নিশ্চিত মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছে রানা। আবদুলের কথা ভাববার সময় তখন নয়, তবু নিজেকে মস্তবড় অপরাধী মনে হলো। ওর এই আকস্মিক নির্মম মৃত্যুর জন্যে মনে মনে নিজেকেই দায়ী করল রানা। এই মৃত্যুর ফাঁদে কেন ও আনতে গেল ওকে! কবীর চৌধুরীর ভয়ঙ্কর রূপ কি ও চিটাগাঙেই দেখেনি? তবু আজ এ দুঃসাহস করতে গেল কেন সে? আরও অনেক ভাবনা চিন্তা করে অনেক সাবধানে পা বাড়ানো উচিত ছিল ওর। একটু পরেই লুটিয়ে পড়বে ওর প্রাণহীন দেহটা আবদুলের পাশে। তেমনি এক তীক্ষ্ণ মরণ চিৎকার বেরিয়ে আসবে ওর মুখ দিয়েও। কিন্তু এ মৃত্যুতে লাভ তো কিছুই হলো না। রাহাত খান শুনলে কাঁচা পাকা ভুরু জোড়া কুঁচকে বলবেন, ‘ফুলিশ’। মেশিনগানধারীর উদ্দেশে মনে মনে বলল, ‘জলদি কর, হারামজাদা, দেরি করছিস কেন, যা করবি কর তাড়াতাড়ি!’

‘চলো, আগে বাড়ো।’ ঠেলা দিল পিছনের লোকটা।

সামনের লোকটাও এবার মেশিনগানের মাথাটা দিয়ে ডান দিকে ইঙ্গিত করল। ‘কোনও রকম শয়তানির চেষ্টা করলে ওই নির্বোধ পাঠানের অবস্থা হবে তোমারও। সাবধান!’

দুই পা এগিয়ে থামল রানা। ঘুরে দাঁড়াল আবদুলের দিকে মুখ করে। মৃতদেহটার দিকে চেয়ে মনে মনে বলল, ‘তোমার মৃত্যুর প্রতিশোধ আমি নেব আবদুল, প্রতিজ্ঞা করলাম।’ তারপর এগিয়ে গেল সামনে।

টিলার মাথায় সযত্নে ঘাস আর উলুখাগড়া লাগানো বেশ খানিকটা অংশ নিচু হয়ে সরে গেল এক পাশে। সিঁড়ি নেমে গেছে ভিতরে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে। উজ্জ্বল না হলেও স্বচ্ছ আলোয় আলোকিত ভিতরটা। পাক খেয়ে খেয়ে সতেরো-আঠারো ধাপ নামার পর একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল রানা। দু’ভাগ হয়ে সরে গেল দরজাটা দুপাশের দেয়ালের মধ্যে। সামনে প্রশস্ত একটা চারকোণা ঘর। জানালা নেই একটাও, শুধু চার দেয়ালের গায়ে বড় বড় চারটে দরজা।

পরিষ্কার আলোতে এসে আবদুলের হত্যাকারীর দিকে ভাল করে চাইল রানা। বেঁটে লোকটা। খুব বেশি হলে সোয়া পাঁচ ফুট উঁচু হবে। কিন্তু শরীর তো নয় যেন পেটা লোহা। পরনে খাকি হাফ প্যান্ট আর শার্ট। হাত-পায়ের থোকা থোকা বলিষ্ঠ পেশি দেখলেই বোঝা যায় অসুরের শক্তি আছে ওর গায়ে। মাথায় চুলগুলো কদম ছাঁট দেয়া। ছোট কুতকুঁতে, ধূর্ত চোখদুটো যেন জ্বলছে সারাক্ষণ। চ্যাপ্টা নাকের নীচে কালি মাখানো টুথব্রাশের মত খোঁচা খোঁচা গোঁফ চেহারার সঙ্গে বেমানান।

ডানধারের দরজাটার সামনে রানাকে ঠেলে নিয়ে যেতেই খুলে গেল সেটা। কোনও রকম বোতামের বালাই নেই, সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই আপনা আপনি খুলে যাচ্ছে দরজাগুলো। খুব ছোট একটা ঘর সামনে। ধাক্কা দিয়ে সেই ঘরের মধ্যে রানাকে ঢোকাল বেঁটে লোকটা। একজন অনুচরের হাতে সাব-মেশিনগানটা দিয়ে রানার ওয়ালথারটা নিল নিজে। বুড়ো আঙুল দিয়ে ওপর দিকটা দেখিয়ে হুকুম করল, ‘লাশ দুটো নিয়ে নীচতলায় মর্গে চলে যাও তোমরা সব। আমি না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে সেখানে। ওপরে ওঠার আগে রাডার গ্লাসটা দেখে নেবে ভাল করে।’

‘ঠিক হ্যায়, সর্দারজি।’ একজন উত্তর দিল।

এবার রানার পাশে দাঁড়াল বেঁটে সর্দার। দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতেই দেয়ালের গায়ে অনেকগুলো বোতামের মধ্যে ডানদিক থেকে তিন নম্বর বোতামটা টিপে দিল লোকটা। নীচু হয়ে রইল বোতামটা অন্যগুলোর চাইতে। নীচে নামতে আরম্ভ করতেই রানা বুঝল এটা একটা লিফট।

লোকটা রানার থেকে মাত্র হাত তিনেক তফাতে। পিস্তলটা আলগা ভাবে রানার পেটের দিকে মুখ করে ধরা। ঝাঁপিয়ে পড়বে নাকি ও অতর্কিতে? প্রতিশোধের এমন সুযোগ কী পাবে ও আর?

‘হেঁঃ হেঁঃ’ করে কর্কশ গলার হাসি শুনে রানা ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখল বিচ্ছিরি কালো গোঁফটার নীচে ঝক ঝক করছে সাদা দাঁত।

‘ওসব ধানাই-পানাই ছেড়ে দেও, বাপধন। ভাবছ, ঝাঁপিয়ে এসে কাবু করে ফেলবে আমাকে। শালা, উলুকা পাঠা! একবার চেষ্টা করেই দেখো না কেমন মজা!’

সামলে নিল নিজেকে রানা। সড় সড় করে নেমে চলেছে লিফট। চট করে গুনে নিল রানা মোট নয়টা বোতাম আছে দেয়ালের গায়ে। মনে মনে হিসেব করে ফেলল, এখন হয় সাততলায়, না হয় তিনতলায় নামছে ওরা। আধ মিনিট চলার পর থামল লিফট, রানা আন্দাজ করল, তিনতলায় পৌঁছল ওরা। ক্লিক করে একটা শব্দ করে যে দরজা দিয়ে লিফটে ঢুকেছিল তার ঠিক উল্টো দিকের অন্য একটা দরজা খুলে গেল। লিফট থেকে বেরিয়েই একটা দশ ফুট চওড়া মোজাইক করা করিডোর। লম্বা প্রায় পঞ্চাশ গজ হবে। দু’পাশে দেয়ালের গায়ে পরপর নম্বর লেখা। কিছুদূর বাঁয়ে যাবার পর একটা গলি দিয়ে দশ গজ গিয়ে ইএল ৩৬৯ লেখা নম্বরের সামনে দাঁড়াল বেঁটে সর্দার। একটা সাদা বোতাম একবার টিপল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নম্বরটার কিছু উপরে দুবার জ্বলে উঠল সবুজ বাতি। রানাকে এবার দেয়ালের দিকে ঠেলে দিল লোকটা। নাকটা দেয়ালের গায়ে লাগবার আগেই সরে গেল দেয়াল। সিয়িং আই ফটো ইলেকট্রিক সেলের কারবার।

সেই দরজা দিয়ে মস্ত বড় একটা ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াল রানা। অবাক কাণ্ড! এ যেন পাতালপুরীর রাজপ্রাসাদ। পাহাড়ের ভিতর সবটা এয়ারকণ্ডিশন করা। মেঝেতে ঝকঝকে মোজাইকের টাইলসে মোমপালিশ দেয়া। চারদিকের দেয়াল হাল্কা নীল রঙে ডিসটেম্পার করা। বিভিন্ন আকারের অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি সাজানো রয়েছে প্রকাণ্ড ঘরটায়। গোটা কতক সেগুন কাঠের বড় আলমারি। মোটা মোটা ইংরেজি বই সাজানো তাতে। একটা পড়ার টেবিল। ঘরে কাউকে দেখতে পেল না রানা।

‘এসব যন্ত্রপাতি হাঁ করে দেখা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই, মি. মাসুদ রানা। আপনি কেন, পৃথিবীর কেউই কখনও দেখেনি এ যন্ত্র। বুঝিয়ে না দিলে কিছুই বুঝবেন না এর মাহাত্ম।’ একটা যন্ত্রের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এল কবীর চৌধুরী। ‘আহা, দাঁড়িয়ে কেন, বসুন!’

একটা চাকা লাগানো স্টিলের চেয়ারে বসানো হলো রানাকে। চৌধুরীর ইঙ্গিতে একটা নাইলন কর্ড দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হলো তাকে সেই চেয়ারের সঙ্গে নিপুণভাবে, এক বিন্দু নড়াচড়া করবার ক্ষমতা রইল না আর। সন্তুষ্ট চিত্তে এবার বাঁকা পাইপটা ধরাল কবীর চৌধুরী।

‘আপনার চেহারা দেখে বুঝতে পারছি আমার গবেষণাকেন্দ্র দেখে খুব অবাক হয়ে গেছেন আপনি। কিন্তু আপনি যেটুকু দেখেছেন তা পুরোটার ছত্রিশ ভাগের এক ভাগ মাত্র। এ পাহাড়টাকে লম্বালম্বি চার ভাগ করে নিয়েছি আমি। পাহাড়ের মাথা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যে ঘরটায় এসে লিফটে উঠলেন, সে ঘরের চার দেয়ালে চারটে দরজা দেখেছেন–প্রত্যেকটাই লিফট। একটায় উঠে আমার ল্যাবরেটরিতে এসেছেন। অন্য লিফট দিয়ে নেমে অন্যান্য ল্যাবরেটরিতে যাওয়া যায়। এই রকম আরও তিনটে গবেষণাগারে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করছেন পৃথিবীর দশজন সেরা বৈজ্ঞানিক। এই চার ভাগের প্রত্যেকটি আবার নয়তলা। নীচ থেকে কাজ শুরু করে উপর পর্যন্ত সম্পূর্ণ করতে আমাদের পুরো পাঁচ বছর লেগেছে। এটাকে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোটোখাটো শহর বলতে পারেন।’

‘কিসের গবেষণা হচ্ছে আপনাদের এখানে?’

‘তা বলতে আমার আপত্তি নেই। তবে তার আগে একটা কথা আপনার জানা দরকার—আপনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত। আগামী কাল ঠিক সন্ধে সাতটায় এক অভিনব উপায়ে আপনাকে হত্যা করা হবে। এখবর জানবার পরেও কি আমাদের গবেষণা সম্পর্কে জানবার আগ্রহ আছে?’

‘নিশ্চয়ই। মরতে যখন হবে, জেনে মরি। তবে তার আগে আপনার এই বেঁটে বাদরটাকে বলুন আমার পকেট থেকে সিগারেট কেসটা বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিক।’ ভীত হয়ে পড়েছে এমন ভাব দেখাতে চায় না রানা।

চৌধুরীর ইঙ্গিতে বেঁটে লোকটা রানার পকেট থেকে ওয়াটারপ্রুফ কেসটা বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিল রানার ঠোঁটে। তৃপ্তির সঙ্গে গোটা কয়েক টান দিয়ে রানা বলল, ‘শুনি, কী নিয়ে পাগলামি চলছে আপনাদের।’

কয়েক সেকেণ্ড রানার চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে মৃদু হাসল চৌধুরী। বলল, ‘ধৃষ্টতা আমি সহ্য করি না, মি. মাসুদ রানা—চট্টগ্রামে তার প্রমাণ পেয়েছেন। কিন্তু এখন আপনাকে আমি কিছুই বলব না। তার কারণ আপনার কথায় কণা পরিমাণ হলেও সত্যতা সত্যিই আছে। পাগলামিই বটে। লোভও বলতে পারেন। প্রচণ্ড ক্ষমতার লোভ। থাস্ট ফর পাওয়ার। পৃথিবীতে সবাই চায় সার্থকতা। মানবজীবনের সার্থকতা তার পরিপূর্ণ আত্মবিকাশে। আমি নিজেকে কর্ষণ করে প্রভূত ক্ষমতা অর্জন করেছি। কোনও মহাপুরুষ যদি অসামান্য প্রতিভা নিয়ে জন্মে এবং নিজ প্রতিভাবলে প্রচণ্ড ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গোটা পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় এনে তার ইচ্ছেমত ঢেলে সাজাতে চায়, তবে তাকে আপনার মত সাধারণ লোক তো পাগলই বলবে। বল্টু, তুমি মাসুদ সাহেবকে সমস্ত গবেষণাগার ঘুরিয়ে দেখিয়ে নিয়ে এসো। আমি ততক্ষণে কয়েকটা কাজ সেরে নিই।’

একটা যন্ত্রের ওপর ঝুঁকে পড়ল চৌধুরী। রানাকে চেয়ারসুদ্ধ ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে বল্টু, কবীর চৌধুরী আবার বলল, ‘কেবল ঘুরিয়ে দেখাবে, কারও সঙ্গে কোনও কথা বলতে দেবে না। মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল বল্টু। রানা ভাবল, বল্টু! নামটা বড় মানানসই হয়েছে। বল্টুর মতই বেঁটে খাটো শক্ত সমর্থ চেহারা লোকটার।

একটা পাহাড়ের মধ্যে যে এমন বিরাট কারবার চলতে পারে তা রানার ধারণার বাইরে ছিল। পথ তো নয় যেন গোলকধাঁধা। এদিক থেকে ওদিকে, ওদিক থেকে আরেক দিকে কখনও লিফটে উঠছে, কখনও আপনাআপনি দরজা খুলে গিয়ে পথ তৈরি হচ্ছে। ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মোজাইক ফ্লোর। মুখ দেখা যায়। অবাক হয়ে রানা যা দেখল তাতে বুঝতে পারল আধুনিকতম যন্ত্রপাতির সাহায্যে কয়েকজন সুশিক্ষিত বৈজ্ঞানিক দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছে যেন কী এক নেশার ঘোরে। এত সব যন্ত্রপাতির মধ্যে কেবল গোটা কতক কম্পিউটার দেখে চিনতে পারল রানা। বোঝা গেল ফালতু লোক এরা নয়। মিথ্যে ভড়ং করেনি কবীর চৌধুরী। সত্যি সত্যিই বিরাট কিছু কাজ চলছে এই পাহাড়ের মধ্যে। মিনিট বিশেক পক্ষাঘাতে পঙ্গু রোগীর মত চেয়ারে বসে ঘুরে ঘুরে বিরক্ত হয়ে উঠল রানা। বলল, কথা বলতে দিচ্ছ না যখন, তখন কিছুই না বুঝে শুধু শুধু এভাবে বোকার মত ঘোরার কোনও মানে হয় না। ফিরে চলো।’

এত তাড়াতাড়ি ওদের ফিরে আসতে দেখে অবাক হলো চৌধুরী।

‘এরই মধ্যে সব দেখা হয়ে গেল?’

‘দুই সেকশন দেখেই ফিরে এসেছে,’ জবাব দিল বল্টু।

‘কিসের গবেষণা হচ্ছে বুঝতে না পারলে শুধু শুধু ঘুরে লাভ কী?’

‘দেখুন, বিজ্ঞান এই বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এমন একপর্যায়ে চলে এসেছে, এত স্পেশালাইজড হয়ে পড়েছে এর প্রত্যেকটি শাখা-প্রশাখা যে, আপনি তো কলা বিভাগের গ্র্যাজুয়েট মাত্র—একজন ভিন্ন শাখার বৈজ্ঞানিকেরও আপনার দশাই হত এই গবেষণাগারে ছেড়ে দিলে। তথ্যগাণিতিকের হিসেবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রতি পনেরো বছরে আমাদের এতদিনকার সঞ্চিত জ্ঞানের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতিটা কল্পনা করুন একবার! এবং এই অগ্রগতির সবচাইতে পুরোভাগে রয়েছি আমরা—এই গুপ্ত পাহাড়ের গোপন বৈজ্ঞানিকেরা। এক মহাপরিকল্পনাকে সামনে রেখে এগিয়ে চলেছি আমরা দ্রুত সাফল্যের দিকে।’

‘সে তো খুব ভাল কথা, কিন্তু এর মধ্যে আবার বাঁধটা ভাঙার মতলব ঢুকল কেন মাথায়?’

‘বলছি। তার আগে আমাদের গবেষণার কথা বলে নিই। আমার নিজের রিসার্চ হচ্ছে আট্রা-সোনিক্স। অতিশব্দ। সব কথা আপনি বুঝবেন না—মোটামুটি জেনে রাখুন প্রচণ্ড শক্তি আছে এই অতিশব্দের। একে বশে এনে আমি পারমাণবিক অস্ত্রের চাইতে বহুগুণ বেশি ক্ষমতাশালী এক অস্ত্র তৈরি করেছি। গোটা পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় আনবার এই আমার প্রথম অস্ত্র। এর ভাল দিকও আছে। সেদিকেও আমার নজর আছে। বিভিন্ন দিক থেকে এই অতিশব্দকে মানব কল্যাণের কাজে লাগানো হবে। পরে সে নিয়ে আরও আলোচনা করা যাবে। এখন অন্যান্য গবেষণাগুলো সম্বন্ধেও মোটামুটি একটা ধারণা দিয়ে নিই আপনাকে।’

পাইপটা আবার ধরিয়ে নিল চৌধুরী।

‘আমার দুজন জার্মান বন্ধুকে দিয়ে লেভিটেশন-এর উপর গবেষণা করাচ্ছি। লেভিটেশন হচ্ছে গ্র্যাভিটেশন বা মাধ্যাকর্ষণের ঠিক বিপরীত। কল্পনা করুন, কোনও বস্তুকে যদি মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবমুক্ত করে দেয়া যায় তবে তার কী অবস্থা হয়! শূন্যে ছেড়ে দিলেও সেটা মাটিতে পড়বে না। এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে দুই জার্মান বৈজ্ঞানিক। এ আবিষ্কার বিজ্ঞানের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে এক মহাবিপ্লবের সূচনা। হাজারো রকম কাজে লাগানো হবে এই শক্তিকে। কিন্তু সবচাইতে প্রথম আমি ব্যবহার করব একে আমার জেটে। আমার মহাপরিকল্পনাকে সফল করতে আমার প্রয়োজন দ্রুততম ট্রান্সপোর্ট। অ্যারোপ্লেন বলুন আর জেটই বলুন এদের সবাইকে কেবল শূন্যে ভেসে থাকবার জন্যই প্রায় অর্ধেকের বেশি শক্তি নষ্ট করতে হয়। আমার জেট আপনিই ভেসে থাকবে, পুরো শক্তি ব্যবহার করব আমি কেবল এগিয়ে যাবার কাজে। বুঝতে পারছেন?

আত্মতৃপ্তির একটা হাসি ফুটে উঠল কবীর চৌধুরীর মুখে।

‘আজকাল বিলেতে ওরা হুভার ক্র্যাফট তৈরি করছে জলে ডাঙায় সবখানে চলবার জন্যে। বাতাসকে প্রেশারাইজ করে এই গাড়ি মাটি বা পানি থেকে এক ফুট উঁচুতে থাকবে সবসময়—চলবে জেট প্রপালশনে। শুনছি নাকি ইংলিশ চ্যানেলের উপর হুভার-ক্র্যাফটের ডেইলি-প্যাসেঞ্জারি শুরু হবে অল্পদিনেই। কিন্তু এসবের চাইতে আমার জেট কতখানি উন্নত মানের হবে ভাবুন একবার।’

চুপচাপ কিছুক্ষণ পাইপ টানল কবীর চৌধুরী। রানাও একটা সিগারেট চেয়ে নিল।

‘যা বলছিলাম—এই লেভিটেশন। এ ব্যাপারটা পৃথিবীতে নতুন কিছুই নয়; এবং এর প্রিন্সিপলটাও খুবই সহজ। মিশরের পিরামিড হচ্ছে পৃথিবীর সপ্ত আশ্চর্যের একটি। আজকে কারিগরি বিদ্যার এত উন্নতির পরও বিংশ শতাব্দীতে আরেকটা পিরামিড তৈরি করা অসম্ভব। কেন জানেন? আজকের বড় বড় ইঞ্জিনিয়াররা মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও বের করতে পারেনি অত প্রকাণ্ড সব পাথর অখণ্ড অবস্থায় পিরামিডের অত ওপরে কী করে তোলা সম্ভব হলো। আমার, এবং আমার বন্ধুদ্বয়ের বিশ্বাস সেই যুগে অর্থাৎ আজ থেকে পাঁচ ছ’হাজার বছর আগেই মিশরীয়রা এ বিদ্যা আয়ত্ত করেছিল, এবং লেভিটেশনের সাহায্যেই প্রত্যেকটা পাথরকে ওজন-শূন্য করে নিয়ে অত ওপরে উঠিয়েছিল অনায়াসে।’

এসব আজগুবি গল্প নীরবে হজম করে চলেছে রানা। আবার আরম্ভ করল কবীর চৌধুরী।

‘আরেক দিকে ছ’জন বৈজ্ঞানিক রিসার্চ করছেন পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কে। আমরা আণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাই না। প্রয়োজনের সময় যেন বৃহৎ শক্তিবর্গের এই ঠুনকো অস্ত্র বানচাল করে দিতে পারি সে উদ্দেশ্যেই এই গবেষণা আমাদের। আটটা সুপার-কম্পিউটারের পাঁচটাকেই ওইখানে দেখেছেন। আর দেখেছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম অ্যাটম স্ম্যাশার। এর সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন আর একটা মাত্র স্ম্যাশার শুধু পাবেন আমেরিকার ব্রুক হ্যাঁভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে। আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছি আমরা এই ব্যাপারে।’

দেয়াল ঘড়িটার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে চৌধুরী বলল, ‘আমার হাতে বেশি সময় নেই। আন্ট্রা সোনিকস গেল, লেভিটেশন গেল, অ্যাটমিক রিসার্চ গেল, এখন অ্যান্টি-ম্যাটার। পৃথিবী বিখ্যাত পদার্থবিদ ডক্টর আর্থার ডুনিং এবং তার স্ত্রী গবেষণা করছেন এ নিয়ে। প্রতিটি অ্যাটমের একটা অ্যান্টি-অ্যাটম আছে। প্রতি…’

‘এসব শুনে আমার কোনও লাভ নেই,’ রানা বাধা দিল, ‘তা ছাড়া ভালও লাগছে না শুনতে। বুঝলাম, আপনারা কয়েকজন বিকৃতমস্তিষ্ক বৈজ্ঞানিক বিকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করছেন বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে। কিন্তু এর সঙ্গে কাপ্তাই বাঁধের কী সম্পর্ক?’

‘দুই বর্গমাইল জুড়ে ছিল আমার গবেষণাগার। আরও আটটা অপেক্ষাকৃত নিচু টিলা আমার বহু মূল্যবান যন্ত্রপাতিসহ ডুবে গেছে পানির তলায়। আর পনেরো দিনের মধ্যে এইটাও যেত। তাই উড়িয়ে দিচ্ছি আমি বাঁধটা।

‘লক্ষ লক্ষ মানুষকে সেজন্যে খুন করবেন আপনি?’

‘দেখুন, আমার কষ্টার্জিত হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে আমি তৈরি করেছি এই গবেষণাগার। মাত্র কয়েক লক্ষ প্রাণের চাইতে এর দাম আমার কাছে অনেক বেশি। আগামী পঁচিশ বছরের মধ্যে পাকিস্তানের লোকসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। তখন এই ক্ষতিকে লাভই মনে হবে।’ মৃদু হাসল কবীর চৌধুরী। পানি এখন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পাহাড়ের ভেতরে ঢুকতে আরম্ভ করেছে। আজ দেখি সোডিয়ামের ঘরের দেয়ালও ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে। অতগুলো ড্রামের সোডিয়ামে যদি কোনও ভাবে পানি বা অক্সিজেন ঢোকে, তবে চুরমার হয়ে যাবে গোটা পাহাড়।

রানার মনে পড়ল একটু আগে একটা ঘরের ভিতর দিয়ে যাবার সময় বড় বড় অনেকগুলো ড্রাম দেখেছে সে। সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে ঠোঁটের কাছে চলে এসেছে, নাকের ভিতর গরম ধোয়া ঢুকে ঝাঁঝ লাগছে রানার। ইঙ্গিত করতেই বল্টু সেটা নিয়ে অ্যাশট্রেতে ফেলল।

‘ইণ্ডিয়ার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কিসের?’

‘প্রয়োজনের সময়ে রামকেও বানরের সাহায্য নিতে হয়েছিল। বাঁধটা ভাঙবার প্রয়োজন যখন হলো তখন তাদের সাহায্য চাইলাম। খুশি হয়ে তারা এগিয়ে এল সাহায্য করতে। তবে তাদের একটা ছোট্ট অনুরোধ : প্রেসিডেন্ট যখন প্রজেক্ট ওপেন করতে আসবে সেই সময় ফাটাতে হবে ডিনামাইট। রাজি হতেই হলো!’

উত্তেজিত রানার মুখটা হাঁ হয়ে গেল। লোকটা মানুষ না পিশাচ! কী। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে যাচ্ছে কথাগুলো!

‘আপনার দিন ঘনিয়ে এসেছে, মি. কবীর চৌধুরী। আপনার পরিচয় আর কারও কাছে গোপন নেই। চিটাগাং আর কাপ্তাইয়ের…’

‘আমি জানি সে সব। আপনি আমাকে আর গোপন থাকতে দেননি। এর ফলে বহু প্রাণ নষ্ট হবে। কিন্তু ওই যে বললেন দিন ঘনিয়ে আসা—সেটা একেবারে অসম্ভব। আপনাকে বলেছি আমার মারণাস্ত্রের কথা। পৃথিবীর কারও সাধ্য নেই আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ-পাহাড়ের ধারে কাছে আসে। পাকিস্তানের গোটা মিলিটারি ফোর্সও যদি এক সঙ্গে আসে, এক নিমেষে ছাই করে দিতে পারি আমি এই ঘরে বসে শুধু ছোট্ট একটা বোতাম টিপে।

‘কিন্তু বাঁধ আপনি ওড়াবেন কী করে? কড়া পাহারা রয়েছে। সেখানে-ডিনামাইট বসাতেই পারবেন না আপনি।’

বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠল কবীর চৌধুরীর মুখে। বলল, ‘ডিনামাইটগুলো জায়গা মত বসেই আছে, মি. রানা। যে তিন জায়গা আজ দুপুরে এত লোক নামিয়ে তন্নতন্ন করে খোঁজালেন, ঠিক তার থেকে তিন গজ করে বাঁয়ে সত্তর ফিট পানির নীচে বসানো আছে ডিনামাইট। বাঁধের গায়ে গর্ত খুঁড়ে সেগুলো বিশ ফুট ঢুকিয়ে দিয়ে আবার মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। কারও সাধ্য নেই ওগুলো খুঁজে বের করে। কাল সাড়ে ছ’টা থেকে সাতটার মধ্যে আপনি নীচতলার একটা ঘরে শুয়ে টেলিভিশনে দেখতে পাবেন—শত চেষ্টা করেও আপনি আমাকে রুখতে পারলেন না—বাঁধ আমি উড়িয়ে দিলাম। প্রেসিডেন্ট বক্তৃতা শেষ করে বোতাম টিপবে, জ্বলে উঠবে সমস্ত বাতি, পরক্ষণেই ঘটবে মহাপ্রলয়। তারপর একটা বোতামে চাপ দিলেই ধীরে ধীরে পানি উঠতে শুরু করবে আপনার ঘরে। চট করে ঘরটা ভরবে না পানিতে—এর মধ্যে আরও অনেক মজা আছে। সবই আমার স্বকীয় উদ্ভাবন। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না কতখানি ভয়ঙ্কর এবং বিভীষিকাময় হতে পারে আমার মৃত্যুদণ্ড। আগে থেকে এর বেশি আর কিছুই বলব না, বললে এর আকস্মিকতা কমে যাবে আপনার কাছে।’

‘সুলতাকে কোথায় রেখেছেন?’

‘আজ আর সময় নেই, মি. মাসুদ রানা। আপনি আপনার ঘরে বিশ্রাম নিন গিয়ে। কাল আবার দেখা হবে।’

চেয়ারের বাঁধন খুলে দিতেই উঠে দাঁড়াল রানা। হাত দুটো তখনও পিছমোড়া করে বাঁধা। হঠাৎ ভয়ঙ্কর এক কাজ করে বসল সে। এক লাফে কবীর চৌধুরীর সামনে গিয়ে ওর তলপেট লক্ষ্য করে মারল এক প্রচণ্ড লাথি। ঠিক জায়গা মত পড়লে সাত দিন আর উঠতে হত না চৌধুরীকে বিছানা ছেড়ে। কিন্তু চট করে একটু সরে গেল কবীর চৌধুরী। লাথিটা গিয়ে পড়ল ওর ডান উরুর উপর। খট করে কিছু শক্ত জিনিসের উপর লাগল রানার পা। অবাক হয়ে দেখল রানা চৌধুরীর ডান পা-টা খুলে ছিটকে প্যান্টের ফাঁক গলে বেরিয়ে পড়ল মেঝের উপর। ওটা একটা ফাঁপা কাঠের নকল পা। টাল সামলাতে না পেরে সটান মেঝেতে পড়ে গেল চৌধুরীর প্রকাণ্ড দেহটা। এবার বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা ওর উপর। দুই হাঁটু জড়ো করে ঝপাং করে পড়ল রানা কবীর চৌধুরীর পেটের উপর। হুক করে একটা শব্দ বেরোল চৌধুরীর মুখ দিয়ে।

ঠিক সেই সময় কানের পিছনে পিস্তলের বাঁটের একটা জোরালো আঘাত খেয়ে আঁধার হয়ে গেল রানার চোখ। এক ধাক্কা দিয়ে বল্টু ওকে সরিয়ে দিল চৌধুরীর দেহের উপর থেকে। একটা টেবিলের পায়া ধরে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল আবার কবীর চৌধুরী। ওপাশ থেকে ছুঁড়ে দিল বল্টু রানার ওয়ালথারটা। খপ করে ধরল সেটা চৌধুরী। রানার বুকের দিকে লক্ষ্য স্থির করতে গিয়ে দেখল রাগে এবং উত্তেজনায় হাতটা কাঁপছে থর থর করে। পিস্তল ফেরত দিয়ে বলল, ‘চাবুক বের করো।’

তারপর চলল এক অবর্ণনীয় নির্যাতন। হাত দুটো ছাতের একটা কড়ার সঙ্গে বেঁধে শরীর থেকে সমস্ত কাপড় খুলে নেয়া হলো রানার।

তিন মিনিট ক্রমাগত চাবুক চালিয়ে হাঁপাতে লাগল কবীর চৌধুরী। শঙ্কর মাছের লেজের চাবুক। চৌধুরীর প্রিয় অস্ত্র। চোখ দুটো জ্বলছে টর্চের মত।

তখনও রানার জ্ঞান সম্পূর্ণ হারায়নি। সারা শরীরে বিষাক্ত বিচ্ছুর কামড়ের মত জ্বালা, শরীরের রক্ত যেন সব মুখে উঠে আসতে চাইছে, কান দিয়ে গরম ভাপ বেরোচ্ছে। রানার তীব্র আর্তনাদ তিন মিনিটেই গোঙানিতে পর্যবসিত হয়েছে। মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে এখন ওর।

কপালের ঘাম মুছে নিয়ে আবার শুরু করল কবীর চৌধুরী। শরীরের কোনও অংশ বাদ থাকল না আর। চাবুকের লম্বা লম্বা দাগগুলো গায়ের চামড়া চিরে প্রথমে সাদা তারপর লাল হয়ে উঠল। রক্ত গড়িয়ে নামতে আরম্ভ করল নীচের দিকে। জিভটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে রানার।

জ্ঞান হারিয়ে হাত বাঁধা অবস্থায় ঝুলতে থাকল রানার জর্জরিত দেহ। সপাং সপাং আরও কয়েক ঘা বসিয়ে থামল কবীর চৌধুরী। রক্তে ভিজে চটচটে হয়ে গেছে চাবুকের শেষ প্রান্ত।

মাঝরাতে জ্ঞান ফিরল রানার। অন্ধকার ঘরে একটা খাটের উপর শুয়ে আছে ও চিত হয়ে। অসম্ভব তেষ্টা পেয়েছে। পাশ ফিরতে গিয়ে টের পেল হাত-পা টান টান করে খাটের পায়ার সঙ্গে বাঁধা। কপালে হাত না দিয়েই বুঝল গায়ে প্রবল জ্বর। বিস্বাদ হয়ে আছে মুখের ভিতরটা। হঠাৎ এই বোকামি করে ফেলার জন্যে রাগে দুঃখে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে এখন ওর। মনে মনে নিজেকে গাল দিয়ে বলল, ‘বেশ হয়েছে, ঠিক হয়েছে! যেমন কর্ম তেমনি ফল!’

হঠাৎ কানের কাছে বেজে উঠল একটা মিষ্টি সুর। গোটা ঘরটা যেন ভরে গেল সেই সুর মূর্ছনায়। আরও কয়েকটা শব্দ হতেই রানা বুঝল এ হচ্ছে সরোদের সুর। কেউ সরোদ বাজাচ্ছে। অদ্ভুত মিষ্টি হাত। ভাগ্যিস এ ঘরের স্পীকারটা ‘অন’ করা ছিল। বাজনা তো কতই শুনেছে সে, কিন্তু এত ভাল তো কই লাগেনি কখনও আর! মস্ত বড় কোনও ওস্তাদের বাজনা হবে হয়ত। দেহমনের সব জ্বালা সব বেদনা দূর হয়ে যায় এমন মিষ্টি রাগিনী শুনলে। মনে হয় পৃথিবীটা ‘মায়াবী এক স্বপ্নের দেশ’। মিষ্টি চাঁদের আলো, মাতাল হাওয়া, সামনে অথৈ জল, দূরে আবছা গ্রামের আভাস, হিজলের ছায়া, দোল দোল ঢেউ, শাম্পান, আর সেই সঙ্গে ওর তীব্র একাকীত্ব।

মধুর একটা আবেশে জড়িয়ে এল রানার চোখের পাতা। মনে হলো লেভিটেশনের সাহায্যে যেন তার দেহটাকে ওজনশূন্য করে দেয়া হয়েছে।

দরজায় চাবি লাগানোর শব্দ পাওয়া গেল একটু পরেই। ঘরে এসে ঢুকল বল্টু, সঙ্গে আরও দুজন লোক। বল্টু বলল, ‘চৌধুরী সাহেব তলব করেছেন, একটু কষ্ট করতে হবে হুজুরকে।’

খাট থেকে খুলে আবার পিছমোড়া করে বাঁধা হলো রানার হাত দুটো। দুর্বল পায়ের উপর দাঁড়িয়ে নিজের দেহকে অসম্ভব ভারী বলে মনে হলো ওর। কিন্তু কোনও রকম দুর্বলতা প্রকাশ করল না ওদের সামনে। দোতলায় সোডিয়ামের ঘরটা পার হয়ে সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠে এল ওরা। আবার সেই ইএল ৩৬৯, সবুজ বাতি, কবীর চৌধুরীর নির্বিকার মুখ, প্রতিভাদীপ্ত উজ্জ্বল দুই চোখ।

চমকে উঠল রানা ঘরের মধ্যে সুলতাকে দেখে। ওকে দেখেই সুলতা উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না—চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে ওর দেহ। কেবল বলল, ‘তোমাকেও ধরে এনেছে এরা!’

জবাব দিল না রানা; মাথাটা শুধু একটু নিচু করল একবার। দেখল সুলতার দুই চোখের কোলে কালি পড়েছে। অবসন্ন ঘাড়টা যেন মাথাটাকে সোজা রাখতে পারছে না আর।

সারা রাত আমাকে জাগিয়ে রেখেছে এরা এই চেয়ারে বসিয়ে চোখের সামনে বাতি জ্বেলে।

কথাটা শোনাল ঠিক নালিশের মত। মৃদু হেসে মাথাটা আবার একবার ঝাঁকাল রানা। তারপর কবীর চৌধুরীর দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে চাইল সে।

‘আমার এক অনুচরকে গত রাতে আপনাদের আবদুল হাই বন্দি করেছে চট্টগ্রামে। মিলিটারি আমার বাড়িটা দখল করে নিয়েছে আজ সকালে। তাতে কিছুই এসে যেত না, কিন্তু আমার অনুচরটির কাছে একটা নোট বইয়ে ডিনামাইট ফাটাবার ওয়েভ লেংথ এবং সিগনাল কোড লেখা ছিল—সেটাও আবদুল হাইয়ের হস্তগত হয়েছে। এখন আমাদের একমাত্র ভরসা সুলতা দেবী।’

রানার মনে পড়ল, চৌধুরীর বাড়িতে সুলতা সেই নোট বইয়ে কী যেন লিখে দিয়েছিল। সিগনাল কোড এবং ওয়েভ লেংথই হবে বোধহয়।

‘আমাদের কারোই জানা নেই সে সিগনাল। কিন্তু সুলতা দেবী পণ করেছেন কিছুতেই আমাদের বলবেন না। সারারাত অনেক চেষ্টা করেও বের করা গেল না ওর কাছ থেকে। তাই আপনাকে একটু কষ্ট দিতেই হলো, মি, মাসুদ রানা।’

বল্টুকে ইঙ্গিত করতেই রানার জামা কাপড় খুলে নেয়া হলো। পরনে রইল কেবল ছোট একটা আণ্ডারওয়্যার।

রানার দিকে চেয়েই আঁতকে উঠল সুলতা।

‘ইশশ! মাগো! এই অবস্থা করেছে তোমাকে পিশাচেরা!’ সমস্ত গায়ে চাবুকের দাগগুলো এখন কালো হয়ে গেছে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল সুলতার।

ততক্ষণে রানার হাত দুটো আবার ছাতের কড়ার সঙ্গে বাধা হয়ে গেছে। কবীর চৌধুরীর হাতে কালকের সেই চাবুকটা দেখে ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠল রানা একবার।

‘সুলতা দেবী! মিটার ওয়েভ এবং সিগনাল কোডটা দয়া করে আবার লিখে দিতে হবে আপনাকে। কাগজ কলম তৈরি আছে আপনার হাতের কাছে টেবিলের উপর। যদি এক্ষুণি লিখে না দেন তবে আপনার চোখের সামনে চাবকে খুন করে ফেলব আপনার প্রিয়তম মাসুদ রানাকে। বল্টু, তুমি এক থেকে দশ পর্যন্ত গুণবে। এর মধ্যে যদি সুলতা দেবী মত না পাল্টান তা হলে চাবুক মারতে শুরু করব আমি।’

সুযোগ পেয়ে বল্টু খুব দ্রুত এক, দুই, তিন, চার গুণতে আরম্ভ করল। সপাং করে খুব জোরে মাটিতে চাবুকটা একবার আছড়ে নিল কবীর চৌধুরী। চমকে উঠল সুলতা।

‘দেব। আমি লিখে দেব!’ চিৎকার করে উঠল সে।

‘ভুল কোরো না, সুলতা। কিছুতেই লিখে দিয়ো না। তুমি লিখে দিলেও আমাকে খুন করবে, না দিলেও করবে। এই শয়তানের কাছে কিছুতেই আত্মসমর্পণ কোরো না তুমি।’

‘তোমাকে চাবুক মারবে, কী করে সহ্য করব আমি?’

‘চোখ বন্ধ করে রাখো,’ সুলতা।

‘আমার দুই চোখের পাপড়ি কেটে দিয়েছে—চোখ বন্ধ করতে পারি না। খোঁচা লেগে লেগে ঘা হয়ে গেছে।’ হু হু করে কেঁদে উঠল সুলতা।

মাথার মধ্যে যেন আগুন ধরে গেল রানার। কিন্তু নিরুপায় সে। মনের সমস্ত ঘৃণা, দুই চোখ দিয়ে ঠিকরে বেরোচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে শুধু বলল, ‘কুত্তার বাচ্চা!’

‘শাট আপ!’ গর্জন করে উঠল কবীর চৌধুরী। তারপর সুলতার দিকে ফিরে বলল, ‘আপনি যদি এখন লিখে না দেন, তবে আজ হয়ত ড্যাম ওড়াতে পারব না আমি, কিন্তু আগামী কালই আপনার বদলে আরেকজন আসবে ভারত থেকে। কাজেই এভাবে আমাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারছেন না। চিন্তা করে দেখুন কোনটা করবেন। এক্ষুণি লিখে দিলে হয়ত আপনাদের দুজনেরই জীবন রক্ষা পেতে পারে। হয়ত ঢাকায় ফিরে গিয়ে সুখের নীড় বাঁধবার সুযোগ পেতেও পারেন আপনারা।’

‘বিশ্বাস কোরো না ওর কথা, সুলতা। ও মিথ্যে ধোকা দিচ্ছে,’ রানা বলল।

‘বেশ, আপনারা যত পারেন ভালবাসাবাসির অভিনয় করুন। আবার দশ পর্যন্ত গোনো, বল্টু। এইবার শেষ সুযোগ দেয়া হবে আপনাকে, সুলতা দেবী।’

এক, দুই, তিন… আট, নয়, দশ। সপাং, সপাং। যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল ঘরের মধ্যে দুবার।

‘দোহাই আপনার বন্ধ করুন। আমি লিখে দিচ্ছি।’ কাতরে উঠল সুলতা। তারপর রানার দিকে চেয়ে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা কর, রানা, আমি দুর্বল মেয়েমানুষ মাত্র।’

‘লিখে দিল সুলতা খশ খশ করে।’ তারপর বলল, ‘কই, আমাদের ছেড়ে দিন এখন।’

‘হাহ হাহ’ করে হেসে উঠল কবীর চৌধুরী।

‘কী লিখলেন কে জানে! আগে সত্যিসত্যিই বাঁধটা উড়ে যাক, তারপর দেখা যাবে। আর তা ছাড়া, তেমন কোনও কথা তো আমি দিইনি; বলেছি, হয়ত রক্ষা পেতে পারেন আপনারা। তার মানে, হয়ত রক্ষা না-ও পেতে পারেন। হাহ, হাহ্ হাহ হাহ হা।’

‘মিথ্যুক, নীচ, পাষণ্ড!’ গর্জে উঠল সুলতা। সঙ্গে সঙ্গেই চাবুকটা পড়ল ওর উরুর উপর। ‘মাগো,’ তীক্ষ্ণ এক আর্তনাদ। একজন ঠেলে নিয়ে বেরিয়ে গেল চেয়ারে বাঁধা সুলতাকে। রানা পাগলের মত টানাটানি করল হাতটা ছাড়াবার জন্যে, বাঁধন আরও চেপে বসল কব্জিতে। রানাকেও খুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল বল্টু ও তার দুই ষণ্ডামার্কা অনুচর। রেডিও ট্রান্সমিটারটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল চৌধুরী।

বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবছে রানা। তখন সন্ধে সোয়া ছ’টা বাজে। আর মিনিট পনেরো পরই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে কাপ্তাই ড্যাম। কেউ আর ঠেকাতে পারবে না কবীর চৌধুরীকে। এতক্ষণে বোধহয় পৌঁছে গেছেন প্রেসিডেন্ট কাপ্তাইয়ে। সঙ্গে আরও অনেকের মধ্যে থাকবেন পিসিআই-চীফ মেজর জেনারেল (অব) রাহাত খান, ওর পিতৃসম একজন মানুষ। মি. লারসেন এখন কী করছে? ওকে গায়েব হয়ে যেতে দেখে এসপি-ই বা কী করছেন? নিচু কোয়ার্টার ছেড়ে উঁচু কোনও বাসায় উঠে গেছেন বোধহয় এতক্ষণে। আর চিটাগাঙের সদা হাস্যময় আবদুল হাই? আর সুলতা?

সুলতার কথা মনে পড়তেই সচকিত হয়ে উঠল রানা। ওর কি কিছুই করবার নেই? নির্যাতন এবং মৃত্যুর তো আরও পনেরো মিনিট দেরি আছে। এই অবস্থাকে স্বীকার করে নিচ্ছে কেন সে? মনে পড়ল রাহাত খানের একটা কথা: ‘কোনও অবস্থাতেই কখনও হাল ছেড়ে দিও না, রানা। মনে রেখো, যে কোনও বিপদ থেকে রক্ষা পাবার কিছু না কিছু উপায় সব সময়ই থাকে।’ রানা ভাবল, আমার অবস্থায় পড়লে টের পেতে, বাছাধন। সাততলার অফিসে বসে আর উপদেশ খয়রাত করতে হত না।

কী আজেবাজে কথা ভাবছে সে! মাথাটা ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে সজাগ করবার চেষ্টা করল রানা। হাত এবং পা খাটের পায়ের সঙ্গে টেনে বাধা। একটু নড়াচড়া করবার উপায় নেই। নিজেকে মুক্ত করার কোনোই উপায় নেই?

হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল রানার মাথায়। আধমিনিট চুপচাপ পড়ে থেকে দেহমনের সমস্ত শক্তি একত্রীভূত করবার চেষ্টা করল সে। তারপর এক হেঁচকা টানে খাটের ডানধারটা বেশ খানিকটা শূন্যে উঠিয়ে ফেলল। ডানধারটা যেই ফিরে এসে মাটি স্পর্শ করল অমনি আরেক ক্ষিপ্র এবং প্রবল হেঁচকা টানে খাটের বা ধারটা শূন্যে তুলে ফেলতেই উল্টে যাবার সময় ছয় ইঞ্চি পুরু জাজিমটা সড়সড় করে পায়ের তলা দিয়ে সরে গেল ডান দিকে বেশ খানিকটা। বাঁ পা-টা ঢিল পেল ইঞ্চি ছয়েক। সেই পা দিয়ে দুটো লাথি মারতেই ওটা পায়ের দিক থেকে বেরিয়ে গেল খাটের বাইরে। ডান পা-টাও ঢিল পেল এবার। এবার হাত দিয়ে কয়েকটা ঠেলা দিতেই পিঠের উপর থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ল জাজিমটা। হাত দুটোও ঢিল পেল ছয় ইঞ্চি।

অমানুষিক শক্তিতে হেঁচকা টান দেয়ায় কব্জিতে চেপে বসে গিয়েছিল রশি, মিনিট পাঁচেক ধরে নখ দিয়ে খুঁটবার পর মুক্ত হয়ে গেল ডান হাত। বাঁ হাত এবং দুই পা খুলতে আর এক মিনিট সময় লাগল।

প্রথমেই খাটটা জায়গা মত ঠিক করে রেখে জাজিম তুলে দিল রানা খাটের উপর। তারপর বিশ্রাম নিল কিছুক্ষণ খাটে বসে।

হঠাৎ ঘরের এক কোণে একটা বাতি জ্বলে উঠল। চমকে সেদিকে চেয়ে দেখল রানা ওটা টেলিভিশন সেট। কাপ্তাই বাঁধটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তাতে। নিশ্চিন্ত মনে লোকজন চলাচল করছে। রাস্তা দিয়ে দু’জন লোক একটা ওয়ান ফিফটি হোণ্ডা মোটরসাইকেল নিয়ে দ্রুত চলে গেল বাঁধের উপর দিয়ে। স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ কাপ্তাইয়ের পরিবেশ। তবে কি শেষ পর্যন্ত তার বক্তব্য আজগুবি মনে করে উড়িয়ে দিল মি. লারসেন আর এসপি আতাউল হক?

আর সময় নেই। কয়েক মিনিট পরেই ঘটবে প্রলয় কাণ্ড। উঠে গিয়ে ঘরের দেয়াল পরীক্ষা করে দেখল রানা দরজা খোলার কোনও উপায় পাওয়া যায় কি না। নাহ। কোনও বোম নেই ঘরের মধ্যে। হঠাৎ দরজার কাছে পায়ের শব্দ শুনে ছুটে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল রানা। ক্লিক করে দরজা তালা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গেই উজ্জ্বল বাতি জ্বলে উঠল ঘরের মধ্যে। হাতে পায়ে আলগা করে দড়ি পেঁচিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে থাকল রানা ঘাপটি মেরে।

পরক্ষণেই ঘরে ঢুকল বল্টু একা। হাতে একটা প্লেটের উপর কিছু ফলমূল কেটে সাজানো। সন্তর্পণে দরজাটা বন্ধ করে এগিয়ে এল বল্টু খাটের কাছে।

‘দ্যাখ, হারামজাদা, চৌধুরী সাহেব কত বড় দয়ালু মানুষ। মরার আগেও বিকেলের নাস্তা পাঠাতে ভোলেননি।’

কাঁটা চামচ দিয়ে আপেলের একটা টুকরো তুলে রানার মুখে দিল বল্টু। তারপর হঠাৎ রানার বাঁ গালটা কাঁটা চামচ দিয়ে জোরে আঁচড়ে ছিলে দিল। বলল, ‘বেঁটে বাঁদরের খামচি। বুঝলি, শালা হারামখোর?’

টপ টপ করে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ল রানার গাল বেয়ে। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিল রানা। টু শব্দ পর্যন্ত করল না। কিন্তু দ্বিতীয় টুকরো খাওয়াবার পর যখন আবার নাকে খামচি দিতে এল, তখন এক ঝটকায় কাটা চামচটা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বল্টুর বাম চোখের মধ্যে বসিয়ে দিল ধাই করে।

‘গ্যাক করে একটা বিটকেল শব্দ বেরোল বল্টুর গলা দিয়ে। এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে তা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। চামচটা টান দিয়ে বের করে নিতেই রক্ত ছুটল বল্টুর চোখ দিয়ে। তিন চারটে রেখায় নেমে এল সে-রক্ত গাল বেয়ে। রানা চেয়ে দেখল কাঁটা চামচের কাঁটাগুলোয় বল্টুর চোখের ভিতরের সাদা অংশ লেগে আছে।

এবার লাফিয়ে উঠে ওর কণ্ঠনালী চেপে ধরল রানা। তারপর ঠেলতে ঠেলতে দেয়ালের গায়ে নিয়ে গিয়ে ঠেসে ধরল প্রাণপণে। ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে বল্টুর ডান চোখটা কোটর ছেড়ে। রানার হাত ছাড়াবার চেষ্টা করল সে। ওর আঙুলের নখগুলো বসে গেল রানার কব্জিতে। কিন্তু সে কয়েক সেকেণ্ডের জন্য। হাত দুটো ঝুলে পড়ল দু’দিকে। অল্পক্ষণের মধ্যেই আধহাত জিভ বেরিয়ে পড়ল বল্টুর। পুরো দুই মিনিট পর ছেড়ে দিতেই একটা পা ভাঁজ হয়ে হুমড়ি খেয়ে সামনে পড়ল বল্টুর মৃতদেহ। মৃদু একটা ঘড় ঘড় শব্দ বেরোল বল্টুর গলা দিয়ে। রানা বুঝল, ফুসফুসটা তার স্বাভাবিক অবস্থায় আসবার জন্যে খানিকটা বাতাস গ্রহণ করল বাইরে থেকে।

বল্টুর কাছে কোনও অস্ত্র পাওয়া গেল না। আস্তে করে দরজাটা খুলে একটু ফাঁক করে দেখল রানা কিছুদূরেই পায়চারি করে বেড়াচ্ছে কোমরে রিভলভার ঝোলানো একজন প্রহরী। রানার হাত-পা বেঁধেও নিশ্চিত হতে পারেনি। চৌধুরী-চব্বিশ ঘণ্টা পাহারার ব্যবস্থা করেছে।

জোরে কয়েকটা টোকা দিল রানা দরজায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অপর পাশে এসে গেল প্রহরী।

‘ক্যায়া বাত, সর্দারজি?’

‘আন্দার আও!’ বল্টুর গলা নকল করবার চেষ্টা করল রানা।

কিছু মাত্র সন্দেহ না করে অপ্রস্তুত প্রহরী ঘরে ঢুকেই ধাই করে নাকের উপর খেল রানার হাতের প্রবল এক মুষ্ট্যাঘাত। নাকের জল আর চোখের জল এক হয়ে গেল প্রহরীর। ততক্ষণে ওর কোমরের হোলস্টার থেকে রিভলভারটা বের করে নিয়েছে রানা। লোকটা একটু সামলে নিতেই ওর দিকে রিভলভারটা ধরে রানা বলল, এই ঘরের চাবিটা বের করো ভালয় ভালয়, নইলে ওই অবস্থা করে দেব।’

বল্টুর বীভৎস চেহারার দিকে চেয়ে শিউরে উঠল প্রহরী। বিনা বাক্যব্যয়ে পকেট থেকে চাবি বের করল, ‘ওখানেই মাটিতে রাখো চাবিটা। তারপর খাটের উপর গিয়ে শুয়ে পড়ো।’

খাটের সঙ্গে বেঁধে ফেলল রানা প্রহরীকে। তারপর রিভলভারটা ওর বুকের সঙ্গে ঠেসে ধরে বলল, ‘সুলতা রায় কত নম্বর রুমে আছে?’

‘হামি জানে না, সারকার।’

‘আলবাত জানে। রিভলভার দিয়ে একটা খোঁচা দিল রানা ওর পাঁজরে, কাল যে জানানাকে ধরে নিয়ে এসেছে তাকে কোথায় রেখেছে?’

‘ওহহো, উও আওরাত? চার তলামে।’

‘কত নম্বর রুম?’

‘দো শও ছাপ্পান।’

আর দেরি করা চলে না। পথটা জানাই আছে। ঘরটায় চাবি লাগিয়ে দিয়ে তিনতলায় উঠে এল রানা। পথে কাউকে দেখা গেল না। আয়তনের তুলনায় লোকসংখ্যা বোধহয় কম এখানে। ইএল ৩৬৯-এর সামনে এসে বোতামটা টিপল রানা একবার। সঙ্গে সঙ্গেই দুবার জ্বলে উঠল সবুজ বাতি। আপনা আপনি খুলে গেল দরজা।

‘কী খবর, বল্টু?’ রেডিয়ো ট্রান্সমিটারের একটা বোতামের ওপর বুড়ো আঙুলটা রেখে ঘড়ির দিকে চেয়ে বসে আছে কবীর চৌধুরী। রানাকে তাই দেখতে পেল না সে। আবার বলল, ‘আর আধ মিনিট, বল্টু! তারপরই ওই টেলিভিশনে দেখতে পাবে…’

হঠাৎ ট্রান্সমিটারটা রানার এক লাথিতে ছিটকে গিয়ে দেয়ালে লাগল। সেখান থেকে মাটিতে পড়ে ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গেল। হতভম্ব চৌধুরী উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাণ্টামওয়েট চ্যাম্পিয়ন মাসুদ রানার একটা নক আউট পাঞ্চ এসে পড়ল একেবারে নাক বরাবর। গল গল করে রক্ত বেরিয়ে এল নাক দিয়ে। এবার প্রচণ্ড এক লাথি চালাল রানা। লাথি খেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল কবীর চৌধুরী। তক্ষুণি রানার গুলি করা উচিত ছিল, কিন্তু তা না করে, এমনিতেই কাবু করে এনেছে ভেবে যেই আরেকটা লাথি মারতে গেছে অমনি খপ করে পা-টা ধরে ফেলল চৌধুরী। পা ধরে জোরে একটা মোচড় দিতেই পড়ে গেল রানা মাটিতে। রিভলভারটা ছিটকে হাত দুয়েক দূরে পড়ল।

‘এবার? এখন কোথায় যাবে?’

দাবার ছকটা এক মুহূর্তে পাল্টে গেল যেন। হাতি, নৌকো, মন্ত্রী নিয়ে চারদিক থেকে অপর পক্ষের রাজাকে আটকে নিয়ে যেন দেখা গেল সামান্য ঘোড়ার এক আড়াই চালে নিজেই কিস্তি মাত হয়ে বসে আছি। রানার পা-টা ভেঙে ফেলবার জোগাড় করল কবীর চৌধুরী। এক পা খোঁড়া হলে কী হবে, প্রচণ্ড শক্তি রয়েছে ওই প্রকাণ্ড দেহে। অসহ্য যন্ত্রণায় জ্ঞান হারাবার উপক্রম হলো রানার।

হঠাৎ কী যেন ঠেকল হাতে তুলে দেখল সেই চাবুকটা। প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠল ওর মধ্যে। শুয়ে শুয়েই চালাল ও চাবুক নৃশংসভাবে।

ব্রিজ খেলায় ট্রাম্পের উপর দিয়ে ওভার-ট্রাম্পের মত অবস্থা হলো এবার। কবীর চৌধুরীর দুই হাত বন্ধ। চাবুক বাঁচাতে পা ছাড়লেই রানা রিভলভার তুলে নেবে। হেরে গেল চৌধুরী। সাঁই সাঁই চাবুক পড়ছে ওর মুখে-গালে-গলায়-হাতে। নরম মাংস পেয়ে কেটে বসে যাচ্ছে চাবুকটা। তীব্র জ্বালা সহ্য করতে না পেরে রানার পা ছেড়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে লুকাল কবীর চৌধুরী একটা বড় আলমারির পিছনে। রানাও তড়াক করে লাফিয়ে উঠে রিভলভারটা কুড়িয়ে নিল মাটি থেকে, তারপর সেটা বাগিয়ে ধরে বলল, ‘মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াও, কবীর চৌধুরী।’

কিন্তু কোথায় চৌধুরী? কেউ নেই আলমারির পিছনে। ক্লিক করে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ কানে আসতেই রানা বুঝল অদৃশ্য হয়ে গেল কবীর চৌধুরী আলমারির পিছনে দেয়ালের গায়ের কোন গুপ্ত দরজা দিয়ে।

ছুটে বেরিয়ে এল রানা ওই ঘর থেকে। এবার চারতলার দু শ ছাপ্পান্ন নম্বর ঘর। লিফটে করে উঠে এল চারতলায়। কিন্তু সেখানে নম্বরগুলো সবই ছয় শ’র উপরে। রানা ভাবল, মিছে কথা বলল না তো লোকটা? আচ্ছা, অন্য ব্লকের চারতলায়ও তো রাখতে পারে সুলতাকে!

লম্বা করিডোরটার ঠিক মাঝামাঝি এসেই অন্য ব্লকের রাস্তা পেল রানা। এবার দৌড়াতে আরম্ভ করল সে। দেরি হলেই ধরা পড়ে যাবে।

এমন সময় অ্যালার্ম সাইরেন বেজে উঠল পাহাড়ের মধ্যে। সবাইকে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে বিপদ সঙ্কেত দিয়ে। একটা মোড় ঘুরতেই দেখল একজন প্রহরী ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে ওর দিকেই আসছিল—ওকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে রিভলভার বের করতে যাচ্ছে। গুলি করল রানা। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল লোকটা সটান মাটিতে। কাছে গিয়ে দেখল রানা শেষ হয়ে গেছে। দেয়ালের গায়ে লেখা পি এমকে ২৫৪। ঝটপট প্রহরীর রিভলভার আর চাবির গোছা নিয়ে এগিয়ে গেল রানা। আর মাত্র দুটো ঘর বাদেই দু’শ ছাপ্পান্ন।

তেমনি চোখ খুলে বসে আছে সুলতা চেয়ারে বাঁধা অবস্থায়। চাবি খোলার শব্দ শুনে নতুন কোনও নির্যাতনের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল মনে মনে—রানাকে ঘরে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে গেল। ওর হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে রানা বলল, ‘জলদি উঠে পড়, সুলতা। কোনও দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিও না এখন। সবাই সজাগ হয়ে গিয়েছে। যেমন করে হোক বেরোতে হবে আমাদের এখান থেকে।’

‘তুমি! কী করে ছাড়া পেলে, রানা!’

‘সব বলব পরে। এখন উঠে পড়, লক্ষ্মী। একটুও সময় নেই—দেরী করলেই আবার ধরা পড়তে হবে।’

ছুটল দুজন লিফটের দিকে। উপরের দিকে না গিয়ে দুই নম্বর বোতাম টিপল রানা। লিফট থেকে নামতেই কবীর চৌধুরীর গলা শুনতে পেল লাউড-স্পীকারে। সমস্ত পাহাড়ের লোককে নির্দেশ দিচ্ছে সে।

‘দোতলায় ছোট সবাই। ওরা ওপর দিকে যায়নি। দোতলায় সোডিয়ামের ঘরের দিকে যাচ্ছে এখন। যে যেখানে আছ দোতলায় যাও। যার সামনে পড়বে সে-ই গুলি করবে। ইনফ্রারেড রে-র সাহায্যে রানার গতিবিধি টের পাচ্ছে চৌধুরী পরিষ্কার।

মস্ত বড় বড় টিনের ড্রামের মধ্যে সোডিয়াম রাখা। আকারে একেকটা আলকাতরার ড্রামের তিনগুণ হবে। পাশাপাশি আটটা ড্রামের পেট বরাবর গুলি করল রানা। ড্রাম ফুটো হয়ে গিয়ে কলের জলের মত কেরোসিন তেল বেরিয়ে। মেঝেতে পড়তে আরম্ভ করল। রানা জানে অক্সিজেন থেকে বাঁচবার জন্য কেরোসিন তেলের মধ্যে চুবিয়ে রাখা হয় সোডিয়াম। এই তেল বেরিয়ে গেলেই অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে গরম হয়ে উঠবে সোডিয়াম—তারপরই ঘটবে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ। তার আগেই আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে এখান থেকে যে করে হোক, ভাবল রানা।

কিন্তু বেরোবে কোনদিক দিয়ে? পাহাড়ের উপর দিকটা এতক্ষণে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত করে ফেলেছে কবীর চৌধুরী। উপরে উঠতে গেলেই গুলি খেয়ে মরতে হবে। তা হলে? এখন এগোবেই বা কোনদিকে?

চারদিক থেকে লোকজনের হৈ-হল্লা আর পায়ের শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। একটা রিভলভার ফেলে দিল রানা। গুলি শেষ। এখন অবশিষ্ট রিভলভারের তিনটে গুলিই সম্বল।

সুলতার একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল রানা ডান দিকে সেই তেল চুপচুপে মেঝের উপর দিয়ে। কিছুদূর গিয়েই মোড় ঘুরেছে রাস্তাটা। সেখানটায় এসেই রানা দেখল তিন চারজন লোক এগিয়ে আসছে হন্তদন্ত হয়ে। এত কাছে জলজ্যান্ত ওদের দুজনকে সামনে দেখে একটু হকচকিয়ে গেল লোকগুলো। পর পর দুটো গুলি করে দুজনকে ধরাশায়ী করল রানা। আর বাকি দুজন তীরবেগে ছুট দিল উল্টো দিকে জান-প্রাণ নিয়ে। পিছন থেকে বহু লোকের হৈ-হল্লা এগিয়ে আসছে দ্রুত। সেই সঙ্গে খুব কাছ থেকে লাউড-স্পিকারে কবীর চৌধুরী বলছে, মাসুদ রানা এখন একতলার সিঁড়ির কাছে। আর মাত্র একটা গুলি আছে ওর রিভলভারে। এগিয়ে যাও।

কয়েক পা গিয়ে সত্যিই সিঁড়ি পাওয়া গেল। তরতর করে নেমে এল ওরা একতলায়। এখন? এক দিকে গজ বিশেক গিয়ে শেষ হয়েছে করিডোর। সেই দিকেই দৌড় দিল রানা পাগলের মত।

হাঁফাতে হাঁফাতে সুলতা বলল, ‘হাতটা একটু ছাড়। খুব লাগছে।’

চট করে হাত ছেড়ে দিল রানা। উত্তেজনার বশে সুলতার কব্জিটা প্রায় গুড়ো করে দেবার জোগাড় করেছিল ও জোরে চেপে ধরে।

এক সঙ্গে কয়েকটা পিস্তল গর্জে উঠল। দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে দাঁড়িয়ে রানা। দেখল প্রায় পঁচিশ-তিরিশজন লোক এগিয়ে আসছে। লাউড-স্পীকারে কবীর চৌধুরী বলল, ‘এবারে মাথার ওপরে হাত তুলে দাঁড়াও, মাসুদ রানা। বাধা দিয়ে আর লাভ নেই।’

দেয়ালের গায়ে হাতড়ে যে বোতাম খুঁজছিল রানা পেয়ে গেল সেটা। টিপতেই সরে গেল দেয়ালটা একপাশে। সুলতাকে ধাক্কা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঠেলে দিয়ে নিজেও ঢুকে পড়ল ভিতরে। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল আবার।

‘আমাদের বোধহয় ওপর দিকে যাওয়া উচিত ছিল,’ বলল সুলতা।

তখন আর কথা বলবার বা কারণ ব্যাখ্যা করবার সময় নেই। ছুটে গেল রানা ঘরের অপর দেয়ালের কাছে। টিম টিম করে একটা বাতি জ্বলছে ঘরে। উজ্জ্বল হয়ে উঠল রানার মুখ। যা ভেবেছিল ঠিক তাই। হাত দিয়ে দেখল একটা দেয়াল ভেজা।

‘শিগগির আমার কাছে এসো, লতা। খুব কষে আমাকে জড়িয়ে ধরো। জলদি। সময় নেই।’

দেয়ালের সঙ্গে লাগানো একটা লোহার কড়া এক হাতে শক্ত করে ধরল রানা। দেখল ওর গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকা সুলতার দেহটা থর থর করে কাঁপছে ভয়ে। তারপরই বোতাম টিপে দিল রানা। দুর দুর করে উঠল রানার বুকের ভিতরটা অজানা আশঙ্কায়। কী ঘটতে চলছে সে-ই কি জানে ভালমত?

পানি! ভয়ানক জোরে পানি এসে ঢুকল ঘরের মধ্যে। ভাগ্যিস পানির তোড়টা প্রথমে গিয়ে ধাক্কা খেল অপর দিকের দেয়ালে, নইলে কিছুতেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না ওরা। এক সেকেণ্ডেই কোমর পর্যন্ত উঠে এল পানি। বোতামটা ছেড়ে দিল রানা’। ততক্ষণে পানি উঠে এসেছে গলা পর্যন্ত। বন্ধ হয়ে গেল পানি আসবার পথটা।

এবার খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে রানা বলল, ‘সাঁতার জানো, সুলতা?

‘না। কিন্তু এত জল কোত্থেকে এল ঘরের মধ্যে?’

‘এই পাহাড়টার চারদিকেই পানি। আমরা পানির লেভেলের প্রায় নব্বই ফিট। নীচে আছি এখন। পাহাড়টার চারপাশ যখন শুকনো ছিল তখন এই পথ ছিল বাইরে যাতায়াতের জন্যে। এটা আসল গেট না হয়ে কোনও গুপ্ত পথও হতে পারে। এই পথেই আমাদের এখন বেরোতে হবে বাইরে।’

ঠিক এমনি সময়ে যে দরজা দিয়ে ওরা এ ঘরে ঢুকেছিল সেই দরজা খানিকটা ফাঁক হয়ে গেল। অতর্কিত পানির এক ধাক্কায় দরজার সামনের লোকটা ছিটকে সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

‘আমার সমস্ত শরীর জ্বালা করছে পানি লেগে। আমি আর বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারব না, সুলতা। তাড়াতাড়ি সারতে হবে আমাদের সব কাজ। আমি যখন বলব তখন লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে নেবে। বোতাম টিপলেই দরজা খুলে গিয়ে ঘরটা ভরে যাবে পানিতে। সবটা না ভরলে স্থির হবে না পানি, আমরা পানির তোড় ঠেলে বেরোতে পারব না। পানি স্থির হলে আমরা এই পথ দিয়ে বেরিয়ে সাঁতার কেটে উঠব ওপরে, বুঝলে? ততক্ষণ দম বন্ধ করে রাখতে হবে।’

‘এত নীচ থেকে ওপরে উঠবে কী করে আমাকে নিয়ে? আমাকে না হয় এখানে ছেড়ে দিয়ে তুমি চলে যাও।’

‘বাজে কথা বোলো না, লতা। তোমাকে ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে আমি নিজের প্রাণ বাঁচাতে চাই না। তার চেয়ে এসো দুজন একসঙ্গে চেষ্টা করি—মরি যদি, দুজন একসঙ্গে মরব।’

‘অদ্ভুত সাহস তোমার, রানা!’

‘বিয়ের রাতে বাসরঘরে আমার অনেক প্রশংসা কোরো—এখন তোমার শাড়ি খানিকটা ছিঁড়ে চারটে ছোট ছোট টুকরো কর তো। ওগুলো কানের মধ্যে গুঁজে না নিলে এত গভীর পানিতে চাপ লেগে কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে।’

নতুন শাড়িটা ছিঁড়তে এক মুহূর্ত একটু দ্বিধা করল সুলতা। হাজার হোক মেয়ে তো! তারপরই রানার কথা মত কাজ করল।

রানা বলল, ‘রেডি?’

মাথা ঝাঁকাল সুলতা।

এক হাতে সুলতাকে জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে সাঁতার কাটছে রানা উপরে উঠবার জন্য। পা দুটো ঠিকমত ব্যবহার করতে পারছে না—বেঁধে যাচ্ছে সুলতার শাড়িতে, উরুতে।

শেষের তিরিশ ফুট মনে হলো যেন আর শেষ হবে না। একে নির্যাতনে দুর্বল শরীর, তার উপর এই অমানুষিক পরিশ্রম—বুকের ছাতি ফেটে যেতে চাইছে রানার। কপালের দুই পাশে দুটো শিরা দপ দপ করছে। প্রাণপণে সাঁতরে চলল রানা। নিজের কষ্ট ভুলে ভাববার চেষ্টা করল সুলতার না জানি কত কষ্ট হচ্ছে।

কিন্তু এই ওপরে ওঠার কি শেষ নেই? ফুট দশেক থাকতেই হাল ছেড়ে দিল রানা। আর পারা যায় না। ধীরে ধীরে নামতে আরম্ভ করল আবার ওরা। এভাবে নামতে ভালই লাগছিল রানার। ঘাড়ে, গলায়, কানের পাশে সুড়সুড়ি লাগছে পানি লেগে। হঠাৎ সুলতা একটু নড়ে উঠতেই হুশ হলো রানার। শেষ চেষ্টা করে দেখবে ও একবার। বুকের ভিতর হাতুড়ি পিটছে হৃৎপিণ্ড। আবার উঠতে থাকল ওরা ওপরে। ইয়াকুবের মুখটা একবার ভেসে উঠল রানার মনের পর্দায় কেন জানি।

ওপরে উঠে নাক-মুখ দিয়ে অনেক পানি বেরোল সুলতার। দুজনেই খানিকক্ষণ হাঁ করে মুখ দিয়ে শ্বাস নিল বুক ভরে।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গোধূলির সব রঙ মুছে গেছে মেঘের ফালি থেকে। আবছা চাঁদের আলোয় পনেরো গজ দূরে পাহাড়ের ছোট্ট মাথাটা দেখে যেন জ্ঞান ফিরে পেল রানা। পালাতে হবে। এই অভিশপ্ত পাহাড়ের কাছ থেকে পালাতে হবে দূরে। মনে পড়ে গেল গতরাতের অভিযানের কথা, আবদুলের কথা। এখনও ‘ডেকা’ রাডার স্ক্যানার ঘুরছে টিলাটার চূড়ায়।

সুলতার মাথা পানি থেকে অল্প একটু ভাসিয়ে রেখে এক হাতে ব্যাকস্ট্রোক দিয়ে পিছনে সরে যেতে শুরু করল রানা।

হঠাৎ পাহাড়ের মাথায় কবীর চৌধুরীর প্রকাণ্ড দেহটা দেখে চমকে উঠল রানা। কবীর চৌধুরীও দেখল ওদের। তারপর ঝপাং করে লাফিয়ে পড়ল পানিতে। দ্রুত এগিয়ে আসছে চৌধুরী ওদের দিকে।

এইবার প্রমাদ গুণল রানা। একটা মাত্র গুলি আছে ওর রিভলভারে। কবীর চৌধুরীর তা অজানা নেই। যদি এক গুলিতে ওকে ঘায়েল করা না যায় তবে ওর হাতে নিশ্চিত মৃত্যু হবে দুজনের। কাজেই আগে গুলি ছুড়বে না বলে স্থির করল রানা। কবীর চৌধুরীর মনে গুলি খাওয়ার ভয় থাকুক কিছুটা।

কিন্তু চৌধুরী নিজে আসছে কেন লোক না পাঠিয়ে? ও নিশ্চয়ই টের পেয়েছে সোডিয়ামের ড্রাম ফুটো হবার কথা। তাই কাউকে কিছু না বলে সরে আসছে পাহাড় থেকে। সেই সঙ্গে ওর সবকিছু ধ্বংস করে দেয়ার প্রতিশোধটাও তুলে নেবে।

প্রাণপণে ব্যাকস্ট্রোক দিয়ে চলল রানা—সেই সঙ্গে পা দুটো চলছে প্রপেলারের মত। কিন্তু এক হাতে কত আর সাঁতরাবে সে? তার উপর সুলতার ভার। এখন মনে হলো আরও একটা গুলি অন্তত হাতে রাখা উচিত ছিল।

ধীরে ধীরে দূরত্ব কমে আসছে ওদের। পনেরো গজ দূরে থাকতেই প্রথম গুলি করল কবীর চৌধুরী। রানা অনুভব করল ওর হাতের মধ্যে হঠাৎ সুলতার দেহটা একবার অস্বাভাবিকভাবে চমকে উঠল। পরক্ষণেই রানার চোখে-মুখে কী যেন ছিটে এসে পড়ল। চোখে দেখতে পাচ্ছে না রানা আর। তাড়াতাড়ি পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নিল ও চোখ-মুখ। হাতে লাগল চটচটে কী যেন।

হঠাৎ কী মনে হতেই আঁতকে উঠে সুলতার মুখের দিকে চাইল রানা। দেখল মাথাটা হেলে পড়েছে এক দিকে। হ্যাঁ! অব্যর্থ চৌধুরীর হাতের টিপ। তাজা রক্ত আর মগজের অংশ ছিটকে বেরিয়ে এসে লেগেছিল রানার চোখে-মুখে।

রিভলভার বের করল রানা। কিন্তু সামনে কী যেন দেখে এগোনো বন্ধ করে দিয়েছে কবীর চৌধুরী। রানা গুলি করবার আগেই ডুব দিল পানির মধ্যে।

প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে গিয়ে উঠল কবীর চৌধুরী। গুলি করল রানা। দূর থেকে একটা অট্টহাসির শব্দ ভেসে এল। চলে গেল কবীর চৌধুরী।

সামনে যতদূর দেখা যায় কেবল জল আর জল। মেঘবিহীন বৈশাখের আকাশে নিঃসঙ্গ পূর্ণিমার চাঁদ। ছোট ছোট ঢেউয়ের মাথায় আলোর মুকুট। ফুর ফুর করে বইছে পুবালী হাওয়া। মাথার উপর দিয়ে বাদুড় উড়ে গেল একটা।

চাঁদের আলোয় নিষ্প্রাণ সুলতার মলিন মুখটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল রানা। ছোট্ট একটা চুম্বন এঁকে দিল ওর কপালে। তারপর ছেড়ে দিল পানির ভেতর। দ্রুত নেমে গেল দেহটা নীচে। সুলতার চিহ্নও থাকল না আর। নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ, একা মনে হলো রানার। হু হু করে উঠল বুকের ভিতরটা এক অবর্ণনীয় বেদনায়। অবসন্ন দেহটাকে ভাসিয়ে রাখতে কষ্ট হচ্ছে খুব।

কিন্তু কিসের এক মোহে ওখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাঁতার কাটতে থাকল রানা—জায়গাটা ছেড়ে কিছুতেই চলে যেতে পারছে না সে।

হঠাৎ বেশ কাছ থেকে কয়েকটা টর্চের উজ্জ্বল আলো পড়ল রানার চোখের উপর। চোখটা ধাঁধিয়ে গিয়ে কিছুই দেখতে পেল না ও সামনে। কানে এল কে বলছে, ‘ওই যে, আরেক ব্যাটাকে পাওয়া গেছে। স্টেনগান রেডি রাখো, এর, কাছেও পিস্তল থাকতে পারে। সাবধানে ঘিরে ফেলো নৌকা দিয়ে।’

স্বাভাবিক আত্মরক্ষার তাগিদে ডুব দিতে যাবে রানা—এমন সময় কানে এল আবদুল হাইয়ের পরিচিত স্বর।

‘আরে, এ তো আমাদের মাসুদ রানা! এই লতিফ, জলদি কাছে নিয়ে চলো শাম্পান! আপনি এখানে কী করছেন, মাসুদ সাহেব?’

রানা জবাব দিতে চেষ্টা করল কিন্তু আওয়াজ বেরোল না গলা দিয়ে। রানার মুমূর্ষু দেহটা তিনজনে টেনে তুলল নৌকার উপর। ঠিক সেই সময় প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ হলো কাছেই কোথাও। রানা চেয়ে দেখল অভিশপ্ত পাহাড়ের চূড়োটা ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে পানির নীচে। মস্ত বড় বড় ঢেউ উঠল বিশাল রিজার্ভয়েরের গভীর হৃদয় মন্থন করে।

বিস্মিত আবদুল হাই বলল, ‘কী হলো! ভয়ঙ্কর এক্সপ্লোশন হলো বলে মনে হচ্ছে!’

এবারও কোনও জবাব দিতে পারল না রানা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বুজল নৌকার পাটাতনে শুয়ে।