ফিরতি পথে রানার মাথার মধ্যে এত দ্রুত চিন্তা চলল যে গাড়ির মৃদু গুঞ্জন ধ্বনিটা না থাকলে মি. লারসেন আর আবদুল বোধহয় স্পষ্ট শুনতে পেত সে-চিন্তা। বিগত দুই দিনের ঘটনাগুলো এক সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে, এখন ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার প্ল্যান চলছে রানার উর্বর মস্তিষ্কে। তা হলে দাঁড়াল এই, ভারতীয় ডিনামাইট এই বাঁধের তলায় বসানো হয়ে গেছে। এখন কেবল বোতাম টেপার অপেক্ষা। ওগুলো খুঁজে বের করে ওঠাতে পারলে অকেজো করে দেয়া যেত। ওর প্রথম কাজ, ওগুলো উদ্ধার করা। তারপর চৌধুরীর আস্তানা বের করে ধরতে হবে তাকে। সহজে হাল ছাড়বার পাত্র কবীর চৌধুরী নয়। চারদিকে ছায়ার মত কাজ করছে তার লোকজন। মস্ত বড় জাল বিস্তার করেছে সে কাপ্তাইয়ে অনেক ভাবনা চিন্তা করে। …কিন্তু কবীর চৌধুরী বাধ ভাঙতে চাইছে কেন? মতলবটা কী ওর?

ছোট্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শহর এই কাপ্তাই। শান্ত সৌম্য একটা ভাব বিরাজ করছে এর অন্তরের গভীরে। রিজারভয়ের থেকে বাঁশের চালান মাথার উপর দিয়ে রাস্তা পার করে মরা নদীতে নামিয়ে দেবার জন্যে ওভারহেড ক্রেন রয়েছে একটা। এ বাঁশ আসে উত্তর থেকে কর্ণফুলী পেপার মিলসের জন্য। হাতের ডানদিকে ফিশারীর অফিস। সেই পথে গিয়ে আবার ডান দিকে মোড় ঘুরলেই পাওয়ার হাউস। এক লক্ষ বিশ হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে এখনকার এই নীরব পাওয়ার হাউস।

বাঁধ শুরু হবার আগেই সারি সারি অফিসারস কোয়ার্টার। বাঁধ পার হয়ে ডানদিকে রাস্তাটা মোড় ঘুরেছে। নীচে নেমে গেলে বাঁয়ে ডাকবাংলো, ডানে পুলিশের ফাঁড়ি, তারপর আবার বাঁয়ে বাজার। আর বাঁধ থেকে মোড়টা না ঘুরে সোজা চলে গেলে স্পিলওয়ে—উদ্বৃত্ত পানি বের করে দেয়া হয় এখান দিয়ে।

মি. লারসেনের অফিসের সামনে অনেক লোকের ভিড় দেখা গেল দূর থেকে। ব্যাপার কী? দ্রুত চালিয়ে এনে কাছেই পার্ক করলেন মি. লারসেন—তিনজনই লাফিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে।

তখনও আগুন সম্পূর্ণ নিভে যায়নি। ছিন্ন-ভিন্ন গদিগুলো পুড়ছে। অফিসের সামনে দাঁড়ানো রানার ফোক্সওয়াগেনের ধ্বংসাবশেষ এখন এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ে আছে।

জিজ্ঞেস করে জানা গেল মিনিট দশেক আগে প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের শব্দ শুনে অফিস থেকে সবাই হুড়মুড় করে বেরিয়ে দেখে গাড়িটার এই অবস্থা। পেট্রল ট্যাঙ্কে আগুন লেগে দাউ দাউ করে জ্বলছে। আশপাশে কেউ ছিল না তখন।–গাড়ির ভিতরেই বোধহয় আগে থেকেই ছিল বোমাটা।

কেউ টাইম-বম্ব দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে রানার গাড়ি।

অফিস কামরায় ফিরে এসে মি. লারসেন রানার দিকে চেয়ে একটু কাষ্ঠ হাসি হাসলেন। লাল মুখ তার ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। প্রাণহীন হাসিটা মুখ-বিকৃতির মত দেখাল।

‘আপনাকে খুন করতে চেয়েছিল ওরা।’

‘তা চেয়েছিল।’ বিচলিত ভাবটা ঢাকার জন্য সিগারেট ধরাল রানা।

‘আমার গাড়িতে না গিয়ে যদি ওই গাড়িটায় উঠতেন তা হলে?’ আতঙ্ক কাটছে না বিহ্বল লারসেনের। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন তিনি রানার জন্যে।

‘যা হবার তাই হতো। এই নিয়েই তো আমাদের কারবার, মি. লারসেন। যদি আপনার মত করে ভাবতে যেতাম, তা হলে আজই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হতো। একদিন হঠাৎ এভাবেই হয়তো মৃত্যু ঘটবে আমার… কিন্তু এসব কথা যতটা মন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি ততই আমাদের পক্ষে মঙ্গল। এখন কাজের কথায় আসা যাক। আমি এই ড্যামের একটা ছবি আঁকব এবং তার গায়ে তিনটে চিহ্ন দেব। তার আগে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি।’ একটু থেমে মনে মনে গুছিয়ে নিল রানা কথাগুলো।

‘একজন লোক খুব শক্তিশালী এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ড্যামটা উড়িয়ে দিতে চায়।’

‘কেন???’ লারসেন সাহেব হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলেন চোখ দুটো কপালে তুলে। অসাবধানে ধরা মোটা চুরুটটা পড়ে গেল হাত থেকে।

‘তা আমি জানি না। টিএনটি এসেছে তার কাছে আমাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন কোনও দেশ থেকে। আর আপনাদের কথা শুনে যতদূর বুঝলাম সেগুলো সে ইতিমধ্যেই জায়গা মত বসিয়েও দিয়েছে।’

‘লিম্পেট মাইন?’

‘আমার মনে হয় ও জিনিসটা জাহাজের জন্যই উপযুক্ত। এখানে ওরা হাই পাওয়ার্ড টিএনটি ব্যবহার করছে। দূর থেকে রেডিয়ো ট্রান্সমিশনের সাহায্যে ফাটানো হবে ওগুলো।’

‘মাই গুডনেস! কখন?’ আবার কথার মধ্যে বাধা দিয়ে প্রশ্ন করলেন মি. লারসেন।

‘তা-ও আমার জানা নেই। এখন থেকে যে কোনও মুহূর্তে ফাটতে পারে। আমি এক সুযোগে ওদের নক্সাটা দেখে নিয়ে মুখস্থ করে ফেলি। এই বাঁধ কতখানি লম্বা তা আমার জানা নেই। আমি শুধু হুবহু ছবিটা এঁকে লাল চিহ্ন দিয়ে দেব তিনটে জায়গায়। আপনি হিসেব করে ঠিক ঠিক জায়গাগুলো বের করে নিয়ে জনাদশেক বিশ্বস্ত ডুবুরী নামিয়ে তন্নতন্ন করে খোঁজাবেন সে জায়গা।’

‘তা না হয় করলাম। কিন্তু পুলিশে খবর দিচ্ছেন না কেন? লোকটাকে ধরতে পারলেই তো সব গোলমাল চুকে যায়। জানেন, এটা কতখানি সিরিয়াস ব্যাপার? এই ড্যাম এখন ভাঙলে—ওহ, জিসাস্! গোটা চিটাগাং ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যাবে। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, মি. রানা, কত লক্ষ লক্ষ লোক মারা যাবে। সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় এর কাছে কী? একটা লোকও তো বাঁচবে না এই ভয়ঙ্কর বন্যার হাত থেকে!’

‘সবই জানি। কিন্তু পুলিশকে জানিয়ে এখন কোনও লাভ নেই। লোকটার আস্তানা কেউ জানে না। একটা গভীর চক্রান্ত দানা বেঁধেছে এই বাঁধকে ঘিরে। আপনাকে বলেছিলাম, এক কাজে এসে এখানে অন্য ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছি; কিন্তু এখন দেখছি দুটো ব্যাপারই এক। যাক, এখন একটা চক বা মোটা শিষের লাল-নীল পেন্সিল দিন, আমি মেঝেতে ছবিটা এঁকে দিয়ে যাই।’

বাম দিকের চিহ্নটা দেখে আবদুল বলল, ‘এই জায়গাটাই তো আপনাকে এখন দেখিয়ে আনলাম! এখন সোব কথা আমি বুঝতে পারছি, হাজুর। মাঝখানের ওই লাল দাগটাতেই আমি পরথম দিন ভুড়ভুড়ি দেখছিলাম!’

লারসেনের একান্ত অনুরোধে আজকের দিনের জন্য তাঁর গাড়িটা ব্যবহার করতে রাজি হলো রানা। সোয়া একটা বাজে তখন। চাঁদি ফাটানো কড়া রোদ উঠেছে। লারসেনের এয়ার-কুলড ঠাণ্ডা অফিস থেকে বেরিয়ে এসেই অসম্ভব গরম লাগল রানার। চিটপিট করে উঠল পিঠটা। বিকেলের দিকে ঝড় উঠতে পারে।

দুপুরেই উঠল সে ঝড় সুলতার মনে।

‘তোমার গাড়ি কী হলো?’ সুলতা এগিয়ে এল রানাকে দেখে।

‘টাইম-বম্ব দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে কবীর চৌধুরী।’

সুলতা ভাবল, ‘একটু আগে যে লোকটা এসেছিল সে তা হলে সত্যি কথাই বলেছে! সে অবশ্য বলেছিল মাসুদ রানাও ছাতু হয়ে যাবে সেই সঙ্গে।’

‘তোমার কিছু হয়নি?’

‘আমি তখন এই গাড়িতে ছিলাম। কিন্তু কী ব্যাপার, সুলতা—তোমার চোখ মুখ এমন মলিন কেন? কী হয়েছে?’ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে রানা।

‘একটা কথা সত্যি করে বলবে?’

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুলতার মুখের দিকে চেয়ে অনেকখানি বুঝে ফেলল রানা ওর মনের কথা। মৃদু হেসে বলল, ‘বলব।’

‘তোমার সত্যিকার পরিচয় কী?’

‘আমি পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের একজন এজেন্ট, মাসুদ রানা।’

দুই হাতে নিজের দুই কান বন্ধ করল সুলতা। একথা সে শুনতে চায় না! একথা সে বিশ্বাস করে না! না, না, এ হতেই পারে না! এ হতেই পারে না! ও মাসুদ রানা নয়, ও সুবীর, আমার সুবীর!’

‘টেলিগ্রামটা দেখি।’ গলাটা একটু ভেঙে আসে সুলতার।

পকেট থেকে বের করে দিল রানা সে টেলিগ্রাম। সুলতা পড়ল:

‘সেন সিক অ্যাট ঢাকা স্টপ নেগোসিয়েশন ব্রেক ডাউন স্টপ ক্লোজ উইথ নিউ কোম্পানি স্টপ ফর সলভেনসি রেফার চৌধুরী।’

কয়েকবার লেখাগুলোর উপর চোখ বুলাল সুলতা। ধীরে ধীরে অক্ষরগুলো সব এলোমেলো ঘোলাটে হয়ে গেল। টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়ল টেলিগ্রামটার উপর। তারপর ছিঁড়ে কুটিকুটি করে দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল কাগজটা জানালা দিয়ে বাইরে।

‘তুমি এভাবে আমাকে প্রতারণা করলে কেন?’ আহত সাপিনীর মত চাপা গর্জন করে উঠল সুলতা, বললো, ‘কেন আমাকে প্রতারণা করলে তুমি!’

‘এজন্যেই আমাকে পাঠানো হয়েছে, সুলতা। তোমাকেও পাঠানো হয়েছে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে, এদেশের ভয়ঙ্কর একটা ক্ষতি করতে।… আমি আমার সরকারের হুকুম তামিল করেছি মাত্র।’

কিছু খেল না সুলতা। কখনও কি স্বপ্নেও ভেবেছিল এতবড় আঘাত পাবে সে! যাকে ভালবেসে মনে হয়েছে ধন্য হলাম, পরিপূর্ণ হলাম…যাকে বিশ্বাস করে দেহমন সঁপে দিলাম পরম নিশ্চিন্ত নির্ভরতায়, সে বলছে : আমি অফিসের হুকুমে তোমার সঙ্গে অভিনয় করেছি মাত্র। এখন প্রয়োজন ফুরিয়েছে, নিশ্চয়ই এবার তাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবে মাসুদ রানা। কথাটা মনে হতেই শিউরে উঠল সুলতা। নয়া দিল্লীতে প্রথম যখন চাকরিতে যোগ দিল তখন থেকেই এই নাম শুনে আসছে সে। মাসুদ রানার নামে আলাদা একটা মোটা ফাইলে নিত্য নতুন রিপোর্ট সে নিজ হাতে গেঁথে রেখেছে। লাল ফিতে বাঁধা সেই ফাইলটা এখনও চোখে ভাসে সুলতার। কতদিন পাতা উল্টিয়ে পড়েছে সে এর ভয়ঙ্কর, দুর্ধর্ষ, রোমহর্ষক কার্যকলাপের বিবরণ। অদ্ভুত কৌশলী, বুদ্ধিমান এবং দৃঢ়চেতা এই যুবককে তাদের সার্ভিসের কে না ভীতির চোখে দেখে? আজ ভুল করে এরই প্রেমে পড়ে মরণ হবে সুলতার কে ভাবতে পেরেছিল?

রানারও খাওয়া হলো না কিছুই। একটা সোফায় বসে চোখ বন্ধ করে মাথাটা এলিয়ে দিল ও পিছন দিকে। ভাবছিল, এল বিদায়ের পালা। কতটুকুই আর চিনি। একে-কাল দুপুর থেকে আজ দুপুর-চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন কত যুগের পরিচয়, জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধুত্ব। একে বিদায় দিতে হৃদয়টা আজ এমনি করে পুড়ছে কেন?

চোখ বন্ধ করেও মানুষ দেখতে পায়। অস্পষ্ট একটা ছায়া দেখে ধীরে ধীরে চোখ মেলল রানা। দেখল তার কপাল থেকে ছয় ইঞ্চি দূরে সুলতার হাতে ধরা অ্যাট্রা পিস্তলটা লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকে।

‘ধরা পড়বার আগে তোমাকে শেষ করে দিয়ে যাব, মাসুদ রানা। মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হয়ে নাও।’

মৃদু হেসে রানা বলল, ‘আমি প্রস্তুত। মারো।’

‘বাধা দেয়ার চেষ্টা করছ না কেন?’ বিস্মিত হয় সুলতা।

‘আমি দুর্বল, তাই।’

কিছুক্ষণ সমস্ত ইচ্ছাশক্তি একত্রিত করেও যখন ট্রিগার টিপতে পারল না সুলতা তখন একটু হেসে রানা বলল, ‘সেফটি ক্যাচটা অফ করে নাও।’

কয়েক মুহূর্ত পাগলের মত উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে রানার চোখে চোখে চেয়ে থেকে পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলে দিল সুলতা। তারপর জানালার কাছে গিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

আরও পাঁচ মিনিট কেটে গেল নিঃশব্দে।

‘লতা!’ মনটা স্থির করে ডাকল রানা।

‘বলো।’ নির্বিকার কণ্ঠ সুলতার।

‘তোমার কাছে কেউ এসেছিল?’

‘হ্যাঁ।’

‘নিরাপদে কলকাতায় পৌঁছে দেয়ার কথা বলেছিল?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমি বেরিয়ে গেলেই আবার সে আসবে, তাই না?’

চুপ করে থাকল সুলতা। মৃদু হেসে রানা বলল, ‘আজ বিদায়ের ক্ষণে আর অবিশ্বাস না-ই বা করলে, লতা।’

রানার কণ্ঠে এমন একটা আন্তরিক আকুতি ছিল যে বিস্মিত সুলতা কিছুক্ষণ ওর চোখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, ‘আসবে।’

‘তুমি তার সঙ্গে চলে যেও, লতা। কেউ তোমাকে বাধা দেবে না। তোমার সুটকেস যাতে তুমি ফিরে পাও সে ব্যবস্থাও আমি করব, কথা দিচ্ছি।’

‘আমাকে শত্রুপক্ষের গুপ্তচর জেনেও ছেড়ে দেবে?’ ঠিক বিশ্বাস করতে ভরসা হচ্ছে না সুলতার।

‘হ্যাঁ, ছেড়ে দেব। তোমাকে আটকে রাখায় পাকিস্তানের কোনও লাভ নেই। তোমার কাছে এমন কোনও তথ্য নেই যাতে পাকিস্তানের কোনও উপকার হতে পারে। তাই তোমাকে মুক্তি দেব। অবশ্য নিজের ইচ্ছে মত তোমাকে ছেড়ে দেয়ায় আমাকে জবাবদিহি করতে হবে—হয়ত সাসপেণ্ডও করতে পারে কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। তুমি চলে যাও, লতা। তোমাকে আমি নিরাপদে চলে যাওয়ার সুযোগ দেব।’

‘আর কিছু বলবে?’

‘হ্যাঁ। আর একটা ছোট্ট, সাধারণ অথচ অবিশ্বাস্য কথা বলব। কলকাতায় ফিরে গিয়ে কথাটা মনে পড়লে হাসি আসবে তোমার। তোমার কাছে এর কোনও মূল্য নেই বলেই হয়ত চিরকাল এটা অমূল্য হয়ে থাকবে আমার কাছে। তোমার সঙ্গে শুধুমাত্র অভিনয়ই করিনি আমি, লতা। কথাটা বিশ্বাস করো।’

কথাটা শেষ করেই দ্রুত লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে যাচ্ছিল রানা ঘর থেকে, হঠাৎ জামার হাতায় টান পড়ল। ঘুরে দেখল সুলতা।

‘যদি আমি না যাই।’

‘যাবে না কেন?’

‘যাব না-ই তো! আমিও তো তোমায় ভালবেসেছি, রানা! তোমার সন্তান আমি কামনা করেছি আমার গর্ভে।’ মাথাটা নিচু করল সুলতা একটু।

‘সে তো সুবীর সেন মনে করে!’

যদি বলি যাকে মন দিয়েছি তার নাম সুবীর হোক বা রানা হোক কিছুই এসে যায় না, মানুষটা সে একই—তবে তার পাশে চিরদিনের মত একটু স্থান পাব?’

‘পাবে,’ বিনা দ্বিধায় জবাব দিল রানা।

‘আমার সব কলঙ্কের কথা জেনেও আমাকে গ্রহণ করবে তুমি? ঘৃণা করবে?’

‘কলঙ্ক তো চাঁদের অলঙ্কার।’

ঝাঁপিয়ে পড়ল সুলতা রানার বুকের ওপর। দু’হাতে জড়িয়ে ধরল রানা ওকে। ব্যবধান রইল না আর। রানার বুকের ওপর মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে কাঁদছে সুলতা। আলতো করে চুমো দিল রানা ওর কপালে।

‘এক্ষুণি একবার থানায় আসতে পারবেন, মি. মাসুদ? আমি আতাউল হক, এসপি চিটাগাং বলছি। আমি স্পেশাল ডিউটিতে কাপ্তাইয়ে আছি।’ টেলিফোনে গলাটা, একটু উত্তেজিত শোনাল।

এঁর সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল রানার। চিনতে পারল গলার স্বর এবং সিলেটি উচ্চারণ।

‘আসতে পারি। কিন্তু ব্যাপার কী?’

‘আপনার কথামত লোক পাঠিয়েছিলাম। সেই চক্‌চকে তারটার এই মাথায় একটা ক্যামেরা বসানো আছে। আশ্চর্য ব্যাপার! শিগগির চলে আসুন, নিজ চোখে দেখবেন।’

‘আমি এক্ষুণি আসছি।’

‘আরও একটা খবর, হ্যালো, হ্যালো…’

‘বলুন, ধরেই আছি।’ রিস্টওয়াচটা দেখল একবার রানা।

‘এই কিছুক্ষণ আগে যাকে হ্যাণ্ডওভার করলেন ওসি-র কাছে, সেই মতিনকে মেরে ফেলেছে ওরা গুলি করে। থানায় এনে যেই জিপ থেকে নামানো হয়েছে। অমনি একটা গুলি এসে লাগল একেবারে হৃৎপিণ্ডে। একগুলিতেই শেষ। কোনও আওয়াজ পাওয়া যায়নি বন্দুকের। খুব সম্ভব সাইলেন্সর লাগানো টেলিস্কোপ লাগানো রাইফেল দিয়ে মেরেছে বহু দূর থেকে। আপনি গাড়ি নিয়ে একেবারে ভেতর চলে আসবেন দালানটা ঘুরে থানার পেছন দিক দিয়ে। গাড়ি-বারান্দায় গাড়ি থেকে নামবেন না। রাখি, আপনি চলে আসেন।’

ইউএসএ-র জেনারেল প্রিসিশন ইনকর্পোরেটেড-এর তৈরি শক্তিশালী সিসিটিভি ক্যামেরা। একটা টিলার গায়ে জঙ্গলের মধ্যে বাঁধের দিকে মুখ করে বসানো। রোদ-বৃষ্টি থেকে আড়াল করবার জন্য, এবং কিছুটা ক্যামোফ্লেজের উদ্দেশ্যে লেন্স ছাড়া বাকি সব সবুজ প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা।

‘এ তারের আরেক মাথা কোথায় গেছে বের করা দরকার,’ রানা বলল।

‘জিপ দিয়ে অনেক আগেই লোক পাঠিয়ে দিয়েছি। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আশা করি ফিরে আসবে খবর নিয়ে,’ জবাব দিলেন আতাউল হক।

‘গোপনীয়তার ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছেন তো!’

‘হ্যাঁ। বলে দিয়েছি দূর থেকে দেখেই যেন ফিরে আসে।’

‘ভাল করেছেন। খবরটা এলেই যেন আমি পাই সে ব্যবস্থা করবেন দয়া করে। আমি যাচ্ছি এখন মি. লারসেনের অফিসে।’

লারসেনের অফিস থেকেই চিটাগাং-এ আবদুল হাইয়ের কাছে ফোন করল রানা। কিন্তু আসল কথাটাই জানা গেল না। কবীর চৌধুরীর গোপন আস্তানা বের করতে পারেনি আবদুল হাই। কেউ নাকি বলতে পারে না। এইটুকু কেবল জানা গেল, রাঙামাটির সাত-আট মাইল দক্ষিণে প্রায় দুই বর্গমাইল জায়গা কিনে নিয়েছিল কবীর চৌধুরী আট-দশ বছর আগে। এখন সব চলে গেছে রিজার্ভয়েরের পানির তলায়। ওখানে কোনও আস্তানা থাকবার প্রশ্নই উঠতে পারে না।

‘চৌধুরী এখন কোথায়,’ সে প্রশ্নের উত্তরে হাই বলল, ‘সে গা ঢাকা দিয়েছে। সারা চিটাগাং শহরে ওর চিহ্নমাত্র নেই। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে যে কোথাও ওর নামে এক আঁচড় কালির দাগও নেই। তবে একবার মোটর পার্টস ইমপোর্ট করবার লাইসেন্স দিয়ে সে অদ্ভুত কতগুলো যন্ত্র…’

কথা শেষ হবার আগেই টেলিফোনের কানেকশন কেটে গেল। কিছুক্ষণ বিভিন্ন রকমের শব্দ হওয়ার পর নীরব হয়ে গেল রিসিভার।

এমনি সময়ে ঘরে ঢুকল আবদুল।

‘পেলে কিছু?’ লারসেন সাহেবই প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন।

‘না, হুজুর। ওই তিন জায়গায় না পেয়ে তামাম বাঁধ চষে ফেলেছি আমরা কয়জন! কোথাও কিছু নেই। আর থাকলেও, হুজুর, বুঝবার উপায় নেই।’ উর্দু ইংরেজিতে মিশিয়ে বলল ভগ্নমনোরথ আবদুল নিরুৎসাহিত কণ্ঠে।

‘আচ্ছা, আবদুল, তুমি তো এই অঞ্চল খুব ভাল করে চেনো। কবীর চৌধুরী বলে কারও নাম শুনেছ কখনও?’ রানা জিজ্ঞেস করল।

‘না, হাজুর, এ নাম শুনিনি। দেখলে হয়তো চিনতে পারি।’

‘রাঙামাটি এখান থেকে কতদূর?’

‘তেরো মাইল।’

‘তা হলে কাপ্তাই থেকে পাঁচ-ছয় মাইল উত্তর-পশ্চিমে মাইল দুয়েক জায়গা কিনে নিয়ে একজন লোক…’

‘হাঁ, হাজুর! পাগলা এক লোগ ছিল সেখানে। এক টেঙরি ল্যাংড়া ছিল। একবার বোড়ো দাব্‌ড়ি লাগাইছিল আমাদের। শিকারে গিয়ে…’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। সে-ই লোকই কবীর চৌধুরী। রাতের বেলায় সেই জায়গাটা চিনতে পারবে তুমি প্রয়োজন হলে?’

‘ইনশাল্লাহ। কিন্তু সে সব জমিন তো পানির নীচে চলে গেছে, হাজুর।’

‘এক আধটাও উঁচু টিলা কি নেই, যেখানে এখনও পানি ওঠেনি?’

মি. লারসেন মাঝখান থেকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি মনে করেন এক আধটা টিলা যদি পানির ওপর মাথা তুলে থাকেই, সেখানে এখনও আস্তানা আছে লোকটার?’

‘তা ঠিক নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, তবে আমার সেই রকমই সন্দেহ। মোটরবোটে যখন সে এখানে লোক পাঠাচ্ছে, তখন এ সন্দেহটা একেবারে অমূলক নয়।’

রানা ভাবছিল, দুটো মাত্র উপায় আছে। এক, ডিনামাইট খুঁজে বের করে অকেজো করে দেয়া। দুই, চৌধুরীর আড্ডা বের করে ওটা ফাটানোয় বাধা দেয়া।

ডিনামাইট তো তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না। সেটা পাওয়া গেলে হাতে কিছু সময় পাওয়া যেত। এখন যে কোনও মুহূর্তে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। তাই যে করেই হোক চৌধুরীর আস্তানা বের করা চাই-ই চাই। এবং আজই রাত্রে। একমাত্র ভরসা টেলিভিশন ক্যামেরার তার। দেখা যাক, কী দাঁড়ায়। মনের উত্তেজনাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করল সে।

রেস্ট হাউসে ফিরে রানা দেখল ঘর খালি। বাথরুমের দরজাও খোলা হাঁ করা। সুলতা নেই। গেল কোথায়! একই মুহূর্তে অনেক চিন্তা ছুটোছুটি করল রানার মাথার মধ্যে। ছুটে এসে ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করল। কেউ কিছুই বলতে পারল না। কেউ দেখেনি সুলতাকে বেরিয়ে যেতে।

মনে মনে একটা বিষণ্ণ হাসি হাসল রানা। চলে গেছে সুলতা। যাবার আগে অমন অভিনয় না করলেও তো পারত! ঘরটা একেবারে খালি খালি লাগল রানার কাছে। জোর করে মাথা থেকে সব চিন্তা দূর করে শুয়ে পড়ল ও বিছানায় গিয়ে। বিশ্রাম দরকার।

জানতেও পারল না রানা মাত্র একশো গজ দূরে একটা খালি বাড়ির গ্যারেজের মধ্যে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে অসহায় সুলতা রায়।

ঠিক সাড়ে ছ’টায় এসপি সাহেব এসে ঘুম ভাঙালেন রানার। ‘তারের শেষ মাথা পাওয়া গেল?’ প্রশ্ন করল উদগ্রীব রানা।

‘নাহ্। মাইল পাঁচেক রাস্তার পাশ দিয়ে গিয়ে তারটা চলে গেছে ডানধারে দুর্গম পাহাড়ের ওপর দিয়ে। আমাদের লোক সেই পাহাড় ডিঙিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছিল কিন্তু তারের শেষ আর পায়নি। পানির মধ্যে চলে গেছে তারটা। ওখান থেকেই ফিরে এসেছে ওরা।’

‘সন্ধ্যার পর ঠিক যেখানে তারটা পাহাড়ের ওপর দিয়ে গেছে, সেই রাস্তায় আমাকে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারবেন, মি, হক?’

‘নিশ্চয়ই, এ আর এমন কী কথা হলো?’– হাত-মুখ ধুয়ে নিল রানা। চা খেতে খেতে এসপি সাহেব বলেই ফেললেন, ‘হঠাৎ কী আরম্ভ হয়ে গেল কাপ্তাইয়ে, মি, রানা? কিছুই বুঝতে পারছি না। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলবেন?’

সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে নিয়ে সংক্ষেপে বলল রানা সব কথা।

‘তা হলে তো থানায় ফিরে যাওয়া নিরাপদ নয়। পানির লেভেলের অনেক নীচে ফাঁড়িটা—আমার কোয়ার্টারও নীচে। যে কোনও মুহূর্তে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে আমাদের!’ শঙ্কিত এসপি বেসামাল হয়ে পড়লেন সব শুনে।

‘আপনি কেবল নিজের কথাই ভাবছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের কী অবস্থা হবে ভাবুন একবার। আর কাল যদি প্রেসিডেন্ট পৌঁছবার পর পরই বাঁধটা ভাঙে, তা হলে?’

‘ভয়ঙ্কর, মি. রানা! সাঙ্ঘাতিক, প্রলয়ঙ্কর ব্যাপার! এখন লোকটাকে বাধা দেবার জন্যে কী করতে চান? পুলিশ ফোর্স দেব আপনার সঙ্গে?’

‘তাতে কোনও লাভ হবে না। সতর্ক হয়ে গেলেই পালিয়ে যাবে কবীর চৌধুরী ওর আস্তানা থেকে। তারপর যে কোনওখান থেকেই রেডিয়ো ট্রান্সমিটার দিয়ে উড়িয়ে দেবে এ বাঁধ। ওকে কোনও উপায়ে আচমকা অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরতে হবে। ফোর্স নিয়ে গিয়ে লাভ নেই—আমি একা যাব।’

আবদুল এসে দাঁড়াল। রানা তখন জিপে উঠে বসেছে।

‘আমিও যাব, হাজুর!’ আবদুলের কণ্ঠে অনুনয়।

‘যে কোনও ভয়ানক বিপদ ঘটতে পারে, আবদুল। তুমি থাকো, একাই যাব আমি।’

‘হাজুর, বিপোদ হামি ডোর পায় না; হামি সঙ্গে থাকলে বহোত আসানি হোবে আপনার—পাহাড়ে পাহাড়ে আট বোচ্ছোর চলসি আমি।’

ওসি-ও আবদুলের কথায় সায় দিল। যে-কোনও বিপজ্জনক কাজে যেতে এই আবদুলের খোঁজ পড়ে সব সময়। শেষ পর্যন্ত আবদুলের একান্ত অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারল না রানা। ওকেও নিতে হলো সঙ্গে।

আবদুলের কথার সত্যতা প্রমাণ হলো পাহাড়ে কিছুদূর চলেই। দিনের বেলা হয়তো কষ্টে-সৃষ্টে আছড়ে-পাছড়ে এই পাহাড়ি পথে চলা রানার পক্ষে অসম্ভব হত না, কিন্তু আবদুল না থাকলে এই রাতে সত্যিই চোখে আঁধার দেখত সে। ঝোঁপ ঝাড় আর কাঁটার মধ্য দিয়ে গা বাঁচিয়ে একটার পর একটা উঁচু-নিচু টিলা পার হয়ে চলল ওরা। মাঝে মাঝে বন্য জন্তু জানোয়ারের তৈরি পথ পেয়ে যাচ্ছে ওরা—কিছুদূর ভালই চলছে, কিন্তু আবার টেলিভিশন তারটাকে অনুসরণ করতে গিয়ে বিপথে চলতে হচ্ছে ওদেরকে। দুর্গম গোটা কতক খাড়াইয়ে আবদুল আগে উঠে গিয়ে টেনে তুলল রানাকে।

মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে টেলিভিশনের তার দেখে নিচ্ছে ওরা। হঠাৎ ছুরি বের করল আবদুল। পিছন ফিরে কানে কানে রানাকে বলল, ‘পিস্তোল থাকলে রেডি হয়ে যান, হাজুর, কী জানি আইতেছে এদিকে!’

দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা। আধ মিনিট পর রানা শুনতে পেল সামনের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কিছু একটা এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। আবদুলের অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ শ্রবণশক্তির প্রমাণ আগেই পেয়েছিল রানা লারসেনের অফিসে, তাই ওর এত আগে থেকে সাবধান হয়ে যাওয়ায় বিস্মিত হলো না। শব্দটা কিসের ঠিক বোঝাও গেল না। হাত দশেক সামনে এসে থমকে থাকল দুতিন সেকেণ্ড, তারপর ডান দিকে চলে গেল শুকনো পাতার ওপর দিয়ে মচ মচ শব্দ তুলে। কোনও বন্য জানোয়ার হবে।

‘এদিকে বাঘ-টাঘ আছে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘আছে, হাজুর।’

টর্চ জ্বাললে মাঝে মাঝে ওদের সচকিত করে দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে ছোট ছোট ভিতু খরগোশ কিংবা শিয়াল। ওরা থামলেই শুনতে পায় আশপাশে সাবধানী পদক্ষেপ। রানার মনে হলো সবাই যেন নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ওদের পিছন পিছন আসছে। হঠাৎ এক-আধটা প্যাঁচা ডেকে উঠছে। অশুভ ইঙ্গিত। ছমছম করে ওঠে গা।

একটা ঠাণ্ডা ভেজা দমকা হাওয়া আসতেই দুজন একসঙ্গে চাইল আকাশের দিকে। পুব দিকে পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু পশ্চিমের আকাশ ঘন অন্ধকার। আসছে কালবৈশাখীর ঝড়।

একটু পরেই ঝড় উঠল–তার অল্পক্ষণ পর শুরু হলো বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি। চাঁদটা মেঘে ঢাকা পড়তেই চার দিকটা সূচীভেদ্য অন্ধকার হয়ে গেল। বড় একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল রানা। ঠাস ঠাস ডাল ভেঙে হুড়মুড় করে পড়ছে এদিক ওদিকে। রানার রিস্টওয়াচে বাজে সাড়ে আটটা।

‘না, আবদুল। আর অপেক্ষা করা চলে না, এরই মধ্য দিয়ে এগোতে হবে।’ আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে মনস্থির করে ফেলল রানা।

এবার পথ চলা আরও দুঃসাধ্য হয়ে উঠল। পাহাড়ি আঠালো মাটি পিচ্ছিল হয়ে গেছে বৃষ্টির পানিতে। এক জায়গায় পা ফেললে অন্য জায়গায় চলে যেতে চায় সেটা। তার উপর দমকা ঝোড়ো হাওয়া এক ইঞ্চিও এগোতে দিতে চায় না।

উঁচু পাহাড়ের গায়ে গভীর খাদ। তারই পাশ দিয়ে যেতে হবে প্রায় গজ বিশেক। একটু পা ফসকালে একেবারে দু’তিন শ’ গজ নীচে গিয়ে পড়তে হবে। অর্থাৎ একেবারে ছাতু। খুব সাবধানে পা টিপে টিপে এগোল ওরা। কিন্তু সাবধানেরও মার আছে। হঠাৎ পা পিছলে গেল রানার। এক হাতে পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে আসা একটা শিকড় ধরল রানা, কিন্তু তা-ও গেল ছিঁড়ে। চট করে ওর একটা হাত ধরে ফেলল আবদুল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেও গেল পিছলে। সড় সড় করে হাত ধরাধরি করে দুজন পনেরো ফুট নেমে এসে একটা গাছের গুঁড়িতে আটকে গেল। ঠিক সময় মত আবদুল ধরে ফেলতে না পারলে একেবারে খাদের নীচে গিয়ে পড়ত রানা।

‘চোট তো লাগে নাই, হাজুর!’

মৃদু হেসে রানা ভাবল, একেই আমি সন্দেহ করেছিলাম। মনে করেছিলাম, ইসলাম না হয়ে এও সেই লোকটাকে খুন করে থাকতে পারে পানির তলায়!

তিন মাইল এভাবে চলবার পর দেখা গেল সত্যিই পানির মধ্যে চলে গেছে তারটা। বোঝা গেল, আর খুব বেশি দূরে নেই গন্তব্যস্থল।

পানিতে নেমে পড়ল দুজন। কোয়ার্টার মাইলটাক তার ধরে এগোবার পর সামনে একটা উঁচু পাহাড় দেখা গেল। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। ছোট-বড় কালো-সাদা হরেক রকমের মেঘ মাঝে মাঝে চাঁদটাকে আড়াল করছে। যেই হাওয়ায় ভেসে সরে যাচ্ছে মেঘগুলো, অমনি আবার ফিক করে হেসে উঠছে চাঁদ, ছোট ছোট ঢেউগুলোর মাথায় ঝিলমিল করছে তার আলো। পাহাড়টার কাছাকাছি আসতেই রানা দেখল পানির নীচে একটা লোহার পোস্ট পোতা। সেখানে এসে তারটা পোস্টের মধ্যে ঢুকেছে। পোস্টের চারদিকে হাতড়ে আবার তারটা পাওয়া গেল—সোজা চলে গেছে পাহাড়টার দিকে।

এগোতে গিয়েও কী মনে করে থেমে গেল রানা। আবদুলকে একটু অপেক্ষা করতে বলে দু’হাতে পোস্টটাকে বেষ্টন করে ডুব দিল। একটু পরেই হাত দশেক বাঁয়ে ভেসে উঠল সে। ফিরে এসে পোস্টটা আঁকড়ে ধরে বিশ্রাম নিল সে আধ মিনিট, তারপর বলল, ‘আমাদের বাঁ দিকে যেতে হবে, আবদুল।’

‘কেন, হাজুর, তার তো গেছে ওই পাহাড়টার দিকে।’

‘ওটা একটা ভাঁওতা। ওটা অন্য তার। আসল তার এই থামের দশ ফুট নীচ দিয়ে বেরিয়ে বাম দিকে চলে গেছে। সামনের তার ধরে গেলে কিছুই পাওয়া যাবে না।

আবদুলও ডুব দিয়ে হাত দশেক বাঁয়ে ভেসে উঠল। কাছাকাছিই ছিল রানা। বলল, ‘এবার আমি ডুব দিয়ে আরও কিছুদূর এগোব তার ধরে, তারপর আবার ডুব দেবে তুমি।’

এই ভাবে প্রায় পাঁচ-ছয় শ গজ যাবার পর ধীরে ধীরে পানির ওপর থেকে তারটার দূরত্ব কমে গেল। একটানা এতক্ষণ সাঁতরাবার পর দুজনেই হাঁপাচ্ছে কামারের হাঁপরের মত আওয়াজ করে। কিছুক্ষণ চিৎসাঁতার দিয়ে এক জায়গায় পানির ওপর ভেসে থেকে জিরিয়ে নিল ওরা। তারপর পা দিয়ে আলতো করে তারটা ছুঁয়ে এগিয়ে চলল ধীরে ধীরে ব্রেস্ট স্ট্রোক দিয়ে।

হঠাৎ রানার দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে সড়াৎ করে বেরিয়ে ওকে, জোরে একটা লেজের বাড়ি মেরে নিজেই ভয় পেয়ে পাঁচ হাত শূন্যে লাফিয়ে উঠল একটা মস্ত বড় রুই মাছ। ছপাৎ করে ওটা আবার পানিতে পড়তেই হেসে উঠল আবদুল মৃদুস্বরে।

‘আচানক ডর্ ল্যগ গিয়াথা, হাজুর। এ মাছ দু’বরস আগে এ পানিতে ছাড়ল ফিশারি ডিপাটমেন্ট। সওয়া উনিশ লাখ টাকা খোরচা করছে তিনারা। বিয়াল্লিশ লাখ টাকা ইনকাম হোবে, হাজুর। এ বোড়ো আচ্ছা বিজ্‌নিস।’

আরও আধ মাইল এগোবার পর পানি থেকে আট-দশ ফুট উঁচু একটা টিলার মাথা দেখা গেল। তারটা সোজা চলে গেছে সেই ডুবুডুবু টিলার দিকে।

হতাশ হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল আবদুল। একটা আঙুল ঠোঁটের উপর রেখে চাপা স্বরে রানা বলল, ‘শ শ শ!’

একেবারে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল ওরা টিলাটার দিকে। দশ গজ বাকি থাকতেই রানা লক্ষ করল টিলার মাথায় কিছু একটা কাঁচের জিনিস চাঁদের আলোয় ঝিক করে উঠল একবার। থেমে পড়ল রানা। ওটা একটা রেইডার। চারকোণা মুখের এই ‘ডেকা’ রেইডার স্ক্যানার, চারদিকে নজর রাখবার জন্যে বড় বড় জাহাজের ব্রিজের ওপর বসানো থাকে। টিলার ওপর ঘুরছিল ওটা, হঠাৎ রানাদের দিকে চেয়ে থেমে গেল। অবাক বিস্ময়ে যেন প্রশ্ন করছে নীরবে, ‘কে হে তোমরা? কী চাও এখানে?’

ধড়াস করে উঠল রানার বুকের ভিতরটা। আবদুলকে ডুব দেয়ার ইঙ্গিত করে নিজেও ডুব দিল পানির তলায়। কিন্তু এত আলো কীসের? পানির ভেতর চোখ খুলেই টের পেল রানা যে উপরটা এখন আলোকিত। ধরা পড়া গেছে, পালাবার আর পথ নেই। মরিয়া হয়ে ভেসে উঠল সে উপরে। সার্চ লাইটের তীব্র আলোয় ধাঁধিয়ে গেল চোখ। ঠিক এমনি সময়ে শক্ত একটা রশির ফাঁস, এসে পড়ল গলায়। কয়েকটা হেচকা টানে চোখে শর্ষে ফুল দেখতে দেখতে ডাঙায় এসে ঠেকল রানার দেহ। প্রথমেই ওর হাত দুটো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে চুপচুপে ভেজা শোল্ডার-হোলস্টার থেকে বের করে নেয়া হলো পিস্তলটা।

আবদুলকেও একই উপায়ে টেনে আনা হলো–কিন্তু বন্দি হবার আগেই বিদ্যুৎগতিতে কোমর থেকে ছোরা বের করে আমূল বসিয়ে দিল সে সামনের লোকটার বুকের মধ্যে। তীক্ষ্ণ একটা অপার্থিব চিৎকার করে পড়ে গেল লোকটা পানিতে। ততক্ষণে ছুরিটা টেনে বের করে নিয়ে আবদুল পাশের লোকটার কাঁকালে বসাতে যাবে, এমন সময় গর্জে উঠল একটা সাব-মেশিনগান।

তিন সেকেণ্ড একটানা বিশ্রী শব্দ বেরোল ওটা থেকে। করডাইটের উৎকট গন্ধ এল নাকে।

চালনির মত ফুটো ফুটো ঝাঁঝরা হয়ে গেল আবদুলের প্রশস্ত বুক। অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। লুটিয়ে পড়ল রানার পায়ের কাছে ওর নিঃসাড়, প্রাণহীন দেহটা।

এবার ধীরে ধীরে সাব-মেশিনগানের মুখটা ফিরল রানার দিকে। অল্পঅল্প ধোঁয়া বেরোচ্ছে সেটার মুখ থেকে। লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে যেন রানার বুকের দিকে।

চারদিকে অথৈ জল, আকাশে শুক্লা এয়োদশী, আর সেই সঙ্গে মৃদু-মন্দ জোলো হাওয়া।

নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো রানার।