সুলতা লিফটে উঠতেই মাসুদ রানা ঘরে তালা দিয়ে তর তর করে নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে। রানা ভাবছিল, লিফটের ঠিক পাশেই সিঁড়ি ঘর, একই করিডোর দিয়ে বেরোতে হয়, ওখান দিয়ে সুলতার পিছন পিছন বেরোলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।
দোতলায় এসে ম্যানেজারের কাউন্টারে থামল ও। চাবিটা দিয়ে বলল, ‘একটু বাইরে যাচ্ছি। আমাদের কোনও চিঠি বা টেলিগ্রাম এলে হাসান আলীর হাতে দিয়ে দেবেন।’
‘জী, আচ্ছা।’
‘ফিরতে আমাদের রাত হতে পারে। গেট ক’টা পর্যন্ত খোলা রাখেন আপনারা?’
‘গেটে তালা লাগিয়ে দেয়া হয় এগারোটায়। তবে এপাশ দিয়ে একটা পথ আছে। দেরি হলে…’
‘বেশ, বেশ।’ উৎসাহিত হয়ে রানা বলল, ‘কাউকে দিয়ে একটু চিনিয়ে দিন। পথটা-রাতে দরকার হতে পারে।’
‘নিশ্চয়ই, এই সামাদ, যাও তো বাবুকে কিচেনের পাশের রাস্তাটা দেখিয়ে দাও।’
নীচে নেমে সরু একটা গলি দিয়ে মেইন গেটের গজ পনেরো বাঁ দিকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল রানা। দেখল সুলতা ততক্ষণে গাড়িটা ঘুরিয়ে স্টেশনের দিকে রওনা হয়েছে।
হোটেলের সামনে রাস্তার অপর পারে নীল রঙের একটা ওপেল রেকর্ড দাঁড়িয়ে আছে। তিন লাফে রাস্তা পার হয়ে গাড়িতে উঠে বসল রানা। প্রায় একশো গজ দূরে ফোক্সওয়াগেনের টেইল লাইট দুটো দ্রুত সরে যাচ্ছে। রানার রিস্ট ওয়াচে তখন বাজে পৌনে ন’টা। রাস্তার ঝলমলে আলোর পাশে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদটাকে বড় ম্লান দেখাচ্ছে।
এ রাস্তা ও রাস্তা ঘুরে মাইল তিনেক চলবার পর এল নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি। হাসপাতালের উল্টোদিকে আবগারী শুল্ক দফতরের পাশ দিয়ে গেছে বায়েজিদ বোস্তামী বা ক্যান্টনমেন্ট রোড। প্রায় নির্জন রাস্তাটা দোহাজারী রেল লাইনটা পার হয়ে, মাজারের পাশ দিয়ে চলে গেছে। ঠেকেছে গিয়ে চিটাগাং ক্যান্টনমেন্টে। বাঁ দিকে একটা রাস্তা গিয়ে মিশেছে রাঙামাটি রোডে।
অতদূর যেতে হলো না, রেল ক্রসিং আর মাজারের মাঝামাঝি জায়গায় এসে হঠাৎ ডানধারের একটা খোয়া ঢালা কাঁচা রাস্তায় নেমে গেল সামনের ফোক্সওয়াগেন। বড় রাস্তার পাশে একটা একতলা বাড়ির উঁচু পাঁচিল—ঠিক তারপরই ডান দিক দিয়ে চলে গেছে কাঁচা রাস্তাটা।
ওপেলের নাকটা পাঁচিলের আড়াল থেকে একটু বেরোতেই ব্রেক করল মাসুদ রানা। প্রায় দেড় শ গজ দূরে হাতের বাম ধারে একটা দোতলা বাড়ির লোহার গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল ফোক্সওয়াগেনটা। তারপর আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল গেট। গাড়িটা ব্যাক করে পাঁচিলের আড়ালে ঘুরিয়ে রেখে নেমে এল মাসুদ রানা।
দূর থেকে দেখা গেল উঁচু প্রাচীর দিয়ে বাড়িটা ঘেরা। একতলার কয়েকটা ঘরে বাতি জ্বলছে, কিন্তু দোতলাটা সম্পূর্ণ অন্ধকার। চাঁদের আলোয় আবছা কতগুলো উঁচু টিলা দেখা গেল খানিকটা দূরে। একটা নিচু জমি আছে বাড়িটাতে পৌঁছবার আগে হাতের বাঁ ধারে। বোধহয় সেখানে বাড়ি তোলা হবে। মাটি ফেলে অর্ধেকটা ভরাট করা হয়েছে। কয়েক হাজার এক নম্বর ইট জায়গায় জায়গায় থাক দিয়ে সাজিয়ে রাখা।
বাড়িটার গেটের সামনে ডোম বাতির উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত। তাই বাঁ দিকের মাঠের মধ্যে নেমে গেল রানা। ইটের পাঁজার আড়ালে আড়ালে উঁচু প্রাচীরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও। দেখল পাঁচিলের উপর আবার তিন ফুট উঁচু কাঁটাতারের বেড়া। রানা বুঝল অত্যন্ত সুরক্ষিত বাড়ি। একবার ভিতরে ঢুকে কোনওভাবে ধরা পড়লে ওখান থেকে আর বেরোতে হবে না। এমন জায়গায় একটা বাড়িকে এত সুরক্ষিত করার কী উদ্দেশ্য ঠিক বোঝা গেল না।
প্রাচীর বরাবর কিছুদূর বাঁ দিকে চলে গেল রানা। ন’টা সোয়া ন’টাতেই এই এলাকা একেবারে নির্জন হয়ে গেছে। একটানা ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে থেকে থেকে নিচু জলা জায়গা থেকে বেসুরো ব্যাঙের ডাক। এক আধটা জোনাকী মিটমিট করছে ম্লান ভাবে।
গোটা কতক দশ ইঞ্চি ইট একটার উপর আরেকটা রেখে তার উপর উঠে দাঁড়াল রানা। আর হাতখানেক উপরে পাচিলের মাথা। লাফিয়ে উঠে পাঁচিল ধরল ও। কাঁটাতারের বেড়াটা প্রায় দেয়ালের গায়ে লাগানো। ওটাকে ঠেলে উঁচু করবার জন্যে যেই ধরেছে, অমনি ছিটকে দশ ফুট দেয়াল থেকে মাটিতে পড়ল রানা। অসম্ভব জোর এক ধাক্কায় মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ও। হাজার ভোল্টের ইলেকট্রিসিটি চলছে তারের মধ্য দিয়ে। সেই বিদ্যুত্বাহী তারটা রানার ডান হাতের তালুতে আড়াআড়িভাবে বসে যাওয়ায় মাংস পোড়া গন্ধ ছুটল। ফোস্কা পড়ল না। দগদগে ঘায়ের মত কাঁচা মাংস দেখা যাচ্ছে। সাদা রস গড়িয়ে পড়ছে তার থেকে। অজ্ঞান হয়ে নিজের শরীরের ভারে মাটিতে পড়ে না গেলে কয়েক সেকেণ্ডেই মৃত্যু হত রানার।
দু’তিন মিনিট পর ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে এল রানার। কানের কাছে তানপুরার মত একটানা ঝিঁঝি পোকার সুর আর কোলাব্যাঙের ক্ল্যাসিকাল তান শুনে অবাক হলো ও। হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস লাগছে চোখে মুখে। ভাবল, এয়ারকুলারটা বন্ধ করে দিই। ধীরে চোখ মেলল ও। পরিষ্কার চাঁদের আলোয় দেখল একটা দেয়ালের গায়ে কয়েকটা মরচে ধরা শিক দেখা যাচ্ছে। মাটিতে ঘাসের উপর শুয়ে আছে ও। ভাবল, এ কোথায় আছি! হঠাৎ ডান হাতের তালুতে অসম্ভব জ্বালা করে উঠতেই সব কথা মনে পড়ে গেল ওর। উঠে বসে ক্ষত জায়গাটা একবার দেখল রানা। তারপর দেয়ালের উপরের তারগুলোর দিকে চাইল আবার। ভাবল, আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিল আমার। যাক, গতস্য শোচনা নাস্তি। পকেট থেকে রুমাল বের করে ডান হাতটা পেঁচিয়ে নিয়ে। শিকগুলোর দিকে ফিরল ও।
বাড়ির ভিতর থেকে একটা বড় নর্দমা এসে শেষ হয়েছে দেয়ালের বাইরে। ভিতর থেকে পানি এসে এই নিচু জমিতে পড়ে। মোটা শিক দিয়ে বেড়া দেয়া আছে নর্দমাটা। বহুদিনের পুরনো লোহা মরচে ধরে খেয়ে গেছে। সেই নর্দমা দিয়ে হু হু করে দখিনা বাতাস এসে রানার চোখে মুখে লাগছিল এতক্ষণ।
শিকগুলো সহজেই বাঁকিয়ে বাড়িতে ঢোকা সম্ভব মনে করে হাত দিতে গিয়েও থমকে গেল রানা। যদি এতেও কারেন্ট থাকে! বোঝা যাবে কী করে? এবার আর ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা নেই–নিশ্চিত মৃত্যু!
‘ম্যাও।’
চমকে উঠে দেখল রানা, বাড়ির ভিতর থেকে একটা বিড়াল এসে শিকের অপর পারে উঁকি দিচ্ছে। বাইরে চলাচল করবার এই সোজা পথ বের করে নিয়েছে ওটা। শিকের সঙ্গে আলস্যভরে দুবার গা ঘষে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল বিড়ালটা। রানার দিকে নিরুৎসুক দৃষ্টিতে চাইল একবার। তারপর পিঠের উপরটা দুবার চেটে নিয়ে একটা বুক ডন দিয়ে লাফিয়ে চলে গেল ডান ধারে।
নিঃসন্দেহ হয়ে এবার রানা বাঁ হাতে একটা শিক ধরে টান দিল। শিকগুলোর নীচের দিকটা একেবারে চিকন হয়ে গেছে মরচে খেয়ে গিয়ে, তাই বাঁ হাতেই অনায়াসে বাঁকিয়ে উপর দিকে উঠিয়ে দিল সে। হাতের মুঠো থেকে একরাশ লোহার গুড়ো ঝরে পড়ল। খুশি মনে এক এক করে সবকটা শিক বাঁকিয়ে তুলে দিল রানা উপর দিকে, তারপর ডানহাতে ওয়ালথারটা বাগিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল ভিতরে।
বাড়িটার পিছন দিকে মস্ত বড় কম্পাউণ্ড। টিনের ছাউনি দেয়া লম্বা একখানা গুদাম ঘর দেখা গেল। তার সামনে সাত টনী দুটো লরি দাঁড়িয়ে আছে। একটা ফোর্ড, আরেকটা মার্সিডিস। লোকজনের সাড়া শব্দ নেই। শেডবিহীন একখানা একশো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে গুদাম ঘরের এক কোণে বাইরের দিকে। নগ্ন দেখাচ্ছে ওটাকে। বনবন করে কয়েকটা পোকা ঘুরছে ওটার চারধারে।
গেটের দিকে কিছুদূর সরে এল রানা দেয়াল ঘেঁষে। এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সামনের বনেটটা হাঁ করা অবস্থায় ফোক্সওয়াগেনটা দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি বারান্দায়। রানার সামনে বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা। চাঁদের আলো বিছিয়ে পড়েছে মাঠের উপর। এই মুহূর্তে দ্বাদশীর চাঁদটাকে বড় বেশি উজ্জ্বল মনে হলো তার।
দ্রুত পদক্ষেপে একটা নিচু গাছের তলায় চলে এল রানা। সেখান থেকে বাড়ির পিছনটা আর মাত্র গজ দশেক দূরে। পিছন দিকে ব্যারাকের মত কয়েকটা সার্ভেন্টস কোয়ার্টার। কোনও লোকজনের চিহ্ন দেখা গেল না ওদিকে। বাতি জ্বলছে না একটাও। কেবল একটা ইলেকট্রিক জেনারেটরের মৃদু গুঞ্জন ধ্বনি আসছে সেদিক থেকে। নাহ্, কেউ লক্ষ করেনি ওকে।
মাথার উপর দিয়ে একটা বাদুড় ডানা ঝটপট করে উড়ে গেল রানাকে সচকিত করে দিয়ে। আপন মনে ঝুলছিল গাছের ডালে, হঠাৎ কী মনে করে সশব্দে ডানা ঝাঁপটে চাঁদের আলোয় উড়তে লাগল ঘুরে ঘুরে।
বাড়ির পিছন দিকে মাটি থেকে একটা মাধবী লতার ঝাঁড় উঠেছে দোতলার ব্যালকনিতে। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে ঝাঁড়টা। আর তারই মিষ্টি মধুর গন্ধ আসছে মৃদু বাতাসে। রানা জানে, এ-সময়ে গাছে কিলবিল করবে অসংখ্য শুয়োপোকা।
গাড়ি-বারান্দার সামনে সদর দরজা ছাড়া একতলায় ঢোকার আর কোনও উপায় দেখতে পেল না রানা। জানালা দিয়েও কিছু দেখার উপায় নেই। কাঁচের সার্সির ওপাশে ভারী পর্দা ঝোলানো।
আবার কয়েক লাফে এগিয়ে এসে বাড়িটার গায়ে সেঁটে দাঁড়াল রানা। সতর্কভাবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জুতোজোড়া খুলে ফেলল। তারপর পিস্তলটা হোলস্টারের মধ্যে রেখে তরতর করে দোতলার ব্যালকনিতে উঠে এল একটা পাইপ বেয়ে। রুমালের ভিতর ডান হাতের পোড়া তালুটা জ্বালা করে উঠল চাপ লেগে।
খোলা দরজা দিয়ে ঢুকতেই প্রথমে পড়ল সাজানো গোছানো সৌখিন একটা শোবার ঘর। পরিপাটি বিছানার উপর দামি বেড কাভার পাতা। পেন্সিল টর্চ জ্বেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খালি ঘরটা দেখল রানা। বোধহয় বেশ কিছুদিন হলো কেউ ব্যবহার করেনি এ ঘর। পাতলা এক পরত ধুলো জমেছে সব আসবাবপত্রের উপর।
পরপর কয়েকটা ঘর পেরিয়ে একটা বারান্দায় এসে দাঁড়াল রানা। ভূতুড়ে বাড়ির মত শূন্য দোতলায় একটা লোকও নেই। সিঁড়ি ঘরের কাছে আসতেই দেয়ালের গায়ে একফালি আলো দেখা গেল। একতলার ভেন্টিলেটার থেকে আসছে আলোটা।
পায়ের পাতার উপর ভর করে নিঃশব্দে কয়েক ধাপ-নেমে এল রানা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে। ভেন্টিলেটারের ফাঁকে চোখ রেখে দেখতে পেল ড্রইংরুমে একটা সোফায় বসে রানার দিকে মুখ করে কথা বলছে সুলতা, আর রানার দিকে পিছন ফিরে বসা দুজন লোক অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে শুনছে। সুলতা আর লোকগুলোর মাঝখানে একটা টেবিলের উপর সব ক’টা প্যাকেট রাখা। বড়গুলোর থেকে একটা প্যাকেট আর ছোট প্যাকেটটা খুলে সাজানো আছে টেবিলের উপর ভিতরের জিনিস।
চৌকোণ ধাতব বস্তুটার উপর চোখ পড়তেই রানার সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। ডিনামাইট! টিএনটি! তা হলে তিনটে বাক্সের মধ্যে করে তিনটে ডিনামাইট এল ভারত থেকে গোপন পথে। সঙ্গের ছোট বাক্সটায় এল একটা রেডিয়ো ট্রান্সমিটার। খুব সম্ভব ডিনামাইটগুলো ফাটানো হবে রেডিওর সাহায্যে।
সমস্ত ইচ্ছাশক্তি একত্রিভূত করে কান পেতে রানা শুনতে চেষ্টা করল সুলতার কথাগুলো। কিন্তু নিচু গলায় কথা হচ্ছে বলে কিছুই শোনা গেল না।
সামনে একজন কিছু জিজ্ঞেস করল। সুলতা ট্রান্সমিটারের কয়েকটা ডায়াল ঘুরিয়ে বুঝিয়ে দিল। রানা বুঝতে পারল বিশেষভাবে তৈরি এই রেডিও অপারেটেড ডিনামাইটের ব্যবহার পদ্ধতি বুঝিয়ে দিচ্ছে সুলতা। এ সম্বন্ধে কয়েকদিন বিশেষ ট্রেনিং দেয়ার পর ওকে পাঠানো হয়েছে কলকাতা থেকে। কিন্তু এই শক্তিশালী ডিনামাইট দিয়ে কী ধ্বংস করতে চায় এরা? রাহাত খানের কথা মনে পড়ল, ‘বিরাট কোনও পরিকল্পনার প্রায় সমাপ্তির দিকে চলে এসেছে এরা। …জানতে হবে তোমার কী আছে ‘প্যাকেটে, কাকে দেয়া হচ্ছে সেটা, আর কেন দেয়া হচ্ছে। ওদের সমস্ত কুমতলব বানচাল করে দিতে হবে।’ কঠিন সংকল্পের মৃদুহাসি ফুটে উঠল রানার ঠোঁটে।
পিছনের একটা ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে উঠে গিয়ে দাঁড়াল সুলতা। সাদা চক দিয়ে তার উপর একটা ডায়াগ্রাম আঁকল। তারপর লাল চক দিয়ে তিনটে জায়গায় গোল চিহ্ন দিল। রানা বুঝল, এবার বোঝানো হচ্ছে ঠিক কোন জায়গায় ডিনামাইটগুলো বসাতে হবে।
নক্সাটা দেখে কিছুই বোঝা গেল না। চেষ্টা করেও রানা কোনও কিছুর সঙ্গে এর মিল খুঁজে পেল না। ছবিটা যত্ন করে মনের মধ্যে গেঁথে নিল ও, ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে।
আবার সোফায় এসে বসল সুলতা। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর একজন একটা নোট বই এগিয়ে দিল, তাতে কী সব লিখে দিল সুলতা।
হঠাৎ সুলতার সামনের লোক দুজন উঠে দাঁড়াল। রানা চেয়ে দেখল সুলতার পিছনের একটা দরজা দিয়ে ভারী পর্দা উঠিয়ে ঘরে ঢুকল সাড়ে ছ’ফুট লম্বা এবং সেই পরিমাণে চওড়া একজন লোক। কাঁধের উপর প্রকাণ্ড একটা মাথা, মাথা ভর্তি কোকড়া চুল ব্যাকব্রাশ করা। অত্যন্ত সুপুরুষ চেহারা। পরনে কড়া ইস্তিরির রুচিসম্পন্ন টেট্রন সুট। লোকটা ঘরে ঢুকল ডান-পা-টা একটু টেনে টেনে।
সুলতা উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল, লোকটা ওকে বসতে বলে অপর দু-জনকেও বসবার ইঙ্গিত করল। তারপর নিজে সুলতার পাশে বসে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করল। সামনের একজনকে কিছু একটা আদেশ করতেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
এবার বিদায় গ্রহণের পালা। সাড়ে দশটা বাজে। সুলতা উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল। মিষ্টি হেসে তাকে বিদায় দিতে এগিয়ে গেল নতুন আগন্তুক।
সুলতা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই পা টিপে আবার দোতলায় চলে এল রানা। গাড়ি-বারান্দার ঠিক মাথার উপরের ব্যালকনিতে একটা মোটা থামের আড়াল থেকে শুনল গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে উঁচু গলায় সুলতা বলছে, ‘গেটটা কাউকে একটু খুলে দিতে বলুন, মি. চৌধুরী।’
‘আপনি রওনা হন। এখান থেকে বোতাম টিপলে আপনিই খুলে যাবে গেট,’ ভারী গলায় উত্তর এল।
রানা ভাবল সুইচটা কোথায় আছে দেখতে পেলে হতো। কিন্তু তখন আর নীচে নামার সময় নেই।
সামনেটা আলোকিত করে গেটের কাছে চলে গেল ফোক্সওয়াগেন। গেটটা খুলে ভিতর দিকে ভাঁজ হয়ে গেল। হেডলাইটের আলোয় রানা পড়ল গেটের উপর প্লাস্টিকের নেম প্লেটে লেখা:
কবির চৌধুরী
২৫৭ বায়েজিদ বোস্তামী রোড
চিটাগাং।
গাড়িটা বেরিয়ে যেতেই লোহার গেট বন্ধ হয়ে গেল। ক্লিক করে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ করে তালা লেগে গেল গেটে। রানা ভাবল, আপাতত কাজ শেষ। কালকে শুরু হবে আসল কাজ। এখন আবার পাইপ বেয়ে নামা, ড্রেন গলে বেরিয়ে হোটেলে ফেরা। ফোঁস করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়াল সে।
‘হ্যাণ্ডস আপ!’
চমকে উঠল রানা। উদ্যত রিভলভারের নলটার দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সে। তিন গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে মি, চৌধুরীর আদেশে যে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সেই লোকটা। রানা এক পা এগোতেই উজ্জ্বল বাতি জ্বলে উঠল ব্যালকনিতে। গর্জন করে উঠল লোকটা, ‘খবরদার! আর এক পা এগিয়েছ কি গুলি করব। কোনও চালাকি চাই না। মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়াও।’
ধীরে দু’হাত মাথার উপর তুলে ধরল রানা। ঠিক সেই সময় আরও দুজন লোক উঠে এল সিঁড়ি বেয়ে। একজনের উদ্দেশে লোকটা বলল, ‘হাবীব, দেখো তো এর সঙ্গে কোনও অস্ত্রশস্ত্র আছে কি না।’
হাবীব ও তার সঙ্গের লোকটা এগিয়ে এল রানার দিকে। রানা বুঝল, এই সুযোগ। রিভলভার থেকে যেই হাবীব ওর দেহটা আড়াল করেছে অমনি এক ঝটকায় পিস্তল বের করে ফেলল সে। কিন্তু ভীষণ বলশালী একটা হাত চেপে ধরল ওর কব্জি। হাবীবের পাশের লোকটা কব্জিটা ধরে বিশেষ কায়দায় একটা মোচড় দিতেই ঠিক শিশুর হাতের খেলনার মত রানার অটোমেটিক ওয়ালথারটা খসে পড়ে গেল মাটিতে। হাবীব ওটা তুলতে গেছে, হাঁটু দিয়ে ওর চিবুকে কায়দা মত একটা লাথি মারতে গিয়ে থেমে গেল রানা। ঠিক হৃৎপিণ্ড বরাবর পিঠের উপর একটা তীক্ষ্ণ ছুরির ফলা অল্প একটু বিঁধল। ততক্ষণে রিভলভারের সামনের আড়াল সরে গেছে। হাবীবের সঙ্গের পাতলা-সাতলা লম্বা অথচ অসুরের মত বলশালী লোকটা রানার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘দুষ্টুমি করে না, খোকা। মারব।’
এই বিপদের মধ্যেও লোকটার রসিকতায় মৃদু হাসল রানা। ওর হাত দুটোকে পিছমোড়া করে সাঁড়াশীর মত চেপে ধরল লম্বা লোকটা। চেষ্টা করেও এক বিন্দু আলগা করতে পারল না রানা সে মুঠো। ঠেলতে ঠেলতে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নীচতলার একটা দেয়ালের সামনে নিয়ে আসা হলো রানাকে। একটা বোতাম টিপতেই দেয়ালটা দু’ভাগ হয়ে গিয়ে একটা দরজা বেরিয়ে পড়ল। মাঝারী আকারের একটা ঘরের ভিতর চলে এল রানা। হাবীব রয়ে গেল বাইরে। লম্বা লোকটার পিছন পিছন ঘরে ঢুকল রিভলভারধারী। পিছনে দেয়ালটা আবার জোড়া লেগে গেল।
‘লাইব্রেরিতে নিয়ে এসো।’ ভারী গলার আওয়াজ পাওয়া গেল ঘরের মধ্যে, কিন্তু কোনও লোকের দেখা নেই। এদিক ওদিক চেয়ে রানা দেখল দেয়ালের গায়ে স্পীকার বসানো আছে একটা।
ততক্ষণে তাকে আরেকটা দেয়ালের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একই উপায়ে দরজা তৈরি হলো সে দেয়ালে। রানার মাথায় তখন অতিদ্রুত কয়েকটা চিন্তা ঘুরছে। এখান থেকে বেরোবার কৌশল উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে সে।
একটা দামি সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উপরটা পুরু সবুজ ভেলভেটে ঢাকা—তারই ওপাশে রিভলভিং একটা চেয়ারে বসে শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে কবীর চৌধুরী। সামনের টেবিলের উপর একটা মোটা ইংরেজি বই পড়তে পড়তে উল্টে রাখা। চট করে নামটা দেখে নিল রানা। এইচ. এ. লরেঞ্জ-এর লেখা ‘প্যাটার্ন অভ ইলেকট্রন্স।’
‘আসুন, আসুন! বসুন।’ নরম স্বাভাবিক গলায় আপ্যায়ন করল কবীর চৌধুরী। যেন কিছুই ঘটেনি, এমনি ভাব।
পুরু কার্পেটের উপর দিয়ে নিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসানো হলো রানাকে ডেস্কের দিকে মুখ করে। হাতটা ছেড়ে দিল লম্বা লোকটা। রানাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাচল। হাতের মধ্যে রক্ত চলাচল বন্ধ ছিল এতক্ষণ। হাত দুটো ঝুলিয়ে রাখল রানা চেয়ারের হাতলের দুই পাশে। চিনচিনে মৃদু ব্যথার সঙ্গে আবার রক্ত চলতে শুরু করল।
কোনও কথা না বলে কবীর চৌধুরী আপাদমস্তক লক্ষ্য করছিল রানাকে। দৃষ্টিটা স্থির এবং একাগ্র। মনে হলো যেন অন্তস্তল ভেদ করে বেরিয়ে গেল সে দৃষ্টি। যেন কিছুই এর নজর থেকে গোপন রাখার উপায় নেই। ঝিরঝির করে এয়ার কণ্ডিশনারের একটা মৃদু গুঞ্জন আসছে ঘরের এক কোণ থেকে। এই প্রথম রানা অনুভব করল অত্যাশ্চর্য এক ব্যক্তিত্ব। চোখে মুখে চেহারায় সবদিক থেকে যেন প্রতিভা এবং শক্তির বিচ্ছুরণ হচ্ছে। অদ্ভুত প্রাণবন্ত একটা মানুষ। মস্তবড় মাথা ভর্তি কোকড়া চুল তেলের অভাবে কিছুটা রুক্ষ। বয়স পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ হবে।
রানা লক্ষ করল কবীর চৌধুরীর গায়ের রঙটা তিনদিনের পানিতে ডোবা প্রায় পচে ওঠা মড়ার মত। যেন বহুদিন মাটির নীচে কোনও তলকুঠুরির সোদা আবহাওয়ায় কাটিয়েছে, বাইরের আলো-বাতাসের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত।
টেট্রনের কোটটা খুলে একটা হ্যাঁঙ্গারে ঝোলানো। সাদা স্টিফ কলার শার্টের নীচে গেঞ্জির অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে কয়েকটা বাঁকা রেখায়। অনামিকায় মস্ত বড় একটা হীরের আংটি উজ্জ্বল আলোয় ঝিমি করছে। জুলফির কাছে কয়েকটা পাকা চুল আভিজাত্য এনেছে চেহারায়।
কিছুক্ষণ চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে রানাকে লক্ষ্য করল মি. চৌধুরী। রানাও পাল্টা লক্ষ্য করল তাকে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, তারপর ঘরের চার ধারে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। সৌখিন কোটিপতির লাইব্রেরি যেন, সাজানো গোছানো ঠাণ্ডা ও নীরব এই ঘরটা। বোধহয় সাউণ্ড-প্রুফ করা। থরে থরে সরু, মোটা অনেক বই সাজানো বারো চোদ্দটা বড় বড় আলমারিতে। কবীর চৌধুরীর ঠিক মাথার উপর পিছনের দেয়ালে টাঙানো স্বামী বিবেকানন্দের মস্ত একটা অয়েল পেইন্টিং।
রানা ভাবছিল, এই লোকটাই কি সেই বিখ্যাত চৌধুরী জুয়েলার্সের মালিক? তবে এর বাড়িতে অত বড় গুদাম ঘর কিসের? বাড়িটা এমন ভাবে সুরক্ষিত করবার কী দরকার? ভারতীয় গুপ্তচর বিভাগের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক? তার উপর স্বামী বিবেকানন্দের ছবি, অ্যাডভান্সড ফিজিক্সের বই। ঠিক সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সিগারেট কেসটা বের করবার জন্যে পকেটে হাত দিতে গেল রানা। কথা বলল কবীর চৌধুরী।
‘সিগারেট খেতে পারেন আপনি। কিন্তু অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকলে সাবধান হতে অনুরোধ করছি। প্রতিটি মুহূর্ত আমি প্রস্তুত আছি আপনার জন্যে। ফলটা আপনার জন্য শুভ হবে না।’
বৃথা হুমকি দেবার লোক কবীর চৌধুরী নয়। বাড়িটায় ঢুকে এতক্ষণ পর্যন্ত যা দেখেছে, তাতে অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে গেছে রানার কাছে—এ লোকের প্রতিটা খুঁটিনাটি ব্যবস্থায় অসামান্য বুদ্ধিমত্তার পরিচয় আছে, এবং সেই সঙ্গে আছে প্রচণ্ড ক্ষমতার ইঙ্গিত।
একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিল রানা।
‘আপনার নাম?’ রানার চোখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল কবীর চৌধুরী। যেন একবিন্দু মিথ্যে বললেই ধরে ফেলবে।
সুবীর সেন।
পলকের জন্যে ভুরু জোড়া একটু কোঁচকাল কবীর চৌধুরী। তারপর স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘ইণ্ডিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের সুবীর সেন?’
‘আজ্ঞে, হ্যাঁ।’
‘সুলতা রায়কে আপনিই গাড়িতে তুলে নিয়ে এসেছেন বসন্তপুর থেকে?’
‘আজ্ঞে, হ্যাঁ।’
‘তা, কী কারণে এই গরীবালয়ে পদার্পণ?’
‘হেড অফিসের হুকুম।’
‘বিশ্বাস করলাম না আপনার কথা।’
‘বিশ্বাস করাবার মত যুক্তি আমার পকেটে আছে, মি. চৌধুরী।’
পকেট থেকে একখানা কাগজ বের করল রানা। টেবিলের উপর ছুঁড়ে দিল। সেটা কবীর চৌধুরী একবার চোখ বুলাল সাঙ্কেতিক চিঠিটার উপর। এবার আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল তার চোখ দুটো।
‘এ চিঠির আদৌ যদি কোনও অর্থ থাকে, তবে তা বের করে নিতে আমার পনেরো মিনিট সময় লাগবে। যাক, আপাতত ধরে নিলাম আপনি সুবীর সেন। কিন্তু আমার বাড়িতে অনধিকার প্রবেশ করেছেন কেন?’ চিঠিটা ভাঁজ করে টেবিলের উপর পেপার-ওয়েট দিয়ে চাপা দিয়ে রাখল কবীর চৌধুরী।
‘সুলতা রায়কে অনুসরণ করবার আদেশ আছে আমার উপর। ডিনামাইটগুলো ঠিক হাতে পৌঁছল কি না এবং ঠিকমত ব্যবহার করা হলো কি না সেটা দেখার ভার দেয়া হয়েছে আমাকে। তাই গাড়ির মধ্যে লুকিয়ে সুলতার সঙ্গেই ঢুকেছি এ বাড়িতে।’
‘সুলতার গাড়িতে আপনি আসেননি—এসেছেন ওপেল রেকর্ডে করে। কবীর চৌধুরীর হাসি হাসি মুখটা গম্ভীর থমথমে হয়ে গেল। মনে হলো রানার মুখের উপর কেউ যেন দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল। তীব্র দৃষ্টিতে রানার চোখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, ‘মিছে কথা আমি বরদাস্ত করি না, সুবীর বাবু। আপনি ভুল করছেন। মিথ্যে বলে আজ পর্যন্ত আমার হাত থেকে কেউ নিস্তার পায়নি। আপনিও পাবেন না।’
টেবিলের উপর থেকে একটা পাইপ তুলে নিয়ে চামড়ার পাউচ থেকে টোবাকো ভরে নিল কবীর চৌধুরী। একটা লাইটার দিয়ে সেটা ধরিয়ে আঙুল দিয়ে টিপে আগুনটাকে সব জায়গায় সমানভাবে ছড়িয়ে দিল। তারপর একগাল ধোয়া ছেড়ে বলল, ‘রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটা তো বটেই, আপনার ডান হাতটাও প্রমাণ করছে যে আপনি সুলতার সঙ্গে আসেননি, দেয়াল টপকাতে গিয়ে প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেয়েছেন ইলেকট্রিসিটির। আমি তখন এখানে ছিলাম না। হঠাৎ বাতির আলো কমে যাওয়ায় এ বাড়ির কারও কাছেই আপনার আগমন গোপন ছিল না। তবে এরা ভাবতেও পারেনি যে ভাগ্যক্রমে নর্দমাটা পেয়ে যাবেন আপনি। এতক্ষণে সে পথটা বন্ধ করা হয়ে গেছে। এ বাড়িতে আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ আমরা লক্ষ করেছি। কাজেই মিথ্যে কথা না বাড়িয়ে বলে ফেলুন আপনি কে, এবং কেন এ বাড়িতে প্রবেশ করেছেন।’
‘আপনিও মিথ্যে বকর বকর না করে চিঠিটা পড়ে দেখুন, মি. চৌধুরী। তারপর আমাকে যেতে দিন।’
‘চিঠিটা পড়ে দেখলেও আপনাকে যেতে দেয়া হবে না। এ বাড়িতে ঢোকা যদিও একেবারে অসম্ভব নয়—কারণ দেখতেই পাচ্ছি আপনি ঢুকেছেন–কিন্তু এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া সত্যিই অসম্ভব।’
‘তার মানে?’
‘মনে হচ্ছে, আজ আর সুলতা দেবীর সঙ্গে রাত কাটানো আপনার কপালে নেই, সুবীর বাবু। কেবল একটা চিঠিতে কিছুই প্রমাণ হয় না। তা ছাড়া আপনার কথায় অনেক গোলমাল আছে। শুনুন। আপনি বলছেন, হেড অফিসের হুকুমে আপনি এবাড়িতে প্রবেশ করেছেন। অথচ আপনার হেড অফিস আমার বাড়ির দেয়ালের ওপর ইলেকট্রিক তারের অস্তিত্ব সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল থাকা সত্ত্বেও আপনাকে সাবধান করে দেয়নি–এ কেমন কথা? তার ওপর আপনার জুতো জোড়া। ঘরের এক কোণের দিকে চাইল চৌধুরী। রানাও দেখল একটা টী-পয়ের উপর সাজানো রয়েছে ওর জুতো জোড়া। ওগুলো ঢাকার বিউটি ফুট ওয়্যারের তৈরি। ওগুলোর গোড়ালিতে যে চোরা কুঠুরী আছে তার মধ্যে রাখা ছুরিটা বিশেষ কায়দায় তৈরি হয়েছে শিয়ালকোট থেকে। ভারতীয় গুপ্তচরের এসব গুপ্ত জিনিস কি আজকাল পাকিস্তান সাপ্লাই দিচ্ছে?’
‘দেখুন, আপনি মিথ্যে আমাকে সন্দেহ করছেন। আমি…’
বাধা দিয়ে গর্জে উঠল কবীর চৌধুরী, ‘মিথ্যে আমি কাউকে সন্দেহ করি না, সুবীর বাবু। রাস্তার উপর যে ওপেল রেকর্ড রেখে এসেছেন সেটা পিসিআই-এর চিটাগাং-এজেন্ট আবদুল হাইয়ের। আপনি বলতে চান পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ভারতীয় সিক্রেট সার্ভিসকে পূর্ব পাকিস্তানের এক মহাধ্বংসলীলায় সাহায্য করছে? সেটা সম্ভবপর হলে আমি এদের কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করতাম, ভারত সরকারের কাছে হাত পাততে হত না। বুঝতে পারছেন আমার কথা? এখন বলুন, আপনার পরিচয়?’
চুপ করে থাকল রানা। এর চোখে ধুলো দেয়া সহজ কথা নয়।
‘চুপ করে থেকে কোনও লাভ নেই, সুবীর বাবু। কথা আপনাকে বলতেই হবে—এবং সত্যি কথা। এর উপর নির্ভর করছে আপনার জীবন মরণ। দেখুন, আমি বৈজ্ঞানিক মানুষ, এখন এক ভয়ঙ্কর খেলায় নেমেছি। যে-কোনও রকম বাধা অতিক্রম করবার ক্ষমতা আমার আছে। আপনি যদি সত্যি কথা বলেন, তবে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর হাত থেকে আপনার বাঁচবার একটু ভরসা থাকতেও পারে। মিছেমিছি প্রাণী হত্যা আমি পছন্দ করি না। আমার পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়নে আপনি কতটুকু ক্ষতিকর ভূমিকা নিতে পারেন তা জানতে পারলে ঠিক সেই পরিমাণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। হয়ত এমনও হতে পারে, মাত্র কয়েকটা হাড়গোড় ভেঙে আপনাকে বর্মা মুলুকে সরকারী পুলিশের হাতে ছেড়ে দিয়ে আসা হলো। সেখান থেকে নাকানি চুবানি খেয়ে দেশে ফিরতে ফিরতে কয়েক মাস লেগে যাবে—কয়েক বছরও লাগতে পারে, কিন্তু প্রাণে তো বাঁচলেন! কথা না বললে সবচাইতে সহজ পথটাই বেছে নিতে হবে আমাদের।’
এ পাইপটা নিভে গিয়েছিল। আবার ধরিয়ে নিল কবীর চৌধুরী। কিছুক্ষণ মগ্ন চিত্তে পাইপ টানার পর আবার বলল, আর আপনার ভাগ্যক্রমে যদি কাল সকালে সুলতা দেবী এসে আপনাকে সুবীর সেন বলে সনাক্ত করেন তবে আপনার একটা মধু-রাত্রি মাটি করে দেয়ার জন্যে আমরা আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করে আপনাকে সসম্মানে মুক্তি দেব।’
‘এখুনি মিসখায় টেলিফোন করে সুলতাকে ডেকে পাঠান না।’ এতক্ষণে একটু আশার আলো দেখতে পেল রানা।
‘এত রাতে বিরক্ত করা কি ঠিক হবে? আচ্ছা, বেশ। আপনি যখন হোটেলে ফিরবার জন্যে এত উতলা হয়ে পড়েছেন, তখন দেখছি ফোন করে।’
রিসিভার তুলে ডায়াল করল কবীর চৌধুরী। রানা আরেকটা সিগারেট ধরাল। পিছনে চেয়ে দেখল ওর ওয়ালথার পিপিকে-টা আলগাভাবে হাতের মুঠোয় ধরে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে অস্থিসর্বস্ব লম্বা লোকটা। রিভলভারধারী কখন যেন কবীর চৌধুরীর গোপন ইঙ্গিতে নিঃশব্দে সরে গেছে পিছন থেকে।
‘হোটেল মিসখা? …সুলতা দেবীকে ডেকে দিন তো দশ নম্বর রুম থেকে। …না তো, একটু আগে আমি রিং করিনি। …নেই? (কপালটা একটু কোঁচকাল কবীর চৌধুরী) …বাবুর সঙ্গে বেরিয়ে গেছে? কখন? …আচ্ছা ঠিক আছে।’
রানা ভাবছে, এতক্ষণে তো হোটেলে পৌঁছে যাবার কথা। পরমুহূর্তে মনে পড়ল, এ নিশ্চয়ই হাসান আলীর কাজ। টেলিফোন এলে কী করতে হবে ও নিজেই বলে দিয়েছিল তাকে …হোটেলে তা হলে একটু আগে কেউ ফোন করেছিল? কোথা থেকে টেলিফোন! তবে কি তার পরিচয় প্রকাশ পেয়ে গেছে? সুলতাকে যখন চেয়েছিল ফোনে তখন নিশ্চয়ই তাকে সাবধান করে দেয়ার জন্যে ইণ্ডিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের কেউ করেছিল এই ফোন।…এখানেও তো ওরা ফোন করে জানাবে তা হলে! কোনও ভাবে খবরটা আটকানো যায় না? ফোনের তারটা ছিঁড়ে ফেললে কেমন হয়? ফোনটা হাতে পাওয়ার জন্যে বলল রানা, সুলতা হোটেলেই আছে। আমিই ওকে নিষেধ করেছি বাইরের কারও ফোন ধরতে। আমাকে দিন; আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি।’
টেলিফোনটা কবীর চৌধুরী এগিয়ে দিতে যাবে এমন সময় রানাকে চমকে দিয়ে বেজে উঠল টেলিফোন। ক্রিং ক্রিং…ক্রিং ক্রিং..
কবীর চৌধুরী বলছি। …আচ্ছা, বলুন! …কে, সুলতা? এই কিছুক্ষণ আগে হোটেলে ফিরে গেল। …কী বললেন? সুবীর সেন ঢাকার আর্মি হাসপাতালে? তবে সুলতাকে বসন্তপুর থেকে আনল কে? …মাসুদ রানা? (চট করে একবার রানার ফ্যাকাসে মুখের উপর চোখ বুলিয়ে নিল কবীর চৌধুরী, তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ মন দিয়ে শুনল ফোনের কথাগুলো।) …বুঝলাম, কিন্তু পিসিআই কেবল চিঠিটা দেখে আর কী বুঝবে? এখানে কী হচ্ছে বা হতে চলেছে তার কিছুটা জানতে পেরেছে কেবল মাসুদ রানা। আপনাদের অত চিন্তার কোনও কারণ নেই। মাসুদ রানা এখন আমার হাতে বন্দি। কাল ভোরে এ পৃথিবীর জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে ওকে চিরতরে মুক্তি দেব …হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার এলাকায় আমি যে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম। …নিশ্চিন্ত থাকুন, সুলতা নিরাপদে কলকাতা পৌঁছবে, আজ রাতেই সরিয়ে ফেলব ওকে মিসখা থেকে …ঠিক আছে, সমস্ত দায়িত্ব আমি নিলাম।’
ফোনটা নামিয়ে রেখে রানার দিকে চেয়ে একটু হাসল মি. চৌধুরী।
‘আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে বড় খুশি হলাম, মি. মাসুদ রানা। দেয়ালের ওপর অমন ভয়ানক শক্ খেলেন, তবু আমাদের লোক আপনাকে খুঁজে পাওয়ার আগেই ঢুকে পড়লেন বাড়ির ভেতর। ভাবছিলাম কার এতবড় দুঃসাহস? এখন পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু। আমি অত্যন্ত দুঃখিত (যদিও চেহারা দেখে একটুও দুঃখিত মনে হলো না তাকে), মৃত্যুর চাইতে হাল্কা আর কোনও দণ্ড আপনাকে দিতে পারছি না, মি. মাসুদ রানা। তবে সাহসী লোকের প্রতি আমার কিছুটা দুর্বলতা আছে… আমি চেষ্টা করব আপনার জন্যে যতদূর সম্ভব বেদনাহীন মৃত্যুর ব্যবস্থা করতে।’
‘আমার মৃত্যু হলেই মনে করেছ তুমি পার পেয়ে যাবে?’
রানার কথার কোনও জবাব না দিয়ে লম্বা লোকটাকে কবীর চৌধুরী বলল, ‘একে ঠাণ্ডা ঘরের পাশের কুঠুরীতে আটকে রাখো, ইয়াকুব। ভোর চারটেয় আমি ল্যাবরেটরিতে ফিরে যাব, তখন ওকে হাত-পা-মুখ বাধা অবস্থায় গাড়ির পেছনে তুলে দেবে। এখন যাও। সাবধান থাকবে। যদি বেশি অসুবিধার সৃষ্টি করে, শেষ করে দেবে।’
একটা অশ্লীল গালি বেরিয়ে এল রানার মুখ দিয়ে।
বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়াল কবীর চৌধুরী। সপাং করে একটা চাবুকের বাড়ি পড়ল রানার কাঁধের উপর। চমকে উঠল রানা। ততক্ষণে আবার নেমে আসছে চাবুক। ডান হাতে ধরে ফেলল রানা চাবুকটা, কিন্তু এক হেঁচকা টানে কবীর চৌধুরী ছিনিয়ে নিল সেটা। স্টিং রে বা স্থানীয় ভাষায় শঙ্কর মাছের লেজের চাবুক। হাতের তালুর পোড়া জায়গাটার উপর দিয়ে জোরে ঘষতে ঘষতে বেরিয়ে গেল সেটা মুঠো থেকে। অবর্ণনীয় ব্যথায় নীল হয়ে গেল রানার মুখ। একটা চাপা আর্তচিৎকার বেরিয়ে পড়ল মুখ দিয়ে। হাতের রুমালটা লাল হয়ে গেল রক্তে।
‘বেয়াদবির শাস্তি!’ বলে কবীর চৌধুরী মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করল ইয়াকুবকে।
দাঁড়িয়ে পড়েছিল রানা। ইস্পাত কঠিন দুটো হাত এসে ওর ডান হাতটা ধরে মুচড়ে পিঠের দিকে নিয়ে গিয়ে উপরে ঠেলতে লাগল। রানার মনে হলো হাতটা ভেঙে যাবে। ব্যথায় গলা দিয়ে একটা অদ্ভুত গোঙানি মত শব্দ বেরোল ওর। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল কপালে।
‘এগোও।’ একটা ঠেলা দিল ইয়াকুব পিছন থেকে।
রানার পা এলোপাথাড়ি পড়তে লাগল। দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে ওরা একটা লম্বা বারান্দায় পড়ল। দুপাশে দেয়াল।
‘হাতটা ভেঙে যাবে! উঃ! আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি!’ কাতর স্বরে বলল রানা। হাতটা একটু আলগা হোক, তাই চাচ্ছে ও।
‘চোপ, শালা!’ ধমকে উঠল ইয়াকুব, কিন্তু কব্জিটা ইঞ্চি তিনেক নামিয়ে দিল পিঠের উপর। রানা ভাবছিল, তলপেট, কণ্ঠনালী বা অণ্ডকোষ-এই তিন জায়গা, হচ্ছে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দুর্বলের লক্ষ্যস্থল।
ইচ্ছে করেই একবার হোঁচট খেল। ইয়াকুবের গায়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগল ওর। আন্দাজ পাওয়া গেল দুজনের মধ্যের দূরত্বটা ঠিক কতখানি।
এবার হঠাৎ রানা ডানধারে একটু সরে গেল এবং বাঁ হাতটা সটান সোজা রেখে খুব জোরে পিছন দিকে চালাল। ধাই করে হাতটা লক্ষ্যবস্তুর উপর পড়তেই তীক্ষ্ণ একটা শব্দ বেরোল ইয়াকুবের মুখ থেকে। ডান হাতটা ঢিল পেয়ে পিঠের উপর থেকে নামিয়ে আনল রানা। ইয়াকুব ততক্ষণে যন্ত্রণায় বাঁকা হয়ে গেছে। দুই হাত দিয়ে সে দুই উরুর মাঝখানে কী যেন চেপে ধরেছে। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড এক লাথি মারল রানা ওর পাজরের উপর। ছিটকে গিয়ে পাশের দেয়ালে পড়ল লোকটা—ভয়ানক জোরে মাথাটা ঠুকে গেল দেয়ালের সঙ্গে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিল ইয়াকুব, মড়ার উপর খাড়ার ঘায়ের মত মাসুদ রানার প্রচণ্ড লেফট কাট এসে পড়ল ওর নাকের উপর।
ইয়াকুবের লম্বা দেহটা সটান মাটিতে পড়তেই রানা চোখ মুখের ঘাম মুছে নিল হাতের পিছন দিক দিয়ে, তারপর ইয়াকুবের পকেট থেকে নিজের ওয়ালথারটা বের করে নিল। যেদিকে ওকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেদিকেই এগোল রানা। কয়েক পা যেতেই পিছন থেকে দোতলার উপর যে লোকটা রানাকে প্রথম ধরেছিল, তার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সেই আগের মতই বলে উঠল লোকটা, ‘হ্যাণ্ডস আপ!’
পিস্তল ধরাই ছিল হাতে, এক নিমেষে ঘুরে দাঁড়িয়ে গুলি করল রানা। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল লোকটা, মুখটা খোলাই থাকল, আওয়াজ বেরোল না। দুহাতে নিজের বুকটা চেপে ধরল সে। তারপর ঢলে পড়ে গেল মাটিতে। হাতের রিভলভারটা থেকে একটা গুলি ছুটে বেরিয়ে ছাতে গিয়ে লাগল কিছুটা চুন-সুরকি খসে পড়ল ওর মৃতদেহের উপর পুষ্পবৃষ্টির মত।
এবার সামনের দিকে ছুটল রানা। যেভাবে হোক বেরোতে হবে এখান থেকে। পিস্তল আর রিভলভারের আওয়াজ এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়ির আর সবার কানে গেছে।
বারান্দাটা কিছুদূর সোজা গিয়ে আবার বাম দিকে মোড় নিয়েছে। আরও খানিকটা গিয়ে দেখা গেল সামনে দেয়াল, আর পথ নেই। কায়দা জানাই ছিল, যে কটা বোতাম পেল হাতের কাছে সব এক এক করে টিপতে আরম্ভ করল। হঠাৎ দেয়ালটা ফাঁক হয়ে গেল ‘ওপেন সিসেমে’র মত। একটা বড় হলঘর। ঘরে ঢুকেই রানা বুঝতে পারল এই ঘরেই সুলতা বসে ছিল কিছুক্ষণ আগে। টেবিলের উপর থেকে ডিনামাইটগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। হঠাৎ ঘরের একপাশ থেকে কেউ কথা বলে উঠল, ‘মাসুদ রানা, যেখানে আছ সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়। এক পা নড়লেই মারা পড়বে।’
থমকে দাঁড়িয়েছিল রানা, কিন্তু পরমুহূর্তে বুঝল ওটা লাউড স্পীকারের ধোঁকাবাজি। এক সেকেণ্ডে বাড়িটার নক্সা চিন্তা করে নিল ও। ডান দিকে যেতে হবে ওর এখন। ঘরের ডানধারে দেয়ালের গায়ে একটা পর্দা সরিয়ে দেখা গেল ওটা বাথরুম। আরেকটা দরজা দিয়ে পাশের ঘরে চলে এল রানা। যেন গোলক ধাঁধা। এর থেকে বেরোবার পথ কোনদিকে? আবার খুঁজতে খুঁজতে মস্ত আলমারির পিছনে একটা বোতাম পাওয়া গেল। সামনের দেয়ালটা ফাঁক হতেই অবাক হয়ে দেখল রানা ফাঁকা মাঠ দেখা যাচ্ছে সামনে। একটা সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নামলেই বাড়িটার পিছন দিকের প্রাঙ্গণ।
লাফিয়ে নেমে গেল রানা মাঠের মধ্যে। তারপর এক ছুটে চাকরদের ব্যারাকের বারান্দায় গিয়ে উঠল।
ঠিক সেই সময়ে রানার সমস্ত আশা ভরসা এক ফুয়ে নিভিয়ে দিয়ে দপ করে জ্বলে উঠল গোটা চারেক ফ্লাড লাইট। সারা মাঠ দিনের মত পরিষ্কার হয়ে গেল। দ্রুত তিনটে গুলি করে রানা তিনটে ফ্লাড-লাইট নিভিয়ে দিল, কিন্তু পঞ্চাশ গজ দূরে গুদাম ঘরের মাথায় যেটা জ্বলছে সেটাতে গুলি লাগল না।
এমন সময় ভয়ঙ্কর আওয়াজ তুলে কয়েকটা রাইফেল গর্জে উঠল এক সঙ্গে। রানার আশপাশে গুলিগুলো এসে বিঁধল, কোনওটা দরজায়, কোনওটা দেয়ালে। এক লাফে সরে গিয়ে দেয়ালের আড়াল থেকে দেখল রানা ছয়-সাতজন লোক রাইফেল নিয়ে এগোচ্ছে ওর দিকে। একজনের হাতে আবার একটা স্টার্লিং সাব মেশিনগান। এই প্রথম রানার আফসোস হলো এক্সট্রা ম্যাগজিন সঙ্গে না রাখার জন্য। পিস্তলে আর মাত্র তিনটে গুলি অবশিষ্ট আছে। এতগুলো লোককে ও ঠেকাবে কী করে? শিরশির করে মেরুদণ্ড বেয়ে একটা ভয়ের শিহরণ উপরে উঠে এসে ওর মাথার পিছনে ঘাড়ের চুলগুলোকে খাড়া করে দিল।
কাছেই একটা লাউড স্পীকারে কে যেন বলল, ‘হাত তুলে দাঁড়াও, মাসুদ রানা, নইলে কুকুরের মত গুলি খেয়ে মরবে।’
এবার পাগলের মত ছুটল রানা গুদাম ঘরের দিকে। আরও এক ঝাঁক গুলি বেরিয়ে গেল কানের পাশ দিয়ে। একটা পিচের ড্রামের আড়ালে বসে দুটো গুলি করল রানা। একজন রাইফেলধারী চিৎকার করে চিৎ হয়ে পড়ল। বাকি সবাই শুয়ে পড়ল মাটিতে। আবার দৌড়াল রানা। মাত্র একটা গুলি অবশিষ্ট আছে চেম্বারে। শোল্ডার হোলস্টারের মধ্যে রেখে দিল রানা পিস্তলটা। তারপর এক লাফে মার্সিডিস লরির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল।
লরিটায় স্টার্ট দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামনের উইণ্ড-শীল্ডে কয়েকটা গুলি এসে বিঁধল। ভাঙা কাঁচের টুকরো ছিটকে এসে বিঁধল রানার চোখে-মুখে।
মাথা নিচু করে লোকগুলোর দিকে জোরে লরি চালিয়ে দিল রানা। গোলাগুলি বন্ধ করে যে যেদিকে পারল ছিটকে পড়ে জান বাঁচাল। এবার সোজা গেটের দিকে চলল লরি। আবার আরম্ভ হলো পিছন থেকে গুলিবর্ষণ। গেটের কাছাকাছি আসতেই পিছন দিকে একটা হ্যাণ্ড গ্রেনেড ফাটল বলে মনে হলো ওর। কিন্তু এখন আর ফিরে চাইবার অবসর নেই। সাত টনী মস্ত লরি হুড়মুড় করে গিয়ে পড়ল গেটের উপর। স্টিলের গেট দেয়াল থেকে খসে শুয়ে পড়ল মাটিতে। মৃদু হেসে বড় রাস্তায় চলে এল রানা লরি নিয়ে।
লরিটা সেখানেই রেখে রাস্তায় নেমে বাড়িটার দিকে চাইল একবার রানা। দোতলার বারান্দায় উজ্জ্বল আলোয় দেখা গেল কবীর চৌধুরীর প্রকাণ্ড দেহটা।
স্থির অচঞ্চল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে রানার দিকে।
হাত নেড়ে টাটা করল রানা।