কিন্তু অতখানি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়া ঠিক হয়নি রানার। জেগে থাকলে পাঁচটা সাড়ে-পাঁচটার দিকে আস্তে খুট করে দরজার ছিটকিনি খোলার শব্দটা শুনতে ও পেতই। কবীর চৌধুরীকে ভয়ঙ্কর লোক হিসেবে ও চিনেছে, কিন্তু প্রয়োজনের সময় সে যে কতখানি দুর্দান্ত হয়ে উঠতে পারে সেটা ঠিক উপলব্ধি করতে পারেনি।
ঘুম ভাঙল রানার সকাল আটটায়। সুলতা অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে চান-টান করে আপন মনে সারা ঘরময় গুনগুন করে বেড়াচ্ছে। এটা ওটা গুছিয়ে রাখছে। চুপচাপ শুয়ে শুয়ে তাই দেখছিল রানা। হঠাৎ ওর দিকে চোখ পড়তেই লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠল সুলতার গাল। গত রাত্রির কথা মনে পড়ে যেতেই দুই হাতে চোখ ঢাকল সে।
একটু হেসে উঠে বসল রানা। সুটকেস থেকে টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, সাবান আর কাপড় বের করে দিল সুলতা। আলতো করে ওর চিবুকটা একটু নেড়ে দিয়ে খুশি মনে শিস দিতে দিতে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল রানা। বাথরুমের দরজায় ভিতর থেকে আর বল্টু লাগাল না।
বাথটাবের কলটা খুলে দিয়ে বেসিনের সামনে দাঁত মেজে নিল রানা। আরও এক-আধটা কাজ সেরে নিয়ে স্লীপিং গাউনটা খুলে দেয়ালের গায়ে ব্র্যাকেটে ঝুলিয়ে রাখল। বাথটাব প্রায় ভরে এসেছিল—দু’মিনিট অপেক্ষা করে কল বন্ধ করে দিল রানা। তারপর সম্পূর্ণ দিগম্বর অবস্থায় নেমে পড়ল টাবের ভিতর।
মস্ত বড় বাথটাবটা মসৃণ পিচ্ছিল সাদা পাথরের তৈরি—ইচ্ছে করলে তার মধ্যে বাচ্চাদের সাঁতার শেখানো যায়। অকারণ পুলকে রানার গায়ে কাঁটা দিল। ধীরে ধীরে গা-হাত-পা ঘষতে ঘষতে গতরাতের মধুর ঘটনাগুলো মনে মনে উল্টে পাল্টে উপভোগ করছে ও হাসি মুখে।
হঠাৎ পিছনের পর্দাটা কেঁপে উঠল। সামনের দেয়ালে একটা ছায়া পড়ল আবছা মত। চমকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল রানা উদ্যত ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে আছে ইয়াকুব। দ্রুত উঠবার চেষ্টা করল ও বাথটাব থেকে–কিন্তু পিছলে গেল হাত। তা, ছাড়া দেরীও হয়ে গেছে। ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে বাথরুমের মধ্যে পর্দার আড়ালে অপেক্ষা করছিল ইয়াকুব, সুযোগ বুঝে এক ঝটকায় পর্দা সরিয়ে রানার মাথার কাছে এসে দাঁড়াল সে। তারপর এক হাতে রানার চুলের মুঠি চেপে ধরল, মাথাটা চলে গেল পানির তলায়।
চোখ বন্ধ করে রানা আশা করছিল এবার ছুরিটা আমূল ঢুকে যাবে ওর বুকের ভিতর। পানির নীচে টু শব্দ করতে পারবে না ও। লাল হয়ে যাবে বাথটাবের পানি, নিঃশব্দে কয়েক সেকেণ্ড ছটফট করে মৃত্যু হবে তার। ছুরিটা যখন বিঁধবে, খুব বেশি কি কষ্ট হবে?
তিন-চার সেকেণ্ড অপেক্ষা করবার পরও যখন তার বুকটা অক্ষত রইল তখন চোখ মেলে দেখল রানা যে ছুরিটা হাতে ধরাই আছে—সেটা ব্যবহারের কিছুমাত্র আগ্রহ নেই ইয়াকুবের। ঠিকই তো, যখন নিঃশব্দে নিঝঞ্ঝাটে কাজ সারতে পারছে, তখন ছুরি-ছোরার কী দরকার?
দুই হাতে প্রাণপণে চেষ্টা করল রানা চুলের মুঠি ছাড়াবার। আরও শক্ত করে এঁটে বসল হাতটা-একটু আলগা হলো না সে মুঠি। ছটফট করতে থাকল রানা একটু দম নেবার জন্যে। মনে হলো বুকের ছাতিটা ফেটে যাবে এখুনি।
চেষ্টা করে দেখল, হাত দুটো পৌঁছুচ্ছে না উপরে, পিঠে ভর করে পা-দুটো উপর দিকে উঠিয়ে বাথটাবের কিনারায় বাধাবার চেষ্টা করল রানা। কিন্তু সেয়ানা ইয়াকুব তখন চুল ধরে টেনে ওর পিঠটা আলগা করে দেয়-পিঠের নীচে শক্ত কিছু না থাকায় ঝপাৎ করে পা-দুটো পড়ে যায় আবার টাবের মধ্যে।
প্রায় এক মিনিট ধরে একের পর এক নানান কৌশলে চেষ্টা করল রানা, কিন্তু বিফল হলো প্রতিবারই। পিচ্ছিল বাথটাব থেকে কিছুতেই মুক্তি পেল না। ঝিমিয়ে এল ওর দেহটা ক্রমে।
হঠাৎ রানা বুঝতে পারল যে ও মারা যাচ্ছে। সম্পূর্ণ নিরুপায় ও এখন। এর হাত থেকে তার মুক্তি নেই—বৃথাই চেষ্টা করা। মাথার কাছের লোকটা আসলে ইয়াকুব নয়, স্বয়ং যমদূত আজরাইল। মনে পড়ল জ্যোতিষী বলেছিল, আটান্ন বছর পর্যন্ত ওর আয়ু। এইবার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেল যে জ্যোতিষশাস্ত্র ভুল, কিন্তু এই সত্যটা প্রমাণ করবার উপায় নেই—ও তো মরেই যাচ্ছে। প্রমাণ করবে কে? হাসি পেল রানার।
চোখ খুলে দেখল পানির উপর জ্বলজ্বলে দুটো চোখ চেয়ে আছে ওর দিকে। ঝকঝক করছে সাদা দাঁতগুলো, ছোট ছোট ঢেউয়ে ইয়াকুবের মুখটা দুলছে এলোমেলো ভাবে।
ছোট একটা সরু শিকলে পা ঠেকল রানার। বুঝল, বাথটাবের পানি বেরোবার রাস্তাটা যে রাবারের ঢাকনা দিয়ে ঢাকা আছে, এ শিকল তারই সঙ্গে লাগানো। আস্তে করে শিকলটা পা দিয়ে সরিয়ে দিলেই ঢাকনিটা খুলে পানি বেরিয়ে যাবে টাব থেকে। কিন্তু অবসন্ন হয়ে গেছে রানার শরীর। একবার চেষ্টাও করল ও শিকলটা সরাবার, কিন্তু পা নড়ল না একটুও। মস্তিষ্কের হুকুম স্নায়ুগুলো আর বয়ে নিয়ে যেতে পারছে না অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাছে। সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলছে রানা।
শেষবারের মত রানা চাইল উপর দিকে। তেমনি জ্বলজ্বল করছে দুটো চোখ। হঠাৎ তিনটে চোখ দেখতে পেল রানা। দুটো চোখের ঠিক মাঝখানটায় যেন আরেকটা চোখ দেখা যাচ্ছে। চুলের মুঠি আলগা হয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়ল অসহায় রানা।
রানা বাথরুমে গিয়ে ঢুকতেই সুলতা এগিয়ে গেল রানার এলোমেলো বিছানাটার দিকে। বালিশটা সরাতেই সাইলেন্সর লাগানো পিস্তলটা দেখল সে। চাদর সাট করে পিস্তলটা যত্নের সঙ্গে আঁচল দিয়ে মুছে আবার বালিশের তলায় রেখে দিল সে। সুবীরের জিনিস বলে পিস্তলটাকেও আদর করতে ইচ্ছে করছে ওর।
বেশ অনেকক্ষণ কেটে গেল। একটা সিনেমা পত্রিকা নিয়ে ছবিগুলোর উপর। আনমনে চোখ বুলিয়ে গেল সে। নীচের ক্যাপশনগুলো পর্যন্ত পড়ল না। কিছুতেই মন বসছে না কোনও কাজে। মেরিলিন মনরোর আত্মহত্যার তাজা খবর বেরিয়েছে সদ্য, সেই সঙ্গে তার জীবনী। সেটাতে পর্যন্ত মন বসল না। হলো কী ওর? উল্টাতে উল্টাতে যখন শেষ হয়ে গেল সব কটা পাতা তখন ঝপাৎ করে টেবিলের উপর পত্রিকাটা চিত করে ফেলে উঠে দাঁড়াল ও। বেরোচ্ছে না কেন সুবীর এখনও?
জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল সে। বাইরে বেশ রোদ উঠেছে। সারি সারি একতলা দোতলা, তিনতলা বাড়িগুলোর ছাতের উপর বিছিয়ে পড়েছে সে রোদ। দৈনন্দিন হট্টগোলে লিপ্ত হতে চলেছে কর্মব্যস্ত চট্টগ্রাম বন্দর। এই আবছা কোলাহল নিরালায় বসে কান পেতে শুনলে ভালই লাগে।
হঠাৎ নীচের দিকে চোখ পড়তেই দেখল সুলতা দুজন লোক পড়ে আছে গলির মধ্যে। বোধহয় মারা গেছে। পাশে জটলা করছে কয়েকজন। একজন তাদের মধ্যে সাদা পোশাক পরা, আর বাকি ক’জনের খাকি পোশাক-পুলিশ।
দৌড়ে এসে বাথরুমের সামনে দাঁড়াল সুলতা। কয়েকবার ডাকল, ‘শুনছ, এই, শুনছ?’ ভিতর থেকে কোনও জবাব এল না। আবার ডাকল। কোনও জবাব নেই। কী মনে করে চাবির গর্তে চোখ রাখল সে। ফুটো দিয়ে দেখল, অপরিচিত এক লোক উবু হয়ে বসে আছে বাথটাবের মাথার কাছে। এক হাতে মস্ত এক ছুরি, আর অপর হাতে পানির মধ্যে কী যেন ঠেসে ধরে আছে।
মুহূর্তে পরিষ্কার হয়ে গেল সুলতার কাছে গোটা ব্যাপারটা। হত্যা করা হচ্ছে সুবীরকে। ছুটে গিয়ে পিস্তলটা নিয়ে এল সে বালিশের তলা থেকে। বাথরুমের দরজার হাতলটা ঘোরাতেই খুলে গেল দরজা। ধাক্কা দিয়ে হাঁ করে দিল কপাট, তারপর লোকটার বুক লক্ষ্য করে টিপে দিল ট্রিগার।
সোজা গিয়ে গুলি লাগল লোকটার কপালে—দুই চোখের ঠিক মাঝখানটায়। দ্বিতীয় গুলির আর প্রয়োজন হলো না। গভীর ক্ষতস্থলটা দেখতে হলো ঠিক শিবের তৃতীয় নেত্রের মত। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল রক্ত— পড়ে গেল লোকটা মেঝের উপর। কলবল করে লাল রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে ড্রেনের দিকে।
বহুকষ্টে রানাকে টেনে বের করল সুলতা বাথটাব থেকে। পরিশ্রম আর উত্তেজনায় নিজেই হাঁফাচ্ছে সে, তাই ঠিক বুঝতে পারল না নাড়ী চলছে কি না। ফার্স্ট এইড কোর্স কমপ্লিট করাই ছিল—আর্টিফিশিয়াল রেসপিরেশন দিতে আরম্ভ করল সে রানার মুখে মুখ লাগিয়ে, আর বুকের পাঁজরে দু’হাতে চাপ দিয়ে।
ঠিক এমনি সময় দমাদম ধাক্কা আরম্ভ হলো দরজায়। ভয়ে পাংশু হয়ে গেল সুলতার মুখ। হাত-পা ঠক ঠক করে কাঁপতে শুরু করল তার। নিশ্চয়ই পুলিশ এসেছে। বাথরুমে রক্তারক্তি কাণ্ড—নীচে মৃতদেহ—এদিকে সুবীর বেঁচে আছে না শেষ ঈশ্বরই জানেন! পাকিস্তানে এসে এবার হাতকড়া পড়ল ওর হাতে। জল বেরিয়ে এল চোখ দিয়ে। চোখ মুছে নিয়ে মন শক্ত করবার চেষ্টা করল ও। ভাবল, যে ক’জনকে পারি গুলি করে মেরে তারপর ধরা দেব। পিস্তলটা হাতে তুলে নিল সুলতা।
দরজায় করাঘাতের শব্দ বেড়েই চলল। সেই সঙ্গে শোনা গেল কয়েকজন লোকের হাঁক-ডাক। ঠিক সেই সময়ে একটু নড়ে উঠল রানার দেহ। আশার আলো দেখতে পেল সুলতা। সুবীরের জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে পারলে নিশ্চয় এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যাবে। এই অল্প পরিচয়ের মধ্যেই বুঝতে পেরেছে সুলতা, এই অদ্ভুত, বেপরোয়া লোকটার উপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করা যায়।
বার কয়েক জোরে জোরে কঁকি দিতেই লাল দুটো চোখ মেলে চাইল রানা। কয়েক সেকেণ্ড ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকল সে, ঘাড়টা ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক চাইল কয়েকবার, তারপর মনে হলো ধীরে ধীরে যেন বুঝতে পারছে সবকিছু।
কিছুক্ষণ চুপচাপ ছিল দরজার ওপাশের লোকগুলো, হঠাৎ দরজার ছিটকিনি খুলে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে। নীচের সেই সাদা পোশাক পরা লোকটা সবার আগে। ঘরে ঢুকে প্রথমেই হাতের ডান ধারে পড়ল খোলা বাথরুম।
মরিয়া হয়ে পিস্তল তুলল সুলতা। গুলিটা বেরোবার ঠিক আগের মুহূর্তে লাফিয়ে উঠে এক ঠেলায় সুলতার হাতটা লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দিল রানা। তারপর এক ঝটকায় কেড়ে নিল পিস্তলটা ওর হাত থেকে। ছুটে যাওয়া গুলিটা ছাতে লেগে। চ্যাপ্টা হয়ে টুপ করে পড়ল সুলতার কোলের উপর। হতভম্ব সুলতা হাঁ করে রানার মুখের দিকে দুই সেকেণ্ড চেয়ে থেকে ফিসফিস করে বলল, ‘পুলিশ!’
‘কী ব্যাপার, সুবীর বাবু! একি দশা আপনার? খুন হয়ে পড়ে রয়েছে কে?’ প্রশ্ন করল পিসি আই-এর চিটাগাং এজেন্ট আবদুল হাই এক সেকেণ্ডে অপ্রতিভ ভাবটা কাটিয়ে উঠে।
প্রথমে রানা চেয়ে দেখল ইয়াকুবের লম্বা দেহটা। কুঁকড়ে পড়ে আছে সে মাটিতে–এখনও রক্ত বেরোচ্ছে কপাল থেকে। তারপর নিজের নগ্ন দেহের দিকে নজর যেতেই সম্বিত ফিরে পেল সে। একটানে ব্র্যাকেট থেকে তোয়ালেটা নিয়ে শরীরের মাঝামাঝি জায়গায় জড়িয়ে নিল। তারপরই আবার মাথাটা ঘুরে উঠে চোখ আঁধার হয়ে এল। ‘আমাকে ধরুন…’ বলেই পড়ে যাচ্ছিল ও মেঝের উপর, লাফ দিয়ে এগিয়ে এসে ধরে ফেলল ওকে আবদুল হাই।
একজন সেপাইয়ের সাহায্যে রানাকে ওর বিছানায় এনে শোয়ানো হলো। নীচের ‘বার’ থেকে আউন্স দুয়েক ব্র্যাণ্ডি এনে খাওয়ানো হলো ওকে। সিপাইদের ঘরের বাইরে দাঁড়াতে বলে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আদ্যোপান্ত ঘটনা শুনে নিল। আবদুল হাই সুলতাকে প্রশ্ন করে করে। তারপর বাইরে দাঁড়ানো সাব ইন্সপেক্টারকে কিছু বলল নিচু গলায়। বিনা বাক্যব্যয়ে একটা মোটা ক্যানভাসের বড় থলের মধ্যে মৃতদেহটাকে ভরে নিয়ে বাথরুমের রক্ত ধুয়ে পরিষ্কার করে দিয়ে চলে গেল সেপাইরা, যেন কিছুই হয়নি এমনিভাবে।
রানাকে চোখ মেলতে দেখে ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে আবদুল হাই সুলতাকে বলল, ‘আপনি কিছু ভাববেন না, সুলতা দেবী। আমার নাম পুলক ব্যানার্জী। খাকি ড্রেস পরা ওই পুলিশ আমাদেরই লোক। সরিয়ে ফেললাম লাশটা কারও টের পাবার আগেই। কিন্তু আর একটু হলেই সেম-সাইড করে ফেলেছিলেন, সুলতা দেবী। আমার তো আত্মাটাই চমকে গিয়েছিল একেবারে!’
‘আমি কী করে বুঝব বলুন যে আপনি পাকিস্থানী পুলিশের লোক নন?’ একটু সলজ্জ হাসি হেসে বলল সুলতা।
‘তা অবশ্যি ঠিকই বলেছেন। আপনার অবস্থায় পড়লে আমিও বোধহয় তাই করতাম। যাক, ভাগ্যিস ঠিক সময় মত সুবীর বাবুর জ্ঞান ফিরে এসেছিল! যা সই আপনার হাতের; নির্ঘাত কপালে লাগত গুলিটা!’
‘যাহ, সই না আরও কিছু! ভয়ে এমন কাঁপছিল হাতটা—গুলি করলাম হার্ট লক্ষ্য করে, ছুটে লাগল গিয়ে কপালে।’
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল আবদুল হাই। রানাও যোগ দিল হাসিতে। বলল, ‘ভালই সই বলতে হবে। যাক, এখন কলিং বেলটা টিপে দাও তো, কিছু খেয়ে নিয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ব।’
‘কোথায় যাচ্ছ?’ বেলটা টিপে দিয়ে জিজ্ঞেস করল সুলতা।
‘কাপ্তাই।’
‘কাপ্তাই কেন?’
‘কাজ আছে।’
‘অসুস্থ শরীর নিয়ে আজ না গেলেই কী নয়?’
আবদুল হাই মুখ টিপে হাসল। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে রানা বলল, ‘না, যেতেই হবে।’
‘আর আমি?’
‘তুমি ইচ্ছে করলে যেতে পারো আমার সঙ্গে। ইচ্ছে করলে পুলক বাবুর সঙ্গে ঘুরে ফিরে দেখতে পারো চিটাগাং শহর।’
‘আমি তোমার সঙ্গেই যাব।’
‘গেলে জলদি কাপড় পরে তৈরি হয়ে নাও।’
সুলতা যেই কাপড় ছাড়তে বাথরুমে ঢুকল, অমনি ইশারায় হাইকে কাছে ডাকল রানা। বিছানার পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল হাই।
‘কবীর চৌধুরীকে চেনেন? ২৫৭ নম্বর বায়েজিদ বোস্তামী রোডে ওর বাসা।’
‘চিনি মানে? খুব ভাল করে চিনি।’
‘ওর সম্বন্ধে যা জানেন সংক্ষেপে বলুন।’
‘তিনিই তো চৌধুরী জুয়েলার্সের মালিক। অজস্র টাকা। খুবই বিনয়ী ভদ্রলোক। তেমনি আবার দান খয়রাতে দরাজ হাত। এমন লোক হয় না। বহু দাতব্য চিকিৎসালয়, স্কুল আর কলেজ ওঁরই টাকায় চলে। জনসাধারণের মধ্যে যেমন সুনাম আছে ওর, তেমনি আছে সরকারী অফিসের উঁচু সার্কেলে দহরম মহরম। প্রথম দিকে প্রায়ই ঢাকা-করাচি-লাহোর এমনকী নিউ ইয়র্ক-লণ্ডন-মস্কো পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করেছেন, এখন চিটাগাং-এর বাইরে বড় বেশি যান না। কী ব্যাপার! হঠাৎ তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছেন যে?’
‘এই কবীর চৌধুরীই আমাদের টার্গেট। একটু আগে যে সব লোককে পাচার করলেন থলেয় ভরে তারা তারই অনুচর।’
হাঁ হয়ে গেল আবদুল হাইয়ের মুখটা।
‘বলেন কী, মশাই?’
‘মশাই নয়, সাহেব; কিন্তু যা বলছি ঠিকই বলছি। ভারতীয় ডিনামাইটগুলো তারই কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে কাল রাতে। আমার উপর আক্রমণের বহর দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আমাকে সে চিনে ফেলেছে। ও-ই যে আসল লোক, এতক্ষণ সেটা জানতাম একা আমি, এখন আপনিও জানলেন। কাজেই আমারই মত আপনার মাথার ওপরেও এই মুহূর্ত থেকে ঝুলল ওর মৃত্যু পরোয়ানা।
‘আশ্চর্য কথা শোনালেন আপনি!’
‘বিস্মিত হবেন না, মি. হাই। দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যাণ্ড আর্থ… ইত্যাদি, ইত্যাদি। এখন কাজের কথায় আসা যাক। খুব সাবধানে নিজের গা বাঁচিয়ে ওর সম্পর্কে যতখানি সম্ভব তথ্য উদ্ধার করুন, আজই। আমার যতদূর বিশ্বাস, চিটাগাং-এর কাছাকাছি ওর আরেকটা আস্তানা আছে–সেখানে সে ল্যাবরেটরি করেছে একটা। সে ব্যাপারেও একটু সন্ধান নেবেন। কিন্তু সাবধান, চৌধুরীর বাড়ির ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করবেন না, ওটা একটা দুর্গম দুর্গ। আর একটা কাজ আছে। আপনি পাহাড়তলী স্টেশনে গিয়ে সুলতার নামে একটা টেলিগ্রাম করবেন। টেলিগ্রামের নীচে প্রেরকের নাম থাকবে জেটিটি—লিখবেন, কবীর চৌধুরী শত্রু, যেন সে সুবীরের কথা মত চলে।
‘আপনি কাপ্তাই থেকে ফিরছেন কখন?’
‘ঠিক জানি না। তবে মনে হয় বেলা চারটের মধ্যেই ফিরতে পারব।’
‘বেশ, আমি চললাম। এর মধ্যেই সব খবর বের করে ফেলার চেষ্টা করব। ওহহো, ভুলেই গিয়েছিলাম; কাপ্তাই থেকে ফিরে সোজা আমার বাংলোতে চলে যাবেন। আপনাদের মালপত্র আমার ওখানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি আমি। একটা চমৎকার ঘর আপনাদের দুজনের জন্যে রেডি রাখা হবে।’
রানা কিছু বলতে যাচ্ছিল, বাধা দিয়ে আবদুল হাই বলল, ‘এটা আমার অনুরোধ নয়, স্যর… হেড আপিসের হুকুম। আমি চললাম। গুড বাই!’
ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল আবদুল হাই।
চিটাগাং থেকে কাপ্তাই পঁয়ত্রিশ মাইল। অতি চমৎকার রাস্তা। মোড় ঘুরবার সময় রাস্তার সুপার এলিভেশন এত সুন্দর যে যেখানে স্পীড লিমিট টেন মাইলস লেখা, সেখানেও পঞ্চাশ-ষাট মাইল বেগে অনায়াসে ইউ টার্ন নেয়া যায়। পথে পাঁচটা চেক-পোস্ট।
এক লক্ষ বত্রিশ হাজার ভোল্টের গ্রিড সাব-স্টেশন দেখা গেল রেলগেট পার হয়ে কিছুদূর যেতেই হাতের বাঁয়ে। বিটকেল সব যন্ত্রপাতি, কাঁটাতার দিয়ে এলাকাটা ঘেরা।
দু’পাশে উঁচু টিলা—মাঝে মাঝে পাহাড়ের উপর দিয়ে গেছে আঁকাবাঁকা মসৃণ পথ। চন্দ্রঘোনা পার হয়ে কর্ণফুলীর পাশ দিয়ে যাবার সময় চোখে পড়ে অপূর্ব সুন্দর সব দৃশ্য! নদীর অপর পাড়েই উঁচু পাহাড়। লম্বা লম্বা গাছ আর ছোট আগাছায় ভর্তি সেগুলো, শহুরে মনকে টানে অন্য এক অচঞ্চল সাদামাটা জীবনের প্রতি, নীরব ইঙ্গিতে। চারদিকে কেবল পাহাড় আর পাহাড়।
হঠাৎ একটা সামান্য ব্যাপার চোখে পড়ল রানার। রাস্তার পাশে টেলিফোনের তার এতক্ষণ ছিল চারটে, নতুন চকচকে একটা তার রোদে ঝিলমিল করছে বলে রানা লক্ষ্য করল— তার এখন দেখা যাচ্ছে পাঁচটা। রানা মোটেই আশ্চর্য হয়নি প্রথমে, কিন্তু অবাক হলো কাপ্তাইয়ের শেষ চেক-পোস্টটা পার হবার পর যখন দেখল তার আবার চারটেই দেখা যাচ্ছে—পঞ্চমটা নেই।
ভিআইপি রেস্ট হাউসে একটা কামরা বুক করে সুলতাকে সেখানে রেখে সোজা মি. লারসেনের অফিসে গিয়ে উঠল রানা। পরিচয় পেয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন তিনি। তিনিই পিসিআই-এর সাহায্য চেয়ে টেলিগ্রাম করেছিলেন ডিফেন্স সেক্রেটারির কাছে। আবদুলকে ডাকিয়ে এনে বাইরে দাঁড়ানো দারোয়ানকে বিশেষ নির্দেশ দিয়ে ঘরের সব দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন তিনি।
সংক্ষেপে সেদিন সন্ধ্যার ঘটনাগুলো বললেন মি, লারসেন। তারপর বললেন, ‘সেদিন আমি রাফিকুল ইসলামের মাছের গল্পে ভুললেও আবদুলের তীক্ষ্ণ চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি লোকটা। বাংলোয় ফেরার পথে ও আমাকে চার্জ করল ইসলামকে পানিতে নামতে দেয়ায়, বলল লোকটাকে জ্যান্ত ধরে আনা যেত, ইসলাম যদি ওকে পানির তলায় খুন না করত। সব ব্যাপার চাপা দেয়ার জন্যে লোকটার মুখ চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে সে। ভিতরে আরও কিছু ব্যাপার আছে—অ্যাণ্ড হি ওয়াজ রাইট! সেদিন রাতেই তারা দুই-দুইবার অ্যাটেমপ্ট নিয়েছে আবদুলের ওপর। খুব হুঁশিয়ার না থাকলে সে রাতেই শেষ হয়ে যেত আবদুল। যাক, সে কথায় পরে আসা যাবে। আবদুলের অবিশ্বাস্য মন্তব্য মাথার মধ্যে এমন ঘুরপাক খাচ্ছিল যে সে রাতে ভাল করে ঘুমোতে পারিনি। সকালে উঠেই হাসপাতালে গিয়ে হাজির হলাম। লোকটা কিভাবে মারা গেছে জানেন? পটাশিয়াম সায়ানাইড। কেউ ইনজেক্ট করেছে ওর পিঠে। ইসলাম গায়েব—ওকে পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালে যাচ্ছি বলে সোজা চিটাগাং চলে গেছে।
‘ইসলামকে তুমি কেন সন্দেহ করলে, আবদুল?’ আবদুলের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল রানা। পানির নীচে মাঝপথে দেহটা আবদুলের হাতে ছিল, তাকেও তো খুনী হিসেবে সন্দেহ করা যেতে পারে।
‘সেটা সাহেবকে বলেছি আমি, উনিই বলুন।’ কথাটা বলতে বলতে একটা স্লিপ প্যাড থেকে ঘ্যাঁচ করে টান দিয়ে একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে নিয়ে কিছু লিখল আবদুল, তারপর লারসেন সাহেবের চোখের সামনে ধরল লেখাটা।
লারসেন সাহেব ওটার উপর একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘১৯৬০ সালে যখন চ্যানেল ক্লোজ করা হলো তখন একটা ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ পেয়ে যায় UTAH এবং IECO আগে থেকে টের পেয়ে সাবধান না হলে (রানার চোখের সামনে কাগজটা ধরল এবার আবদুল। তাতে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা, ‘সামবডি লিসনিং!’) আজ আর ড্যাম কমপ্লিট করতে হত না। অন্ততঃপক্ষে আরও পাঁচ বছরের জন্যে পিছিয়ে যেত কাজ। সেই ঘটনার পর আবদুল আমার সঙ্গে হাতি শিকারে গিয়ে এই ইসলামের ব্যাপারে সাবধান…’
বিড়ালের মত নিঃশব্দে ডানধারের একটা দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল আবদুল। এক ঝটকায় দরজাটা খুলেই কলার ধরে ভিতরে টেনে আনল একটা লোককে। এত আচমকা ঘটল ব্যাপারটা যে প্রথমে একেবারে হকচকিয়ে গিয়েছিল লোকটা। কান পেতে ঘরের কথাবার্তা শুনছিল সে নিবিষ্ট চিত্তে, হঠাৎ এমন বাঘের থাবা এসে পড়বে কে ভাবতে পেরেছিল! কিন্তু চট করে সামলে নিয়ে এক ঝটকায় আবদুলের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় দিল দরজার দিকে। কিন্তু ততক্ষণে রানা, লারসেন দুজনেই এগিয়ে এসেছে। লোকটাকে ধরে পিছমোড়া করে হাত দুটো বেঁধে ফেলা হলো। অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেল না কিছুই।
লারসেন সাহেব থানায় ফোন করে রানার দিকে ফিরে বললেন, ‘এ হচ্ছে আমাদের ডিসপ্যাঁচ ক্লার্ক মতিন। এর সম্বন্ধেও আবদুল আমাকে সাবধান করেছিল, আমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম ওর কথা।’
কয়েকটা প্রশ্ন করেই বোঝা গেল কোনও কথাই বেরোবে না মতিনের পেট থেকে। পরিষ্কার বলে দিল মতিন, ‘নির্ঘাত মৃত্যুর চাইতে জেলের ভাত খেয়ে বেঁচে থাকা অনেক ভাল। একটা কথাও বের করতে পারবেন না আমার কাছ থেকে, যত নির্যাতনই করেন না কেন।’
রানা মনে মনে বলল—‘কথা তোমাকে বলতেই হবে বাছাধন। স্কোপালামিন। টুথ সেরামের একটা ইনজেকশন পড়লেই মুখে খৈ ফুটবে।’ কিন্তু কিছুই বলল না সে। মৃদু হেসে মি. লারসেনকে বলল, ‘চিটাগাং এসেছিলাম অন্য কাজে, এখন দেখছি এক মহাষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যাক, আমি সেদিন সন্ধ্যার সেই জায়গাটা দেখতে চাই। একটা সিনিয়র সার্ভিস ধরাল ও।’
‘চলুন, আপনাকে বোটে করে নিয়ে গিয়ে দেখাব।’
ওসি-কে আড়ালে ডেকে কিছু বলল রানা, নিজের আইডেন্টিটি কার্ডও দেখাল, তারপর ফোক্সওয়াগেনের দরজাটা খুলল, ভুরুজোড়া একটু কোঁচকাল, তারপর আবার কী মনে করে দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে লারসেন সাহেবকে বলল, ‘চলুন, আপনার গাড়িতেই যাই, কথা বলতে বলতে যাওয়া যাবে।’
‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। আসুন।’ ভিতর থেকে পাশের দরজাটা খুলে দিলেন লারসেন।
‘আচ্ছা, কালই তো প্রেসিডেন্ট আসছেন, তাই না?’ রানা মুখে বলল এই কথা, কিন্তু মনে মনে ভ্রুকুটি করে চিন্তা করল, ফোক্সওয়াগেনের দরজটার আলগা থাকবার তো কথা নয়! তারপর ভুলে গেল সে কথা।
‘হ্যাঁ, লঞ্চঘাটে যাবার সময়ই দেখবেন মাঠের মধ্যে কী সুন্দর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। নানান রঙের বালব দিয়ে সাজানো হয়েছে স্টেজ। পাকিস্তান আর ইউএসএ-র পতাকা আঁকা হয়েছে পেছনে; বন্ধুত্বের এম্বলেম দুই হাত আঁকা হয়েছে তার নীচে। সামনে অসংখ্য লোকের বসবার ব্যবস্থা। প্রেসিডেন্টের সামনে টেবিলের ওপর একটা সুইচ থাকবে পাওয়ার হাউস থেকে কানেক্ট করা। বক্তৃতার পর সেই সুইচ টিপবেন প্রেসিডেন্ট—আর ঝলমল করে জ্বলে উঠবে সমস্ত বাতি। ওপেন হয়ে যাবে প্রজেক্ট। কী চমৎকার নাটকীয় হবে, তাই না?
স্পীডবোটে উঠে আবদুল একমনে বকে যাচ্ছিল, ‘আট বোচ্ছোর ধরে কাজ করছি আমি কাপ্তাইয়ে, হুজুর। আমি যেখোন কারাচি-হায়দ্রাবাদ টানাসপোট সার্ভিসে কাম করি, তোখোন হামার এক দোস্ত ছিল বঙ্গালি—বাড়ি চিটাগাঁও। তার কাছে বহোত গপ সুনছি—ষাট-সত্তর মঞ্জিল দালান আছে চিটাগাঁওয়ে হাজার হাজার। ডাবল-ডেক ট্রাম চোলে বহোত চওড়া রাস্তায়। ভাবলাম এ শাহার তো দেখতে হোবে। যোখোন পারথোম আয়লাম, আদমীকে জিগাই, ‘ভাইয়া, ডাবল ডেক ট্রাম চালতা কৌন রাস্তে মে?’ কেউ কোথা বুঝে না, ট্রামই দেখে নাই কাভি, বোলে, ‘হামি জানে না।’
হামি মনে কোরলাম কে, ‘হামি জানে না,’ দুসরা কোঈ গাড়ি হোগা। বার বার বলি, ‘না, না, ডাবল-ডেক ট্রাম, ডাবল-ডেক ট্রাম।’ হা হা করে হাসল কিছুক্ষণ আবদুল।
‘ওয়্যাস্ট পাকিস্তানে দুই পোয়সাকে ‘টাকা’ বোলে। পারথোম যেখোন হোটেলে খেলাম, বিল হোল এক টাকা। হামি ভি খোদার কাছে হাজার শোকর গোজার কোরে দুই পোয়সা বের কোরে দিলাম। দেখি, হোটেলওয়ালা মারতে চায় দিললাগী দেখে।’ আবার এক পেট হেসে নিল সে। আরেকটা সিগারেট ধরাল রানা।
‘কিন্তু এই পাহাড়ী লোগ বোড়ো ভাল, হুজুর। দাস রাকোম ট্রাইব আছে: মগ, চাকমা, পাঙকো, তিপরা, খেয়াঙ, কুকী, মোরাঙ, তুঙতু-নিয়া, লুসাই… লুসাই হোলো সব কিশ্চান, বোড়ো মেহমান নেওয়াজী। বহোত কামলা পাওয়া যায় সিখানে। ‘গুড বাই’-কে বোলে ‘দাম তা কিঙ-তু,’ ‘তুমহারা ক্যয়া নাম’-কে বোলে ‘নামিঙ তু’…’
হঠাৎ রানার বিস্ফারিত চোখের দিকে চেয়ে থেমে গেল আবদুল। বিদ্যুৎ শিহরণ যেন বয়ে গেছে রানার শরীরে। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল ও ড্যামের দিকে। ব্ল্যাকবোর্ডে সুলতার আঁকা নক্সটা পরিষ্কার ফুটে উঠল ওর চোখের সামনে। এই ছবি! এই ছবিই আঁকছিল সুলতা কবীর চৌধুরীর বাড়িতে ব্ল্যাকবোর্ডের উপর। মনে মনে তিনটে লাল চিহ্ন আঁকল রানা বাঁধের গায়ে। নিঃসন্দেহ হলো সে, যখন ঠিক বাম দিকের চিহ্নটার উপর এসে লারসেন সাহেব বললেন, ‘এই সেই স্পট।’