বিজয় উদ্যোগ করিয়া দিল। তীর্থপর্যটনে রাজপুত্রের কুলপুরোহিত সঙ্গে ছিলেন, তিনি আমাদিগের বিবাহ দিলেন।”

গি। কন্যা সম্প্রদান করিল কে?

মৃ। অরুন্ধতী নামে আমার এক প্রাচীন কুটুম্ব ছিলেন। তিনি সম্বন্ধে মার ভগিনী হইতেন। আমাকে বালককাল হইতে লালনপালন করিয়াছিলেন। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন; আমার সকল দৌরাত্ম্য সহ্য করিতেন। আমি তাঁহার নাম করিলাম। দিগ্বিজয় কোন ছলে পুরমধ্যে তাঁহাকে সংবাদ পাঠাইয়া দিয়া ছলক্রমে হেমচন্দ্রের গৃহে তাঁহাকে ডাকিয়া আনিল। অরুন্ধতী মনে জানিতেন, আমি যমুনায় ডুবিয়া মরিয়াছি। তিনি আমাকে জীবিত দেখিয়া এতই আহ্লাদিত হইলেন যে, আর কোন কথাতেই অসন্তুষ্ট হইলেন না। আমি যাহা বলিলাম, তাহাতেই স্বীকৃত হইলেন। তিনিই কন্যা সম্প্রদান করিলেন। বিবাহের পর মাসী সঙ্গে বাপের বাড়ী গেলাম। সকল সত্য বলিয়া কেবল বিবাহের কথা লুকাইলাম। আমি, হেমচন্দ্র, দিগ্বিজয়, কুলপুরোহিত আর অরুন্ধতী মাসী ভিন্ন এ বিবাহ আর কেহ জানিত না। অদ্য তুমি জানিলে।

গি। মাধবাচার্য জানেন না?

মৃ। না, তিনি জানিলে সর্বনাশ হইত। মগধরাজ তাহা হইলে অবশ্য শুনিতেন। আমার বাপ বৌদ্ধ, মগধরাজ বৌদ্ধের বিষম শত্রু।

গি। ভাল, তোমার বাপ যদি তোমাকে এ পর্যন্ত কুমারী বলিয়া জানিতেন, তবে এত বয়সেও তোমার বিবাহ দেন নাই কেন?

মৃ। বাপের দোষ নাই। তিনি অনেক যত্ন করিয়াছেন, কিন্তু বৌদ্ধ সুপাত্র পাওয়া সুকঠিন; কেন না, বৌদ্ধধর্ম প্রায় লোপ হইয়াছে। পিতা বৌদ্ধ জামাতা চাহেন, অথচ সুপাত্র চাহেন। এরূপ একটি পাওয়া গিয়াছিল, সে আমার বিবাহের পর। বিবাহের দিন স্থির হইয়া সকল উদ্যোগও হইয়াছিল। কিন্তু আমি সেই সময়ে জ্বর করিয়া বসিলাম। পাত্র অন্যত্র বিবাহ করিল।

গি। ইচ্ছাপূর্বক জ্বর করিয়াছিলে?

মৃ। হাঁ, ইচ্ছাপূর্বক। আমাদিগের উদ্যানে একটি কূয়া আছে, তাহার জল কেহ স্পর্শ করে না। তাহার পানে বা স্নানে নিশ্চিত জ্বর। আমি রাত্রিতে গোপনে সেই জলে স্নান করিয়াছিলাম।

গি। আবার সম্বন্ধ হইলে, সেইরূপ করিতে?

মৃ। সন্দেহ কি? নচেৎ হেমচন্দ্রের নিকট পলাইয়া যাইতাম।

গি। মথুরা হইতে মগধ এক মাসের পথ। স্ত্রীলোক হইয়া কাহার সহায়ে পলাইতে?

মৃ। আমার সহিত সাক্ষাতের জন্য হেমচন্দ্র মথুরায় এক দোকান করিয়া আপনি তথায় রত্নদাস বণিক বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন। বৎসরে একবার করিয়া তথায় বাণিজ্য করিতে আসিতেন। যখন তিনি তথায় না থাকিতেন, তখন দিগ্বিজয় তথায় তাঁহার দোকান রাখিত। দিগ্বিজয়ের প্রতি আদেশ ছিল যে, যখন আমি যেরূপ আজ্ঞা করিব, সে তখনই সেরূপ করিবে। সুতরাং আমি নিঃসহায় ছিলাম না।

কথা সমাপ্ত হইলে গিরিজায়া বলিল, “ঠাকুরাণি! আমি একটি গুরুতর অপরাধ করিয়াছি। আমাকে মার্জনা করিতে হইবে। আমি তাহার উপযুক্ত প্রায়শ্চিত্ত করিতে স্বীকৃত আছি।”

মৃ। কি এমন গুরুতর কাজ করিলে?

গি। দিগ্বিজয়টা তোমার হিতকারী, তাহা আমি জানিতাম না, আমি জানিতাম, ওটা অতি অপদার্থ। এজন্য আমি তাহাকে ভালরূপে ঘা কত ঝাঁটা দিয়াছি। তা ভাল করি নাই।

মৃণালিনী হাসিয়া বলিল, “তা কি প্রায়শ্চিত্ত করিবে?”

গি। ভিখারীর মেয়ের কি বিবাহ হয়?

মৃ। (হাসিয়া) করিলেই হয়।

গি। তবে আমি সে অপদার্থটাকে বিবাহ করিব-আর কি করি?

মৃণালিনী আবার হাসিয়া বলিলেন, “তবে আজি তোমার গায়ে হলুদ দিব।”